একজন মানুষ ঘুম থেকে উঠে দেখছে সে ছাড়া আর কারো মাথা নেই... একদল শিশু মানুষের মাথা নিয়ে ফুটবল খেলছে। অন্য শিশুরা অপেক্ষা করছে অন্য একটি মাথার... দুহাত কাটা খগেন একজনকে কুপিয়ে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। সে স্বীকার করছে খুনটা সে করেছে। পুলিশ সাজিয়ে দিচ্ছে গল্পটা... একজন মানুষ খুন হওয়ার পরও নিজের মৃত্যুকে অস্বীকার করে যাচ্ছে... এক বৃদ্ধ দম্পতি ধর্ষণের সংবাদগুলোর কাটিং নিয়ে উদযাপন করে যাচ্ছে দিনের পর দিন... মৃত্যুর পর কবর থেকে উঠে এসেছে রহমান। এরপর বদলে যাচ্ছে গ্রামের গল্পটা... প্রায়ই নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে শহরের পিৎজা ডেলিভারি বয়। ওদিকে হরিণের মাংস ব্যবসায়ী দম্পতি আত্মগোপনে থেকে অর্ডার করে চলেছে পিৎজা... ব্রথেলে এক বারবনিতার কাছে কাস্টমার হয়ে এসেছে তারই পিতা... দু' বন্ধু রেস্তোরাঁয় এসেছে মানুষের মাংস খেতে। সামনে খাবারের মেন্যু...
এমন ২১টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত 'মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ' বইটি।
কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মোজাফ্ফর হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমির অনুবাদ উপবিভাগে কর্মরত। প্রধানত ছোটগল্পকার। পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। অতীত একটা ভিনদেশ গল্পগ্রন্থের জন্য তিনি এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্য পুরস্কার এবং স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষেরা গল্পগ্রন্থের জন্য আবুল হাসান সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়াও ছোটগল্পের জন্য তিনি অরণি সাহিত্য পুরস্কার ও বৈশাখি টেলিভিশন পুরস্কারে ভূষিত হন।
বাংলাদেশের ছোট গল্প লেখার এতো উন্নতি হচ্ছে দেখে খুবই প্রাউড ফিল করতেছি।
এই বইটার নাম দেখে অনেকে কিনতে চাচ্ছেন না, এখন পর্যন্ত আমার চেনা দুইজন থেকে এই অভিযোগ শুনলাম, কিন্তু বিশ্বাস করেন, বইটা পড়ার পরে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকার মতো অবস্থা হবে, যেটা আমার হয়েছে। আমি বলবোনা আমি খুব মেন্টালি প্রিপেয়ার্ড ছিলাম বইটা পড়ার জন্য, কিন্তু প্রিপেয়ার্ড থাকা খুবই জরুরী। বাচ্চারা দূরে থাকবেন এই বই থেকে।
২১ টা ছোট গল্প নিয়ে বইটা, কিন্তু গল্পগুলোতে ডার্ক হিউমার থেকে শুরু করে, পলিটিক্যাল স্যাটায়ার, ম্যাজিক রিয়েলিজম, খুন, ধর্ষণ, ব্যাক্তি স্বাধীনতা, করোনা, বেকার জীবন সবকিছুর কথা গল্পচ্ছলে বলা হয়েছে। আমি খুবই একটা ধাক্কা খেয়েছি 'গল্প না বা নিছক কল্পনা'- গল্পটা পড়ে। আপনারা পড়লেই বুঝতে পারবেন কেন!
বেশ ভালো লেগেছে - শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে, যে জীবন ফুটবলের, মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ , বিড়াল পোস্টমর্টেম, মসজিদ আর বেকার জীবনের অপটিত গল্পটি, এটার কয়েকটা লাইন অনেক মনে ধরেছে --
"তাহলে যে কবি জীবনানন্দ লিখলেন, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? তিনি বলেন। ভুল লিখেছেন। এই কারণেই তো কবিকে আমি অপছন্দ করি।(আমি কিন্তু জীবনানন্দ বলতে আবার পাগল) সকলেই হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। এটা মানুষের কমন রোগ।আমরা প্রত্যেকেই এই কারণে অসুস্থ। "
"জীবনানন্দ নামটি যে জীবনানন্দের জন্য সঠিক ছিল তারই-বা প্রমাণ কী? আমরা সকলে যে ভুল নামে ভুল মানুষের ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছি না, তা কি আপনারা লেখকরা নিশ্চিত করে বলতে পারেন?"
এবং 'মিসিং পিৎজা বয়' গল্পটা পড়ে আমার একটা কথায় মাথায় আসছে, কোয়েন্টিন টারান্টিনো এই গল্প পেলে সাথে সাথে মুভি বানিয়ে ফেলতেন আর অবশ্যই খুব রক্তারক্তি দৃশ্য তো থাকবেই।
এটাই আমার লেখকের প্রথম কোন বই পড়া, আশা করছি বাকিগুলো ও সংগ্রহ করবো। লেখকের জন্য শুভকামনা।
আর আমাকে বলতেই হচ্ছে করোনার মধ্যে হলেও আমরা কিন্তু বেশ ভালো কোয়ালিটি সম্পন্ন বই পেয়েছি এই মেলা থেকে।
মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ ১২০ পৃষ্ঠার বইটিতে ২১ টি ছোট গল্প ঢেলে সাজানো হয়েছে। লেখক প্রচন্ড সুন্দর ভাবে গল্পের প্লট গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রতিটা গল্পই ছিল ডার্ক সাইডার। বেশিরভাগ গল্পই মনে হয়েছে ব্ল্যাক কমেডির সাথে সাথে রূপক অর্থ বহন করেছে। সমাজ- রাষ্ট্রের গোঁড়ামি গুলো ব্যঙ্গাত্মকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা খুব উপভোগ করেছি। কম কথায় এতো সুন্দর গল্প বোধহয় আর সম্ভব না। গল্পে খুন, ধর্ষণ, করোনা পরিস্থিতি, পলিটিকাল স্যাটায়ার, বেকার জীবন, ডার্ক হিউমার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি চমৎকার ভাবে প্রতিস্থাপন করেছেন সাথে লেখকের লেখনশৈলী মুগ্ধ করেছে গল্পে ভালো ভ্যারিয়েশন ছিলো। কিছু কিছু গল্প মনে গভীরভাবে দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছে। তবে যারা ভায়োলেন্স, ডার্ক হিউমার নিতে পারে না তাদের জন্য বইটি মোটেও সুখপাঠ্য হবে না। তাই বলা যায় ছোটদের বা অপরিপক্বদের জন্য এই বই না।
