দীর্ঘ অমানিশার শেষে তখন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রথম আলো ফুটে ওঠার পালা ৷ কলকাতায় আসছেন রামমোহন রায় ! তাঁর আগমন যেন সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিচ্ছে ঘোর নিদ্রামগ্ণ জাতির দেহে৷ প্রথম যে মানুষটি সেই ঘুম ভেঙে উঠে এলেন, এবং পরবর্তীতে যাঁর নাম আমরা মুছে ফেললাম, তিনিই দ্বারকানাথ ঠাকুর ৷ এই মানুষটিই নবজাগরণের সেই বিস্মৃত পশ্চাৎপট, যাঁর ছবিতে কখনো আলো পড়েনি ৷ সেই পট, যার উপরে ফুটে ওঠে রামমোহন রায়, ডিরোজিও, ডেভিড হেয়ারের উজ্জ্বল ছবি ৷ ভারতবর্ষের চিকিৎসাব্যবস্থা, চিত্রকলা,গ্রন্থাগার আন্দোলন, অভিনয়শিল্প, প্রথম রাজনৈতিক সভা, ব্যবসাবাণিজ্য...এমন অসীম অনন্ত ক্ষেত্রে তাঁর অন্তহীন দান আমরা অনায়াসে বিস্মৃত হই ৷ উত্তরপুরুষদের বানিয়ে-তোলা এক ছবিকেই আমরা দ্বারকানাথ ঠাকুর বলে জেনে এসেছি সার্ধশতবর্ষ ধরে ৷ একবারও সত্যকে চিনতে চাইনি ৷ এই বই সেই দ্বিধান্বিত, খণ্ডবিখণ্ড, উদার অথচ প্রশ্ণাতুর মানুষটির মুখে একঝলক আলো ফেলেছে ৷ নতুন আলোয় দেখা দিচ্ছে এক বিস্ময়কর মহাচরিত্র ৷ দ্বারকানাথ ঠাকুর ৷ পরাধীন দেশের রাজপুত্র!... এক আশ্চর্য উন্মোচন ৷
বিস্মৃত এক রাজপুত্রের মহাকাব্যিক প্রত্যাবর্তন: রাজা ভট্টাচার্যের ‘দ্বারকানাথ : পরাধীন দেশের রাজপুত্র’
আলোচনার নান্দীমুখ:
“তাঁর পিতা রাজা ছিলেন না, তবু তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম রাজপুত্র।” — এই একক পঙক্তিতে ধরা আছে এক বিস্মৃত নায়কের ব্যতিক্রমী জীবনকাহিনি, যেখানে রাজতন্ত্র নেই, তবু রাজসিকতা আছে—যেখানে নেই কোনও মুকুট, কিন্তু আছে দূরদর্শিতা, প্রতিভা, এবং স্বপ্ন দেখার সাহস।
ঐতিহাসিক সচেতনতার মানচিত্রে যাঁকে প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে আত্মীয়স্বজনের নিরবতায়, সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণের নির্বোধতায় এবং সাহিত্যিকদের শ্রদ্ধাহীনতায়, সেই দ্বারকানাথ ঠাকুরকে কেন্দ্র করেই রাজা ভট্টাচার্য নির্মাণ করেছেন এক অনুপম মহাকাব্য। ‘দ্বারকানাথ : পরাধীন দেশের রাজপুত্র’ নিছক কোনও জীবনী নয়, বরং একটি অন্তঃসলিলা ইতিহাস, একটি বিস্মৃত সময়ের শ্রুতি-সমৃদ্ধ কাব্যিক দলিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ভোরবেলায়, যখন বাঙালি মধ্যবিত্তের চেতনার ভাঁজে ভাঁজে জমছিল নবজাগরণের আলো, তখনই দ্বারকানাথ ছিলেন সেই সেতুবন্ধন—যিনি ব্রাহ্ম আন্দোলন, সমাজসংস্কার, বাণিজ্যিক বিস্তার এবং রাজনৈতিক চিন্তনের বিস্ময়কর এক সমন্বয়। রাজা ভট্টাচার্যের কলমে এই চরিত্র কেবল ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে এসে হাঁটেন না—তিনি হাঁটেন আমাদের সময়ের দিকেও, যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন: "তোমরা কি আদৌ জানো আমি কে ছিলাম?"
এই বই পাঠ মানে কেবল একজন মানুষকে জানা নয়, বরং জানা এক গোটা যুগকে—যুগের স্পন্দন, দ্বন্দ্ব, আশা, পতন ও পুণরাবির্ভাব। এটি হল সেই আখ্যান, যেখানে অতীত নিছক অতীত নয়, বরং ভবিষ্যতের এক মৃদু পূর্বাভাস।
দ্বারকানাথের নিঃশব্দ প্রত্যাবর্তন আসলে ইতিহাসকে পুনরুদ্ধারের এক সাহসী প্রয়াস। আর এই বই, সে তো এক ‘আত্মজীবনী নয়—আত্মা-জীবনী’।
বিশদে: --
১) এক বিস্মৃত পুরুষের পুনরাগমন
ঐতিহাসিক গ্রন্থ কিংবা জীবনী নয়, বরং “উপন্যাস”—এই পরিচিতিই প্রথমে এক ধরনের দ্বিধা তৈরি করে। সচেতন পাঠকের মনে প্রশ্ন ওঠে—তথ্য আর কল্পনার সীমারেখা কি যথাযথভাবে রক্ষা করা হয়েছে? ইতিহাস কি সাহিত্যের নান্দনিকতায় হারিয়ে যায়নি?
