Satinath Bhaduri was a Bengali Indian novelist and politician. He was known by his literary pseudonym, Chitra Gupta. His ancestral home was in Krishnanagar in the district of Nadia. He obtained an MA degree in Economics from the University of Patna in 1930. In 1931 he completed his BL degree. He started practising law at Patna between 1932 and 1939. He then joined Indian National Congress and became a district secretary of Purnia. He was imprisoned in Bhagalpur Jail twice: 1940-41 and 1942-45. In 1948, he fell out with the Congress and joined the Socialist Party.
Satinath's first novel was Jagari (1946), for which he received the very first Rabindra Puraskar (1950). This book earned him considerable fame, and was translated into English in 1965 as part of the UNESCO Collection of Representative Works.
লেখককে খুঁজে পাওয়া যায় না বর্ণনায়, এমন নিরাসক্তভাবে লেখা খুব কঠিন কাজ। ঘটনা ঘটছে, চরিত্রগুলো বলে যাচ্ছে তাদের চিন্তা বা কর্ম- লেখকের কোনো কৃতিত্ব যেন নেই এই বর্ণনায়। আর এই কৌশল আয়ত্ত্ব করতে পারেন যিনি, লেখক হিসেবে তিনি প্রথম শ্রেণীর নি:সন্দেহে। সতীনাথ ভাদুড়ির ঢোঁড়াইচরিত মানস পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
রামচরিত মানসের রামচন্দ্রের সমান্তরালে ঢোঁড়াই বেড়ে ওঠে। জ্ঞান হবার পর থেকে সে জানে দুটি জিনিস অবিনশ্বর। রামায়ণ আর তার গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাস্তা 'পাক্কী'। কিন্তু সবই পালটায়। সময়- প্রথা, ঢোঁড়াইয়ের পালক পিতা বাওয়া, সাধ করে বিয়ে করা স্ত্রী রামিয়া। বিহারের ভূমিকম্প, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সত্যগ্রহ আন্দোলন- রবার্ট জেরেমিক্সের ফরেস্ট গাম্পের মতোই ঢোঁড়াই প্রত্যক্ষ করে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ। ফরেস্ট গাম্পের সাথে তার প্রথম পার্থক্য স্থান-কালে, দ্বিতীয় পার্থক্য, সাধারণ মানু্ষের মতো ঢোঁড়াই কেবল পিছু করে গেছে ইতিহাসের আর জেরেমিক্সের সিনেমায় নায়ক নিজেই ইতিহাস বদলে গেছে।
এখানেই, ঢোঁড়াইকে দিয়ে কোনো কিছুই আরোপ না করানোতেই, সতীনাথের সার্থকতা।
অদ্ভুত এই নিস্পৃহ বর্ণনাশৈলীতে সতীনাথ ভাদুড়ি মুগ্ধ করে ফেললেন। তার আরেক ম্যাগনাম ওপাস 'জাগরী' পড়বার আগ্রহ বেড়ে গেলো অনেক।
আমি একেবারেই নিশ্চিত নই বইটির রেটিং কত দিতে পারি! কিন্তু দিতেই হয় যেহেতু, তাই চোখ বুঁজে চার তারা দিয়েছি। কারণ বলছি পরে।
সাহিত্যের নিয়মিত পাঠকরা নিশ্চয়ই অবগত থাকবেন যে 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। অনেক জায়গাতেই অনেকের কথায় বা লেখায় দেখেছি তাদের দৃষ্টিতে অন্যতম মহৎ এক উপন্যাস হচ্ছে এটি। সেরা দশ,সেরা বিশ ইত্যাদি লিস্টেও এর স্থান আছে।
এ ব্যাপারে আমিও প্রায় একমত। এযাবৎ আমার অল্পবিস্তর পাঠের অভিজ্ঞতায় উপন্যাসের ফর্ম, গঠনশৈলী,পটভূমি সম্পর্কে যে জানাশোনা, প্রত্যাশা, সেসবের সবকিছুই তো আছেই,উপরন্তু অনেক কিছুতেই উৎকর্ষতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে আমি মনে করি।
এমনকি উপন্যাসের যেই জিনিসটা আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লাগে তা হলো 'বহুস্বর'(polyphony)। অর্থাৎ বর্ণনভঙ্গিতে লেখকের কণ্ঠ পাওয়া যাবেনা,বরং ঘটনা,অবস্থা, চরিত্র ও অবস্থান অনুযায়ী বর্ণনা থাকবে। এরকম ভাবে লেখা সহজ কথা নয়,সত্যিই সহজ না।বেশিরভাগ লেখাতেই মনে হবে লেখক তার মতামতকে চাপায়ে দিচ্ছেন। অথচ সতীনাথ ভাদুড়ি এমনটা করেননি। ঈর্ষণীয়ভাবে তিনি বহুস্বরের সফল প্রয়োগ করেছেন।
আরেকটা দারুণ বৈশিষ্ট্য মনে হয় যে কোনো চরিত্রকেই ঢালাওভাবে ভাল বা খারাপ বা লোভী বা সৎ বা হিংসুটে বা বিবেচক--এভাবে না বর্ণনা করা। মানুষমাত্রেই যে অনেক বৈপরীত্যের মিশ্রণ বা সমষ্টি,,এক জায়গায় সে লোভে পরে হানাহানি করে তো আরেক জায়গায় ভালবাসার কথা ভেবে পুড়ে খাক হয় তো আরেক জায়গায় নিজের স্মৃতির ভেতরে ডুবে ডুবে কথা বলতে বলতে হারিয়ে যায় তো আরেক জায়গায় চিৎকার করে নিজের প্রাপ্য অধিকারটুকু দাবি করে।সব করে একটাই মানুষ। এমন করে চরিত্র বোনা মুন্সিয়ানার কাজ।
আর প্রায় তিনশ পৃষ্ঠার একটা উপন্যাস।কত কিছুই আর ঘটতে পারে!? বা অনেক ঘটনা চাইলেই ঠেসেঠুসে দেওয়াই যায় তো। কিন্তু অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে, সূক্ষ্ণভাবে বহুমুখী ঘটনাপ্রবাহের স্রোতে -তাও আবার ঐতিহাসিকভাবে,রাজনৈতিকভাবে ও সৎভাবে সেটার বয়ান দিয়ে যাওয়া,,চাট্টিখানি কথা নয়।
এবার আসি আমার পাঠের অভিজ্ঞতায়। করুণ! পুরো পড়ার পিরিয়ডটুকুতে কম করে হলেও বিশবার ভেবেছি যে এটা আর পড়বোনা,।এমনকি প্রথম ১০০ পৃষ্টা পড়তে গিয়ে আমার জান যাবার জোগাড়। জানের উপর পাথর চেপে চেপে যেন শেষ করেছি এটা (অবশ্য এটাকে শেষ করাও বলতে বাঁধছে আমার,কেউ যদি পাঁচ মিনিটও উপন্যাসটির উপাখ্যান সম্পর্কে জানতে চায়,একটু বুঝিয়ে বলোতো কি হয়েছে!-- আমি ওখানেই ঠপাস! বস্তুত কোনরকমে ঠেলেঠুলে ভাসাভাসাভাবে, কোন ঘটনাকে উপেক্ষা করার মতন চোখ বুলিয়ে শেষ পৃষ্ঠায় পৌঁছানোটাকে উপন্যাস শেষ করা বলতে রাজি না আমি। রাজি থাকলে তৃপ্তির ঢেঁকুর ওঠে, কিন্তু আখেরে কিচ্ছু হয়না)।
