প্রথম উপন্যাস আগস্ট আবছায়া-য় মাসরুর আরেফিন ঘুরে এসেছেন ইতিহাসে বর্বরতা ও সহিংসতার অলিগলি। দ্বিতীয় উপন্যাস আলথুসার-এ তিনি বুঝতে চেয়েছেন রাষ্ট্রের দমন-পীড়নের পাশাপাশি পরিবেশবাদী আন্দোলন ও শৈশবকে। আর তৃতীয় এ উপন্যাসে তিনি জানতে চাইছেন কারা চালায় এ পৃথিবী, কীভাবে তা চালায় তারা এবং কেন তা ওভাবেই চালায়, আর কেন ঠিক নির্দিষ্ট ওই একভাবে ‘সিস্টেম’-টা চলে বলেই টিকে থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থা? কী সেই ‘সিস্টেম’? এখানে ছাব্বিশ বছর পরে এক ভাই তার হারিয়ে যাওয়া বড় ভাইকে খুঁজছে দূর এক দেশের লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া এই কালে; দুই বন্ধু হিসাব মেলাতে চাইছে শৈশবের বরিশালে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর এক অন্যায়ের সঙ্গে পরের এক নৃশংস সাম্প্রদায়িক খুনের; আর নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এক লোককে তারই স্বদেশি ধনী বড় ভাই সাহায্য করতে রাজি কেবল ওই নিঃস্ব মানুষটার স্ত্রীকে বিছানায় নিতে পারার শর্তেই। সেই সঙ্গে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠতম রাশিয়ান কবি ওসিপ মান্দেলশ্তামের বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাহরণকারী হত্যাকাণ্ড যত তার জট খুলছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে কেন লেখকের ক্ষমতা রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিপরীতমুখীভাবে ক্রিয়াশীল।
ওভারগ্রাউন্ডে কি কোনো ‘সত্য’ নেই? ‘সত্য’ আছে কি কেবল আন্ডারগ্রাউন্ডে, যেহেতু ওখান থেকেই প্রসেস করা হয় মাটির ওপরের মৃত্যুগুলো? আর বিপ্লবের পরে রাষ্ট্র যে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তি আরও শক্তিহীন, সেটাও কি কেউ নিশ্চিত করে দেয় ওই আন্ডারগ্রাউন্ডে বসেই?
জন্ম- ১৯৬৯ অক্টোবরে, খুলনা। পড়াশুনা করেছেন বরিশাল ক্যাডেট কলেজ এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্ন-এ।
প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থ: ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প (২০০১)। বইটি সে বছর প্রথম আলোর নির্বাচিত বইয়ের তালিকায় মনোনীত হয়েছিলো।
মাসরুর আরেফিন বিশ্বসাহিত্য নিয়ে অবসেসড এক লোক। বিশ্বসাহিত্যের মহান লেখকদের উপর উনার পড়াশোনা ও বিদগ্ধতা প্রশংসনীয়। সাহিত্য উনার চিন্তা-চেতনা জুড়ে সর্বক্ষণ থাকে। সবকিছুই অক্ষরের জগতের মাধ্যমে দেখার প্রবণতা টা নাকি অনেকেরই থাকে।সেই তালিকায় শাহাদুজ্জামান, বুদ্ধদেব বসুরা ছিলেন। আকাশে সাদা ভাসমান মেঘপুঞ্জ তাদের অবধারিতভাবে মনে করিয়ে দেয় বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘদল কে। আমি অত্যন্ত সাধারণ এক যুবক হয়েও বিস্মিতভাবে খেয়াল করেছি যে, পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু বইয়ে পড়া অভিজ্ঞান দিয়ে অনুভব করি। মাসরুর আরেফিনের উপন্যাসের নায়কেরা প্রেম,বিষাদ,রিরংসা সবই অনুভব করেন কাফকা,জীবনানন্দ, ওসিপ অথবা প্রুস্তের লেখা দিয়ে।মাসরুর আরেফিনের লেখার এই ব্যাপারটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। তাছাড়া উনার ব্যতিক্রমী গদ্যশৈলী প্রশংসার দাবীদার।
