'মাহমুদুল হক রচনাবলি: প্রথম খণ্ড' গ্রন্থটিতে প্রকাশের ক্রমানুসারে সন্নিবেশিত হয়েছে ৬টি উপন্যাস : অনুর পাঠশালা, নিরাপদ তন্দ্রা, জীবন আমার বোন, কালো বরফ, চিক্কোর কাবুক ও খেলাঘর। পরিশিষ্টে রয়েছে গ্রন্থ প্রসঙ্গ, মাহমুদুল হকের জীবনপঞ্জি ও মাহমুদুল হক চর্চা।
Mahmudul Haque (Bangla: মাহমুদুল হক) was a contemporary novelist in Bangla literature. He was born in Barasat in West Bengal. His family moved to Dhaka after the partition in 1947. His novels deal with this pain of leaving one's home.
Mahmud gave up writing in 1982 after a number of acclaimed novels. Affectionately known as Botu Bhai and always seen as a lively figure in social gatherings, the rest of the time he was said to lead a solitary life.
দুনিয়া উলোটপালোট করে দেয়া সেই ভাইরাস অবশেষে চলে এলো ঘরে। ভাগ্যক্রমে তেমন জোর আক্রমণ হলো না, অল্পের ওপরেই গেলো। হালকা জ্বরের কদিন কেবল থ্রিলার ঘরানার লেখাই পড়ে গেলাম। সাথে মাহমুদুল হক।
'জীবন আমার বোন' আর 'কালো বরফ' পড়েছি একাধিকবার, প্রথম দু'বার মুগ্ধ হতে, পরে সেই মুগ্ধতাকে খুঁটিয়ে দেখতে। এবার সে দু'টো পড়লাম না। 'অনুর পাঠশালা'- সেই নিবিড় ভাইয়ের কাছ থেকে ধার করে নেবার প্রায় এক দশক পরে- আবার পড়লাম এবার। 'চিক্কোর কাবুক'ও এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। নতুন করে পড়লাম ওই 'নিরাপদ তন্দ্রা' আর 'খেলাঘর'। হয়তো, কেবল তাদের নিয়ে কথা বলাটাই তাই যৌক্তিক ছিলো।
তবু এই আলাপের উত্থাপনটা মূলতঃ বাংলা একাডেমির সংকলনটার দিকে লোকের মনোযোগ টানতে। দুই খণ্ডের মাহমুদুল হক রচনাবলি দামে বোধহয় ৬০০ টাকার সামান্য বেশি; কিন্তু ট্রানজিস্টারকে যে লোক বনবেড়াল বানায়, দীর্ঘশ্বাসকে যে করে তোলে নবাবপুরের রাস্তা আর চুলের গন্ধ দিয়ে যে নির্মাণ করে কালো রঙের বরফ- তার গদ্যের মূল্য কি আদৌ দেয়া যায়?
মাহমুদুল হকের গদ্য নিয়ে বলতে গিয়ে, উপমার জন্য ভিখারির মতো হাত পাতি তারই রচনায়৷ চিক্কোর কাবুক কিশোর উপন্যাসের সেই টুপু, শব্দের রঙ যে দেখতে পায়, তার মুখেই ব্যাপারটা শোনা।
" - বাংলাদেশ, বল দেখি ছোকরা এর রঙ? - সবুজ। - গুলতাপ্পি মারা হচ্ছে? - আচ্ছা, আবার বলো তো শুনি। - বাংলাদেশ, বাংলাদেশ! - বাংলাদেশ সবুজ। আর যদি একসাথে পরপর দু'বার উচ্চারণ করো- তবে তার রঙ লাল।... "
আমার ধারণা, শব্দের রঙ দেখতে পেতেন মাহমুদুল হক নিজেও। 'বর্ণমালা' শব্দের আরেকটা অর্থ যে 'রঙের খেলা'ও, কয়জনের লেখা পড়ে তা স্মরণ হয় আমাদের?
