শস্ত্র-আখড়া ছেড়ে ভিনদেশে শস্ত্রীর মামুলি চাকরি বীরের পোষায়নি। আর পোষাবেই বা কেন, যেখানে আখড়ায় সে চূড়ান্ত প্রশিক্ষণ নিয়েছে তেজোসৃপবধের ওপর?
ওদিকে সুদূর শুক্তি নগরে গণিতবাগীশ জলিলিও জলিলি সুখে থাকতে ভূতের কিল খেয়ে উদ্ভাবন করে বসলেন এক আজব কল, যাকে তিনি নিরুপায় হয়ে ডাকেন ‘আকাশে-উড্ডীয়মান-তেজোসৃপের-দৃশ্য-চক্ষুর-সম্মুখে-আনয়নপূর্বক-ভূমি-হতে-পর্যবেক্ষণের-যন্ত্র’ বলে।
এ এমন এক অচেনা পৃথিবীর গল্প, যার আকাশ শাসন করে তেজোসৃপ, আর মানুষ তেজোসৃপের ভয়ে গুটিসুটি হয়ে বাঁচে নানা ভূখণ্ড জুড়ে। নিয়তির অমোঘ জালে জড়িয়ে বীর পা বাড়ায় সাত সাগর আর তেরো নদীর ওপারে শুক্তি নগর বরাবর; হেঁয়ালি আর বিপদে ভরা তার যাত্রায় একের পর এক এসে জুটতে থাকে বিচিত্র সব চরিত্র। ওদিকে জলিলিও জলিলি চেনা নগরে ক্রমশ অচেনা সব বিপদের মুখোমুখি হয়ে টের পান, অঙ্কই সকল আতঙ্কের মূল।
বাংলা সাহিত্যে বিশাল পরিসরে জগৎসজ্জাকেন্দ্রিক ফ্যাণ্টাসি গল্প বিরল; সে অভাব খানিকটা হলেও পুষিয়ে দেবে এ সরস কল্পনোচ্ছল বইটি। 'তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা'র বর্ণিল ভুবনে পাঠক স্বাগত।
শেষ কথাটি দিয়েই শুরু করি তবে - বাংলা ভাষায় এমন বই আমি আগে কখনো পড়িনি।
আমি বেশ অনেক দিন ধরে রিডার্স ব্লকে ভুগছি। কোন বই পুরোটা শেষ করতে পারি না, খানিকটা পড়ে আর মন বসে না, ফেলে রাখি। সেই আমি আচ্ছন্নের মত এই বই পড়ে শেষ করলাম এক সপ্তাহের মধ্যে, নাওয়াখাওয়া রান্নাবান্না কাজকর্ম সব শিকেয় তুলে। কী নেই এখানে? 'ফ্যান্টাসি-অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার-রোমান্স-হিউমার' কিছুই যে বাদ যায়নি। চেনা পৃথিবীর বাইরে নতুন একটি ফ্যান্টাসির জগৎ, যে জগতের অধিবাসীরা এখনো তাপগতিবিদ্যার যুগে পৌঁছায়নি। এ জগতে একেকটি ভূখন্ড, একেকটি নগরী একেক রকম- বিচিত্র তাদের অধিবাসী, বিচিত্র তাদের ভাষা, পোশাক, রীতিনীতি। জাদু-বিজ্ঞান-ধর্ম-অর্থ-রাজনীতির কুটিল খেলায় তারা জড়িয়ে আছে। আকাশ দাবড়ে বেড়াচ্ছে তেজোসৃপ, সাগরে জলদস্যু। 'বংদেশ' নামের ভূখণ্ডের এক তরুণ শস্ত্রী বীর বের হয়েছে তেজোসৃপবধের সংকল্পে। তার চোখ দিয়ে আমিও সে অচিন বর্ণিল জগতের রস আস্বাদন করতে থাকি। বীরের বিপদসংকুল পথের সাথী হয়ে আমিও পদে পদে শিহরিত হই। ওদিকে সমান্তরালে চলতে থাকে শুক্তি নগরের বিজ্ঞানী জলিলিও জলিলির আজব কল আবিষ্কারের বিড়ম্বনা - শুক্তি নগরের অভ্যন্তরীণ জটিল রাজনীতি এবং প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সাথে ঘাত-প্রতিঘাতের প্রতিচ্ছবি ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকে চোখের সামনে।
'আগুনি'র প্লট অসামান্য, কিন্তু তার চাইতেও আমার যেটা বেশি ভালো লেগেছে তা হলো মাহবুব আজাদের লেখনী। তাঁর ভাষা অনবদ্য। মাহবুব আজাদ এক অনন্য কল্পনার পৃথিবী রচেছেন, যে জগৎ পুরোটাই নতুন, অথচ লেখকের পুঙ্খানুপুঙ্খ কিন্তু সাবলীল বর্ণনার গুণে তা মানসচোখে কল্পনা করতে একটুও বেগ পেতে হয় না। যাঁরা ইংরেজি ফ্যান্টাসি পড়েন, তাঁরা জানেন, এমন অনেক ইংরেজি শব্দ আছে যেগুলো আমরা ইংরেজি উপন্যাস বা মুভিতে হামেশাই পড়ছি, শুনছি, কিন্তু সেগুলো বাংলায় আমাদের আপন হয়ে ওঠেনি। এ রকম বিশাল ব্যপ্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ফ্যান্টাসি তো বাংলা সাহিত্যে আগে কখনো লেখাও হয়নি। 'আগুনি'র পৃথিবী একটি নতুন পৃথিবী, বাঙালি লেখকের হাতে তা গড়ে উঠেছে, কাজেই তার অধিবাসীদের মুখে বাংলা বুলিই থাকবে। সেই বুলিতে আড়ষ্টতা থাকলে পাঠকের মনোযোগ থাকতো না। অত্যন্ত দক্ষ হাতে মাহবুব আজাদ প্রয়োজনীয় বিদেশী শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজে খুঁজে ব্যবহার করেছেন, দরকার হলে নতুন শব্দ প্রবর্তন করেছেন। প্রতিটি শব্দই একেবারে যথার্থ হয়েছে। ড্রাগন যেমন হয়েছে তেজোসৃপ - বাকি শব্দগুলোর উদাহরণ আর দিলাম না, যাঁরা শব্দের খেলা ভালোবাসেন, তেমন পাঠকদের জন্য চমক হিসেবেই নতুন শব্দগুলো থাক। শুধু শব্দই নয়, এই নতুন পৃথিবীতে তো আমাদের পৃথিবীর চলমান প্রবাদ প্রবচন বাগধারাও চলবে না। তাই মাহবুব আজাদ ওগুলোও নিপুণভাবে তৈরি করেছেন তাঁর জগতের ইতিহাস ও কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্য রেখে।
এই বই লেখক উৎসর্গ করেছেন সুকুমার রায় এবং টেরি প্র্যাচেটকে। তিনি হেঁটেছেনও সুকুমার এবং প্র্যাচেটের পথে। মাহবুব আজাদের অন্যান্য লেখা পড়ার সুবাদে আমি এমনিতেই তাঁর হিউমারের ভীষণ ভক্ত। 'আগুনি'তেও তিনি আমাকে নিরাশ করেননি। অসম্ভব মজার মজার সংলাপ, কবিতা এবং গান রয়েছে এই বইয়ে। সে সব সংলাপ, গান আর চরিত্রগুলোর নামকরণের মাঝ দিয়ে আমাদের সাহিত্য, সমকালীন ঘটনা আর পপ কালচার মুচকি হেসে উঁকি মেরে যায়। পড়লে না হেসে পারা যায় না। একটা জায়গা পড়ে এত জোরে হেসে উঠেছি যে আমার মেয়ে চমকে ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে।
এটি প্রাপ্তবয়স্কদের উপন্যাস, ছেলেবেলার ডালিম কুমার সুয়োরানী দুয়োরানী ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী নয়। এই ব্যাপারটাতে এসে কিছু জায়গায় আমার মনে হয়েছে প্রাপ্তমনস্ক পুরুষ পাঠকদের কথা লেখক মাথায় রেখেছেন বেশি, সমরে এবং রমণে যেখানে পুরুষই বেশি সক্রিয় (মূল নারী চরিত্রদের কথা বাদ দিয়ে বললাম)। তবে 'আগুনি'র পটভূমি যে সময়ে দেখানো হচ্ছে, সে সময়কার সমাজের মানসিকতা হয়তো এরকমই থাকার কথা।
সব মিলিয়ে 'আগুনি' আমার কাছে ভীষণ সুখপাঠ্য মনে হয়েছে। বই পড়তে পড়তে দুইদিন রান্না না করে টেইক-আউট খাওয়াটা একদমই বিফলে যায়নি!
দ্বিতীয় খণ্ডের অপেক্ষায় রইলাম। মাহবুব আজাদকে অনন্ত শুভ কামনা।
পড়তে পড়তে কতবার যে হাহহাহা হিহিহি করে হেসেছি তার হদিস নেই। অন্যদিকে ভাষার ওপর লেখকের দখল দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি। হিউমার করার জন্য তার পুরো বাক্যও লাগে না স্রেফ একটা শব্দ খরচই যথেষ্ট! কি আশ্চর্য!!
চিন্তা করেন... বইয়ের সবচেয়ে ভয়ংকর, উত্তেজনাকর অবস্থায় আছেন... মানে একদম বাঁচা-মরার লড়াই টাইপ জায়গায়.. শ্বাসটা পর্যন্ত ফেলার টাইম নাই বইয়ের চরিত্রগুলার জানি কী দফারফা হয়ে যায় এই বেলা! এমন সময় এমন একটা কান্ড কিংবা এমন কোন একটা শব্দের কারুকাজ.. আপনি অই সিরিয়াস মুহূর্তেও হো হো করে হেসে উঠবেন। আগুনি পড়বেন অথচ কখনও কখনও ফিক ফিক করে কিংবা কখনও হো হো করে হেসে উঠবেন না.. তা হবে না তা হবে না। এমন অনেকবার হইসে হাসির দমক সামলাতে না পেরে বিদঘুটে শব্দ করে আম্মুর ঘুম ভাঙ্গায় ফেলসি।
আগুনি বইটার রিভিউ বা পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে যেয়ে নিজেকে জলিলিও জলিলি মনে হচ্ছে। যে কী না কঠিন কাজগুলো এক দুই বিপলে করে ফেলতে পারলেও সহজভাবে গুছিয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে জানে না... আমার কাছে ক্যান যেন মনে হয় লেখালেখির জগতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো ফ্যান্টাসি জনরার লেখা। শুধু বইয়ের কাহিনি লিখে ফেললেই হয় না.. পুরো আস্ত একটা জগৎ নির্মাণ করতে হয়। চাট্টিখানি কথা!!! আগুনি জগতে লেখক যে শুধু সেই কাজটা করতে পেরেছে তা না.. বরং 'জঙিয়া তলোয়ার'-এর মতোই মসৃণ ভঙ্গিতে করেছেন। এই বইটার প্রতিটা চরিত্র, একেকটা দেশ, একেকটা চরিত্রের কার্যক্রম, উত্থান-পতন, লেখকের লেখার ধরণ, ভাষাগত মাধুর্য ইত্যাদি ইত্যাদির প্রশংসা করে করেই কেবল পাতার পর পাতা লিখে ফেলা যায়.. আগুনি আমার কাছে কিছুটা আবেগের নামও। কীভাবে বইটার খোঁজ পেয়েছিলাম সেটা এখন আর মনে নাই কিন্তু এই একটা বই.. যেটা পড়তে না পেরে কিছুদিন পর পর বইয়ের রিভিউগুলা পড়ে আসতাম। অন্তর্জালে পড়ার জন্য আবেদন করে রেখেছি সেই কবে থেকেই.. সাড়া পাইনি। সেই অপেক্ষা অবশেষে রিজওয়ান ভাইয়ের কল্যাণে শেষ হইলো... ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করতে পারব না। একদিক থেকে এখন মনে হচ্ছে ভালোই হইসে, নয়তো অভিযানের আদ্ধেক পরে মেইল আসার অপেক্ষায় হা পিত্যেশ করে বসে থাকার চেয়ে এক সাথে এক বসায় অখন্ড মনযোগ নিয়ে কাপ্তানের নেতৃত্বে বীরদের সাথে অভিযানে রওনা হয়ে যাইতে পারসি.. মন্দ কী?
প্রথম খন্ড পড়ার পর মন দ্বিতীয় খন্ডের জন্য আকুলিবিকুলি করতেসে... আর আমি যদিও অনলাইনে কিংবা পিডিএফে বই পড়ে অভ্যস্ত তাও কোন বই বেশি ভালো লাগলে সেটা আমার বুকশেল্ফগত না হইলে শান্তি লাগে না.. কাজেই, এখন থেকেই নির্দিষ্ট বাজেট আর বইয়ের তাকে একটা অংশ রেখে দিতে হবে.. যদি কোনদিন আগুনি প্রিন্ট বই হিসেবে পাই... ইশ! যদি পাই 💔💔 মধুদামাদের ঘ্যানঘ্যানানি মিস করব.. প্রচন্ড রকমের মিস করব.. বাবাবতুতার কোবতেও 😂 আমার পড়া সবচেয়ে ভ্যাবলা নায়ক সম্ভবত বীর.. আর কাপ্তান তো কাপ্তানই.. ❤️ সেনাপতি নাপো আর কাপ্তান অন্যরকম ভালোলাগার দুইটা চরিত্র। গণককে তলব করতে হবে.. একটু গ্রহ নক্ষত্রটা দেখে যেন বিচার করে দেয়.. লেখক কবে নাগাদ দ্বিতীয় পর্বটা লিখবেন..
বই শেষ ঠিক আছে.. কিন্তু আবার পড়ব ❤️❤️ লেখকের জন্য বেশ বড়সড় একটা ঢালেবাড়ি ❤️
#Re_Read
কোনমতে বোধ হয় একটা বছর পার করেছি আগুনি পড়া শেষ করে। লেখক সাহেব সেই ২০২০ সালে বইয়ের প্রথম খন্ড লিখে শেষ করে দ্বিতীয় পর্ব লেখার কথা বেমালুম ভুলে গেলেন নাকি এখনও কাহিনিইই গুছাচ্ছেন আল্লাহমাবুদ জানেন। তাএ একটু শান্তি লাগতো বইটা হার্ডকভারে পাওয়া গেলে 💔 বীর, গণক, মধুদামাদ, সৎ-পরিশ্রমী-অধ্যাবসায়ী নাবিক- কাপ্তান চাবুকমারু, সেনাপতি নাপো, জলিলিও জলিলি... এদের সবাইকে এতো এতো এতো মিস করতেসিলাম.... আবার শুরু করলাম আগুনি। অভিজ্ঞতা? সেই প্রথমবার পড়ার মতো। কখনও খিক খিক করে, কখনও হো হো আশেপাশের মানুষের বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে হেসে উঠা... উফফ! 'আগুনি পড়ার দিনগুলি' নামে একটা বই লেখা হয়ে যেতে পারে ফর শিওর।
ও লেখকভায়া... প্লিজ.. পরের পর্ব লিখেন.. অপেক্ষা তো আর ভাল্লাগেনা....
বি.দ্র. দ্বিতীয় বার পড়তে যেয়ে আরেকটা (খুবই গুরুতর ঘটনার) মিসটেক চোখে পড়ছিল.. আমি আরেহহহ! এই নির্ভুল লেখায় ভুল পাইসি ভেবে নগদে স্ক্রিনশট নিয়ে ভাবসিলাম এইবার ব্যাপারটা একটু আলোচনা করা লাগে। পরের অধ্যায়েই ব্যাপারটা লেখক এত্তো সুন্দর করে সামাল দিয়েছেন! মনে হইলো, পাঠকেরও ভুল না, লেখকেরও না, টাইম লাইনের জন্য ভুল মনে হয়েছে। আর তখন আরও একবার আগুনির প্রেমে পড়ে গেলাম দ্বিগুণ উদ্যমে.. ❤️
নাদের আলী... আর কতো বছরের অপেক্ষা করলে আসবে এর পরের পর্ব? 💔💔💔
"তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা" গ্রন্থমালার প্রথম খণ্ড "আগুনি" নিয়ে কিছুমিছু লিখতে বসলাম। নিজের ভাষাগত সীমাবদ্ধতা আর শব্দভাণ্ডারের রুগ্নতা নিয়ে এই সুবিস্তৃত পরিসরের মৌলিক সৃষ্টির প্রতি সুবিচার করতে পারবো - এমন সম্ভাবনা শূণ্যের কোটায়। কাজটা আমার জন্য তাই কিছুটা অস্বস্তিকরও। তবে হিং ভূখণ্ডের গণিতবাগীশ জলিলিও জলিলি যেমন তাঁর দূরেদ্যাখা যন্ত্রের নাম রাখেন ‘আকাশে-উড্ডীয়মান-তেজোসৃপের-দৃশ্য-চক্ষুর-সম্মুখে-আনয়নপূর্বক-ভূমি-হতে-পর্যবেক্ষণের-যন্ত্র’, অনেকটা সেরকম ভাষাতেই আগুনি নিয়ে টুকটাক আলোচনা করাই যায়।
লেখাটা খানিক পক্ষপাতদুষ্ট হবে – প্রথম কারণ আমি “এপিক ফ্যান্টাসি”র বিশেষ ভক্ত। দ্বিতীয় কারণ “বাংলা ভাষায়” এটাই আমার পড়া এবং দেখা প্রথম ও একমাত্র বই যাকে এই শ্রেণীতে ফেলা যায়। বাংলা ভাষা-কে আগের বাক্যে ঊর্ধ কমার মাঝে রাখার বিশেষ কারণ আছে। ১২৯৬ পাতার এই বইয়ে লেখক প্রতিটা শব্দ রচনা করেছেন বাংলায়। প্রয়োজনে নতুন শব্দ বানিয়ে নিয়েছেন (প্রায় শত শত), বিলুপ্তপ্রায় বাংলা শব্দকে পরম যত্নে তুলে এনেছেন, ভিন্ন ভাষা থেকে আসা প্রচলিত শব্দগুলোকেও যেন বাংলার মোড়কে মর্যাদার স্থান দিয়েছেন। এবং তারপরেও পড়তে যেয়ে হোঁচট খেতে হয়নি একবারও। উদাহরণ দেয়া যাক। বাঙ্গালির দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার কোনো গল্প বা উপন্যাস সম্ভবত নেই। ফলে সুমদ্রযাত্রা নিয়ে ভিন্ন ভাষায় পড়া গল্পের গ্যানেট আর অ্যালবাট্রসকে তাই দূরের ভিনদেশী পাখি মনে হয়। লেখকের কলমে তারা যখন হয়ে ওঠে ডুবসড়কি আর চাঁদোয়াডানা তখন যেন অনেক আপন হয়ে আসে। পাল আর মাস্তুলের সংখ্যা এবং বিন্যাসের ভিত্তিতে ভাগ করা “গামিনী”, “ধারিণী”, “প্লাবিনী”, “বেগিনী” ইত্যাদি জাহাজের চিত্র কল্পনা করেও প্রচুর আনন্দ পেয়েছি।
এটা এমন একটা জগৎ যার খাদ্যশৃঙ্খলের সর্বোচ্চে পর্যায়ে দাপটের সাথে রাজত্ব করে তেজোসৃপ। প্রাক-তাপগতিবিদ্যার সেই সময়ে, যখন জাদু আর বিজ্ঞানের মাঝে রেখাটা মলিন হয়ে আসছে, সেই রহস্যময় সময়ে বং ভূখণ্ড থেকে তেজোসৃপবধের সংকল্প নিয়ে তরুণ শস্ত্রী বীরের অং সায়র, টিং সায়র পারি দিয়ে, মরুময় ছট ভুখন্ডের গিরি-উপত্যকা পেরিয়ে, লাল সায়র হয়ে আরও উত্তরের সবুজ সায়রের পারে শুক্তিতে পৌঁছানোর যাত্রা যেন ফ্রোডো ব্যাগিন্স আর স্যামওয়াইজ গ্যামজির শায়ার থেকে মর্ডরে যাওয়ার মতই মহাকব্যিক। আবার ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে থাকা শুক্তির বহুমাত্রিক আর বহুপাক্ষিক ভূ-রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও জাদুচর্চাকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র-জটিলতা-কুটিলতার সাথে তুলনা দেয়া যায় সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ারের বিস্তৃত পটভূমির।
আশ্চর্যের ব্যাপার, গল্পটা মুহূর্তের জন্যও “ঝুলে” যায়নি। এতগুলো চরিত্রের বিকাশ, পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, সম্পূর্ণ নতুন একটা পৃথিবীর বিশাল পটভূমি আর মানচিত্রকে পাঠকের কল্পনায় দৃশ্যমান করে তোলা, ভূখণ্ড ভেদে রসনা বিলাসের অদ্ভুত সব আয়োজন, বর্ণিল চরিত্রগুলির ততোধিক বর্ণিল নামকরণ, এলাকাভেদে বিচিত্র সব রীতি আর ধর্ম – সবমিলিয়ে যেন এক মাস্টারপিস! আগ্নিদেবী দাউদাউ, মরুদেবতা ধুধু, জলদেবতা কলকল, বাতাসের দেবী হুহু, চান্নিঠাকুর আর সুজ্জিঠাকুর – সবার অনুসারীদের নিয়ে এ এক আশ্চর্য পৃথিবী। আবার এদের মাঝেই চেনা পৃথিবীর অতীত ইতিহাস থেকে থেকে উঁকি দিয়ে মুচকি হাসে।
নামকরণ নিয়েই মোটামুটি আরেকটা অধ্যায় রচনা করা যায়। শস্ত্রাচার্য ভীষণকিল, চরনায়ক উৎকর্ণক, নগরপাল ঋজুকদম, হিমহিজলের কাঠ, মামুট বাহিনী, তুষারমূষা, শুক্তির দশচক্র, দাউদাউমার্গের কিরিয়াকন – তালিকা অনেক দীর্ঘ। বরং সেই আনন্দ পাঠকের জন্য তোলা থাকুক।
তবে এত কিছু যদি দরকার না থাকে তারপরেও বইটা পড়া যেতে পারে। শুধু একটা রহস্যোপন্যাস হিসাবে, বা নিখাদ অ্যাডভেঞ্চারের বই হিসাবে, বা স্রেফ একটা রূপকথার গল্প হিসাবে বা উচ্চমার্গের একটা সাহিত্যকর্ম হিসাবেও পড়া যায়। যে আশা নিয়েই পড়া হোক – হতাশ হবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। মাহবুব আজাদের প্রথম বইয়ের নাম ছিল সম্ভবত ম্যাগনাম ওপাস। তবে আগুনিকেই তাঁর ম্যাগনাম ওপাস বলবো আমি। লেখকের প্রতি টুপি-খোলা-কুর্ণিশ রইলো।
প্রথম খন্দ পড়ার অভিজ্ঞতা অনন্য। গল্পের বই পড়ে আমাদের যে পড়াশোনা শুরু বড় হতে হতে জ্ঞানের অন্বেষণ,সাহিত্য,জীবন,দর্শন নানা ভারিক্কি খোজের আড়ালে গল্প পড়ার মজা ভুলেই গিয়েছি। এই বইটা আমাকে আবার আমাকে মনে করিয়ে দিল কেন বই পড়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু এমন ভাবে প্রথম খন্ড শেষ হলো দ্বিতীয় খন্ড পড়ার আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর ভাবে গেথে রেখে গেলো। জানিনা কবে পড়তে পারবো দ্বিতীয় খন্ড। আদৌ পড়তে পারবো কিনা। কেউ কি জানেন দ্বিতীয় খন্ডের কি খবর?