এর পূর্বেও তথাকথিত ও জনপ্রচলিত বোরিং,কঠিন,অহেতুক বিশাল বিশেষণের অনেক ফিকশন আমি আনন্দের সাথে আগ্রহের সাথে পড়েছি সেসব থেকে প্রভাবিতও হয়েছি কিন্তু এমন অবস্থা বোধয় এই প্রথম। চমৎকার এই জ্বলজ্বলে শক্তিশালী উপন্যাস পাঠে কেন এই বন্ধুর অভিজ্ঞতা,তার সম্ভাব্য কিছু কারণ ভাবলাম-
১। যথেষ্ট ঘুরিনি;তাই জায়গা, মুহূর্ত কল্পনায় আনতে পারিনিঃ ফিকশন পড়ার সময় খুব সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে আমি ঘটনাকে ভিজুয়ালইজ করার চেষ্টা করি।সিনেমায় সেটিকে কেমন দেখাতে পারে সেরকম। ধরা যাক প্রকৃতির বা মানুষের বর্ণনা শুরু হলো। সাথে সাথে গাছ সবুজ রাস্তা নদী আবহাওয়া একটু একটু করে গজিয়ে উঠছে। মানুষের পা থেকে মাথা পর্যন্ত গড়ে উঠছে। এবং আমি এই ভিজুয়ালাইজেশনটা সবসময় নতুনভাবে করতে চেষ্টা করি। কিন্তু দেখা গেলো সেটা পারছিনা,,,ফলত পুরাতন কোন জায়গা( আমার গ্রাম,আমার ঘর) ঘুরেফিরে আসছে।এটাতেও প্যারা খাই। মনে হয়,যদি আরো ঘোরাফেরা করতাম, মানুষের মুখ দেখতাম,জীবনযাপন আরেকটু বর্ণিল হইতো,,, বা এই উপন্যাসের জন্য জিরানিয়া অঞ্চল বা সেদিককার মানুষদের জানতাম তাহলে অনেক বেশি সুবিধা হোতো।
২।ওখানকার যে জাত,গোত্র নিয়ে কাহিনী বুনিত হয়েছে--তাৎমা,ধাঙর,সাঁওতাল। তাদের শ্রেণির জীবনযাত্রার ধরণ ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমার আইডিয়া নাই। যাতে করে ওদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে বুঝতেও হয়তো বুঝে উঠতে পারিনি।
৩।আমার ভাষাবোধ এখনো দূর্বলঃ যে আমি উপন্যাসে মূলত নিত্যনতুন এক্সপেরিমেন্টাল কথন ও স্টাইল খুঁজি, ও 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'এর মত অভিনব গদ্য দেখলে গদগদে হই খুশিতে, তারপরও কাহিনীতে হঠাৎ হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলেছি( এই উপন্যাসটা পড়তে হয়েছে পুরো সজাগ মনযোগে।।।ওইযে থাকেনা যে একটা বর্ণনায় গতি থাকলো এমন যে পড়ছি তো পড়ছি মাঝে মাঝে মনযোগ বাইরে আসছে কিন্তু ওই গতিটাই আপনারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং একটু মনযোগহীনতা খুব একটা সমস্যা করছেনা?!কিন্তু না,এই উপন্যাস পুরো মনযোগ দাবি করে।একটা আনমনা হয়ে পড়লে আবার পড়তে হয়েছে ওই লাইনটা)।
৪।ওসময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞঃ মূলত, কোনকিছুই রাজনীতির বাইরে না। যে সময়ের ফ্রেমে উপন্যাসটি লেখা হলো, ওসময়কার দিনদুনিয়ায় কম যুদ্ধ হয়নি,কম শোষণ হয়নি, কম ক্ষমতার গদিবদল হয়নি-- আর সেসবকিছুর প্রভাব কি ওই নিম্নশ্রেণির দৈনন্দিনতায় গিয়ে মেশেনি?!তারা কি এজন্য সাফার করেনি?! আর উপন্যাসের শেষ ১০০ পৃষ্ঠা তো যেন রাজনৈতিক ঘটনার বোমা। চেরমেন (চেয়ারম্যান), জমিদার, বাবুসাহেব, হাকিম, গিধর মণ্ডল-- শোষণ ও ক্ষমতালাভের জন্য হিংসা মারামারি, প্যাঁচ খেলা ও প্রতারণা।।।। ওসময়ের ওই পটভূমির ইতিহাস কম জানা থাকাও একটা কারণ।
আরো কিছু টুকরো টাকরা খুচরো খাচরা কারণ আছে।সেসব না তোলাই শ্রেয়।
তো এতসব ভকভকানি পড়ে যদি কারো এই উপন্যাস পড়া সম্পর্কে একটু সংকোচ কাজ করে, পড়বো কি পড়বো না--তাদের বলতে চাইঃ হ্যাঁ।
অবশ্যই পড়তে হবে আপনাকে।পড়া উচিত যদি আপনি এর আগে এই বইটা পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন। কারণ, আমি কাঠখড় পুড়িয়েছি তারমানে তো এই��া যে আপনাদেরও একই অবস্থা হবে! উপন্যাসের পাতায় পাতায় যে মাথা ঘুরে দেওয়া উপমা, রূপক,বহুবিধ ইশারা-ইঙ্গিত(যেইটা একটা ভাষার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।ভাষার সৌন্দর্য তো এই ইশারা- ইঙ্গিতেই!),অনেক অনেক idiom, লোকজ উপাদান, লোকজ সঙ্গীতের ইন্টারেস্টিং ব্যবহার, এমনভাবে অনুভূতির প্রকাশ যাতে অবাক হবেন যে এমনেও কেউ অনুভব করতে পারে?!?।
অতএব, পড়েন। আরো পড়েন। আবার পড়েন।
তাছাড়া, এই একটা উপন্যাস পড়াই তো আর সবটা পড়া না। আপনার পড়ার যে জার্নি, সেইটার একটা অতিক্ষুদ্র অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হচ্ছে এই উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা যেটা যোগাযোগ ঘটায় অনেক কিছুর।
তাৎমাটুলি'র লোকের হলো ঘড়ামির কাজ। ছনের বদলে টিনের প্রচলন হবার পর যাদের কর্মসংস্থানও প্রায় বিপন্ন। নয়তো, শিলাবৃষ্টি হলে যখন গ্রামের লোক শূণ্য চোখে নিজের ক্ষেতের পাশে বসে পড়ে, সেখানে তাৎমাটুলিতে জাগে খুশির জোয়ার-নে, চালগুলো আরো ভেঙে পড়ুক, তবেই না ডাক পড়বে তাদের। দিনবদলে যে ঘর ছাওয়ার কাজ গেছে, সাথে উঠে যাচ্ছে পার্শ্ব-জীবিকা কুয়ো খোঁড়ার কাজ-ও, টিউবওয়েলের বরাতে। ধানের মৌসুমে স্ত্রীদের ধান-কাটনির কাজে কি আর বছর যায়?
