যখন আপনি কোনো মুসলিমের কাছে পুনর্জাগরণের আশা ব্যক্ত করবেন, দেখবেন সে হতাশা ব্যক্ত করছে। সে বলবে, ‘তুমি উলো বনে মুক্তা ছড়াচ্ছ।’ কেউ হয়তো আরও আগ বাড়িয়ে বলবে, ‘তুমি তো ফুটো বেলুনে ফুঁ দিচ্ছ। ফুটো বেলুনে ফুঁ দিয়ে লাভ নেই। এক দিক থেকে ফুঁ দিলে বাতাস অন্যদিক থেকে বের হয়ে যায়।’ অনেকের মাঝেই এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। ফলে তারা অন্যায়ের নিষেধ ও আল্লাহর পথে আহ্বান করা থেকে পিছিয়ে থাকে। আসলে খিলাফাতের পতনের পর মুসলিম উম্মাহ কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। স্তিমিত ভাব বিরাজ করছে সবখানে। মরচে ধরেছে আমাদের মন ও মগজে। কমে গেছে কলমের ধার, ভোঁতা হয়ে গেছে তলোয়ার। মুসলিম উম্মাহ যে বিজয়ী জাতি, এ কথা ভাবতেও যেন অনেকের গা শিউরে ওঠে। আল্লাহ যে আমাদের বিজয়ের জন্যে প্রস্তুত করছেন, এ কথা শুনলে ভ্রু কুঁচকায় অনেকেই। যারা দ্বীনের জন্যে জীবন বাজি লাগাতে চায়, নৈরাশ্যবাদীরা তাদের পেছন থেকে টেনে ধরে রাখে। এরা আসলে মন-মগজে পাশ্চাত্যের গোলাম হয়ে গেছে। গোলামির ভাইরাস মিশে আছে এদের রক্তকণিকায়। এসব নৈরাশ্যবাদীদের জাগানোর জন্যেই এই বই।
'মুসলিমদের পরাজিত মানসিকতা' বইটি শাইখ ড. আবদুল্লাহ আল খাতির রহিমাহুল্লাহ-প্রদত্ত একটি ভাষণ। প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে ভাষণটি তিনি বৃটেনে মুসলিম তরুণদের উদ্দেশ্যে প্রদান করেছিলেন। খুবই ছোট্ট(৪০ পৃষ্ঠা) কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। অনুবাদ সাবলীল।
বই থেকে পছন্দের একটি অংশ তুলে ধরছি :
❝ বাস্তবতা হলাে পশ্চিমারা এগিয়েছে যন্ত্র ও প্রযুক্তিতে, মানবতার দিক থেকে তারা অগ্রসর হতে পারেনি। (পশ্চিমাদের উন্নতির) বিভিন্ন রিপাের্টে যে রেখাটি ওপরের দিকে উঠে গেছে, সেটা কেবল প্রযুক্তির দিক থেকে। কেননা তারা প্রচুর যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। তাই যে জাতি তাদের সামাজিক রীতিনীতি অনুসরণ করবে এবং তাদের সামগ্রিক জীবনপদ্ধতি অবলম্বন করবে, তারা হবে মানসিকভাবে চরম অধঃপতিত। সুতরাং তাদের কাছে যে উন্নতি রয়েছে সেটা প্রযুক্তির উন্নতি, মানবতার নয়। মানবতার মাপকাঠিতে আমরা উন্নতি লাভ করতে পারি কেবল আমাদের দ্বীন মেনে চলার মধ্য দিয়ে। তবে তাদের আবিষ্কার ও প্রযুক্তিকে আল্লাহর আনুগত্যের পথে কাজে লাগানাের উদ্দেশ্যে আমরা সেগুলােও তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করতে পারি। ❞ [পৃষ্ঠা - ১০]
শেষ করছি কুরআনের একটি আয়াত দিয়ে,
❝ তোমরা ভেঙে পড়ো না এবং দুঃখ পেয়ো না। তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো। ❞ [সূরা আলে ইমরান : ১৩৯]
কলেবরের দিক থেকে ছোট কিন্তু গুরুত্বের দিক থেকে বইটি বিশাল। কোথায় যেন পড়েছিলাম না শুনেছিলাম যুদ্ধের অর্ধেকই মনস্তাত্ত্বিক। আর আমরা এখানেই পরাজয় মেনে বসে আছি। যা হওয়ার কথা ছিল বাকি অর্ধেকের ভিত্তি, তাই আমাদের মূল বিপর্যয়ের কারণ হয়ে বসে আছে আজ।
বাজারে ভালো ইসলামিক বইয়ের অভাব নেই আজ, আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু মৌলিকত্ব ও গুরুত্বের দিক থেকে খুব অল্প বই-ই এই ৪০ পৃষ্ঠার ছোট বই থেকে অগ্রাধিকার পাবে বলে আমার বিশ্বাস। আমরা আবরাহার যুগে নই বইয়ের সাথে এই বইটিও যুগোপযোগীতার দিক থেকে দ্বিনী যেকোনো বইয়ের লিষ্টে শীর্ষে থাকার দাবি রাখে।
আত্মপরিচয়ের ঘাটতিতে ভোগা এই উম্মাহ আজ অনেকটা জাতে উঠার জন্য অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলছে বিশ্ব নেতৃত্বে থাকা কুফরি শক্তিগুলোকে। অথচ এই অন্ধ অনুসরণই যে তাদের সমস্ত ধ্বংস ও অপমানের কারণ সেটা বোঝার শক্তিটুকু তারা আজ হারিয়ে ফেলেছে।