প্রথমেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি বলে নিই - আগুনি পড়া যাচ্ছে অন্তর্জালেই, এই ঠিকানায় - বিনামূল্যে। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি, পড়া শেষ হলে পাঠক এর উপযুক্ত মূল্য চুকোতে কসুর করবেন না! https://golpodroom.com/books/aguni
লেখার বাকি অংশটুকু না পড়লেও ক্ষতি নেই। পাঠক হিসেবে আগুনির সাথে যে আনন্দদায়ী, শিহরণজাগানিয়া অবিস্মরণীয় যাত্রার অভিজ্ঞতা আমার হলো, তার কিছুটা টুকে রাখতেই এই লেখার অবতারণা। ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
তেজোসৃপ - সে আবার কী? এমন শব্দ তো শুনিনি। সরীসৃপের গণ্ডি পেরিয়ে আরো কিছু যে থাকতে পারে, আমার দরিদ্র শব্দভাণ্ডার এ ভাবেনি কখনো। হায়, যদি জানতাম কার পাল্লায় পড়েছি, আর সামনে কী অপেক্ষা করছে! যতবার একেকটা নতুন শব্দ চোখে পড়েছে, লেখককে মনে মনে কুর্নিশ করেছি। প্রায় ১৩০০ পৃষ্ঠার একটা বই লেখা সম্ভব কারো পক্ষে কোন ইংরেজি শব্দের ব্যবহার ছাড়াই, তাও আবার এ যুগে এসে, ভাবতেই ঘাম ছুটে যায়, লেখা তো পরের ব্যাপার।
মাহবুব আজাদের লেখার সাথে পরিচয় সচলায়তন এবং আশাকর্পূরে। উঁচু রসবোধ এবং দুষ্টু কথায় পারঙ্গম তিনি। শব্দ নিয়ে খেলা করার অভ্যাস তাঁর আছে এটা জানতাম। কিন্তু সে অভ্যাসকে তিনি এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তা জানা ছিল না। পাঠকের সাথে লেখকের যোগসূত্র স্থাপিত হয় লেখার মাধ্যমে। মনোযোগী পাঠক ঠিক ঠিক ধরে ফেলতে পারেন লেখকের যত্নটুকু; লিখতে গিয়ে তার যে সময়-শ্রম-মেধা ব্যয় হয় তার প্রতিফলন লেখায় ধরা পড়ে ঠিকই। আর ফাঁকি দিতে চাইলে তা-ও নজর এড়ায় না। এ জায়গায় মাহবুব আজাদ ছাড় দেননি এতটুকু। কেবল বিদেশী শব্দের বাংলাকরণ নিয়ে তিনি যে জাদু দেখিয়েছেন, অতটুকুই যথেষ্ট পাঠককে বিমোহিত করার জন্য, গল্পের পটভূমি, কাহিনীবিন্যাস, চরিত্রের কথা তো বাদই দিলাম। আমি নিশ্চিত বলতে পারি, বাংলা ভাষায় আগুনি স্থান করে নিতেই এসেছে।
অপেক্ষা করছি ছাপা মুদ্রণের জন্য। মুঠোফোন আর কম্পিউটারের পর্দায় আগুনি পড়ে আশ মিটছে না। বইয়ের তাকে সাজিয়ে রেখে আর মাঝে মাঝে উল্টে পাল্টে “কলাগাছের ভেলায় ভাসা মেয়ে” পড়ার জন্য হলেও বইটা ছাপার হরফে চাই।
পরিবেশক গল্পদ্রুম বিনামূল্যে বইটি অনলাইনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে টুকরো করে করে পড়ার কারণে একটি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি যা সমাধান করা যায় খুব সহজেই। বইয়ের একেবারে শেষে যে নির্ঘণ্টটি জুড়ে দেয়া হয়েছে, আগুনির আন্তর্জালিক ঠিকানায় তা যুক্ত করে দিলে পাঠক হিসেবে আগুনির রস উপভোগে সুবিধা হবে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই নতুন শব্দের ব্যবহার স্থাল-কাল-পাত্রভেদে একেবারে মানিয়ে গেছে এবং অর্থ বুঝতেও ততটা অসুবিধা হয়নি। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরকম নির্ঘণ্টের অভাব বোধ করছিলাম। বইয়ের শেষ খণ্ডে এসে তার দেখা পেলাম বটে, কিন্তু ততক্ষণে বই তো পড়া শেষ। দ্বিতীয়ত, একটা মানচিত্র যদি যুক্ত করা যায়, কল্পনার তরী নিয়ে সায়র থেকে সায়রে ভেসে বেড়ানো অনেকটা সহজ হতো। যা হোক, মনে হচ্ছে নির্ঘণ্ট আর নিজের আঁকা মানচিত্র সম্বল করেই আরেকবার আগুনিতে নেমে পড়তে হবে, ভালো বই তো বারবার পড়া-ই যায়, তাই না?
অবশেষে শেষ হলো তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা #1 সিরিজের সুদীর্ঘ ১৩০০ পাতার প্রথম বই ‘আগুনি’ নিয়ে আগুনি দেয়া। প্রথমেই একটা কথা বলে নিতে চাই। আমি বাংলায় ফ্যান্টাসি উপন্যার পড়ুয়াদের দুই ভাগে ভাগ করতে চাই। যারা ‘আগুনি’ পরেছেন আর যারা পড়েননি।এর মাঝে আর কোন যদি কিন্তু নাই। কেন নাই যারা পড়েন নাই তারা পড়লেই বুঝবেন। যেমনটা আমি হতভাগা নিজেও বুঝি নাই এতদিন।
এই কয়েক সপ্তাহ অফিস করেছি,বাসায় গেছি, পরের দিন অফিস গেছি। রুটিন চলেছে রুটিনের মতো। কিন্তু একদিনও ‘আগুনি’ থেকে চোখ সরাইনি। বলা ভালো সরাতে পারেনি। বাংলা ফ্যান্টাসি সাহিত্যে এমনতরো বই আগে কখনো আসেনি আসবেও না। এমনই চমৎকার তার কাহিনী এবং লেখনী।
আমাদের দেশে ফ্যান্টাসি সাহিত্য বর্তমানে হাঁটিহাঁটি পা পা করছে। ভালো কোন ফ্যান্টাসি পড়তে গেলে সেই বিদেশী সাহিত্যের দিকে হাত বাড়াতে হয়। না বাড়িয়েও উপায় নেই। বাংলায় ফ্যান্টাসি বই তো আছেই হাতেগোনা। তাই নতুন অনেক পাঠক চাইলেও বাংলা ফ্যান্টাসি পড়তে পারেন না। অনেকে হাতেগোনা যেগুলো আছে সেগুলো পড়ে ফ্যান্টাসির প্রতি আগ্রহ পায় না। আমার মতে তাদের সবাইকে(মানে যারা নতুন ফ্যান্টাসি পাঠক আছেন) অন্য ফ্যান্টাসিগুলো পরে সাজেস্ট করে সবার আগে ‘আগুনি’ সাজেস্ট করাই ভালো। এক দুই চ্যাপ্টার পড়ে ফেললে ১৩০০ পাতা কোন বিষয়ই না। দেখতে দেখতে পাতার পর পাতা উড়ে যাবে। কখন যাবে কিভাবে যাবে পাঠক নিজেও বুঝতে পারবেন না। মাহবুব আজাদের ক্ষুরধার লেখনী চুম্বকের মতো আকর্ষণ করবে। ঠিক যেমন বাবুর্চী লিংয়ের চৌমেন আকৃষ্ট করেছে শুক্তি নগরের সবাইকে। ‘আগুনি’র সবচেয়ে বড় সম্পদ মাহবুব আজাদের লেখনী। দুর্দান্ত তার ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং।দুর্দান্ত সব শব্দের খেলা। লেখক কোন বিদেশী শব্দের প্রয়োগ করেননি। প্রয়োজনে নিজেই শব্দ বানিয়েছেন। লেখকের ভাষা এক কথায় অনবদ্য। মাহবুব আজাদ এক অনন্য কল্পনার পৃথিবী বানিয়েছেন, যে জগৎ পুরোটাই নতুন,কিন্তু লেখকের পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং সাবলীল বর্ণনার গুণে তা মানসচোখে কল্পনা করতে একটুও বেগ পেতে হয় না। আগুনি আসলেই একটা ইন্টার ন্যাশনাল লেভেলের লেখনী হইছে। অনুবাদ করলে এর স্বাদ নষ্ট হবে। একমাত্র বাঙ্গালিরাই এর স্বাদ অনুভব করতে পারবেন পুরোপুরি। আগুনির প্রতিটা পাতা যেন এক একটা ক্ষীর চমচম। ললিতে মৃগতনুর মতো তুলতুলে। ‘আগুনি’র যে ভাষা কাহিনী মোটামুটি হলেও শুধু লেখনীর জোরেই ছক্কা পিটাতো। কিন্তু যেমন তার লেখনী তেমনই চমৎকার কাহিনী এবং ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং। আগুনিকে চোখ বন্ধ করে বাংলার ফ্যান্টাসি মহাকাব্য বলেই দেয়া যায়। কারণ বাংলা সাহিত্যে এমন আর আর আসবে না। আসলে মনে হচ্ছে আগুনি নিয়ে যতই লেখি লেখা ফুরাবে না। আগুনির গল্প এগিয়েছে কয়েকটা প্যারালাল প্লটে।এক্ ভাগে গল্প এগিয়েছে কাল্পনিক শুক্তি নগরকে কেন্দ্র করে। যেখানে আছেন শুক্তির সেনাপতি নাপো। নপরপাল ঋজুকদম। জাদুকরেরা। ডিম দিয়ে খোকা ফোটানো মহা পরাক্রশশালি ধর্মীয় নেতা শিফু আর তার দলবল। আছে শুক্তির চৌধুরিরা। আছে বণিক সমাজ। আর আছে অসম্ভবকে সম্ভব করা নারীলোভী নষ্টা পাপিষ্ঠ পাগলা কিন্তু জিনিয়াস বিজ্ঞানী জলিলিও জলিলি। গল্প এগিয়েছে শুক্তির রাজনীতি নিয়ে এবং তাদের কুশীলবকে ঘিরে। অন্য রাজ্যের সাথে শুক্তির রাজনীতি এবং শুক্তির ভিতরে ক্ষমতার আন্তঃরাজনীতি। ক্ষমতার পালা বদলের সবাই নিজেদের কার্য হাসিলে তৎপর। আর তার জন্যই কুটিল চাল চালতে কেউই পিছপা হয়না। শুক্তির রাজনীতি আর তাদের কুশিলবদের কুটচাল দেখে আমার মনে হয় সবাই আমোদিত হবেন। এক একটা কি দুর্দান্ত ঠাণ্ডা মাথার চাল। ‘আগুনি’তে ধর্ম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সূর্য্যিঠাকুর, চান্নিঠাকুর, আগুনের দেবী দাউদাউ, বাতাসের দেবী হুহু, দেবতা কলকলের পুজারি ‘আগুনি’র পৃথিবীর মানুষেরা। আর শুক্তি নগরে বসত গেড়েছেন দেবী দাউদাউ। আর তার প্রধান মঠ ‘কিরিয়াকন’। কিরিয়াকনের মহাপ্রতাশালী গুরুদের সাথে অসম্ভবকে সম্ভব করা নারীলোভী নষ্টা পাপিষ্ঠ পাগলা কিন্তু জিনিয়াস বিজ্ঞানী জলিলিও জলিলি’র আবিষ্কার নিয়ে দ্বন্দ্বে নাপোর ভূমিকা এবং চিপায় চাপায় বুদ্ধি খরচ করা দেখতে পাঠকেরঅ ভালো লাগবে।
আর আরেকদিকে কাহিনী এগিয়েছে বংদেশের শস্ত্র-আখড়া ছেড়ে ভিনদেশে শস্ত্রীর মামুলি চাকরি নেয়া বীর’কে কেন্দ্র করে। চাকরী তার পোষাচ্ছে না। কারণ তার মূল উদ্দেশ্য তেজোসৃপ মেরে রাজার কাছে থেকে পয়সাপাতি আর রাজকন্যা নেয়া। একে তার আখড়ার গুরু বলেছেন ‘আগুনি দেয়া’। তবে কিভাবে তেজোসৃপ মারতে হয় জানেনা বীর। তবে তেজোসৃপ মারতে কি কি লাগে সেগুলা বলেছে তার আখড়ার গুরু আচার্য্য ঝু। তাই সূর্য্যিঠাকুরের নাম নিয়ে একদিন বেড়িয়ে পড়ে যে অসাধ্য সাধন করতে। তেজোসৃপ মারতে হবে। আর তা করতে হলে তাকে যেতে হবে দুনিয়ার আরেক প্রান্তের শুক্তি নগরে। কিন্তু কখনোই না দেখা তেজোসৃপ এবং ঘর থেকে দুই পা না ফেলা বীর কিভাবে শুক্তি যাবে? ঘটনাচক্রে তার যোগাযোগ হয় চতুর উকিল মধুদামাদ এবং কাপ্তান চাবুকমারু,আর তার জাহাজে উপভিষ্ট সব ভাষায় কথা বলতে পারা বাবাবতুতার সাথে। এদের সাথে ঘর ছাড়ে বীর ‘আগুনি’ দেয়ার সংকল্প করে। উদ্দেশ্য শুক্তি নগর। পথে যেতে যেতে আঞ্ছোৎ বীরের ধীরে ধীরে বুদ্ধি খোলে। দুর্গম এই সমুদ্র যাত্রায় নানা ঘাত প্রতিঘাতের সম্মুখীন হয় বীর। আর যাকে ঘিরে প���রো ‘আগুনি’ । সেই তেজোসৃপ তো আছেই। আকাশে উড়া তেজোসৃপকে আমরা চিনি ড্রাগন হিসাবে। খাদ্য শৃঙ্খলে তেজোসৃপ সবার উপরে। গত সাতশ বছরে কেউ মারতে পারেনি তেজোসৃপ। সেই অসাধ্য সাধন করতে বীর কি পারবে? আর নাথু? বীর যেখানেই যায়,দেখা যায় তার আগেই সেই পথ তার আগেই অনুসরণ করে গিয়েছে রহস্যময় চরিত্র নাথু। কে এই নাথু? কি চায় সে? আর কাপ্তান চাবুকমারু? তারই বা কি উদ্দেশ্য? মহাকাবিক্য এই বই নিয়ে আসলে লিখতে গেলে দশ বিশ পাতাতেও শেষ হবে না। প্রতিটা ক্যারেক্টার নিয়ে বিশ্লেষণ করার অবকাশ আছে। পরের বইয়ের জন্য এখন শুধু অপেক্ষা। আর বইটা যেহেতু এখনো ইবুক সংস্করণ পাওয়া যায়। দ্রুত বই আকারে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়ে গেলো।
বই- আগুনি (তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা #1) লেখক- মাহবুব আজাদ প্রকাশনী – ইবুক সংস্করণ রেটিং- রেটিং দিয়ে এই বইকে মূল্যায়ন করা যাবে না। এই বই রেটিং এর উর্ধে।
শুরুতেই বলে নিই এই বইটা হাতে নিয়ে আরেকবার না পড়া পর্যন্ত তৃষ্ণা ঠিক মিটবে না। 'আগুনি' পড়ার আগ পর্যন্ত আমার ধারনাই ছিলো না বাংলায় ঠিক ফ্যান্টাসি উপন্যাস লেখা যেতে পারে! আমি এককথায় মুগ্ধ এবং অভিভূত। এতো মোটা একটা বই(কল্পনা করে নিচ্ছি ঢাউশ সাইজের একটা বই হাতে নিয়ে পড়ছি) অথচ একবারের জন্যেও মনে হয়নি কোথাও এর টানটান উত্তেজনা একটুও ঝুলেছে। টানা পড়েছি, যখন থামতে হচ্ছিলো বাধ্য হয়ে তখন অধীর আগ্রহে একটু পর পর মেইল দেখছি পরেরটুকু পড়ার অনুমতি আমাকে দেয়া হচ্ছে কি না! এতো মনোযোগ দিয়ে বহুদিন পড়িনি। এমনকি, নিজের পেশাগত একটা লেখাও সরিয়ে রেখেছি আগুনির আগুনে পুড়তে, পরেরটুকু পড়ে ঠাণ্ডা হতে। আমরা সবাই কম-বেশি সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহার করার জন্য বলি বটে, লেখক মাহবুব আজাদ সেটাই করে দেখালেন। প্রায় ১৩০০ পৃষ্ঠা পড়ে একটাই ইংরেজি শব্দ আমি পেলাম, লিঙ্গুয়া টিংকা। বাকি শব্দগুলোর এতো সুন্দর বাংলা করেছেন লেখক, অভিবাদন না জানিয়ে পারা যায় না। পুরো উপন্যাসটা আমাকে চুম্বকের মতো টেনে রেখেছিলো, আর এখন পরের খণ্ড কবে পড়তে পারবো তার জন্য হাপিত্যেশ করছি। ইদানিংকার ফেসবুকনির্ভর গল্প পড়তে পড়তে যখন বিরক্তি ধরে যাচ্ছিলো বাংলা গল্প/উপন্যাসের উপর, তখন আগুনি মস্ত এক স্বস্তি দিলো। সবশেষে, বইটা মুদ্রিত হয়ে প্রকাশ হোক, এই কামনা থাকলো। থাকলো লেখকের প্রতি শুভকামনা।
‘বড়োদেন রূপকথা’ বলা ❛আগুনি❜ যে বঙ্গদেশের সবচেয়ে বিশাল আর সমৃদ্ধে ভরপুর মন ভোলানো এপিক ফ্যান্টাসি সেটা লেখকের শিষ্ট আর কুশলতাসম্পন্ন লেখার মোহে পড়ে এড়িয়ে যেতে পারি না। টানা ছাব্বিশটি দিন আমি এই ❛আগুনি❜ নিয়ে ঘুরপাক খেয়েছি। বিপুল জ্ঞান নিয়েছি, শিখেছি এবং জেনেছি। তাই দিনগুলো কখনও ভুলার না। কখনোই না। বাংলায় এমন অসামান্য ফ্যান্টাসির সাক্ষী যে কখনও হব—তা না দেখেছি স্বপ্নে না ভেবেছি কল্পনায়। দীর্ঘ ছয় থেকে সাত মাস ❛আগুনি❜ পড়তে ব্যাকুল আমি—পইপই করে এধার-ওধার ঘুরে মরেছি। শুধুমাত্র পুরো গ্রন্থটি একটিবার করায়ত্ত করার আশায়। এক পর্যায়ে ভেবে নিয়েছি ❛আগুনি❜ আর পড়া হবে না। কিন্তু মন থেকে চাওয়ার ইচ্ছা প্রবল থাকায় অবশেষে আমিও ❛আগুনি❜ দিতে (পড়তে) পেরে নিজেকে শস্ত্রীর (চরিত্র) মতো কিঞ্চিৎ সৌভাগ্যশালী যে ভাবতে পেরেছি—এই অনেক। যদিও এই শস্ত্রীর আগুনি দিতে ঢের দেরি, হয়তো পরবর্তী কোনো এক খণ্ডে এর কর্মনির্বাহ হবে।
‘তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা’ গ্রন্থমালার প্রথম খণ্ড ❛আগুনি❜। ১২৯৬ পৃষ্ঠার এই উপাখ্যানের আখ্যায়িকাকে খণ্ডে খণ্ডিত করে লিখতে গেলে বেলা ফুরোবে কিন্তু লেখা না। অল্প কথার মাঝেও যদি বিস্তারিত টেনে নিয়ে আসি; ক্ষমা করবেন। ❛আগুনি❜ কী বা কী তার কাজ সেই বিষয়ে পরে আলোকপাত করি। এই উপাখ্যানের বিষয়বস্তু নিয়ে যদি সম্যক ধারণা দিতে হয় তবে—জর্জ আর. আর. মার্টিনের ‘আ সং অব আইস অ্যান্ড ফায়ার’-এর মতো অন্যান্য এপিক ফ্যান্টাসি সিরিজের সাথে তুলনা করব! প্রশ্ন আসতে পারে—এক খণ্ড পড়ে এত বড়ো তুলনা কীভাবে দিচ্ছি? —আসলে না দিয়েও পারছি না। আমি যখন এই মহাকাব্যের ৭০০ পৃষ্ঠা অতিক্রম করি তখনই পুরোপুরি বুঝেছি যে, ❛আগুনি❜ উপাখ্যানের ক্ষমতা আছে সেইসব দুনিয়া কাঁপানো ফ্যান্টাসি সিরিজের সাথে টক্কর দেওয়ার। আর থাকবে না-ই বা কেন? এমন এপিক ফ্যান্টাসির বইয়ে আপনি প্রথমে কী খুঁজবেন—একটি জগৎ; যা অবশ্যই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। এবং সেই জগৎ আমাদের জগতের মতো প্রাসঙ্গিক কিছু দিকের মিল থাকলেও নতুনত্ব হিসেবে থাকবে দেশ বা নগররাষ্ট্রগুলোর স্বতন্ত্র ভাষা, আচার, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, খাবার, পোশাক, রাজনীতি, কূটনীতি, ধর্মচর্চা, ঋতু, পতাকা-সহ এমন অনেক বৈশিষ্ট্য যা খুব সহজে আলাদা করা যায়। কোনো দেশ বা রাষ্ট্র কেন আরেকটি রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে চলে, একে অপরকে নিপীড়ন করে এবং ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্র দখলানোর (দখল করার) প্রচেষ্টাকে যুদ্ধের ময়দানে সামিল করে; এই সবটুকু কারণ এপিক ফ্যান্টাসিতে যেমন আছে তেমনই ❛আগুনি❜-তে রয়েছে।