সমাজের দ্বারা একপাশে ঠেলে রাখা এই জনগোষ্ঠী তাই ভরসা রাখে দৈবে, আর অলীক মানুষে। আকাশের গোঁসাই পূব থেকে পচ্চিমে ঢলে পড়বেন রোজ, এর যেমন ব্যাত্যয় নেই, ব্যাত্যয় নেই তেমন থানের গোঁসাই, বৌকা বাওয়া, রেবণগুণী, প্রমুখের প্রতি তাৎমাদের শ্রদ্ধার। পরিবর্তন কিছু ঘটে কখনো, যখন ততোধিক চমৎকারিত্ব নিয়ে হাজির হয় 'গানহী বাওয়া'র মতো দিব্য লোক, যার কাছে এমনকি গাঁয়ের কূলপুরোহিতও মাথা ঝোঁকায়।
তাৎমাটুলি আর ধাঙড়টুলি পাশাপাশি হলেও, নিজেদের মাঝে বড্ড ফ্যাসাদ। সমাজের চোখে সমান নিচু দুই দল নিজেদের নিয়ে মেতে থাকলে যা একটু ঠোকাঠুকি হয় আরকি। তারপরও জিরানিয়ার হাটে তামাসা দেখতে যাওয়া, আর রামায়ণকে মাথায় করে রাখা, এতে কারো অমিল নেই। তাদের কাছে ছাপা অক্ষর বলতে রামায়ণ, তাই শিক্ষিত লোকমাত্র রামায়ণ-পড়া দিব্য লোক। যেমন গানহী বাওয়া। কথার কি তেজ তাঁর! তিনিই আবার একদিন হাজির হলেন 'মহাৎমাজি' রূপে। এবং পাঠকের তখন বোধদয় হয়, এই মহাৎমাজি আসলে মহাত্মা গান্ধী, গানহী বাওয়া 'গান্ধী বাবা'। আর রামায়ণ-পড়া গানহীর রামরাজ্য গড়ার ডাক, মূলত কংগ্রেসের আন্দোলন।
এইখানে, জিরানিয়ার তাৎমাটুলি থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য আমরা লেখকের কাছে আসি। সতীনাথ ভাদুড়ী, আইনজীবির পেশায় যাঁর মন টেকেনি, কংগ্রেসের সাথে ঘুরে ফিরেছেন তৃণমূল মানুষের মাঝে। রাজনৈতিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল কারাবাস, যেখানে বসেই জাগরী লিখেছিলেন। মহাৎমাজি'র পাঠানো 'বলন্টিয়র' যখন গ্রামের লোকদের মহাৎমাজির কথা শোনায়, আর মানুষ তা দৈব-জ্ঞানে শোনে, ভেবে নেওয়াই যায়, এই ভলান্টিয়র লেখক নিজেই।
কখনো এই বহিরাগত 'বলন্টিয়র', কখনো জিরানিয়ার হাটে আয়োজিত 'টুরমনের তামাশা', এই-ই দুনিয়ার হালচাল সম্বন্ধে তাৎমাটুলির সচেতনতা। এবং সেসবের যেমন নিজস্ব অর্থ করে নেয় তারা, তাও আগ্রোহদ্দীপক বটে। যেমন ভোটের সময় মহাৎমাজি'স চিঠি এলো সবার হাতে হাতে, গানহী নিজে লিখেছেন, রামায়ণের হরফের মতো লেখা (আদতে ছাপার অক্ষর)। তাই সবার কাজ, 'বোট'-এর সাদা বাক্সে সে চিঠির জবাব রাখা। পরম শ্রদ্ধায় সে সাদা বাক্সকে তেল-সিঁদুর লাগাতেও চেয়েছিল কেউ, মহাৎমাজি'র স্মরণে। কিন্তু আইনের লোকের তাড়া খেয়ে তা আর হয়নি।
এই আইন ব্যাপারটাও বেশ অদ্ভুতুড়ে। যেবার ভূমিকম্পে মাঠ চৌচির হলো, লোক প্রাণ নিয়ে বাঁচল কোনোরকম, সেবার মহাৎমাজি'র তরফ থেকে ত্রাণ এসেছিল। কিন্তু হিসেবের মারপ্যাঁচে সবটাই রয়ে গেল 'বাবুজি'র ভাঁড়ারে। বাবুজির ছোট ছেলে, লাডলীবাবু মহাৎমাজির কাজ করতে গিয়ে জেল খেটে বাপের নাম কেটেছিল ইংরেজ সরকারের কাছে। সেই লাডলীবাবু-ই কাংগ্রিসের সরকারের চেয়ারম্যান হয়ে এসে, বাপের জোতদারির সহায়ক হয়ে দাঁড়ালো। বলন্টিয়রের ভাষ্যে 'জুলুমকার' ইংরেজ সরকারের হাতে যে ভোগান্তি, আবার 'কাংগ্রিস'-এর হাতেও সেই ভোগান্তি-ই। মাঝে থেকে, রাজা যে-ই হোক, লাভ লুটছে বড়লোকেই।
ব্রাত্যজনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার স্বরূপ আমরা দেখি মূল চরিত্র ঢোঁড়াই-এর পাশে থেকে। ঢোঁড়াই, যে সাহস করে সব নতুন কাজের আঞ্জাম দেয়- হোক তা জাতের অমতে পৈতে ধারণ, অথবা বাবুজি'র বিপক্ষে গ্রামের লোকদের সমবেতকরণ। ঢোঁড়াইয়ের জীবনটা বেশিদিন 'নিজের' থাকেনি। সমাজের ওপর বিতৃষ্ণায় ঢোঁড়াই ভেবে নিয়েছিল, "ঘরের থেকে পর ভালো, আর পরের থেকে জঙ্গল ভাল"। তবু পরের জন্য কন্ঠ তুলতে ঢোঁড়াই-ই এগিয়ে এসেছে বারবার, যার কূল-ঠাঁই হারাবার পরোয়া ছিল না। একে একে ইংরেজের অত্যাচার আর জোতদারের সুবধা ভোগ, কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও 'বাবুজি' আর 'মোড়ল' পেরিয়ে গাঁয়ের লোক অব্দি সুফল না আসা, এসবই দেখেছে ঢোঁড়াই এবং ব্রাত্য মানুষ। কাংগ্রিসের 'সাতিয়াগিরা' (সত্যাগ্রহ) এবং আর সব তৎপরতা মানুষের কাছে খুব ঐশী হয়ে ধরা দিলেও, তাদের দিন পাল্টায়নি। শেষে বলন্টিয়রের মতো ঢোঁড়াই-ও যোগ দেয় 'ক্রান্তিকারী'র দলে, 'স্বরাজ' আনতে গিয়ে যারা নিজেরাই হয়ে পড়েছিল বেপরোয়া লুটেরা।
ঢোঁড়াই চরিত মানস উপন্যাস কেবল গরীব মানুষদের জীবনযাপন দেখা নয়, তাদের একজন হয়ে কিছু কাল যাপন করা। নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ বলা যেতে পারে। লেখক সতীনাথ ভাদুড়ী সত্যিই এঁদের মাঝে থেকেছেন, রাজনৈতিক প্রচার করেছেন, 'বলন্টিয়র' হয়ে শ্লোগান দিয়েছেন, জেলেও গেছেন। আবার কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ লোক হিসেবে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করার সুযোগ ছেড়ে, দল থেকে সরেও এসেছেন। তাঁর এই উপন্যাস আবার প্রান্তে বসে সেই রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জির অবলোকন-ও। উল্লেখ্য, একটা নিরুত্তাপ, Indifferent অবলোকন। বড় বড় ঘটনাবলী প্রান্তের মানুষজনদের জীবনে আর কতটা আঁচড় কাটতে পারে, কাটলেও তার ফলভোগ কেমন হয় তাদের জন্য, এইসব না চাইতেও দেখে যেতে হয়েছে মানুষের, ঢোঁড়াই-এর, পাঠকের।
এবং সব ঘটনাবলীর মাঝে বয়ে চলেছে যে ঢোঁড়াই, নিজের গল্পের ওপর সামান্যই তার ভাগ আছে। রাম চরিত মানসের রামের মতো নিজ হাতে ইতিহাস লেখার গল্প তা নয়। কেন লোকে বলে রামচরিতের ছায়ায় ঢোঁড়াই চরিত গড়ে উঠেছে, তা পাঠক হয়ে আমার বোধগম্য নয়। কিন্তু তবুও, ঢোঁড়াই-এর গল্প নাড়িয়ে গেছে শেষ অব্দি। কিছুতে যার সংযোগ ছিল না, তার সাথে অদ্ভুত এক সংযোগ বোধ করবেন পাঠক, শুরু থেকে শেষে।
ঢোঁড়াই চরিত মানস খুব দরকারি একটা বাংলা ক্ল্যাসিক। সম্ভবত সিলেবাসেও আছে এটা কোথাও। কবি প্রকাশনী'র বাংলাদেশি সংস্করণ বেশ ভালো মানের প্রডাকশনে বইটা এনেছে। তবে বাংলা ক্লাসিক পড়তে আগ্রহী যে কাউকে ঢোঁড়াই পড়তে বলতে পারছি না, তার কারণ, সবচে সহজভাবে যেমন ভাষার ব্যবহার ঘটেনি, তেমনি অনেক জায়গায় বাক্য সজ্জা-ও বেশ বিভ্রান্তিকর... কখন কার বক্তব্য এলো, কোনটা চরিত্রের সংলাপ আর কোনটা লেখকের, এসব অনেক জায়গায় গোলমেলে লাগতে পারে। এবং এই সব বিড়ম্বনা পেরিয়ে এলে, ঢোঁড়াই চরিত মানস হতে পারে প���ঠকের সারাজীবনে পড়া মনে রাখার মতো একটা উপন্যাস।
While this book is often described as a groundbreaking work in Bengali literature by academics and authors, Dhorai Charit Manas and Satinath Bhaduri are not household names in Bengal. The novel was not much of a success on its first publication.
That is perhaps not surprising, because unlike most of Bengali literature, this book is not written from a middle class/upper caste perspective. The main characters in the novel are Bihari villagers and the story is told in their voice. The protagonist Dhorai is a young male from the Tatma (weaver) community. We follow Dhorai's life story in the backdrop of the social and political upheaval of the Indian independence movement.
