মায়ের চেয়ে সুন্দর বন বেশি পছন্দ ছিলো বাবাটার। পশুর নদীর গর্জন শুনলেই তার মাথা খারাপ হয়ে যেত। মোটা চালের ভাত আর কোন্দ আলুর ঝাল ঝাল বিদঘুটে একটা তরকারী খেয়ে রোজ দুপুরে সে বের হয়ে যেত নৌকাটা নিয়ে। পশুর আর সন্ধ্যা নদীর অলিগলি চষে বেড়ানো হয়েছে তার। বনের গভীরে, একদম গহীনে কাঠের জন্য যেত বাবা। সাথে থাকত মোর্শেদ আলী। তোবড়ানো একটা টিনের ডিব্বায় মা খাবার দিয়ে দিতো। ওটা থাকতো মোর্শেদ আলীর হাতে। এক হাতে বৈঠা আরেক হাতে ডিব্বা। বাবা কুড়াল পাশে রেখে নৌকার পাটাতনে কাত হয়ে শুয়ে গান ধরতো। ‘ওরে হৈ হৈ, জোয়ান মরদ বয়সের আগে হইলো বুড়া/ নাইরে বিবির সোহাগ/আনিতে রস ছোবল দিলো শঙ্খচূড়া...।’ একটা সময় নদী ছেড়ে নৌকা ঢুকতো খালে। নালার মতন ছোট্ট খাল। সে নালার শরীর চিড়ে ধীরে ধীরে নৌকা যেত গহীনে। এতটা গহীনে যেখানে বনকর্মীরা তো দূরের কথা, জলদস্যুরাও আসতো না। শুধু বাতাসের সো সো আওয়াজ। জলের ওপর বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ আঘাত। ভুতুড়ে পরিবেশ। মোর্শেদ আলীর ভয় ধরতো। বলতো,‘বাপজান, ডর লাগে। ফিরা যাই লন।’ তার বাবা হাসতো। বলতো, ‘পুরুষ মাইনষের কইলজা হইতে হইবো পাহাড়ের মতন। এক বিঘৎ হইলে চলবো?’ শুনে মোর্শেদ আলী চুপ যেত। ছোটবেলা থেকেই তার পৌরুষত্ব টনটনা। তবে এদিকে বাঘের ভয় আছে। শুনেছে অন্যদের কাছে। বাঘ জনবসতির কাছে এসে নিত্য টেনে নিয়ে যায় ছাগল, গরু। একটা বাঘ না, অনেকগুলো বাঘ। মোর্শেদ আলীর ভয় তাই কমতো না। ইচ্ছে না থাকার পরেও তাই থেকে থেকে বলতো, ‘ও বাপজান। ফিরা যাই না।’ বাবা হাসতো। খালিই হাসতো। ধুর।
এই বইটা আসলে কিছু ছোটগল্পের সংকলন। কিছু ভাল, কিছু লেখকের অবসর বিলাস। তবে আমার তিনটি গল্প- ফিলিম কানন, বাঘবিধবা, আর ক্রোধ ভাল লেগেছে। বাকিগুলি মোটামুটি মানের।এটা আমার এই লেখকের পড়া প্রথম বই, যদিও তিনি নতুন কেউ নন। লেখনী খারাপ নয়, উপভোগ করেছি, তবে দামটা একটু কম হলে ভাল হত।
ʼʼবাঘবিধবাʼʼ শীর্ষক গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সর্বমোট ১৭টি গল্প। সবগুলো গল্পের কাহিনি নিয়েই একটু করে আলোচনা করছি।
▪︎কাহিনি সংক্ষেপ :
🔘 ফিলিম কানন : নুরাইনপুর বাজারের কাছে বিচিত্র এক বাগান আছে। বাগানের নাম ফিলিম কানন। ফিলিম কাননের মালিক, বজলু বিশ্বাস সিনেমাপাগল মানুষ। ফিলিম তথা ফিল্ম জগতের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ। সেই আগ্রহ থেকেই ফিলিম কাননের আবির্ভাব।
🔘 বিষণ্ণ পাতা : সন্তানহারা মায়ের শোক কেউ বোঝে না। দুই সন্তানকে হারিয়ে রুবিনার কষ্টের শেষ নেই। কষ্টগুলো বেরিয়ে আসে পাগলামি হয়ে। পাগলামির অংশটুকু সবাই দেখে, কষ্টের পরিমাণ কেউ দেখে না। কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে থাকে!