মৃত্যুর অনেকদিন পর যেসব সাহিত্যিক সাধারণ পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছেন তাদের মধ্যে মাহমুদুল হক একজন। দীর্ঘ অনেকদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার পর বিগত কয়েকবছরের মধ্যে মাহমুদুল সাহেব পাঠকের সামনে ধরা দেয় উজ্জ্বল এক বলয় হয়ে। আর না হওয়ার কোন কারণ নেই, কারণ সাহিত্যিক হিসাবে তিনি যে অসামান্য তার প্রমাণ 'অনুর পাঠশালা', 'নিরাপদ তন্দ্রা', 'কালো বরফ' সহ বিভিন্ন উপন্যাসে ছড়িয়ে আছে। 'প্রতিদিন একটি রুমাল' নামে গল্পগ্রন্থটাও সেই ইঙ্গিত দেয়। তাই হয়তো পছন্দের সাহিত্যিক হয়ে উঠতেও বেশি সময় লাগেনি আমার। তবুও নির্মোহ থেকে প্রতিটি লেখা চেষ্টা করি, কিন্তু সে লাগাম থাকে কোথায়? লেখক তার লেখায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেন আমাকেসহ।
প্রথম খন্ড শেষ করার পর আমার অনুভূতি এ-ই!
"সামন্তসেনায় বকুলগাছতলায় এখনও দাদাভাইয়ের কবর আছে। ফুলের সময় রোজ আমি দাদাভাইকে মালা গেঁথে পরাতাম। দাদাভাই গলা বাড়িয়ে দিয়ে বলত, দে দে, যত দিবি তত পাবি। বলতাম, কী পাব? বলত, যা দিবি তাই পাবি। ফুলের মালা দিলে ফুলের মালা পাবি, জীবন ফুলের মতো হবে, ঝলমল করবে, হাসিখুশি থাকবে, সুগন্ধে ভুরভুর করবে; দে দে, যত দিবি তত পাবি। বকুলফুলের মালা কী ভালোটাই না বাসত আমার দাদাভাই। সব জমিয়ে রাখত, শুকিয়ে যেত, তাও রাখত। চুপড়ি ভরে বাক্স-প্যাটরার ওপর বসিয়ে রাখত। দিদামণি বলত, এই ছুঁড়ি, আমার জিনিসের ওপর তোর এত লোভ কেন, নোলা ছিঁড়ে নেব আমার থাকার মধ্যে আছে তো কেবল ওই একটা ঠুনকো বুড়ো, তার ওপরেও হারামজাদির। নজর পড়েছে, তোর চোখ গেলে দেব। আমি দাদাভাইয়ের কপালে মস্ত একটা কাজলের ফোঁটা দিয়ে দিতাম, বলতাম এখন হয়েছে তো, আর নজর লাগবে না। দিদামণি হেসে বলত সতিনেরও বাড়া, পেটে পেটে তোর এতও চালাকি, ওমা আমি কোথায় যাব, কত ফন্দিই না শিখেছিস, ভেবেছিস এইসব করে আমাকে বুঝ দিবি, তা হচ্ছে না। এক সময় ন্যাকারখেকো বুড়ো কী আমায় কম জ্বালিয়েছে।"
- খেলাঘর
