গত-বছর প্রেক্ষাগৃহে 'কান্তারা' দেখবার সৌভাগ্য হয়। নিপাট কন্নড় ছবি, তায় আবার অ্যাকশন-ধর্মী। পশ্চিমবঙ্গে আহামরী ব্যবসা করেনি, বলাই বাহুল্য। প্রায় ফাঁকা অন্ধকার থিয়েটারে, ছবিটি দেখতে বসে, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সেবারে। নেপথ্যে, ছবির দোষ-ত্রুটির অন্তরালে প্রোথিত ফোক-হররের সুদক্ষ বীজ।
আশ্চর্য লাগে। ওরা পারলো, আমরা পারলাম না কেনো? দুই-পারে দুটো জলজ্যান্ত বাংলা। ইতিহাস ও সংস্কৃতি উপচে পড়ছে কানায় কানায়। তবুও বাঙালির বিস্মৃতপ্রায় লোকাচার, আঞ্চলিক বিশ্বাস ও ধর্মীয় আচার-আচরন স্থান পায় না ভালো কোনো কাজে? কলকাতা-কেন্দ্রিক না হলে, বুঝি গল্প শোনানো মানা?
বই নিয়ে কথা বলতে বসে, সিনেমা নিয়ে পড়েছি বলে মাফ করবেন। তবে ব্যাপারটা ভাবায়। নিজভূমির লোক-সংস্কৃতি নিয়ে তুমুল আগ্রহী হলেও, এই বিষয়ে ছবি তো দুরস্ত, পর্যাপ্ত বইটুকুও খুজে পাইনা। লেইম্যানদের সহজ ভাষায় তো আরওই নয়। তমোঘ্ন নস্কর এই ডোমেনে কাজ করছেন, এটা বাঁচোয়া। বিগত কয়েক বছরে, ওনার মতন অনেক নবীন লেখকেরা উদ্যোগ নিয়ে হরর আর লোকাচারের মেলবন্ধন ঘটাচ্ছেন। তাই কোথাও গিয়ে, বাংলা ভাষার পাঠক হিসেবে, আশাবাদী হওয়া সাজে।
আমার অবশ্য এত অবধি লেখকের অন্য কোনো বই পড়া হয়নি। খোলা মনে, অনেক আশা নিয়ে, 'দেও' দিয়ে হাতেখড়ি। ভালো লাগে, কারণ বইজুড়ে নিষ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। সেই নিরিখে, লেখক-প্রকাশক-সম্পাদক সকলেরই কম বেশি ফুল মার্কস প্রাপ্য। ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের অলংকরণ নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। অমন সুন্দর ছবিগুলো ছাড়া বইটি পূর্ণতা পেত না। ভালো লাগে, বৈঠকী চালে ভয়ের গপ্পো শোনানোর আদিম অকৃত্তিম রেওয়াজটির অবতারণা। দাদাঠাকুর শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বানের মুখে গল্প শোনা, তাই উস্কে দেয় ছেলেবেলার টুকরো স্মৃতি।
তবে, সবটাই যে কার্যকরী, এমনটা নয়। কিছুটা হলেও, যা আমার পাঠক সত্ত্বাকে বিক্ষণ্ডিত করছে। বইতে তেইশখানি ছোট গল্প পাবেন। যার প্রতিটিতেই কোনো না কোনো দেব, দেবী বা অপদেবতার আগমন ঘটছে। তারা কখনো বা ক্রুর। কখনো রুষ্ট ও ভয়ংকর! আবার কখনো নেহাতই নির্মল, কল্যাণময় ও ভরসা-জাগানিয়া। এহেন গল্পগুলোর উপভোগ্যতায় কাঁটাতার হয়ে দাঁড়ায় দুটো জিনিস। এক, লেখকের আলগা, বাধনহীন লেখনী। দুই, গল্পের পরিধি ও বিন্যাস।
বইতে তেইশের বদলে তেরোটি গল্প থাকলে অনেক বেশি খুশি হতাম। কোয়ালিটি ওভার কোয়ান্টিটি এনিডে। মূল চরিত্র একই থাকলেও, 'সেই রাত' নামক গল্পটি নেহাতই নিরীহ একখানি ভয়ের গল্প, যা কোনো ফোক-হরর সংকলনে বেশ বেমানান। ব্যাপারটা দুঃখের, কারণ বইজুড়ে দারুণ সব মৌলিক কনসেপ্ট। এবং তাদের অনেকগুলোকেই মাত্র চার-পাঁচ পৃষ্ঠার ছোট-ছোট গল্পে আটকে থাকতে হয়েছে। পটভূমির পর্যাপ্ত বুননের অভাবে, আলাদা করে কোনো গল্পই সেভাবে মনে দাগ কাটে না। সাথে নড়বড়ে গদ্য। হালকা পরিপক্কতার অভাব। যা প্রথম কটা গল্পে ভীষণ ভাবে বিদ্যমান। শেষ খাতে, কিছুটা হলেও উন্নতি পায়।
এছাড়াও, এতগুলো গল্প একত্রে পরিবেশিত হওয়ার দরুন একঘেয়েমি সেট ইন করে দ্রুত। আমার মতন এক-দুদিনে গোটাটা পড়তে বসলে, যা সচরাচর কাটানো মুশকিল। শ্রীশচন্দ্র ডাক্তার। সেই নিরিখেই নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ান। অসুখ-বিসুখ-মহামারীর পেছনে দৌড়ঝাঁপ হেতু, দৈবের অলৌকিক যোগ পান মাঝেমধ্যেই। ছকে বাঁধা সবটাই। তবুও, ব্যাপারটা একটু বেশিই কাকতালীয় বলে মনে হয়। এছাড়াও, সিংহভাগ গল্পেই নিয়মমাফিক কোনো গুনিন বা তান্ত্রিক জাতীয় চরিত্রের আগমন ঘটা এবং রহস্যের দ্রুত সমাধান। দাদাঠাকুর যেন সেখানে কেবলই দ্রষ্টা। উপলক্ষ্য মাত্র।
কোথাও গিয়ে তাই, চরিত্র হিসেবে শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বানের দারুণ কোনো বিশেষত্ব বা রিটার্ন ভ্যালু পেলাম না। তিনি গপ্পের কানেক্টিভ টিস্যু হলেও, ঠিক অপরিহার্য নন। তবুও আশা করি, পরবর্তী বইতে ওনাকে আরো বর্ধিত রূপে পাবো। গতে ধরা সংলাপ ও অবিনস্ত্য গল্পকথনের অনেক বাইরে। ভয় ও ভক্তির ত্রিমাত্রিক প্রকোপে স্পটলাইটখানি কেবল, বাংলা ও বাঙালির লোকায়ত বিশ্বাসকে আলোকিত করে থাকবে, এই আশা রইল। আর হ্যাঁ, কেবল ওই স্থানীয় ইতিহাসের খোলসে পুঁথিগত ইনফোডাম্পিংটুকুর প্রতি যৎসামান্য রাশ টেনে ধরলেই...
যাক গে। যাই হোক। নিটপিকিং করে লাভ নেই। সবটাই আপেক্ষিক। দোষ-গুণ পেরিয়ে, লেখকের প্রচেষ্টাকে শ্রদ্ধা জানাই। এমন সব খাঁটি উদ্যোগ আরো আসুক। কিনে পড়বার দায়িত্ত্ব আমার।
তমোঘ্ন নস্কর এই সময়ের সবচেয়ে ভালো গল্প-বলিয়েদের একজন। সেই মানুষটি যখন নিজের পরিবারের নানা লোককথা এবং আঞ্চলিক বিশ্বাস নিয়ে ভয়ের গল্প লেখেন, তখন তার স্বাদ একেবারে অন্য রকম হয়। আর সে-গল্প যদি হয় ভয়ের পাশাপাশি ভক্তিরও, তাহলে কেমন হয়? তখন আমরা পাই 'দেও'। অলংকরণে সমৃদ্ধ এবং নয়নসুখকর লে-আউটে শোভিত এই বইটিতে 'ভূমিকা' ইত্যাদির পর মোট তেইশটি গল্প স্থান পেয়েছে। তারা হল~ ১. অমৃত ২. সোনাকালী ৩. বাংসক ৪. অসুখ ৫. এলোকেশী ৬. খুদবুড়ো ৭. ঘণ্টাকর্ণ দেব ৮. ঘাঘরসিনি ৯. জিয়াংসি ১০. ধনকুঁদরা ১১. নারায়ণী ১২. পাঁচুঠাকুর ১৩. প্রাপ্তি ১৪. বড়ামচণ্ডী ১৫. বাবা বসন্ত রায় ১৬. ভিটে ১৭. ভৈরব ১৮. মাকাল ঠাকুর ১৯. লিওক ২০. শ্বেত মৃত্যু ২১. সন্তান ২২. সেই রাত ২৩. দেও লেখক এদের লৌকিক দেব-দেবী'র অলৌকিক কথা বললেও আমার নিজের মনে হয়েছে, এরা আসলে মানুষের কথাই বলেছে। সেই কথায় যতটা আছে অন্ধকার, ততটাই আছে আলো। যতটা আছে খারাপ, ততটাই আছে ভালো। তবে সেই-সব আখ্যানে নীতি নিয়ে হামবড়াই নেই। আছে স্রেফ নিটোল গল্প-বলা। আর একটা জিনিস এই গল্পগুলোতে এসেছে। প্রকৃতি এবং মা— তাঁদের আমরা দেবী হিসেবে ঘোষণা করি বা না-করি— এই বইয়ে মস্ত বড়ো জায়গা নিয়েছে। মায়ের কাছে যেমন আমরা ভয়, ভালোবাসা আর আকুলতা নিয়ে আসি, তেমনই নানা অনুভূতির মিশেল তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে এই গল্পগুলো। এখানেই লেখার সার্থকতা। এখানেই লেখকের সার্থকতা। এই বই বাংলা সাহিত্যে কতটা আলোচিত হবে, তা জানি না। তবে বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত শহরের আলো আর কোলাহল থেকে দূরের গ্রামীণ বা আরণ্যক সমাজ নিয়ে আজও যে সাহিত্য ভাবে, তাতে এটির এক অত্যন্ত বিশিষ্ট স্থান থাকা উচিত। সুযোগ পেলে অতি অবশ্যই পড়ুন।
গ্রামীণ অলৌকিকতায় ডুবে এক হৃদয়ছোঁয়া ভ্রমণ : “দেও” পাঠ প্রতিক্রিয়া