ছোটগল্প প্রসঙ্গ এলেই একটা কথা আমাদের কানে বাজে 'শেষ হইয়াও হইলো না শেষ'। মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ বইটার গল্পগুলোকে না ঠিক এই কাতারে ফেলা যাবে না। নামটার মতন কিছু গল্পও ভীষণ অস্বস্তিদায়ক। তবে এই অস্বস্তির মূল কারণ সত্য ঘটনার নগ্ন বয়ান। ডার্ক হিউমার, জাদুবাস্তববাদ কিংবা রূপকের আড়ালে বর্ণিত গল্পগুলো পড়ার পর আপনার মনে হতে পারে, আরে এরকম তো কত ঘটতে দেখেছি! কিছু কিছু গল্প নিজেদের অক্ষমতার সাথে পুনঃপরিচয় করিয়ে দেবে হয়তো। তবে হ্যাঁ, গল্পগুলো সব টানা পড়া যায় না। তখন একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন চোখে পড়ে। আমার মতে কিছুটা বিরতি দিয়ে দিয়ে বইটা শেষ করলে হয়তো পুরো রসটুকু আস্বাদন করা যাবে। যে জীবন ফুটবলের, মসজিদ মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ , বিড়াল পোস্টমর্টেম, বেকারজীবনের অপঠিত গল্পটি, শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে- এই গল্পগুলো মনে থাকবে দীর্ঘদিন। লেখকের আগামী বইগুলোর জন্যে শুভকামনা থাকলো।
২১ টি ছোট গল্প নিয়ে লেখক মোজাফ্ফর হোসেনের সংকলন মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ। প্রত্যেকটা গল্পই ডার্ক ঘরনার। কয়েকটা গল্প স্নায়ুতে চাপ ফেলার মত। গল্পগুলোতে ব্ল্যাক কমেডিরও ছোঁয়া ছিল। কয়েকটা গল্পে ম্যাজিক রিয়েলিজমও খুঁজে পাওয়া যাবে। কয়েকটা গল্পের ব্যাপারস্যাপার এতই ডার্ক, কিছুটা মনের ওপরও প্রভাব পড়ে। সমাজ-রাষ্ট্রের গোঁড়ামিগুলোও রূপক অর্থে ব্যঙ্গাত্মকভাবে দেখানো হয়েছে। লেখকের লেখনশৈলী দারুণ। কম কথাতে ভালো গল্প বলতে পারেন। তবে ব্যাপারটা হল বইটা সবার জন্য নয়। ভায়োলেন্স, ডার্ক হিউমার না নিতে পারলে বইটা স্বাভাবিকভাবেই ভালো লাগবে না।
অসাধারণ!!! এই রকম স্যাটায়ার ছোটগল্প এখনো যে বাংলাদেশে লেখা হয়, তা ' মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ ' না পড়লে জানতে পারতাম না। প্রায় প্রতিটি গল্পই মাথায় ক্লিক করার মতো। ভালো লেগেছে, লেখকের জন্য শুভকামনা।
একুশটা গল্প আছে বইতে। প্রথম দু-তিনটে গল্প মন্দ লাগছিল না। তারপর যত এগোতে থাকলাম, বুঝলাম একটাই আইডিয়াকে (কিংবা ফর্মুলাকে) ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একুশবার ব্যবহার করেছেন লেখক। গুরুতর কিছু সামাজিক এবং মানবিক ইস্যু নিয়ে ডার্ক-কমেডি ধাঁচের গল্প লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু গল্পগুলোর মধ্যে সার্থক ডার্ক-কমেডির সূক্ষ্মতা এবং গভীরতা নেই। বরং morbid অতিনাটকীয়তার উপর্যুপরি ব্যবহারে (অথবা হাতুড়ির প্রহারে) একটা সময় গল্পগুলোকে কৃত্রিম এবং predictable মনে হতে শুরু করে। মনে হয় যেন, পাঠকের মনে স্রেফ চমক সৃষ্টি করার জন্য প্লট নিয়ে এরকম আপ্রাণ কসরৎ করেছেন লেখক। গল্পগুলোর গদ্যের মানও কাজ-চালানো-গোছের। এই ধরণের গল্প লেখার জন্য ভাষানির্মাণের যে-পারদর্শিতা প্রয়োজন, লেখকের উপস্থাপনায় তা অনুপস্থিত। সবমিলিয়ে, মানুষের মাংস খেয়ে তৃপ্তি পেলাম না মোটেও! 😥
বইটাকে নিয়ে যদি এক শব্দে কিছু বলতে হয় তাহলে একটা শব্দই মাথায় আসে-'ডার্ক'।
অনেকে অদ্ভুত নামের জন্য বইটার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন কিন্তু হলফ করে বলা যায় ছোট ছোট গল্পগুলো পড়ে লেখকের চিন্তা করবার ক্ষমতা, লেখনী আর কিছুটা রূপক স্টাইলে লেখা গল্পগুলো পড়ে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। আমি প্রচন্ড রকমের মুগ্ধ! একদম শুরু থেকে শেষ পর্য��্ত একই রকম স্ট্যান্ডার্ড ধরে রেখেছেন। গল্পে কী আসে নাই? সমাজের প্রায় সব ধরণের অসঙ্গতি নিয়ে লিখেছেন। আসলে আমাদের অবস্থা এখন গল্পের মাথা ছাড়া মানুষদের মতো হয়ে গেছে। কিছুই দেখছি না, শুনছি না, বুঝছি না। চলছে জীবন.. চলুক না, চলছেই তো! ২১ টা ছোট ছোট গল্প, ২১ রকমের বাস্তবতা।
ভালো ভালো রিভিউ রেটিং দেখে প্রকাশের পর থেকেই আগ্রহী ছিলাম বইটা সংগ্রহ করবার, পড়বার। স্যাটিস্ফাইড। লেখকের অন্য বইয়ের দিকেও এখন থেকে নজর থাকবে। দেখা যাক.. এই ধারাবাহিকতা লেখক পরবর্তীতেও বজায় রাখতে পারেন কি না। শুভকামনা লেখকের জন্য।
খুদি কো কার বুলন্দ ইতনা কে হার তাক্কদির সে পেহলে খুদা বান্দে সে পুছে বাতা তেরা রাযা ক্যয়া হ্যায়।
নিজেকে এতোটা বিশাল করে তোলো যেন ভাগ্য লেখার সময় স্বয়ং খোদা জিজ্ঞেস করে বল বান্দা তোর ইচ্ছা কী। মহামতি আল্লামা ইকবালের কথা মনে পড়ে গেলো। ছোট গল্পের মর্মকথা জীবনের অভিজ্ঞান। চাইলেই গল্প লেখা যায় কিন্তু গল্প কিভাবে জীবন হয়ে উঠে সেটা তো মনে হয় সমাজ ঠিক করে দেয়। কি জানি...দশজনের মধ্যে বাস করেও ব্যক্তি যখন নিজেকে ‘একজন’ বলে চিনতে পারছে, তখন থেকেই তো সাহিত্যের শুরু বলে আমার কাছে মনে হয়।
সেই ব্যক্তিকে আরও স্পষ্ট করে চেনার আকাঙ্ক্ষা থেকে মোজাফ্ফর হোসেনের নতুন ছোট গল্পের বই 'মানুষ মাংসের রেস্তোরাঁ'-এর পাঠ শুরু। পড়তে পড়তে মনে পড়ল, সময়ের ভেতরকার স্পন্দন বুঝতে পারা, সমকাল ও ইতিহাসকে পাঠকের কাছে মূর্ত করে তোলা, রক্তমাংস নিয়ে হাজির হওয়া—এই তো একজন ফিকশন রাইটারের কাজ।
অনেক দিন আগে আজিজে তক্ষশীলা তে চা খেতে খেতে কে যেন বলেছিলো, গল্প হচ্ছে মডার্ন মিথ। গল্প থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি। আবার সব কিছু থেকেই গল্প তৈরি হয়। একদম প্যারাডক্স। মানুষ মাংসের রেস্তোরাঁ পড়ার সময় প্রশ্ন জাগছিল, ছোট গল্প আসলে এখন কেমন হওয়া উচিত? সেই পথে আমরা কতটুকু হাঁটতে পেরেছি?
