‘অতীত একটা ভিনদেশ’ বইটি এক্সিম ব্যাংক অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ পুরস্কারে ভূষিত হয়। গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্পের মধ্যেই এক ধরনের জাদু আছে। কী রকম জাদু! জাদুটা হলো, পাঠক যখন গল্পগুলো পড়ছেন তিনি তখন যুগপৎভাবে এক ধরনের বিস্ময় ও ঘোরের মধ্যে পতিত হবেন।
গল্পের চরিত্ররা অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতে ঘুরে বেড়ায় অনায়াসে। এমনকি মৃতরাও ফিরে আসে কিংবা জীবিতরা চলে যায় মৃতের জগতে। পাঠক প্রায়শই ধন্দে পড়ে যাবেন, ঘোরের মধ্যে জীবিত-মৃতের বা অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের মাঝে হারিয়ে ফেলবেন নিজেকে।
নন্দিত লেখক হারুকি মুরাকামির মতো এই বইয়ের লেখক মোজাফফর হোসেনও বিশ্বাস করেন, আমরা সবসময় একটা বানোয়াট বা আরোপিত পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছি। ফলে লেখকের গল্পেও তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বইয়ের আঠারোটি গল্পে লেখক মুন্সিয়ানার সঙ্গে নানারকম, নানা পদের জীবনের বাঁক বদলের কথা লিখেছেন যা পাঠ করলে পাঠকের মধ্যেও তৈরি করবে আরেক ভিন্ন জগৎ– বইয়ের গল্পগুলোর বড় বৈশিষ্ট্য এটিই।
কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মোজাফ্ফর হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমির অনুবাদ উপবিভাগে কর্মরত। প্রধানত ছোটগল্পকার। পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। অতীত একটা ভিনদেশ গল্পগ্রন্থের জন্য তিনি এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্য পুরস্কার এবং স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষেরা গল্পগ্রন্থের জন্য আবুল হাসান সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়াও ছোটগল্পের জন্য তিনি অরণি সাহিত্য পুরস্কার ও বৈশাখি টেলিভিশন পুরস্কারে ভূষিত হন।
অতীত একটা ভিনদেশ এত সুন্দর বইয়ের গুডরিডস রেটিং এত কম!!! প্রায় প্রতিটি গল্পই জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়েলিজম নিয়ে লেখা। গল্পের ধাচ সাধারণ নয়, অনেকটা নিরীক্ষাধর্মী। প্লট ও সুন্দর। পড়তে ভালো লেগেছে। এর আগে লেখকের 'মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ ' পড়েছিলাম। দুইবইয়ের তুলনা করলে সাহিত্যগুনে এই বইটি অনেক উপরে।
সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কখনো সাম্প্রতিকতা মিশিয়ে এক সুখাদ্য মিক্সড ফ্রুট সালাদ ঘরানার বই এটা। এর আগে মোজাফফর হোসেনের যেই বই পড়েছি, মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ; সেখানে সমাজের স্থুল নির্মমতার কথা কোল্ড-ডার্ক এনভায়রনমেন্টে পরিবেশন করেছেন লেখক৷ ভালো গল্প পাঠককে শুনিয়েছেন নির্দয়ভাবে। রেস্তোরাঁ হিসেব করলে কোনো ফুড ভ্লগার হয়তো রেটিং দিতেন এভাবে:
খাবার: ৮/১০ সার্ভিস: ২/১০ পরিবেশ: ২.৫/১০
বিষয়বস্তু হিসেব করলে খানিকটা মিল রয়েছে বটে, তবে এখানের পরিবেশন অনেক সফট, যত্নের সাথে পাঠককে শুনিয়েছেন গল্প। আগের বইটা ডার্ক, এই বইটা মেলানকোলিক। বিষন্নতার চাদরে আচ্ছাদিত শীতকাল। ফুড ভ্লগার রেটিং দিতেন এভাবে:
ছোট গল্প সংকলন, মোট ১৪টা ছোটগল্প। এতগুলো গল্প যে বইয়ে আছে, সে বইয়ের সব গল্প আমার ভালো লেগেছে, এমন বই অদ্যাবধি পড়িনি। এটাও তার ব্যতিক্রম না। বরং বলা যায় বেশিরভাগ গল্প স্রেফ প্লট বিচার করলে খুব একটা ভালো লাগেনি। তবে লেখকের লেখার প্যাটার্ন আমাকে মুগ্ধ করেছে, মুগ্ধ করেছে জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ। 'বাঁশিওয়ালা মজ্জেল', 'সুখ অসুখ' আর 'লাশটি জীবিত লাশের'; এই তিনটি অসাধারণ লেগেছে। লেখকের লেখা আবারও পড়বো, বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়বো।
ওহ আরেকটা জিনিস। বইয়ের শুরুতে একটা 'পাঠকথন' আছে, যেটা লিখেছেন জাহানারা নওশিন (উনি একজন কথাসাহিত্যিক কিন্তু ওনার কোনো লেখা আমি পড়িনি, নামও শুনিনি)। এই পাঠকথনটা স্পেশাল। মানে বই পড়া, পড়ার সময়ে দৃষ্টিভঙ্গি এবং পড়া শেষে পড়ার অনুভূতি শেয়ার করাটা যে এত নান্দনিক হতে পারে, সেটা আরেকবার প্রমাণ পেলাম এই লেখাটি পড়ে।
না, ইউনিক স্টাইলের গদ্য হয়ত অতটা নাই বা চমকে দেবে না কিংবা চোখেও লাগবে না, কিন্তু গল্প ভালো হয়ে ওঠার অন্য যে উপাদান; গল্পের টপিক; তা প্রায় গল্পেই জোরালো। 'কেবল কথা বলতে চেয়েছিলাম' গল্পটি তো ছেলেবেলায় ফিরায়ে নিয়ে গেছিল পুরাপুরিই বলা যায়। আধুনিক গল্পে পাঠক নিজের সাথে রিলেট করতে পারার যে ব্যাপার থাকে, তা আছে। কিছু রহস্য, কিছু অমীমাংসা; এরও ধাঁচ কিংবা আঁচও রয়েছে কয়েকটা গল্পে৷ ফলে একঘেয়ে লাগার বিষয়টি নাই। খুব স্ট্রেস কন্ডিশনের মধ্যে বইটা পড়লাম, এবং এই সময়টায় বেশ একটা রিলিফ দিচ্ছিলো গল্পগুলো। দূর্বল গল্প যে নাই সেরকম না, 'সুখ অসুখ' গল্পটা যেমন, এত দ্রুত টাইমলাইন পাল্টেছে যে ঠিক ছোটোগল্পের প্লটে আঁকড়ে থাকার বিষয়টি চলে গেছে। আরও দু চারটা গল্প ততটা ভালো লাগে নাই। তারপরও ওভারঅল ভালো বই।
এই বইয়ে ১৪টি গল্প। বেশ বৈচিত্র্য আছে। আলাদা করে বলতে হয় ‘খোয়াব’ এবং ‘কেবল কথা বলতে চেয়েছিলাম’, এই দুইটি গল্পের কথা। খোয়াব-এ এক বালক স্বপ্ন দেখে, যা অনেক সময় সত্যি হয়ে যায়। পুরো বইয়ের মধ্যে এই গল্পটিকেই সবচেয়ে শক্তিশালী লেগেছে। অন্যটি, কৈশোরের একপাক্ষিক প্রেম নিয়ে। বেশ সুন্দর করে সেই বয়সের অনুভূতি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