আরেফিনের উপন্যাসের বিস্তৃতি ব্যাপক হয়। আন্ডারগ্রাউন্ড ' বরিশাল থেকে শুরু করে রাশিয়া ঘুরে শেষ হয়েছে ওসিপ মান্দেলশতামের বন্দী কামরা পর্যন্ত। মাসরুর আরেফিনের সমস্যা টা হলো তিনি লেখার আগেই ঠিক করে নেন যে তাকে বিশ্বমানের মহৎ উপন্যাস লিখতে হবে। সে জন্য তিনি উপন্যাসে সচেতনভাবে নিয়ে আসেন পৃথিবীর প্রায় সমস্ত কিছু। এবং শেষমেশ দেখা যায় যে সমস্তটা উপন্যাস হিসেবে সংহত না হয়ে, হয়ে যায় জগাখিচুড়ী। ফলে উনার জাদুকরী গদ্যে আমরা পেয়ে যায় অর্ধ-পাকানো আফসোস-যোগ্য উপন্যাস। মাসরুর আরেফিন পৃথিবী এবং জীবন নিয়ে গভীরভাবে ভাবুক লেখক। আঁটসাঁট বেধে পৃথিবীর মহৎ উপন্যাসটা লেখবার বদলে উনি যদি নিজ মননশীলতার গহীনে ডুবে নিজস্ব ভাব-সৌন্দর্যের একান্ত বিবরণ লিখতে বসেন, আমার বিশ্বাস একমাত্র তখনই উনি মহৎ কিছু লিখতে পারবেন।
কিছুটা মাস্টার অ্যান্ড মার্গারিটা ভাইব পেয়েছি। সাধারণ পরিস্থিতি থেকে হুট করে অস্বাভাবিক, স্যুরিয়েল, দুঃস্বপ্নের মত পরিবেশ তৈরি, আবার হুট করে স্বাভাবিকে ফেরত আসার juxtaposition টা চমৎকার। লেখকের মুন্সিয়ানার তারিফ করতেই হয়, তবে হয়তো গল্পটা বড় গল্প হিসাবেই ভাল ছিল। বড় গল্প থেকে উপন্যাসে রূপ দিতে যাওয়ায় প্লটের tightness কিছুটা কমে গেছে।
একমাত্র প্রধান নারী চরিত্র ভালেন্তিনা কে দেখা মাত্র প্রটাগনিস্ট এর ইয়ে খাড়া হয়ে যাওয়া, প্রতি মুহূর্তে তার শরীরের বর্ণনা, শেষ পর্যন্ত তাকে ধর্ষণ, এই অংশটা দিয়ে যদি লেখক পুরুষালি সমাজে নারীর অসহায়ত্ব বুঝাতে চেয়ে থাকেন, তাহলে বলব এই কনসেপ্ট চর্বিত চর্বন, আর আমি বাঙলা উপন্যাসে এভাবে নারীদের দেখতে দেখতে ক্লান্ত। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর উপর যৌণ নিপীড়ন ছাড়াও আরো অনেক রকম নিপীড়ন আছে, এরকম mature উপন্যাসেও সেই নারীর দৌড় বিছানা পর্যন্ত ব্যাপারটা একটু বিরক্তি উদ্রেককর এবং হতাশাজনক।
উপন্যাসশিল্পের প্রথাশাসিত গৎবাঁধা সংজ্ঞা মানার বাধ্যবাধকতা ও দায় আধুনিক কথাশিল্পীর কতোটা, তা গবেষণার বিষয়। প্রথা ভেঙে শিল্প-সাহিত্য তৈরি করে নেয় নতুন পথ। সংজ্ঞাশাসনের আলাপে না গিয়ে লেখক মাসরুর আরেফিন এর আলোচিত উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পাঠ-আলোচনা করা যেতে পারে। প্রতিভার অভিজ্ঞতাকেন্দ্র ও আবিস্কারশক্তির নির্যাস না জেনে তাঁর উপন্যাসের বিচ্ছিন্ন-বিবেচনা আংশিক, ভাসা ভাসা, শিল্পের প্রতি অবিচার। লেখকের ইতিহাসজ্ঞান, জীবনঅভিজ্ঞতা, কাললগ্ন