Dhorai Charit Manas is nothing if not ambitious, covering a range of themes from the political--caste, class, land, Gandhi, the independence movement--to the personal--growing up, love, loss and fatherhood. It succeeds beautifully in telling a story that is engrossing, poignant and hilarious in equal parts.
One of the themes is about the tension between the social/political changes and the existing (class/ caste/ gender) hierarchies. Bhaduri captures the interplay between existing hierarchies and the changing politics brilliantly. The novel's universe is a successful microcosm for India in the 40's. Quite a contrast with the sentimental and woolly headed political understanding of most of his contemporary Bengali novelists.
Bhaduri comes close to anticipating magic realism. The narrator of the book shares Dhorai's reality--. one where Ramayana is the ultimate source of wisdom, ghosts are commonplace, Ojhas have supernatural powers and a certain naked Sadhu has the power of breaking out of whatever jail the British put him in.
Dhorai Charit Manas is a beautiful novel. In its centering of the perspective of its subaltern protagonists, it feels surprisingly modern. The themes of social hierarchies still resonate.
ভাত খাওয়ার সময় আর একটু ডাল নিতে ইচ্ছে করলেও সে কোনদিন চায়নি, পাছে রামিয়ার কমে যায় এই ভেবে। রামিয়া জোর করে দিতে এলেও নেয়নি। এত ভালোবাসতো সে রামিয়াকে।
শুরু করার সময় অদ্ভুত ভাষা আর অচেনা সব চরিত্র দেখে ঘাবড়ে গেছিলাম। একটু পড়ে অনেকদিন ফেলে রাখছি। কয়েকদিন আগে জোর করে পড়া শুরু করলাম। ঢোঁড়াই (প্রধান চরিত্র) একটু বড় হয়ে উঠলো, পাক্কীতে কাজ করতে গেলো, আশেপাশের চরিত্র, মানচিত্রও ততো পরিচিত হয়ে উঠলো। অফিসের ফাঁকফোকরে ৪/৫ দিনে পড়ে ফেলেছি পুরোটা। ভালো একটা জার্নি ছিলো। আর মনে হচ্ছিলো এটা অনেক আন্ডাররেটেড একটা উপন্যাস। যতোটুক আলোচনা হওয়া দরকার, ততোটুক হয় নাই।
"রামচন্দ্রের অবতার মাহাতমা জি তাঁর কথার ওজন রামায়ণের কথার মতো"
পড়তে না জানা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, গরিব খেটে-খাওয়া মানুষ গুলোর গান্ধীর প্রতি যে কত ভক্তি শ্রদ্ধা ছিল, তা চিত্রায়িত হয়েছে একটা বড় অংশে। যে নাম নিয়ে মুক্তির স্বপ্ন দেখে, সেই নাম দিয়েই যদি শোষণ চলে, তাহলে দিন যায় কিন্তু গরিবের ভাগ্য পরিবর্তন হয় না।
রামিয়া, জমিন, মাহাতমা, দেশের প্রতি ভালোবাসার গল্প। দীর্ঘশ্বাস আর জীবন পরিবর্তন না হওয়া মানুষের গল্প।
সতীনাথ ভাদুড়ী জিরানিয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন মাত্র তিনটি ছোট বাক্যে, তাদের এত ক্ষমতা, যে ওতেই দৃশ্যপটের ইশারা, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট সমস্তটাই যেন উঠে আসে; অনুমান করে নিতে কষ্ট হয় না মহাকাব্যিক এ উপন্যাস কী অনিঃশেষ জাদু ধরে রেখেছে।
লোকটা জিরানিয়াকে লিখছেন এইভাবে, "তখনও যা ছিল, এখনও তাই। বালিয়াড়ির জমির উপর ছেঁড়া ছেঁড়া কুলের জঙ্গল। রেলগাড়ি ইস্টিশানে পৌঁছবার আগেই ঘুমন্ত যাত্রীদের তুলে দিয়ে লোকে বলে, 'জঙ্গল আ গেয়া, জিরানিয়া আ গেয়া।"
ঐটুকুতেই যেন ট্রেনে দূরে কোথাও যেতে যেতে দেখা হয়ে যায় রহস্যময় জনপদটিকে, যার উপরে মেঘের ছায়া সংক্ষিপ্ত আর বাতাস অনুকম্পায় মুখর, শিশুদের মুখে, নারীর উন্মুক্ত পিঠে আর পুরুষের হাতের রেখায় আঁকা ট্র্যাজেডির কুয়াশাচূর্ণ মানচিত্র।
আমার মনে হয় সমগ্র বাংলা ভাষার উপন্যাসের পরিমাপ হতে পারে একটা কালপর্বে। ঢোঁড়াই চরিত মানস সেই কালপর্ব। ঢোঁড়াইয়ের আগে আর পরে লেখা বাংলা উপন্যাস একই মাত্রায় দেখা সম্ভব নয়।
সতীনাথ ভাদুড়ির লেখা অবশেষে পড়লাম। এইটাই একটা বড় প্রাপ্তি। লেখার স্টাইল ভীষণ রকমের আলাদা৷ অনেক লেখার স্টাইল ভালো হয়, কাহিনী টানে না। আবার কাহিনী ভালো হয়, লেখা তেমন আলাদা কিছু হয়না। এটা দুই দিকেই পূর্ণ। ঢোঁড়াই এক অভূতপূর্ব চরিত্র। খুব প্রচ্ছন্নভাবে সে প্রকট। আঞ্চলিক শব্দের যথোপযুক্ত ব্যবহার ভালো লেগেছে।
আদি রামায়ণ মুনি বাল্মীকি লিখেছিলেন সংস্কৃতে। ষোড়শ শতকে প্রথম হিন্দিতে একে অনুলিখিত করেন কবি তুলসীদাস, তবে "রামচরিতমানস" নামে। হিন্দি ভাষায় এক অনন্য সাহিত্যকর্ম এটি, যা এর সাথে একদম প্রান্তিক মানুষের কাছেও পৌছে দিয়েছিল রামায়ণকে। এই বইয়েরই আদলে সতীনাথ ভাদুড়ি লিখেছেন "ঢোঁড়াই চরিত মানস", যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র ঢোঁড়াই, জীবনের পদে পদে রামচন্দ্রজীর কৃপা খুঁজে বেড়ায়।
রামায়ণের মতই এতে কাণ্ডে ভাগ করা। গল্পের পটভূমি জিরানিয়া, অযোধ্যার অদূরে। সেখানে থাকে তাৎমা আর ধাঙড়রা, দুই প্রান্তিক গোষ্ঠী। এমনই এক তাৎমা বালক ঢোঁড়াইয়ের জীবন কাহিনী নিয়ে চলেছে গল্প। ঢোঁড়াই গল্পের নায়ক হলেও তার জীবন দুঃখ আর বিষাদে পরিপূর্ণ। জীবনে যেখানে সে কাউকে ধরে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছে, জীবন তাকে ঠেলে নিয়ে গেছে অন্যত্র। কাজেই এ বইয়ের শেষটাও যে সুখী হবে না, সে বুঝাই যাচ্ছিল। তবুও সার্থক এক সমাপ্তি হয়েছে বইয়ের।
লেখকের লেখার হাত বাংলা সাহিত্যে অনন্য বটেই। বাংলার সাথে তিনি তাৎমা-ধাঙড়দের মুখের প্রচলিত হিন্দিকে মিশিয়ে লিখেছেন। এতে লেখা হয়েছে আরো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ঘেঁষা, বুঝতে সহজ করে দিয়েছে তাদের জীবনযাত্রা। প্রায় প্রতি পাতায় আছে ফুটনোট বিভিন্ন দুর্বোধ্য শব্দের/বাক্যের। কীভাবে জমিদার-নায়েবরা লোক ঠকায়, কীভাবে ভিন দেশে চলতে থাকা বিশ্বযুদ্ধগুলো অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রামের মানুষদের জীবনকে বদলে দেয়, এগুলোও উঠে এসেছে লেখার মধ্যে দিয়ে। তবে উনার লেখার সিগনেচার দিক হল ন্যারেশনে প্রথম পুরুষ-উত্তম পুরুষ মিশে যাওয়া। একটা প্যারা প্রথম পুরুষে শুরু করলেও হঠাৎ উত্তম পুরুষে বদলে যায়। আবার দুটি চরিত্রের মাঝে অগুরুত্বপূর্ণ সংলাপেও পরিণত হয়। এরকম লেখনী আগে দেখিনি। কিছু ক্ষেত্রে কে বলছে তা ধরতে কষ্ট হলেও, এটা গল্পকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে কোনো সন্দেহ নাই। দুঃখ হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের এমন ভিন্নধর্মী এক লেখককে এতদিন পরে কেন খুঁজে পেলাম।