তমোঘ্ন নস্করের “দেও” নিছক একটি বই নয়—এ এক টাইম মেশিন। আপনি যদি আজন্ম শহুরে হন, দিনের সিংহভাগ কাটে হাই-রাইজের কাচে ঘেরা ঘরে আর কানে হেডফোনে লুপ বাজে লো-ফাই প্লেলিস্ট, তাহলে “দেও” খুললেই মনে হবে আপনি হঠাৎ কোনও এক অলৌকিক রাতে গ্রামবাংলার মাঝমধ্যিখানে চলে এসেছেন। এখানে নেই অ্যাপের নোটিফিকেশন, নেই রোডরেজ—শুধু মাটির গন্ধ, তালপাতার পাখা, আর টিমটিমে প্রদীপের আলোয় কেউ গল্প শোনাচ্ছেন—ভয়ের, ভক্তির, ভালবাসার, আর বিশ্বাসের।
এই গল্পগুলো যেন আপনার দাদু বা দিদার মুখে বলা আখ্যান। সেই যখন রাতে লোডশেডিং হতো, আর খাটে পিঁপড়ের তেল দেওয়া হতো। সেইসব ভৌতিক গল্পের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেও “দেও” নিজেকে দাঁড় করায় এক অন্য উচ্চতায়। কারণ এই বই শুধু ভয় দেখায় না—বিশ্বা�� করতে শেখায়। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচলিত লোকদেবতা ও অপদেবতাদের ঘিরে গড়ে ওঠা এই গল্পগুলো যেন আমাদের লোকবিশ্বাসের হারিয়ে যাওয়া গুপ্তধনের ম্যাপ ফেরত দেয়।
তুলনা করতে গেলে মনে পড়ে যায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের “জলসাঘর”—যেখানে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি ও সমাজচিত্র একে অপরকে এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে গল্প হয়ে ওঠে ইতিহাসের ছায়া। তমোঘ্ন নস্করের “দেও”-তেও তেমনই—এখানে প্রতিটি অলৌকিক চরিত্র শুধু ভয় জাগায় না, তারা হয়ে ওঠে সমাজের গভীরে চেপে থাকা অচেতন সত্তাগুলোর প্রতীক।
অনেকে হয়তো ভাববেন, এর সঙ্গে “ঠাকুমার ঝুলি”-র কোনো মিল আছে কি না। আছে, তবে সেটি রূপকথার স্বপ্নঘন রঙে নয়—এখানে যা রয়েছে, তা হল লোকবিশ্বাসের কাঁচা, ধুলো-মাটির গন্ধমাখা বাস্তবতা। এই ভূতেরা রাজপুত্র খায় না, ডাইনিদের সঙ্গে নাচেও না—তারা হাঁটে ধানখেতের আল দিয়ে, বসে গৃহদ্বারের ধারে, আর থেকে থেকে চুপিচুপি বলে ওঠে—“আমিও ছিলাম, আমাকেও দেখো।”
ঠিক যেমন বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে ভূতের চেয়েও বেশি ভয় জাগায় অনাহার, অনভিপ্রেত মৃত্যু আর সামাজিক বর্জন, তেমনি তমোঘ্নর ভূতেরা সেই সব চেনা ভয়কে এক ভিন্ন মুখোশে হাজির করে। তারা চমকে দেয় না—তারা মনে করিয়ে দেয়। তমোঘ্নর ভূতের গল্প মানে শিউরে ওঠা নয়, বরং থমকে যাওয়া—একটা ব্যঞ্জনাবহ নৈঃশব্দ্য, যেটা থেকে যায় গল্প পড়ে শেষ করার পরেও।
এই কারণে তাঁর ভূতেরাও হয়ত কিছুটা অভিমানী, কিছুটা অভিমানহীন—কারণ তারা জানে, মানুষ ভয় পায় ভুলে যেতে, এবং তমোঘ্ন সেই ভুলে-যাওয়া ভয়কে পুনরুদ্ধার করেন, যেন এক নিঃশব্দ প্রত্নতাত্ত্বিক, যিনি মাটির তলায় পুঁতে-থাকা একটা প্রাচীন আর্তিকে তুলে আনেন—আধুনিক পাঠকের বুকের ঠিক মাঝখানে রাখার জন্য।
“দেও”-র প্রেক্ষাপট শুনলেই হয়তো মনে হবে এটি হরর ফিকশন, কিন্তু আদতে এটির সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে মহাশ্বেতা দেবীর লেখা সমাজ-সংলগ্ন গল্পগুলোর সঙ্গে। পার্থক্য এই যে, মহাশ্বেতা যেখানে বাস্তবের রক্তমাখা মাটি থেকে লিখতেন, তমোঘ্ন তাতে যোগ করেন মিথ ও মায়ার স্তর। ফলে তাঁর লেখা হয়ে ওঠে surreal, কিন্তু তাতে বাস্তবের শ্বাসপথ অবরুদ্ধ হয় না।
তুলনা করা চলে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের “অলৌকিক কাহিনি” সিরিজের সঙ্গেও। তবে হেমেনবাবুর লেখায় যেখানে অ্যাডভেঞ্চার এবং ডিটেকটিভ ঘরানার সঙ্গে অলৌকিকের ফিউশন থাকে, “দেও” সেখানে মন দিয়ে বলে চলে মানুষের ভয়—অভাব, একাকীত্ব, বিস্মৃতি—এইসবের কাহিনি।
আর এক জায়গায় “দেও”-র অবস্থান একেবারে অনন্য: যেখানে শারদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক গল্পে থাকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ, সেখানে তমোঘ্ন লোককথার বুনটে টেনে আনেন জাতি, লিঙ্গ, বঞ্চনার ন্যারেটিভগুলো—এ এক সচেতন, রাজনৈতিক পাঠ, যা অলৌকিকতার পিছনে সত্যিকারের মানুষদের গল্প বলে।
ভৌতিক ছায়া আর বিশ্বাসের আলোয় “দেও” হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের সেই বিরল কাজগুলির একটি, যা বিভূতিভূষণের “মৌরিফুল” গল্পের মতো প্রাকৃতিক, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের “অন্ধকারের হাতছানি”-র মতো মরমি, আবার সত্যজিৎ রায়ের অলৌকিক গল্পের মতো সুনিপুণ ছাঁদে নির্মিত।
তমোঘ্ন কোনও জনপদের ইতিহাস লিখছেন না—তিনি আমাদের মনের ভিতরকার গ্রামগুলোর ম্যাপ আঁকছেন। আর সেই মানচিত্রে আপনি যদি খুঁজে পান এক বৃদ্ধা, যিনি প্রতিদিন নদীতে জলভাত দিয়ে আসেন এক “মরণ-ভূত”-এর উদ্দেশে—তাহলে জানবেন, আপনি “দেও”-র জাদু-দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছেন। এটি নিছক অলৌকিক গল্পের গাথা নয়, এটি হল মানুষ ও মিথের সংলাপ।
এই চোখধাঁধানো, শিল্পরুচিসম্পন্ন অলংকরণ ও আকর্ষক লে-আউটের বইটিতে ‘ভূমিকা’-সহ মোট তেইশটি গল্প স্থান পেয়েছে। প্রতিটি গল্প যেন একেকটা গোপন দরজা—যা একবার খুললেই পাঠক প্রবেশ করেন লোকবিশ্বাস, সংস্কার, আতঙ্ক আর বিস্মৃত অতীতের ঘন জগতের ভেতরে। সংকলিত গল্পগুলি হলো—
এই বইয়ের আসল শক্তি লুকিয়ে আছে তার প্রতিটি স্তরে—একদিকে রয়েছে সাহিত্যিক সৌন্দর্য, আর অন্যদিকে লোকসংস্কৃতির এক নিবিড় দলিল। পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে মনে পড়ে তলস্তয়ের সেই অমোঘ কথা: “Write about your village, and you write about the world।” তমোঘ্ন ঠিক সেটাই করেছেন। “দেও”-তে তিনি লিখেছেন বিষ্ণুপুর, ঝাড়গ্রাম, নলহাটি, বারুইপুরের গল্প, অথচ সেই আঞ্চলিকতার ভেতর দিয়েই আমরা দেখতে পেয়েছি কুমায়ুনের ‘ভানাম’, কেরালার ‘তেইয়্যম’, মহারাষ্ট্রের ‘চৌধরী দেবতা’র ছায়া।
লোকবিশ্বাসের গল্পগুলো যখন পাকা হাতে লেখা হয়, তখন সেগুলো আর কেবল ‘ব্যক্তিগত’ থাকে না—তারা হয়ে ওঠে আমাদের সকলের। “দেও” সেই মাটি-ধোয়া সারল্য নিয়ে দাঁড়ায় পাঠকের সামনে। তার আকাশটা বিস্তৃত—যেখানে ভারতের প্রতিটি কোণার অদেখা দেবতা আর ভূতেরা একে অপরের মুখপাত্র হয়ে ওঠে।
এই কারণে “দেও” শুধু বাংলা ভাষার বই নয়, এটি ভারতীয় লোকবিশ্বাসের বৃহত্তর সংলাপেও অংশ নেয়। ঠিক যেমন ওমর লুল্লার “Hymns to the Unknown Gods” বা R. B. Bhattacharya-র “Folk Religion and Its Modern Face” লোকবিশ্বাসকে ব্যাখ্যা করেছে গবেষণাধর্মী রূপে, তমোঘ্ন সেটি করেন গল্প বলার নিজস্ব ঢঙে—সহজ, সাহসী, এবং হৃদয়গ্রাহী।
শেষ কথা, যদি আপনি ভাবেন ভৌতিক মানেই ‘পেত্নী-স্কন্ধকাটা-শাঁকচুন্নি' তাহলে “দেও” আপনার পাঠে এক নতুন দিগন্তের জানালা খুলবে। এখানে ভূতেরা কোলাহল করে না, তারা নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ায়। কখনও অভিমান করে, কখনও আদর করে। আর মাঝে মাঝে, একেবারে চুপিচুপি—তাদের গল্প বলে যায়।
এটা ভয়? নাকি গভীর এক চেনা বিষাদ, যেটা কেবল গ্রামের পুকুরঘাটেই বোঝা যায়?
