হামিম কামালের গদ্যকে কি বলবো আমি? জাদুকরী নাকি সম্মোহনী? চৈতন্যের এমন এক সূক্ষ্ম স্তরে গিয়ে তিনি গল্প বলেন যে বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। দুর্বোধ্যতা কিংবা ব্যাখ্যাহীনতার ব্যাপারটি যে আসেনা তেমন নয়। কিন্তু প্রকৃতির রহস্যময়তা আমরা কতটুকুই বা বুঝতে পেরেছি! হামিম কামালের লেখার জগতে বিচরণ করে যে আনন্দ আর নূতনত্বের স্বাদ পাই তার জন্য গল্পের যৌক্তিকতা বিসর্জন করতে আপত্তি নেই। আমি এটা বোঝাচ্ছিনা যে তাঁর গল্পের কাঠামোতে কোন সমস্যা আছে বা যৌক্তিকতা নেই। আমি বলতে চাইতেছি যে হামিম কামালের জগতে প্রবেশের পর কোন কিছু ভাবার দরকার পড়েনা, শুধু অনুভব আর অনুভব.....
মনে হলো কোনো এক অপার্থিব জগতে এক নিগূঢ় যাত্রাশেষে কিছু লিখতে বসেছি।
ঢেউখেলানো কালো চুল পাহাড়ি নদী সাঙ্গুর মতো কাঁধ স্পর্শ করে গেছে যার, কিংবা শেষ মুহূর্তে ঈশ্বরের বুড়ো আঙুলের চাপ পড়ে যার নাকটা একটু বোঁচা হয়ে গেছে, সেই লিন্ডা মার্লিন পিউরিফিকেশন আর তার বাগানবিলাস - আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে উপন্যাসের বিষয়বস্তু এটুকুই। কিন্তু না, বহু-স্তরায়িত এই উপন্যাসে ধরা দিয়েছে ভেজা মাটির ঘ্রাণ, কিংবা হংসলতায় মোড়ানো গাছপালা, ছায়া, মিথ- এই সবকিছুর সংমিশ্রণ।
বোধাতীত রহস্যে ঘেরা এই উপন্যাসে সন্ধান মেলে রূপনিয়সী নামক এক প্রতীতির। (এর প্রকৃত অর্থ কী তা জানা নেই, তাই নিজের মতো করে একটি অর্থ খুঁজে নিয়েছি) কাব্য কারিমের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ ও স্বয়ং লেখকের অনঘ অঙ্কন বইটিতে যোগ করেছে বিশেষ মাত্রা।
ব্যক্তিগত ব্যস্ততার চাপে ক্লিষ্ট হয়ে বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম হামিম কামালের এই উপন্যাস, শেষ করলাম অদ্ভুত এক প্রশান্তি ও মোহগ্রস্ততা নিয়ে। আর জানি, এর রেশ থেকে যাবে আরো কিছুদিন। এরপর হয়তো মাঝেমধ্যেই মানসপটে অবলোকিত হবে অলকানন্দা, কামিনীর টব আর বাগানবিলাসের সবুজ বাকেটটাকে ঘিরে বাঁধা দড়ির গিঁটখানা কিংবা ভেসে উঠবে ফুটপাতে ছোট করে বাঁধা বৃদ্ধ ঘোড়াটার ছবি!