গল্প পড়তে বরাবরই ভালো লাগে। তবে বর্তমানে অধিকাংশ গল্পই দেখি মোটাদাগে একই টাইপ-প্রেমের গল্প। তাই আজকাল আর গল্প পড়া হয় না। মোজাফফর হোসেনের 'অতীত একটা ভিনদেশ' এদিকটা বেশ ভালোভাবেই পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। ১৩টি গল্প নিয়ে বইটি। এখানে লেখক কয়েক ধরণের গল্পের সমাবেশ ঘটিয়েছেন। দেশ বিভাগের গল্প আছে, আছে মুক্তিযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতার গল্প, আবার নারীর প্রতি সহিংসতা কিংবা সমাজের নিম্ন শ্রেণীর শোষণ-পীড়নের গল্পও আছে। প্রেমের গল্পও আছে তবে সেই চেনা প্ল্যাটফর্মের 'আমি তোমাকে ভালোবাসি' বলে দুটি ছেলে-মেয়ের ঘর সংসার এরপর হয় তাদের ভুলভাঙা কিংবা সুখে শান্তিতে বসবাস করার গল্প না।
মজার দুটো কনসেপ্টের দুটো প্রেমের গল্প 'কেবল কথা বলতে চেয়েছিলাম' আর 'মৎস্যজীবন'। টিনএজ বয়সে স্কুলজীবনের মনে মনে ভাবা প্রেমিকাকে নিয়ে এক কিশোরের গল্প 'কেবল কথা বলতে চেয়েছিলাম।' আর ওদিকে ছেলে-মেয়ে-বউ নিয়ে সংসার করা পুরো দস্তুর গৃহস্থ লোকের পরনারীর প্রতি ভালোবাসা মোহ নিয়ে লেখা 'মৎসজীবন'। নামের মত তাঁর প্রেমটাও ক্ষণস্থায়ী। ডাঙাতে তোলার সাথে সাথেই যে জীবনের ইতি ঘটে।
৪৭ এর দেশবিভাগ সেসময়ের প্রতিটি মানুষের মনে দগদগে ঘা এর মত। পূর্বপুরুষ যে দেশের মাটিতে জন্মেছেন, যে দেশের আলো হাওয়া- মাটিতে বড় হয়েছেন হঠাৎ একদল রাজনীতিবিদের ঘোষণায় সে দেশ পর হয়ে গেল এ অনুভূতি আসলে কেমন তা কল্পনাও করতে পারি না। তাই দেশ বিভাগের যেকোন সাধারণ গল্পও আমার কাছে অনেক অসাধারণ লাগে। মোজাফফর হোসেনের 'ঘুমপাড়ানো জল' ও খারাপ লাগেনি। ৪৭ এ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া হরিশঙ্কর যখন অনেক পরে নিজের জন্মভিটাকে দেখতে আসেন তখন আসলে আর সেই অতীতের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। অস্থির মনে একবুক হতাশা নিয়ে যখন ফিরে যান তখন আমাদের মনেও যেন একটা হতাশা ভর করে- কেন এমন হল!
শেষ গল্প 'সুখ অসুখ' টা ভালো ছিল বেশ। একদিকে কিছুই অর্জন করতে না পারা যেমন মনে অসুখের জন্ম দেয় অন্যদিকে সব পাওয়া লোটাসের আত্মহত্যাও বুঝিয়ে দেয় 'আসলে কেউ সুখী নয়'।
এছাড়া ভালো লেগেছে 'লাশটি জীবিত লাশের'। এদেশে জীবিত মানুষের দাম তো নেইই সেই সাথে মৃতের সম্মানটুকু টাকা না থাকলে কেউ করে না- এটা সবার জানা। তবু গল্পে কোথায় যেন একটা বেদনার আভাস ছিল।
'বাঁশিওয়ালা মজ্জেল' এক মৃত বাঁশিওয়ালার গল্প। পুরো গল্পটা শেষ না করলে বোঝা যাবে না আসলে যে গল্প-কথক ও মৃত। এই গল্পে লেখক ধর্মীয় উন্মাদনার চিত্র তুলে ধরেছেন সম্ভবত সেই যে একবার বাউল আখড়ায় হামলা হল সেই ঘটনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে।
তবে যেটা ভালো লাগেনি তা হল কিছু গল্পতে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কেমন একটা খোঁচা। আজকাল এটাও একটা স্টাইল হয়ে গিয়েছে লেখার। সাহিত্য আর ধর্মের মেলবন্ধন নাহোক অন্তত চুলাচুলি চাই না!