“দেও” সেই প্রশ্নই তোলে—কিন্তু উত্তর দেয় না। উত্তর খুঁজে নিতে হবে আপনাকে, একেকটা রাত পেরিয়ে, একেকটা অলৌকিক গল্পের আলো-আঁধারিতে।
এই বিশ্বাস, যেটা শহরের ভাষায় অনেক সময় কুসংস্কার হয়ে ওঠে, গ্রামীণ মানুষদের কাছে তা সংস্কার। লেখক ঠিক সেখানেই হাত দিয়েছেন। সেই বিশ্বাস, যা একজন মা নিজের সন্তানের সুস্থতা চায় বলেই করে, অথবা এক বৃদ্ধা, যিনি ব্রতের নিয়ম না মানলে ভয় পান— কুসংস্কারের অন্ধত্ব থেকে নয়, বরং নির্ভরতা থেকে।
তেইশটি গল্পের প্রত্যেকটিই আবর্তিত হয়েছে কোনও না কোনও গ্রামীণ দেবতা বা অপদেবতাকে ঘিরে। যাঁরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বাইরে, কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই মানুষের “ঘরের ঠাকুর”—লিওক, বাংসক, খুদবুড়ো, বাবা বসন্ত রায়, নারায়ণী, ধনকুঁদরা—নামগুলোও যেন একেকটা ঘুরে আসা জায়গা।
গল্পকথক শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান, এক সরকারি ডাক্তার। তাঁর সহজিয়া ভাষায় বলা গল্পগুলো এককথায় অনবদ্য। না, শুধু ভাষার জন্য নয়, বর্ণনার ধাঁচের জন্যও—খালপাড়ের হিজল গাছে যে দেবতার বাস, সে যখন বলে, “পাতা মোর শয্যা, পাঁচে বিন্যাস”—সেই মুহূর্তে দেবতা দূরের কোনও অস্তিত্ব নয়, বরং পাশের পুকুরপাড়ের বুড়ো গাছ হয়ে ওঠেন।
প্রতিটি গল্পে যেমন ভয় রয়েছে, তেমনই রয়েছে মমতা। যেমন “প্রাপ্তি” বা “লিওক”-এ অপদেবতা হয়ে ওঠার পেছনে আছে এক দীর্ঘ সামাজিক বঞ্চনার ইতিহাস। এই দিকটা বইটিকে শুধু “ভৌতিক কাহিনি” রাখেনি, দিয়েছে সমাজমনস্তত্ত্বেরও ছোঁয়া।
ভাষা আশ্চর্য সহজ. অথচ সাহিত্যিকতা হারায়নি। বরং অলৌকিকতা আর বাস্তবের মধ্যে যে সূক্ষ্ম দোলাচল, তা তমোঘ্নর কলম খুব নিপুণভাবে সামলে নেয়। একদিকে যেমন “ছপাৎ ছপাৎ শব্দ ক্রমশ ঘাপুস-ঘুপুসে বদলে গেল” এরকম উপমা এসেছে, যেটা কেবল জলভেজা পথের হাঁটার সঙ্গে পরিচিত পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে যাবে, তেমনি এসেছে একাধিক আঞ্চলিক শব্দ, যেগুলোতে পাঠক আরও ডুবে যেতে পারেন, যদি পাশে থাকত ছোট্ট একটি গ্লসারি।
তবে সমস্যা কিছু আছে, অবশ্যই। কিছু কিছু গল্প যেন প্রায় একই ফর্ম্যাটে এগিয়েছে—একটা গল্প শেষ করে মনে হয়, আরেকটাও হয়তো একই ছন্দে চলবে। সব গল্পেই ন্যায়বান বাবু গল্প বলছেন, আর অলৌকিক কোনো ঘটনা ঘটছে। বৈচিত্রের দিক থেকে তাই কিছুটা পুনরাবৃত্তি হয়। “সেই রাত” নামের একটি গল্প পুরো বইয়ের মুড থেকে আলাদা, যেন নেটফ্লি��্স সিরিজের ট্রিটমেন্ট পেয়েছে।
আরও একটা অনুরোধ—“জিয়াংসি” গল্পটি যেন লেখক উপন্যাস করে ফের লেখেন। এর মধ্যে সেই গা ছমছমে থ্রিলার-ফ্লেভার আছে, যা গল্প নয়, গোটা একটি বই দাবি করে।
তবে এসব ক্ষুদ্র ত্রুটি বইটির মহিমাকে একচুলও ক্ষুণ্ণ করতে পারে না। কারণ বইয়ের শক্তি তিন জায়গায়—
১. ঐতিহাসিক গবেষণায় ভর করে থাকা অথচ পড়তে অসাধারণ রসময়
২. হারাতে বসা গ্রামীণ দেবদেবী ও সংস্কৃতির এক অনুপম দলিল
৩. একটি আদ্যন্ত “বাংলা” পাঠ-অভিজ্ঞতা—কখনও মুড়ি তেলেভাজা সহযোগে, কখনও বাদাবনের ঘ্রাণ মিশে
ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের অলংকরণ নিখুঁত, যদিও প্রচ্ছদ আরও মনকাড়া হতে পারত। মুদ্রণমান ভালো, তবুও কিছু জায়গায় হালকা আবছা প্রিন্ট হয়েছে বলে পাঠকের চোখে পড়তে পারে। পৃষ্ঠার নিচে যদি আঞ্চলিক শব্দের ব্যাখ্যা থাকত, অনেক পাঠকের সুবিধে হতো—বিশেষ করে যাঁরা গ্রামীণ বাংলা থেকে দূরে।
“দেও”–কে আমি দেখি এক নিঃশব্দ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মতো। এ এক হারিয়ে যাওয়া লোকবিশ্বাস ও লোকাচারের পুনরুদ্ধার—একটা সময়ের, একটা জায়গার, একটা বিশ্বাসের। যেখানে অপদেবতা মানেই শয়তান নয়, বরং সমাজচ্যুত, ভুলে যাওয়া, কখনও ক্ষমাপ্রার্থী এক অস্তিত্ব।
এই বই একাধারে সাহিত্য, গবেষণা, লোকসংস্কৃতি এবং স্মৃতিচারণার সংমিশ্রণ। তার থেকেও বড়ো কথা, এটি আমাদের সেই সরল, সহৃদয়, গন্ধমাখা সময়ের সঙ্গে পুনঃপরিচয়। সেই সময়, যখন গল্প বলার মানেই ছিল এক গা ছমছমে অথচ আন্তরিক রাত।
তাই বলা যায়—“দেও” একান্তভাবেই প্রাপ্তি।
পাঠক যদি তাঁর বুকশেলফে কোনও গ্রামীণ দেবতার বসবাস করাতে চান, জায়গা খালি রাখুন। আজকেই সগ্রহ করুন —“দেও”।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো বইয়ের সমালোচনা করার মতো পান্ডিত্য আমার নেই, কেবলমাত্র কিছু অনুভুতি, ভালো/খারাপ লাগা বলতে পারি মাত্র তাই অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করবেন না। প্রথমেই আসি বইয়ের বিষয়ে, অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ২৩ টি "লৌকিক" দেবতা বা অপদেবতাদের নিয়ে লেখা এই বই। ব্যাপারটা বলাটা যতটা সহজ বিষয়টা ততটাই গভীর, আসলে এইসব লৌকিক দেব- দেবীদের বিভিন্ন ভাবে দেখা যেতে পারে, কোথাও কোথাও এরা প্রচলিত ধর্মের কোন দেবতারই সহজ রূপ(রনকিনি/রঙ্গিনী,কালি মায়ের রূপ) কোথাও আবার এরাই কোন প্রচলিত ধর্মের দেবতা রূপে ধীরে ধীরে স্থান পেয়েছে(অনার্য পশুপতি যা পরবর্তীতে বৈদিক যুগে শিবের রূপে সনাতন হিন্দু ধর্মে পূজিত হন), কোথাও বা দুই বা ততোধিক ধর্মের মিলিত আচারে ও বিশ্বাসে এদের পুজো হয়(যেমন ধর্মঠাকুর/ধর্মরাজ,হিন্দু ও বৌদ্ধ), অর্থাৎ এদের লীলা বা মাহাত্ম্যের শেষ নেই! সেরকমই ২৩টা গল্প স্থান পেয়েছে এই বইতে, যদিও অধিকাংশ দেবতা/অপদেবতাই এই বাংলার বিশেষ করে সুন্দরবন অঞ্চলের ফলে তাদের জড়িয়ে বেড়ে ওঠা গল্পগুলি একটু একই রকম মনে হলেও হতে পারে তবে পড়তে গিয়ে একঘেয়ে লাগবে না কখনই, বিশেষ করে লেখক কখনোই এই বইকে নন-ফিকশন গবেষণা ভিত্তিক প্রবন্ধের ঢং এ বলেনই নি বরং নিজের তৈরি একখান চরিত্র শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান বলে এক "গল্প-দাদুর" অবতারণা করেছেন, ফলে গল্পের ছলে এই লোকগাথা গুলি "শুনতে শুনতে" হাই ওঠে না, বা বইটা ভাঁজ করে মোবাইল খুটাতেও ইচ্ছে করে না। গল্পের লেখনী একদম সহজ সরল, পাঠক আটকাবেন না কোথাওই বরং কখন যে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টে শেষ করে ফেলবেন বুঝতেই পারবে না। কিছু গল্প ভয় ধরায়, কিছু গল্প সাহস জাগায়, এবং কিছু গল্প বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাঝের পর্দাটাকে উঠিয়ে দেয়, প্রতিটা গল্প যাকে বলে "এক শে বাড়কার এক" আর স্বয়ং ঋজু গাঙ্গুলি যেখানে বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন(এই অংশটিও মন দিয়ে পড়ার অনুরোধ রইল) সেক্ষেত্রে আমার মতো মূর্খের মন্তব্য করাটা "শিশুসুলভ বাতুলতা" মাত্র। এই বই আসলে একটা ইতিহাস, না জানা, না শোনা ইতিহাস। আজকালকার ইন্টারনেটের যুগে এক ক্লিকেই শুধু দেশি কেন বিদেশি লোকগাথাও চোখের সামনে ভেসে আসে, ভেসে আসে একের পর এক কিংবদন্তি, কিন্তু তাতে কি সেই গল্প দাদু বা ঠাম্মার গায়ের গন্ধটা থাকে? থাকে না একদমই! তবে আমরা যারা ছোটবেলায় সেই ওম পেয়েছি তারা জানি শীতকালের দুপুরে বা কারেন্ট চলে যাওয়া সন্ধ্যে বেলায় ঠাম্মার গা ঘেঁষে বসে শোনা "দেশ বাড়ির" গল্পের মজা, সেটা এই বয়সে এসেও খুব মিস করি, তবে এই বই খানিক হলেও সেই আশাটা মেটায়। এবার কিছু অত্যন্ত প্রিয় গল্পে আসি, মন কাড়ে "অমৃত", যদিও পূর্ব প্রকাশিত ও শ্রুতিনাটকও হয়েছে তবুও পড়তে মন চায়, মন টানে "নারায়ণী", "বসন্ত রায়", "ঘাঘরসিনি", "বড়াম চণ্ডী" এবং এই বইয়ের তুরুপের তাস "দেও", কথায় আছে "বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর", সেরকমই ভালো জিনিসে বিশ্বাস থাকলে খারাপ শক্তিকেও অবজ্ঞা করা যায় না, সেইরকম কিছু গল্পও আছে, পাবেন "বাংশক", "সন্তান", "প্রাপ্তি", "ভিটে", "জিয়াংসি" এবং আমার অন্যতম প্রিয় "লিওক", প্রিয় কারণ এই গল্প "আঁর দেশ চিটাগং এর", শুধু এই গল্প নিয়ে আমাদের এশিয়ায় কত যে লোকগাথা ছড়িয়ে আছে তা গুনে শেষ করা যাবে না। বাকি আরো গল্প আছে, এখানে মাত্র কয়েকটার কথা বললাম। এবার একটু তথাকথিত "খারাপ" লাগা গুলি বলি। এক, শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান একজন বিজ্ঞানের ছাত্র ও ডাক্তার, সেই হিসাবে গুনীন, তান্ত্রিকদের