এই বইতে শায়েখ, যা মূলত উনার প্রদত্ত একটি ভাষণ, উম্মাহর বিপর্যয়ের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার অত্যন্ত সহজ,সংক্ষিপ্ত ও সাবলীল ভাষায় আলোচনা করেছেন। যা আবারও প্রমাণ করে যে আল্লাহর দ্বীন কতোটা সহজ আর তার বার্তাও কতটা স্পষ্ট।
বইয়ের অনুবাদ থেকে নিয়ে সবকিছুই খুব সুন্দর হয়েছে মা শা আল্লাহ। বইয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিন। শাইখ ড.আব্দুল্লাহ আল খাতিরকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমীন। সকল প্রশংসা এই বিশ্বজাহানের একক স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহর।
খুবই ছোট একটা বই, কিন্তু এর বিষয়বস্তুগুলো অনেক ভারী। আমাদের মুসলমানিত্বের সাথে সম্পর্কিত মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা ও সমাধানগুলো চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
শেষের অংশটুকু ছিল ইমান জাগানিয়া। দ্বীন ইসলামের বিজয় তো সুনিশ্চিত। সুতরাং, যে দ্বীনের সাথে থাকবে, সে সম্মানীত হবে। আর যে দ্বীনকে পরিত্যাগ করবে, সে অপদস্থ হবে।
"তোমরা হীনবল ও দুঃখিত হয়ো না, বস্তুতঃ তোমরাই জয়ী থাকবে যদি তোমরা মু’মিন হও।"
- আল ইমরান:১৩৯
এই আয়াতই নির্দেশ করে একজন মুসলিম হওয়ার থ্রেশল্ড লেভেল এটাই যে সে কোনো অবস্থায় আশা ছাড়বে না। নৈরাশ্য এসে ভর করলে বুঝা উচিত এটা ওয়াসওয়াসা ছাড়া কিছু নয়। দ্রুত আল্লাহ আযযা ওয়াজালের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে নিতে হবে। ঈমান ও তাকওয়াকে আরো মজবুত করে দেয়ার জন্য তাঁর কাছে চাইতে হবে।
গত ৫ মাস ধরে প্রথম কেবলার স্থানে যা হচ্ছে তার প্রতিবাদে এতদূর থেকে কিছু করার নেই ভেবে যারা আমরা হতাশ, ফিতনায় গ্রাস হয়ে পড়া দুনিয়া দেখতে দেখতে যারা আমরা হতাশ, যারা বিরাট পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন রাতারাতি- খোরাসান থেকে কালো ঘোড়ার দল, ইমাম মাহাদী তারাই ঠিক করে দিবেন সবকিছু......না, যুদ্ধ শুরু হবে নিজেকে দিয়ে। নিজের নফসের সাথে যুদ্ধ, নিজেকে সকল প্রকার শিরক- কুফর-ফিতনা-বিদ'আত থেকে সরিয়ে রাখা, ইবাদত-আমল-কর্ম সবকিছু শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেখানো পথে করা। এরপর নিজের পরিবারের দিকে নজর দেয়া, তারপর আপনার প্রতিবেশি। প্রত্যেক মুসলিমই এককেজন দাঈ। এই দায়িত্ব কি আমরা পালন করতে পারি? এই ছোট দায়িত্বই তো অনেক বড় ইমপ্যাক্ট ফেলার জন্য যথেষ্ট! এই জি হা দ গুলোই তো প্রয়োজন। আমরা যদি চেষ্টাই না করি রবের সাহায্য কি করে পাব!
কষ্ট দুর্দশা বাধার কোনো সীমা থাকবে না যখন নিজ জায়গা থেকে আমরা এই জি হা দে নামবো। আল্লাহতা'লা তো বলেছেন-
"মানুষ কি মনে করেছে যে, তারা ঈমান এনেছে বললেই, তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তাদের পরীক্ষা নেওয়া হবে না? তাদের পূর্বে যারা ছিল, তাদেরও পরীক্ষা করেছি। অবশ্যই আল্লাহ জেনে নিবেন, কে সত্য বলেছে আর কে মিথ্যা বলছে।"
- আল আনকাবূত:২-৩
মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
জাহান্নামকে চাহিদাপূর্ণ বস্তু ও প্রবৃত্তি দ্বারা বেষ্টন করে রাখা হয়েছে আর জান্নাতকে বেষ্টন করা হয়েছে কষ্ট-ক্লেশ দ্বারা।
কেউ যদি মনে করে দ্বীনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ, গোলাপ ফুলে সুশোভিত এবং সহজ, সে ভুল করবে। দ্বীনের অনুসারী ব্যক্তিদের জন্য বিপদ-আপদ ও সমস্যার অপেক্ষা করা ছাড়া ভিন্ন উপায় নেই। এ-সমস্ত পরীক্ষার মুখোমুখি তাদের হতেই হবে।
এসব নিয়ে লিখতে গেলে অনেককিছুই লিখতে ইচ্ছা করে আসলে। এই বইটা পড়ে ভাল লাগার কারণ কথাগুলোর সাথে আমার সহাবস্থান।