শুধু এতেই লেখক পুরো জগৎ নির্মাণ শেষ করেননি। ❛আগুনি❜র মূল আকর্ষণ হচ্ছে বাংলাভাষার সফল ব্যবহার। অর্থাৎ ভাষার খেলা। একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে যে এমন উপাখ্যান লেখা সম্ভব; তা ❛আগুনি❜ না পড়লে হয়তো জানা হতো না। ভাষার এত সুনিপুণ ব্যবহার আর কারুকার্য আমি যেন বহু বছর পর দেখলাম। ফিরে পেলাম জগদ্বিখ্যাত লেখকের শ্রেষ্ঠ সব লেখনশৈলীর স্বাদ। লেখক মঙ্গলকাব্যের ধারায় যে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত তা নামধাতুজ ক্রিয়ার উপযুক্ত ব্যবহার দেখে সহজে আন্দাজ করা যায়। শুধু তাই না, লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজশেখর বসু ও সৈয়দ মুজতবা আলীর আশ্বাসদায়ী প্রবন্ধগুলো থেকে যে অনুপ্রেরণা খুঁজে নিয়েছেন তা ❛আগুনি❜-তে স্পষ্ট। লেখক এ-ও স্বীকার করেছেন এই উপাখ্যান পড়ে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও ননী ভৌমিকের রচনভঙ্গির ছাপ যদি কোনো পাঠক খুঁজে পেয়ে থাকেন—তিনি নিজেকে সার্থক মনে করবেন। আমি এক্ষেত্রে বলব, লেখক শুধু সার্থক নন—সার্থকতার সকল পরীক্ষায় তিনি পাশ মার্ক থেকেও বেশি কিছু করে দেখাতে পেরেছেন। নিজের স্বতন্ত্র লিখনপদ্ধতি দিয়ে পুরো উপখ্যানটিকে যে এমনভাবে ট্রিবিউট দিয়েছেন—তা মনোমুগ্ধকর। মুগ্ধতার পূর্ণ ছাপ ❛আগুনি❜-তে রয়েছে। শুধুমাত্র এই একটি দিক বিবেচনা করলেও বিশ্বের আলোচিত ফ্যান্টাসি সিরিজগুলোর সাথে ❛আগুনি❜ এক ঘাটে জল খেতে সক্ষম। ভাবতে পারেন কেন এত তুলনা টেনে লিখছি? —শুধুমাত্র বোঝানোর জন্য এত এত উদাহরণ টানতে বাধ্য হচ্ছি এ-ই। ❛আগুনি❜ এক এবং অদ্বিতীয়। বাংলায় এমন কাজ না আগে কখনও হয়েছে আর না ভবিষ্যতে হবে। এখন পর্যন্ত আমার পড়া বাংলা ফ্যান্টাসি হিসেবে ❛আগুনি❜ সেরার সর্বোচ্চ সিংহাসনে শোভিত হবে। যারা ইতোমধ্যে ❛আগুনি❜ পড়েছে আর যারা পড়বে; দুই-ই গোষ্ঠী সমান সৌভাগ্যবান। যারা পড়তে পারেননি ধৈর্য ধরুন—ধৈর্যের ফল সব সময় মিষ্টি হয়।
❛আগুনি❜-তে আকর্ষণের কমতি নেই। ভাষার ব্যবহারের রং ছড়িয়েছে সংলাপে। বাংলা শুদ্ধ ও আঞ্চলিক ভাষা থেকে পশ্চিমবঙ্গের ভাষা পর্যন্ত লেখক সংলাপে কৌশলে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের পার্থক্য���ুলো গড়ে দিয়েছেন। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের নাম নিয়ে বললে—অং, বং, হিং, টিং, চং ইত্যাদি ভূখণ্ডের নাম আসবে। একটু সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখবেন বং মানে বংদেশ (বঙ্গদেশ)। বংদেশের ভাষা বংবুলি। লেখক ভাষাকে এখানে ‘বুলি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভাষার নিপুণতার সাথে শব্দের খেলার জন্য ❛আগুনি❜ বিখ্যাত (একদিন অবশ্যই হবে)। শব্দ নিয়ে খেলা লেখকের অসামান্য গুণ। অল্পপ্রচলিত বা অচর্চিত শব্দের আধিক্য এই উপাখ্যানে ভরপুর। তাই যারা ‘শব্দখোর’ অর্থাৎ শব্দের খেলা দেখতে পছন্দ করে এবং নতুন নতুন শব্দ জানার ও শেখার চেষ্টা করছেন—তাদের জন্য ❛আগুনি❜ পছন্দের শিরোমণি হয়ে থাকবে। পর্তুগিস, ফরাসি, ইতালীয়, চৈনিক থেকে বাংলায় আগত যত শব্দের প্রয়োগ করা যায় লেখক তা করে দেখিয়েছেন। উপাখ্যানের শেষে এই শব্দ নিয়ে আলাদা ছোটোখাটো একটি অভিধানও রয়েছে। যা কি-না শুরুতে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন বা হতা��ার কথা বললে একটি মানচিত্রের অভাব খুব বেশি ভুগিয়েছে। রাষ্ট্রের পার্থক্য আর সমুদ্রপথের রেখা আর দিকনির্দেশনার জন্য যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
❛আগুনি❜র প্রেক্ষাপট যে শুধু স্থলের ব্যবহার রয়েছে এমন নয়। লেখক সমুদ্র আর জলদস্যুর মেলবন্ধনে এই উপাখ্যান হয়েছে আরও জীবন্ত। যতটা কাহিনি স্থলের—ততটা জলেরও। সমুদ্র এখানে ‘সায়র’ হিসেবে পরিচিত। যেমন লালাসায়র, সবুজসায়র। আর নগররাষ্ট্রের নামগুলো বেশ মজাদার। এই যেমন—জাঙিয়ার জংদ্বীপ, হিং ভূখণ্ডের শুক্তি, বহমিকা, গহীনটিং, গুলঘোর দ্বীপপুঞ্জ, চিরু, নাগিস্থান, ঝিনুয়া, বংদেশের গাংডুমুর ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে হাস্যজনক হলো চরিত্রদের নাম। লেখকের মুনশিয়ানার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে এমন নামকরণের জন্য। সাধারণত বাংলা ফ্যান্টাসি বইগুলোতে নামের খটমটতার কারণে অনেক পাঠক অনাগ্রহ প্রকাশ করে বইগুলো পড়তে। শুধু নামগুলো জানা আর তাদের করণীয় কাজগুলো দেখার জন্য হলেও ❛আগুনি❜ পড়া উচিত।
বংদেশের শস্ত্রী বীর যে কি-না আগুনি দিতে বেরিয়েছে অজানার উদ্দেশ্যে। আগুনি হচ্ছে একটি পরীক্ষা। অনেকটা অগ্নিপরীক্ষার মতোই। তবে এই পরীক্ষায় কতল করতে হয় তেজোসৃপ-কে! তেজোসৃপ কী? —তেজোসৃপের পরিচয় যদি এক নামে দিতে হয় তা হলো—ড্রাগন অথবা কাল্পনিক Draco বর্গভুক্ত অগ্ন্যুদ্গারী খেচর সরীসৃপবিশেষ। এখানে লেখক এই তেজোসৃপের কয়েকটি প্রজাতি এবং তাদের কাজ এত বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন যে অবাক হতে বাধ্য। বাংলায় যা আগে কেউ কখনও এত বিস্তারিত ভাবে দেখাতে পারেনি। যাহোক, এই তেজোসৃপ বধের সংকল্পকে ❛আগুনি❜ বলা হয়। অজানার এই পথে বীর সঙ্গী হিসেবে পায় দুরন্ত আর বিচক্ষণ উকিল মধুদামাদকে (নামটা মজার না?)। লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সায়র পার হওয়া জরুরি। সেই সায়র পার হতে গিয়ে ঘটনাচক্রে পরিচয় ঘটে সারেং চাবুকমারুও (জাহাজের কাপ্তান নয় কিন্তু তবুও কাপ্তান) সাথে। একইভাবে সাক্ষাৎ হয় সকল ভাষার পারদর্শী ভিনবোন বাবাবতুতা এবং হাত দেখে ভবিষৎ বলা সত্য কথক গণকের সাথে। কথায় কথায় বীর জানতে পারে আগুনি দিতে হলে যেতে হবে শুক্তি নগরীতে!
শুক্তি নগরী হিং ভূখণ্ডের মধ্যভাগের বন্দর ও নগররাষ্ট্র। বংদেশের সীমানা পেরিয়ে সোপ্পার, লালসায়র, চেরু, সবুজসায়রের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসতে হয় শুক্তি নগরে। বীরের এখন একমাত্র উপায় চাবুকমারুর সাথে ‘মিষ্টি কুমির’-এ (জাহাজ) চড়ে বসা। শুক্তি নগরে ঋজুকদম নগরপাল হলেও সেখানে চলে বণিকচক্রের ভরপুর বাণিজ্য ব্যাবসা। আছে রক্ষাচক্র এবং আড়ালে থাকা জাদুচক্র। শুক্তির সেনাপতি নাপো হচ্ছে এই উপাখ্যানের অন্যতম একটি চরিত্র। পাশাপাশি গণিতবাগীশ জালিলিও জলিলির (গ্যালিলিও ও জলিল মামুর অসামান্য মিশ্রন) দারুণ সব গবেষণা শুক্তি নগরের গুরুত্বপূর্ণ সম্বল। এই গবেষণার মধ্যে ‘তেজোসৃপের চোখ’ অথবা ‘আকাশে-উড্ডীয়মান-তেজোসৃপের-দৃশ্য-চক্ষুর-সম্মুখে-আনয়নপূর্বক-ভূমি-হতে-পর্যবেক্ষণের-যন্ত্র’ জলিলির অসামান্য আবিষ্কারের একটি। এ-যে দূরবীক্ষণ যন্ত্র আশা করি বলে দিতে হবে না। এমন একটা তেজোসৃপের চোখ প্রয়োজন শস্ত্রী বীরের যা ব্যতীত আগুনি দেওয়া সম্ভব না। শুধু চোখ না প্রয়োজন আরও অনেক কিছু; যা বীরকে খুঁজে নিতে হবে বিভিন্ন নগররাষ্ট্র থেকে। শুক্তি নগরে দেখা যায় রাজনীতি আর কূটনীতির জবরদস্ত খেলা। ঘরের শত্রু বিভীষণের প্রবাদ এই উপাখ্যানে দারুণ খাটে। এর বাইরে শুক্তির সাথে বহমিকার শীতল যুদ্ধে বণিকচক্রের এক চক্র—লবণ চক্রের ফেঁসে যাওয়া নিয়ে নগরপালের সাথে দ্বন্দ্ব, সেনাপতি নাপোর সাথে নগরপালের নাখোশ সম্পর্ক, জলিলির আবিষ্কারে কিয়াকনের ধর্মগুরুর প্রতিবাদ সব মিলিয়ে শুক্তির বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা পদে পদে যে রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগ্রত করবে সে-কথা বলে দিতে হবে না। পড়তে বসলে শুক্তির কুয়াশা আপনা-আপনি হাড় কাঁপিয়ে দিবে।
ধর্মের বিস্তারিত আখ্যান ❛আগুনি❜-তে বিদ্যমান। বিভিন্ন দেশের দেব-দেবীও ভিন্ন ভিন্ন। তাদের উপাসনার আচারেও রয়েছে ভিন্নত্ব। শুক্তি নগরে দাউদাউ দেবীর আবাসস্থল, বংদেশে সুজ্জি ও চান্নি ঠাকুর। অন্য কোনো দেশে আছে বাতাসের দেবী হুহু।
চরিত্রের দিক নিয়ে আরেকটু আলোচনা করলে উঠে আসবে বিশেষ তিনটি চরিত্র। পুরো উপন্যাসে ত্রাস সৃষ্টি করা নাত্থু, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী চরিত্র ইরারি এবং শুক্তি নগরের ঘুম হারাম করা সুন্দরী মৃগতনু। এই তিনটি চরিত্র পুরো উপাখ্যানের অন্যান্য চরিত্রদের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একইসাথে কাহিনিকে দারুণ প্রভাবিত করতে এদের ভূমিকা অসামান্য। ❛আগুনি❜ উপাখ্যানে প্রত্যকটি চরিত্রের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একে ওপরের সাথে মিল খুব কমই খুঁজে পাবেন। লেখকের এমন চরিত্রসৃষ্টির জন্য কুর্নিশ অবশ্যই জানাতে হয়। বইটি পড়া বন্ধ করলে চরিত্রগুলো মানসপটে ঘুরপাক খেতে থাকে আর ঘুমালে বাস্তবে চলাচল শুরু করে। তারা যেন আমাকেও টেনে নিয়ে যেতে চায় ওই লালসায়রে; যে আকাশে দুটো তেজোসৃপ মিষ্টি কুমিরকে পোড়ানোর ফন্দি আঁটে। এ-এক অদ্ভুত ভালোলাগা। যা ভাষায় প্রকাশ করেও কূল করা যাবে না।
আগুনি চরিত্র পুরুষপ্রধান হলেও দুই নারী চরিত্র আলাদাভাবে নজর কাড়ে। আগামীতে মিস্ত্রিদিদি হিসেবে পরিচিত ইরারি ও মৃগতনু যে কাহিনিতে ভালো প্রভাব ফেলবে তা অনুমেয়।
❛আগুনি❜-তে রয়েছে কবিতার ছড়াছড়ি। কবিতা-কে এখানে বলা হয় ‘কোবতে’। বাবাবতুতা একজন কবি, জংদ্বীপে কবিতা প্রতিযোগিতার আসর বসে। এই কবিতার ক্ষমতাও অনেক। বলতে পারেন রীতিমতো জাদুকরী ক্ষমতা আছে। জাদুর কথা যখন এসেছে এই নিয়ে বলি। এই মহাকাব্যে জাদুর প্রয়োগ খুবই সীমিত হলেও কার্যকারিতা অনেক বেশি। ‘আগুন’ জাদুর কিছু খণ্ড চিত্র দেখা গেলেও বাকি জাদুগুলোর ভোজবাজি হয়তো আগামী খণ্ডগুলোতে দেখা যাবে। তেজোসৃপের পাশাপাশি এই উপাখ্যানে আছে কুহকিনী। রক্তচোষা তার কাজ।
যুদ্ধ কৌশল বা সমরনীতি নিয়ে বললে, এমন কিছু নেই যা লেখক বর্ণনা করতে ভুলেননি। যুদ্ধের অস্ত্র থেকে শস্ত্র সবকিছুর উদাহরণ টেনেছেন সুনিপুণ ভাবে। ক্যাল্টাপুলের নাম হয়েছে এখানে ‘ঝপাং’; যা দিয়ে গোলা নিক্ষেপ করা হয়। এই কাজ করে গোলন্দাজরা। সেই সাথে ধনুকীর কাজের নমুনা সুচারুভাবে লেখা রয়েছে। বুদ্ধির খেলা যেমন এই উপাখ্যানে আছে তেমনই আছে হাস্যরসের মেলা। লেখকের আরও একটি অসাধারণ গুণ যে তিনি খুব সহজে পাঠককে হাসাতে পারেন। আমি নিজেও ক্ষণে ক্ষণে হেসে ওঠেছি। এমন রসবোধের বই সত্য বলছি—বহুদিন পড়িনি। তাও আবার ফ্যান্টাসিতে। ফ্যান্টাসি মানে শুধু জাদু নিয়ে মারামারি, কূটনীতি নির্ভর আর ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলে রাজ্য দখল অথবা আক্রমণী কাজকারবার না; তা লেখক অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ❛আগুনি❜ অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য। আবার শুধু প্রাপ্ত বয়স্ক হলে হবে না, বাংলা ভাষা ও শব্দ নিয়ে অগাধ জ্ঞান না থাকলে এই উপন্যাস শতভাগ পাংশে লাগবে। লেখক যে ধৈর্য আর অধ্যবসায় নিয়ে বিশাল আখ্যানটি লিখেছেন তার রস পুরোপুরি আস্বাদন করতে চাইলে পাঠককেও তেমনটা ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের মূল্য চোকাতে হবে।
পরিশেষে বলব, ❛আগুনি❜ উপাখ্যান বাংলা ফ্যান্টাসির সম্পদ এবং আমাদের মতো ফ্যান্টাসি প্রেমীদের সম্পত্তি। লেখককে সাধুবাদ জানানোর ভাষা নেই, যেমনটা নেই প্রতিটি খুঁটিনাটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করার। তবে এই বই নিয়ে একটা সময় তুমুল আলোচনা হবে বলে বিশ্বাস। বইয়ের অলংকরনের কথা আলাদা করলে বলতে হয়। কাহিনির সাথে সামঞ্জস্য দারুণ সব চিত্রকর্মের কারণে কিছু অস্পষ্ট বিষয়ও স্পষ্ট রূপে ধরা দিয়েছে। চিত্রগুলো দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এমন কিছুও সম্ভবত আগে কোনো ফ্যান্টাসি বইয়ে ��য়নি। আসলে না হওয়ার সারি এতই লম্বা যে আর তালিকা করতে ইচ্ছে করেনি। এমন জিনিস হাতে নিয়ে পড়ার অনুভূতি যে কেমন হবে—তা ভাবতেই ভালো লাগা দিগুণ হচ্ছে। আশা করছি ‘গল্পদ্রুম’ বইটির পেপারব্যাক বা হার্ডকপি সংস্করণ শীঘ্রই বাজারে প্রকাশ করবে।
এমন দারুণ উত্তেজনাকর দীর্ঘ এক যাত্রা, পদে পদে বিপদ আর বাস্তবতার শিক্ষা। নগরে নগরে সংগ্রাম সেই সাথে যুদ্ধের আগমনী বার্তা। ভালোবাসার ব্যর্থ গল্প ��র আগুনি দেওয়ার সংকল্প। ভয়কে জয় করার সাহস আর শৈশবের তিক্ত স্বাদের যন্ত্রণায় লেখা ❛আগুনি❜ উপাখ্যান প্রতিটি চরিত্রের এক একটি নিজস্ব গল্প। যা অভাবনীয় আর অকল্পনীয়।
যারা ফ্যান্টাসি পছন্দ করেন অথবা না করেন; বাংলা ভাষা নিয়ে যাদের গর্ব সেই গর্বে গর্বিত হওয়ার আরও একটি সেতু এই ❛আগুনি❜। একবার এর ওপর দিয়ে হাঁটা ধরলে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। মাঝে মাঝে এমন বই পড়লেও জীবন সার্থক মনে হয়। এখন নিজেকেও লেখকের মতো সার্থক মনে হচ্ছে।
≣∣≣ বই : আগুনি [‘তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা’ প্রথম খণ্ড] ≣∣≣ লেখক : মাহবুব আজাদ ≣∣≣ জনরা : এপিক ফ্যান্টাসি ≣∣≣ প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২৯, ২০২১ ≣∣≣ প্রচ্ছদ : সুরঞ্জনা ≣∣≣ অলংকরণ : লেখক, স্টুডিওসি, সুরঞ্জনা, সজীব ওসমান ≣∣≣ পরিবেশনা : গল্পদ্রুম ≣∣≣ মুদ্রিত মূল্য : ঐচ্ছিক ≣∣≣ পৃষ্ঠা : ১২৯৬
বি.দ্র. ❛আগুনি❜ তিনটি ই-বুক খন্ডে বিভক্ত। আমি অনেক কষ্টে মেইলে ‘অনলি রিড’ অপশনে পড়েছি। ফাইল শেয়ারের কোনো অপশন নেই। তাই অযথা লিংক খুঁজে বিব্রত করবেন না। ধন্যবাদ। বাকি কোনোকিছু জানতে হলে, https://golpodroom.com/ ওয়েবসাইটে ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন।
পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ফ্যান্টাসি পড়ছি বহুদিন ধরে। ইউরোপীয় সংস্কৃতির আদলে গড়া বিভিন্ন জগত নিয়ে ফ্যান্টাসি উপন্যাস পড়ে সবসময় মনে হয়েছে, আমাদের দেশি ধাঁচে হাই ফ্যান্টাসি পড়ার সুযোগ কবে হবে। সেই অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে আগুনি পড়ার মাধ্যমে।
প্রথম যখন পড়া শুরু করি তখন মনের ভিতর কিছুটা ভয় ছিল, শেষ পর্যন্ত কি দেশি ভাষায় বিদেশি ধাঁচের ফ্যান্টাসিই পড়তে হবে? শুরুতে নাকামুরার ব্যাপারে পড়ার পর সেই ভয় কিছুটা জাঁকিয়ে বসে। হয়তো দেখা যাবে সব বিদেশি ধাঁচের চরিত্রের ছড়াছড়ি। একটু এগুতেই সেই ভয় পুরোপুরি কেটে যায়। অসম্ভব যোগ্য একজন লেখকের হাতেই যে এই ফ্যান্টাসিটা গড়ে উঠেছে, সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগে নি। গল্পের শুরু উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে গড়া অঞ্চলে। মূল চরিত্রগুলোও একেবারে আমাদের দেশি। একটু একটু পড়ি, আর থেমে অবাক মনে ভাবি এমন অসাধারণ জিনিস লেখক কিভাবে তৈরি করেছেন। এই উপন্যাসটার বিভিন্ন ভালোলাগার দিক নিয়ে লিখতে গেলে আমাকে আসলে একটা বইই লিখে ফেলতে হবে। এই পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখতে গিয়েও আমার বিশেষণের ভাণ্ডার ফুরিয়ে যাবে।
উপন্যাসটার জগতনির্মাণ ছিল অসাধারণ। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে লেখক এই জগতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন। শুরুটা ছিল উপমহাদেশীয় অংদেশে। তারপর আমাদের ঘুরিয়ে এনেছেন আরব ধাঁচের মরুভূমি দিয়ে ভেনিস ধাচের শুক্তি নগরে। মাঝখানে মিশর ধাঁচের এক রাজ্যেও যাত্রাবিরতি হয়। প্রতিটা এলাকার খুঁটিনাটি, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, জীবনের ধরণ- এই ব্যাপারগুলো তৈরিতে দারুণ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পের মূল ঘটনা ঘটেছে শুক্তি নগর ও সায়র থেকে সায়রে। উপন্যাসে জাহাজি জীবনের খুবই মনোমুগ্ধকর এক বর্ণনা দিয়েছেন। জাহাজ চালাতে যে বিভিন্ন জিনিসগুলো করা লাগে, সেগুলোর মধ্যে অনেক কিছুই প্রথমবারের মতো জেনে অভিভূত হয়েছি। যেমন কালদারের কাজ হচ্ছে জাহাজ কতদূর গেল সেটা বের করা। মধ্যযুগে এটা কিভাবে করা হত, সে ব্যাপারে আমার মনে অনেকবার প্রশ্ন জেগেছে। সেটার উত্তর পেয়েছি উপন্যাসটা পড়ার মাধ্যমে। কাহিনির আরেক ভাগ ঘটতে থাকে শুক্তিনগরে। নগরের বিভিন্ন অংশ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক, নগরের ইতিহাস, রাজনীতি- এই সবই দক্ষ তুলির আচড়ে ফুটিয়ে তোলা।