রাজা ভট্টাচার্যের ‘দ্বারকানাথ: পরাধীন দেশের রাজপুত্র’ এই প্রশ্নের নিঃসংশয় উত্তর দেয়—হ্যাঁ, এটা উপন্যাস, কিন্তু তথ্যনিষ্ঠ, দার্শনিক, মননশীল ও ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত এক উপন্যাস।
দ্বারকানাথের ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর শৈশব—যেখানে এক শিশুর রাত কাটে দাসীর মুখে রাজপুত্র-রাজকন্যার গল্প শুনে, কিংবা সেই কিশোর দ্বারকার কলকাতা দর্শনের অদম্য আকাঙ্ক্ষা—এসব মুহূর্ত যেন নিছক দৃশ্য নয়, একেকটি জীবনের আলেখ্য। প্রথম পাঠশালার দিন, প্রথম ইংরেজি শেখা, বাবার মৃত্যুর অভিঘাত, আর এক তরুণ মননের ধীরে ধীরে জেগে ওঠা—সবই এসেছে উপন্যাসের শৈল্পিক ভাষায়, অথচ একটি বাক্যও কল্পনার বাড়াবাড়িতে কলুষিত হয়নি।
রাজা ভট্টাচার্য তথ্যের কাঠামো নির্মাণ করেছেন পাণ্ডিত্যের ভিত্তিতে, আর সেই কাঠামোকে প্রাণ দিয়েছেন সাহিত্যের শ্বাসপ্রশ্বাসে। ফলে পাঠক একদিকে যেমন একটি বিস্মৃত মহাপুরুষের জীবনকাহিনি জানতে পারেন, তেমনি অনুভব করেন তাঁর হৃদয়ের অনুক্ষণ স্পন্দন।
এই উপন্যাস এক নতুন পাঠাভিজ্ঞতা—যেখানে ইতিহাস আর উপন্যাস হাত ধরাধরি করে হাঁটে, তথ্য আর অনুভবের মাঝে কোন খাদ থাকে না। এটি শুধুই এক পুরুষের পুনরাগমন নয়, বরং এক ইতিহাসের হৃদয়ে আলো ফেলা।
২) নায়ক না ভিলেন? উত্তরাধিকারদের নীরব ষড়যন্ত্র
বইটি পড়তে পড়তে ক্রমশ এক অস্বস্তিকর, গা ছমছমে প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে থাকে—দ্বারকানাথ ঠাকুর কি তাঁর উত্তরসূরিদের জন্য এক অপ্রস্তুত, এমনকি অস্বস্তিকর নাম ছিল? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার কি সচেতনভাবে তাঁকে বিস্মৃতির গহ্বরে ঠেলে দিয়েছিল?
এই প্রশ্নের সরল উত্তর নেই। রাজা ভট্টাচার্যও কোনও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন না পাঠকের ওপর। কিন্তু যে সূক্ষ্ম অনুপস্থিতির ইঙ্গিত তিনি ছড়িয়ে রেখেছেন—তা নিছক ঐতিহাসিক ‘ছেদ’ নয়, বরং এক প্রজন্মের পক্ষপাতদুষ্ট নির্মাণ কৌশলের আলামত। দেবেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় দ্বারকানাথের উপস্থিতি প্রায় নেই, রবীন্দ্রনাথের রচনাবলিতে তাঁর নাম এক রহস্যময় অনুপস্থিতি, আর তাঁদের সংরক্ষিত চিঠিপত্রের ভাণ্ডারে কোথাও কোথাও ‘নির্বিচার ধ্বংস’-এর উল্লেখ—এসব কিছু মিলে যেন এক ঐতিহাসিক ‘ডিলিট’ বাটনের শব্দ শোনা যায়।
এ শুধু ব্যক্তিগত ইতিহাস নয়। এটি বৃহত্তর ইতিহাস রচনার সেই নির্মম প্রক্রিয়া, যেখানে যাকে মনে হয় “অস্বস্তিকর”—তাঁকে মুছে ফেলা হয়, ভুলে যাওয়া নয়, বরং ভুলিয়ে দেওয়া হয়। দ্বারকানাথ ছিলেন সাহসী, পাশ্চাত্য প্রভাবিত, ব্যবসাবানিজ্যে আগ্রহী, মদ্যপানকারী, রাণীদের সঙ্গে নৃত্যরত একজন বিতর্কিত আধুনিক। একদিকে তিনি এক রেনেসাঁ-পুরুষ, অন্যদিকে তৎকালীন ভদ্রসমাজের চোখে “ভ্রষ্ট”। ফলে তাঁর উত্তরাধিকারীদের কাছে তিনি যেন simultaneously hero ও heretic—নায়ক এবং ‘নীরব ভিলেন’।
এই উপন্যাস সেই নীরবতাকেই প্রশ্ন করে, সেই সাইলেন্সেই শব্দ তোলে। যেন বলে—“ইতিহাস শুরু হয়নি রবীন্দ্রনাথে, আর শেষও হয় না তাঁর মধ্যেই।” দ্বারকানাথকে ভুলে গিয়ে এক অসম্পূর্ণ ইতিহাস রচিত হয়েছে।
এবং রাজা ভট্টাচার্যের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানেই—তিনি কোনও কাঁটায় হাত না দিয়ে রক্ত দেখিয়েছেন।
৩) ছাপার অক্ষরে প্রাণের রং: কালি, কাগজ আর কলকাতা
এই বইয়ের ভাষা যেন এক জনমদীপিত শহরের ধুকপুক শব্দ। সরল, অথচ অনুভবসমৃদ্ধ; অকৃত্রিম, অথচ অভিজাত। রাজা ভট্টাচার্যের কলম শুধু ঘটনা বলে না, সে জায়গা দেখায়, গন্ধ শোনায়, এবং অনুভব ছুঁইয়ে দেয়।