কারও এই বই পড়তে ইচ্ছা করলে তাকে বলব ঐতিহ্যের ভার্সন অবশ্যই এড়িয়ে যেতে। দুর্বল সম্পাদনা, দুর্বল বাইন্ডিং, ভূমিকার অনুপস্থিতি, অতিরিক্ত দাম এসব কারণে বইয়ের মান গেছে অনেক কমে।
এই বইটি সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বলেছিলেন, “বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নোবেল অর্জনের মতো বই 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' ছিলো।”
ঢোঁড়াই'র জীবনের ভাঙা-গড়ার খেলা। জন্মের কিছুদিনেই বাবাকে হারানো। মা নিজের পথ দেখে চলে যায়। বওকা বাওয়া নিজের সন্তানের চেয়ে আপন করে নেয়। সেই বাওয়ার বদৌলতে জীবনে আসে সুখ, হয় সংসার। সংসার ত্যাগী বাওয়া ঢোঁড়াইয়ের সাথে অদৃশ্য দূরত্ব অনুভব করে অন্তর্ধান হয়। টিকেনি সংসার। গড়ার পর ভাঙা সেও ক্ষোভে তৎমাটুলিকে বিদায় দেয়। নতুন গ্রামে নতুন ঢোঁড়াই। গল্পের স্রোত এগিয়ে চলে। ভয়ঙ্কর ভুমিকম্প, বিশ্বযুদ্ধ সব কিছুর আড়ালে ছিলো, ঢোঁড়াই'র বাবার ইচ্ছা। ছেলে একদিন তল্লাটের রামায়ন পাঠকারী হবে। সেটা ঢোঁড়াই না জেনেও মন থেকে শিক্ষার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করে। বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর সে আশা পূরণ হয়। কোনো এক ঘটনার মধ্যদিয়ে অনেক আশায় আবার গ্রামে প্রত্যাবর্তন করে আরও বিধ্বস্ত হয় সে।
উপন্যাসের নায়ক 'ঢোঁড়াই' এর মতে যা বদলায় না তা হলো - পাক্কী আর রামায়ণ। কিন্তু সময় বদলায়। সেই সময়ের কারণেই বাল্যকাল থেকে মনের গহীণে লালিত রামচন্দ্রজীর জীবনী টি শেষকালে এসে পথিমধ্যে ফেলে গেল সে। পাক্কীর পথ মুহূর্তেই সকল আগ্রহ হারিয়ে হলো রিক্ত। এই 'ঢোঁড়াই চরিত মানস'।
রাম চরিত মানস অর্থাৎ রামায়ণ থেকে নেয়া নাম সম্বলিত বইটি পড়তে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। ইংরেজ শাসনামলে মহাত্মা গান্ধীর উত্থান, সত্যাগ্রহ, ক্রান্তিকাল বইয়ের বেশ কিছু অংশ জুড়ে ছিল। যার মধ্যে সতীনাথ ভাদুড়ী নিজের তৈরী ঢোঁড়া সাপটাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ধর্মভীরু, ন্যায়পরায়ণ এবং ভালোবাসা বিবর্জিত ঢোঁড়াই বিষদাঁত ছাড়া ছোবল দিতে জানে। সময়কালের প্রেক্ষাপটে বইয়ে প্রচুর আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যার কারণে পাদটীকা পড়ে এগুতে সময় লাগবে পাঠকের। একটি শ্রেণীভিত্তিক সমাজব্যবস্থার উপাখ্যান যাতে রাজনীতির ছোঁয়া পেয়েছে। কিছু জিনিস খুব অদ্ভুত। যেমন: ঢোঁড়াই এর ছোট থেকে বড় হওয়া এবং একটি জীবিকা থেকে আরেকটি জীবিকা ক্ষেত্রে প্রবেশ যেভাবে তার পারিপার্শ্বিকতা ও রাজনৈতিক পরিবেশকে পরিবর্তন করেছে, পরিবর্তন করেছে তার মতাদর্শকে। এখানেই শ্রেনীবিভাগের মূলরেখাপাত করে ফেলেছেন লেখক। তার স্বার্থকতা সেখানেই। তুলসীদাসের রচনা রামচরিত মানস এর প্রতি তীব্র আগ্রহ নিন্মবর্গীয়দের মাঝে ধর্মভীরুতার চিহ্ন যে বহন করে তা লেখক খুব ভালোভাবে তুলে ধরেছেন। ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে মানু্ষের পরিবেশকে বদলে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রকল্পকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে স্যোশ্যালিস্ট উপন্যাসের গঠনকে সচেতনভাবেই বাদ দিয়ে রামায়ণের গঠনের কাছে ফিরে যাওয়া একজন ইতিহাস সচেতন ঔপন্যাসিকের বিস্তৃত চিন্তাধারারই বহিঃপ্রকাশ।
“পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি”
ঢোঁড়াই এই পথকেই জীবন সঙ্গী করে নেয়া চরিত্র। বিহারের তাৎমাটুলির পথ থেকে ঢোঁড়াইয়ের শেকড় ছাড়িয়েছে বিসকান্দা পর্যন্ত। ঢোঁড়াই জীবনের পথিক, সংগ্রামের পথিক। তা বলেই হয়তো, সতীনাথ ভাদুড়ী তার সর্বশ্র দিয়ে সাজিয়েছেন ঢোঁড়াইকে। ক্রমে ক্রমে ঢোঁড়াইকে করে তুলেছেন স্বাধীন ভারতের প্রত্যাশার পথিক। ঢোঁড়াই এর মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ রিপ্রেজেন্ট করে প্রতিটি স্বাধীনতাকামীর আকাঙ্খাকে। স্বাধীনতার অর্থ না জানলেও স্বাধীনতাকে অনুভব করা যায়। সমাজ সংস্কার, সাম্রাজ্যবাদের থাবা, হায়নাদের শোষণকে ঢোঁড়াইয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। তুলসীদাসকে মূল রামায়ণ মহাকাব্যের রচয়িতা বাল্মীকির অবতার মনে করা হত। তার ‘রামচরিতমানস’ এর সরলীকরণ আর আদর্শসৃষ্টরূপ যেন সতীনাথের ‘ঢোঁড়াই’।
তাৎমারা পরিশ্রম আর সংগ্রামী জাতি। এখানে আবেগ এর চেয়ে জোর, শক্তির গুরুত্ব বেশি। তারপরও মানুষের ভেঙে পড়া, হারিয়ে ফেলার মতো অনুভূতিগুলো সার্বজনীন। “ফুলঝরিয়া সকলের কথাতেই তার অঙ্গহীনতার প্রতি ইঙ্গিতের আভাস পায়। তার মা সুদ্ধ তাকে ছেড়ে কথা বলে না। তার চোখের পাতা ভিজে ওঠে। কিন্তু এই জলকাদা হিম কুয়াশার দেশে, কারও চোখের পাতা ভিজল কিনা, তা দেখবার সময় নেই তাৎমাদের।”
‘রামিয়া’ ও ‘সাগিয়া’- দুই নারীর উপস্থিতি ভিন্ন সময়ে ঢোঁড়াই এর জীবনে আবির্ভাব করে ভিন্নভাবে আবিষ্কার করায় ।
জাত অহংকার আর আভিজাত্য নিয়ে পরজাতির সাথে লড়া যায়না। নিজ দেশের ক্রান্তিকালে সাবাইকে এক হয়ে উঠতে হয়। এই আদর্শ সকল সময়-দেশ-কালের জন্যই। “তাৎমা-ধাঙড় সকলেই একসঙ্গে হেসে ওঠে। এই বিয়ের হিড়িকে ধাঙড় তাৎমারা, দুই টোলার ইতিহাসে, এই প্রথমবার যেন একটু কাছে আসে। এই দুর্দিনের রোজগারের অসুবিধে, তহশীলদার সাহেবের বেইমানি, আরও অনেক জিনিস হয়তো এর মধ্যে আছে, কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের বিয়েকে উপলক্ষ করেই সম্ভব হয়েছে।”
আদি কান্ড, সাগিয়া কান্ড, এবং হতাশা কান্ড এই তিনভাগে ঢোঁড়াই এক অজানা সময়কে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে আনে।