এবার আসি চরিত্রগুলোর ব্যাপারে। লেখকের চরিত্রচিত্রণেও দক্ষতার ঘাটতি নেই। আমার সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র মধুদামাদ আর বাবা বতুতা। মধুদামাদের ঘড়েল উকিলি বুদ্ধি এবং দুঃখের মধ্যে করা হাস্যকর সব করুণ উক্তি আমাকে ভীষণ আনন্দ দিয়েছে। উপন্যাসে আমার পড়া সবচেয়ে অসাধারণ মুহূর্ত ছিল যখন বাঈজী ঠুমরি গান ধরে আর মধুদামাদ তা শুনে যে প্রতিক্রিয়া দেখায়। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়েছি। লেখক এবং লেখাটার প্রতি ভালোবাসা তখন বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে। ভিনবোল বাবা বতুতার বিভিন্ন ব্যাপারে গভীর জ্ঞান এবং সাথে কবিতা রচনা করার মতো সুকুমারবৃত্তি যেমন তার প্রতি সম্মান জাগায়, তেমনি তার কবিতাকে অত্যাচারের অস্ত্রে পরিণত করাটা ভীষণ হাসায়। জাহাজ কাপ্তান চাবুকমারু একজন আদর্শ শক্ত ধাঁচের রাশভারী চরিত্র। মাঝে মাঝে গাম্ভীর্যের ভিতর দিয়ে ফুটে ওঠা ছেলেমানুষী কৌতুক তার প্রতি ভালোলাগাটা বাড়িয়ে দেয়। গল্পের মূল যে চরিত্র বীর, শুরুতে সে ছিল বেশ সাদামাটা ধাঁচের। কিন্তু অনেক গল্পের সাথে সাথে এটা তার বিকশিত হওয়ারও গল্প। ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে শেষের দিকে গিয়ে সে যখন নিজেকে নতুন করে চিনতে পারে, তখন তার ভবিষ্যৎ কাহিনি জানার আগ্রহটা অনেক বেড়ে যায়। গল্পের নারী চরিত্র তুলনামূলক কম। শক্ত ধাঁচের তরণিক যে কোনো পুরুষের সাথে টক্কর দেয়ার যোগ্যতা রাখে। আর অন্যজনের ব্যাপারে কিছু বলছি না স্পয়লারের ভয়ে। আরো বহু বহু দারুণ চরিত্র আছে এই এপিক ফ্যান্টাসি জগতে। কঠোর এবং সুযোগ্য সেনাপতি নাপো, বহমিকার ধুরন্ধর রাষ্ট্রদূত, ক্রমশ ফাঁদে আটকাতে থাকা প্রতিভাবান বিজ্ঞানী জলিলিও, নিজের গর্ত নিজে খোঁড়া গণক আর আমাদের সবার প্রিয় বাবুর্চি লিং। এবং আরো অনেকে। গল্পের মূল প্রতিপক্ষ যে নাত্থু, পুরোটা সময় তার কাণ্ডকীর্তির ব্যাপারে শুধু শুনেই যাওয়া লাগে। সাথে তার ব্যাপারে ধারণাটাও বাড়তে বাড়তে কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে যায়। একদম শেষে যখন তার দেখা পাওয়া যায়, সে হতাশ করে নি। অসাধারণ এক প্রতিপক্ষই পেয়েছে বীর।
জগতনির্মাণ আর চরিত্র যেমনই হোক, যে কোনো ফ্যান্টাসির মূল শক্তি তার গল্প। এখানে গল্পটার শুরুতেই বীরের মূল লক্ষ্য সম্পর্কে জানা যায়। আগুনি দেয়া। আকাশে ভেসে বেড়ানো দুর্ধর্ষ তেজোসৃপ বধ। যা গত সাতশ বছরে কেউ করতে পারে নি। সে লক্ষ্যে এগুনোর পথেই সে দেখা পায় মধুদামাদ, গণক, চাবুকমারুর। তাদের সাথে বের হয় তেজোসৃপবধের উপকরণ সংগ্রহে। গল্পে একই সাথে অনেকগুলো প্লট চলতে থাকে। শুক্তি নগরে চলা রাজনীতি, জলিলির করা আবিষ্কারের প্রভাব, জাদুচক্রের কর্মকাণ্ড, চাবুকমারুর জাহাজযাত্রা, বহমদূতের তথ্যসংগ্রহ। আরো বেশ কিছু। ধীরে ধীরে সুতো টেনে তিনি কাহিনিগুলোকে এক জায়গায় আনেন। শেষে গিয়ে যখন একের পর এক প্লট পয়েন্ট প্রকাশিত হতে থাকে, তখন রুদ্ধশ্বাসে পড়ে যেতে হয়। এবং কাহিনি শেষে দিন গোনা শুরু করতে হয় যে কবে পরের বইটা বের হবে।
উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে আমার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল এই বইয়ে হয়তো ক্ল্যাইম্যাক্স ধরণের কিছু থাকবে না। লেখক হয়তো পরবর্তী খণ্ডের জন্য তুলে রাখবেন। যখন ক্ল্যাইম্যাক্সটুকু পড়লাম, তখন আসলে যে অনুভূতিটা হচ্ছিল সেটা অনির্বচনীয়। সারাজীবন বিদেশি বিভিন্ন হাই ফ্যান্টাসিতে দারুণ দারুণ সব ক্ল্যাইম্যাক্সের দেখা পেয়েছি। আমাদের দেশি একজন লেখক যে তাদের সাথে টক্কর দেয়ার মতো একটা ক্ল্যাইম্যাক্স উপহার দিয়েছেন, সেটা নিঃসন্দেহে গর্বের। কবিতা আবৃত্তি করতে করতে গণক যখন গাড়ি ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছিল, এপিক একটা অনুভূতি পেয়েছি।
গল্পের আর যে দিকটা টেনেছে, সেটা হচ্ছে শব্দনির্মাণ। ইংরেজি শব্দ সম্পূর্ণ বর্জন করেও যে কতটা সাবলীল বর্ণনা দেয়া যায়, সেটা এখানে দেখা গেছে। ফ্যান্টাসিটা দেশি ধাঁচের, তাই সব ক্ষেত্রেই তিনি আমাদের উপমহাদেশীয় সংস্কৃতি অনুসরণের চেষ্টা করেছেন। তাই সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টার বদলে এসেছে বিপল, পল, দণ্ড। ফুট, মিটার, মাইলের জায়গায় এসেছে হাত, ধনু, ক্রোশ। যেসব শব্দের বাংলা নেই, সেগুলোর যুৎসই বাংলা শব্দ তিনি তৈরি করেছেন খুব দক্ষতার সাথে।
এই বইয়ে আসলে এমন কিছুই নেই যেটা আমার ভালো লাগে নি। আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর তালিকায় এটা স্থান করে নিয়েছে। শুধু একটাই অভিযোগ, ফ্যান্টাসির বাংলা যেই বংদেশ, সেটা কেমন হতে পারে সেটা দেখতে পেলাম না। গল্পের প্রধান তিন চরিত্র বীর, চাবুকমারু ও মধুদামাদ বংদেশী, ঠিক যেটা আমার আশা ছিল। কিন্তু বংদেশে গল্পের প্রয়োজনে পা রাখা সম্ভব হয় নি। তবে আশার কথা, এটা প্রথম খণ্ড। ভবিষ্যতের কোনো খণ্ডের একটা বিরাট অংশ বংদেশে হবে এই আশা মনে পুষে রেখেছি। ফ্যান্টাসির বাংলা দেখতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে চাই না। লেখক তার সৃষ্ট এই অসাধারণ জগতের পরবর্তী খণ্ড খুব শীঘ্রই আমাদের উপহার দেবেন, সেই কামনা রইল।
নানা ব্যস্ততায় অনেক দিন ধরেই বই পড়া হচ্ছিল না। প্রায়ই চেষ্টা করি আবার বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু মনের মত বই পাচ্ছিলাম না। এপিক ফ্যান্টাসি আমার প্রিয় জনরা, আর এই জনরায় বাংলা ভাষায় বই আমি পড়ি নি তেমন। ঘনাদার "সূর্য কাঁদলে সোনা"র মত বই হয় তো আছে কিছু, কিন্ত লর্ড অফ দ্যা রিংস বা গেম অফ থ্রোন্স টাইপের ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ফ্যান্টাসি আমি পাই নি বাংলায়।
আর এই জায়গাটাই নিতে পেরেছে আগুনি। বইটা Terry Pratchet meets GRRM বলা যায়। একদম শুরু থেকেই অ্যাডভেঞ্চার, কমেডি, রাজনীতি, ভাষার গাঁথুনি, নতুন নতুন শব্দ আর নতুন পৃথিবী, যেখানে চিরচেনা পৃথিবীর ছাপ পাওয়া যায় আবছা - সব মিলিয়ে রাতের ঘুম হারাম করে পড়েছি বইটা। বোনাস হিসাবে আছে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা চরিত্র আর ঘটনার প্রতি মৃদু নড, যেটা না জানলেও বইয়ের রসগ্রহণে কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু টের পেলে একটু বাড়তি মজা লাগে আর কি।
আগুনির পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্যের চূড়ায় আছে তেজোসৃপ, আগুনি তবু মানুষেরই গল্প। কাহিনির শুরু এক শস্ত্রীর তেজোসৃপবধের মাধ্যমে চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। সেই প্রতিজ্ঞাপূরণের জন্য পথে বেরিয়ে সে দেখা পায় নানা রকম চরিত্র আর জনপদের। দুঃসাহসী জলদস্যু, রহস্যময় গণক, কূটবুদ্ধির উকিল, বহুভাষী পর্যটক - এদের সাথে মিশে তার যাত্রা চলতে থাকে। অন্যদিকে আছে বিভিন্ন জনপদের গল্প। নগরপাল, সেনাপতি, ব্যবসায়ীচক্র, জাদুচক্র, ধর্মপাল, প্রতিদন্দ্বী রাজা, রাজদূত - সবাই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নানা রকম চাল চালছে। একের চাল অন্যের সাথে মিলিয়ে গিয়ে এক বেশ জমজমাট অবস্থা। নেপথ্যে আছে সেই তেজোসৃপ, যার রহস্য বইয়ের শেষ পর্যন্ত ঘনীভূত হয়।
বাংলায় যেহেতু ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ফ্যান্টাসি নেই, সেইজন্য আগুনির কাজ অনেকটা কঠিন। আগুনিকে তার নিজের পৃথিবীর উপকথা, ইতিহাস, পুরাণ - সবই তৈরি করতে হয়েছে। আর সেই কাজে আগুনি শতভাগ সফল। কাঠিকৌমুদী বা জ্ঞানী হাচুমিচুর প্রবাদ, আগুনপ্যাঁচা, মামুট বা তেজোসৃপকে কেন্দ্র করে আঁকা নকশা, পাতায় পাতায় অলংকরণ - সব মিলিয়ে আগুনির পৃথিবী জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেই সাথে পুরো বইতে বাংলা শব্দের ব্যবহার, সেটা নতুন শব্দ গড়ে হলেও এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। নতুন শব্দগুলোও কনটেক্সট অনুযায়ী সহজবোধ্য, বইয়ের শেষে নির্ঘন্ট ছাড়াই বেশিরভাগ শব্দই চিনে ফেলা যায়। ডোরাঘোড়া (zebra), তালহরিণ (Giraffe), চাঁদোয়াডানা (albatross), কালিমারি (squid), আটঠ্যাঙ্গা (octopus), লালচুটকি (red snapper), ঝলসি (Barbecue) -এইরকম শব্দগুলো বাংলা ভাষাতে এক সময় বহুপ্রচলিত হবে সেই আশা করাই যায়।
প্রায় ১৩০০ পৃষ্ঠার বই আগুনি, কিন্তু একটুও ঝুলে যায় নি। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টান টান উত্তেজনায় এগিয়ে গেছে, আর শেষের টুইস্ট পুরোই অসাধারণ। সিরিজের বাকি বইগুলো পড়ার জন্য এখন থেকেই অপেক্ষা করে থাকবো। আশা করি মাহবুব আজাদ সিরিজ সমাপ্তির ব্যাপারে টোলকিন বা টেরি প্র্যাচেটের পথ অনুসরণ করবেন, মার্টিনের না। :D
বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের তর্জন-গর্জন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফেব্রুয়ারি মাস কেন্দ্রিক। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই আমরা বিশাল বই মেলা আয়োজন করি, ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে নাটক-বিজ্ঞাপণ তৈরি করি। বাংলা একাডেমী, শহিদ মিনার ও টেলিভিশনের পর্দায় নিয়মমাফিক আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই আটকে থাকে ভাষার প্রতি আমাদের সব আবেগ, ভালোবাসা ও দ্বায়িত্ববোধ। অথচ সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় যেটি -- ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ও শিল্প-সাহিত্যে বাংলা ভাষার ব্যাপক চর্চা -- তার প্রয়োগ-ই যেন দিন দিন লঘু থেকে লঘুতর হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বায়নের এই যুগে নতুন নতুন বিদেশী শব্দের বাংলা পরিভাষা সৃষ্টি করে বাংলাকে সমৃদ্ধ করা তো অনেক পরের কথা, বরং নিত্য ব্যবহার্য বাংলা শব্দগুলো আমাদের অজান্তেই প্রতিনিয়ত ভিনদেশী শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।
বর্তমানের বাংলা সাহিত্যেও ভিনদেশী শব্দের এই অযাচিত ও অপ্রয়োজনীয় আক্রমণ বেশ দৃষ্টিকটূভাবে লক্ষণীয়! এই বাস্তবতায় কোন রকম ভিনদেশী শব্দ ছাড়াই প্রায় দেড় হাজার পৃষ্ঠায় লাখ চারেক বাংলা শব্দের সমারোহে "আগুনি"র মত অসাধারণ রূপকথা সৃষ্টির জন্য মাহবুব আজাদ কে অসংখ্য ধন্যবাদ। চিরচেনা বিদেশি শব্দের সহজ কিন্তু আকর্ষণীয় বাংলা অলঙ্করণ ও চমৎকার কিছু পরিভাষার গাঁথুনিতে এক কল্পজগতের রোমাঞ্চ অভিযান, জাদু-টোনা, জলদস্যু, ও রাজনীতি লেখকের স্বভাবজাত রসবোধের সাথে মিলে মিশে পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধের মত আচ্ছন্ন করে রাখবে পুরোটা সময় জুড়ে।
আগুনিতে তেজোসৃপ বধের দৃঢ় সংকল্পে এক দুঃসাধ্য অভিযানে নামে 'বং দেশের' তরুণ শস্ত্রী বীর। বীরের বিপদসংকুল বিচিত্রসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অচিনপুরের এক বর্ণিল জগতে ঘুরে আসলাম। এই অভিযানে বীরের সহযাত্রী হিসেবে মধুদামাদের মত কুটিল উকিল, পিলে চমকানো খাচ্চর খাচ্চর কবিতার রচয়িতা বহুভাষী বাবাবতুতা ও বেফাঁসে আটকে পড়া গণকের উপস্থিতি মুখে হাসি ফুটাতে বাধ্য! চাবুকমারুর মত জাঁদরেল জলদস্যু ও তার 'সৎ-পরিশ্রমী' নাবিকদের সাথে ওলহাঙরের সবুজ-সায়রে আধিপত্যের সংঘাত আবার সমুদ্রের ভিন্ন এক জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এর সাথে এসে যুক্ত হয় শুক্তি ও বহমনগরের মধ্যে ক্ষমতার রেষারেষি। ধর্ম-বিজ্ঞান-রাজনীতির মারপ্যাঁচে শুক্তি-বহমনগর আমাদের সমসাময়িক জগতের মত হতে গিয়েও আবার রূপকথায় হারিয়ে যায়। জাদু চক্র, আরেফের ধর্মগুরু, নগরপাল, চৌধুরী সমাজ, সেনাপতি নাপো, ও বহমরাজের মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত যেন আমাদের পরিচিত জগতের-��� আরেক রূপ। জলিলিও জলিলির মত প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, বার্তা সর্দার মতিরমণ, চং দেশের বিখ্যাত বাবুর্চি লিং এর মত অসংখ্য চরিত্র গল্পের বিভিন্ন পর্যায়ে একেকরকম আবেদন নিয়ে উপস্থিত হয়। সময়ের সাথে সাথে প্রতিটি চরিত্রের বিকাশ ও গল্পের মূলধারায় তাদেরকে বিনিসুতায় গেঁথে রাখার ক্ষেত্রে লেখক বেশ মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। শব্দ নিয়ে খেলার পাশাপাশি মাহবুব আজাদের নিজস্ব ভাষাশৈলির মোহে পরে কখন যে সময় চলে গিয়েছে টেরও পাইনি।
আগুনি পড়ার সময় মনে হচ্ছিল অং-বং-হিং-চিং-শুক্তি-বহম-সবুজ সায়রের একটা মানচিত্র চোখের সামনে থাকলে মন্দ হত না। নষ্টি বাই, ওলহাঙরের তাড়া, নাত্থুর মুখোমুখি হওয়ার মত কয়েকটি ক্লাইম্যাক্সে উত্তেজনা আরেকটু জিইয়ে রাখলে হয়ত আরও ভালো লাগত। সে যাই হোক, "গল্পদ্রুম" বিনামূল্যে বইটি অন্তর্জালে পড়ার সুযোগ করে দেওয়ায় অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু যন্ত্রের পর্দায় এই বই পড়ে সুখ নেই। মোটা কাগজে ছাপানো রং বেরঙের ছবিতে হাত বুলিয়ে আয়েশ করে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়তে পারলে পূর্ণ সুখ পাওয়া যেত। ছাপার কাগজে আগুনি প্রকাশের জন্য লেখক/প্রকাশকের কাছে অনুরোধ রইল।
আগুনির প্রথম খন্ড পড়ে কি বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না । আসলে এই বইয়ের পাঠাভিজ্ঞতা বর্ণনা করার ভাষা আমার নাই । এক কথায় অসামান্য, অসাধারণ অভিজ্ঞতা । গল্পের পরিবেশে , চরিত্রগুলোর মাঝে আমি এখনো বুঁদ হয়ে আছি। চোখের সামনে সবকিছু একদম ফুঁটিয়ে তুলেছে লেখকের বর্ণনাভঙ্গি । এক কথায় মুগ্ধকর। আর চরিত্রানুযায়ী সংলাপ প্রক্ষেপণ, ক্রিয়াপদের ব্যবহার ( চিন্তানো , নষ্টানো ...) , কত কত নতুন বাংলা শব্দের যে সমাহার ( Albtross কে যে চাঁদোয়াডানা ডাকা যেতে পারে , ঢালেবাড়ি , মালেবাড়িসহ এরকম কত শব্দ ) ... সব মিলিয়ে বলতে পারি এরকম বই আমি আগে পড়িনি । আর লেখকের হিউমারের ব্যবহার ...ওহ্ ...কতবার যে মধুদামাদ উকিলের কথা শুনে ( পড়ার জায়গায় শোনা লিখেছি এবং এটা একদম স্বাভাবিকভাবেই এসেছে । লেখকের বর্ণনাভঙ্গি এমনই যে ; সব চরিত্র জীবন্ত মনে হবে । ) হাসতে গড়িয়ে পড়েছি তার ঠিক নেই । তারপর চরিত্রগুলোর নামকরণ; এরকম নামকরণের সাহস বাংলাভাষায় আর কোন লেখক দেখিয়েছেন বলে জানা নেই আমার । আর এত বিস্তৃত পরিসরের গল্পের কাহিনিতে থ্রিলারসম গতি ধরে রাখা এটা একমাত্র জাত লেখকের পক্ষেই সম্ভব । এই বই বহুল পঠিত হোক এটা আমি খুব করে চাই । ফেসবুক-সর্বস্ব-এটেনশন সিকিং লেখকদের এই যুগে বাংলা ভাষায় মাহবুব আজাদের মত পরিশ্রমী এবং মেধাবী লেখকদের খুব প্রয়োজন । বাংলা ভাষার জন্য এই বই এক মূল্যবান দলিল। আমাদের আলসে লেখক সমাজের গালে এক প্রবল চপেটাঘাত। লেখকের কল্পনা করার আর সেটা শক্ত হাতে একটুও টাল না খেয়ে ফুটিয়ে তোলার যে ক্ষমতা ; আমি যারপরনাই মুগ্ধ সেই ক্ষমতায়। লেখক মাহবুব আজাদ , আপনাকে অভিবাদন এবং ধন্যবাদ এত অপূর্ব এক জগতে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।
সানডে টাইমসের এক রিভিউতে লর্ড অব দ্য রিংস সম্পর্কে একটা কথা বলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে কথাটা কিংবদন্তী হয়ে রয়েছে। কথাটা হচ্ছে - "The English-speaking world is divided into those who have read Lord of the Rings and those who are going to."