কথায় বিশ্বাস বা বিপদ থেকে রক্ষা পেতে তাদের কাছে ছোটাটা মাঝে মাঝে বড় বেশি তাড়াতাড়ি মনে হলো যেন, এই জায়গা গুলিতে একটা শক্তিশালী "দ্বন্দ্ব" রাখা যেত। দুই, গল্প বড় বেশি কথক নির্ভর মনে হয়, গল্প বলার ফাঁকে শ্রোতাদের কোন ভূমিকা নেই, এই জায়গা গুলি "তারপর নিজের এক্সপোর্ট কোয়ালিটির বিড়িতে একটা টান দিয়ে তারিণীখুড়ো আবার বলতে লাগলেন" গোছের বা বরদা গোছের pause থাকলে আরো বেশি নাটুকে লাগতো। তিন, বেশ কিছু গল্পে উনি ডাক্তার, কিছু গল্পে ডাক্তার হিসাবে কম মোটিভেটর এমনকি তদন্তকারী হিসেবেও দেখা গেছে, এটা কেন? চার, "সেই রাত" গল্পে সেভাবে কোন "অপদেবতা" নেই তবে ইতিহাস আছে, এই গল্প খাঁটি ভয়ের গল্প কিন্তু সংকলনের বিষয় হিসাবে তেমন মানানসই কি? তাইলে এবার একটু ভালো দিকে আসি অর্থাৎ "বইটা কি পকেট হালকা করে কিনে রাখার মতো? উত্তর হলো "হ্যা হ্যা এবং হ্যা", কারণ এখনকার দিনে তিন রকম বই কাটছে, এক, "হিং টিং ছট" মানে তন্ত্র মন্ত্র, যেখানে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই লেখক বা লেখিকা নিজে কতটা পড়েছেন, সে নিয়ে সন্দেহ আছে, তথ্যসূত্র পাবেন না অনেক ক্ষেত্রেই। দুই, দুটো বা তিনটে রগরগে শয্যাদৃশ্য যুক্ত ক্রাইম থ্রিলার। তিন, মহান মানুষদের কেচ্ছা নিয়ে লেখা সফট পর্ন, যেগুলিকে এক শ্রেণীর পাঠক তোল্লাই দিয়ে "ক্লাসিক" এর আসনে বসাচ্ছেন ফলে এইরকম বাঁধানো "চটি বই" শয়ে শয়ে কপি বিকোচ্ছে! এর বাইরে বেরিয়ে এসেও যে কাজ হয় সেটার প্রমান দিয়েছেন এই বইয়ের প্রকাশক ও লেখক/সম্পাদক সকলেই, তাঁদের সাহস ও উদ্যোগকে কুর্ণিশ আমার। যেই বিষয়টা নিয়ে মাননীয় স্বপন কুমার ঠাকুরের "কৌলাল" ছাড়া কেউ কাজ করে না, সেই বিষয়কে একটা "গল্প-দাদুর" চরিত্র দিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে এদেরকে ধন্যবাদ। আর বিশেষ করে যারা একটু পড়াশোনা করে লিখতে চান তাঁদের কাছে এই বই প্লটের খনি, চাই শুধু একটা পাকা হাত আর নিজের একটু কল্পনা, ব্যাস। তবে দেরি না করে কিনে ফেলুন, বা কিনেছে এমন কারোর থেকে নিয়ে পড়ে ফেলুন, কমকরে একবার পড়ুন বইটা, নিজের কথা বলতে পারি এই বইটার জন্যে প্রকাশক আর লেখক কে খুব জ্বলিয়েছি এবং সেটা সার্থক হয়েছে দেখে ভালো লাগছে। এছাড়া মনে হয় লৌকিক দেবতা নিয়ে আরো কিছু জানতে চাইলে "কৌলাল" এর ব্লগ আর ভিডিও বাদে আরো একখান বই বলতে পারি সেটা হলো গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর "বাংলার লৌকিক দেবতা", এতে হয়তো এই বিষয় নিয���ে কিছুটা উৎসাহ বাড়তে পারে পাঠকের, আসলে এই পোড়া দেশে এসব নিয়ে চর্চা হয়না প্রচলিত মাধ্যমে, হলেও লোকে জানতে পারে না। যাই হোক এই আলোচনাটা দেখে যদি একটা মানুষও এই বইটা পড়েন তো নিজের বেশ ভালো লাগবে। আলোচনার শেষে শ্রীশ চন্দ্র ন্যায়বানের মতোই বলতে ইচ্ছে করে "আমাদের পুথিপড়া বিদ্যা দিয়ে এই বিশ্বাসগুলোকে ঠিক চেনাজানা খোপে ধরানো যায় না রে।" খোলা মনে গল্পগুলি পড়ুন, আলোচনা করুন। আপনার পাঠ শুভ হউক।
কনসেপ্ট হিসাবে বইটা বেশ ভাল। তেইশ খানা ছোট ছোট আখ্যান: সব কয়টা গল্পই বাংলার দেবদেবীদের আর উপদেবতাদের নিয়ে। বৈঠকী চালে গল্প এগোয়। অর্থাৎ জটিলতা তেমন নেই। প্রতিটা গল্পের মোড়কে থাকেন শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান, বাচ্চারা যাকে দাদামশাই বলে ডাকে। এই পর্যন্ত ঠিকই আছে।
আসল সমস্যা হল গল্পবলিয়েকে নিয়েই। দাদামশাইয়ের জীবন এত দেবদেবীময় কেন হল, সেটার কোনও ভাল ব্যাখ্যা পেলাম না। উনি পেশায় ডাক্তার, ইংরেজদের সময় থেকে বাংলার নানান জায়গায়, নানান জাতের মানুষের মাঝে কাজ করে আসছেন। কিন্তু এই মেডিকেল জীবনে দেব-দেবীদের এত ভিড় কেন? দাদামশাইয়ের জীবিকা আধ্যাত্মিক ধরণের হলে ব্যাপারটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য হত না? সঠিক উত্তর নেই এই বইয়ে, হয়তো পরের গুলোয় আছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করতে পারি নি।
দাদামশাইয়ের চরিত্রও অনেকটা বিউলির ডালের খিচুড়ির মত। খুব কম্ফোর্টিং, কিন্তু অতিরিক্ত পরিমাণে একঘেয়ে। এই চরিত্রকে নিয়ে প্রতিটা গল্পের ফ্রেমিং ডিভাইস করাটা এই বইয়ের সবথেকে বড় দুর্বল দিক।
এইবার আসি গল্পগুলোর কথায়। বাংলার লৌকিক দেবদেবীরা সাধারণ লোকেদেরই প্রচণ্ড দুঃখর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় প্রতিটা গল্পে। একটা অস্পষ্ট সামাজিক আর অর্থনৈতিক ভেদাভেদের ব্যাপার রয়েছে গল্পগুলোয়। মূলত সামাজিক নিচু স্তরের গরীব লোকেরা বেশি কষ্ট পায়, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিপদের সমাধান আসে উচ্চপদস্থ কোনও মানুষের থেকে। ব্যাপারটা লক্ষণীয় বটে। তবে এইসমস্ত থিম তেমন ভাবে বিশ্লেষিত হয় নি গল্পগুলোয়। বললাম না, বৈঠকি চালের গল্প। কনসেপ্টের ছোঁয়া লাগিয়েই গল্প শেষ হয়ে যায়। এটার জন্যে অনেক সমালোচনা দেখলাম, কিন্তু আমার ব্যাপারটা খারাপ লাগে নি।
গল্পগুলোর মধ্যে সেরা লেগেছে "ধনকুঁদরা"। অসামান্য কনসেপ্ট, আর তেমনই হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি। বেশি কিছু বলতে চাই না গল্পটা নিয়ে, সবাই চমকটা পাক।
(পুঃ এমন বাংলা বইয়ে পেজ নাম্বারগুলো ইংরেজি তে কেন?)
(পুঃ পুঃ ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের অলংকরণ এই বইয়ের আরেকটা ইউ এস পি। সেটা নিয়ে কয়েক প্যারা লেখাই যেত, কিন্তু যাক গে)
বই : দেও লেখক : তমোঘ্ন নস্কর প্রকাশনা : অরণ্যমন মুদ্রিত মূল্য : ২২৫/-
বহুদিন পরে একটা বই পড়তে পারলাম। টালমাটাল পরিস্থিতিতে বই পড়া যখন একেবারেই হয়ে উঠছে না, সেই সময়ে হাতে নিয়ে বসি 'দেও'।
ছোটোবেলায় আমাদের জীবনের অন্তরঙ্গ সঙ্গী ছিলেন আমাদের ঠাকুরদা/ঠাকুমা যাঁদের গল্পের ঝুলি কখনও শূন্য থাকত না। তাঁদের দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে নাতি, নাতনিদের নির্ভেজাল আনন্দ দেওয়া থেকে তাঁরা কোনও বিরতি নেননি।
এই বইটিতেও রয়েছে তেমনই এক সরলমনা ঠাকুরদা, তাঁর নাম শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান, যিনি পেশায় ডাক্তার। পেশাগত কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়া, সেখানকার আঞ্চলিক মানুষ তথা ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে আলাপচারিতায় তাঁর ঝোলায় জড়ো হয়েছে অভিজ্ঞতার পরত। নাতি, নাতনিদের আবদারে বিভিন্ন সময়ে শুনিয়েছেন সে সব হাড়হিম করা অভিজ্ঞতার গল্প। তাঁর গল্প বলার ধরন শিশু থেকে তাঁর পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক সদস্যকেও মোহমুগ্ধ করে রাখে।
বইটিতে রয়েছে ২৩টি গল্প। প্রতিটি গল্পের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে রয়েছে আঞ্চলিক দেবদেবী, অপদেবতার কীর্তি এবং বর্ণনা, এঁদের বিষয়ে হয়তো বর্তমানে আমরা বহু মানুষই আর অবগত নই। গ্রামাঞ্চলে গেলে যদিও কিছু আভাস পাওয়া যায়। গল্পগুলির সারল্য আমার বাবাকেও, যিনি বিগত কয়েক বছরে বই পড়ার ধৈর্য্য হারিয়েছেন, ভীষণ আকর্ষণ করেছে। বাবা পড়ে জেনে অবাক হয়ে গেছেন এই তথ্যগুলি। শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান তাঁর পরিবারের কচিকাঁচাদের সঙ্গে কখন আমাদের অর্থাৎ পাঠকদের ঐ গল্পের পরিবেশে ঘিরে ফেলেছেন তা আমরাও টের পাইনি। প্রতিটি গল্প একে অপরের থেকে স্বাদে আলাদা, কিন্তু লক্ষ্য এক - আমাদের মনে ভালো লাগার ছাপ ফেলে যাওয়া।
সবশেষে লেখক তমোঘ্ন নস্কর-কে তাই জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের শৈশবকে তাজা করে দেওয়ার জন্য। 'দেও' আবার ফিরুক, এটাই চাই। স্কুল খুললে স্কুলের খুদেগুলোর মধ্যে কয়েকজনকে হলেও গিফট করার ইচ্ছা রইল। 😊❤️
সবাই পড়বেন, আশাহত হবেনই না, বরং, বাড়ির ছোটোরাও এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলবে।