একটা সময় হারতে হয়। নিজের মানুষ, নিজের গোত্রের সাথে লড়াই করে অধিকার আদায় করে নেওয়া যায় কিন্তু বেঁচে থাকা যায় কি! নিজের ভালোবাসার মানুষ শক্তির জোড়ে কখনো আগলে রাখা যায়না বলে হয়তো ঢোঁড়াই প্রথমবারের মতো পথে নেমেছিল। অথচ রামিয়ার জন্য ঢোঁড়াই স্থিরতার স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল। “কিন্তু রামজীর সঙ্গে লড়াই করা চলে না। তাই সে হার মেনেছে তাৎমাটুলির সমাজের কাছে, পরাজয় স্বীকার করেছে সামুয়রের কাছে।”
তাৎমাটুলির বাইরের জীবনে এত মুশকিলও থাকতে পারে তা ঢোঁড়াই আগে কল্পনাও করতে পারেনি। মিথ্যার আচঁলে মিথ্যা লুকিয়ে থাকে। জীবনকে ভিন্নরূপে দেখার সুযোগ কিংবা নিয়তি এই পথই তৈরি করে দেয়।
“তবে না ওগুলো মারকুটে হবে; গোপাষ্টমীর দিন শুয়ারের পেট ফুঁড়বে শিং দিয়ে পঁতিয়ে। রাজপুতের ছেলের এই তো চাই! এ নাতিটা তাঁর গুণ পেয়েছে, বাপ-কাকার মতো নয়। তাই এটাকে তিনি এত ভালোবাসেন। একে তিনি নিজের মনের মতো করে তৈরি করে যাবেন। এর মধ্যে মধ্যে গেঁথে দিয়ে যাবেন, দুনিয়াদারির অ আ ক খ । বাড়িয়ে যাও হাত যত দূর পৌঁছায়, এই লাঠিসমেত হাত। হাত গুটিয়ে বসে থেকো না কখনও।”
“যা দিনকাল! কেউ আর তা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কেবল খবর রাখত গঞ্জের বাজারের লোকেরা। মুলুক জুড়ে ‘আমনসভা’ হচ্ছে থানায় থানায়। দারোগাসাহেব ভিতরে ভিতরে ঠিক করেছে, এ থানার আমনসভায় সভাপতি করবে রাজপারভাঙার সার্কেল ম্যানেজারকে। তারই মিটিন হবে। থানা আমনসভার নিচে পরে হবে গ্রাম আমনসভা।”
“সত্যিই ‘পাক্কীর’ সঙ্গে তার নাড়ী বাঁধা। লাঙলের ফালের দাগ যেন ‘পাক্কী’, আর তার দু'পাশের গাছের সার, হলরেখার দু-ধারের উঁচু মাটি। জীবন কেটেছে ওই গাছের আওতায়, গোঁসাই-থানে, শীতের হিমে, বর্ষার জলে, গ্রীষ্মের লু-বাতাসে। পাক্কীর ধারের মাটি-কাটার গর্তগুলো দেখলেই তার মনের মধ্যে ভিড় করে আসে, শনিচরা, বুদ্ধ ঠিকেদারসাহেব, ওরসিয়রবাবু, আরও কত কে। সবাই তারা ছিল ভাল লোক। সেখানকার সেই ছেলেটা আর তার মা, আর এখানে সাগিয়া, এই দুইয়ের সংযোগের সূত্র পাক্কী। তাই না তার মন ওখান থেকে ছুটে এখানে আসে।” এই পর্যায়ে এসে বলাই যায় গল্পের নায়ক পাক্কী।
স্বদেশী আন্দোলনে ভলেন্টিয়া থেকে জায়গা পায় বিপ্লবী দলে, তখন নাম হয় রামায়ণজী। ভাদুড়ী ঢোঁড়াই চরিত্রকে যতভাবে মসৃণ করা যায় করে গিয়েছেন। সম্মান দিয়েও দেখিয়েছেন একজন মানুষের মনস্ত্রান্তের অবস্থা, আবার কঠিনতম অবস্থায় পেলেও দেখিয়েছেন সয়ে যাওয়ার আকার। বিজয়ী আর বিজিত ঢোঁড়াই পক্ষান্তরে আমাদের জীবনের গতিময় কালগুলো ভাবসম্প্রসারণ।
“ঢোঁড়াইরা ঢোঁড়া সাপের জাত। যতই খাবলাক, ছোবল মারুক, তড়পাক, এক মরলে যদি ওদের বিষদাঁত গজায়”
প্রায় ৬ (ছয়) মাস আগে শুরু করেছিলাম। এতদিন অল্প অল্প করে পড়ে শেষ করলাম। এ রত্ন কেন যে নোবেল কমিটির নজরে যায় না। :/ হলে হয়তো বাংলা সাহিত্যে নোবেল লরিয়েটের সংখ্যা আরও একজন বাড়ত অন্তত।
নির্মোহ লেখা খুব কম লেখকই লিখতে পারেন, আর যিনি তা পারেন সে লেখার তুলনা হয় না। লেখক সতীনাথ ভাদুড়ির সৃষ্টি ঢোঁড়াই চরিত্রের মাঝে লেখককে কোথাও খুজে পাওয়া যায় না, কি স্বচ্ছ ভাবে নিজের প্রতিচ্ছায়া কে দূরে রেখে তৈরি করেছেন কেন্দ্রীয় চরিত্র ঢোঁড়াইকে।
ঢোঁড়াই বেড়ে ওঠে তাৎমাটুলিতে রামচরিত মানসের রামচন্দ্রের আদলে, মা বাব ছাড়া পালক পিতা বাওয়ার কাছে। রামায়ণ আর গ্রামের রাস্তা পাক্কী এই দুটি জিনিসকে সে অবিনশ্বর বলে জেনেছে।
জন্ম থেকে অবহেলা অনাদরে ভিক্ষা করে বেড়ে ওঠা ঢোঁড়াই শুধু বাওয়ার স্নেহ ভালবাসা কে নিজের ও খাঁটি বলে পেয়ে এসেছে। একটা সময় সে বাওয়ার পিতৃ স্নেহের বন্ধনের সাথে সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ধীরে সব পাল্টাতে থাকে - সময়, রীতি- নিয়ম। দোষ যারই থাক পাল্টে যায় পালক পিতা বাওয়া, অনেক ভালোবাসার স্ত্রী রামিয়া।
সময় পাল্টে অনেকটা দূরে এসে সে নিজেকে পাল্টাতে গিয়ে বিহারের সেই ভূমিকম্প, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সত্যগ্রহ আন্দোলন-- এসবের নায়ক হয়ে ওঠে, অতীত ভূলতে গিয়ে মিশে যায় ঘটনার সাথে কিন্তু অতীত তাকে পিছু ছাড়ে না।
আমার কেন জানি মনে হয় বিখ্যাত বইগুলো একটু কঠিন হয়, আমার কাছে কঠিন লাগে। লেখক সতীনাথ ভাদুড়ির " ঢোঁড়াই চরিত মানস " অসাধারণ এক উপন্যাস তাতে কোন সন্দেহ নাই, ভাষা একটু শক্ত এই যা। বাংলা সাহিত্যের এমন একটা বই যা না পড়াটা অন্যায়। কিছু বই যে উপায়ে পড়া হোক না কেন সংগ্রহে রাখাটা জরুরি, এ বইটাও তেমনই একটা বই।
লেখকের এক অসামান্য সৃষ্টি, যেখানে আমরা লেখককে খুঁজেই পাই না। কোনো judgement নেই, কোনো commentary নেই, আছে শুধু অপূর্ব চরিত্র চিত্রণ আর সেই চরিত্রদের সাহায্যে এক যুগ ও প্রধানত sub-altern সমাজকে ফিরে দেখা।
কুর্মি, কোয়েরি, ভূমিহার, রাজপুত, তন্ত্রী, কুশওয়াহা, যাদব, হরিজন ... নামগুলো এখনও বড় চেনা আর তাদের সমীকরণ এখনও বড়ই জটিল।
দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়া বই, সময় নিয়েছিলাম হাতে হাবিজাবি কাজের ফাকে সময় ছিলো না বলেই, সচেতন এবং দ্রুতগামী পাঠকের জন্য দুই তিন বৈঠকের বই হয়তোবা। কিন্তু প্রচুর থামতে হয় টিকা ভাষ্যের কারণে। নিয়ত করে উপন্যাস পড়তে বসলে কথার অর্থ খোজপে পাতার নিচে তাকাতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু যেহেতু লেখক ব্যবহার করেছেন একটা প্রান্তিক শ্রেনীর ভাষা এবং সেই সাথে এসেছে পুরোটাই রামায়ন কেন্দ্রিক কথা তাই কথাগুলর অর্থ তোলে দেওয়া হয়তো দরকার ছিলো। আদতে এই উপন্যাস কাউকে টেনে নিয়ে যেতে হবে জোর করে, একেবারে শেষের দিকে এসে যে ভাল লাগাটুকু পাবে সেই আশায় ২৬৫ পাতাই তাকে পড়তে হবে। হয়তো সামগ্রিক ভাবে লেখক নামকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন, নতুবা পুরোটা উপন্যাস শুধু এই নামকেন্দ্রিক চরিত্রের বাইরে একটু সময়ের জন্য আর কোন চরিত্রকে তোলে ধরেছি। ঢোরাই এর জীবনে আসে নারীগণ খুব তুচ্ছ্যতাচ্ছিল্যের শিকার লেখকের কলমে, এতো দ্রুত গতিতে এদের নিষ্কৃত করেছেন লেখক তার লেখা থেকে ভাবলে অবাক লাগে। একটা চরিত্র তিলে তিলে গড়ে তোলে হুট করে বিদায়! হয়তো এভাবেই যায় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক! হয়তো এই আমাদের জীবনচরিত!