আমি সানডে টাইমসের মত প্রথিতযশা নই (ইন ফ্যাক্ট আমার কোন যশই নেই)। তারপরও একজন দুঁদে ফ্যান্টাসিপ্রেমী বাংলাভাষী হিসেবে অত্যন্ত গর্বের সাথে একই কথা বলছি আগুনি বইটার ক্ষেত্রে। বাংলা বইপড়ুয়া সমাজকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। একদল আগুনি পড়েছে আর বাকিরা পড়তে যাচ্ছে।
কেন এত বিশাল একটা কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছি বইটাকে? এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয় এমন আকর্ষনীয় কাহিনির সাথে এত চমৎকার গদ্যের মিশেল আমি বাংলায় খুব কম পড়েছি। তার সাথে যোগ করুন দুর্দান্ত জগৎসৃষ্টি, পুরো বইজুড়ে বাঙালীয়ানার ছড়াছড়ি, দেশী আবহ আর তার সাথে যে কোন আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার ফ্যান্টাসি রাইটারের ঈর্ষা জাগানোর মত উপস্থাপনা (হ্যাঁ, আমি ব্র্যান্ডন স্যান্ডার্সন, প্যাট্রিক রথফাস, রেমন্ড ই ফিয়েস্ট কিংবা নীল গেইম্যান বা জর্জ মার্টিনের কথা মাথায় রেখেই বলছি। ব্যতিক্রম সম্ভবত টেরি প্র্যাচেট আর টোলকিন)। সব কিছু মিলিয়ে কী মনে হয়? জাস্ট সিম্পলি – বুম!, তাই না? হ্যাঁ, ঠিক তাই। আগুনি বইটা বাংলা ফ্যান্টাসির ইতিহাসের একটা অনন্য মাইলফলক, একটা সত্যিকারের বুম।
ডিটেইলে যাবার আগে একটা কথা বলে নিই। আমি বইটাকে ফ্যান্টাসি বলছি বটে। কিন্তু লেখক নিজে বলেছেন বইটার ঘরানা বড়দের রূপকথা। বইটাতে পশ্চিমা ধাঁচের ফ্যান্টাসির একটা বড় উপকরণ – যাদু ব্যবস্থার (ম্যাজিক সিস্টেম) অস্তিত্ব নেই। তাই অনেকে হয়তো ফ্যান্টাসির সংজ্ঞা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষন করে দেখতে বা দেখাতে চাইবেন সত্যিই এটা ফ্যান্টাসি না, অন্য কোন ধারার বই। আমি আর জঁরার কচকচিতে যাবো না তাঁদের সাথে। যে ঘরানা খুশি ভেবে নিন – বইটা পড়ে মজা পেলেই হলো। আর এই কথাটা আমি আমার সমস্ত সম্পদ বন্ধক রেখে বলতে পারি – বাংলাভাষী পাঠক হলে আগুনি পড়ে আপনি মজা পাবেনই পাবেন। এর কোন কোন ব্যতয় নেই। দাঁড়ি।
প্রথমেই আসি কাহিনি নিয়ে। আগুনি একটা সিরিজের অংশ। লেখক-প্রকাশকের ভাষায় “তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা” গ্রন্থমালা। এই গ্রন্থমালার প্রথম বই হচ্ছে আগুনি। আগুনির কাহিনি এগিয়েছে মূলত দুটি মাত্রায়। একদিকে বংদেশি তরুণ শস্ত্রী বীরের কাহিনি (শস্ত্রী শব্দটা নতুন ঠেকছে কি কারো কাছে? আগুনি পড়তে থাকুন, আরো অনেক শব্দের সাথে পরিচয় হবে, আপনিও সমৃদ্ধ হবেন)। বং দেশের বীর বের হয়েছে তেজোসৃপ বধ করতে। কিন্তু সে না জানে কিভাবে তেজোসৃপ বধ করতে হয়, না জানে কোথায় তেজোসৃপ খুঁজে পাওয়া যায়। তবুও অটল মনোবলে বীর এগিয়ে চলে লক্ষ্যপূরণে। পদে পদে নানারকম বিপত্তি ঠেলে সামনে এগিয়ে চলে বীর। যাত্রাপথে সাথে জোটে ধুরন্ধর উকিল মধুদামাদ আর একজন গণক যার গণনা ভুল হয় না কখনো। এদের নিয়ে বীর গিয়ে ওঠে সারেং (কাপ্তান না কিন্তু!) চাবুকমারুর মিস্টি কুমির নামের জাহাজে। সেখানে পরিচয় হয় নানাভাষায় পারদর্শী ভিনবোল বাবাবতুতার সাথে। এদিকে চাবুকমারুরও কিন্তু নিজস্ব এজেন্ডা আছে। সে সেটা পূরণে নিবিষ্টপ্রাণ। পরে দেখা পাওয়া যায় মিস্ত্রিদিদি ইরারির।
অন্যদিকে শুক্তি নগরের কাহিনি যেখানে পরতে পরতে মিশে আছে জটিল অভ্যন্তরীন রাজনীতি, বাণিজ্যকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থার সারবস্তু, সেইসাথে ধর্মীয় জুজুর “ডিম দেয়া” (আগুনি পড়লে শব্দজোড়ার মাহাত্ম্য সম্যক উপলব্ধি করতে পারবেন) আর পার্শ্ববর্তী রাজ্য বহমিকার সাথে ঠান্ডা-গরম দুইরকমই লড়াই। এখানে বাড়তি পাওনা হিসেবে আসে শুক্তির সেরা সুন্দরী মৃগতনুর কাহিনি, তার সাথে অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ সমরনায়ক নাপো আর অসাধারণ মেধার অধিকারী (কিন্তু সেই রকম দুশ্চরিত্র) বিজ্ঞানী জলিলিও জলিলির গল্প। শেষ মেষ এদের সবার সাথেই বীর এবং তার দলবলের দেখা হয়, কিন্তু শেষে এসে “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ” বলে পরের পর্বের ইঙ্গিত দিয়ে আগুনির শেষ হয়।
এবারে বলি ভালো লাগার দিকগুলো নিয়ে। সবার প্রথমে যেটা বলতে হয় সেটা লেখনশৈলী। মাহবুব আজাদের লেখা এমনিতেই দুর্দান্ত। আগুনিতে এসে যেন সেটা আরো পূর্ণতা পেয়েছে। বিশেষ করে “বড়দের রূপকথা” লেখার জন্য তিনি এত চমৎকার অথচ সহজ, ঝরঝরে অথচ সাহিত্যমান সম্পন্ন একটা ভাষার সৃষ্টি করেছেন যে পাঠকের পক্ষে তাঁর গল্পের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া খুবই সহজ। মাত্র এক তুড়িতে মিশে যাবেন বইটির সাথে – এতই দারুন! আগ্রহী হলে গল্পদ্রুমের পাতা থেকে একটু পড়ে দেখতে পারেন। আগুনির তরতরে গতিশীল ভাষার সাথে পরিচিত হতে পারবেন। লেখকের অসাধারণ দক্ষতার গুণে কাহিনির সাথে পাঠকের দূরত্ব তৈরি হয় না মোটেও। বরং পাঠক থাকেন এর দৃশ্যপট আর চরিত্রদের খুব কাছাকাছি। ফলে এক লহমায় আগুনির মধ্যে ডুবে যেতে পাঠকের বিন্দুমাত্রও সমস্যা হয় না।
এবার আসি জগৎসৃষ্টি নিয়ে। আগুনির জগৎটা কাল্পনিক হলেও এটা আদতে আমাদের চেনা পৃথিবীই। বলা হয়েছে “অভিন্ন পৃথিবী, ভিন্ন ভূবিন্যাস”। কিন্তু চেনা পৃথিবী হলেও বং, জং, শুক্তি, বহমিকা ইত্যাদি দেশগুলোর সাথে আমাদের পরিচিত দেশের খুব মিল থাকলেও তারা একটু আলাদা। আর এখানেই লেখকের মুন্সীয়ানা। প্রতিটি রাজ্যের কৃষ্টি, সংস্কৃতি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে টুকরো টুকরো ঘটনা আর অলংকরণের মধ্য দিয়ে। রাজ্যগুলোর সাংস্কৃতিক পরিচয় যে ভিন্ন, সেটাও ফুটে উঠেছে খুব সুন্দরভাবে। তাই আমরা দেখি সুজলা সুফলা বংদেশীদের সহজিয়া রুপ, পাশাপাশি রুক্ষ, কঠোর এলাকার পাশাদের রূঢ় মানসিকতা। শুক্তির ব্যবসাদারদের অর্থকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার পাশাপাশি ফুটে ওঠে বাবাবতুতার দেশের লোকদের উপার্জনের জন্য দূর-দূরান্তে ভ্রমনের তাগিদ। গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোর মুখের ভাষাও কিন্তু লেখক নিয়ে এসেছেন বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে। শুক্তির চৌধুরীরা দেশের এক শ্রেনীর চৌধূরীদের কথা মনে করিয়ে দেয় সহজেই। তাদের মুখে কলকাতার ভাষা আশ্রয়ী বাক্য শুনতে মজা লেগেছে।
জগৎ তৈরির অন্যান্য উপকরণগুলোও খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন বিভিন্ন দেব দেবীর উপাসনা – দেব দেবী অনুযায়ী উপাসনার ধরণ বদলে গেছে, বদলে গেছে প্রার্থণার অনুপানও। উদাহরণ দেই। বাতাসের দেবী হুহুর ভক্তরা দেবীর উদ্দেশ্যে বাতাসে খই উড়ায় (উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ – এনি ওয়ান?)। মামুট নামের প্রাণি যারা পোষে, সেই জাতির পানীয়ের নাম “মামুটপানি”। আবার বন্দরনগরীতে যে পানীয়টির রমরমা কারবার সেটি হচ্ছে নীরা। এই রকমভাবে কল্পনার জগৎটিকে এমন এক সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সুতো দিয়ে বেঁধেছেন মাহবুব আজাদ যে সবগুলো জিনিসকেই মনে হয় খুব স্বাভাবিক। ঠিক আমাদের বাস্তব পৃথিবী নয়, কিন্তু দূরেরও নয়। হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাবে অনায়াসে।
আর আগুনির যে জিনিসটা সবচেয়ে বড় আকর্ষন মনে হয়েছে আমার কাছে সেটা হলো “ফান অ্যান্ড পান”। সবকিছুতেই এই মজার স্পর্শ আছে। যেটা পাঠককে আনন্দ দেবে, আবার ঘটনার ঘনঘটা বা কাহিনির গুরুত্ব বিন্দুমাত্রও হ্রাস করবে না। সেই সাথে সমসাময়িক ঘটনাবলী বা আমাদের পৃথিবীর কিছু সূক্ষ রেফারেন্স এসেছে যেটা সচেতন পাঠকমাত্রই ধরতে পারবেন। এবং ধরতে পেরে দুর্দান্ত মজা পাবেন। যেমন বিজ্ঞানী জলিলিও জলিলি। এই বিজ্ঞানী দূরের জিনিস কাছে দেখার যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। পরিচিত লাগছে? আবার এই বিজ্ঞানীই যখন বলেন অসম্ভবকে সম্ভব করাই জলিলির কাজ তখন অন্য কারো কথা মনে পড়ে যায় না? অন্যদিকে দেবীর ভক্তরা যখন রাগের মাথায় “দেবীর হেঁচকি” বলে গালি দেন তখন রোওলিঙের “মার্লিন’স প্যান্টস” বা অ্যাজিমভের “গ্রেট গ্যালোপিং গ্যালাক্সি”র মতো মজা পাওয়া যায়। এছাড়াও ধরুন মাঝদুপুরে ডেকে ওঠা একটা বিটকেল পাখির নাম “দিবাঘোঁচু” (মতিকন্ঠের সাথে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁদের কাছে ঘোঁচু শব্দটাকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই)! আগুনির পরতে পরতে এরকম আরো অজস্র মজাদার উপাদান ছড়িয়ে আছে।
চরিত্রচিত্রনের প্রসঙ্গে বলবো বাংলা আর কোন ফ্যান্টাসীতে আমি এত চমৎকার চরিত্র বিন্যাস পাই নি। শুধু তাই না, প্রতিটি মূল চরিত্র যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি তাদের আবেগ, অনুভুতি, চিন্তাভাবনার ধরণ মননশীল পাঠকের বুঝতে একটুও কষ্ট হবে না। প্রধান চরিত্রগুলোর ক্যারেক্টার কার্ভ স্পষ্ট বোঝা যায়। সেই সাথে এটাও বোঝা যায় তাদের আর্কের শিখরে পৌঁছুতে এখনো বাকী আছে (প্রথম বই যেহেতু)। বীরের কথা তো আগেই বললাম -দুর্দান্ত দুঃসাহসী অথচ কম বয়সের কারনে এখনো পুরোপুরি পরিণত নয়। তার পাশাপাশি গল্পের ভিলেন নাত্থুর সাথে তুলনা করলেই দুজনের চরিত্রের মিল এবং পার্থক্যটা স্পষ্ট বোঝা যায়। উকিল মধুদামাদ! আহ – এই চরিত্রটা ছাড়া বইটাই আলুনি হয়ে যেত। বাজি ধরে বলতে পারি আপনি মধুদামাদকে যেমন গালি দেবেন, তেমনি পছন্দ করবেন। এরকম আরেকটা পরস্পর বিরোধী বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন চরিত্র বিজ্ঞানী জলিলিও জলিলি। তার জ্ঞানসাধনা আর নারীলিপ্সা এই দুটো পুরোই একশো আশি ডিগ্রী ঘোরানো বৈশিষ্ট্য। কিন্তু উপস্থাপুনার গুনে মোটেও অস্বাভাবিক লাগে না! সারেং চাবুকমারু – তার চরিত্রের কঠোর দিকটা তো ফুটে উঠেছেই, পাশাপাশি কোমল দিকটাও প্রকাশ পেয়েছে সুন্দর ভাবে। আর ইরারি! আগুনি বইয়ের সবচেয়ে ব্যক্ত্বিত্বসম্পন্ন চরিত্র মনে হয়েছে ইরারিকে।
এখানে একটা কথা অবশ্য বলতেই হবে। আগুনি মূলতঃ পুরুষপ্রধান। মূল নারী চরিত্র বলতে এখন পর্যন্ত ইরারি আর মৃগতনু। হয়তো যে সময়ের কথা বলছেন লেখক, সে সময়টাকে এভাবেই দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু বাকী নারী চরিত্রগুলো বড়ই একপেশে। এখানে আরেকটু বিস্তৃতি থাকলে ভালো লাগতো।
যাই হোক, আগের আলাপের সূত্র ধরে বলি চরিত্রগুলোর নামকরণেও কীযে মজা আর লেখকের মুন্সীয়ানা লুকিয়ে আছে তা বইটা না পড়লে বোঝা যাবে না। গল্পের একজন নায়ক হচ্ছে বীর। সে অস্ত্র চালনায় পারঙ্গম শস্ত্রী। সুতরাং নামকরণের মাহাত্ম্য এখানেই বোঝাযায়। জাহাজের প্রধানের নাম চাবুকমারু। বহমিকার দুর্দান্ত সাহসী রাষ্ট্রদূত, যে কিনা লোকজনকে দিয়ে কাজ আদায়ে অতিশয় পটু, তার নাম লৌহশিং। বাণিজ্যিক নগরের প্রধানের নাম অটলদিস্তা। আরো মজা কী জানেন? বিভিন্ন ধর্মের দেবদেবীর নাম। বাতাসের দেবী হুহুর কথা তো আগেই বলেছি। আগুনের দেবী হলেন দাউদাউ, জলের দেবী হলেন কলকল! এমন কার্যকর অথচ মজাদার নামের সমাহার আগুনির আকর্ষন বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ।
আগুনি সম্পর্কে বলতে গেলে আরেকটা কথা না বললে আলোচনা সম্পূর্ণ হয়না মোটেও। সেটা হলো বাংলাভাষার ব্যবহার। প্রায় ১৩০০ পৃষ্ঠার একটা বইয়ে লেখক ইংরেজী বা অন্য কোনভাষার আশ্রয় নেননি মোটেও। এই একটা কারনেই তো বইটা সব বাংলাভাষী পাঠকের হাতে যাওয়া উচিৎ। অন্যান্য ভাষার শব্দগুলোর, যেগুলোর বাংলা নেই, সেগুলোর বাংলাকরণ করেছেন খুবই দক্ষতার সাথে। কিছু উদাহরণ দিই। জেব্রা তো ইংরেজী শব্দ। লেখক এটার বাংলা করেছেন ডোরাঘোড়া। কি আশ্চর্য লাগসই নাম, তাই না? তেমনি অ্যালবাট্রসের নাম করেছেন চাঁদোয়াডানা। কার্যকারিতার উপরে ভিত্তি করে নামকরণের আরেকটা উদাহরণ হলো কোলঢাকা। বলুন তো, মূল শব্দটি কী ছিলো?
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন – অ্যাপ্রন! এছাড়া কিছু কিছু শব্দের বাংলা করা হয়েছে খুবই মজার ভংগীতে। স্প্রিং এর বাংলা হয়েছে তিড়িং (এই বাংলাটা করেছেন জনাব উজ্জ্বল মন্ডল)। ট্রিবুসেট নামের যে অস্ত্রটা মধ্যযুগে ব্যবহার হতো, তার বাংলা করেছেন ঝপাং। কী অদ্ভুত সহজিয়া অথচ কার্যকর নাম। আবার জলদস্যুদের জলি রোজার পতাকার বদলে এখানে জলদুস্যুর পতাকার নাম হয়েছে “কাক্কেশ্বর কুচকুচে” (সুকুমার রায় মনে পড়ে কারো?)। এই নামকরণের স্বার্থকতা কিন্তু জাহাজের কাপ্তানের সাথেও জড়িয়ে আছে। বইটি পড়লে বুঝতে পারবেন।
এবার আসি যে জিনিসগুলো আমার ততোটা ভালো লাগেনি সেগুলোতে। নারী চরিত্রের কথা তো আগেই বলেছি। এছাড়া সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছে নামধাতুজ ক্রিয়ার ব্যবহারে। লেখক শেষে বলেছেন য��� মধুসূদন দত্তের দেখানো পথে তিনি মাইকেলি ঘরানার ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এগুলো পড়ে আরাম পাইনি মোটেও। চরিত্র যখন কথা বলছে, সেখানে মেনে নেয়া গেলেও লেখক যেখানে বর্ণনা করছেন, সেখানে খরচ করার বদলে খর্চানো, দখল করার বদলে দখলানো সাফ করার বদলে সাফানো পড়তে ভালো লাগেনি।
আর অভাব বোধ করেছি একটা মানচিত্রের। কোন দেশটা যে কোথায়, মনের চোখে সেটাকে দেখার চেষ্টা করলেও সব এলোমেলো হয়ে গিয়ে একটা হ য ব র ল হয়ে গেছে একটু পরেই। বইয়ের শুরুতে একটা মানচিত্র পেলে খুব ভালো হতো।
তবে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটার মুখোমুখি হয়েছি তা হলো বইটির খন্ডগুলো পেতে দেরী হওয়ায়। বৈদ্যুতিন বই (ই-বুক) হওয়ার কারনে বইটা পেয়েছি তিন টুকরোয়। তাও তিনটি টুকরো তিন সময়ে। ফলে প্রথম টুকরো শেষ করে হাপিত্যেশ করে বসে ছিলাম অনেকদিন। তারপর ২য় এবং তার পর ৩য় টুকরো পেয়েছি। ৩য় টুকরো পেতে বেশী সময় না লাগলেও বইটাতে এতই ডুবে ছিলাম, যে এমনকি এক দিনের দেরীই আর সইছিলো না। ইদানীং তো শুনলাম অনেকে অনেকদিন ধরে গল্পদ্রুমের কাছে বার্তা পাঠিয়ে রেখেও প্রথম টুকরোটিই হাতে পাচ্ছে না! গল্পদ্রুমের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
বইটি তিন টুকরোয় পাওয়া যাওয়ায় শেষ টুকরোয় পাওয়া নির্ঘন্ট বলতে গেলে কোন কাজেই আসেনি। একসাথে পেলে এই নির্ঘন্টটা অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করতো।
বইয়ের সাজসজ্জা আর অলংকরণ নিয়ে কিছু না বললেই নয়। এমন পাতায় পাতায় দুর্দান্ত অলংকরণ সমৃদ্ধ বই পেলেই ত পড়তে ইচ্ছে করবে যে কারো। শুধু এই অলংকরনের জন্য হলেও এই বইটার একটা হার্ডকপি বাজারে আসা একান্ত আবশ্যক। গল্পদ্রুম এবং মাহবুব আজাদের কাছে জোর দাবী জানিয়ে গেলাম।
সবশেষে শুরুতে বলা কথাটাই আবার বলবো। বাংলায় এমন বই আগে পড়িনি আর। আর প্রত্যেক বাংলাভাষী পাঠকের অবশ্যই অবশ্যই আগুনি বইটা পড়া উচিৎ।
ছেলেটার নাম বীর। পেশায় শস্ত্রী। নিজের পেশা বিসর্জন নিয়ে তার শখ জেগেছে আগুনি দিবে। আগুনি দিতে পারলেই জীবনটা বেশ আয়েশেই কাটবে। তাই চলছে শুক্তি নগরের অভিমুখে। কিছু চিনে না সে। শুধু জানে শুক্তিতে গেলেই দেখা মিলবে কাঙ্ক্ষিত বস্তুর। যার জন্য সে ছেড়েছে নিজের জন্মস্থান। পথে চলতে চলতে তার দেখা মিলে মধুদামাদের। মধুদামাদ পেশায় একজন উকিল। লতি ডাকাতের ওকালতি করতে গিয়ে কুড়ি গরু জালিয়াতির শাস্তিস্বরূপ কুয়ায় পতিত হয়েছে সে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে বীর। অবশ্যই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। যতক্ষণ না সেই পারিশ্রমিক পাওয়া যাবে, মধুদামাদকে ছাড়া হবে না। বেশি কথা বললে ঘাড়ে রদ্দা মেরে অজ্ঞান করে ফেলার কৌশল আয়ত্তে আছে বীরের।
শুক্তি নগরে জাদু নিষিদ্ধ। জাদু করলেই শাস্তি। সে অনেককাল আগে এ জাদু নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তখন দেখে জাদুকররা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। লুকিয়ে থাকছে। তাদের মধ্যে একজনের নাম লুদভিগ। তার প্রধান জাদু হচ্ছে আগুন জাদু। আর এই জাদুতে চোখের পলকে পুড়িয়ে ফেলা যায় সবকিছু। বেশ কিছুদিন ধরে শুক্তি নগরের বণিক পাড়ায় অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। একে একে বিভিন্ন ব্যবসায়িক জায়গায় আগুন লাগছে। কিছুতেই এর সমাধান করা যাচ্ছে না। জাদুচক্র ধারণা করছে লুদভিগ ফিরে এসেছে। কিন্তু কেন এভাবে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে? কিছু কি বলতে চায় সে? যদি একবার ধরা পড়ে, যদি তার জাদুর রহস্য উন্মোচন হয়; তাহলে বেজায় সমস্যা। তাই লুদভিগকে থামাতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
বীরের বাহুতে তেজোসৃপের উল্কি আঁকা রয়েছে। আরও একজনের বাহুতেও এমন উল্কি আঁকা। তার নাম নাথু। সেও ছুটে চলেছে কোনো লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যে। সে কারণেই জংদ্বীপের জাঙ্গিয়া তলোয়ার কিংবা এক বুড়ো ভেল্কিবাজের তেজোসৃপের চোখ আয়ত্তে নেয় সে। এর জন্য প্রাণ হরণেও পিছপা হয় না। এমনকি চলতে ফিরতে জাহাজের সারেং ভাবুকমারু, তার পুরো দলকে নিকেশ করে এগিয়ে চলে। সায়রের ত্রাস ওলহাঙ্গরের ছেলেও তার থেকে নিস্তার পায়নি। কী চায় সে? কেন এভাবে রক্তের খেলায় নিজেকে রাঙিয়ে এগিয়ে চলছে?