পড়া শেষ করলাম 'দেও'। মূলত বাংলার এবং কিছু বাংলার বাইরেরও লৌকিক দেবতাদের নিয়ে লেখা ২৩টি গল্প। গল্পগুলির কথক লেখকের দাদা মশাই শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান। তিনি তাঁর জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নাতি-নাতনিদের শোনান। গল্পগুলি তাই কতটা সত্যি আর কতটা কল্পনাশ্রিত সেটা বরং পাঠকের মানসিকতার উপরের ছেড়ে দেওয়া ভালো। তবে যদি একটু অন্যদৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায়, তাহলে এই লেখাগুলো বাংলার নিজস্ব বিশ্বাস ও ধর্মচেতনাকে পুনরুদ্ধার করে এনেছে। সেই দিক থেকে লেখকের জন্য কোনও সাধুবাদই যথেষ্ট নয়। লেখাগুলোর পরতে পরতে পুরানো দিনের দাদু-দিদাকে ঘিরে ধরে নাতি-নাতনির গল্পের আসরের পাড়া-গাঁয়ের সংস্কৃতিকে মনে করায়। কখনও দালানে, পূজার মন্ডপে বা সন্ধেবেলায় ঘরের দাওয়ায় হ্যারিকেনের চারিদিকে গোল হয়ে বসে গল্প শোনার দিনগুলি মনে করায়। আমরা যারা মফস্বলে বা একটু গ্রাম্য পরিবেশে কোনও না কোনওভাবে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছি, তারা হয়ত- বনবিবি, মাকাল ঠাকুর, পাঁচু ঠাকুর, ষষ্ঠী ঠাকুর, বাবা বসন্ত রায়, সুনিয়া বা সিনি ঠাকুরের পূজার কথা শুনে থাকব। সেই লোকসংস্কৃতিকে ননফিকশক করে উপস্থাপন করলে কতজন আগ্রহী হতেন জানি না, তবে লেখক যেভাবে সেগুলোকে ফিকশনের আদলে গড়েছেন, তাতে ব্যাপারটা বেশ উপাদেয় হয়েছে। এই লৌকিক দেবদেবীদের সেই এলাকার মানুষ খুব জাগ্রত জ্ঞান করেন এবং তাঁরা রুষ্ট হলে যে অনিষ্ট হতে পারে এই বিশ্বাস মানুষগুলোর মধ্যে আছে। কতটা সত্যিই মিথ্যে জানি না, তবে আমার জেঠুর বাড়ি সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার ঝড়খালি গ্রামে হওয়ার সেখানে বনে যাওয়ার আগে বনবিবি পূজা দেওয়া, বাঘের ডাক শুনলে দক্ষিণরায়ের নাম করে কপালে হাত ঠেকানো এসব দেখেছি। সব থেকে মজার ব্যাপার হল এই ধরণের লৌকিক দেবতাদের কোনও ধর্মীয় বিভাজন নেই। তাঁরা সব জাতি-ধর্ম থেকেই পূজা পান।বইয়ের প্রসঙ্গ ধরেই বলি পাঁচু ঠাকুরের ব্যাপারে আমি আগেও বেশ কিছুবার শুনেছি। ব্যক্তিগতভাবে একটি মুসলিম পরিবারকে চিনি, তাঁদের বাড়ির কোনও মহিলা এখনও গর্ভবতী হলে পাঁচু ঠাকুরের পূজা দেওয়ার হয়। আর এই প্রায় দশমাস সব সময় নাকি সাদা পে��চারা রাতে যেখানে সেই গর্ভবতী মহিলা থাকেন সেই বাড়িটি ঘিরে রাখে। শিশুর জন্মের পর ষষ্ঠী ঠাকুরের পূজার পরে শিশু আরও কিছুটা বড় হয়ে উঠলে, এই পেঁচাগুলি নাকি নিজেরাই আবার কোথাও চলে যায়। এই পরম্পরা নাকি তাঁদের পরিবারে বেশ কয়েক পুরুষ ধরে চলে আসছে। তাঁদের নাকি এমনও অভিজ্ঞতা হয়েছে, কোনও রাতে গর্ভস্থ ভ্রূণের বা শিশুর কোনও সমস্যা হলে সারারাত পেঁচাগুলি ডাকত। পরেরদিন ডাক্তার ডেকে হয়ত সমস��যার সুরাহা হত। কিন্তু এই ঘটনা বংশ পরম্পরায় একাধিকবার তাঁদের পরিবারে ঘটেছে এ কথার অনেক জীবিত সাক্ষীর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে।বাবার কাছেও শুনেছি গ্রামের দিকে যাদের বাচ্চা বার বার মারা যেত, তারা পাঁচু ঠাকুরের পূজা দিত। তাই এই সমস্ত প্রান্তিক দেবদেবীর কথা একসাথে পড়তে পেরে বেশ ভালোই লাগল। তাই এই লৌকিক দেবতাদের গল্প সত্যি নাকি মিথ্যে সে তর্ক সাইডে রেখে প্রান্তিক মানুষের বিশ্বাসের ও সংস্কৃতির গল্প পড়ে ফেলতে পারেন। এই বইয়ের অন্যতম প্রাপ্তি ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের অসাধারণ অলংকরণগুলি যেগুলো বিমূর্ত ধারণাকে মূর্ত করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছে। তবে বেশ কিছু জায়গায় একটু বর্ণসজ্জায় বিপর্যয় ঘটেছে। সম্ভবত একই ব্যক্তির নাম এক জায়গায় 'সন্তা' , পরের পাতায় 'ভন্তা' বলা হয়েছে। এগুলো একটু ঠিক করার দরকার। খুব কঠোর যুক্তির আতস কাচের নীচে দেখলে হয়ত কিছু কিছু জায়গায় মনে হতে পারে, কোথাও গিয়ে হয়ত অন্ধ বিশ্বাসকে কিছুটা হলেও প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। তাই সেই চিরাচরিত প্রবাদটাই বলি, 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!' তাই যাঁরা কঠোর যুক্তিবাদী, তাঁদের জন্য পরামর্শ- ভালো 'গল্প' ভেবে পড়ে ফেলতে পারেন। যাঁরা বিশ্বাসী মানুষ, তাঁরা পড়তে পড়তে মাথায় দুবার ঠেকিয়ে পেন্নাম করে নেবেন। জয় বাবা তমোঘ্ন দেও-এর জয়!
২০২২ সালে যখন কলকাতা যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম, তখন বাংলা বই সংগ্রহের বাসনা ছিল সবার আগে। বিদেশে বাংলা বইয়ের যোগান থাকলেও তা অতটা আশানুরূপ নয়। লাইব্রেরিতে কিছু থাকে, আর কিন্ডলে দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে হয়, কিন্তু ভেতর ভেতর একটা তালিকা বানাচ্ছিলাম যাতে বইপাড়ায় গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। সেই তালিকার শীর্ষে ছিল তমোঘ্ন নস্করের লেখা অরণ্যমন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় বই 'দেও - লৌকিক দেবদেবীর অলৌকিক কথা'।
অনেকটা সময়ের ব্যবধানে কলকাতা গিয়েছিলাম। মাঝের বিষন্ন কোভিড সময়ে একাধিক বইয়ের প্রকাশ হতে দেখেছি, তাদের রিভিউ চোখে পড়েছে। কিন্তু যে দুটো বই পাঠকের ভালোলাগার সূচকে প্রথম সারিতে ছিল, তাদের একটি শ্রী কল্লোল লাহিড়ীর লেখা 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল', আর অন্যটি 'দেও'। ইন্দুবালা আগেই পড়ে নিয়েছিলাম, যথারীতি বাকি নজর ছিল ওই লাল সাদা ডোরাকাটা বইটার দিকে, যা আমার অপেক্ষার সুযোগ নিয়ে পেপারব্যাক থেকে হার্ডকভারেও পরিণত হল।
প্রত্যাশার পারদ যখন অনেকটা ওপরে উঠে যায়, তখন বই বা সিনেমার ক্ষেত্রে দেখেছি বেশিরভাগ সময়ে তারা সেই তৃপ্তি দিতে পারে না। এতে দোষ অবশ্যই আমার, কারণ সৃষ্টির আসল মজা না নিয়ে তাকে তুলনা করতে থাকি সেই প্রত্যাশার মাত্রার সঙ্গে, তুলনা চলে সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে যে 'দেও' কি উতরোতে পারল সেই উচ্চাশার শিখর? এক শব্দে বললে 'হ্যাঁ', তবে আলোচনার বিষয় কিছুটা থেকেই যায়।
প্রথমে কিছু উদ্ধৃতি তুলে দিই বইটির প্রসঙ্গে।
সুসাহিত্যিক শ্রী সৈকত মুখোপাধ্যায় বইটির রিভিউতে লিখেছিলেন, "দেও বা লৌকিক দেব-দেবীরা এখানে গল্প গড়ে তোলার অনুঘটক মাত্র - লেখকের চেতনার সেই বেদনাময় বালুকণা, যাকে ঘিরে পরতে-পরতে উজ্জ্বল কল্পনার ক্ষরণে গড়ে ওঠে ছোটগল্পের মুকুতাফল।"
সম্পাদক শ্রী ঋজু গাঙ্গুলী তাঁর ভূমিকায় লিখেছেন, "গ্রামীন জীবনে ক্ষেত্রসমীক্ষা করার অভিজ্ঞতা থাকলেই বোঝা যায়, মন্দির-মসজিদ আর অন্য নানা ছকবাঁধা ধর্মাচরণের বাইরে দুটো প্রকাণ্ড জিনিস মানুষের জীবনে থেকেই যায় - ১) ভক্তি, ২) ভয়।... পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হওয়া ছাড়া আর কোনো বার্তা বা উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করা হবে না।... তাই কুসংস্কার বা ভুলভাল আচারের সমর্থনে কোনো কথা যাতে বলা না হয় - সে বিষয়ে আমরা সতর্ক ছিলাম। কিন্তু পরিবারে যে ছোট্ট ঠাকুরটিকে পান-সুপুরি দিয়ে পুজো করা হয়, তিনি যদি কারুর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দেখা দেন - সেই কাহিনী কি কুসংস্কার জ্ঞানে পরিত্যাজ্য হবে? মোটেই না! এই বিশ্বাস আর ভয়ের গল্পই তো বলতে বসেছেন লেখক, সেটা থাকবে। পাঠক তা পড়বেন। তারপর তিনি সেটিকে কীভাবে গ্রহণ করবেন - তা একান্তভাবেই পাঠকের ওপর নির্ভর করবে।"
বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব এর আগেও লেগেছে বারবার। বাংলা লোকসাহিত্যে এমন বই বা প্রচলিত গল্পকথার ভুরি ভুরি উদাহরণ মেলে। মনে আছে ছোটবেলায় ঠাম্মার দেরাজে একটা বাঁধানো বই থাকত। বাংলা বাক্য পড়তে শেখার পর সেই বইটার নাম জানলাম। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'মেয়েদের ব্রতকথা'। ঠাম্মাকে তেমন পড়তে দেখিনি। নিজেই সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখলাম বিভিন্ন ব্রতকথা প্রচারের ছুতোতে কথক একটি করে গল্প বলেছেন। দেব দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারে ব্যবহৃত সেই গল্পগুলিকে তখন বাস্তবই মনে হত। প্রতিটা গল্পের মূল সুর হত একইরকম, যা বড় হয়ে বুঝেছি। কোনো এক পরিবারের সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটবে, হয় তা পূর্বের কোনো পাপের ফল, আর নয়ত দেবতা পুজো চাইছেন। দুই দলকে দেখানো হত - একদল নিয়মনিষ্ঠা মেনে ব্রত রাখতেন, আর একদল অবিশ্বাসের ছাতা মেলে ধরতেন। দুই দলের যাত্রাপথে ভিন্ন চিত্র দেখা যেত। পুজো-আচ্চা করা দলের চলার পথে বিভিন্ন বাড়িতে অন্নপ্রাশন জন্মদিন বিয়ে পৈতে এইসব শুভকাজ হত, আর অন্য পথে চুরি ডাকাতি মহামারী মৃত্যু দেখা দিত। এমন একটা ধাঁচ বুঝে যাওয়ার পর থেকে সেই গল্প পড়ার আর আগ্রহ পাইনি।