সাম্প্রতিককালে নিউজে, সোস্যাল মিডিয়ায় আত্মহত্যায় মৃত(?) মুনিয়ার চারিত্রিক ভাব সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা দেখে ভাবছি, কোন ফিকশন রাইটারের সাধ্য নেই জীবনের চেয়ে বড় কোনো কাহিনি ফাঁদার। একটি মেয়ে মারা গেছে, মেয়েটিকে খুন করা হয়েছে, সেটা নিয়ে কথা না বলে তার চরিত্র নিয়ে ভিক্টিম ব্লেমিং করা!
অবাস্তব ও পরাবাস্তবতায় এই ছোট গল্প গুলোর আখ্যান শুরু। লেখক বা গল্পের বর্ণনাকারী যা কিছুই বলেছেন বা বলার চেষ্টা করেছেন, যেখানে সমাজের নির্মমতা বা নিষ্ঠুরতা বা নানা অবিচারের ছবি এঁকেছেন রূপকের মাধ্যমে; সত্যি বলতে আমার কাছে আজকাল কেন জানি মনে হয়, 'লাইফ ইজ লার্জার দ্যান ফিকশন'।
এই মহামারী শেষ হলে একদিন চায়ের নিমন্ত্রণ দিয়ে রাখলাম লেখক সাহেবকে।
দিনে দিনে আমাদের নৈতিক স্থলন হতে হতে এতটাই নিচে নেমে গেছে যে ভালো কিংবা মন্দের হিসাব হারিয়ে ফেলেছি। আমরা আমাদের নৈতিকতা বেঁচে দিয়েছি। সত্যি কথা বলার সৎ সাহসকে দিয়েছি জলাঞ্জলি। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা কিংবা প্রশাসনের জোর করে চাপিঁয়ে দেওয়া কাজগুলোর প্রতিবাদ না করতে করতে পরিণত হয়েছি জড় সদৃশ বস্তুতে। বইয়ের “শেষ মাথাটি কাটাপড়ার আগে” গল্পে সেরকমই একটি সমাজের উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে হঠাৎ করেই একদিন সবার মাথা নেই হয়ে যায়। মাথাবিহীন মানুষগুলো দ্বারা লেখক আসলে নৈতিকতা বেচা আমাদেরকেই বুঝিয়েছেন। পরাবাস্তব ধরণের গল্পটি দুর্দান্ত। একেবারে মগজে গিয়ে গাঁথে। “একটি খুনের স্বীকারোক্তি” গল্পের মূল প্রটাগোনিস্ট এবং বুড়ো চেয়ারম্যান আমাদের প্রতিটি গ্রামে গ্রামে আছে। একটু এদিক ওদিক তাকালেই আমাদের বাড়ির পাশেই চেয়ারম্যানের মতো লোকজন পাওয়া যাবে। “স্পাই” গল্পটি মনে করিয়ে দেয় আমাদের বিস্মৃতি কিছু অতীতকে। মানুষ হিসাবে আমাদের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। গল্পটি ছোট হলেও দারুণ শক্তিশালী। সংকলের দারুণ একটা গল্প। বইয়ের সবচেয়ে সেরা গল্পগুলোর একটা হচ্ছে “মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ” গল্পটি। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন কি ধরণের গল্প হতে পারে এটি। ঘুম থেকে উঠেই আমরা কতশত খারাপ নিউজ দেখি পত্রিকায়। গরম ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমরা সেসব নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করি কিন্তু দিন শেষে ঘুরেফিরে আমরা সুযোগ পেলে সেই একই খারাপ কাজটা করি। আমরা হয়তোবা ঘুষ নিয়ে অন্য কাউকে দুকথা শোনাতে পারি। কিন্তু নিজের সামনে টাকা যোগের সুযোগ দেখলে কয়জন সেটা সামলাতে পারি? এই গল্পটিতে মানুষের মাংস বিক্রির রেস্তোরাঁয় দুই বন্ধুর আগমনের এবং তাদের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে দেশের কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়। এক কথায় ব্রিলিয়ান্ট। সংকলনের সেরা গল্পের একটি। “বঙ্গন্ধুকে চিঠি” গল্প প্রথমে পড়ে তোষামোদি গল্প মনে হলেও যতই সামনে এগুবেন ততই ভুল ধারণা ভেঙ্গে যাবে। একদম শেষের টুইস্ট অপ্রত্যাশিত ছিল। “জীবনের গল্প প্রতিযোগিতা”, “যে জীবন ফুটবলের”, “ধর্ষণের প্রতিশোধ” গল্পগুলো যেন আমাদের সমাজের নানা অসঙ্গতির প্রতিরূপ। বিশেষ করে “ধর্ষণের প্রতিশোধ” গল্পটির কথা বলতেই হয়। গল্পটি শেষ করে অজান্তেই মন খারাপ হতে বাধ্য। “খুনের সংবাদ ধরাতে” কিছুটা পরাবাস্তব ধরণের গল্প। প্লট কমন হলেও লেখনীর জোরে উতরে যাবে। “মিসিং পিৎজা বয়” সাইকোলজিক্যাল ক্রিপি ধরণের। গল্পে নতুনত্ব নেই কিন্তু লেখার আছে। সংকলনের আরেকটি সেরা গল্প হচ্ছে “বাক-স্বাধীনতার অনন্য দৃষ্টান্ত”। এই গল্প নিয়ে আসলে আমি কিছু বলব না। কারণ বলার প্রয়োজন নেই। গল্পের নামেই বলে দিচ্ছে এটা কেমন গল্প হবে। আর এখন আমাদের বাক স্বাধীনতার কি অবস্থা সেটা বলে দেওয়ার তো কোন প্রশ্নই আসে না। বুঝে যাওয়ার কথা গল্পে কি হতে পারে। “পুনরুথান” গল্পটি পরাবাস্তব ধরণের। হুজুগে বাঙ্গালীর হুজুকগিরির এবং তিলকে তাল বানানোর একদম উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই গল্পটি। “করোনা,মৃত্যুর আগে এবং পরে” গল্পে কি বলা হয়েছে সেটা নিশ্চয় বলার অপেক্ষা রাখে না। “বিড়াল-পোস্টমর্টেম” গল্পটি সাইকোলজিক্যাল । গায়ে বেশ কাঁটা দিয়ে উঠে। কিন্তু শেষ লাইনের টুইস্ট একদম চমকে দেয়। মোড় ঘুরিয়ে দেয় গল্পের। “গল্প না নিছক কল্পনা” গল্পের থিম নিছক কল্পনা নয়। কারণ ‘কল্পনা’রা ঠিক আমাদের আশপাশেই আছে। খুব বেশি মাত্রায় আছে। আমরা সবসময় ওদের এড়িয়ে যাই। এরকম আরও বেশ কিছু দারুণ দারুণ গল্পের সমন্বয়ে “মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ” গল্প সংকলনটি গড়ে উঠেছে। ছোট গল্পের বইয়ের রিভিউর একটা প্রধান সমস্যা হলো গল্প সম্পর্কে কিছুই বলা যায় না। শুধু গল্পগুলো কি ধরণের কিংবা গল্পের ভাবার্থটা বলা যায়। না হলে স্পয়লার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ছোট গল্পের বই হিসাবে বইটি একদম সার্থক। গল্লে পরাবস্তবতা ছিল, সাইকোলজিক্যাল এলিমেন্ট ছিল, ডার্ক কমেডি ছিল। কিন্তু সবগুলো গল্পই আসলে আমাদের সমাজের নানার অসঙ্গতি তুলে ধরেছে। লেখক মোজাফ্ফর হোসেনের লেখা সহজ, সাধারণ। দারুণ মুন্সিয়ানার সাথে তিনি গল্পের বিষয় বস্তুর সাথে আমাদের সমাজের অসঙ্গতিগুলো যোগসূত্র তৈরি করেছেন। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আমাদের অক্ষমতা কিংবা উপেক্ষাগুলো। প্রতিটি গল্পই মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। একবারের জন্য হলেও আপনার আমার বিক্রি করে দেওয়া বিবেকটাকে নাড়া দিয়ে যাবে। সংকলনের সেরা গল্প গল্পের কথা আসলে “শেষ মাথাটি কাটাপড়ার আগে”, “মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ”, “মিসিং পিৎজা বয়”, “বাক-স্বাধীনতার অনন্য দৃষ্টান্ত”, “বিড়াল-পোস্টমর্টেম”, “বঙ্গবন্ধুকে চিঠি”, “স্পাই”, “যে জীবন ফুটবলের”, “ধর্ষণের প্রতিশোধ”, “সিসিফার হাসে ঈশ্বরের হাসি” গল্পগুলোর কথা মনে পড়ে। কিছু গল্প আছে মধ্যম মানের। কিছু গল্প আছে চলনসই। যারা ছোট গল্প পছন্দ করে তাদের জন্য একটি হাইলি রিকমেন্ডেড গল্প সংকলন।
আমাদের সমাজের নোংড়ামিগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবনাচিন্তা করেছেন?! আরে ধুর! অত মাথা খাটানোর কী আছে? নিউজ চ্যানেল, খবরের কাগজ, চায়ের কাপে ঝড় তোলা কিংবা ফেসবুক থেকে বহুদূরে থাকলেও সমাজ-রাষ্ট্র ওসব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। গা-গোলানো নামের গল্পগ্ৰন্থটার বইটার প্লট এইসব নিয়েই। এগুলো আমাদের সিস্টেমের ওপেন সিক্রেট। গল্পগুলোর পরিস্থিতি বুঝতে কোনো কষ্ট হবে না; মনে হবে এরকম কী একটা তো সত্যিই শুনেছি, এই তো সেদিনও! লেখকের মুন্সিয়ানা বুদ্ধিদীপ্ত এন্ডিং-এ। তাছাড়া শেষদিকে কিছু আউট অব বক্স থিংকিংও আছে গল্পগুলোতে। ওগুলোর জন্য আর একঘেয়েমি আসেনি।
গল্পগুলো মন্দ নয়। বলা যায় বেশ ভালোই। কিন্তু বইটি সম্পর্কে পাঠকের শংসাবচন পড়ে কিংবা শুনে প্রত্যাশা মনে হয় আরো বেশি ছিল। প্রত্যাশা মেটেনি। ব্যক্তিগতভাবে একটি গল্প সংকলনে মনে হয় আমি কিছুটা বৈচিত্র চাই।
এখানে মনে হয়েছে একই স্বাদের গল্প কিংবা একই গল্প যেন বারবার পড়ছি। মনে হয়েছে এখান থেকে বেছে বড়জোর তিন চারটি গল্প নিলেই চলত। একই কৌশল অতি ব্যবহারে ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে।
নামটা অদ্ভুত, তাই না? বইটাতে আকৃষ্ট হওয়ার প্রথম কারণ এই অদ্ভুত নামটাই। দ্বিতীয় কারণ বিভিন্ন বইয়ের গ্রুপ এবং গুডরিডসে বইটার প্রচুর পজিটিভ রিভিউ। তাইতো গত মাসে এক বইয়ের গ্রুপের বদৌলতে সুযোগ পেয়েই বইটা কিনে ফেলি আর এখন মাসের প্রথমেই পড়ে ফেললাম অদ্ভুত নামের অদ্ভুত সুন্দর এই বইটা।
বইটা সম্পর্কে আমার কথা বলার আগে, দাঁড়ান, দু-একটা গল্প সম্পর্কে বলি। ( এই দুই প্যারায় স্পয়লার আছে) প্রথমেই বলা যাক ‘ শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে' গল্পটার কথা। এক সকালে ঘুম থেকে উঠেই কথক দেখতে পেল সে ব্যতীত তার বাড়ির সবাই এবং শহরের সবাই মাথাবিহীন হয়ে পড়েছে। স্বপ্ন দেখছে ভেবে চোখ-মুখে পানি নেওয়ার পরও যখন অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না তখন সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল কথক, সাথে দুশ্চিন্তা তো আছেই। রাস্তায় নেমে সে আরও অবাক হলো। মাথাবিহীন হওয়ায় সবাই কেমন নিশ্চিন্তে চলছে, কেউ কোনো প্রতিবাদ করছে না, মাথা থাকাই অপরাধ হয়ে গিয়েছে শহরে, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মাথা কেটে নেওয়ার অপারেশন চলছে। কি অবাক লাগছে আজগুবি ব্যাপার ভেবে? তাহলে মাথার জায়গায় বিবেক বা চিন্তাশক্তি বসিয়ে গল্পটা ফের পড়ুন।
এবার বলি নাম গল্প ‘ মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ’র কথা। শহরে নতুন একটা রেস্তোরাঁ এসেছে, সেখানে নাকি টাটকা মানুষের মাংস পাওয়া যায়। তো কথক টাটকা মানুষের মাংসের টেস্ট নিতে চলে গেল বন্ধুসমেত। সেখানেই দেখল কিভাবে মালিকপক্ষ যুদ্ধ থেকে, শহরের বস্তি থেকে টাটকা মানুষের মাংস সরবরাহ বজায় রাখছে। তাহলে কি কোনো মানুষ এর প্রতিবাদ করছে না? সেটাও কথক দেখতে পারল তার পাশের টেবিলেই। টাটকা মানুষের মাংস খেতে খেতে একদল স্যুট-কোট পরা মানুষ মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করছে। কি বোঝা যাচ্ছে না গল্পটা? যুদ্ধ আর ব্যবসার বলি হওয়া কোটি কোটি মানুষ আর দুমুখো কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর কথা ভাবলেই পরিস্কার হবে।
কি বোঝা যাচ্ছে লেখকের স্টাইল? হুম সেটাই, আপাত দৃষ্টিতে অবাস্তব আর অদ্ভুত ঘটনার মাধ্যমে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা-ই তুলে ধরেছেন লেখক। ডার্ক হিউমার, পরাবাস্তবতা, সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার, ভৌতিক আবহ ইত্যাদি ব্যবহার করে লেখক এত নিপুণভাবে গল্পগুলো বলেছেন যে প্রায় প্রতিটা গল্পেই মুগ্ধ হতে হয়। হ্যাঁ প্রায় প্রতিটা, কেননা স্বভাবতই একটা সংকলনের একুশটা গল্পের মধ্যে দু-চারটা অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের হবেই। তাছাড়া কিছু গল্প যে মাঝামাঝি অবস্থাতে থাকতেই অনুমান করা যায় নি, সেটাও না। তারপরও প্রায় প্রতিটা গল্পের টুইস্টগুলো ভীষণ ভালো ছিল। একটি খুনের স্বীকারোক্তির শেষদিকের দু-দুটি টুইস্ট, বঙ্গবন্ধুকে চিঠির ছোট্ট একটা বাক্য, বিড়াল-পোস্টমর্টেম, গল্প না বা নিছক কল্পনা ইত্যাদি গল্পের শেষদিকের দু-চারটি কলমের আঁচড়-ই গল্পগুলো অনবদ্য করেছে।