পাঠককে তিনি হাত ধরে নিয়ে যান এক উনিশ শতকের কলকাতায়—যেখানে রাস্তায় ধুলো নয়, ইতিহাস উড়ছে; গঙ্গার ঘাটে শুধু জল নয়, সভ্যতার গন্ধ; মশার ঝাঁকে ঢেকে থাকা অন্ধকার কোঠায় যেমন রয়েছে উপনিবেশের ছায়া, তেমনি আছে আত্মজাগরণের আলো। ছাপাখানার ছেঁড়া আলমারিতে, থিয়েটারের লজে, কিংবা ব্রাহ্ম সমাজের উঠোনে ঘুরে বেড়ানো কথাস্রোত যেন এক অতীতচারণ, যেটা রোমান্টিক নয়, বরং গভীরভাবে রাজনৈতিক।
বিশেষভাবে উজ্জ্বল বিদেশযাত্রার অংশটি—যেখানে দ্বারকানাথ নিজের খরচে শিক্ষার্থী পাঠাচ্ছেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কোথাও নেপলস বন্দরে অভ্যর্থনায় তোপধ্বনি হচ্ছে, কোথাও বাকিংহাম প্যালেসের সোনার ডাইনিং-এ রাণীর আতিথ্য চলছে—পড়তে পড়তে মনে হয়, যেন ইতিহাস নয়, কোনও হারিয়ে-যাওয়া কল্পনাপ্রসূত মহাকাব্য পড়ছি। আবার কোথাও তা এতটাই বাস্তব, এতটাই ঘরোয়া, যেন ‘গোরা’র পূর্বসূরি কাউকে হঠাৎ চেনা যায়—যিনি একদা শেয়ালে ভরা গঙ্গার ঘাট পেরিয়ে একদিন পৌঁছে গিয়েছিলেন রানীর রাজসভায়।
এই ভাষা তথ্যের গম্বুজ নয়, অনুভবের জাদুঘর। এখানে প্রতিটি শব্দে লেগে আছে চটকের চেয়ে স্নেহ বেশি, চমকের চেয়ে চরিত্র। বইয়ের ভাষা কোনও সময়ে গদ্যের মতো স্থির, আবার কোথাও ছন্দের মতো ভেসে যায়—ঠিক যেমন দ্বারকানাথ নিজে ছিলেন: স্থিতও, আবার অস্থির।
এই অক্ষররেখা শুধু ইতিহাস বলে না, ইতিহাসকে জীবন্ত করে।
৪) ঐতিহাসিক বয়ান ও উপন্যাস: দ্বন্দ্ব, সহবাস না কি নতুন এক সাহিত্যবিচার?
এখানেই উঠে আসে একটি ‘গুরুগম্ভীর’ নয়—বরং ‘গুরুত্বপূর্ণভাবে ঝুলন্ত’ প্রশ্ন: এই বইটি আসলে কী? ইতিহাস না উপন্যাস? তথ্যচিত্র না কল্পচিত্র?
কেউ একে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-এর ধারায় রাখছেন—যেখানে ইতিহাস ও সাহিত্য একে অপরের হ���ত ধরাধরি করে হাঁটে। কেউ আবার অভিযোগ তুলছেন—তথ্যনিষ্ঠতা তেমন নেই, ফ্যাক্টের খুঁটিনাটি খুঁজলে হতাশ হতে পারেন গবেষকরা।
কিন্তু এক্ষেত্���ে রাজা ভট্টাচার্য যা করেছেন, তা নিছক কোনও ঘরানার ভেতরে ফেলা যায় না। তিনি তথ্যকে একমাত্র লক্ষ্য করেননি, আবার কল্পনার ফানুসও ওড়াননি। বরং এই বই দাঁড়িয়ে আছে এক দারুণ ‘genre-bending’ মোহনার উপর—যেখানে ইতিহাস নিজেই সাহিত্য হয়ে ওঠে, আর উপন্যাস নিজেই এক ধরনের নথি।
তাঁর ভাষা রমণীয়—তবে তা চটুল নয়। তাঁর কল্পনা বিস্তৃত—তবে তা বিকৃত নয়। অনেকটা যেন একজন নাট্যপরিচালক, যিনি পুরনো দলিলখানা হাতে নিয়ে তাতে প্রাণ ফুঁকে দেন, কিন্তু সংলাপের মূলসুরটা ঠিক রেখে দেন।
তথ্যনিষ্ঠ ইতিহাসের কাঠিন্য যাঁদের কাছে একমাত্র পছন্দ, তাঁদের জন্য হয়তো প্রথম খণ্ডে কিছু ঘাটতি অনুভূত হতে পারে—আর্কাইভ, পাদটীকা, সূত্রনির্ভর অধ্যয়নের স্বাদ এখানে কম। কিন্তু এই বইয়ের উদ্দেশ্যই যদি হয় ‘বিস্মৃতির থেকে উদ্ধার’, তবে তার প্রথম পদক্ষেপ তো অনুভবের মাধ্যমে স্মরণ ঘটানো, নাকি?
এই বই ইতিহাসের ‘অলিখিত অংশ’কে কল্পনার আলোয় মসৃণ করে তোলে। ইতিহাসের সঙ্গে কল্পনার এই সহবাস কোনও দ্বন্দ্ব নয়, বরং নতুন এক সাহিত্যচর্চার সম্ভাবনা। যেখানে রোমাঞ্চ আছে, রেফারেন্সও আছে; আবেগ আছে, আবার আর্তিও।
সুতরাং, এটাকে কেবল “ঐতিহাসিক উপন্যাস” বললে ভুল হবে, আবার “কল্পনানির্ভর জীবনী” বললেও কম বলা হবে। বরং বলাই ভালো—এই বই এক ইতিহাসের পুনর্পাঠ, এক সাহিত্যের নবজন্ম।
৫) প্রকাশনাগত দৃষ্টিভঙ্গি: কোয়ালিটি বনাম প্রাপ্যতা—পাঠক কি শুধুই পাঠক, না ভোক্তাও?