"ভিজে কুকুরের মতো গা থেকে কাদা ঝাড়তে থাকে এক ধরনের অনুভূতি; অপরাধবোধ সম্পর্কে তার ধারণা খুব একটা স্বচ্ছ নয়, কেবল এই অনুভূতির আলগা স্পর্শে অল্পবিস্তর সংকুচিত হয়ে পড়ে সে। আমাদের ভিতরে যে কত প্রবল মানুষের আস্তানা পাতা, যারা প্রায় সকলেই অচেনা, কখন যে কার করায়ত্ত আমরা, ইহকালে তা জানা যাবে না কখনো, আগেও ভেবেছে খোকা এসব। যে স্তন দৃপ্ত খেলোয়াড়ের হাতের বল হতে চায়, দন্তক্ষতের মালা জড়াতে চায়, নির্বোধ শিশুর ঠোঁটে তা অমন উগ্র অথচ মধুর হয় কীভাবে, খোকার মাথায় তা খেলে না; তার শুধু মনে হয়, একা নই, কেউই আমরা একা নই ।"
- জীবন আমার বোন
এসব টুকরোটাকরা লেখাগুলো মনকে আন্দোলিত করে। কী প্রবল কাতরায় ভোগায়! কিছু কিছু লেখার ঘোর কাটিয়ে ওঠা কখনোই সম্ভব না। মনে আছে 'অনুর পাঠশালা' পড়ার পর ঘোর কাটেনি সহজে। এখনো মাঝে মাঝে আমায় আক্রান্ত করে ফেলে। 'অনুর পাঠশালা' উপন্যাসের প্রথম নাম হলো 'যেখানে খঞ্জনা পাখি'। পরে নাম পাল্টে 'অনুর পাঠশালা' রাখা হয়। তবে 'যেখানে খঞ্জনা পাখি' আমায় জ্বালিয়ে মারে।
লেখকের ধারাবাহিক বর্ণনা, দৃষ্টিভঙ্গি ঘটনাপ্রবাহ ভেদে হয়ে ওঠে ভিন্নধর্মী। যুতসই বর্ণনা, মাঝে মাঝে শব্দের খেলা নিয়ে লেখক যেন মেতে ওঠেন অন্য এক আমেজে। বিশেষ করে শব্দ নিয়ে চাতুর্যময় ব্যবহার বেশ প্রভাব বিস্তার করে তার লেখায়। এসব কারণে পছন্দের সাহিত্যিকের মধ্যে মাহমুদুল হক উপরে অবস্থান করেন।
ছোটদের মনোজগতে ঘোরাফেরা করা খুব কঠিন বলে মনে হয় আমার। লেখক অনায়াসে সেই কাজটি করে দেখালেন 'কালো বরফ' এবং 'অনুর পাঠশালা' বইতে। এছাড়া 'জীবন আমার বোন' ও 'খেলাঘর' বইতে মুক্তিযুদ্ধের আনাগোনা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তি না হয়ে সাধারণ মানুষের মনের ভাব, টানাপোড়েনের যে চিত্র তিনি অঙ্কন করেন তার তুলনা হয় না। এসব বিভিন্ন কারণে মাহমুদুল হক পছন্দের।
শেষ করি তাঁর কথা দিয়েই।
"একটা নদী যখন শুকিয়ে যায়, তখন তাকে
কেউ অপরাধী বলে সাব্যস্ত করে না, তার কথা মনে করে শুধু দুঃখ পায় । একটা সামান্য মানুষকেও ঠিক এইভাবে দেখো। এইভাবে দেখলে তার ধ্বংসস্তূপই কেবল তোমার নজরে আসবে। বুকের ওপর দুটো হাত জড়ো করে মার খাওয়া মানুষ যখন বলে মুঠোয় কী আছে দেখতে চেয়ো না, দোহাই তোমাদের, এ তোমাদের কোনো কাজে লাগবে না, সারাজীবনের সঞ্চয় শুধু এইটুকুই, এই সামান্য স্বপ্নটুকুই, তখন ধরে নিতে হয় সে বেঁচে আছে কেবল স্মৃতির ভেতর। তার চেয়ে নির্বিষ, তার চেয়ে নিরাপদ জানোয়ার আর কে!"