আর যেটা বললাম, লেখকের সমাজ-সচেতনতার প্রশংসা করতেই হয়। ভঙ্গুর প্রশাসন, বিরোধীমত দমন, সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা, ক্ষমতার অপব্যবহার, নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন, সমাজের তিলকে তাল করার প্রবণতা, বাকস্বাধীনতা, করোনা পরিস্থিতি, সংবাদপত্র ও কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর মূল্যবোধ ও ব্যবসা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, গৃহকর্মী নির্যাতন, পতিতাবৃত্তি ইত্যাদি বিস্তৃত পরিসরে কাজ করেছেন লেখক। আর লেখনী এত সরল অথচ এত টু-দ্য-পয়েন্ট যে মুগ্ধ হতে হয়। একদম মেদহীন লেখনী, লেখক যা বলতে চেয়েছেন সেটাই স্পষ্ট করে বলে গিয়েছেন প্রতিটা গল্পে।
তো শেষ করি এটা বলে যে লেখকের লেখনী ও বিষয়বস্তু নির্বাচনে মুগ্ধ হয়েছি। তো তাঁর বাকিগুলো পড়ার ইচ্ছা রইলো যত দ্রুত সম্ভব।
ছোটগল্প দেখে বইটি পড়ার আগ্রহ তেমন একটা ছিলো না বললে একটুও ভুল হবে না। তবে বইটি নিয়ে এত এত ভালো রিভিউ পড়ে যারপরনাই আমারও ইচ্ছে জাগে বইটি পড়ার! তার উপর নামটিও পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট যেমনটি আমাকে আকৃষ্ট করেছিলো। . 'মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ ' মোট ২১টি গল্পের সংকলন। প্রতিটি গল্পই মনে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করবে।লেখক ডার্ক হিউমার কিংবা রূপকের আড়ালে একের পর এক বর্ণনা করে গেছেন সমাজের নিকৃষ্ট কিছু দিক। যেগুলো আমরা দেখেও না দেখার ভান ধরি কিংবা 'এটাই নিয়ম' বলে আমাদের মস্তিষ্কে সেট করে দিয়েছি। খুন, ধর্ম নিয়ে ব্যবসা,পলিটিক্যাল স্যাটায়ার, পত্রিকা অফিসের পলিটিক্স, দুর্নীতি সবকিছুই এই গল্পগুলোতে উঠে এসেছে। যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।কিছু গল্প পড়ার সময় এমন হয়েছিলো যে নিজের অস্তিত্বটাকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।মনে হচ্ছিলো আমি এই কেমন সমাজে বসবাস করছি? এই সমাজ তো আমার যোগ্য না!! . ২১টি গল্পের মধ্যে প্রায় সব গল্পই ভালো লেগেছে তবে শেষ মাথাটি কাটা যাওয়ার পর,মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ, খুনের সংবাদ ধরাতে,বিড়াল পোস্টমর্টেম, মসজিদ,গল্প না নিছক কল্পনা,পুনরুত্থান এই গল্পগুলো বেশি ভালো লেগেছে।কিছু গল্প দুবার করে পড়েছি। মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ গল্পটির শেষ লাইনে এসে রীতিমতো ঘৃণায় আমার গা গুলিয়ে বমি আসছিলো।আফসোস একদলা থুতু ফেলেই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলাম। . সবাইকে বইটি পড়তে সাজেস্ট করব। তবে প্রস্তুতি নিয়েই পড়তে হবে।নাহয় এমন কিছু অস্বস্তিকর মুহুর্তের শিকার হতে হবে যা কল্পনার অতীত। আর ভুলেও আমার মতো একসাথে সব গল্প পড়ে যাওয়ার মতো ভুল করবেন না! রয়ে সয়ে, ব��ঝে বুঝে পড়তে হবে।আপনিও একটু অনুভব করুন না আমরা কেমন সমাজে আছি!!
লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞ।এমন বই আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।
কি অদ্ভুত একটা নাম, "মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ"! শুনলেই মনে হবে নরখাদকদের নিয়ে লিখা কোন এক ভয়ংকর বই, কিন্তু আসলে তা নয়। বইটা একটা গল্পগ্রন্থ, যেখানে স্থান পেয়েছে ২১টি ভিন্ন স্বাদের গল্প। বইয়ের নামের মতো প্রত্যেকটা গল্পের নামই এমন বিদঘুটে। ভয়ংকর না হলেও গল্পের প্লট গুলো যথেষ্ট অস্বস্তিকর। গল্পগুলোতে লেখক প্রতিকী অর্থে তুলে ধরেছেন সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনা আর সমস্যাকে। কিছু কিছু গল্প ছিল টপ নচ এবং আপনাকে সত্যিই ভাবিয়ে তুলবে। গল্পগুলো পড়তে গেলে বোর হবার উপায়ই নেই কারন লেখকের সংযুক্ত করা কিছু সুক্ষ্ম ডার্ক হিউমার। তাই বলে সবগুলো গল্পই আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে এটা বলব না। কয়েকটা আসলেই অতি সাধারণ গল্প ছিল। তবে 'শেষ মাথাটি কাটাপড়ার আগে', 'মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ', 'খুনের সংবাদ ধরাতে' টাইপের গল্পগুলো তা সহজেই পুষিয়ে দেয়। ধন্যবাদ বন্ধু শাশ্বতকে, বইটা খুঁজতে সাহায্য করার জন্য। পুরো নীলক্ষেত এলাকা খুঁজাখুঁজি করে শেষে পাঠক-সমাবেশ থেকে যোগাড় করি বইটি। যাইহোক পড়ার পর সব পরিশ্রম উশুল। ট্রাই করে দেখতে পারেন, একবসায় পড়ে ফেলার মতো একটা বই...😊😊
বইয়ের নামটাই প্রথমে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করবে। ভাববেন নিশ্চয় আরেকটা মানুষখেকোর ভুতুড়ে গল্প।