মনের ঐক্যবিন্দু তাঁর সৃষ্টির নিগূঢ় সত্য। শিল্পরূপটি তাই বুঝতে লেখক-শিল্পীর মানসগঠনের খনন জরুরি। মাসরুর আরেফিনের চেতনালোক ঐশ্বরিক মেধা, ক্যাডট কলেজ ও বিদেশে অধ্যয়ন, শীর্ষব্যাঙ্কারের জটিল নিকেশ ও কর্পোরেট জগতের চমকরঙিন অভিজ্ঞতায় শুধু সীমায়িত নয়। বাণিজ্যের যোগবিয়োগের পর দিনশেষে তিনি রিডিংঘরে অভিনিবেশমুগ্ধ ভিন্ন মানুষ। তাঁর সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার প্রাণসূত্র একদিকে জন্মজাত; অন্যদিকে পরিমাপের গন্ডি পেরুনো, বিস্তৃত। বিশ্বাসমুগ্ধ শোনিতপ্রবাহ ধারণ করে জন্ম-বেড়েওঠা হলেও তাঁর শিক্ষার্থীকাল বাম আদর্শ বা সমাজতন্ত্রের মুগ্ধতাগ্রাহী। কয়েকশ’ বছরে দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধ, পশ্চিমা গণতন্ত্র, ধনবাদের ভোগমুখী জীবন, ইউরোপীয় রেনেসাঁসস্নাত মানবতাবাদের বিস্তার, মিথাশ্রয়ী ভূভারতের নবজাগরণ, চীন-রাশিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, ভারতীয় জাতীয়বাদ, দ্বিজাতিতত্ত্ব, দেশভাগ, শিল্পবিপ্লব, প্রযুক্তি বিপ্লবের মতো নানা ঘটনার-দূর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিশ্বসমাজ । মাসরুর এই প্রত্যক্ষদর্শনের অংশ কিংবা উত্তরাধিকার। এসব ঐতিহাসিক-সামাজিক জ্ঞান লেখকমানস সংগঠনের ভিত্তিমূল। মাসরুরে মিলেছে আরও তাঁর প্রথাবিরুদ্ধ জীবনজিজ্ঞাসা-আত্মব্যকুলতা, দেশকালভাষা নির্বিশেষে সাহিত্যের বিপুলবিশালপাঠ। ফলে তাঁর চেতনালোক ও প্রেক্ষণবিন্দু নির্মোহ, সংস্কারমুক্ত, আন্তর্জাতিক ও বহুবিস্তৃত। গ্রামজ শহরে বেড়ে ওঠা আর বাংলা সাহিত্যের জীবনান্দ, বিভূতিভূষণ, কমলকুমার, তারাশঙ্কর, মণীন্দ্রগুপ্তে মতি তাকে যেমন করেছে তৃণমূলবুঁদ; তেমনি বিশ্বসাহিত্যের কাফকা, বোর্হেস, দান্তে, ভার্জিল, চেখভ, গোগোল, গোর্কি, সেবাল্ট, হেমিংওয়ে, সমারসেট মম প্রমুখের বিপুল বৈভব করেছে আন্তর্জাতিকতায় ঋদ্ধ, সীমান্তঅতিক্রমী। পাঠ করে ধারণা করি, সমাজ ক্রমবিকাশের জটিল প্রবাহে বিশ্বময় হত্যা, হানাহানি, নৈরাজ্য, কমিউনিজমের পতনজনিত হতাশায় তাঁর মানসচেতনা দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ, চঞ্চল, অমীমাংসিত। সমাজসংসারের মধ্যবিত্তধর্মী মিষ্টি বিশ্লেষণ করে পাঠকতুষ্টিতে তাঁর নিরাসক্তি ও অনাগ্রহ। বরং তাঁর কাছে তা সনাতন, বিপজ্জনক, কাপুরুষোচিত আত্মপ্রবোধ। তাঁর সৃজনশীলতার শক্তিকেন্দ্র দ্বন্দ্বমুখর, থমকেথাকা বলে তা তাড়িত ও উদ্যমরত - অনন্তসময়ের মধ্যে গড়ে ওঠা সভ্যতার সিস্টেম, রাষ্ট্র, ক্ষমতার অন্তরালসন্ধানে। কাজে কাজেই জীবনভাবনায় মাসরুরের সতত বিকাশশীল চেতনালোকের এই ইন্টারিমে যেসব লেখা পাবো, তা কার্যত সময়-সভ্যতার রূঢ় ইতিহাস বোধের নিগূঢ় সংমিশ্রনের শিল্পরূপ। প্রথাপরিবেষ্টিত উপন্যাসের আখ্যান, প্রেম-রোমান্টিকতা, নায়ক-নায়িকার মিষ্টি বা ট্রাজিক পরিণতি তাঁর অন্বিষ্ট