ভাবুকমারুর এক ভাই আছে চাবুকমারু। তার সাথে দেখা হয় বীরের। চাবুকমারুর জাহাজে চড়েই শুক্তি নগরের উদ্দেশে যাত্রা করে সে। পথে কত বিপদ ওঁৎ পেতে থাকে। কখনও দস্যুর হামলা, কখনও আবহাওয়া চোখ রাখে। আকাশে উড়ে বেড়ানো তেজোসৃপ আগুনে ঝলসে দিতে চায়। তারই মাঝে ছুটতে গিয়ে বিপদেও পড়তে হয়। বিপদের কারণ, হাতে আঁকা উল্কি। বীর কখনও নিজ অঞ্চলের বাইরে যায়নি। এমন দূরের যাত্রায় তাই বিস্ময়ের সাথে অনেক কিছুই জানতে পারছে, শিখতে পাচ্ছে। সব জানা ও শেখায় তার যে লক্ষ্য, তা কি পূরণ হবে?
শুক্তি নগরের পাশেই অবস্থিত বহমিকা। দুই রাজ্যের মধ্যে সাপে নেউলে সম্পর্ক। বেশ কয়েক শীত আগে যুদ্ধে বহমদুয়ার দখল করার দরুন শুক্তি নগরকে উচিত শিক্ষা দেওয়া মনস্থির করে বহমরাজ। ফলে নিজেদের সায়রসরেস কাঠ শুক্তি নগরে রপ্তানি বন্ধ করে। কিন্তু এ কাঠ ছাড়া যে জাহাজ বানানো বা মেরামত করা যাবে না। আর জাহাজ ঠিকঠাক না থাকলে বাণিজ্যও জমবে না। ফলে দুই রাজ্যের সম্পর্ক অবনতির দিকে ধাবমান। আর এরই মাঝে শুক্তি নগরের নগরপাল যখন ঘোষণা দেয়, বহমিকায় লবণ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হবে, তখন যেন আগুন ঘি ঢালার মতো পরিস্থিতির তৈরি হয়।
যুদ্ধের দামামা বাজছে। প্রস্তুত হচ্ছে দুই রাজ্যই। কখন কে আক্রমণ করবে বলা যাচ্ছে না। কানাঘুষো চলছে অভ্যন্তরে। জমে উঠছে তীব্র অসন্তোষ। এই যুদ্ধের বাজারে পন্ডিত জলিলি শুক্তি নগরের তুরুপের তাস। তার আবিষ্কার কিংবা গণিত শাস্ত্র যেন সবকাজ সহজ করে তুলছে। শহরের অভ্যন্তরে সক্রিয় হচ্ছে জাদুচক্র, লবণচক্র কিংবা চৌধুরীরা। সবাই নিজেদের ফায়দা খুঁজে বেড়াচ্ছে। অপেক্ষা করছে বড় কোনো ঘটনার।
▪️পাঠ প্রতিক্রিয়া :
সবার প্রথম প্রশ্ন আসতে পারে, আগুনি আসলে কী? আগুনি একটা অগ্নিপরীক্ষা। যে পরীক্ষায় জিততে পারলে যেকোনো শস্ত্রী জীবন নির্বিঘ্নে কাটাতে পারবে। তাকে আর শস্ত্রীগিরি করতে হবে না। কোনো রাজ পরিবারের পুত্র বা কন্যাকে শিক্ষাদানেই বাকি জীবন কাটাতে পারবে। কিংবা রাজকন্যা হবে তার শয্যাসঙ্গী অথবা মিলবে বিশাল পুরস্কার। যা দিয়ে পুরোটা জীবন কেটে যাবে আরামে। কিন্তু এই পরীক্ষা দিতে ভীষণ মূল্য চুকাতে হবে। আকাশে বিশাল ডানা ছড়িয়ে উড়ে বেড়ানো তেজোসৃপকে বধ করা তো মুখের কথা নয়। আবার আগুন ছুঁড়তেও পটু তেজোসৃপগুলো। মূলত এই তেজোসৃপকে বধ করাকেই আগুনি বলে।
“আগুনি” তিলোত্তমা ও তেজোসৃপ সিরিজের প্রথম বই। বিশাল মহাযজ্ঞ এখানে লেখক তুলে এনেছেন। কলেবরের বিস্তৃতি ব্যাপক। সেই সাথে কাহিনিও চলেছে সমানভাবে। ঘটনাবহুল এই বই পড়ে একটা বিষয় বুঝতে পারলাম, বাংলা সাহিত্যে এমন লেখা এর আগে হয়নি। ফ্যান্টাসি জনরায় এখন অনেকেই লিখছেন, এই জনরায় বাংলা সাহিত্যে সমৃদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু “আগুনি”র নিবেদন অন্যরকম। এই বইটা প্রকাশ পেলে সব বইকে ছড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। দুর্দান্ত এক উপাখ্যান। যার প্রতিটি অধ্যায়ে ঘোরলাগা কাজ করে। যেভাবে লেখক গল্প বলেছেন, তার প্রতিটি ছন্দে ছড়িয়ে আছে মুগ্ধতা। একবার পড়ে এই বই অনুভব করা সম্ভব নয়। পরিপূর্ণ তৃপ্তি পেতে আমার বোধহয় আরেকবার পড়তে হবে।
যেহেতু বইটি বিশাল কলেবরের আর ঘটনাবহুল, সেহেতু সব ঘটনার আত্মস্থ করে নেওয়ার একটা বিষয় চলে আসে। তবে পাঠকের সুবিধার্থে পুরো বইয়ের ঘটনাকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে বীরের যাত্রা। যে যাত্রায় শামিল হয়���ছে অনেকে। বরং বলা যায়, অনেকের যাত্রার সাথে মিশে গিয়েছে বীরের লক্ষ্য। আরেকদিকে শুক্তি নগরের ঘটনা। যেখানে একের পর এক ষড়যন্ত্রের বীজ পোতা হচ্ছে। কখনও যুদ্ধের মতো কাহিনির গুজব উঠছে। যে নগরের হর্তাকর্তাদের কারো সাথে কারো বনিবনা নেই। সামনে যেমন অবস্থা দেখান না কেন, পেছনে সবাই যেন একে অপরের শত্রু হিসেবেই ধরা দেয়।
এই বইতে আলোচনা করার অনেক উপাদান আছে। সবকিছু নিয়ে আলোচনা করলে রিভিউয়ের দৈর্ঘ্য বিশাল হয়ে যাবে। মানুষ যেহেতু বড় রিভিউতে বিরক্ত বোধ করে তাই অনেক কিছুই আলোচনায় আনছি না। তারপরও ১২৯৬ পৃষ্ঠার বইয়ের রিভিউ খুব বেশি ছোট করে লেখার যোগ্যতা আমার নেই।
▫️প্রথমে এই বইতে রচিত জগৎ বিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করা যায়। এখানকার জগৎ বেশ জটিল ও বিশাল। লেখক যেহেতু ম্যাপ দেননি, তাই বুঝতেও অসুবিধা হয় কিছুটা।
শুরুটা জংদ্বীপ দিয়ে। যেখানকার জঙ্গিয়া তলোয়ার জগৎবিখ্যাত। এছাড়াও অংদেশ, বংদেশ, হিংদেশ রয়েছে। লেখক প্রতিটি দেশের নাম খুব আকর্ষণীয়ভাবেই উল্লেখ করেছেন। গাংডুমুর, নাগিস্তান, শুয়াকি, সবুজসায়র, টিংসায়র, লালসায়র। নামগুলো পড়তে মজাই লাগে।
তবে মূল আলোচনাটা হবে শুক্তি নগর আর বহমিকার। অনেক আগে থেকেই তাদের মধ্যে একটা শীতল সম্পর্ক বিদ্যমান। অবশ্যই তা ব্যবসার খাতিরে। তবে যুদ্ধে যখন এক দেশের কিছু অঞ্চল আরেকদেশ কুক্ষিগত করে, তখন অনেক কিছুই বদলে যায়। এই যেমন বহমিকা তাদের সায়রসরেস কাঠ শুক্তিকে দিতে নারাজ। ফলে জাহাজ উৎপাদন না মেরামত সম্ভব না। জাহাজ ঠিক না থাকলে সমুদ্রে ভেসে ব্যবসাও সম্ভব না। এর ফলশ্রুতিতে শুক্তির নগরপাল নিজেদের লবণ প্রাগবহমে দিতে অনিচ্ছুক। এখানেই বদলে যায় সবকিছু।
শুক্তির সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে দশচক্র আর চৌধুরীরা। তাদের প্রভাবে খোদ নগরপাল অসহায়। এই দশচক্রের মধ্যে অনেকগুলো ব্যবসায়িক চক্র আছে। প্রতিটি সেক্টর এক একটা চক্র। লবণচক্রের প্রভাব এখানে অনেক বেশি। আরেকটা চক্র নিয়ে কথা না বললেই নয়। জাদুচক্র। শুক্তি নগরে জাদু নিষিদ্ধ। জাদু করতে দেখলেই গর্দান নিতে হবে। ফলে ওরা পালিয়ে বেড়ায়, নিজেদের লুকিয়ে রাখে। একবার প্রকাশ পেলে আর রক্ষে নেই। যে বিষয় সাধারণ মানুষের আয়ত্বের বাইরে, একজন বিশেষ কেউ বিশেষ কিছু করতে পারে — তাকেই জাদু হিসেবে অভিহিত করা হয়।
মার্গে জাদু যেহেতু নিষিদ্ধ, সেহেতু কেউ জাদু করতে পারবে না। দেবী দাউদাউ এখানে প্রধান। ধর্মের দিকগুলোও বেশ আকর্ষণীয়ভাবে লেখক উপস্থাপন করেছেন। দাউদাউ, কলকল, চন্নিঠাকুর, সুয্যিঠাকুর নামগুলো ভিন দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের কথা বয়ান করে।
▫️বিশাল এই বইতে অসংখ্য চরিত্রের আনাগোনা রয়েছে। যার প্রধান বীরকে ধরে নেওয়া যায়। তার এক যাত্রা এখানে বর্ণিত। যে কাজে সে যাচ্ছে তার কিছুই সে জানে না। তার এই যাত্রায় ঠেকে শেখার যে বয়ান লেখক দিয়েছেন, আমার কাছে যথাযথ মনে হয়েছে। নিজ অঞ্চলে নিজেই রাজা, কিন্তু অন্য বিভুঁইয়ে পা রাখলে তার গুরুত্ব থাকে না।
বীরের এই চলার পথে অনেকের সাথেই পরিচয় হবে। মধুদামাদ, গণক, বাবাবতুতা, চাবুকমারু, ইরারি। প্রত্যেকের গুরুত্ব এখানে অপরিসীম। চাবুকমারুর যে দক্ষতা আর চরিত্রের দৃঢ়তা এখানে উপস্থাপিত হয়েছে, এর সাথে চরিত্রকে রহস্যময় করে তুলেছে। এক হাত, এক পা, এক চোখের সাথে কাঁধে এক দাঁড়কাক। জাহাজের সারেং, সওদাগর না নীলদাড়ি? কে এই চাবুকমারু?
পুরো বইটাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে মধুদামাদ। এই চরিত্রকে আপনার বিরক্ত লাগবে, ইচ্ছে করবে ঘাড়ের মধ্যে রদ্দা দিয়ে অজ্ঞান করে দিতে, কিন্তু দিন শেষে তার কাজের সফলতাও কাম্য। পেশায় সে উকিল। আর উকিল বেশি কথা বলে। একসময় মনে হয় মধু কাজে ফাঁকি দিতে ওস্তাদ, কিন্তু যখনই নিজের কমফোর্ট জোনের মধ্যে এসে কাজের ফিরিস্তি দিতে হয় তারচেয়ে সেরা কেউ নয়। ভিনবোল হিসেবে বাবাবতুতা খুবই দুর্দান্ত এক চরিত্র। এমন বিশ্বাসী মানুষ পাওয়া খুবই দুষ্কর। গণকও শেষে বেশ কাজের হিসেবে ধরা দিয়েছে।
আরও দুইজনের কথা না বললেই নয়, জলিলিও জলিলি ও নাপো। জলিলি পন্ডিত, বিজ্ঞানী। তার কাজের ক্ষেত্রে বেশ পটু। কিন্তু যখনই ধর্মীয় গুরুর বিরুদ্ধে কিছু যায়, তখন সেটা নিজের বিরুদ্ধেও বয়ান দেয়। মিথ্যে দোষারোপে গর্দান যাওয়ার মতো অবস্থা। যে তেজোসৃপের চোখের কথা এখানে বর্ণিত, সেই চোখের আগুনে না-কি চন্দ্রে ফোসকা পড়ে গিয়েছে। লেখক যে বাস্তব ঘটনাগুলো এখানে বর্ণনা করেছেন, মনে হয়েছে ছক কষে, হিসাব করে সবকিছু রচিত। তাই কোনো ত্রুটি পাওয়া সম্ভব নয়।
নাপো শুক্তি নগরের সেনাপতি। তার চরিত্রের দৃঢ়তা মুগ্ধ করার মতো। দাস থেকে সেনাপতি হওয়া শুক্তি নগরে কঠিন, যেখানে চৌধুরীরা এই পদ ধরে রেখেছিল। নাপো কীভাবে হলো, তার বয়ান শেষের দিকে বেশ আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। লক্ষ্য ও দৃঢ়তা থাকলে সবকিছুই সম্ভব। কিন্তু অভিজাত শ্রেণীর কাছে নিচু শ্রেণী অবজ্ঞার বস্তু। তারা কি শান্তিতে থাকতে দিবে?
শুরু থেকেই বইয়ের একটা জিনিষ মনে হচ্ছিল, এখানে কোনো শক্তিশালী নারী চরিত্র নেই। যা ভীষণ হতাশ করছিল। মাঝে ইরারি এলো। তাকে লেখক খুব একটা স্পেস দেননি। তবে চরিত্রটা এমন, তার স্বল্প সময়ের অবস্থান ও চরিত্রের দৃঢ়তা তাকে গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্রে পরিণত করেছে। এরপরে এলো মৃগতনু। একবার মনে হয়েছিল, তাকে রাখা হয়েছে শোভা বর্ধনের জন্য। কিন্তু শেষের দিকে তার যে গুরুত্ব দেখানো হয়েছে, এরচেয়ে চমক দেওয়া হয়তো সম্ভব ছিল না।
লেখকের এই গুণ ভালো লেগেছে। প্রতিটি চরিত্রকে কোনো না কোনো গুরুত্ব দিয়েছেন। কিছু নাম বেশ মজাদার। ভীষণকিল, ঋজুকদম, কর্ণকিট, লিং, ভাবুকমারু, ছোটো পেদ্রো ইত্যাদি। তবে আরেকটা চরিত্র এখানে ছিল, যে না থেকেও গল্পকে এগিয়ে নিয়েছে। নাথু! এই চরিত্রের পেছনে অনেকেই ঘুরছে। রহস্যময় এক চরিত্র। যে একের পর এক প্রাণ হরণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তার লক্ষ্য কী কেউ জানে না। এই চরিত্রের উন্মোচন যেভাবে হবে, কেউ হয়তো প্রত্যাশাও করবে না। লেখকের এই দক্ষতাও প্রশংসা করার মতো। শেষের দিকে অনেকগুলো চমক তিনি রাখতে পেরেছিলেন।
▫️বইটির সবচেয়ে ভালো দিক কোনটি? এমন প্রশ্ন করা হলে আমি বলব, এর ভাষাশৈলী। কী দুর্দান্ত, অমায়িক লেখা। পুরো বইতে কোনো ইংরেজি শব্দের ব্যবহার নেই। নিজে বেশকিছু শব্দের অবতারণা করেছেন, যা পড়তে ভালো লেগেছে। কয়েকটা উদাহরণ দিই — বারবিকিউকে তিনি লিখেছেন ঝলসি, জেব্রাকে ডোরাবাঘ, চাকে পিচিং, ভাষাকে বুলি, ধর্মকে মার্গ; ইত্যাদি এমন অনেক শব্দ ছিল। তার নতুন নতুন শব্দ আমোদ দিয়েছে, কিন্তু পড়তে অসুবিধা হয়নি। লেখনশৈলী সাবলীল ছিল।
এই বইটা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, কোনো নবীন লেখক যদি লেখার আগে এই বইটা পড়তে পারে তাহলে তারই মঙ্গল হবে। অনেকেই কেবল বাংলাভাষার ব্যবহার করতে গিয়ে কঠিন শব্দের অবতারণা করেন। কিন্তু সহজ ভাষাতেও যে কেবল বাংলা শব্দের উপর ভরসা করে দারুণভাবে লেখা যায়, এই বইটা তার উদাহরণ। একটা ফ্যান্টাসি বইয়ের লেখা তো এমনই হওয়া উচিত। যার ঘোর থেকে বের হওয়া কঠিন, রেশ থেকে যাবে অনেকক্ষণ।
লেখকের হিউমারের প্রশংসা করতেই হয়। বইটা পড়তে গিয়ে কতবার যে নিজের অজান্তেই হেসে উঠেছি, তার হিসাব নেই। কঠিন কিছু মুহূর্তেও হিউমার দিয়ে লেখক পাঠকের সাথে মনস্তত্ত্বের খেলা করেছেন। এই যে লেখকের বর্ণনার সহজভঙ্গি, এতে করে পাঠকের সাথে বইয়ের এক ধরনের সংযোগ স্থাপিত হয়। চরিত্রগুলোকে আপন মনে হয়। এই দক্ষতায় যে লেখক লিখতে পারেন, বইয়ের সাথে সাথে তিনিও যেন পাঠকের সাথে গল্প করেন। যে গল্প শেষ না হোক, পাঠকের এমন চাওয়া তৈরি হয়।
▫️ তেজোসৃপ নামের এক প্রাণী এই বইয��ের অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে উল্লেখ করা যায়। একাধিক এমন প্রাণী রয়েছে। তাদের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। কেউ আগুন ছুঁড়ে, কারো আগুন তৈরি হতে লেগে যায় অনেক অনেক বছর। তেজোসৃপের সাথে এক অদ্ভুত কুহকিনীর কথাও বলা যায়। কে সে? বই পড়লেই জানা যাবে।
এখানে দুই তেজোসৃপের লড়াই বেশ আকর্ষণীয় ছিল। তাছাড়া তেজোসৃপের আক্রমণে জাহাজের কী হাল হতে পারে, তার প্রতিফলন লেখক ঘটিয়েছেন। শেষে আরেকটা লড়াই ছিল, মানুষ বনাম তেজোসৃপের। এই বর্ণনা লেখক এর দারুণভাবে দিয়েছেন, অ্যাড্রেনালিন হরমোনের ছোটাছুটি বেড়ে যায়।
এক সমুদ্রে ভ্রমণে কত প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে, তার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন লেখক। দুই রাজ্যের মধ্যে কূটনীতির অবনতি, নিজ রাজ্যে মতের বিরোধ, যুদ্ধের মতন পরিস্থিতির তৈরি, কত ষড়যন্ত্র, রাজনৈতিক কূটচাল ছিল বইয়ের পাতায় পাতায়। লেখক প্রতিটি বিষয় এমনভাবে লিখেছেন, যেন তিনি নিজে জানতেন তিনি কী করতে যাচ্ছেন। এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল বলেই তিনি তার সবটা দিয়ে বিশাল এই উপাখ্যান লিখতে পেরেছেন।
লেখকের দক্ষতা আরেকটু দিশা পায়, যুদ্ধের বর্ণনা ও সমরবিদ্যায়। এখানেও তিনি ছক কষে প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা করেছেন। যেন এই যুদ্ধের সেনাপতি তিনিই। তার মস্তিষ্কের নিউরনে যে যুদ্ধের কলাকৌশল আছে তার পুরোটা ঢেলে দিয়েছেন বইটিতে।
▫️বইটির শেষটা এমনভাবে হয়েছে, এরচেয়ে যথাযথ সমাপ্তি আর হয় না। একসময় মনে হচ্ছিল, লেখক কি অসমাপ্ত রেখেই কাহিনি শেষ করবেন? সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, অথচ কাহিনি এখনো অনেক বাকি। তবে শেষে এসে যে গতির ধাক্কা দিয়েছেন, সেটা সামলানো শুরুতে দায় হয়ে উঠছিল। অনেক ঘটনা খুব দ্রুত ঘটেছে। অনেক চমক লেখক সামনে এনেছেন। আর পুরোটা শেষে যে সমাপ্তি হয়েছে, আমার কাছে শতভাগ যথাযথ মনে হয়েছে। যদিও এর পরের ঘটনা পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা মনে জমছে। কবে পারব, কে জানে!