'দেও' হাতে নেওয়ার আগে মনে হচ্ছিল সেই একইরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে না তো? প্রত্যাশা আর সন্দেহ পাশাপাশি রেখে পাঠ শুরু করলাম।
গল্পের প্রধান চরিত্র শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান একইসঙ্গে ছিলেন ডাক্তার ও শিকারি। অবিভক্ত বাংলার নানা জায়গায় তিনি কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়িয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরেছেন। পুজোর সময় বাড়ি এসে ছোটদের কাছে সেই ঝুলি খুলে একের পর এক গল্প বলেন। দাদামশায় শ্রীশচন্দ্রই হলেন এই বইয়ের মূল গল্পকথক। লেখক তাঁর শৈশব অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে নিখুঁতভাবে সাজিয়েছেন এই গল্প বলার পরিবেশ। এমন মনোরম গল্পের আসর বসলে তখন কল্পনা আর বাস্তবের চিন্তা মাথাতেই আসে না। মসৃণ গতিতে তা এগিয়ে চলে।
গ্রামবাংলার বিভিন্ন দেব দেবী বা অপদেবতাদের ভয়াবহ কাহিনী শুনলে আজকের দিনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। যুক্তি দিয়ে বিচার ও অনুসন্ধান করতে বসলে হয়ত গল্পগুলির প্রচলনের পেছনে আসল কারণ খুঁজে বের করাও যেতে পারে। কিন্তু দেখা যায় বিভিন্ন রক্তমাংসের মানুষের আখ্যানই বহু ক্ষেত্রে শতাব্দীর ব্যবধানে ধীরে ধীরে পৌরাণিক গাথায় পরিণত হয়। দেব দেবীর মাহাত্ম্য হিসেবে তা স্থায়ী আসন বানিয়ে নেয় মানুষের মস্তিষ্কে, আর ভক্তিভাবের অনুসারী হয়ে আসে ভয়ের প্রভাব, যা সেই বিশ্বাসের বীজ আরো দৃঢ়ভাবে বপন করে দেয়৷ বইতে লেখক সচেতনভাবে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন তৃতীয় পুরুষে গল্প বলার আশ্রয় নিয়ে। দাদামশায়ের বলা বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে প্রকারান্তরে ব্রিটিশ শাসনকালে গ্রামবাংলার আর প্রকৃতির ছবি এঁকেছেন তিনি, আর সুনিপুণ অথচ সহজ সরল ভাষার প্রয়োগে তৈরি করেছেন রুদ্ধশ্বাস সব গল্পের কাঠামো।
এই গল্পগুলিতে কি তা বলে কোনো ধাঁচ নেই? আছে, তবে লেখকের দক্ষতায় তা গৌণ হয়ে রয়েছে শেষ পাতা অবধি। বই শেষ করার পর আমিও সচেতনভাবে হাতে গুনে এমন বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরতে পারি যা প্রায় প্রতিটা গল্পেই পেয়েছি। কিন্তু তার প্রয়োজন পড়বে না। বইটি থেকে আসল প্র��প্তি অসাধারণ কিছু ছোটগল্প, যা পড়ে পাঠক ভয় পাবেন, আর বাংলার হারিয়ে যাওয়া তেইশজন লৌকিক দেব দেবীর সঙ্গে আলাপ সেরে নিতে পারবেন।
'দেও'-র মতো একটি আকর্ষক বিষয় বেছে নিয়ে পাঠকের দরবারে তা সঠিক মাত্রায় পরিবেশন করায় লেখক যে সফল হয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিছু মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়ল। আশা করি প্রকাশক পরবর্তী মুদ্রণে তা শুধরে নেবেন। ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের অলঙ্করণ এই বইয���ের সম্পদ, কিন্তু তাঁর আঁকাগুলির মুদ্রণের মান যথাযথ নয়, বিশেষ করে ছবিতে ছায়ার ব্যবহার ঠিক মতো ফুটে ওঠেনি বইতে।
বইয়ের শেষে জানা যায় শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান আবার গল্পের আসর সাজাবেন। যার ফলস্বরূপ আমরা পেতে চলেছি বইটির দ্বিতীয় খণ্ড - 'বিষহরি'। আগের খণ্ডের মতো এই নতুন খণ্ডেরও সার্বিক সাফল্য কামনা করি। লেখকের কলম চলতে থাকুক, শুভকামনা রইল।
বই ~ দেও লেখক ~ তমোঘ্ন নস্কর সম্পাদক ~ ঋজু গাঙ্গুলী প্রকাশক ~ অরণ্যমন প্রকাশনী প্রথম প্রকাশ ~ জানুয়ারি ২০২১ মুদ্রিত মূল্য ~ ২৫০ টাকা
জ্যোতিষচন্দ্র ন্যায়বানের বড়োদাদা শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান ওরফে দাদামশাই, একাধারে পেশাদারী ডাক্তার এবং শিকারী। কর্মসূত্রে অবিভক্ত বাংলার নানা অঞ্চলে তিনি ঘুরে বেড়াতেন। ব্রিটিশ ভারতবর্ষের বুকের গভীরে খোদাই করা বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবীদের ঘিরে বিভিন্ন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় দাদামশাই তার গল্পের ঝুলি ভরিয়ে রাখতেন। কখনো বৃষ্টি বাদলের দিনে, কখনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে, নাতি নাতনিরা তাদের দাদার কাছে গল্প শোনার বায়না ধরে। দাদামশাইও কখনও তার ছেলেবেলার কথা, কখনও তার কলেজ অথবা কর্মজীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাদের গল্পের আকারে ভালোবাসায় মুড়িয়ে শোনায়।
🔸পাঠ অনুভূতি:
'দেও' বইটি বহুদিন ধরে আমার উইশলিস্টে ছিলো, কিন্তু যখনই গান্ধীজি আমার সহায় হতেন আর আমি এই বইয়ের খোঁজ করতাম, তখনই কাকতালীয়ভাবে বইটি আর পাওয়া যেত না। গত বছরে প্রায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকার পর জানতে পারি, বইটির সটিক সংস্করণে তাও আবার হার্ড কভারে আসতে চলেছে। ব্যাস্, আমায় আর পায় কে? বই পাড়ায় আসার প্রথম দিনই সংগ্রহ করে ফেললাম। এই বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কমবেশি সকলেই জানেন।
২৩টি ছোটোগল্পের এই সংকলনের প্রতিটি গল্পেই মিশে রয়েছে ভয়, ভক্তি, গ্রামবাসীদের সারল্য, সোঁদা মাটির গন্ধ, জোলো হাওয়া আরও অনেক কিছু। গ্রাম্য পরিভাষায় যত্ন সহকারে প্রতিটি গল্প বোনা হয়েছে। এত সহজ ভাষায়, এত সুন্দরভাবে লৌকিক দেব-দেবীদের নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন, বাড়ির ছোটো থেকে বড়ো প্রায় সকলেরই পাঠপযোগী হয়ে উঠেছে 'দেও'। প্রচ্ছদ এবং অলঙ্করণ বিশেষভাবে নজর কাড়ে। তবে আমার বিনীত অনুরোধ, পরেরবার যেন বইয়ের ভেতরের অলঙ্করণগুলি প্রতি গল্পের শেষে পুরো পাতা জুড়েই থাকে।
আর একটি বিষয়ে না বলে পারছি না। 'এরর-ফ্রি' বলে যদি কোনো ট্যাগ রয়ে থাকে তাহলে আমি এই বইটিকে তা উৎসর্গ করবো। বহুদিন পর এমন বই পড়লাম যেখানে মুদ্রণ প্রমাদ অতি সামান্য। টুকটাক কিছু জায়গায় ভুল চোখে পড়েছে। আশা রাখি, পরবর্তীতে সেই ভুলগুলি শুধরে নেওয়া হবে। গল্পের শুরুতে ভূমিকা অংশে ঋজু গাঙ্গুলীর লেখাটি বেশ ভালো লেগেছে।
"শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান আবার আসবেন গল্প শোনাতে"। হ্যাঁ। আমিও সেই অপেক্ষাতেই রইলাম। আপনারা যারা এখনও 'দেও' পড়ে উঠতে পারেননি, তাদের সকলকে আমি বলবো, অন্তত একটিবার পড়ুন। বহু অজানাকে জানার মাঝেও কোথাও নিজেদের ছোটবেলা খুঁজে পাবেন, এ আমি হলফ করে বলতে পারি।
খুউব সুন্দর একটা আকর্ষণীয় প্রচ্ছদে ২৩ টি গল্পের সমাহার হল তমোঘ্ন নস্করের "দেও"। ছবিতে বইটা যেমন প্রিমিয়াম লাগছিল, হাতে নিয়ে সেই 'প্রিমিয়াম লুক'টাই ফিল করতে পারছিলাম। দুর্দান্ত প্রচ্ছদ, অপ্রতিম অলংকরণ।
তারপর? তারপর আমি আর কিছুই খুঁজে পাইনি বইটাতে। ফেসবুকে ছোট ছোট লেখা লিখে সত্যিই দারুণ জনপ্রিয় হয়েছেন তমোঘ্ন দা। আর এসব মোটেই সহজ নয়। আলৌকিক ব্যাপার নিয়ে ওনার রিসার্চ এবং লেখার ধরণ সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে বইটা একটু বেশীই একঘেয়েমি লাগলো। বইটার ৫২%-এ প্রায় সাড়ে দশখানা গল্প পড়ার পর আর এগোতে ইচ্ছে করলো না। এই সাড়ে দশটা গল্পের মধ্যে 'ধনকুদরা' বেশ ভালো লেগেছে। তাছাড়া প্রতিটা গল্পেরই কাঠামো প্রায় একই রকম। পেশাদার ডাক্তার দাদামশায়ের জীবন অত্যধিক দেবদেবিযুক্ত কাণ্ডে পরিপূর্ণ যার সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। বইয়ের দ্বিতীয় গল্প 'সোনাকালী'। গল্পটা আমার কাছে খুব চেনা ব্লেন্ডিং মনে হলো। যদি তারানাথ তান্ত্রিকের কিছু কিছু অংশ এবং বিভূতিভূষণেরই ছোটগল্প "অভিশপ্ত"কে খুব গুছিয়ে ব্লেন্ড করা যায় তবে সোনাকালী-র মত গল্প ওঠে আসে। কিন্তু তাই বলে এটাকে কপি বলা যাবে না। যেহেতু এখানে একাধিক গল্পের মিশ্রণ এবং সাথে লেখকের নিজস্ব মশলাও রয়েছে, তাই এটার স্বাদ খানিকটা ভিন্ন। পুরোপুরি কলাও নয়, সম্পূর্ণ দুধও নয়; বানানা মিল্কশেক বলতে পারেন!