পাখিদের কান্না শুনে আমাদের মনে হতে পারে গান। যদিও পাখিরা কাঁদে। ‘লিন্ডার বাগানবিলাস হয়তো সে পাখিদের কান্নার গল্প কিংবা এমন কোন ফুলের গল্প যে এখনও পৃথিবীতে আসেনি অথবা ঝরে গেছে বহুকাল আগে, তবুও তার গন্ধ টের পাওয়া যায় মনে।
এই উপন্যাসের মিস্টিক জার্নি পাঠককে এক লহমায় নিয়ে যাবে অপার্থিব কোন এক পাহাড়ের কাছে আর পাতা উল্টাতে উল্টাতে তার মনে হবে সে এক ভবঘুরে মেঘ।
দুর্বোধ্য মনে হলো। অনেক জায়গা অস্পষ্ট, ধোঁয়া ধোঁয়া। রেটিং দেয়া থেকে তাই বিরত থাকছি।
শুরুটা চমৎকার। জাফলংয়ে বন্ধুর মৃত্যু দিয়ে শুরু। গল্পের প্রোটাগনিস্ট কমল টিউশনি পড়াতে গিয়ে হঠাৎ নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত। আচমকা শ্বাসকষ্ট। পকেট থেকে ইনহেলার বের হলো। আমিও ভালো কিছুর জন্য নড়েচড়ে বসলাম।
ভালো দিয়ে শুরু করি। হামিম কামালের ভাষা কাব্যিক। কারুকার্যময়। বোঝা যায় অনেক ভেবে চিন্তে, রীতিমত নিক্তিতে ওজন করে একের পর এক শব্দ সাজিয়েছেন ভদ্রলোক। কয়েকটা জায়গার বর্ণনা তো রীতিমত সাইকেডেলিক। মুমূর্ষু এক ঘোড়া দেখে প্রোটাগনিস্টের আবেগী হয়ে পড়া ও কসাইয়ের নিষ্ঠুর হাত থেকে ঘোড়াকে মুক্ত করে দেয়ার কথাটা আলাদাভাবে বলা যায়। জাফলংয়ে বন্ধুর মৃত্যু আর ঘোড়াকে প্রকৃতিতে মুক্ত করে দেয়ার দৃশ্যটা বইয়ে আমার সবচাইতে প্রিয়।
এবার খারাপ যা লেগেছে তা বলি। সংলাপ অতিমাত্রায় কাব্যাক্রান্ত। সেজন্যই হয়তোবা সংলাপকে বাস্তবঘেঁষা মনে হয়নি। মনে হয়েছে লেখক জোর করে তার পাত্রপাত্রীদের দিয়ে সংলাপগুলো বলিয়ে নিচ্ছেন। ওরা একেবারেই প্রস্তুত না। আমি আবার র' ল্যাংগুয়েজের পূজারী। এ জন্য মানুষের নিন্দামন্দ কম খেতে হয় নাই। কিন্তু আমি যা না, তা তো লিখতে পারি না। তাই না?
আর চরিত্রগুলো খুবই ওয়ান ডাইমেনশনাল। সবাই খুব ভালো। কমল ভালো, শ্রাবণ ভালো, লিন্ডা ভালো, নীলিমা ভালো, এলা ভালো, ট্রাক ড্রাইভার ভালো, ফ্যাসিবাদী চা ওয়ালাও 'বেশ' ভালো। এত এত ভালো চরিত্র ঠিক হজম হচ্ছিল না। হয়তোবা নিজে খুবই মন্দ মানুষ বলেই এই সমস্যা।
একটু আক্ষেপ রয়ে গেল। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত বইয়ের দুর্বোধ্যতাও যদি ছাড়াতে পারতাম, রহস্যটা ধরতে পারতাম, তাহলে হয়তো আক্ষেপ ঘুচতো।
কোভিড আসার পর থেকে আমার একটি বইও পড়া হয় নাই। তবে আমাকে লিন্ডার বাগানবিলাসের পাণ্ডুলিপি পড়তে হয়েছিল। আমি মনে করেছিলাম, পারব না, মন বসাতে পারি না। কিন্তু আমি প্রথম থেকেই লিন্ডার সাথে হুকড হয়ে গিয়েছিলাম। মন খুব অস্থির থাকলে সম্ভবত এমন কোনো লেখার কাছে যেতে ইচ্ছে করে যেখানে গিয়ে বসলে মন শান্ত হয়ে যায়। হামিমের ধীরলয়ে বলা মাল্টি লেয়ারের এই উপন্যাসটি ঠিক তাই করেছে।