▪️পরিশেষে, কিছু বই শেষ করার পর যে ঘোরলাগা কাজ করে, তার থেকে বেরোতে ইচ্ছে করে না। “আগুনি” তেমন এক উপাখ্যান। এর ঘটনাপ্রবাহ, চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় প্রতিনিয়ত। এমন এক বই পাঠকের ঘরে ঘরে থাকা উচিত। এমন এক বই বাংলা ফ্যান্টাসি সাহিত্যের ইতিহাস বদলে দিতে পারে। তারপরও কোন অভিমানে বা আক্ষেপে লেখক পাঠককে বঞ্চিত করছেন, তা জানি না। আশা করব লেখক দ্রুতই বইটা প্রকাশের উদ্যোগ নিবেন। একই সাথে পরবর্তী বইটিও লিখবেন। যাত্রাটা যে এখনো বাকি।
এই বইয়ের রিভিউ লেখা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা হয়ে যাবে৷ এটুকু নিঃসন্দেহে বলতে পারি বাংলাভাষায় অভিযানধর্মী রূপকথা ধারায় এটি একদম প্রথমে স্থান পাবে এবং এর ধারেকাছে রাখার মত কাউকে পাওয়া যাবে না। প্রথমত, এই বইয়ের ভাষা এক অনন্য কীর্তি। বিভিন্ন বিস্মৃত শব্দ ও অব্যবহৃত শব্দের পাশাপাশি বহু নতুন সফল বাংলা অনুবাদ ও শব্দ প্রণয়ন পাঠককে সদানন্দিত রাখে। দ্বিতীয়ত, হাস্যরস ও চলিতসংস্কৃতির সুকৌশলী প্রয়োগ এই সুবৃহৎ বই পড়ার ক্লান্তিকে তুড়ি মেরে দূর করে দেয়। তৃতীয়ত, ঘটনাবিন্যাস ও সমান্তরাল জগতসৃষ্টির অসামান্য দক্ষতা এই বইকে আর পাঁচটা ভালো বাংলা বইয়ের থেকে অনেক অনেক যোজন এগিয়ে দিয়েছে। এটি ছাপা হয়ে এখনও বেরোয়নি। বেরোলে বইয়ের জগতে তোলপাড় পড়ে যাবে, এটুকু ভরসা রাখা যায়। লেখকের জন্য শুভেচ্ছা রইল, অমর হবে এই বই।
আগুনি বাংলা সাহিত্যের একটা ক্রোশফলক । এর হাত ধরে একসময় বাংলায় ফ্যান্টাসি বইয়ের শাখা বদলে যাবে । এত অসাধারণ জগৎ তৈরী, চরিত্রায়ন, বর্ণনা শব্দ নিয়ে খেলা করা কোনকিছুই আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মত না । আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন আমাদের মধ্যে একটা টার্ম প্রচলিত ছিল, কোন কিছুর তীব্রতা বোঝাতে ব্যবহার করতাম । যেমন কুকুরের মত খিদা, কুকুরের মত গরম ইত্যাদি ।
আগুনি কুকুরের মত ভাল একটা বই । আমি পরের পর্বের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি । আশা করি এই বইটি একদিন ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হবে । আমার বইয়ের শেলফের একটা তাক আমি এখনই তেজোসৃপ আর তিলোত্তমার জন্য বরাদ্দ রেখে দিয়েছি । লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ এত বিশাল কলোবরের এত অসাধারণ একটি বইয়ের জন্য । আর গল্পদ্রুম ( https://golpodroom.com/ ) কে ধন্যবাদ এই বইটি পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য ।
মানুষ কেন বই পড়ে? জ্ঞানী হবার জন্য নাকি স্রেফ আনন্দের জন্য? অন্যদের কথা জানি না, আমি পড়ি আনন্দের জন্য। সেই ফাঁকে যদি দুয়েকটা জ্ঞানার্জনের পূণ্য অর্জিত হয় সেটা বাড়তি লাভ।
তো, এই পড়াশোনা ব্যাপারটা জ্ঞানার্জনের পাশপাশি মানুষের কল্পনাশক্তির প্রসারণ ঘটায় ব্যাপক ভাবে। আমি নিজে স্কুল বয়স থেকে আজ অবধি হাজার হাজার হাবিজাবি বই গিলে নিজের কল্পনাশক্তির বড়সড় এক পর্বত দাঁড় করিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনে আর নতুন কিছু পড়ার নাই। কিন্তু কয়েকদিন আগে শেষ করা একটি অভিনব পুস্তকের কাছে আমার সমস্ত কল্পনাশক্তির পর্বতের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে। আরেকটুর জন্য ধ্বসে পড়েনি।
মজার ব্যাপার হলো, আমি আগ থেকেই জানতাম আমি একটি কল্পকাহিনী পড়তে যাচ্ছি যার সাথে বাস্তবের কোন যোগসূত্র নেই। তবু এই হোঁচট খাবার কারণ কী?
জানতে হলে, পড়তে হবে।
আপনি অনেক জ্ঞানী কিংবা পড়ুয়া হতে পারেন, কিন্তু আমার বিশ্বাস এমন কিছু আপনি আগে কখনো পড়েননি। বড়দের রূপকথা হিসেবে ঘোষিত অভিনব গ্রন্থটির নাম ‘আগুনি’। কথাসাহিত্যিক মাহবুব আজাদের সাম্প্রতিকতম সৃষ্টিকর্ম।
এটা আপনাকে এমন কিছু দেখাবে যাতে আপনার অভ্যস্ত চিন্তাভাবনার কম্পাস উল্টোদিকে ঘুরে যেতে পারে। শুধু বাংলা ভাষায় নয়, পৃথিবীতে অন্য কোন ভাষাতে এমন অদ্ভুত কোন উপখ্যান লেখা হয়েছে কিনা জানা নেই। এই উপখ্যানের বিষয়বস্তু যেমন বিচিত্র, তেমনি স্থান, কাল, পাত্র সবকিছুই বিচিত্র। আমাদের চিরচেনা যে জগতটির মধ্যে আমরা বাস করি, এটা তার চেয়ে একেবারেই আলাদা। এতখানি আলাদা হওয়া সত্ত্বেও আপনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারবেন না। এখানে রহস্য, রোমাঞ্চ, কুটচাল, রসবোধ সবকিছুই এমন নিবিড়ভাবে সন্নিবদ্ধ হয়েছে যে পড়তে পড়তে একসময় আপনার মনে হবে আপনিও আগুনির জাহাজের এক নাবিক।
আপনাকে কেউ ১২৯৬ পৃষ্ঠার বই পড়ার অনুরোধ করলে আপনি আঁতকে উঠতে পারেন। ভাবতে পারেন ইহজীবনে এই পুস্তক আপনার পক্ষে শেষ করা অসম্ভব। আমিও শুরুতে তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সাহস করে যখন আগুনির প্রথম দুটো অধ্যায় শেষ করলাম, তখন আবিষ্কার করলাম, আগুনির কল্পজগত আমার একাংশ দখল করে ফেলেছে। আমার ঘোরতর বিশ্বাস, ‘আগুনি’ বাংলা সাহিত্যে একটা অভিনব সংযোজন হতে যাচ্ছে।
আগুনির প্রেক্ষাপট অতীতকালের এক পৃথিবী। কিন্তু এর সময়কাল বোঝা সহজ নয়। কখনো মনে হবে মধ্যযুগ, কখনো মনে হবে আরো প্রাচীন কোন যুগ। আগুনিতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি, খাদ্যাভ্যাস, ভৌগলিক বিবরণ সবকিছুই আমাদের চেনা জগত থেকে আলাদা। এমনকি রূপকথায়ও আমাদের চেনা জগতের অনেক কিছু উপস্থিত থাকে, আর কিছু না হোক খাবার ��াবারগ��লো পরিচিত। এখানে আপনি এমনসব খাবারের নাম শুনবেন- যা এই ভূগ্রহের কোথাও কখনো ছিল না। এমনসব পশুপাখির উপস্থিতি আছে যা আমাদের চেনা জগতে নেই। আপনি বিস্মিত হবেন প্রাচীন যুগের আদিম প্রযুক্তির বিচিত্র ব্যবহারে।
কিন্তু এত অদ্ভুত আজগুবি কাহিনীতে ভরপুর আগুনিতে আপনি এমন কিছু অতিচেনা মানুষের দেখা পেয়ে যাবেন, মনে হবে প্রতিদিন আপনি তাদের কোন না কোন পত্রিকার পাতায় দেখেন। বিষয়টি খুব চমকপ্রদ। বিচিত্র কিছু মানব চরিত্রের সার্বজনীন উপস্থিতি এবং নিঃসন্দেহে তারা বাঙালী। কিছু ক্ষেত্রে আপনার চেনা পাশের বাড়ির লোকটিও হতে পারে। এখানে এমন কিছু বিচিত্র চরিত্রের মানুষের দেখা পাবেন যাদের চলমান কাণ্ডগুলো আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে বইয়ের শেষ সীমানা পর্যন্ত। মধুদামাদ বা বাবাবতুতার মতো দুটো চরিত্রের উপস্থাপনা এতই নিপুন হয়েছে যে বইটি শেষ করার পরও পাঠতৃষ্ণা রয়ে গেছে তাদের পরবর্তী কাণ্ডকারখানা জানার জন্য। শুনলে অবাক হতে পারেন ১২৯৬ পৃষ্ঠার বিপুলায়তনের এই উপাখ্যান পড়ার পরও পরের খণ্ড পড়ার অপেক্ষা করছি।
শেষ করার আগে আগুনির ভবিষ্যত পাঠকদের জন্য একটি পরামর্শ। গড়পড়তা গল্প উপন্যাসের গতিতে আগুনি পড়া অনুচিত। একটু সময় নিয়ে, ধীরে সুস্থে, রয়ে সয়ে আগুনির ‘পিচিং’ পান করতে হয়। ভাবছেন ‘পিচিং’ আবার কী বস্তু? না জানাই স্বাভাবিক এই পানীয় কেবল আগুনিতেই পাবেন আরো অদ্ভুত কিছু খাবার দাবারের সাথে। আগুনির কয়েক অধ্যায় পাঠ করলেও পড়লে আপনিও এক পেয়ালা পিচিং নিয়ে বসতে চাইবেন। আগুনিতে এমন সব অচেনা অজানা খাবার আছে প্রথম দিকে যা বুঝতে একটু কষ্ট হলেও একসময় অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। এছাড়াও আগুনিতে প্রাচীন যুগের এমন সব অপ্রচলিত বাংলা শব্দ আছে, যা সচরাচর কোথাও দেখা যায় না। সুখের বিষয়, এসব অপ্রচলিত শব্দ এবং নতুন তৈরী হওয়া শব্দের মর্মার্থ গ্রন্থের শেষাংশে যুক্ত করেছেন লেখক।
আগুনি এখনো অনলাইন সংস্করণে নরম ইবুক আকারেই আছে। মুদ্রিত কাগজ মলাটের শক্ত বই হিসেবে কী বাজারে আসবে? তা জানি না। কিন্তু আমার বুকশেলফের একটি শূন্যস্থান অপেক্ষা করবে আগুনির কাগজে ছাপানো মুদ্রিত পুস্তকের জন্য।
বাংলা সাহিত্যে এইরকম বই পড়ি নাই। নাই। ইংরেজীতে কিছুটা সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ার কাছাকাছি ব্যাপ্তির দিক দিয়ে। কিন্তু তার সাথে একেবারে বাঙালি উপাদান, হাস্যরস, গল্পের মিশিয়ে এমনকিছু লেখা শক্তিমান লেখকের পক্ষেই সম্ভব। বইয়ের পুরো রিভিউ দিতে আরেকটা বই লেখা লাগবে। তাই অত্যন্ত সংক্ষেপে লিখি যে ব্যাপার গুলা দুর্দান্ত:
গল্পের গাঁথুনি: There is no unintentional loose end, which is very impressive even if we just consider the size of the book, it is like a beautiful complex math equation। চরিত্র, জায়গা, খাবার, গল্পের গতি, borderline surreal humour, ঐতিহাসিক এবং কাল্পনিক ব্যাপারগুলো, এরমধ্যে তারসাথে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ঘটনা এতগুলা ভ্যারিয়েবল নিয়ে কাজ করে এই রকম শক্ত গাঁথুনির গল্প খুবই কষ্টসাধ্য হওয়ার কথা । কিন্তু তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো বই পড়ার সময় এই বিপুল কর্মযজ্ঞের ভার টের পাওয়া যায় না। খুবই সুখপাঠ্য ।
দোষে গুণে মিলানো সাধারণ মানুষের অসাধারণ এডভেঞ্চার চরিত্ররা এডভেঞ্চুরাস কিন্তু খুবই মানবিক। আমাদের আসেপাশে দেখা লোকজনের মতো দোষেগুণে মিলানো। চরিত্রের মধ্যে আমি বাবাবতুটা, মধুদামাদ , গণক ট্রিও এর সুপার ফ্যান, নাচুনি বুড়ি, নীলদাড়ির জাহাজের লোক, শুক্তিনগরের লোকজনও জটিল। বীর চরিত্র এর ডেভেলপমেন্ট ও খুবই ভালো। এপিক গল্প যে বীরপূজা দেখা যায় সেটা নাই। চরিত্ররা মাটির কাছাকাছি। চরিত্রদের ধারাবাহিকতা এবং ডেভেলপমেন্ট বেশ শক্তিশালী
ভূগোল এর ব্যাপারে অনুমান করতে পাজল সল্ভ করার মজা পেয়েছি। এতো এতো জায়গা এতো এতো জায়গার ইউনিক চরিত্রে তৈরী করা অনেকটাই লর্ড অফ টি রিং অথবা আইস এন্ড ফায়ারের মতো। কিন্তু তার সাথে যেটা ইউনিক জায়গার নামকরণ : অঙ্গ বংগ কং: কলিঙ্গ , থাইল্যান্ড, চং:চীন, শুক্তি ইংল্যান্ড? জং: মধ্য প্রাচ্য? (edit: মন্তব্যে একজন যেমন শুধরে দিয়েছেন: জং জাপান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি)
আমি খাবারপ্রিয় মানুষ: এতো মজার মজার খাবার, বিশেষ করে চেনাজানা দেশি শুঁটকি,মাছভাজা, চটপটি, এমন ফ্যান্টাসিতে এইরকম ভাবে ইন্টিগ্রেট করা! একটুও আউট অফ প্লেস লাগে নাই। বিদেশে থাকি এইসব খাবারের দোকানপাট হাতের কাছে নাই। তাই পাঠেই পুরো ভোজন করতে হয়েছে। কাজের পর রাতের খাবারের পর পড়েছি বই। কিন্তু জিভে জল আসা তাতে কম হয় নাই। আশা করি আজ থেকে দুইশ বছরপর এই খাবারের বর্ণনা মানুষের মনে হিংসার উদয় করতে সক্ষম হবে :ড
স্টোরি লাইন খুবই ভালো লাগছে। এতো বড়ো বই, এতো চরিত্র আর জায়গা, স্টোরিলাইন এর দিক ঠিক রাখাই তো একটা বিরাট কাজ! কিন্তু স্টোরি লাইন খুবই আগ্রহজাগানিয়া, চমক আছে অনেক, বিশেষ করে একেবারে শেষে :)
লেখকের রসবোধ সব সময় ই জটিল। কিন্তু এইখানে এইভাবে seamlessly incorporate করা সিম্পলি মাইন্ড blowing . আমার মাথায় যেই দৃশ্য ছাপা হয়ে গেছে সেইটা হলো কবিতায় ড্রাগন তাড়ানো, আর নাচুনি বুড়িদের কবিতায় কথা বলা। মাল্টিডিমেনশনাল থিংকিং আর জায়গায় জায়গায় কোথায় কবিতায় রস বোধ গুলা বলা বাদ দিলুম।হাস্যরস আর গল্পের গাঁথুনির ব্যালান্স দুর্দান্ত। বিভিন্ন চরিত্রেরখুনসুটি এই কোবিদ লোকডাউনের আটকা পরা বহুদিন না মানুষ দেখা বান্দার জন্য এর জন্য মলমের মতো কাজ করেছে। অনেক জায়গায় বর্ডারলাইন surreal &silly কৌতুক গল্পের গভীরতা নষ্ট না করে বরং বৃদ্ধি করেছে। কায়দাটা কি?
ঐতিহাসিক ব্যাপারগুলা আমার ধারণা আমি ২০ পার্সেন্ট ধরতে পারছি। তাতেই খুব intriguing! কোনটা হিস্টরিকাল এলিমেন্ট আর কোনটা ফ্যান্টাসি সেইটা গেস করতে মজা পাইছি। আর কনটেম্পোরারি বাংলাদেশী জিনিসগুলা কিছু কিছু ধরতে পারছি। Spoiler: গল্পের গসিপ রাজ্যের নাম মতিরমন আর বিজ্ঞানীর নাম জলিলিও :ড
শেষ কথা: এমন মৌলিক বই লেখা আগুনি প্রাপ্ত লেখকের দ্বারাই সম্ভব :) পরের বই গুলাতে এইগুলো ছাড়াও আরো বেশি তেজসৃপ, আরো তিলোত্তমা, আরো সাধারণ অসাধারণ মানুষজন (ইনক্লুডিং LGBTQ+ ) দেখতে চাই।
(বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে রিভিউ দেওয়ার মাফ চাইলুম। আগে ইংরেজি পারতাম না, এক দশকের বেশি প্রবাসজীবনের ফল এখন বাংলা ও পারি না তেমন। অনেক মনের কথা বলতে ঠিক বাংলা শব্দ খুঁজে পাই না।)
বই এর সমালোচনা লেখার মত বিদ্যা আমার নেই। আগুনির এই পাঠপ্রতিক্রিয়া একান্তই আমার মনের কথা; বইটা পড়ে একজন দুর্বল পাঠক হিসেবে যেটা অনুভব করেছি তাই লিখলাম।
আগুনি পড়ে শেষ করলাম কয়দিন আগে। এই রকম বই বাংলা ভাষায় আগে লেখা হয়নি, ফুলস্টপ। এইটা হল ফাঁকিবাজি, আরোও খানিকটা খোলাসা না করলে অপরাধ হবে। বেশ কিছু ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে দিনে আট বা দশ পাতা, এমন করে আগুনি পড়েছি। এমন হচ্ছে বেশ কিছু দিন থেকেই, অল্প করে পড়তে পাই; কিন্তু পার্থক্যটা হলো যে বেশ অনেকটা সময় লাগলেও আগুনি শেষ করেছি। বই এর ঘটনা-মটনা নিয়ে কিছু লিখতে চাই না, নিজে পড়ে মজা নিন। সোজা বাংলায় বলি, আগুনি পড়ে আমার অনুভূতি দুই রকম হলো। এক হলো অসাধারণ আনন্দ। আমার বই পড়ে তখনই আনন্দ, যখন দিনের শেষে নিজের জন্যে বরাদ্দ সামান্য সময়টুকুতে কী করি কী দেখি কী পড়ির মাঝে খুব সহজে একটা কিছু পড়ার মত হাতে নিতে পারি। মানে দাঁড়ালো জোর করে ঠেলেঠুলে বইয়ের ��াঝে নিজেকে ঠুসে দিতে না হয় যদি, আর যদি বইটা সারা দিন নানা কাজের আর চিন্তার ফাঁকে টানতে থাকে বারবার, সেটাই আনন্দ। ভুলে গিয়েছিলাম এই ব্যপারটা। প্রথমবার শঙ্কু বা সন্দেশ বা কপোট্রনিক সুখ দুঃখ পড়ার মত ঘটনা ঘটে গেল আগুনি পড়ার সময়। দুই হলো অপরাধবোধ। সময়ে অসময়ে অনেক সু/কুপদ্ধতি অবলম্বন করে বই জোগাড় করে পড়েছি। এই রকম অপরাধ বোধ করিনি। কী বিপুল পরিশ্রম এই বই এর পেছনে এর লেখক ও তার সহযোগীরা করেছেন! তারপর বিনামূল্যে পাঠকের হাতে দিয়ে দিলেন আগুনি! এটা কিভাবে সম্ভব হল জানি না। কিন্তু বারবার শুধু মনে হচ্ছে লেখককে বেজায় ঠকালাম!