এতক্ষণ আলোচনা চলল লেখক, বিষয়বস্তু ও ভাষার উৎকর্ষ নিয়ে। কিন্তু একটা জায়গায় এসে পাঠকের হাত হোঁচট খায়—সেটা হল বইটির প্রকাশন প্রক্রিয়া।
খণ্ডিত সংস্করণ প্রকাশের পর পরে ‘অখণ্ড’ সংস্করণ বাজারে আনার সিদ্ধান্ত—সেটি একধরনের বিপণন কৌশল নাকি খাঁটি বিভ্রান্তি, সে প্রশ্ন উঠছেই। অনেক পাঠক এই দ্বিখণ্ডিত কৌশলকে ভালো চোখে দেখেননি। অনেকে তো বলছেন, “এটা যেন সিনেমার পার্ট ওয়ান দেখে টিকিট কেটে বসে থাকা, পরে জানা গেল ওটা আসলে ইন্টারভ্যাল!”
‘খোয়াবনামা’-র প্রকাশনার অভিজাততা এবং প্রায় নান্দনিক মানদণ্ড থেকে ‘পত্রভারতী’-র অধিক পরিচিত, কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাণিজ্যিক বিন্যাসে আসাটা একপাক্ষিক লাফ মনে হয়েছে কিছু পাঠকের কাছে। প্রথম সংস্করণের লেআউট, মলাটের টেক্সচার, টাইপোগ্রাফির ভারসাম্য—সবই অনেকের মতে বেশি যত্নবান ছিল। দ্বিতীয় সংস্করণে সে দিকটা খানিক কাঁচা লেগেছে, যেন দারুণ একটা রেসিপি রান্না হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চামচটা প্লাস্টিকের দেওয়া হয়েছে।
তবে এখানেই মজার টুইস্ট—কন্টেন্টই শেষ কথা। রাজা ভট্টাচার্যের লেখার জোর এতটাই, এতটাই প্রবল যে এই ছাপার অসঙ্গতি অনেকটা ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়। পাঠক রেগে গেলেও, পাতার পর পাতা পড়তে পড়তে ঠিক মুগ্ধ হয়ে যান। যেন কেউ বারণ করেও মন থেকে গানটা গাওয়া থামাতে পারছে না।
তবে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে এটা একটা স্পষ্ট মেসেজ—সাহিত্যিক দায়িত্ব শুধু লেখকের নয়, প্রকাশকেরও। পাঠক কেবল পৃষ্ঠা কেনেন না, অভিজ্ঞতাও কেনেন। আর সেই অভিজ্ঞতাকে টেকসই, সম্মানজনক এবং পূর্ণাঙ্গ করে তোলার দায় বর্তায় প্রকাশকের উপরও।
কাজেই, ‘প্রাপ্যতা’র দোহাই দিয়ে যদি ‘গুণমান’ জলাঞ্জলি দেওয়া হয়—তাহলে পাঠক খুশি হন না, শুধু ক্ষমা করে দেন। কিন্তু যতবার এই বই নতুন কোনও মুদ্রণে আসবে, ততবার সেই ক্ষমার অদৃশ্য ব্যালেন্সশীটে একেকটি হিসেব লিখে রাখবেন—হয়তো একদিন তা সুদে-আসলে মেটানো হবে।
৬) দ্বারকানাথ: ব্যক্তিত্ব ও পরিণতি — ট্র্যাজেডির রাজারেখা
দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবন এক অর্থে যেন শেক্সপিয়রীয় ট্র্যাজেডির ছাঁচে গড়া—আলোকোজ্জ্বল, প্রজ্ঞাপূর্ণ, অথচ নিঃসঙ্গ এবং শেষপর্যন্ত ধ্বংসসুন্দর। তিনি কেবল একজন ব্যবসায়ী, সমাজসংস্কারক কিংবা ‘ব্রাহ্ম আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক’ ছিলেন না—তিনি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি নিজেই নিজের সময়ের চেয়ে বহু বছর এগিয়ে ছিলেন।
এই ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে মোহময় এবং একইসাথে হৃদয়বিদারক দিক হল তাঁর স্বপ্নদর্শিতা। তিনি বুঝেছিলেন—কোনও জাতি গঠিত হয় কেবল ধর্মীয় বা ভাষিক ঐক্যে নয়; বরং তা গঠিত হয় অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কার ও উদারচিন্তার সমন্বয়ে। এই কথাগুলো আজও সভা-সেমিনারে উঠে আসে, কিন্তু দ্বারকানাথ তা ভেবেছিলেন ১৮৩০-এর দশকে।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’ ছিল বাণিজ্য ও প্রযুক্তির এক যুগান্তকারী সংযোগ। রেল, স্টিমার, ছাপাখানা—এইসব দিয়ে তিনি ভারতকে দেখতে চেয়েছিলেন ব্রিটেনের সমতুল্য এক আধুনিক, আত্মনির্ভর দেশ হিসেবে। কিন্তু সমস্যা হল, তিনি ছিলেন সেই নকশার একমাত্র স্থপতি—বাকিরা তখনও পাটকেল ছুঁড়ছিল।
এবং এখানেই উঠে আসে ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা বনাম উপেক্ষা’-র চিরন্তন নাট্যরূপ। সমাজ যাঁকে এক হাততালির বেশি কিছু দিতে পারেনি, ঋণগ্রস্ত হয়ে তাঁকে প্যারিস, লন্ডনের পথে নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়াতে হয়। অথচ এমনও হয়, বাকিংহাম প্যালেস থেকে তাঁর নামে দাওয়াত আসে।
এ এক অদ্ভুত দ্বৈততা—সম্ভাবনা ও পরাজয়ের একসাথে সহাবস্থান।
আর এই দ্বৈততাই তাঁর জীবনের ট্র্যাজিক গঠনটিকে সম্পূর্ণ করে তোলে। ইতিহাসে আমরা এমন অনেক চরিত্র পাই, যাঁরা যথাসময়ে ঠিক মানুষদের কাছে পৌঁছতে পারেননি। দ্বারকানাথ তাঁদের মধ্যেও ব্যতিক্রম, কারণ তিনি চেষ্টা করেছিলেন—সর্বশক্তি দিয়ে, সর্বান্তঃকরণে।
শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যান বিদেশের মাটিতে, পরিবার পরিজন ছাড়াই। শবদেহ দেশে ফেরে না। এক অচেনা দেশের গোরস্থানে তাঁর চিহ্ন থাকে, আর পরিচিত দেশের ইতিহাসে শুধু একটিমাত্র “অবান্তর” প্যারাগ্রাফ।
এটাই বোধহয় ট্র্যাজেডির আসল গ্লানি—আপনি ঠিক ছিলেন, কিন্তু কেউ শুনলো না।
তাঁর জীবন ছিল এক মহাকাব্যিক পটভূমি, কিন্তু পাঠক ছিল না। রাজা ভট্টাচার্যর বই যেন সেই ‘অনুপস্থিত পাঠক’-এর জবাব। এক আর্কাইভ-প্রেমী সাহিত্যিক যেন বলে উঠছেন—“তুমি একা গেলে ঠিকই, কিন্তু আমরা ভুলিনি।”
এবং এই কথাটাই, এতদিন পরে হলেও, দারুণ ভাবে প্রতিধ্বনিত হয়।
৭) উপসংহার: রোমন্থনের আহ্বান—এবং এক প্রিন্সলি বিস্ফোরণ
এই বই পড়া মানে কেবল ইতিহাস জানার চেষ্টা নয়—এটা যেন ইতিহাসকে শোনার এক অভিজ্ঞতা। সেই ইতিহাস, যাকে অতীতের আড়াল থেকে কেউ ফিসফিস করে বলছে, “তুমি আমায় এখনও মনে রাখো?” আর রাজা ভট্টাচার্য সেই ফিসফিসানিকে করে তুলেছেন বজ্রনিনাদের মতো গম্ভীর—উজ্জ্বল—অপরিহার্য।
“দ্বারকানাথ” নামটির পাশে “প্রিন্স” বসে আছে কেবল পদবাচক অভিধা হিসেবে নয়, বসে আছে একধরনের আভিজাত্য-জন্ম, যা রক্তে নয়—চিন্তায়, স্বপ্নে, সাহসে গড়ে ওঠে। এই বই তাই এক ব্র্যান্ড নিউ মহাকাব্য, যেখানে বর্ণনায় তথ্যের দার্ঢ্য আছে, ভাষায় আছে ছন্দের মাধুর্য, আর শিরদাঁড়ায় আছে ইতিহাস-বিধ্বস্ত নায়ককে প্রাপ্য সম্মানে ফিরিয়ে আনার জেদ।
যাঁরা ভাবেন ইতিহাস নেহাত কিছু সালতারিখ আর সাদাকালো মুখাবয়ব, তাঁদের জন্য এই বই এক নিদ্রাভঙ্গ। সতীদাহ থেকে শুরু করে ব্রাহ্ম সমাজ, ক্লাইভ থেকে ক্যালকাটা ক্লাব, রাজা রামমোহন থেকে রাণী ভিক্টোরিয়া—সবকিছু এসে মিশেছে এই আখ্যানের ঢেউয়ে।
অবশ্যপাঠ্য? নিঃসন্দেহে।
অসমাপ্ত? আংশিকভাবে, কারণ দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের প্রতীক্ষা থেকেই যাচ্ছে।
অসামান্য? নো ক্যাপ, এটা সোজা next-level.
এই বই পড়ে মনে হয়—ঐতিহাসিক সুবিচার শুধু নথিতে হয় না, সাহিত্যেও হতে পারে।
শেষে বলতেই হয়—এই বই কোনও রিভিউ চায় না, চায় রিভাইভাল। এক বিস্মৃত রাজপুত্রের ঘোড়ায় চেপে যেন ফিরে আসছে উনিশ শতকের সকাল—ধুলো-ওড়া পথে, কাঁধে ইতিহাসের ব্যাগ, চোখে আগামীর আগুন।
দ্বারকানাথ ফিরে এসেছেন। এবার পাঠকের কর্ষণ শুরু।
“আভিজাত্য শুধু রক্তে নয়, সাহসে থাকে।
আর ইতিহাসে, তা লুকিয়ে থাকে নিঃশব্দের গভীরে।”
এই নিঃশব্দেই রাজা ভট্টাচার্য জ্বালিয়ে দিয়েছেন এক উত্তপ্ত শঙ্খধ্বনি।
শোনা না-গেলে, দোষ আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয়ের।
**আমার কৈফিয়ত: বইটি এই নিয়ে পঞ্চমবার কভার টু কভার পড়লাম। এটি আমার দ্বিতীয় রিভিউ।
এই বইটা শুধু বাংলা জীবনভিত্তিক উপন্যাসের ধারাতেই নয়, বরং গোটা বাংলা সাহিত্যেই একটি দিকচিহ্ন। কেন? প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ঠাকুর পরিবারের একাধিক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের সক্রিয় চেষ্টায় দ্বারকানাথের যে ভয়াবহ চরিত্রহনন ঘটেছিল, একা তাঁদের মহড়া নিয়েছেন লেখক। তার জন্য তাঁকে যে গবেষণা করতে হয়েছে, তা অতুলনীয়। তারই ফলে তিনি বহুল-প্রচলিত বইয়ের মাধ্যমে বাঙালির মনে প্রোথিত অলীক গল্পদেরও দুরমুশ করতে পেরেছেন। এ শুধু শ্রম বা মেধা নয়, সাহসেরও কাজ। দ্বিতীয়ত, নীরস তথ্য আর ঘটনাক্রমকে সুললিত লেখনীর মাধ্যমে সজীব ও সরস করে তুলেছেন লেখক। ইতিহাসের পাতায় পাওয়া নামগুলো রক্তমাংসের মানুষ হয়ে উঠেছে। তাদের অনুভূতিরা স্পর্শ করেছে আমাদের। বলুন তো, এ কি সহজ কাজ? তৃতীয়ত, বইটিকে শুদ্ধ আকারে ও রুচিসম্মত উপায়ে পরিবেশন করে প্রাপ্য সম্মান জানানো হয়েছে। বিশ্বাস করুন, বহু ভালো কাজ প্রকাশকের অবহেলায় নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে তেমনটা হতে দেওয়া হয়নি। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বর্ণশুদ্ধি— সর্বত্র দেখা গেছে যত্নের ছাপ। এ জিনিস সত্যিই প্রশংসনীয়। সব মিলিয়ে আবারও বলব, এ এক অসাধারণ বই। এর মাধ্যমে দ্বারকানাথের রাহুমুক্তি কতদূর ঘটল, তার বিচার ভবিষ্যৎই করবে। তবে মন্দকথার কুয়াশায় ঢাকা মানুষটির তেজোদৃপ্ত, কাঁটার মুকুট পরে থাকা চেহারা আমাদের সামনে যে স্পষ্ট হয়ে দেখা দিল— এ-বিষয়ে সংশয় নেই। এমন বই পড়া দরকার। প্লিজ পড়ুন।