আমাদের চেনা জীবনের গল্প খুব সেনসিটিভ চোখে সাথে রহস্যঘেরা মিথ এবং রুপনিয়সীর একটি কনসেপ্ট। রুপনিয়সী শব্দটা নতুন। মজার ব্যাপার হলো, এটা না বুঝলেও সমস্যা নাই। আমার মনে হয় প্রতিটা পাঠক নিজের মতো করে আলাদা একটা অর্থ খুঁজে নেবে।
সবেমাত্র পাহাড় থেকে ঘুরে ফিরেছি আর বইটা আমার হাতে এলো! এইরকম কাকতালীয় ব্যাপারে আমি ব্যাপক মজা পাই। আগ্রহের জায়গা বাড়তে থাকলো আমার পরিচিত একজনের সাথে "কমল" নামের চরিত্রের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়ে.... খুব ধীর গতিতে দু-এক পাতা পড়ে যাচ্ছি আর রহস্যময়তা আবিষ্ট করছে আমায়। ভেতরে ভেতরে আকুলতা বেড়েই চলেছে আর ভাবছি রূপনয়সীর- মায়ার জাল , প্রকৃতির নিবিড়তা বড়ই অদ্ভুত! সে এক ভিন্ন আবেশে চেনা জগতের বাইরে টেনে নিয়ে দরজা মেলে দিলো আমি এতটাই হারিয়ে গেলাম বুদ হয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত কিংবা হয়তো থেকেই যাবো। লিন্ডার বাগানবিলাস -কে ছুঁয়ে দেখতে বড্ড ইচ্ছে হলো আরও কত কী... আহ! আমার মত খুদে পাঠকের জন্যে রেটিং এর ব্যাপারটা বড্ড নিদারুণ ।
বইটা মাল্টিলেয়ারড। প্রথম প্রায় অর্ধেক বা তার বেশি অংশ এগিয়েছে অনেকটা লিনিয়ারভাবে। আশ্চর্য সহজ এবং সুন্দর। কিন্তু লিন্ডা কাঠমুন্ডুতে যাওয়ার পর থেকে আমরা ঢুকে যাই অধিবাস্তবের জগতে। এরপর উপন্যাস তুমুল গতিতে ছুটেছে, নতুন নতুন দৃশ্য, জায়গা এবং চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে। প্রকৃতি, মাটি, বাতাস, আর মানুষের অনুভূতির মন্তাজ বরাবরের মতই অসাধারণ লেগেছে। কিন্তু কিছু কিছু জিনিস ডিসকানেক্টেড লেগেছে। যেমন মজনুর চরিত্র, রাজনীতিবিদের জীবনী। হামিম কামাল যখন রিয়ালিস্ট ঘরানায় লেখে তখন তা অত্যন্ত কোমল এবং পেলব হয়। আবার সে যখন প্রকৃতির সাথে অভিযানে বের হয়, সেটা যেন একদম চোখের সামনে ভাসে। সবমিলিয়ে হামিম কামালের সিগনেচার টোন বজায় থেকেছে এই উপন্যাসেও। তবে তার অধিবাস্তবতার দিকে টেনে নেয়ার যে প্রবণতা, সেটা কখনও পাঠককে ক্লান্ত করতে পারে। যেহেতু সে একরৈখিক বাস্তবতার চরিত্র এবং সংলাপ নির্মাণে অত্যন্ত দক্ষ।
হামিম কামালের লেখায় মানুষ যেমন চরিত্র, চরিত্র তেমন প্রকৃতিও। শহুরে পাহাড়ী দেশি বিদেশি জীবিত মৃত কত চরিত্রই না হেঁটে চলে বেড়ালো চোখের সামনে, জলের অনুরণন তুলে গেল বুকের ভেতর! আহা কমল, শ্রাবণ, নীলিমা, লিন্ডা, এলা লীরা মজনু- কত বিচিত্র মানুষের সঙ্গেই না দেখা হলো, হলো বন্ধুতা, হলো প্রেম! সুরময় সুখময় সুষমামাখা ভাষা হামিমের, লিন্ডার বাগানবিলাস উপন্যাসটি পড়তে পড়তে তাই স্নিগ্ধতায় ভরে থাকে প্রাণ। লেখকের প্রকৃতিমনস্কতা আর জীব ও জগতের প্রতি প্রেম আর তার ফলে ঘটে চলা একেকটা অনবদ্য ঘটনা- পড়তে হয় আর প্রেমে পড়তে হয় লেখকের আর তাকে ভালোবাসতে হয় আরো থেকে আরো। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনের বই, বাঁধাই ভালো, প্রচ্ছদ সুন্দর। বর্ণবিন্যাসও পাঠসহায়ক। তবে বানান ভুল প্রচুর। আর সবাই ভীষণ ভীষণ ভালো, অবাস্তব রকমের ভালো, মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। দুয়েক জায়গায় হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো উপন্যাস তার পথ হারিয়েছে, যেন ঘুরছে নিরুদ্দেশ। তবে দারুণ করে তা ফিরেও এসেছে, রোমাঞ্চকর যাত্রাশেষে পাঠককে পৌঁছে দিয়েছে ঠিকঠিক গন্তব্যে। সঙ্গে ছিল এর অসাধারন জীবনদর্শন, আর উপভোগের মন্ত্র। সব মিলিয়ে দারুণ পাঠাভিজ্ঞতা হলো। এমন বই বারবার পড়া যায়। প্রথম অধ্যায় তো এর মধ্যেই কয়েকবার পড়ে ফেলেছি..
দূর্দান্ত এক উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। কমল একটা ক্লাস টেনের মেয়েকে পড়াতে এসে এক ছবির প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শুরুতে বন্ধু আরিফকে হারিয়ে ফেলার গল্প করেন। যে গল্পে সিলেটের সেই প্রকৃতির মোহমায়া আর জাফলং। এই কমল বারবার কত ঘোরের মধ্যে ঢুকে যায় সেগুলোই উপন্যাসকে জীবিত করে তোলে। আমি প্রকৃতির বর্ণনা পড়ে এর আগে মুগ্ধ হয়েছি বিভূতির, তুর্গেনেভের আর মাসরুর আরেফিনের। তবে হামিম কামালের প্রকৃতি বর্ণনা অন্যরকম ঘোর লাগা বর্ণনা। ওনি যখন ফিরোজা রঙের জলের বর্ণনা দেন গাছের বর্ণনা দেন তখন মনে প্রকৃতি কথা বলছে।
সেই দশম শ্রেণির ছাত্রী এলার বোন লিন্ডার প্রেমে পড়ে যায় কমল। প্রেমে পড়ে লিন্ডার বাগান বিলাসেও। একদিন লিন্ডাকে খুঁজতে গিয়ে লিন্ডাকে না পেয়ে জানতে পারে লিন্ডা নেপাল চলে গেছে। মায়ের সীতাহার বেঁচে যখন নেপালে যায় কমল তখনই ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব ঘটনা । দেখা হয় লুইয়ের সঙ্গে।
লুইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েই ঘটে যত অবাস্তব ঘটনা। কেমন পরাবাস্তব সব ঘটনা। লুই আগে থেকেই সব জেনে বসে আছে। লিন্ডাকে খোঁজে দিবে বলে সঙ্গী হয় তার।
এরমধ্যে শ্রাবণ নীলিমার প্রেমের আভাস পাওয়া যায় যারা কিনা কমলের বন্ধু। শ্রাবণ আর নীলিমা মিউচুয়াল।
দেশে ফিরে এক মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার আর বই করে লাখখানেক টাকা ইনকাম হয় কমলের। তখন বান্দরবন যেয়ে পরে আরেক গভীর সমস্যায়।
নানান ঘটনার প্রবাহ, আর মাটি, প্রকৃতি, প্রকৃতি রূপ গন্ধ বর্ণনায় এক অনবদ্য উপন্যাস লিন্ডার বাগানবিলাস।
ভিন্ন রকম পাঠের অভিজ্ঞতা দেয় লিন্ডার বাগানবিলাস। থ মেরে বসে কিছু ভাবতেও বলে লিন্ডার বাগানবিলাস।
This entire review has been hidden because of spoilers.