কিন্তু ভেতরের বিষয়বস্তু যে কোন গা ছমছমে ভৌতিক গল্প থেকেও আপনাকে বেশী অস্বস্তি দিবে। লেখক বেশ স্বাধীনভাবে কল্পনার চাদরে বাস্তব বীভৎসতাকে আড়াল করে তুলে ধরেছেন। অন্যান্য ভূতের গল্প আর লোমহর্ষক হত্যারহস্যের গল্পগুলো পড়ে আপনি স্বস্তি পাবেন এই ভেবে যে বাস্তবে এমন হতেই পারে না। কিন্তু এই বই আপনাকে সেই স্বস্তি দিবে না।
যতই আপনি উপলব্ধির চোখ দিয়ে গল্পগুলোর ভেতরের বার্তাকে বুঝবেন ততই শিউরে উঠবেন। "শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে"- গল্পের শেষ মাথাওয়ালা মানুষটার মতই মুক্ত চিন্তার মানুষগুলো আজ বিপন্ন। "ধর্ষণের প্রতিশোধ" গল্পের সেই পত্রিকার ধর্ষণের খবর সংগ্রহ করা দম্পতির প্রতি আপনার ঘৃণা জাগবে না, বরং সমব্যথী হবেন। অবাক হয়ে লক্ষ করবেন মানবতার জয়গান গাইতে গাইতে পৃথিবীটাই একটা বিশাল "meet human meet" হয়ে গেছে , যেখানে ধনীরা মানবতা নিয়ে আলোচনা করতে করতে তৃপ্তি ভরে গরিবের মাংসের নানা আইটেম উপভোগ করছে। "বাক-স্বাধীনতার অনন্য দৃষ্টান্ত " পড়ার পর আবিষ্কার করবেন আপনার মাথায় অলরেডি ফ্রীডম চিপ লাগানো হয়ে গেছে।
থাক অনেক বেশী স্পয়লার হয়ে যাচ্ছে। মোট ২১ টা গল্প আছে বইটাতে । সবগুলোই অসাধারণ তা বলব না। তবে বেশিরভাগই মস্তিষ্কে ঝড় বইয়ে দিবে।
বইয়ের নাম আর প্রচ্ছদ দেখেই বলতে গেলে কিনে ফেলেছিলাম। সবচেয়ে বেশি যেই জিনিসটা দেখে আগ্রহী ছিলাম তা হলো বইয়ের নাম। "মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ " এ আবার কেমন নাম! নাম দেখে যেমনটা ভেবেছিলাম ঠিক তার উল্টো।
২১ টি দূর্দান্ত গল্প নিয়ে লেখা বইটি। রয়েছে একের পর এক টুইস্ট। একেকটি গল্প পড়ে অনেক সময় নিয়ে বসে ভেবেছি। প্রথম গল্পটা শেষ করেই একটা ধাক্কা খেলাম। এরপর ধীরে ধীরে সময় নিয়ে শেষ করলাম বইটা। গল্পগুলো সবার জন্য নয়। খুব বুঝে বুঝে সময় নিয়ে পড়তে হবে। একেকটি গল্প খুব ভাবাবে আপনাকে। এই গল্পগুলোতে উঠে এসেছে আমাদেরই সমাজের কিছু নৃসংস চিত্র। তবে অনেকের জন্য হয়তো কিছুটা ট্রিগারিং ও। ডার্ক হিউমার বা ডার্ক ফ্যান্টাসি থেকে শুরু করে ম্যাজিক রিয়েলিজম,খুন,ধর্ষন,করোনা,বেকার জীবন ইত্যাদি নানা বিষয় উঠে এসেছে বইটিতে।
মোজাফফর হোসেন এর পড়া এটিই প্রথম বই। লেখকের আরও বই পড়ার আশা আছে।
বইটার কথা প্রকাশ হবার পর থেকেই নামটা চোখে বাজছে। মানে 'মানুষের মাংসের রেস্তোরা' কেমন নাম আবার? এইযে আমার মতো কিছু পাঠকরা আছেনা যারা হঠাৎ হঠাৎ ক্লিশে সব গল্প লেখে ফেসবুকে দেয়, এরকম নাম দেখে সেই ধরণের বই-ই ভেবেছিলাম। তাই কেনার ইচ্ছাই হয়নি। তবে অনেকের কাছে ভালো শুনছিলাম, আমার ছোটভাই স্তেভান প্রথম এটা পড়ার সাজেশন দেয় প্রোপারলি। এরপর তো বুকস্টায় অনেক প্রিয় মানুষের কাছে শুনলাম।
আমি একদিনে শেষ করবো বলেও দুইদিন নিলাম। কারণ গল্প গুলো সুন্দর। ভাবায়। বইটা সবার জন্য না। সবাই পড়তে পারবেন, তবে এখানে ভায়োলেন্স, রক্তারক্তিসহ আরও কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো অনেকের জন্য ট্রিগারিং। বইটায় গল্পগুলো ডার্ক ফিকশন, ডার্ক কমেডি, অবাস্তব, পরবাস্তব ইত্যাদি ঘরাণার। তবে বইটার যে ব্যাপারটা ইম্প্রেসিভ বলে শুরুতেই বিজ্ঞাপন করলাম সেটা হলো প্রতিটা গল্পের লুকানো ম্যাসেজ, লুকানো অর্থ। প্রথম গল্পটা পড়েই যখন ধাক্কাটা খেলাম, তখন বুঝে গিয়েছিলাম এই বই ব্রেক কষে কষে সতর্ক ভাবে পড়তে হবে, অর্থটা ধরতে হবে। যদিও খুব ডিপ চিন্তাভাবনার কিছু নাই, সহজেই বোঝা সম্ভব। প্রতিটা গল্পে তিনি সমাজের নির্মমতা, নিষ্ঠুররা আর নৃশংসতার কথা রূপক অর্থে শ্লেষের সাথে গল্পে প্রবেশ করিয়েছেন। ভাবণার খোড়াক যে কোনো বইকে আমি সেরার কাতারে ফেলি। এই বইটাও তাই রিসেন্ট পড়া গল্পসংকলন গুলোর মধ্যে টপেই থাকবে। তবে চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে, এই বইতেও ছিলো কিছু কিছু। এখানে গল্প সংখ্যা ২১টি। প্রতিটি গল্প যে টপনচ ছিলো তা নয়। ২-১টা গল্প মনে হয়েছে খুবই সাধারণ, আরেকটু অন্যভাবেও লেখা যেতো। তবে বেশিরভাগই অত্যন্ত সুন্দর, তাই রেকোমেন্ডেড। মোজাফফর হোসেন এর 'অতীত একটা ভিনদেশ' সংগ্রহ করবো খুব শীঘ্রই। আগ্রহ বেড়ে গেছে!
এমন ডার্ক লেখা আমি বহুদিন পড়িনি। আমাদের সমাজের, মানুষের বিবেক, নৈতিকতার চরম অবক্ষয় কোন জায়গায় আছে সেটা প্রতিটা গল্পে বিভিন্ন ভাবে লেখক তুলে ধরেছেন স্যাটায়ারের মাধ্যমে। আমি কয়েকটা গল্প পড়তে পড়তে প্রচন্ড অস্বস্তি বোধ করেছি, ফ্রাস্টেটেড বোধ করেছি। মনকে বিক্ষিপ্ত করে তুলেছে অনেকগুলো লেখা। টানা পুরোটা বই শেষ করতে পারিনি। আস্তে আস্তে পড়েছি। এবং প্রায় প্রতিটা গল্পই খুব ভাল লেগেছে।
দু একটা গল্প বাদ দিলে এটা দারুন একটা গল্পসংকলন। তবে এই দারুন গল্পের জন্য প্রতি গল্প পড়ে গল্পটা আসলে কাদের বলা হয়েছে বা গল্পটা কোনদিক নির্দেশ করে সেটা পাঠককে বুঝতে হবে কেননা এটা না বুঝলে অনেকের কাছেই হয়ত এটা গার্বেজ মন�� হতে পারে।
The concept of the stories is very common. It felt like reading something from the newspaper.. as almost all the stories are common.. it was really easy to predict the conclusion. The language is lil bit rough. Maybe that’s why I didn’t enjoy the book the way I should’ve!