কিছু বই আছে এমন যে খুব প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করেও পরে হতাশ করে। আবার কিছু কিছু বই এর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র প্রত্যাশা না থাকলেও পড়ার পর তৃপ্তির রেশ ছড়িয়ে দেয়। এই বইটি দ্বিতীয় দলের। রাজা ভট্টাচার্যের নামের সাথেই আগে পরিচিত ছিলাম না, না এই বই নিয়ে আগে কোন আলোচনা পড়া ছিল। তবু বইয়ের নামটি এবং যাকে নিয়ে লেখা সেই মানুষটি আমার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ছিল। প্রথম আলো, সেই সময় বা কেরী সাহেবের মুন্সী এই ধরণের ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ার সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল আগে। এই বইটিও ইতিহাস ঠিক নয়, ঐতিহাসিক উপন্যাস। যশোর থেকে আসা কুশারী পদবীধারী পিরালি ব্রাহ্মণদের একটি শাখা বা পরিবার কলকতা শহরের পত্তনের আগে থেকেই সেখানে থিতু হন। জাতে ব্রাহ্মণ বলে তাদেরকে ঠাকুর বলে ডাকতো অনেকেই, সেটিই তাদের পদবী হয়ে দাঁড়ায় কালক্রমে। সেই ঠাকুরবাড়ির নীলমণি ঠাকুর ছোট ভাই দর্পনারায়ণের সাথে মতান্তর হলে চলে গিয়েছিলেন জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। তার ছেলে রামলোচন পৈত্রিক সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ পেলেও সেই সম্পত্তি বাড়িয়েছিলেন। নিজের চেষ্টায় হয়ে উঠেছিলেন একজন ক্ষুদ্র জমিদার। তখন পর্যন্ত দর্পনারায়ণের পাথুরিয়াঘাটের ঠাকুর পরিবারের অংশটিই ছিল ধনাঢ্য এবং শহর কলকাতার পরিচিত ও প্রভাবশালী পরিবার।
রামলোচন আর ছোট ভাই রামমণি বিয়ে করেছিলেন আপন দুই বোনকে। বড় বোন অলকাসুন্দরী ছিলেন রামলোচনের স্ত্রী। জন্মের পরপরই তার কন্যা সন্তানটি মারা গেলে তার অসুস্থ ছোট বোন নিজের সদ্যজাত পুত্রটিকে বড় বোনের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এবং এর পরপরই মারা যান। সেই সন্তানটিই দ্বারকানাথ ঠাকুর। মাতৃহীন হয়েও তাকে মা হারা হতে হয় নি কিন্তু কিশোর বয়সেই পিতৃহীন হতে হয়েছিল। রামলোচন যে সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন তাতে দ্বারকানাথ একটি বিলাসী ক্ষুদ্র জমিদার হিসেবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন বা সব সম্পত্তি উড়িয়েও দিতে পারতেন। এর কোনটাই তিনি করেন নি। শেরবোর্নের পাঠশালায় ইংরেজি তো শিখেছিলেন তারপর নিজের আগ্রহে তখনকার কলকাতার প্রসিদ্ধ ইংরেজ আইনজীবি ফার্গুসনের কাছ থেকে পাঠ নিয়েছিলেন আইন শিক্ষার। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই হয়ে উঠেছিলেন কলকাতার সেরা আইন ব্যবসায়ী। পৈত্রিক জমিদারী তো ধরে রেখেছিলেনই সাথে তা বিস্তৃত করেছিলেন আরও বহুগুণ। সেখানেই শেষ না, শুরু বলা যায়। বাণিজ্যে তিনি ছিলেন প্রচন্ড রকম সফল, বানিয়া নয় আক্ষরিক অর্থে হয়েছিলেন কোম্পানির আমলের সবচেয়ে বড় বাঙালি শিল্পপতি। রাণীগঞ্জের কয়লাখনিই হোক কিংবা চীনে আফিমের ব্যবসা কিংবা নিজের মালিকানাধীন ব্যাংক সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল তার ব্যবসা। রেশম, চিনি, নীল, বীমা কিংবা জাহাজ শিল্প কোথায় ছিলেন না তিনি? অবশ্য একা নন, সাথে সহযোগী সহযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন বন্ধুপ্রতিম উইলিয়াম কার। দুজনের নামে গঠিত হয়েছিল কার ঠাকুর কোম্পানী। আবার একই সাথে করেছেন কোম্পানীর চাকরিও, সল্ট এন্ড ওপিয়াম বোর্ডের প্রথমে সেরেস্তাদার পরে দেওয়ান। তবে এগুলো তার কেবল আর্থিক সাফল্যের কথা। পাথুরিয়াঘাটার সম্পর্কে কাকা গোপীমোহন ঠাকুরের মাধ্যমে তার পরিচয় এবং সখ্যতা হয়েছিল সমকালীন শ্রেষ্ঠ বাঙালি রামমোহন রায়ের সাথে। সেই অসমবয়েসী বন্ধুত্ব তার ভেতরের কুসংস্কার ভেঙ্গে দিয়ে তাকে করেছিল