প্রথম গল্পটা দুর্দান্ত লেগেছিল আমার। যার দরুন প্রত্যাশা গিয়েছিল বেড়ে। কিন্তু আশায় করুণ কয়লা, পরবর্তী গল্পগুলো সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। চেষ্টা যে করেনি তা নয়, তবে যেমন গভীরতা আমি খুঁজছিলাম তেমনটা পাইনি। গল্পের বিষয়গুলো এ সময়ের। এমন সব বিষয়, যা আমরা দেখেও-না-দেখার ভান করে চলেছি। এড়িয়ে চলেছি। হয়তোবা জানি মন্দ-- কিন্তু সে মন্দ নিয়েও আমাদের কোন বক্তব্য নেই। কিন্তু এখানে লেখকের বক্তব্য আছে। অন্তত একারণে হলেও তিনি শ্রদ্ধার দাবি রাখেন। এছাড়া মাঝের কয়েকটি গল্প বেশ ভালো লেগেছে, মোটকথা অনুভব করেছি। ভালো লেগেছে একেবারে শেষ গল্পটি। আর পুরো বইতে যে বিষয়টি বেশি ভালো লেগেছে তা হলো, লেখক অনেক কথাই সরাসরি বলেননি, ইঙ্গিত করে বুঝিয়েছেন।
অতীত একটা ভিনদেশ-- সেই দেশের খোঁজ করেছি পাতায় পাতায়। পেয়েছি.. তবে আশা মেটেনি আরও প্রগাঢ় পেতে চেয়েছিলাম এই যা!
একটা ভালো লেখা পড়লে কেমন তৃপ্তি আসে! ধরুন ঘরে খাবার নেই। খাদ্য উপার্জনেরও তেমন ব্যবস্থা নেই। মনে করেন আমাদের সেই করুন ইতিহাসের সময়টা। যে সময়টাতে মানুষ খেয়েছে তবে দিনে এক বেলা। অথবা দু দিন অন্তর অন্তর। ‘বাবার কাছে শুনেছি সেই সময়ের দুঃখ শোকের গল্প। তিনি বড় বড় শ্বাস ছাড়েন আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জানিস বাবা! অমন একটা সময়! আল্লাহ বড় ভালো রেখেছেন। তিন বেলা খাইয়েছেন। আলহামদু লিল্লাহ।’
অমন একটা পরিবেশ। খাবার নেই। বহুদিন পর খাবারের সন্ধান মিললো। যখন পেট শুধু খাদ্য চায়। চোখ ঝাপসা। কিচ্ছু দেখা যায় না। তখন আমাদের সময়ের আলুভর্তা ডাল সর্বোৎকৃষ্ট খাবার। এসব বাদ দিয়ে ওই পরিবেশে যদি গোস্তের সন্ধ্যান মেলে। সাথে আরো যত রকমের উন্নত আইটেম হওয়া সম্ভব। সাথে আবার অতিরিক্ত রুচিবর্ধন কল্পে সালাদের বাড়তি ব্যবস্থা। তবে খাবার টা কেমন হবে! বর্ণনাতীত সুন্দর।
এই বই ঠিক তেমনই। উন্নত খাবারের মতো কেবল তৃপ্তি নয় পরিতৃপ্তিকর এর প্রতিটি গল্প। আছে গোস্তের মতো উন্নত আইটেমের সাথে বাড়তি রুচিবর্ধক সালাদের ব্যবস্থা। আমি এ যাবৎ গল্প পড়েছি বহু। তবে বর্তমান তরুনদের এই অভাবনীয় সুন্দর কাজ সত্যিই বিমোহিত করেছে। আসলেই সম্মানের যোগ্য ছিলো এ বই। এক মলাটে বহু রকম তৃপ্তি পাওয়া যাবে ৷ সাথে লেখক নিজস্ব যোগ্যতা আর বিশেষ বৈশিষ্টের সাক্ষর রেখেছেন বইয়ের প্রতিটি গল্পে। যেমনটা তার ব্যাপারে বলাহয়--- একটি সম্পুর্ণ আলাদা নির্মাণজগৎ তিনি আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ৷ প্রতিটি গল্পই সরল সহজ সুখপাঠ্য ৷ অর্থ মর্মের বিচারেও অনন্য ৷
লেখক এবং তার বইয়ের জন্য শুভ কামনা ৷
বইঃ অতীত একটা ভিনদেশ ৷ লেখকঃ মোজাফফর হেসেন ৷ প্রকাশনীঃ বেহুলা বাংলা ৷ মলাটমুল্যঃ ২২০ টাকা ৷