🔘 হিমশিম দৃশ্যকল্প : স্বপ্নের নিবাস, একাকীত্ব আর পালিয়ে বেড়ানো জীবনকে কেন্দ্র করে লেখকের নিজস্ব অনুভূতি উঠে এসেছে এই গল্পে।
🔘 পরিবার এবং : জনক, ভগিনী আর সহধর্মিণীকে কেন্দ্র করে লেখকের নিজস্ব অনুভূতি প্রাধান্য বিস্তার করেছে এই গল্পে।
🔘 মানুষকাহন : দুটি ভিন্নধারার প্লট নিয়ে গল্প এগিয়েছে। প্রথম প্লটের মূলে রয়েছে প্রেম। দ্বিতীয় প্লটে আবর্তিত হয়েছে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে লেখকের নিজস্ব অনুভূতি।
🔘 শব্দের এলোমেলোমি : নামকরণের ব্যাপারটাকে সার্থক করে এলোমেলো শব্দের টুকরো টুকরো আলাপ উঠে এসেছে এই গল্পে। মার্চ মাসের ৭, ৮ এবং ৯ তারিখের এই আলাপগুলো মূলত ডায়েরিতে টুকে রাখা দিনলিপির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
🔘 জান্নাতে জান্নাত আলি : জান্নাত আলির বয়স যখন মাত্র সাত, তখন তার উচ্চতা একেবারে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি! সময় যত গড়ায়, জান্নাত আলির উচ্চতা তত বাড়ে। উচ্চতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ক্ষুধা। তারপর?
🔘 ক্রোধ; প্রতিশোধ : ঈর্ষা থেকে জন্ম নেয় ক্রোধ। ক্রোধ জাগিয়ে তোলে প্রতিশোধ স্পৃহা। সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বোঝা বেশ কঠিন হয়ে যায় তখন।
🔘 বনপোড়া হরিণ : শহরের সচ্ছল যত রিকশাওয়ালা আছে - সবাইকে গরিব বানানোর জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠেন এলাকার ডিসি সাহেব। ধীরে ধীরে গরিবের সংখ্যা বাড়ে। এদিকে অন্যকে গরিব বানাতে গিয়ে নিজেই যে গরিব হয়ে বসে আছেন ডিসি সাহেব, সেই কথা মনে থাকে না তার।
🔘 মানুষপাখি : দীর্ঘদিন ধরে চিলেকোঠার ঘরে আত্মগোপন করে আছে সুজন। বিপদ কেটে গেলেও চিলেকোঠার মায়া ছাড়তে পারে না সে। খাঁচার পাখি যেমন খাঁচার মায়ায় জড়িয়ে পড়ে, সুজনও তেমন জড়িয়ে পড়ে চিলেকোঠার মায়ায়!
🔘 ফেরারি ফানুস : লেখকের পাপ বিষয়ক নিজস্ব অনুভূতির কথা উঠে এসেছে এই গল্পে।
🔘 কথোপকথন কিছু : পাওয়া আর না পাওয়া-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংলাপনির্ভর গল্প।
🔘 বিষাদের জনপদ : পরিবারের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছেন জামাল সাহেব। সময় এখন নিজের জন্য বাঁচার। যাহোক; বাঁচার মানে খুঁজতে গিয়ে থাইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন ভদ্রলোক। সেখানে গিয়ে জড়িয়ে পড়লেন নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চারে।
🔘 নজরবন্দি ছোট্টবেলা : ছেলেবেলার নস্টালজিকতা নিয়ে লেখকের নিজস্ব অনুভূতির সমাহার এই গল্প।
🔘 সারমেয় : সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। অথচ মানুষের কিছু কিছু কার্যকলাপ তাদেরকে সারমেয়দের চেয়েও অধম বানিয়ে দেয়!