তাছাড়া যেটা খুব চোখে লাগলো সেটা হলো প্রায় প্রতিটা গল্পই গন্ধযুক্ত। এই যেমন – "অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ", "বাড়িময় ঘুরপাক খাওয়া আঁশটে গন্ধ", "তীব্র বোঁটকা গন্ধ", "অদ্ভুত গা-গোলানো গন্ধ", "একটা পচা গন্ধ", "একটি তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ", "গরুর গায়ের বোদো গন্ধ" ইত্যাদি। যখন প্রায় সব গল্পেই কিছু না কিছু গন্ধের বর্ণনা থাকে তখন খানিকটা বিরক্তি তো লাগেই। আমি যে কপিটা পড়েছি সেটা ৭ম মুদ্রণ। তারমধ্যে আবার তৃতীয় মুদ্রণটা সংশোধিতও। কিন্তু যখন পড়ি, "যখন শ্রঞ্জয়ের বিবাহ হয়েছিলেন", "মাসের মাসের পর মাস কেটে গেল", "শেষে এক সিদ্ধ তান্ত্রিক এসে শেষে বিধান দিলেন", "আরও কয়েকটি ধনী পরিবার আরও কয়েকটি পরিবার স্বপ্ন পেয়েছিল মায়ের পুজো হবে", "মোড়লকে মা আদেশ দেন মা", "দূরে কয়েকটা কয়েকটা ব্যাং ডাকছিল" অথবা "তুমি কথা দিয়েছিলেন" তখন পড়ার উৎসাহ এমনিতেই নেতিয়ে যায় এবং সন্দেহ হয় সংশোধন কর্তাকে!
এতসবের পর আর "বিষহরি" বা "দধিচি" পড়ার ইচ্ছে থাকলো না। কারণ এগুলোও "দেও"-এরই সিক্যুয়াল। বইটার প্রচ্ছদ, অলংকরণ এবং শুধুমাত্র "ধনকুদরা" গল্পটার জন্য একটা ⭐ দিলাম। যাঁরা লেখকের ফেসবুকের লেখার ভক্ত অথবা ব্যক্তিগতভাবে জড়িত, তাঁদের জন্য বইটা কর্তব্য হিসেবে হলেও অবশ্যই পঠনীয়।
দেও শব্দটি হল দেবতার অপভ্রংশ। এখন প্রশ্ন হল দেবতা কে বা কারা? দেবতা মানে কি ঈশ্বর? শব্দকোষ বলে দেবতা হলেন প্রাকৃতিক বা অতিপ্রাকৃতিক কোনও শক্তি। প্রাগৈতিহাসিক যুগে যখন আদিমানবের মধ্যে চেতনার উন্মেষ ঘটছিল, যখন আদিম ভূমি নিজের ভয়াল রূপ পরিত্যাগ করে উঠতে পারেনি, তখনই বোধকরি দেবতার জন্ম হয়েছিল। বৃক্ষ, পশু, বর্ষণ, সবের মাঝে আদিমানব খুঁজেছিল নিজের রক্ষাকর্তাকে। তারপর কালচক্রের প্রবর্তনে দেবতার রূপ পরিবর্তিত হল। কেউ আরাধ্য হলেন, কেউ ব্রাত্য হলেন।
এই বইটি আমাদের গল্প বলে সেইসব ব্রাত্য দেবতার, না, ভুল বললাম, এই বই দেওর কথা বলে। সেই দেও যাঁরা আজও আছেন, মনের অগোচরে, দৃষ্টির বাইরে। আড়ালে থেকে তাঁরা আজও রক্ষা করে চলেছেন আমাদের, কখনও নারায়ণী রূপে, কখনও বসন্ত রায় হয়। কখনও বা মাশান ঠাকুর হয়ে সাজাও দিচ্ছেন।
মোট তেইশটি পরিচ্ছদে লেখক গ্রাম বাংলার নানার লৌকিক দেবতার গল্প শুনিয়েছেন। কখনও তাঁরা রয়েছেন মাদারের ভাঙা ভিটে রক্ষা করতে, কখনও বা তাঁরা ধনকুঁদরা হয়ে দুঃস্থ ভক্তকে পরিত্রাণ করছেন। এই রক্ষা আর পরিত্রাণের কখনও কখনও বড় ভয়ঙ্কর এক মূল্য দিতে হয়েছে সবাইকে।
জমাটি বৈঠকী মেজাজে নিজের নানান অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান। তাঁর গল্প শোনানোর ঢংটি বড়ই চমৎকার। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমিও যেন ওই রাতের ডাক শুনতে পাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি রাতচড়াদের, গন্ধ পাচ্ছি দাদামশায়ের হুঁকোর। মহাবিদ্রোহের পরবর্তী কালে ইংরেজ সরকারের বেতনভোগী ডাক্তারবাবু নিজের ঝোলা উপুড় করে গল্প শুনিয়েছেন নিজের নাতি- নাতনিদের। তাঁর চাকরি তাঁকে নিয়ে গেছে বাদাবন থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়ে।
মুদ্রন প্রমাদ চোখে পড়েনি বললেই চলে। কিন্ত তবুও খুঁত না ধরলে "ঠাউর পাপ দেবে।" পৃষ্ঠ ১৫০এ রাজার নাম একবার জগদীশ প্রসাদ, আরেকবার জগদীশ্বর হয়ে গেছে। সেই রাত গল্পে "বেগমশা" বলে জনৈকার উল্লেখ আছে। যেহেতু স্থান আওয়াধ, তাই উনি বেগম হজরত মহলের কথা বলছেন বলে ধরে নিচ্ছি। সেই ক্ষেত্রে বেগমশা না হয়, বেগম সাহেবা হওয়া বেশী যুক্তিযুক্ত হত বলে আমার ধারণা। বেশ কিছু স্থানীয় শব্দের ব্যবহার করেছেন লেখক যেমন তিওর। আদ্যান্ত শহুরে আমার পক্ষে এই শব্দগুলো বুঝতে একটু অসুবিধে হয়েছে। গল্পের তালে মানে বুঝেছি। বইয়ের শেষে টীকা দেখে আশ্বস্ত হয়েছি যে আমি ঠিক বুঝেছি। তবুও যদি এই টীকাগুলো পরিচ্ছদের সঙ্গেই দেওয়া হত, তাহলে বোধকরি পড়তে আরও সুবিধা হত।
শেষে বলব লেখকের গবেষণা এবং পরিশ্রমের মূর্তরূপ এই বই। আমি জানি না উনি কত গ্রন্থাগার, আর্কাইভ খুঁজে তুলে এনেছেন এই বিস্মৃত দেওদের কাহিনি। তাঁর এই পরিশ্রম প্রশংসাযোগ্য।
সদ্য পড়ে শেষ করলাম সুলেখক তমোঘ্ন নস্কর মহাশয়ের লেখা "দেও" গল্প সংকলন টি । অনেক দিন পরে এমন একটা ছোট গল্প সংকলন পড়লাম যা পড়ার সময়ে হারিয়ে গেছিলাম সেই ছোটবেলায় যখন দাদু দিদারা আধো অন্ধকারে চারিপাশে নাতি নাতনিদের নিয়ে গল্প শোনাতেন। আমার সৌভাগ্য যে অমিও সেই সময়ের কিছুটা হলেও স্বাক্ষী থাকতে পেরেছি যা এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই বই কিছুটা হলেও পাঠককে সেই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে ।
এখানে আমাদের কে গল্প শোনাচ্ছেন শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান, পেশায় ডাক্তার স্বসম্বোধনে দাদু। ঘুরে বেরিয়েছেন ভারতের বহু স্থান যে কারণে তাঁর গল্পের ঝুলি কখনও শেষ হয়না। তিনি আমাদের কে শুনিয়েছেন ২৩ টি গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন লৌকিক দেব দেবীদের অলৌকিক কথা। লেখক এমন ভাবে এই গল্প গুলো বর্ণনা করেছেন পড়ার সময়ে মনে হচ্ছিলো অমিও সেখানে বসে বসেই যেন গল্প শুনছি। খুবই সহজ সরল ভাষা এবং প্রত্যেকটা গল্প ভীষণই টান টান এবং উত্তেজনাময়।
এই বইয়ের ভালো লাগা অনেক আছে তাঁদের ভিতরে একটি বিশেষ দিক হলো এখানে লেখক বাংলার হারিয়ে যাওয়া অনেক সংস্কৃতি কে তুলে এনেছেন, যা এখন আমরা ভুলতে বসেছি। এই সব তথ্য এমনকি এই ২৩ টি গল্প লেখা হয়েছে ২৩ জন দেবতা কখনও অপদেবতা দের কে নিয়ে তাঁদের সম্পর্কে প্রচুর তথ্য আছে কখন ও তাঁদের পূজা পদ্ধতি ও বলা আছে যা পড়লেই বুঝতে পারবেন এগুলো লেখার জন্য এই বিষয়ের উপরে লেখককে কতটা গবেষণা এবং পরিশ্রম করতে হয়েছে।
বেশ কিছু স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তবে সেগুলো সম্পর্কে আবার বইয়ের শেষে টীকা দেওয়া হয়েছে। এটাও বেশ ভালো লাগলো। প্রিন্টিং মিস্টেক চোখে পড়েনি।
বইয়ের প্রোডাকশন কোয়ালিটি অসাধারণ। ভীষণই সুন্দর এবং ঝকঝকে ছাপা। প্রত্যেকটা গল্পের জন্য আছে অসাধারণ কিছু অলংকরণ। এছাড়া উপরি পাওনা হিসেবে বইয়ের শেষে লেখকের স্বরচিত একটি "মা ষষ্ঠী বন্দনা " আছে।
অলৌকিক গল্প, ভুতের গল্প, দেব দেবীদের গল্প যদি পছন্দ করেন, যদি ফেলে আশা ছোটবেলার দিনগুলোর একটু অনুভূতি পুনরায় অনুভব করতে চান এই বই অবশ্যই আপনার জন্য। সংগ্রহে রাখার মতো একটা বই।
ভালো থাকবেন লেখক। আপনার লেখনীর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি। আমাদের কেও আরও নানান স্বাদের কাহিনী উপহার দিতে থাকুন। ইতিমধ্যেই শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান আবার ফিরে এসেছেন এই বইমেলা তে নতুন আরও গল্পের ঝুলি নিয়ে। খুব শীঘ্রই সংগ্রহ করব নতুন বই "বিষহরি " টিও।
ছোটোবেলায় দিদিমা ,মামার কাছে অনেক ধরনের গল্প শুনতাম। সেই সব পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিল এই বই। লৌকিক দেব দেবী ও অপদেবতা নিয়ে লেখা গল্প সংকলন 'দেও'। বইতে মোট তেইশটি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্প থেকে আলাদা আলাদা লৌকিক দেব দেবী ও অপদেবতার কথা জানা যায়। সংকলনের মুখ্য চরিত্র শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বান কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন।তাঁর জীবনের কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা গল্পের মাধ্যমে শুনিয়েছেন কখনো নাতি নাতনি কখনো বয়স্কদের কাছে।