এই বইটা ছিল এক ঘোরময় যাত্রাপথের মতো৷ অতীতকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে প্রায় সবগুলো গল্পই, বিভিন্ন রঙে। অধিকাংশ গল্পে বিষণ্নতার পিয়ানো মূর্ছনা ছড়িয়েছে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির গল্পের চেয়ে বরং ফেলে আসা সময়কে ধারণ করাটাই যেন ছিল গল্পগুলোর মূল লক্ষ্য৷ অথচ সহজ, সাবলীল আপাত নির্ঝঞ্ঝাট গল্পগুলোতেই উঠে এসেছে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা সামসময়িক অস্থিরতার টুকরো টুকরো আখ্যান। যেন খুব যত্নের সাথে লেখক বুনেছেন বিষণ্ণতা, গল্প আর বাস্তবতার চাদর।
কিছু গল্প ছিল ঘটনাপ্রধান আর কিছু ছিল বর্ণনাপ্রধান। তবে, ঘটনাপ্রধান গল্পগুলোতেও বর্ণনার ঘনঘটা ছিল। চরিত্রদের সাথে কিংবা তাদের ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণে আমাকেও যেতে হয়েছে এক ঘোরের মধ্য দিয়ে। কখনো কখনো মনে হয়েছে এই জীবন আমি যাপন করে এসেছি, এ যেন আমারই গল্প! কিন্তু গল্পগুলোর গভীরতা ছিল অনেক। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সীমানা ভেদ করে কখন যে সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক সমস্যাগুলো ফুঁটে উঠেছে তা গভীরভাবে না ভাবলে কেউ হয়তো টেরই পাবে না! সবমিলিয়ে, মনে হয়েছে আসলেই পুরোটা সময় আমি ভিন্ন কোনো দেশে ভ্রমণ করে এসেছি, অথচ সেই সময়টা যেন আমার নিজের মধ্যেই ধারণ করা। লেখক কেবল গল্পের ছলে সময়ের পর্দাটা ছিড়ে দিয়েছেন!
‘মোজাফ্ফর-এর গল্পের আপাত সরল কাঠামো, সাবলীল বর্ণনাভঙ্গি পাঠককে দ্রুত গল্পের ভুবনে প্রবেশ করিয়ে দেবে যদিও সামান্য সময় পার হলেই তিনি সম্মুখীন হবেন নানা সম্ভাবনার, বহুকৌণিক গল্পজগতের। সচেতন পাঠক সেটিকে পরাবাস্তব, জাদুবাস্তববাদ বা অতি-আধুনিক গল্পের জগৎ—যে-নামেই চিহ্নিত করুন না কেন গল্পের পাঠতৃপ্তি কী পাঠযোগ্যতা বিন্দুমাত্র ব্যাহত হয় না তাতে।’
কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
*** পাঠক যখন মোজাফ্ফরের গল্প পাঠে আছেন, পড়ছেন তার কোনো গল্প, হঠাৎই অস্বস্তিত্বে পড়তে পারেন—গল্পটি শেষ হয়ে গেল না কেন, কিংবা কেন শেষ হলো এখানে। পাঠক গল্পটি যখন শুরু করেছিলেন, তখনো হয়তো এই একই বিস্ময় ও ঘোরে আক্রান্ত ছিলেন—গল্পটি এভাবে কেন শুরু হলো। বস্তুত, গল্প মোজাফ্ফর হোসেন কোথায় শুরু করবেন, কোথায় শেষ, তা শুধু তিনিই জানেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা পাঠকের পক্ষে অনুমান করা কঠিন। মোজাফ্ফর এমন একটি নির্মাণশৈলী আয়ত্ত করেছেন, আমরা দেখতে পাই, পাঠক যতই তার গল্পের সাথে মিশে যেতে চান, যতই জাকিয়ে বসতে চান, মোজাফ্ফর ততই তাদের সরিয়ে সরিয়ে দেন।...মোজাফ্ফর হোসেনের বড় বৈশিষ্ট্য, একটি সম্পূর্ণ আলাদা নির্মাণজগৎ তিনি আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাস্তব-অবাস্তব-পরাবাস্তব, যেন সত্য ও মিথ্যা কিংবা মিথ্যা না-র এক অদ্ভুত মিশ্রণে তিনি নিজেকে আলাদা করে ফেলেন।... এদিকে, গল্পের বিষয়ে কতই-না নানা বৈচিত্র্য তার। কী অনায়াস তার পর্যবেক্ষণ, কিছু বিদ্রুপ কী সহজেই না ঝলসে ওঠে তার হাতে। আর তার গদ্যও দেখি মেদহীন, সুস্বাদু, মুচমুচে।... [শংসাবচন (এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্য পুরস্কার-২০১৭) মঈনুল আহসান সাবের]