🔘 উড়ন্ত কলাম : টুকরো টুকরো দিনলিপির সংকলন এই গল্প; যেখানে বেঁচে থাকা, বোকামি, মধ্যবিত্ত জীবন, মৃত্যু, বন্ধুত্ব, আকাঙ্ক্ষার ন্যায় বিচিত্র সব বিষয়ের ওপর নিজস্ব চিন্তাধারার প্রকাশ করেছেন লেখক।
🔘 বাঘবিধবা : যে গল্পের নামে বইয়ের নামকরণ; সেই ʼʼবাঘবিধবাʼʼ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সবার শেষে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাঘবিধবা কারা? বাঘের কবলে পড়ে প্রাণ হারায় যাদের স্বামী, তারা-ই বাঘবিধবা। এবং আকলিমা নামক এক বাঘবিধবাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এই গল্পের পুরো কাহিনি।
▪︎পর্যালোচনা :
গ্রন্থে এমন কিছু গল্প অন্তর্ভুক্ত হয়েছে; যেখানে বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখকের চিন্তাধারার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন : ʼʼহিমশিম দৃশ্যকল্পʼʼ, ʼʼপরিবার এবংʼʼ, ʼʼমানুষকাহনʼʼ, ʼʼশব্দের এলোমেলোমিʼʼ, ʼʼফেরারি ফানুসʼʼ, ʼʼনজরবন্দি ছোট্টবেলাʼʼ, ʼʼউড়ন্ত কলামʼʼ ইত্যাদি। লেখকের নিজস্ব জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এসব গল্পের কাহিনি জুড়ে তেমন বৈচিত্র্যময়তা হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে; লেখার মধ্য দিয়ে নিজের ভাবনাগুলোকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার একটা চেষ্টা অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যায়।
ʼʼফিলিম কাননʼʼ শীর্ষক গল্পের প্লট ভালোই ছিল। শব্দচয়নে ছিল মাধুর্যতা। দারুণ সুন্দরভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল কাহিনির গতি। কিন্তু শেষাংশে এসে যে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অবতারণা করেছেন লেখক; সেটা ঠিক গা ছমছমে আবহ তৈরি করতে পারেনি। বরং হাস্যকর বলে মনে হয়েছে।
ʼʼবিষণ্ণ পাতাʼʼ, ʼʼজান্নাতে জান্নাত আলিʼʼ, ʼʼবনপোড়া হরিণʼʼ, ʼʼকথোপকথন কিছুʼʼ, ʼʼবিষাদের জনপদʼʼ, ʼʼসারমেয়ʼʼ - এই গল্পগুলো পড়ে তেমন ভালো লাগেনি। আবার তেমন খারাপও লাগেনি। মূলত লেখকের লেখার কায়দায় একটা গতিময়তা ছিল, যার কারণে গল্পগুলো পড়তে গিয়ে তেমন বিরক্ত অনুভূত হয়নি।
ʼʼক্রোধ; প্রতিশোধʼʼ আর ʼʼমানুষপাখিʼʼ - এই দুটো গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। বর্ণনাশৈলী দারুণ, কাহিনির প্লটও খারাপ না।
এবার আসি ʼʼবাঘবিধবাʼʼ প্রসঙ্গে। পুরো বই পড়ে এই একটা গল্প আমি খুঁজে পেয়েছি, যা আমার দীর্ঘদিন মনে থাকবে। এবং বাঘবিধবা তথা সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আরও কিছু সাহিত্যকর্ম পড়ার ইচ্ছে রইল।
নাম গল্পটি বেশ ছিলো, আর এটাকে পুরোপুরি ছোটগল্পের বই বলা যায়না। বেশ কয়েকটি লেখা লেখকের আত্মকথন ছিলো। গল্পের প্লটগুলো ভালো হলে ও লেখকের ভাষার শৈথিল্যের জন্য ভালো আগেনি।