সম্প্রতি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের বাকবদলের খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখক মাহমুদুল হকের রচনাবলির প্রথম খণ্ড। এখানে ক্রমানুসারে মুদ্রিত হয়েছে ৬টি উপন্যাস: অনুর পাঠশালা, নিরাপদ তন্দ্রা, জীবন আমার বোন, কালো বরফ, চিক্কোর কাবুক ও খেলাঘর। মাহমুদুল হক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক। তিনি স্বতন্ত্র নানা দিক থেকে। তাঁর গদ্য আধুনিক ও অনুপম। একদিকে চরিত্রের আকর্ষণীয় সংলাপ ও অন্যদিকে লেখকের নৈর্ব্যক্তিক স্বর ভাষাকে আরো গতিশীল করে তুলেছে। প্রায়শ তাঁর উপন্যাসে, বিশেষ করে অনুর পাঠশালা ও জীবন আমার বোনে কাহিনির চেয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে ভাষার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকাজ। বিমূর্ত এবং মূর্ত শিল্প যে বিন্দুতে এসে মিলিত হয় সেই বিন্দু থেকেই কাহিনির রেখা টেনে ধরেন তিনি। বহির্জগত ও অন্তর্লোক দুটোই পাশাপাশি উন্��ীলিত হয়। ফলে অনেকাংশে তাঁর উপন্যাস ব্রিটিশ উপন্যাসের মতো কাহিনিনির্ভর না হয়ে ফরাসি উপন্যাসের মতো কাঠামোনির্ভর হয়ে উঠেছে। এই ক্ষেত্র�� তিনি বাংলা ভাষার চিরায়ত সাহিত্যের পাঠকদের জন্য নতুনতর অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছেন। রচনাবলির প্রথম খণ্ডে স্থান পাওয়া প্রতিটি উপন্যাসই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি, মাহমুদুল হক লিখেছেন খুব কম, এবং এই কারণেই কিনা জানি না, তাঁর প্রতিটা গ্রন্থই স্বতন্ত্র ও কোনো-না-কোনো বিবেচনায় বাংলা ভাষার অমূল্য সম্পদ। অনুর পাঠশালা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। লেখা অবশ্য ১৯৬৭ সালে। কিশোর অনুর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, একাকীত্ব, ক্রোধ, হতাশা প্রভৃতি বিষয় হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের ঘটনাগুলো অনুর দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণিত হয়েছে, ফলে তার মনোজাগতিক অবস্থার পাশাপাশি সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের চিত্র উঠে এসেছে নির্ভেজাল ভাষ্যে। নিরাপদ তন্দ্রা তিনি লিখেছেন ১৯৬৮ সালে কিন্তু প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। উপন্যাসটি নয়টি পর্বে বিন্যস্ত। চরিত্রদের আত্মকথন ও শৈশব রোমন্থন মাহমুদুল হকের সাহিত্যের মোটামুটি চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তাঁর সেই চিহ্নায়নের সূচনা ঘটে। এখানে অধিকাংশ চরিত্র শেকড়হীন, উদ্বাস্তু। লেখক যেহেতু নিজেও স্থানচ্যুত মানুষ, তাঁর বেদনা ভাগ করে নিতেই যেন চরিত্রগুলো সামাজিক অবস্থাভেদে পাঠকের সামনে আসে। জীবন আমার বোন প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। লেখকের সম্ভবত সর্বাধিক পঠিত উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চে শুরু হয়ে এর কাহিনি শেষ হয়েছে ২৭শে মার্চ এসে-- বহির্বাস্তবে বিক্ষোভ, গোলাগুলি, অসহযোগ আন্দোলন এবং অন্তর্বাস্তবে আতঙ্ক, স্বাধীন দেশের স্বপ্ন। এর মধ্যে সচেতন কিন্তু নির্লিপ্ত স্বভাবী উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের আত্মজাগরণ ঘটে সময়ের সবচেয়ে নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে: ‘সারা দেশ চামু-ার মতো রক্তলোলুপ জিভ বের করে রেখেছে, রক্ত দাও, রক্ত দাও, আর রক্ত দাও।’ খোকা ভেতরের দ্বন্দ্বে দিশা খুঁজে হয়রান হয়। খোকার এই শূন্যতাবোধ লেখকের ভেতর থেকে উৎসারিত। উপমহাদেশের ভুল রাজনীতির শিকার হয়ে মাহমুদুল হক গৃহহীন হয়েছেন, হারিয়েছেন শৈশব। এই ক্ষয় থেকে ব্যক্তি মাহমুদুল হকের হৃদয় কখনো মুক্তি পায়নি। কালোবরফ (১৯৯২) উপন্যাসে এসে সেই ক্ষয়ের মর্মন্তুদ অনুভূতি আরো বেশি প্রকাশ্য। ভাঙনের মাঝে মানুষ কাউকে আকড়ে থির থাকতে পারে না। একে একে সরে যায় জীবন, অদৃশ্য হয় সম্পর্কের রেখা। পরিমিতিবোধ মাহমুদুল হকের সাহিত্যের যে অনিবার্য সৌন্দর্য সেটা সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট হয় এই উপন্যাসে। অসাধারণ কিছু ছোটগল্প ও উপন্যাসের পাশাপাশি মাহমুদুল হকের একমাত্র শিশুসাহিত্য হলো অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস ‘চিক্কোর কাবুক’। সাহিত্য প্রকাশ থেকে ১৯৭৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। মাহমুদুল হক গদ্যভাষা ও বিষয়বস্তুতে সম্পূর্ণভাবেই বড়দের লেখক। তার প্রমাণ মেলে তাঁর ‘কালো বরফ’ ও ‘অনুর পাঠশালা’ উপন্যাসে--সেখানে শিশুচরিত্র থাকলেও উপন্যাস হিসেবে তা শিশুতোষ নয়। তবে কিশোর উপন্যাস হিসেবে ‘চিক্কোর কাবুক’ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সৃষ্টি। উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায়ের একটি করে শিরোনাম আছে। এবং সবগুলো অধ্যায়ের কথক হল গল্পের মামা। মামাদের মুখে শিশুরা গল্প শুনতে ভালোবাসে, আর সেই মামা একটু মজার হলে তো কথায় নেই! এজন্যই হয়ত মাহমুদুল হক কৌশলে একজন মজার মামাকে গল্প বলিয়ের ভূমিকায় দাড় করিয়ে দিয়েছেন। কথকের সেন্স অব হিউমরের কারণে উপন্যাসটি পড়তে কখনো ক্লান্তি আসে না। মামা-ভাগ্নের বুদ্ধিবৃত্তিক আনন্দসফর ক্রমেই প্রকৃত দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় পরিণত হয়। হঠাৎ করেই জঙ্গলে গায়েব হয়ে যায় টুপু। শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্য করে এই রচনা হলেও মাহমুদুল হকের স্বভাবজাত ইঙ্গিতময় ভাষা এটিকে বড়দের জন্যও সুখপাঠ্য করে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধপরবর্তী প্রভাব নিয়ে লেখা উপন্যাস খেলাঘর, ১৯৭৮ সালে লেখা হলেও প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। যুদ্ধকালীন এক নারীর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের বিষাদগাথা এই উপন্যাসের মূল কাহিনি। নিঃসঙ্গতা এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ এখানেও প্রচ্ছন্নভাবে উপন্যাসের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। ঘটনাপ্রবাহকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর বাস্তবতার মনস্তাত্ত্বিক পাঠ। অতীত একটা ভূখণ্ড হিসেবে উপস্থিত মাহমুদুল হকের সাহিত্যে। ভূখ-টা বাস্তবে আর নেই, লেখকের স্মৃতিতে থাকা না-থাকা নিয়ে কোনোমতে টিকে আছে অংশবিশেষ। বিস্মৃতির মধ্যেই স্মৃতি জেগে উঠেছে। ফলে উপন্যাসগুলো লেখকের বা কোনো কোনো চরিত্রের নিজস্ব গল্প হিসেবে লিখিত হলেও সেটি আসলে আমাদের সকলের গল্প। পার্থক্য শুধু এই--একটা সম্ভাব্য গল্প ছেড়ে আমরা আরেকটা সম্ভাব্য গল্প যাপন করছি। মাঝখানে প্রকৃত গল্পটা আমাদের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেছে। রচনাবলিটি সুসম্পাদিত। পরিশিষ্টে রয়েছে গ্রন্থ প্রসঙ্গ, মাহমুদুল হকের জীবনপঞ্জি ও মাহমুদুল হক চর্চা। কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক আবু হেনা মোস্তফা এনাম গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন। তিনি মাহমুদুল হকের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। তাঁর মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিবিঢ়ভাবে পাঠ ও অনুধ্যানের ছাপ এখানে ফুটে উঠেছে।