শেষ মাথাটি কাটা পড়ার আগে এবং মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ, এই দুইটি গল্প পুরোপুরি ভাল লাগলো।
তবে, বাকি গল্পের ক্ষেত্রে আমার কাছে সমস্যার লেগেছে রিপিটেশনের বিষয়টা। একই থিম নিয়ে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লেখা গল্প সংখ্যায় এত বেশি হলে ভাল লাগে না।
আমি জানতাম পাঞ্জেরী শুধু গাইডবই ছাপায় আর সাইড বিজনেস হিসেবে সচিত্র কিশোর ক্লাসিক বের করে। এবারের বইমেলায় আমার এই ভুলটা ভাঙ্গল। বইমেলার আলোচিত বেশ কিছু বইই তারা ছাপিয়েছে। সেই আলোচিত বইগুলোর মধ্যে একটা হলো “ মানুষের মাংসের রেস্তোরা ”, লেখক, মোজাফফর হোসেন।
প্রথমেই আসা যাক প্রডাকশনের কথায়, বইটার বাইন্ডিং, ছাপার মান খুবই ভালো; একেবারে “আদর্শ” লেভেলের। আর প্রচ্ছদটাও বইয়ের থিমের সাথে একদম মানানসই। ছোটখাট, একবসায় পড়ে ফেলার মত একটা বই; হাতে নিলেই ভালো লাগে।
১২০ পেজের এই বইয়ে ২১ টি গল্প আছে। অনুমিতভাবেই গল্পগুলো কলেবরে বেশী বড় নয়। তবে লেখকের কৃতিত্ব হলো তিনি অল্প কথায় বেশ ভালোভাবে গল্পগুলোর চিত্রায়ন করতে পেরেছেন। প্রত্যেকটা গল্পই ডার্ক আর গ্রিটী। কয়েকটিতে পরাবাস্তবতার ছোয়াও আছে। বইয়ের প্রথম দুটি গল্পই যেকোন পাঠককে হুক করে ফেলবে। সমসাময়িক বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে লেখক স্যাটায়ারিক ভঙ্গিতে অবলীলায় উপস্থাপন করেছেন। আমি এপর্যন্ত বর্তমান সময়কে উপজীব্য করে লেখা এর চেয়ে ডার্ক কোন লেখা পড়িনি। আশেপাশের ঘটা ঘটনা গুলো পড়লে এত নগ্ন লাগে দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। গল্পগুলোতে রাজনীতি, নৈতিকতা, ধর্ম, হিপোক্রেসি, লোভ হেন কোন বিষয় নেই যা উঠে আসেনি। ছোট ছোট গল্প হওয়ায় গল্প নিয়ে বেশী কিছু বলতে গেলেই স্পয়েল হয়ে যাবে। শেষ মাথাটি কাটাপড়ার আগে, মানুষের মাংসের রেস্তোরা, ধর্ষণের প্রতিশোধ, বাক স্বাধীনতার অনন্য দৃষ্টান্ত, সিসিফাস হাসে ঈশ্বরের হাসি, বিড়াল-পোস্টমর্টেম এই গল্পগুলো তুলনামূলকভাবে বেশী ভালো লেগেছে। এই বইয়ের সবচেয়ে রিল্যাভ্যন্ট গল্প মনে হয়েছে ফ্রিল্যান্ড এর বাকস্বাধীনতাকে উপজীব্য করে লেখা গল্পটি। এই একি গল্পগুলোই হয়তো আরো পলিশড ভাবে উপস্থাপন করা যেত, সেন্সর করা যেত কোন কোন ক্ষেত্রে পরাবাস্তবতার আশ্রয় না নিয়ে সরাসরি ও বলা যেত কিন্তু তখন সেগুলো এমন ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারতো না মানুষের চেতনাজগতে। লেখক ইচ্ছা করেই সবগুলো গল্পই এইভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন পাঠক ধাক্কা খায়, ভাবতে বাধ্য হয়। সাইজে ছোট হলেও এটি মোটেও এক বসায় পড়ে ফেলার মত বই না। এর প্রতিটা গল্প পড়ে ভাবতে হবে, নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে।
লেখককে অব্যশই বাহবা দিতে হবে। তিনি এক্সপেরিমেন্ট করার সাহস দেখিয়েছেন। নাট্যপন্যাস লেখক, সেলিব্রেটি লেখকদের লেখার ভীড়ে এই ধরণের লেখা পড়লেই ভালো লাগে। তার কাছ থেকে আরো বড় কলেবরে এমন ইম্প্যাক্টফুল লেখার আশা থাকলো।
আমরা তো স্যুপ অর্ডার করিনি? আমি বলি। এটা কমপ্লিমেন্টরি। ফিঙ্গার স্যুপ। খান, ভুলতে পারবেন না। শুনেই আমার জিভে জল চলে আসে। এমনিতেই অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা ক্ষুধার্ত। আমি স্যুপের একটা বাটি নিজের দিকে টেনে নেই। পাতলা ডালের রঙ, চামচ দিয়ে নাড়তেই চিংড়ির মত কুচিকুচি করে কাটা আঙুল ভেসে ওঠে। একটা তুলে মুখে দেই। অমৃত। ভেতরের হাড়টা দাঁতের নীচে পড়ে মটমট করে। চিংড়ির চেয়ে কয়েকগুণ বেশি স্বাদ। বাচ্চার আঙুল নাকি? আমি জিজ্ঞাসা করি। আজ একটা অর্ডারে দুটো পথশিশু জ বা ই হয়েছে। এই শহর থেকে দুজন অনাগত ভিক্ষুক বা পকেটমার কমে গেল। ম্যানেজার বলে। বাহ! দারুণ। এই ব্যবসাটা দশ বছর আগে চালু হলে আমার আইফোনটা হারাতে হতো না। ওতো দাম দিয়ে কিনে ব্যবহারই করতে পারলাম না। হারুন শুনে খুশী হয়ে বলে।
চমৎকার একখানা বই পড়লাম। আমি অবশ্য মাঝেমধ্যেই বলি এই দুনিয়ায় মানুষের মাংসের চেয়ে সস্তা কিছু নেই। মানবাধিকার, মনুষ্যত্ব বা আর দশটা এই ধরনের বড় বড় বুলি আসলে আলোচনায় ভারিক্কি ভাব আনার জন্যই ব্যবহার করা হয়। বাস্তবিক জগতে এসব কথার আদতে দাম আছে বলে মনে হয় না। বিচার যাই হোক, তাল গাছ সবার চিন্তা করলেও তাল যে কতিপয় ব্যক্তি আগেই খেয়ে ফেলেছে সেসব নিয়ে বলেও আসলে লাভ নেই। দেশে বিদেশে ক্ষমতাশালীরা আছে বিপদে। হুদাই তাদের মত নিরীহ ব্যক্তিদের গরীব গুবরো জনগণ হিংসে করে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করে। যাউক গা, আমার কি। আমি খেয়ে পড়ে নির্বিবাদে বেঁচে থাকলেই হলো। বিদ্রোহী কবি বলে গিয়েছেন 'দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।' তিনি বলতে ভুলে গিয়েছিলেন দেনা যারই হোক মেটানোর দায়ভার কিন্তু আমজনতার। থাক, কথা বাড়ালেই বেড়ে যায়। আজকের মত বিদায়৷