স্টাইল্টা আরেকটু শুধু ভাল হইতে পারত হয়ত, জাস্ট আরেকটু কম জাম্পি হইতে পারত। আর ছাড়া একদম পারফেক্ট। ঢোঁরাই, ও ঢোঁরাই, তোমাকে আমি চিনসি, জানসি, তোমার জন্য আমার পরান কাঁদে, কিন্তু তোমার ভাগ্যে এ ছাড়া আর কিই বা ছিল, পৃথিবী ঢোঁরাইদের ভাগ্যে এ ছাড়া আর কিসু রাখে নাই। আমি বুধনী কেও চিন্সি, বাবুলাল চাপরাশিকেও, রতিয়া ছড়িদারকেও, রবিয়া আর তার বৌ, মহতো আর তার গিন্নীকে, সামুয়র বদমাশটাকেও, বাবুসাহেব কে, বলন্টিয়রকে আর লাডলিবাবুকে খুব ভাল করে চিনে গেসি, ভোপতলালকে একটু কম, আর চিন্সি রামিয়াকে, মোসম্মত আর সাগিয়াকে। সতীনাথ ভাদুড়ী সত্য জেনেছে, সতীনাথ ভাদুড়ী সত্য জানায়।
গল্পটির কাঠামোগত দিক থেকে তুলসী দাসের 'রামচরিত মানস' এর বিশেষ অনুকরণ। সে হিসেবে এটিও একটি এপিক উপন্যাস তো বটেই, দারুণভাবে গল্পটির যবনিকাপাত হয়েছে যেন মনে হয় ঢোঁরাইই তো রাম আর রামিয়াই তো সীতা।
দশ পাতা পড়েই মনে হয়েছিলো, এই লেখা বেশ অন্যরকম, অন্য স্বাদের, আসলেই তাই। লেখার ধরন আমার কাছে মন্দ লাগেনি। বইটির আরেকটি দিক যেটা বিশেষ ভাবে ভালো লেগেছে তা হল, টীকা। প্রতিটা পাতায় টীকা দেয়া হয়েছে। আমি জানিনা টীকা না থাকলে বিহারের ওই আঞ্চলিক কথাগুলো কত খানি বুঝতাম। 'গানহী বাওয়া' যে মহাত্মা গান্ধী তাই তো প্রথমে বুঝি নাই!
ঢোঁড়াই , একটা সময়ের প্রতিনিধি । একটি সময়ের দলিল । যে ইতিহাস আমরা বইে পড়িনা, যে ইতিহাস কালচক্রে হারিয়ে যায়। এ কাহিনী আবার শাশ্বত বটে, আমাদের চিরন্তন নিয়তির সাথে লুকোচুরি খেলা। অসাধারন লেখা।
Ordinary but so grasping. This book broke me three times & still lured me to kept falling in love... .. Why our dearest persons end up with things that we've never imagined into. .. Again & again
উপন্যাসের প্রেক্ষাপট পটভূমি ব্রিটিশ শাসনের শেষকালে বিহারের ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের অনাথ ছেলে ঢোঁড়াই। ঢোঁড়াইয়ের চোখ দিয়ে সে স্থান-কালের সামাজিক বাস্তবতাকে দেখা। বারবার এসেছে তুলসীদাসের রামচরিতমানস প্রসঙ্গ, ঢোঁড়াই চরিত মানসের সমান্তরালে। ডায়লগ বা মনোলগে প্রচুর বিহারী/আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কাহিনীতে ডুব দিতে কাজে দিয়েছে অনেক। অবশ্য এসব অপরিচিত শব্দ/বাগধারা বুঝিয়ে দিতে প্রচুর ফুটনোট আছে, আরও অনেক যোগ করা যেতো।
পুরো লেখনিতে লেখক নিজে যেন অনুপস্থিত। ঢোঁড়াই ও তার আশেপাশের মানুষজনের কথাবার্তা চিন্তাভাবনায় লেখক নিজের ��োনো মতাদর্শ বা কমেন্টারি চাপিয়ে দেননি, সবাই ভেবে, বলে গেছে তাদের মতোই। তাই তাৎমাটুলি বা ধাঙরটুলির মানুষ কিভাবে নিজেদের দেখে, অন্যান্যদেরকেই বা কীভাবে দেখে, শহর বা বৃহত্তর ভারতের সাথে তাদের যে সামান্য সংযোগ, পাঠককে সব ঘটনা দেখতে হয় এই চরিত্রদের চোখ দিয়েই। সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত কোণের মানুষের চোখে জীবনকে, ইতিহাসকে দেখার এই অভিজ্ঞতার জন্যই উপন্যাসটাকে পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে রাখবো।
ঢোঁড়াইয়ের জন্ম, মায়ের অন্যত্র বিবাহ, ঢোঁড়াইয়ের বড় হওয়া, বিবাহ, বিচ্ছেদ, গ্রামত্যাগ, সব ছাড়িয়ে পরবর্তীতে বিহারের ভূমিকম্প কিংবা মহাত্মা গান্ধীর আন্দোলন, গণভোট, সবই দেখি ঢোঁড়াইয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে। একই সাথে ঢোঁড়াইও গড়ে উঠতে থাকে আমাদের সামনেই। তাৎমাটুলির ছোট্ট ঢোঁড়াই এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই পাক্কীতে হেঁটে চলে আসে বিসকান্ধায়, নতুন করে জীবন শুরু করতে। রামায়ণ পড়তে না জানা ঢোঁড়াই হয়ে ওঠে রামায়ণজী।
উপন্যাসের শেষ দিকে ঢোঁড়াই যেন আমাদের বর্তমানে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। পরিবর্তন আনতে এসে নিজেদের মধ্যেই পরিবর্তন দেখে হতাশা, নিজেকেই যেন দূরে ঠেলে দেওয়া।
"তার মনের মধ্যে দলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো জড় হয়েছে, তার সঙ্গে এটাকে সে গেঁথে রেখে দিয়েছে। সব ভাল-না-লাগাগুলো জমে জমে দানা বেঁধে অভিযোগ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেখানে। প্রথম প্রথম যেমন দলটাকে আপন মনে হতো, এখন আর তা হয় না। তা না হলে যে নিজের কাছেই নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে হতো।"
শেষে এসে ঢোঁড়াই চরিত মানস অদ্ভুতভাবে মিলে যায় রামচরিতমানসের সাথে। ঢোঁড়াই নামের রাম হতাশ হয়, ফিরে যায় নিজেকে সঁপে দিতে।
সতীনাথ ভাদুড়ী নিজেই নাকি এই চরিত্রনির্মাণ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবে আমাকে মুগ্ধ করতে ব্যর্থ হননি তিনি।
বাংলা ভাষায় লেখা বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