নয়। মাসরুরের রূপকী প্লট, চরিত্র, ভাষাভঙ্গি, চরিত্রচিত্রণ- সমকালচেতন। সমাজরাষ্ট্রের পাতালপ্রণালির নির্মমতা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকতে শিল্পমোড়কে তা ভোক্তাপাঠককে নিয়ত প্ররোচনা দিতে থাকে, মীমাংসা দিয়ে থিতু করে না। মীমাংসা দেয় না বলে তা আরোপদুষ্ট অভিযোগের উর্ধ্বে। উপর্যুক্ত বিষয়গুলোকে সামনে রেখে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’পাঠে ব্রতি হলে এর শিল্পরূপটি ধরা যাবে। লেখক উপন্যাসের পরিকল���পিত পরিণতিকে চিত্রিত করতে আখ্যান শুরু করছেন মস্কো শহর থেকে। নাটশেলে প্লটটি হচ্ছে, কথাকার উত্তমপুরুষ নায়ক ‘আমি’ পেশায় সাংবাদিক-ঢাকার পত্রিকার তরুণতম সম্পাদক, মস্কো এসেছেন সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে যোগ দিতে। ছাব্বিশ বছর আগে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির তরফে রাশিয়ায় পাড়ি জমানো পরিবারবিচ্ছিন্ন অগ্রজ শামসুল আরেফিনকে খুঁজে বের করাকে মিশন হিসাবে নিয়েছে। হারানো ছেলের সঙ্গে মায়ের কথা বলার আকুতি নায়ককে এই মিশন নিতে প্রণোদিত করেছে। সে ঢাকার সাংবাদিক বন্ধু রাহাতের অনুজ রাশিয়াপ্রবাসী সাদাতের সাহায্য নেয়। কমিউনিজম ও রুবলের পতনে দেউলিয়া সাদাত বিষাদগ্রস্থ ও আত্মহনোন্মুখ। তার স্ত্রী বাঙালি-রাশান শংকর সুন্দরী ভ্যালেন্তিনা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক। বরিশালের ভাটিখানায় একসঙ্গে বেড়ে ওঠা নায়কের বাল্যবন্ধু কামাল রাশিয়ায় বিলিওনিয়ার। সে প্রতাপশালী শাসক ভ্লাদিমির পুতিনের ৩৫ নম্বর সার্কেলের লোক। ভাইয়ের অনুসন্ধানের সুবাদে সাদাত-ভ্যালেন্তিনার সঙ্গে নায়েকের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। তারা নায়কের কাছে ধন্যাঢ্যপ্রবাসী কামাল প্রসঙ্গ ওঠায়। কামালের সঙ্গে কথোপোকথনে সমকামকাতর হিন্দু গৃহশিক্ষক প্রদীপ বসাকের সম্প্রদায়সঙ্কট ও মৃত্যুর স্মৃতিময়তা উথলে ওঠে। একরাতে কামাল নায়ককে মস্কো আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের এক উদ্ভট-দুনিয়া দেখায়। পৃথিবীর অদেখা সিস্টেমের নাড়িভুড়ি উন্মোচিত হয় সেখান থেকে। ভাতৃসাক্ষাৎ সাদামাটা ভাবে শেষ করে নায়ক মনোনিবেশ করে রাশিয়ার প্রখ্যাত কবি ওসিপ মান্দেলশ্তাম হত্যাকান্ড রহস্য উন্মোচনে। কবির মস্কোর ফ্ল্যাট-যা এখন জাদুঘর- দেখতে যায় নায়ক, সাদাত ও ভ্যালেন্তিনা। ওসিপ এক্সপার্ট চেচেনযোদ্ধা তকদিরভ, মারা ভোরহিস, প্রিসবিলস্কি, তারানোভস্কি, পিনখোস, দিমিত্রসহ নানা চরিত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া, পুলিশী জেরা, অভিনয় ও ফিল্মের মাধ্যমে কবির জীবনকৃতি উঠে আসে। নায়কসহ দর্শণার্থীরা নাটকীয়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ডাকাতির শিকার হয় এখানে। পরে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠা ভ্যালেন্তিনা হোটেলের নায়কের কক্ষে এলে নায়ক ভোগলিপ্সায় মেতে ওঠে এবং তরমুজ খেয়ে এর সমাপ্তি টানে। রাতে গাইড দিমিত্রির কাছ থেকে নায়ক কবি মান্দেলশ্তামের মৃত্যুর ফাইলটি কব্জা করে এবং রহস্যের জট একটার পর একটা খুলতে থাকে। ঢাকা ফেরার দিন তাকে এয়ারপোর্টে আটকে আন্ডারগ্রাউন্ড সম্পর্কে জেরা করা হয়। জেরার উত্তরে পৃথিবীর সিস্টেম এবং ওসিপের মৃত্যুর নেপথ্য উঠে আসে। ২. বার্তামুখ্য রাজনৈতিক উপন্যাসের-যা রাষ্ট্রীয় নীপিড়নের প্রমাণ অনুসন্ধানে এগোবে-আখ্যান জমজমাট করা বা ঘটনাসংগঠন জটিল। বক্তব্যের তাগিদে গল্পের নান্দনিকতা ক্ষুন্ন হওয়া স্বাভাবিক। মাসরুর আরেফিন দেশি-বিদেশি উপন্যাসশিল্পের অন্দর মাড়ানো মানুষ বলে জটিলকে করে তুলেছেন জলবৎ। দক্ষ ঔপন্যাসিক ঘটনা পরম্পরাকে সুক্ষ্ন অন্তর্বয়নের মাধ্যমে জীবনের নিগুঢ় সত্যে প্রস্ফূটিত করে তোলেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে গল্পের গতি, বলার মুন্সিয়ানা, ঘটনাস্রোতের মধ্যে ভাবালুতাময় ফ্ল্যাশব্যাক, নাটকীয়তাসৃজন, চরিত্রচিত্রণ- সব মাপকাঠিতে লেখক শিল্পসিদ্ধির প্রমাণ দিয়েছেন। এতে সজীব-চলমান চরিত্র চেচেন মুসলিম তকদিরভ, রাশান গাইড দিমিত্রি, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির বলি শামসুল আরেফিন, ওসিপ জাদুঘরের মারা ভোরহিস, ইমিগ্রেশন পুলিশ দ্রাজদাপারমা নিজ নিজ শ্র্রেণীর প্রতিনিধি। নব্য ধনী ও প্রতাপশালী মাফিয়াশ্র্রেণীর প্রতিনিধি কথকের বন্ধু কামাল, কমিউনিজমপতনে আর্থিক দেউলিয়াত্বে বিপন্নমানস যুবার প্রতীক সাদাত, বিপন্ন স্বামীর স্ত্রী হিসাবে লক্ষ রাশান নারীর প্রতীক ভ্যালেন্তিনা উপন্যাসের গল্পকে টানটান করে এগিয়ে নেয়। আন্ডারগ্রাউন্ড নামের উদ্ভট পাতালজগতের জেনারেল ফ্লাইশটারমেশ্টার, খাম খাম, খ্যাঁক সেআল, টানাপার্টির বোগলি, ওলগাসহ নানা চরিত্র ; অদৃশ্য, রহস্যময় ও চমৎকার চরিত্র ‘মিকি’, ড্রাগন ও ‘সেবাস্তিয়ান’ নির্জীব হলেও আখ্যানের মাধুর্য বাড়ায়। প্রয়াত মান্দেলশ্তাম উপন্যাসকে চালিত করলেও ঐতিহাসিক বা রেফারেন্স চরিত্র মাত্র। নায়ককে সারাক্ষণ সঙ্গ দিয়ে যায় সাহিত্যজ্ঞানদীপিত নায়িকা ভ্যালেন্তিনা- উদ্ভিন্নযৌবণা, ফ্রেগ্রেন্সপ্রিয়, বাঙালি-রাশান সুন্দরী। ঐতিহাসিক ঘটনার পারম্পর্য রক্ষা, আখ্যানের বিকাশ ও বক্তব্যময়তার একঘেঁয়েমি কাটাতে চরিত্রগুলো সজীব, চলমান ও সংলাপমুখর। চরিত্রচিত্রণ এ উপন্যাসের বড় এক সাফল্য। মনীষীগণ বলেন ‘উপন্যাস হচ্ছে জীবনার্থের রূপান্বিত রূপক’। ‘পরীক্ষাপরিশীলিত চেতনাস্রোতের শব্দনির্মিত রূপকল্প’ই উপন্যাস (প্রফেসর সৈয়দ আকরম হোসেন)। ঔপন্যাসিকের আত্মবোধের সমগ্রতায় আবিস্কৃত জগৎ-জীবনের পরমার্থ উপন্যাসশিল্পের অন্বিষ্ট। আগেই বলেছি, নিয়ত পরিবর্তনমান পৃথিবীতে জটিল জীবনবাস্তবতাকে শিল্পে তুলে আনতে আধুনিক ঔপন্যাসিক