এক নতুন মানুষ। রামমোহনের সহযোদ্ধা হয়ে দ্বারকানাথও সতীদাহ প্রথা রোধ আইন তৈরির পিছনের অন্যতম নায়ক। এছাড়া হিন্দু কলেজ, মেডিকেল স্কুল, ব্রাহ্ম সমাজ সব ক্ষেত্রেই রামমোহনের সাথে ছিলেন তিনি। ইংল্যান্ডে রামমোহনের মৃত্যুর পর নিজেই টিকিয়ে রেখেছিলেন এসব প্রতিষ্ঠান। নিজেও সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন পাথুরিয়াঘাটের ঠাকুর পরিবারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা প্রসন্নকুমার ঠাকুরকে। তার উদ্যোগেই সৃষ্টি হয়েছিল জমিদারদের সংগঠন ল্যান্ডহোল্ডার্স এসোশিয়েশন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয় ডাক্তার তৈরিতে বিপুল অর্থসাহায্য করেছিলেন তিনি তবু তার পিতার মতো মা অলকাসুন্দরীও প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন যদিও তখন দ্বারকানাথ বিপুল বৈভবের মালিক। দূভাগ্যক্রমে তখন তিনি ছিলেন ভারতের পশ্চিম অঞ্চল ভ্রমণে ব্যপ্ত। নিজে গোড়ামীর উর্ধ্বে যেতে পেরেছিলেন বলেই তার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয় স্ত্রী দিগম্বরীর যে দূরত্ব দিগম্বরীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘোচে নি। বেলগাছিয়া ভিলায় তিনি প্রভাবশালীদের জন্য আয়োজন করতেন আড়ম্বরপূর্ণ ভোজের, স্বয়ং ভারতের বড়লাট পর্যন্ত তাতে এসেছিলেন একবার আর সাধারণ ইংরেজ দম্পতিদের জন্য সেটা তো ছিল মধুচন্দ্রিমা যাপনের আদর্শ জায়গা। সমকালীন গোড়া সমাজ তাকে নিয়ে কুৎসা রটিয়েছে বারবার তিনি কর্ণপাতও করেন নি।
রামমোহনের পর তিনিও কালাপানি পার হয়ে ইউরোপে যাওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছেন একবার নয় দুই দুই বার। স্বয়ং রাণী ভিক্টোরিয়ার সাথে তার ছিল প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, অনেকবার বৃটিশ রাজপরিবারের সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ হয়েছিল তার। ফ্রান্সের সম্রাট লুই ফিলিপসহ প্যারিসের বিদগ্ধ মহলেও তিনি হয়েছিলেন সাদরে সমাদৃত। ইংল্যান্ডে তার নামের সামনে লোকে যুক্ত করে নিয়েছিলো প্রিন্স খেতাবটি। কোন রাজার সন্তান ছিলেন না তিনি, না কোন প্রাতিষ্ঠানিক খেতাব পেয়েছিলেন। তবু এই একাধারে জমিদার, ব্যবসায়ী, সমাজ সংস্কারক এবং সমকালীন বাঙালি সমাজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষটি ছিলেন এক অঘোষিত রাজপুত্র। বিপুল অমিতব্যয় তিনি করেছেন জীবনের শেষপ্রান্তে ইউরোপে গিয়ে, প্যারিসে এক ভোজসভায় আগত নারী অতিথিদের প্রত্যেককে দান করেছিলেন এক একটি বহুমূল্যবান কাশ্মিরী শাল, শেষ পর্যা��়ে ব্যবসায়েও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলেন। তার জীবদ্দশাতেই বেশকিছু সম্পত্তি বিক্রিও করে দিতে হয়েছিল। তার জেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথ পরবর্তীতে ব্রাহ্ম সমাজের হাল ধরে বিখ্যাত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পৈত্রিক ব্যবসা তার সন্তানেরা ধরে রাখতে পারেন নি। তবু দূরদর্শী ও বিচক্ষণ দ্বারকানাথই তার মৃত্যুর পর তার বংশধরদের পতনের হাত থেকে রক্ষা করে গিয়েছিলেন বেশ কিছু জমিদারি ট্রাস্টি করে দিয়ে। নতুবা তার মৃত্যুর পরই হয়তো জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির পতন হতে পারতো। দেশপ্রেমিক এবং স্বাধীনচেতা এই মানুষটির পরিকল্পনা ছিল ভারতে রেলপথ বসানোর নিজের উদ্যোগে। তা তিনি সফল করে যেতে পারেন নি অকালমৃত্যুর কারণে। এমন বহু পরিকল্পনা তার মৃত্যুতে আর সফল হয়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়বার ইউরোপ ভ্রমণে গিয়ে অল্প কিছুদিন রোগভোগের পর মৃত্যু ঘটে আমৃত্য যোদ্ধা, নিঃসঙ্গ এক মহান পুরুষের। সাফল্যের চুড়ায় উঠেও, বহু মানুষের সাথে থেকেও যিনি ছিলেন একাকী, পরাধীন দেশের রাজ্যহীন রাজপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরের।