লৌকিক দেব দেবী ও অপদেবতা বিষয়ে আগে কখনো কিছু লেখা পড়িনি । তাই আমার কাছে বিষয়টি নতুন। গল্প গুলির মাধ্যমে অনেক অজানা অচেনা দেব দেবী সম্পর্কে জানলাম।সেই সব দেবতা ও অপদেবতাকে নিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রথা সম্পর্কেও জানতে পারলাম। গল্পগুলির মধ্য দিয়ে লেখক গ্ৰাম গঞ্জের প্রাকৃতিক রূপ ও গ্ৰাম্য জীবনকে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এছাড়া বিভিন্ন লৌকিক সংস্কৃতি ও প্রথা সম্পর্কেও বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন যা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু গল্পগুলি অলৌকিক বিষয়ক তাই ভয় ও কৌতূহল মেশানো রোমাঞ্চকর অনুভূতির উপস্থিতি রয়েছে প্রায় সব গল্পেই। আর সব ঘটনা অথবা গল্প অথবা অভিজ্ঞতা যাই বলা হোক না কেন গল্প শোনানোর মতো করে লেখা হয়েছে বলে পড়তে বেশ ভালোই লেগেছে । সরল ও চমৎকার লেখনী তাই আমার মনে হয়েছে কয়েকটি গল্প আরো একটু বড় হলে মন্দ হতো না
সব গল্পই ভালো তবু ব্যক্তিগতভাবে অমৃত,সোনাকালী,বাংসুক, এলোকেশী,খুদবুড়ো,নারায়ণী,ভিটে, বাবা বসন্ত রায়,বড়মাচন্ডী,লিওক,সন্তান,ধনকুঁদরা,দেও, জিয়াংসি, পাঁচুঠাকুর ও ভৈরব বেশী ভালো লেগেছে। যদিও ' সেই রাত ' গল্পটি অলৌকিক বিষয়ক হলেও এই গল্পে কোন আঞ্চলিক দেব দেবী বা অপদেবতা নেই।
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ বেশ ভালো। তবে বইএর ভেতরের ছবিগুলির সাইজ বড় হলে দেখতে আরো ভালো লাগতো। বই এর শুরুতে ঋজু গাঙ্গুলি ও লেখকের লেখা ভূমিকা পড়তেও ভালো লেগেছে। এই ধরনের বিষয় নিয়ে লেখার প্রয়োজনীয়তা সেটা ফিকশন বা নন ফিকশন যাই হোক না কেন এবং এই ধরনের বিষয় নিয়ে লেখার ভাবনা কিভাবে বাস্তবায়িত হয়ে এই সংকলন তৈরী হলো সেই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও সরলভাবে ���লা হয়েছে। তবে গল্পের শেষে যদি আঞ্চলিক দেব দেবী বাংলা ও অন্যান্য রাজ্যের কোথায় কোথায় এঁদের সম্পর্কে জানা যায় সেইসব তথ্যসূত্র থাকলে ভালো হতো।
অজানা লৌকিক দেব দেবী ও অপদেবতা দের নিয়ে লেখা এই গল্প সংকলন আমার পড়তে বেশ ভালোই লাগলো। আশা করবো যারা অলৌকিক বিষয়ক গল্প পড়তে পছন্দ করেন তাদের ভালো লাগবে এই বই।
আমাদের গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের লোকাচার, কুসংস্কার ও আরও অনেক কিছু। সেই সব লোকাচারের গল্পকথা শুনলে কখনও মনে হয় সত্যি, আবার কখনওবা তা শুধুই অবাস্তব মনে হয়। তবে এইসব গল্পকথার বেশিরভাগই গড়ে ওঠে বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবী ও অপদেবতার কাহিনীর ওপর নির্ভর করে। আর গ্রামবাংলার এই সমস্ত ভেসে বেড়ানো কাহিনী ও লৌকিক দেবদেবীর কথা দুই মলাটের মধ্যে বন্দি করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন লেখক তমোঘ্ন নস্কর। তাঁর লেখা 'দেও' এবং 'বিষহরি' বইতে তিনি এক গল্পদাদুর আসরের মাধ্যমে পাঠকদের অভিজ্ঞতা করিয়েছেন বাংলার বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবী ও অপদেবতার কথা। দুটি বই মিলিয়ে তিনি প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি দেবদেবীর কথা তুলে ধরেছেন। গল্পদাদু শ্রীশচন্দ্র ন্যায়বানের বাচনভঙ্গি এই রোমহর্ষক কাহিনীগুলিকে আরও আকর্ষণীয় ও শ্রুতিমধুর করে তুলেছে। এই কাহিনীগুলির মধ্যে যেমন রয়েছে বাংসক, খুদবুড়ো, পাঁচঠাকুর, বড়ামচন্ডীর কথা; তেমনই রয়েছে মাকাল ঠাকুর, বাঘরাই ও হালকাঠি বাবার কথাও। কাহিনীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেখক গল্প বলার ছলেই পাঠকের পরিচয় ঘটিয়েছেন গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন আচার, লোকাচার ও সংস্কৃতির সাথে। পাঠক যখন 'দেও' এবং 'বিষহরি' বইদুটির রস আস্বাদন শুরু করবে, তখন মনে হবে সে যেন গ্রাম-বাংলার কোনো মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলেছে; আর তার চোখের সামনে ধরা দিচ্ছে এক অন্য গ্রামবাংলা - যা প্রাকৃতিক ভাবে বৈচিত্রময় হওয়ার সাথে সাথে হয়ে উঠেছে লোকাচারে বৈচিত্রময়।
গ্রাম বাংলায় প্রচলিত বিভিন্ন দেব দেবী ও অপশক্তিদের নিয়ে গল্পগুলি। যতটা ধুমধাম করে অতি প্রচলিত দেবদেবীরা পুজিত হন ততটা ঘটা করে বিভিন্ন গ্রামের নিজস্ব এই দেবদেবীরা পূজা পান না। কিন্তু গ্রাম বাংলার মানুষের নিষ্ঠা, ভক্তি আর প্রাণের ছোঁয়া থাকে পুরোদস্তুর। চিরাচরিত তন্ত্র মন্ত্রের বাইরে গিয়ে আঞ্চলিক এই উপাখ্যানগুলিকে তুলে ধরার দিকেই লেখক মনোযোগ দিয়েছেন। কিছু গল্প গ্রাম বাংলার বাইরে বেরিয়ে ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যের ‘দেও’দেরও তুলে ধরেছে। এই আখ্যান গুলি কতটা সত্য জানি না তবে পড়তে গিয়ে গ্রামীণ রূপের ছোঁয়া পেয়ে ভালো লেগেছে।
গল্পের কথক যখন নিজে সশরীরে গল্প শোনাচ্ছেন তখন ‘তারপর কী হলো’ প্রশ্নটা জিইয়ে রাখা কঠিন।লেখক গল্পের এন্ডিং এ বৈচিত্র রেখে সেই কৌতূহল ধরে রেখেছেন।
লেখনী মজবুত আর ঝরঝরে হলে আরও মজা নিয়ে পড়তাম। বিশেষ করে শুরুর দিকের গল্পগুলোয় রীতিমতো হোঁচট খেয়ে এগোতে হয়েছে। এতগুলো গল্পের মাঝে কিছু গল্প স্বাভাবিক ভাবেই চিরাচরিত ফর্মুলা ধরেই এগিয়েছে, তবে পরের দিকের গল্পগুলিতে পরিণতি বোধের ছাপ স্পষ্ট ।
সব শেষে বলব বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের কিছু টুকরো টুকরো নিদর্শন পেতে বেশ ভালোই লাগলো।
আমার এর মধ্যে পড়া সবচেয়ে প্রিয় বই। কিছু বই আছে তারাতাড়ি শেষ করতে ইচ্ছে করে শেষটা জানার জন্য, আর কিছু বই আছে যেগুলো রইয়ে সইয়ে পড়তে হয়, যাতে তারাতাড়ি শেষ না হয়ে যায়। এটা সেই ২তিয় পক্ষের বই। আমি নিজেও ৮০-৯০ দশকের গ্রামে বড় হওয়াদের দলে। ছোটবেলেয় অন্ধকার ঘরে দাদু- দিদিমার থেকে গল্প শোনতাম। এই বইটা সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিল। যে দেওতাদের সম্ভন্ধে এই বইয়ে লেখা, তার মধ্যে দু-একটা আমার আগে থেকেই জানা সেই সুবাদে। কিন্তু বাকিগুলো এই প্রথম জানলাম। লেখককে ধন্যবাদ এমন বই লেখার জন্য। পরের খন্ডের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
লৌকিক দেব দেবীদের নিয়ে এ বই পড়তে মন্দ না।কখনোই মনে হয়নি পড়ছি যেন সানডে সাসপেন্স শুনছি। শ্রিশচন্দ্র ন্যায়রত্ন যেভাবে গল্প গুলো বলেছেন তাতে প্রত্যেকটি গল্প অন্য মাত্রা নিয়েছে। লৌকিক দেবতাদের, তাদের পূজার ওপর অনেকে তথ্য পাওয়া গেলো। এই সিরিজ এর আরও বইএর অপেক্ষায় রইলাম।
এক কথায় দারুণ। হরর জানরা টা আমার সবসময়..ই পচ্ছন্দের। আর হরর সেগমেন্ট এর মধ্যে অতিপ্রাকৃত ও প্রাচীন গল্পগাথার অপূর্ব সংমিশ্রণ খুঁজে পাওয়া ভার। যা দেও এর মাধ্যমে তমোঘ্ন নস্কর করে দেখিয়েছেন। সভ্যতা শহরমুখী হওয়ার আগের এইসব কাহিনীতে গ্রাম গঞ্জের একান্নবর্তী পরিবার, ঝোপঝাড়, বনজঙ্গল, খাঁ খাঁ করা দুপুর,রহস্যময় সন্ধ্যা-রাত্রি, তাদের লোকজসংস্কৃতি, আরাধ্য দেবতা,লোকদেবতা, অপদেবতার কাহিনী উঠে এসেছে বৈঠকি কায়দায় বলা নস্টালজিক দাদা,ঠাকুরদাদার বহু পুরোনো গল্পের মাধ্যমে। মধ্যে খানের গল্পগুলো একটু ছোট ছোট এছাড়া দেও রোমাঞ্চকর, গা শিরশিরে ও ভয় জাগানিয়া। সত্যি এ ভয় আলাদা। এ ভয় আপনাকে তৃপ্তি দিবে ফের দুঃস্বপ্ন দেখাবে। সব ধরণের পাঠকদের কাছে দেও ভালোবাসা পাবে, সমাদৃত হবে।