মনোজ সেন-এর জন্ম ১৯৪০, বেলেঘাটায়। পড়াশোনা শুরু স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে। সেখান থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স। অতঃপর বি ই কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বিই পাশ করে চাকরি জীবনের শুরু। প্রথম কাজ ভারী নির্মাণ সংস্থা হেড রাইটসনে, শেষ কাজ টার্নকী ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ায় ডিরেক্টর পদে। ১৯৯৭ থেকে অবসর জীবন, মাঝে মাঝে ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি।
১৯৭২ সালে প্রথম সাহিত্য পত্রিকা 'রোমাঞ্চ'-তে গল্প প্রকাশিত হয়। এরপর টানা কুড়ি বছর (১৯৭২-১৯৯২) 'রোমাঞ্চ' পত্রিকায় রহস্য, অলৌকিক, বিজ্ঞানভিত্তিক, রূপকথা ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় হাজার দেড়েক পাতা ছোটো ও বড়োদের উপযোগী কাহিনি লিখেছেন। ১৯৯২ সালে 'রোমাঞ্চ' পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দশ বছর লেখা বন্ধ ছিল। অনিশ দেব আবার লেখা শুরু করান ২০০১ সালে। 'রোমাঞ্চ' ছাড়া লিখেছেন 'সাপ্তাহিক বর্তমান', 'পরমা' ইত্যাদি পত্রিকায়। মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র দময়ন্তী দত্ত গুপ্ত ও খুদে গোয়েন্দা সাগর রায় চৌধুরী-কে নিয়ে লিখেছেন অনেক কাহিনি।
সাহিত্যের অনুপ্রেরণা আগাথা ক্রিস্টি, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ঘোর নাস্তিক হলেও ইতিহাসের সন্ধানে পড়তে ভালোবাসেন ধর্ম সংক্রান্ত বই। এককালে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবলের মতো সব খেলাতেই ছিলেন পারদর্শী রসিক এই মানুষটি ভালোবাসেন ক্লাসিক গান, ভ্রমণ ও আড্ডা। তাঁর উল্লেখযোগ্য অধুনা-প্রকাশিত কিছু বই হল 'এবং কালরাত্রি', 'কালসন্ধ্যা', 'রহস্যসন্ধানী দময়ন্তী সিরিজ' প্রভৃতি।
প্রাপ্তবয়স্ক তথা প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের জন্য লেখা মোট পাঁচটি কাহিনি আছে এই বইয়ে। তারা হল~ ১) প্রথম পাপ: সমাজের একেবারে উপরের স্তরের বাসিন্দা এক মহিলা দময়ন্তীর কাছে এসে জানালেন, তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে। কিন্তু কে করছে, কেন করছে— তার কিছুই বললেন না তিনি। দময়ন্তী কি পারবেন সত্যকে উন্মোচিত করতে? নিপুণ বর্ণনা এবং লেখনীতে ভারি সুন্দর লাগল এই বড়োগল্পটি। ২) অন্ধ তামস: এক বন্ধুর নিমন্ত্রণে বিহারের এক ছোটো শহরে গেছিলেন দময়ন্তী ও সমরেশ। সেখানেই এক ভারি অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের সমাধান করার দায়িত্ব চাপল দময়ন্তী'র ঘাড়ে। হত্যাকারী কি ধরা পড়ল? এই উপন্যাসিকাটি মনস্তত্ত্ব-আধারিত রহস্যভেদের এক চমৎকার নিদর্শন। ৩) ইজ্জত: সমরেশের যুবা-বয়সের হিরো এসে বললেন, তাঁর ঘরে বারবার চোর আসছে! তাছাড়া উল্টোদিকের পরিত্যক্ত বাড়িতেও সন্দেহজনক একটি মানুষকে দেখা গেছে। দময়ন্তী কি এ-সবের পেছনে লুকিয়ে থাকা সত্য উদ্ঘাটন করতে পারবেন? এই উপন্যাসটি শুধু এই বইয়ের শ্রেষ্ঠ আখ্যানই নয়। বাংলায় প্রথম, তৃতীয় এবং ষষ্ঠ রিপু নিয়ে যত রহস্যকাহিনি লেখা হয়েছে তাদের সবার মধ্যে খুব-খুব উপরের দিকে থাকবে এ-লেখা। ৪) নীলকান্তপুরের হত্যাকাণ্ড: এক মানসিক চিকিৎসালয়ের প্রধান চিকিৎসকের স্ত্রী'র মৃত্যু হল রহস্যজনক উপায়ে। সন্দেহের আঙুল উঠল চিকিৎসকের দিকেই। তারপর কী হল? এই উপন্যাসটি যেমন জটিল, এতে বর্ণিত চরিত্ররাও তেমনই কুটিল। রেড হেরিং এবং চরিত্রের ভিড়ে গল্পটার সব সুতো মাথায় রাখাই কঠিন। তবে শেষটা পড়ে একটা "বেশ হয়েছে!" অনুভূতিই জাগে। ৫) ভগ্ন অংশ ভাগ: শিল্পের জগতে প্রবাদপ্রতিম এক প্রৌঢ় দময়ন্তীকে জানালেন, তাঁর পুত্রের পরিচালনাধীন প্রতিষ্ঠানে ঘটছে অন্তর্ঘাতের ঘটনা। কে করছে এই কাজ? তার অন্তিম লক্ষ্য আসলে কী? শিল্প তথা বাণিজ্যের পটভূমিতে তৃতীয় ও ষষ্ঠ রিপুর ক্ষুরধার খেলা দেখা গেছে এই রুদ্ধশ্বাস কাহিনিতে।
রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি ঠিকমতো লেখা যে কত কঠিন কাজ, তা এই ব্যাপারে সচেষ্ট বহু মহারথী সাহিত্যিকের লেখা পড়লে হাড়ে-হাড়ে বোঝা যায়। কিশোরপাঠ্য কাহিনিতে তবু গুপ্তধনের সন্ধান বা ফর্মুলা-চুরি গোছের ব্যাপার নিয়ে কোনো দাদা বা কাকাকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের জন্য লিখতে গিয়ে অধিকাংশ লেখক বিছানায় ছানা কাটা আর মনস্তত্ত্বের আলো-আঁধারির মাঝে ভারসাম্য রাখতে না পেরে একেবারে ল্যাজেগোবরে হন। সেই পটভূমিতে একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলোচ্য বইটি। এতে ষড়রিপুর সোচ্চার উপস্থিতি নিপুণভাবে পরিবেশিত হয়েছে বাস্তবানুগ চরিত্রচিত্রণ, সমাজচিত্রের বর্ণনা এবং মিত রসবোধের সাহায্যে। রাহুল ঘোষের অলংকরণে সমৃদ্ধ, সুমুদ্রিত বইটি লেখা ও লেখনীর প্রতি সুবিচার করেছে। যদি 'বড়োদের' রহস্য কাহিনি পড়তে আগ্রহী হন, তাহলে এই বইটিকে কোনোমতেই উপেক্ষা করবেন না।
সাসপেন্স আর টুইস্টের যুগলবন্দীটা কেন যেন জমলো না। দময়ন্তী নামের সাথে যে একটা চারিত্রিক দৃপ্ততার ভাইব পাওয়া যায়, সেটার খোঁজ তার রহস্য সমাধানের ক্ষেত্রে করেছিলাম কিন্তু ব্যর্থ।