এই বই দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী অবলম্বনে লেখা।এতে এনার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত লেখাতে ফুটে উঠেছে সেই সময়ের অনেক আজানা কথা।এক সাধারন জমিদার পুত্র থেকে অসাধরণ উদ্যোগপতির কাহিনি।সেই সময়ের বাবুদের মত না হয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বাঙ্গালিরাও ব্যাবসা করতে পারে এবং ইংরেজদের উপর আধিপত্য করে ব্যাবসা বিস্তার করতে পারে।বাবার মৃত্যু তাকে ব্যথিত করেছিল এবং তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কলকাতার চিকিৎসা ব্যাবস্থার উন্নতি করবেন।তার জন্যই সম্ভব হয়েছিলা অস্ত্রোপাচার শিক্ষা এবং প্রথম মরা কাটার কৃতিত্ত অর্জন করেন মধুসুদন গুপ্ত।আর দ্বারকানাথকে বিচলিত করাছিল সতীদাহ প্রথা।তার এবং রাম মোহন রায়ের সাহায্যে বন্ধ হয় এই নিষ্ঠুর প্রথা।আর সহ্য করতে করতে হয়েছিলো মায়ের অন্তর্জিলি যাত্রা যা তাকে খুব কষ্ট দিয়েছিলো এবং সেই সাথে প্রচলিত ব্রাহ্মণ বাদের উপর প্রচন্ড ঘৃনার জন্ম দিয়েছিলো।এর পর পর তার স্ত্রী আর পুত্র বিয়োগ হয়।তবু কোন কিছু তে না থেমে উনি উদ্যোগ চালিয়ে গেছেন।এই সুবিশাল উপন্যাসে আরো অনেক কিছু আজানা তথ্য আছে।তবে তথ্যের চাপে একঘেয়ে হয়ে যায় নি।অনেকদিন পরে একটা উপন্যাস পরে খুব ভালো লাগলো। একটা জিনিস খারাপ লাগলো এখানে বাবার মা কে দিদিমা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।এটা অবশ্যই ঠাকুমা হবে। আমার রেটিং ৫/৫
রবিঠাকুরের ভারতবর্ষ তথা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জনের আগে ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে খুব আড়ম্বরভাবে কেউই মাথা ঘামায়নি। অথচ তাঁর বাপ-দাদারাও কিন্তু অসামান্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজীবনীতে মাত্র ২০ বছরের বিবরণ দিয়েছেন। বিপরীতে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারাকানাথের জীবনী লিখতে গিয়েও প্রায়ই অসম্পূর্ণভাবে থমকে দাঁড়াতে দেখা যায় ক্ষিতিন্দ্রনাথ ঠাকুর অথবা কৃষ্ণ কৃপালানীকে। উপরোক্ত বইগুলো তথ্যসম্ভারে যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং ভরসার যোগ্য, তবে একজন জমিদার থেকে একজন আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী হয়ে উঠার পথে দ্বারকানাথ যেভাবে নিজের মানসিক ও ব্যবহারিক ক্রমবিকাশের সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, তা রাজা ভট্টাচার্যের এই বইতে অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় ফুটে উঠেছে। তিন খণ্ডে বিস্তৃত এই অখণ্ড বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছেন তিন-ধারার দ্বারকানাথ।
রাজা ভট্টাচার্য তাঁর এই বইতে দ্বারকানাথ ছাড়া আরোও দুজন মানুষকে নিয়ে সুদীর্ঘ ও সুবিস্তৃত আলোচনা করেছেন; এক ― রাজা রামমোহন রায়, দুই ― দিগম্বরী দেবী। রামমোহন রায় ছিলেন দ্বারকানাথের জীবিত ঈশ্বররূপী সখা। অন্যদিকে দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী স্বামীর বেশীর ভাগ কাজেরই বিরোধিতা করলেও তিনি ছিলেন দ্বারকানাথের অবচেতন মনের শক্তি-সঞ্চালিকা। নবযুগের চিন্তার ছোঁয়ায় এবং বাবুয়ানির আকর্ষণে দ্বারকানাথের হিন্দুয়ানির প্রতি আস্থা ক্রমশঃ ঢলতে থাকায় তিনি বাড়ির নিত্যপূজা থেকে বঞ্চিত হন। আর ঠিক তখনই দিগম্বরী দেবীকে নিতে হয়েছিল জীবনের সবচেয়ে কঠিন পদক্ষেপ। ব্রাহ্মণদের পরামর্শে তিনি ঠিক করলেন যে তিনি স্বামীর যত্নআত্তি করবেন, তারপরে স্নান করে শুদ্ধ হবেন কিন্তু রাতে স্বামীসংসর্গ করবেন না! তাঁর জন্য নির্দিষ্ট হল বৈঠকখানার একটি শয্যা ও আলাদা রান্নার ব্যবস্থা। নিজের সাত্ত্বিক জীবনের সাথে ভূমিকা মেলাতে পারেননি বলেই স্বামীসহবাসের সুখ থেকে নিজেকে আজীবনের জন্য দূরে রেখেছিলেন। তারপর? তারপর কি হল প্রিন্স দ্বারকানাথের? চিরসখা রামমোহনের মৃত্যুতে ও সহধর্মিণীর কাছ থেকে প্রেমচ্যুত হয়ে কোথায় আশ্রয় নিয়েছিলেন দ্বারকানাথ? সেই সব প্রশ্নের উত্তর সুমার্জিতভাবে সাক্ষী হয়ে আছে রাজা ভট্টাচার্যের 'দ্বারকানাথ'-এ। দ্বারকানাথের জীবনকাহিনী ছাড়াও তৎকালীন ঠাকুর পরিবারের অন্দরমহলে আরও কাছ থেকে ঘুরে দেখার এবং সেই সময়ের ভারতবর্ষকে আরেকটু বেশি করে চেনার জন্য এই বইটি পড়া অবশ্যই কর্তব্য।