তাৎমাটুলি অদ্ভূত এক জগৎ। যেখানে মুন্ডুকাটা সৈন্যের দল কোশী-শিলিগুড়ি রোড ধরে হেঁটে যায়; তাদের কাটা গলায় জ্বলে প্রদীপ, পানির ভূত ছপছপ করে পুকুরের উপর হাঁটে, শাকচুন্নীরা হাত নেড়ে পুরুষমানুষকে ডাকে, প্রত্যাখ্যাত হলে গাছে উঠে যায়৷ এলাকার নিরক্ষর মানুষগুলি রাম এবং রামায়ণকে আদর্শ বলে মনে করে, যারা রামায়ণ পড়তে পারে এদের কাছে তারা মহাজ্ঞানী। পাক্কী অর্থাৎ পাকা রাস্তাটি কোশী থেকে শিলিগুড়ি অবধি গিয়েছে সেখানেই এদের দুনিয়া শেষ। জাতপাতদীর্ণ মানুষগুলি প্রতিবেশী এলাকার ধাঙরদের নীচু চোখে দেখে, মুসলমানকে পেঁয়াজখোর-গরুখোর বলে দূরে সরিয়ে রাখে এদিকে আবার মহরমের জৌলুসে অংশ নিতে ভোলে না৷ এরা রাজনৈতিক ভাবে অসচেতন। মূর্খ মানুষগুলিকে সতীনাথ ভাদুড়ী এমন যত্নে এঁকেছেন, তাদের হাসি কান্না, আনন্দ অভিযোগগুলি নিজের বলে মনে হয়। সতীনাথ ভাদুড়ী হলেন বিরলের মধ্যে বিরলতম সেই সাহিত্যিক, যিনি সরলভাবে এমন জটিল চরিত্রসৃষ্টি করতে পারেন।
রামায়ণ অবলম্বনে হলেও উপন্যাসটি রামায়ণকে অনুকরণ করেনি। এই রামায়ণের দশরথ হলেন ভিক্ষুক, শূর্পনখা পঙ্গু, সে রামকে ভালোবেসেছিলো, রামের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার পর হাউহাউ করে কাঁদে আর নিজের অদৃষ্টকে দোষ দেয়৷ রাবণ আর সীতা অনেকভাবে আসে রামের জীবনে৷ রাজনীতির শিকার হয়ে রাম ভিটেমাটি ত্যাগ করে, যেখানে যায় সেখানের বঞ্চিত মানুষের কন্ঠ হয়ে ওঠে, জমিদারের বিরুদ্ধে লড়াই করার। মানুষগুলি রাজনৈতিক সচেতন হয় এবং বুঝতে পারে সাধারণ ছোটোখাটো যে সব লড়াই তারা করে আসছিলো সেটাই সব নয়, তার থেকেও বড়ো লড়াই 'রংরেজ'দের বিরুদ্ধে যা মহাত্মাজী লড়ছেন। তারা জানতে পারে তাদের পাক্কী শিলিগুড়ি ছাড়িয়েও আরো অনেকদূর পর্যন্ত গেছে। অথচ রাম এইসব থেকে অনেক দূরে চলে যায়, সবসময়ের সঙ্গী তুলসীদাস রামায়ণটিকে ছেড়ে। দুই চরণের উপন্যাসটি একটি মাস্টারপিস এবং এমন ঘটনাবহুল ঠাসবুনোটের উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কিছু বিদেশী ভাষার উপন্যাসগুলির মধ্যেই দেখা যায়।
ইউটিউবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের একটা সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে রবীন্দ্রনাথের এক অন্ধ ভক্তকে যা-তা অবস্থা করে ছেড়েছিলেন। তখন তিনি এই উপন্যাসের নাম করে বলেছিলেন যে “এরকম একটা বই যেকোন ভাষার জন্য দূর্লভ একটা রচনা”
ঢোঁড়াই চরিত মানস শুধু একটা উপন্যাসই নয়। এটা একটা রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক নিরীক্ষা। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ঢোঁড়াইয়ের উত্থান পতনের সঙ্গে ফুঁটে উঠে তখনকার নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে উচ্চ বর্গের মানুষের প্রতারণার চিত্র। কিভাবে বাবুসাহেবরা জমি দখল করে। কিভাবে টোলার মানুষকে বোকা বানিয়ে আঙ্গুলের ছাপ নেয়ার মাধ্যমে তাদের উচ্ছেদ ঘটায়।
এজন্যই মাস্টার সাহেবের বেটা যখন মরনাধারের কাছে বলে যে ইংরেজ সরকার নাকি তাৎমাদের পূর্ব পুরুষের বুড়ো আঙ্গুল কেটে নিয়েছিল তাই তাৎমাদের উপার্জন নেই। তখন যে উত্তরটা দেয় তা হলো, “দেখ কান্ডখানা একবার! তবে একটা সুবধে বুড়ো আঙ্গুল না থাকলে কেউ আর জোর করে সাদা আঙ্গুলে ছাপ দিতে পারবে না; না অনিরুদ্ধ মোক্তার , না সাওজী, না জমিদারবাবু।”
সম্পূর্ণ উপন্যাসটা পড়তে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। বিহারের জিরানিয়া জেলার তাৎমাটুলি, ধাঙড়টুলি, সাওতাল পাড়ার মানুষদের ভাষাকে কেন্দ্র করে লেখা এই উপন্যাসের প্রতি পৃষ্ঠায় নতুন নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচয় হতে গিয়ে পড়ার গতিতে একট স্থিরতা আসে। ফলে এক বসায়, এক ধ্যানে উপন্যাসটি শেষ করা যায়না। তবে চিন্তা করার পরিধিটা তখন বাড়ে। একটা গরীব মানুষ ঠকে যাচ্ছে এটা দেখেও যেমন আমরা নির্মোহভাবে বিবেকের বাঁধাকে উৎরে যাই চলার পথে। তেমনি এই উপন্যাসেও লেখক উৎরে গেছেন তার মোহকে। একদম নির্মোহ ভাবে লিখে গেছেন। প্রতিটা চরিত্রকে ছেড়ে দিয়েছেন বাস্তবতার নিরীখে।
তখনকার সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা এই উপন্যাসের অন্যতম একটা উপজীব্য বিষয়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে মহাত্মাজীর আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফৌজদের ক্যাম্পে জোর করে নাম লেখানো। সব কিছুই ফুঁটে ওঠে এই উপন্যাসে। এটাকে উপন্যাসের থেকেও একটা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরীক্ষা হিসেবে পড়া উচিত।
গল্পটির কাঠামোগত দিক থেকে তুলসী দাসের 'রামচরিত মানস' এর বিশেষ অনুকরণ। সে হিসেবে এটিও একটি এপিক উপন্যাস তো বটেই, দারুণভাবে গল্পটির যবনিকাপাত হয়েছে যেন মনে হয় ঢোঁরাইই তো রাম আর রামিয়াই তো সীতা।
দশ পাতা পড়েই মনে হয়েছিলো, এই লেখা বেশ অন্যরকম, অন্য স্বাদের, আসলেই তাই। লেখার ধরন আমার কাছে মন্দ লাগেনি। বইটির আরেকটি দিক যেটা বিশেষ ভাবে ভালো লেগেছে তা হল, টীকা। প্রতিটা পাতায় টীকা দেয়া হয়েছে। আমি জানিনা টীকা না থাকলে বিহারের ওই আঞ্চলিক কথাগুলো কত খানি বুঝতাম। 'গানহী বাওয়া' যে মহাত্মা গান্ধী তাই তো প���রথমে বুঝি নাই!
সতীনাথ ভাদুড়ীর 'ধোরাই চরিত মানস' শুধুমাত্র একটি উপন্যাস নয়, এটি হলো ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অকথিত কাহিনি—যা কোনো শিক্ষিত অভিজাতের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং এক প্রান্তিক, নিম্নবর্ণের কৃষক ধোরাইয়ের চোখ দিয়ে দেখা। এটি লেখকের একটি অনবদ্য সৃষ্টি যা আমাদের দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অনুচ্চারিত দিকটি তুলে ধরেছে।