আমার মত আম-মানুষের সমস্যা হল, আমাদের কথার ঠিক নেই। এই দুই লাইন আগে বললাম আগুনি পড়ে আমার অনুভূতি সাকুল্যে দুই; অথচ আগুনির একটা ছাপা কপি বগলে রাখার যে ভয়ানক লোভ হচ্ছে, এই অনুভূতির কথাটা না বলে যাই কী করে। ছাপা বইপত্তর তেমন কিছুই আমি সাথে রাখাতে পারিনি; খুব হিসেব করে গোটা কয় নিয়ে ঘুরি; তারপরেও, রংচঙে একটা ছাপা আগুনির মালিক হওয়ার লোভ হচ্ছে খুব।
লেখকের যে নাম ছাপা হয়েছে আগুনিতে, মাহবুব আজাদ, এইটা আমার কাছে খুব গেরেম্ভারি ধরনের। কেমন পর পর লাগে; এর কারণ, সৌভাগ্যবশত লেখককে অন্য একটা নামে অল্পস্বল্প জানি; এটা অবশ্য দুর্ভাগ্যও, আগুনির মত বই যেমন বাংলায় আগে কেউ লেখেনি, ঠিক সেইরকম লেখা থামিয়ে চা-চু খেতে উধাও হয়ে যাবার মত লেখক আর দুইটা নেই। কী আর করা, লাঠি হাতে লেখক ব্যাটাকে খুঁজতে না নামলে, আগুনির পরের পর্ব বাদ দিলাম, ছাপা আগুনি কবে পাবো সেই নিয়ে আপাতত চিন্তিত।
বইটি পড়তে শুরু করার আগে দ্বিধায় ছিলাম, ইন্টারনেটে প্রচুর প্রশংসা পাওয়া বই পড়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই এই সংশয়। আর সত্যি বলতে কাহিনীটিতে এত চরিত্র যে শুরুতে খানিক গুলিয়েই যাচ্ছিল। তবে খানিক ধাতস্থ হওয়ার পরে, আগুনির তিনটি খণ্ড শেষ করে একটাই আক্ষেপ মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, আরও বেশ কয়েক বছর পরে কেন এই বই পড়লাম না! তাহলে ততদিনে 'তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা'র পরের বইটিও প্রকাশ পেয়ে যেত, আর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া অজস্র প্রশ্ন নিয়ে হা পিত্যেশ করে বসেও থাকতে হত না আর কী! চরিত্রচিত্রণ, ভাষার ব্যবহার ও কাহিনী সব মিলিয়ে বইটি যে দুর্দান্ত লেগেছে, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা প্রাপ্তমনস্ক কল্পকাহিনী পড়তে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এই বইটি অতীব সুখপাঠ্য হবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দাউদাউ, কলকল, হুহু, চান্নিঠাকুর সব্বার কাছে প্রার্থনা, দ্বিতীয় বই খুব তাড়াতাড়ি চলে আসুক, আর যদি সম্ভব হয়, তাহলে মুদ্রিত বই আকারে এ কাহিনী প্রকাশিত হলে বড্ড খুশি হব। ডিভাইসের স্ক্রিনে ঠিক এ বই পড়ে পুরোপুরি উপভোগ করা যায় না, এ বই আরাম করে পাতা উল্টে পড়ার মতো।
আগুন, আগুন! দিনকতক ধরে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখব-লিখব ভেবেও হয়ে উঠছে না তার কারণ, লেখবার সময় কোনো অংশে জোর দিলে বাকিটার প্রতি নেহাৎ অবিচার করা হবে। অন্ততঃ, কোন অংশ ভালো লাগেনি দিয়ে শুরু করলেও একটা হদিশ পাওয়া যেত - কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না কারণ এই বিশালায়তন উপন্যাসটির এমন কোনো পাতাই সম্ভবতঃ নেই যা বাদ দিয়ে যাওয়া চলে। আরও কয়েকবার পড়ে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া যোগ করব ভাবছি। এমন জিনিস আগে কখনও বংবুলিতে পড়বার সৌভাগ্য হয়নি। বইটি বারবার পড়তে চাই, অথচ ছাপার অক্ষরে না পাওয়ায় থেকে-থেকে উলটেপালটে দেখা যাচ্ছে না, এ বড় যন্ত্রণা। বইয়ের লেআউট, ছবি, অন্যান্য অলঙ্করণ, সবই অত্যন্ত উপভোগ্য। কখনও দুই-মলাটের মধ্যে এলে গল্পদ্রুম যেন ইমেইলে প্রি-বুকিংয়ের খবর জানিয়ে দেন, এই অনুরোধ রইল। আর, দেবী দাউদাউয়ের পবিত্র উনুনের দোহাই, হে লেখক, দ্বিতীয় খণ্ডটি তাড়াতাড়ি প্রকাশ করুন।
এক একটা দুর্লভ বই থাকে – যা পড়ার পর পাঁচজনকে সে বইয়ের কথা জানানোটা অবশ্যকর্তব্য এবং না জানানোটা অপরাধ বলে মনে হয়। ‘আগুনি’ তেমনই বিরল একটি বই। এই গোত্রের বই – লেখক মাহবুব আজাদ যাকে ‘বড়দের রূপকথা’ আখ্যা দিয়েছেন – বাংলায় আর আছে কিনা জানি না। ‘তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা’-র প্রথম খণ্ড ‘আগুনি’। বিশাল এক ক্যানভাস জুড়ে লেখক এক কল্পজগৎ তৈরি করেছেন। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন রঙবেরঙের চরিত্র। বিশেষভাবে বলার যে সেই চরিত্রগুলির মধ্যে মানুষের পাশাপাশি এক তেজোসৃপের বয়ানও হাজির তাঁর লেখায়। এতগুলি চরিত্রকে ঘিরে যে মুনশিয়ানায় ঘটনার পর ঘটনার জাল বুনেছেন, তা তাঁর অতুলনীয় দক্ষতার প্রশ্নাতীত প্রমাণ। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম ও সমাজের জটিল সব টানাপোড়েন উঠে এসেছে এ লেখায়। কিন্তু গভীরের সঙ্গে আশ্চর্য নিপুণতায় তিনি মিলিয়েছেন সরসকে, ভাষায় সেই সরসতা বজায় থেকেছে বরাবর, সঙ্গে চলতি গান বা কবিতার পঙক্তিকেও মজার ছলে ভেঙেচুরে ব্যবহার করেছেন। এ বইয়ের সম্পদ এক নতুন ভাষা – যা তরতাজা, চলনে ক্ষিপ্র অথচ ইঙ্গিতময়। লেখক জানিয়েছেন আনকোরা নতুন বাংলা শব্দ জুড়তে তিনি পিছপা নন। এ লেখায় অজস্র উদ্ভাবিত শব্দ কিংবা নামধাতুর ব্যবহার – সবই অত্যন্ত মানানসই। ভাষায় ইঙ্গজ শব্দের বদলে বিকল্প শব্দ বানিয়ে নিয়েছেন লেখক, কিন্তু সেই কাজটা এতই সাবলীলভাবে করা যে পরিভাষাগুলো নিয়ে পাঠককে আদৌ হোঁচট খেতে হয় না, বরং লেখক এ বইয়ে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার বাড়ানোর এক পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘আগুনি’-তে যেখানে যৌনতার প্রসঙ্গ এসেছে সেখানেও এই ভাষার দৌলতে তা অন্যরকমের উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। উত্তেজনায় ঠাসা ঘটনাপরম্পরা, চরিত্রগুলির বৈচিত্র্য ও ভাষার উৎকর্ষ (যা প্রায় সারাক্ষণই পাঠকের ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ঝুলিয়ে রেখে দেয়) পাঠককে মুহূর্তের জন্যও চোখ ফেরাতে দেয় না।
এ কোন বিশদ সমালোচনা নয়, তার যোগ্যতাও আমার নেই। তবে মুগ্ধতা জানাতে তো আর যোগ্যতা লাগে না। ‘আগুনি’ বাংলা সাহিত্যে এক মাইলফলক। ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হলে এ বইয়ের জন্য একটি অধ্যায় বরাদ্দ থাকবে – এরকম মনে হয়। একান্ত প্রার্থনা - শস্ত্রী বীর, চাবুকমারু, মধুদামাদ, বাবাবতুতা, ইরারি (আহা, কী সব নাম!)-র জগৎ সবাই চিনুক। শুক্তি, বহমিকা, নাগরতন, জংদ্বীপের মানচিত্র ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক।
এ বইয়ের কাগুজে সংস্করণ হওয়া খুবই উচিত। আগেভাগেই জানিয়ে রাখি - প্রিবুকিং হলে আমি তালিকায় রইলাম।
আশ্চর্য একটা বই। পাতায় পাতায় ছবি, মনে হয় কৈশোরে ফিরে গিয়েছি সোভিয়েত বইগুলো পড়ার দিনে। যেমন লেখা তেমন আঁকা। গল্পদ্রুম নামে এক প্রকাশনা সংস্থার বই, নতুন ওয়েবসাইট। সেখানে লেখা “জগৎসজ্জাকেন্দ্রিক ফ্যাণ্টাসি বা রূপকথার ধারায় প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে বাংলা সাহিত্যে গল্প-উপন্যাস বিরল। গল্পদ্রুম এ ধারায় নতুন রস সঞ্চারে ব্রতী।” জগৎসজ্জাকেন্দ্রিক ফ্যাণ্টাসি জিনিসটা কি আমাকে কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু বোঝার চেষ্টা করেছি অনেক সেইটাও ঠিক না। বই পড়া আরম্ভ করলে খানিক জগৎসজ্জার ব্যাপারটা বোঝা যায়।
গেইম অফ থ্রোনস আমরা সকলেই পড়েছি, দেখেছিও। সেইখানে সুন্দরী ডানেরিস তিনটে ড্রাগন বাচ্চার জন্ম দেয়, বড় হলে সেগুলের ঘাড়ে চড়ে গ্রাম কা গ্রাম ভস্ম করে দেয়। উত্তরে দেয়ালের ঐপারে হাজার বছর বয়েসী হোয়াইট ওয়াকার আর তাদের সর্দার নাইট কিং পরে একটা ড্রাগন কব্জা করে নেয়। জীববিজ্ঞান পদার্থবিজ্ঞান গণিত এগুলির বালাই নেই। আরেক দুনিয়ার গল্প। নিয়মকানুন সবই আলাদা। আগুনি পড়া আরম্ভ করলে লেখক ঠাস করে সেরকম আরেক দুনিয়ায় নিয়ে ফেলেন। সেখানে অংদেশ আছে, বংদেশ আছে। আরো আছে চং দেশ। অং সায়র টিং সায়র। চান্নিঠাকুর সুজ্জিঠাকুর। বংদেশের তরুণ “বীর”, যে লাঠিখেলায় ব্যাপক দড় (সেও আরেক ঢ়হস্যঃ জনপ্রিয় শাস্ত্র তলোয়ারবাজি বা তিরন্দাজি ছেড়ে কেন লাঠিখেলার ওস্তাদ হল সে?)। মধুদামাদকে সে কুয়া থেকে বের করে আনে কুড়ি (নাকি দশ) গরুর প্রতিশ্রুতির বদলে। লতি ডাকাতকে কুপোকাত করা চলে সহজেই যখন সে দেখে ডাকাত লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশিক্ষিত শস্ত্রী লাঠিকে তৈয়ার রাখে সর্বদা। আছে বিজ্ঞানী জলিলিও জলিলি, দূরবিন নিয়ে কি যেন একটা ফ্যাঁকড়া। টহলনায়ক মোষমানিক দাঁত কিড়মিড় করে বাইরের কক্ষে তার অপেক্ষায়। এক জাদুকর আগুনের খেলা নিয়ে হাজির হয়েছে, তাকে নিয়ে তোলপাড়। তার মতলবটা সঠিক বোঝা যাচ্ছেনা, সে কি তবে আগুন নিয়ে জাদুর হাঁড়ি হাটে ভেঙেই দেবে?
লম্বা গল্প। তরতর করে চলে। এরকম শক্ত গাঁথুনির গল্প দেখে ভালো লাগে, আবার মন খারাপ ও হয়। বাইরের কেউ এরকম গল্প লিখলে শক্ত পরিচালকের হাতে আগুনি নিয়ে চমৎকার মুভি/ টিভি সিরিজ হত নিশ্চয়।
পড়া না থাকলে পড়ে ফেলুন। মারাত্মক সময় কাটার শতভাগ গ্যারান্টি।
মাহবুব আজাদের "তেজোসৃপ" এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করে ফেলার মতন এক বই। বাংলায় লেখা এমন অদ্ভুতুড়ে কল্পকাহিনী আমি এর আগে কখনো পড়িনি। বারবার মনে হয়েছে টেরি প্রাচেট, সুকুমার, আর সত্যজিৎ এর কথা। শস্ত্রী বীর, জলিলও জলিলি, মধুদামাদ, গণক বাবাবতুতা, কাপ্তেন, ইরারী, জাদুকর, সব অসাধারণ চরিত্রের মাঝে মাথায় ঘুরতে থাকে, "তেজোসৃপের চোখ, তেজোসৃপের নখ, তেজোসৃপের ডানা, তেজোসৃপের শ্বাস, তেজোসৃপের আঁশ, তেজোসৃপের ছানা" অং দেশ, বং দেশ, চং দেশ, টিং সায়র, অং বুলি - চং বুলি - সব কিছুর মাঝে পাঠক খুঁজে পাবে চেনা সুরে বলা অচেনা গান। উপন্যাসের মাঝে মাঝে যত্ন করে আঁকা ছবি আর ম্যাপ মনে করিয়ে দেয় লেখকের পুঙ্খানুপুঙ্খ সাবধানতা বা perfectionism. নতুন করে কত যে অচেনা বাংলা শব্দ পরিশ্রমী এই লেখক মালার মতন গেঁথেছেন, তাতে আমি মুগ্ধ। কল্পনাজগত কে কতখানি সমৃদ্ধ করে একটি বিশাল রাজ্য গড়া সম্ভব তার প্রমাণ "তেজোসৃপ"। মাহবুব আজাদের জন্য ভালবাসা এবং "তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা" গ্রন্থমালার জন্য শুভকামনা।
বাংলা ভাষায় সত্যই এরকম আগে কিছু লেখা হয়নি ! লেখক কে কুর্নিশ এই অভূতপূর্ব কাজের জন্য। ভাষা ও হাস্যরসের উপর তার অসামান্য দখল ও প্রয়োগ আলাদা মাত্রা যোগ করেছে ফ্যান্টাসির নবীন জগৎসজ্জার উপর ।
আমার বিশ্বাস এই " তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা কথামালা " কালজয়ী হতে পারে কিন্তু তার জন্য পুস্তক পরিবেশনার বর্তমান ব্যবস্থায় পরিবর্তন অতি আবশ্যক ।
৫ তারাই দিতাম; কিন্তু এই বই পড়ার '' ফ্যাকরা " এতই বেশি - পড়তে গিয়ে হয়রানির একশেষ । অচিরেই দুই মলাটের বাঁধনে এই অমূল্য সাহিত্য পড়ার আশা রাখছি ।
দিন কয়েক আগের কথা। অফিসে কাজের মাঝে পরিচিত একজন এসে উপস্থিত। সহাস্যে সম্ভাষণ জানাতেই, তিনি কেন যেন হকচকিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?? আমি তো অবাক! কোথায় মানে? অতিথি বললেন- এই যে হেঁকে উঠলেন- ‘আগুন! আগুন!’ বলি, আগুনটা লেগেছে কোথায়। বুঝলাম, খুব সাম্প্রতিককালে শেষ করা লেখক মাহাবুব আজাদের বড়দের কল্পকাহিনীর বই- তেজোসৃপ ও তিলোত্তমার প্রথম খন্ড- আগুনি’র আঁচ মাথায় পড়েছে বেশ ভাল রকম ভাবে। বইয়ে উল্লেখিত একটি অঞ্চলে, ‘আগুন! আগুন!’ যে হাই, হ্যালোর মতই এক সম্ভাষন। বইটা এদিক থেকে বেশ নতুনত্ব ধারণ করে। আমাদের বাংলা ভাষার সাহিত্যের পরিমন্ডলে কোন এক বিচিত্র কারণে রুপকথা’কে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। কল্পনার অকল্পনীয় বিস্তারে যে অবাস্তবতা বইয়ের পাতায় খুব স্বাভাবিকভাবে ধরা দেয় রুপকথায়, আমাদের কুলীন সাহিত্য বিশারদরা তা উঁচুদরে হয়ত মানতেই নারাজ। তাই হয়ত রুপকথা ছোটদের সাহিত্যের জগতের হাতে খড়ির কাজ করে দিলেও বড়বেলায় সেই জগতে আমাদের আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। কারণ, সাহিত্যিকদের সে অঞ্চলটায় বড়দের জন্য লেখা রুপকথা নেই বললেই চলে। সেখানে তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা সাহিত্যের অঙ্গনে একটা দূর্দান্ত সূচনা এবং সংযোজন বটে। এর প্রথম পর্বটাই বর্তমানে পাঠের জন্য উন্মুক্ত আছে। আগামীতে আরো দুটো পর্ব এসে এই বিস্তৃত আখ্যান সম্পূর্ণ করবে। তবে, সত্যি কথা বলতে কী, তেজোসৃপ ও তিলোত্তমার প্রথম খন্ড আগুনি’কে শুধু বড়দের রুপকথা বলে পরিচয় করিয়ে দিলে এটির প্রতি সঠিক মূল্যায়ন হয় না। এই বইতে নেই কী? রাজনীতির রাজ-রাজড়া থেকে কিং-মেকার, সমস্যা সংকুল সমাজনীতি, কুটনীতির কূটচাল, বাণিজ্যের বাণী আর কৌশল, সাগরের সারেঙদের জীবনাচার, আইন এবং উকিলের প্যাঁচগোঁজ, লড়াইয়ের কড়া নাড়া, যুদ্ধের বুদ্ধি এবং শুদ্ধি, রোমাঞ্চকর ভ্রমণের ভয়ানক আকর্ষণ আর সবচেয়ে আনন্দের হচ্ছে খাবার দাবারের ব্যপারে আকুন্ঠ উৎসাহ নিয়ে বর্ণনা। উপন্যাসটির ভাষাশৈলী নিয়ে আলাদা করে কথা না বললেই নয়। শুরু থেকে শেষ অব্দি লেখক বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছেন। যে জায়গায় প্রচলিত বা পরিচিত বাংলা শব্দ নেই, সেই জায়গায় খুবই সহজবোধ্য বাংলা শব্দ লেখক বানিয়ে নিয়েছেন। সেই শব্দগুলোও এমন সুন্দর যে আপনারও পরবর্তীতে এই শব্দগুলো সুযোগ পেলেই লিখতে বা বলতে ইচ্ছে করবে। কল্পকাহিনী হিসেবে কল্পকাহিনীটি বেশ বড়। এর বিস্তৃত পটভূমিতে ঠাঁই পেয়েছে কল্পিত এক বিশ্বের সাগরঘেরা বা সাগরঘেঁষা অনেকগুলো দেশ এবং মহাদেশ। মজার ব্যপার হচ্ছে, লেখক অঞ্চলভেদে জলবায়ু এবং ভূপ্রকৃতির ছবি তো তুলে ধরেছেনই, সেই সাথে উঠিয়ে এনেছেন সেখানকার মানুষদের সংস্কৃতির ভিন্নতাও। ভাষা, উচ্চারণভঙ্গি, ধর্মবিশ্বাস, পারষ্পরিক সম্পর্ক, জীবিকা, ব্যবসা, সামরিক কৌশল, চিন্তাভাবনা, প্রকাশভঙ্গি সবকিছুতেই যেন প্রত্যেকটা আলাদা এলাকার লোক আলাদা পরিচয় আর আঞ্চলিক স্বতন্ত্র্ অস্তিত্ব নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়। বইয়ে হাস্যরসের কমতি নেই। অবস্থার প্রেক্ষিতে যেমন হাসির উৎস আছে, তেমনি আছে প্রত্যুৎপন্নমতি সংলাপেও। বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ কিছু চরিত্র এমন নাম নিয়ে অবস্থান করছে যে স্রেফ সেই নামটুকুর উল্লেখও আপনার ঠোঁটে হাসি এনে দেবে, কারণ সেই নাম আসলে আমাদের পরিচিত বাস্তব থেকেই উঠিয়ে এনে মলাটের ভেতরে গুজে দেয়া হয়েছে। বইয়ের চরিত্রগুলো বৈচিত্র্যময়। কেন্দ্রিয় চরিত্রগুলোর গঠন ও কাহিনী এগোনোর সাথে সাথে পরিবর্তন- খুবই সুন্দর করে করা। পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেক চরিত্রের ভেতরের বৈচিত্র্যকে বেরিয়ে আসতে দেখি, আমার জন্য যেটা খুব দারুণ একটা পাঠ অভিজ্ঞতা ছিল। বইয়ের অন্যতম শক্তিশালী বিষয় এর অনবদ্য কল্পিত চরিত্র তৈরী এবং বিকাশ হলেও আমার কাছে বইয়ের একমাত্র খুঁতখুঁতানোর জায়গাও এইটাই। প্রথম খন্ডের অর্ধেকের বেশি অংশজুড়ে উল্লেখযোগ্য কোন নারী চরিত্রের দেখাই পাওয়া যায় না। শেষ অংশে কাহিনীর ভীষণ মোচড়ের সাথে এক শক্তিশালী নারী চরিত্রের উদ্ভব ঘটলেও সেটার যে খুব একটা বিকাশ হয়েছে তা বলা যায় না। ঔপনাসিক তাঁর প্রিয় লেখক সত্যজিৎ রায়ের-ই এই বৈশিষ্ট্যটাকে আপন করে নিলেন কী না বোঝা গেল না। তবে সবে তো প্রথম কিস্তি গেল, পরের অংশগুলোতে জাহাজের মুখ কোন দিকে ঘোরে- দেখা যাক। বইটি পড়ার সময় সত্যি বোঝা যায়, কতটা যত্নে আর মেধা খাটিয়ে লেখক এই কল্পরাজ্য তৈরী করেছেন পাঠকদের জন্য। এর বিস্তৃত কলেবরে বোনা প্রতিটি শব্দ প্রাঞ্জল ও পাঠমধুর। কলেবরে বড় হলেও বইটি পড়া শুরু করলে লেখকের গল্প বলার মুন্সিয়ানায় তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যায়। অবাক করা ব্যপার হচ্ছে, এই শ্রমসাধ্য সৃষ্টির প্রথম খন্ড পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য এই মূহুর্তে কোন অর্থমূল্য নেয়া হচ্ছে না। বইটির পরিবেশকের ওয়েবসাইটে গিয়ে পড়ার অনুরোধ জানালেই মিলবে পুরো বইটা পড়ার সুবর্ণ সুযোগ! তবে বইটি পড়ে শেষ করার পর পাঠক হিসেবে আমি এই বইটির প্রতিটি খন্ডের মুদ্রিত সংস্করণ হাতে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা অনুভব করছি। আশা করি অতিমারির এই দূর্দশা কেটে গেলে সেই আকাঙ্খা বাস্তবে রুপ নেবে। আপনার পাঠক মন যখন কল্পরাজ্যে অভিযানের জন্য তৈরীই, তবে আর দেরী কেন? আজই নেমে পড়ুন অজানা এই কল্পনায় গড়া পৃথিবীকে আবিষ্কার করতে। লিংক- https://golpodroom.com/books/aguni
সবে শেষ করলাম। যাকে বলে গোগ্রাসে। বহু দিন গোগ্রাসে কোনও বই গিলিনি। ৬১বছর বয়সে আবার সেই হারানো সুখের দিনের অনুভূতি। অবশ্য এ ব্যাপারে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। আমাকে দিয়ে১২৯৬ পাতার একটা বই এভাবে পড়িয়ে নেওয়ার কৃতিত্ব লেখক মাহবুব আজাদ ভাইয়ের। ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। প্রথম এ গল্পে যা আমাকে টেনেছে তা ভাষা। সম্পূর্ণ বাংলাভাষায় একটা বই! এতদিন মনে হত অসম্ভব। কজনা লিখতে পারেন? এখনতো দেখছি সম্ভব। এবং এ ভাষা কোথাও এলিয়ে পড়েনি। ঝকঝকে, সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত এবং অবশ্যই স্বতঃপ্রভাবি। অনেক অজানা অচেনা শব্দ থাকলেও মানে বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়না। তাছাড়া শেষে নির্ঘণ্ট তো আছেই। দ্বিতীয়, আমার একটা আক্ষেপ ছিল জানেন তো! বড়দের জন্য কেউ রূপকথা লেখেন না। ছোটবেলায় ঠাকুমার কাছে রূপকথা শুনতাম। তারপর আর নেই। বাংলায় আধুনিক যুগে। শৈলেন ঘোষ মহাশয়ের লেখা পড়তাম। খুবই ভালো, মনোহরণ। কিন্তু আর কেউ নেই। বড়দের জন্য তো কেউই নেই। অথচ আমাদের রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি রূপকথার গল্পে ছয়লাপ। অনেকে অবশ্য সেগুলো সত্যি ভাবে আর তার মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজে। যাইহোক, আরব্যরজনী বা চিন জাপান সুমের এবং অবশ্যই গ্রীক পুরাণের গল্পগুলোও রূপকথার খনি। তবে তেজোসৃপ ও তিলোত্তমার ভুবনখানি বড়ো সুখেরও নয়, আনন্দেরও নয়। জটিল রাজনীতি, অর্থনীতি, যুদ্ধউচ্চবিত্তে যেন এ যুগেরই প্রতিফলন। সমাজে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য। উচ্চবিত্তের স্বার্থে নিচুতলার মানুষের বলি চড়ানো সবই আছে। আছে যুদ্ধ। আছে অভিযান আর দেদার মজা। আমি মজে গেছি এ বইয়ে। কাগুজে সংস্করণ বেরোলে জানাতে ভুলবেন না মহাশয়। আগুন আগুন। সবাই ভালো থাকুন।
বইটা পড়ে শেষ করেছি অদ্ভুত ভাল লাগা নিয়ে । Fantasy পড়তে ভালবাসি বরাবর | বাংলা ভাষায় বড়দের fantasy কেউ লেখে না বলে বড় আক্ষেপ ছিল। এই লেখা বাংলা সাহিত্যে মাইলফলক হয়ে থাকবে ৷ এই genre এ এত ভাল লেখা বিশ্বসাহিত্যেও কম ৷ তবে মনখারাপ ও হচ্ছে শেষ হয়ে গেল বলে ৷ চরিত্রগুলোকে আপন করে ফেলেছিলাম অজান্তেই ৷ বন্ধু বিচ্ছেদের মত অনুভূতি হচ্ছে ৷ শেষ কবে এরকম অধীর আগ্রহে কোন বই শেষ করেছি মনে পড়ছে না ৷ লেখককে এবং প্রকাশকদের অনেক ধন্যবাদ | অপেক্ষায় থাকব 'তেজোসৃপ ও তিলোত্তমা' র পরবর্তী খন্ডের জন্য ।