উপরের প্যারাটুকু হুদাই লিখেছি। এই বই সবাই পড়ে মজা পাবে বলেও মনে হয় না। তবে সবারই এই ধরনের বই টেস্ট করে দেখা দরকার। বলা তো যায় না পাইলেও পাইতে পারেন অমূল্য রতন।
দুর্ধর্ষ একটা বই। এখনকার ছোটগল্প তেমন একটা পড়া হয় না। মানে ভরসা পাই না আরকি। কিন্তু এই বইটার নাম দেখেই আগ্রহ তৈরী হয়েছিল পড়ার জন্য। ভয়ংকর লেভেলের পরাবাস্তবতা ও বাস্তবতার মিশেলে লেখক আমাদের সমাজব্যবস্থার নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার নানা চিত্র তুলে ধরেছেন। সাহসী, সৃজনশীল ও ব্যতিক্রমভাবে আমাদের সমাজের নিত্যকার গল্পই বলেছেন তিনি। গতকাল যখন গল্পগুলো পড়া শুরু করি, তখন চার নম্বর গল্প মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ পর্যন্ত পড়ে আর পড়তে পারিনি। মানে স্বাভাবিক ছিলাম না আরকি। এমনটা হয়েছিল ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট পড়ার সময়। রাসকলনিকভ যখন দ্বিতীয় খুনটা করে ফেলে তখন মনে হচ্ছিল খুনের অভিজ্ঞতা আমার হয়ে গেল। স্বাভাবিক থাকতে পারিনি । তখন কিছুদিন গ্যাপ দিয়ে আবার পড়া শুরু করেছিলাম। তবে এই বইটার বেলায় অত বড় গ্যাপ রাখতে পারলাম না। গল্পগুলো টানছিল খুব। কোন গল্পই যেন কোনটার চেয়ে কম নয়। এই ধরণের প্লটে বিদেশী গল্পের অনুবাদ পড়া হয়েছে কিছু। তবে ঠিক এমনটাই নয়। লেখক মোজাফফর হোসেনের লেখা এর আগে পড়িনি। এই বই পড়ে মনে হচ্ছে দারুণ এক গল্পবলিয়ে পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে ডার্ক হিউমার যারা নিতে পারে না এ বই তাদের জন্য না। লেখকের জন্য শুভকামনা। ওনার বাকি বইগুলোও পড়ার আগ্রহ রাখছি।
বইটার নাম দেখে প্রথমে ভড়কে গিয়েছিলাম। এ কেমন নাম? ছোট ছোট গল্প। কিন্তু এ কেমন গল্প? এমন গল্পের কথা মানুষের মাথায় আসে কীভাবে? প্রতিটা গল্প গভীর অন্ধকারের হাতছানি দেয়। যাদু বাস্তবতা, ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো কাহিনী, তিমিরের রুপকতা, গভীর ব্যাঙ্গাত্মক বর্ণনা কী নেই সেখানে! মস্তিষ্কবিহীন সমাজে একজন মাথাযুক্ত মানুষের সংগ্রাম কিংবা পাগলের প্রত্যাবসন অথবা যৌনপল্লীর অভিনব গল্প বা মানুষের মাংসের রেস্তোরায় মানবিকতা বিষয়ক সভা একজন পাঠককে নিয়ে যেতে পারে পরাবাস্তবতার শেষ সীমায়। লেখক জীবনানন্দ নামে একজন বেকারের গল্প বলতে শুরু শেষ করতে পারেননি। ২১ টি গল্প ২১ বার পাঠককে অবাক করবে, ২১ বার নতুন করে ভাবতে শেখাবে। তারপর সবকিছুকে কেবলি শূণ্য মনে হবে-
“আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে; স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়; আমি তারে পারি না এড়াতে, সে আমার হাত রাখে হাতে, সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়, সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময় শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়।”
বইয়ে মোট ২১ টি ছোট গল্প আছে। প্রত্যেকটা গল্পই অন্ধকারের। রাতের তিমির না, দিন-দুপুরের নিকষ কালো আঁধার। আমাদের চারপাশে ঘটে চলা ঘটনাবলী লেখকের সুনিপুণ দক্ষতায় ধরা দেবে খুবই অস্বস্তিকর উপলব্ধির মধ্য দিয়ে। এবং এটাই বোধহয় লেখকের উদ্দেশ্য ছিল।
কিছু কিছু গল্পে পাঠককে বিব্রত করার নগ্ন প্রচেষ্টা ছিল লেখকের। আমার মনে হয় এইটা আরও সূক্ষ্ম ভাবে করার জায়গা ছিল। নিরেট স্পষ্টভাষীতা যখন সবগুলো গল্পেরই মূল বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে, তখন কেমন একটা একঘেয়েমি চলে আসে।
মোজাফ্ফর হোসেনের প্রতিটি গল্পই বিয়োগান্তক— হয়তো সমাজের জন্য, নাহলে মানুষের জন্য। পুরো বই জুড়ে একটা বিষণ্ণ বিবেকের তাড়না অনুভব করবে পাঠক। সাহিত্যেই কেবল বোধহয় বিষণ্ণতা উপভোগ করা সম্ভব!
এই বইয়ের পুরস্কার হিসেবে আমি চাই, বইটিকে অবিলম্বে নিষিদ্ধ করা হোক। তারপর বইটিকে কেন নিষিদ্ধ করা হলো এই কৌতূহলে হাজারো মানুষ বইটি যেভাবেই হোক পড়বে। পড়া শেষ হলে বেশিরভাগ মানুষই বলবে, 'ঠিকই আছে নিষিদ্ধ হয়ে। এইটা কোনো বই হলো! এসব ঘটনা ঘটতে শুনেছে কেউ কখনো!'
সাহিত্যের সচেতন পাঠকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য ২১টি ছোটোগল্পের সংকলন। সমকালকে চিহ্নিত করা, মানুষের বুকের ভাষা-মুখের ভাষার ব্যবহার, সরস শব্দচয়ন সবদিক থেকে গল্পগুলো পরিপূর্ণ।
এবছর এমন অবশ্যপাঠ্য কিছু ছোটোগল্পের বই পড়েছিলাম। যেমন: আশান উজ জামানের 'বা অথবা কিংবা', হাসান মাহবুবের 'মায়াফুলের বন', সুমন রহমানের 'নিরপরাধ ঘুম', নাহিদ ধ্রুব'র 'হিম বাতাসের জীবন' এবং আহমদ খান হীরকের 'সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা(১৮+)'।