সংজ্ঞার ঘেরাটোপ মানবেন কিনা সেটা এক প্রশ্ন। কারণ আধুনিক লেখকের আত্মবোধে জীবনার্থ যেখানে অমীমাংসিত, নিয়তসন্ধানশীল- তিনি উপমহাদেশীয় আদলে জীবনের পরমার্থের সন্ধান কেন দেবেন? রবীন্দ্রনাথের নায়করা পারিবারিক-সামাজিক দ্বন্দ্বের মধ্যেই ব্যক্তিচেতনাকে সমুন্নত রেখে জীবনসন্ধানী। মাসরুরের নায়ক জীবনের অর্থ নিয়ে দ্বিধাময়। জীবনার্থে দোদুল্যমানতা, পরিণতির বহতার জন্য-হতে পারে চেখভপ্রভাবিত- মাসরুরের ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ প্রথাফাড়া, বিরলব্যতিক্রমী, স্রোতবিপরীত উপন্যাস। তা লেখকের উপলব্ধিকে অন্যের ওপর আরোপ করে না, পাঠককে উস্কে দেয়, ভাবিত করে। বৃত্তাবদ্ধ প্রশমিত নির্দ্বন্দ্ব জীবনসত্যে থমকানোর বদলে এতে চলমানতার চমক- “সে বুঝল এখানকার তিনজনই আমরা নানা ধরনের জীবনযন্ত্রণার করুণ গল্পের সামনে বিস্রস্ত বিভ্রান্ত এবং বাংলাদেশ থেকে কাজে মস্কো আসা এই চেনা ভদ্রলোকের হাত তার স্ত্রীকে হয় অভয় দিচ্ছে, না হয় তাকে সাহস জোগাচ্ছে এ রকম খুনে ও মাত্রাজ্ঞানহীন এক সময়ে বেঁচে থাকা নিয়ে। ”(পৃষ্ঠা-২৯)। “ জীবনের মানে বোঝার জন্য যেমন চেখভ পড়া জরুরি, জীবনের মানেহীনতাকে উপলব্ধি করার জন্যও তাই। ….কারো জীবন হয়তো অনেক বেশি গোছানো, সার্বিক বিচারে সংহতি ও সঙ্গতিপূর্ণ, জীবনের লক্ষ্যগুলোও ধাপে ধাপে বিন্যস্ত করা আর কোনো একটা প্যাটার্ণ মেনে সুন্দরও, তার মানে অফিশিয়ালি সেই লোকের জীবন মিনিংফুল”…(পৃষ্ঠা-৩৩) “ আমি কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম জীবনের মিনিং নিয়ে। সিম্পল কথা এই ছিল যে, কারো জীবন দেখা গেল হয়তো ফরম্যালি মিনিংফুল, কিন্তু সেই জীবনের মরাল কন্টেন্ট ফাঁপা, তুচ্ছ, কদর্য…তিনি (চেখভ) বহুগল্পে একই মানুষের জীবনে মিনিংয়ের এই দুই বিপরীতমুখী ধারা থাকবার কথাটা অনেকবার বলেছেন”(পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫)। “ মানে, কারো কাছে জীবনের মানে হয়তো ক্ষমতা থাকা, কারোর কাছে ধন, কারোর কাছে ভালোবাসার উপস্থিতি, সম্মান, স্বাধীনতা ইত্যাদি; আবার কারোর কাছে এর মানে একটা প্রাণখোলা হাসি, কিছু প্রবল-প্রগাঢ় জীবনাভিজ্ঞতা, দেশের জন্য কিছু করা, আত্মত্যাগ; আবার অন্য কারো কাছে তা জীবনে খোদার উপস্থিতি” (পৃষ্ঠা-৩৫)। নামস্বার্থকতা উপন্যাসে শিল্পসিদ্ধির একটি উপাদান। এখানে সাংবাদিক হিসাবে নায়ক কনফারেন্সে যোগ দিতে মস্কো গেলেও ‘মিশন’ হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির জেরে মস্কো পাড়ি জমানো অগ্রজকে খুঁজে বের করা, দেশে ফিরিয়ে আনা, সন্তানপ্রাণ বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দেয়াকে। মস্কোপ্রবাসী বাল্যবন্ধু কামাল ‘মস্কো আন্ডারগ্রাউন্ড’ নিয়ে গেলে বিভিন���ন চরিত্রের সঙ্গে কথোপোকথন ও দৃশ্যের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সিস্টেমের অন্তর্গত রহস্য ভেদ হয়। আবার রাষ্ট্রীয়ভাবে নিগৃহীত কবি ওসিপ মান্দেলশ্তামের মুত্যু রহস্যের ফাইলটিও আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে আবিষ্কার করে আলোয় আনা হয়েছে। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামটি তাই সফল। উপন্যাসটির মজাময় চমক এর গদ্য। ওয়াডালি ব্রাদার্সের ঠুমরির তানের মতো এর গতি গীতলগদ্যস্নিগ্ধ। তা সতত তরঙ্গের মতো ওঠানামা করে। ঘটনা-অনুঘটনার জটিল বিন্যাস তর তর করে উঠে যায় স্বরলিপির নি সা’র ক্লাইমেক্সে, পরক্ষণে নেমে আসে ‘সা রে’ র নষ্টালজিয়ামুগ্ধ শৈশবের তৃণমূলে। বর্ণনায় লেখককে শব্দ হাতড়ে ফিরতে হয় বলে মনে হয় না।- “বলা হতো, ভাটিখানার সবার গায়ে কূপ পাখির ছায়া পড়েছে। …ওই আঁধার ফুঁড়ে সে ডাকত তার থরথরে অসুখাবহ ডাক-কূউপ, কূউপ। আমরা সেই ডাক শুনে স্নায়ুবিবশ চেহারা নিয়ে একে অন্যকে বলতাম, হুমম, কেউ না কেউ সামন���ই মারা যাবে……কিন্তু ঘর থেকে ঘরে ঠিকই ছড়িয়ে পড়ত এমন কথা যে, লাশ বস্তায় ভরে ফেলে দেওয়া হয়েছে আমানতগঞ্জের বিলে কিংবা মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে গোরখ ফুল ও ছাতিম-কদমের ঝাড় পার হয়ে যে মান্দারের পাষাণঝাড়, সেখানে…” (পৃষ্ঠা-৯)। “…আমাদের এই আপাত সুখী পরিবারটা-লালভাঁট, বনজুঁই, টমেটো, পাতাবাহার, মোরগফুল, গন্ধরাজ ও শেফালির ঝাড়ে ঘেরা একতলা দালানে কষ্টেসৃষ্টে হাসতে হাসতে দিন কাটানো পরিবারটা-সোজা নিক্ষিপ্ত হলো এক শোকের মধ্যে-”(পৃষ্ঠা-১৩) “মনে হলো, আমি চারপাশের এই রোদচঞ্চল সময়ের পাথরস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে নিজের মৃত এক স্থির অতীতের সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করছি শুধু, অর্থ্যাৎ উন্মাদের মতো নিজের হারিয়ে যাওয়া কন্ঠস্বরেরই প্রতিধ্বণি তুলছি এতক্ষণ” (পৃষ্ঠা-১৪)। “আমার বোধের জগতে খাড়া হতে চাইল যা কিছু ‘রাশিয়ান’ তার সব-বলশয় থিয়েটারের গায়ে ‘সোয়ান লেক’ এর বিজ্ঞাপনের অপার্থিব আলোর ঝলক; রেড স্কয়ারে সেন্ট বাসিল ক্যাথড্রালের রঙিন পেঁয়াজের মতো গম্বুজে বিচ্ছুরিত সূর্যালোক;মেট্রোপল হোটেলের সামন চার বন্ধুর হা হা হাসি, যার মধ্যে একজন পরিস্কার মিথ্যা বলছে; আমার হাতের ডানে কাচে ঘেরা রেস্তোরাঁর কোনার টেবিলে এক গ্লাস রাশিয়ান বিয়ার ও তার সোনালি রং; গাছের পাতায় বাঁকা হয়ে বসা একটা একশ রং-পাখি;আর সুন্দর এক রাশিয়ান তরুণীর মাটিকে ঝুঁকে পড়ে কেডসের ফিতা বাঁধা, যার ফলে অন্ধকার এক টানেলের মতো দেখাল তার দু বুকের মাঝখানের শূণ্যতাটুকু”(পৃষ্ঠা-২৫)। আহা! কলেবরবৃদ্ধির রাশ টানতে বেশি উদ্ধৃতি না দিলেও বলতে পারি, বলকে বলকে উথলে ওঠা শৈশবের এই ‘ভাটিখানা’, ‘আমানতগঞ্জের বিল’, ‘কূ উ প পাখি’, ‘ছাতিম-কদম’, ‘মান্দার’, ‘লালভাট’,’বনজুঁই’, ‘পাতাবাহার’, ‘গন্ধরাজ’ , ‘শেফালি’, ‘একতলা দালান’ একদিকে লোকায়ত জীবনউৎসারিত, অন্যদিকে সীমান্তঅতিক্রমী আখ্যানস্পর্শী বলে আন্তর্জাতিকও। ওপরের উল্লেখসমূহ বাদেও গীতলগদ্য স্বপ্নরঙিন পাখা মেলেছে উপন্যাসের নায়িকা ভ্যালেন্তিনার চরিত্রচিত্রণ ও উপস্থিতির মুহুর্তসমূহে। ভ্যালেন্তিনা চরিত্রটি বক্তব্যবহুল উপন্যাসটিতে আগাগোড়া নায়কের সঙ্গেই শুধু লেপটে থাকে না, পাঠককে কুহকময় ঘোরে রেখে পাঠপ্রশান্তির প্রণোদনা দিয়ে যায়। সুন্দরী ভ্যালেন্তিনাকে বাদ দিয়ে এ উপন্যাস কল্পনা করা যায় না। তাঁকে ঘিরে নায়কের রোমান্সঘোর অতুলনীয়, লোভনীয় ও লেখকের মনোযোগনিষ্ঠ।- “আমি ভ্যালেন্তিনার বৈকাল লেকের স্বচ্ছ জলের মতো তরঙ্গিত হাসির সামনে চন্দ্রগ্রস্থ হলাম এক মুহূর্তের জন্য।“(পৃষ্ঠা-২৬)। “আমি ভ্যালেন্তিনার চোখ দেখতে পেলাম প্রথমবারের মতো-টানা আয়তাকার, যেমন হয় সুন্দরী রাশিয়ান-পোলিশ-ইউক্রেনিয়ান মেয়েদের, আর তাতে ঘুম না হবার ক্লান্তি ও সমস্ত বাস্তবতাকে উপেক্ষ করে পাহাড়ে বেড়াতে যাবার ইচ্ছার ঝলকানি” “আমি তাকিয়ে আছি ভ্যালেন্তিনার চোখের দিকে এমনভাবে যেনবা ও দুটোর ভেতরেই কোথাও আছে ইরকুতস্কের রেলস্টেশন, যেখানে নামলে পরে যাওয়া যায় বৈকাল হ্রদের পাড়ে” (পৃষ্ঠা-২৮)। “আমি দেখলাম, ভ্যালেন্তিনার হাত কেমন ভেজা-ভেজা, আর সে নিশ্চয় দেখল যে, আমার হাত শক্ত....”(পৃষ্ঠা-২৯)। “ আমি ভ্যালেন্তিনার মুক্তোদানার মতো ঝকঝকে সাদা দাঁত দেখতে লাগলাম। দাঁতের ওপরে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ সূক্ষ্ম দুই জলবুদ্বুদও দেখলাম। এত সুন্দর ছিল ওই বুদ্বুদ দুটো যেমন কিনা আমি পুরো জীবনে আর দেখিনি”(পৃষ্ঠা-৩১) । “আমি তার চুলের থেকে এবং গায়ের থেকে আসা পারফিউমের এক আজব গন্ধ পেলাম-গন্ধটা পুডিংয়ের, অনেক লবঙ্গ মেশানো পুডিং; গন্ধটা নেশা ধরানো, গন্ধটা সন্ধা রাতের, গন্ধটা প্রাদোষিক.......” (পৃষ্ঠা-৩২)। “আমি দেখতে লাগলাম তার সুদীর্ঘ আঙুল এবং টকটকে লাল নেলপলিশ লাগানো কনিক্যাল শেপের নখগুলো, আর বিশেষ করে তার হাতজুড়ে অনেক ছোট সোনালি রোম, সে কী মারাত্মক সোনা ঝরানো রোম তারা” (পৃষ্ঠা-৩৩)। .......“আমি এমনকি ভ্যালেন্তিনার মুখের বেশি কাছে চলে এসেছি,.........এমনকি দেখে ফেলেছি যে, তার দাঁতের সামনের দিকে ঠোঁটের নিচে লুকানো দুটো ছোট-কুকুর দাঁত বা বিউটি-টুথও আছে, এমনকি দেখেছি যে, তার বুকের মাঝখানের টানেলটার গায়ে প্রতিফলিত হচ্ছে আকাশের ময়ূরকন্ঠী নীল এবং সেই টানেল ধরে উড়ছে অস্থিরতার অসংখ্য প্লেন” (পৃষ্ঠা-৪৫)। “ভ্যালেন্তিনার বৈকাল হ্রদের মতো গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে ভেসে যেতে লাগলাম নিপীড়িত-উৎপীড়িত রাশিয়ার মালভূমি ও পাহাড়গুলোর ওপর দিয়ে-এর ভলগা নদীতে ভেসে চলা নৌকা, এর নোভোসিবিরিস্কের সেন্ট, নিকোলাস চ্যাপেল, আবখাজিয়ার স্তেপে ক্লান্ত ঘোড়ার দল, কাজান শহরের বাসস্টেশন, স্মোলোনেস্কের ‘শিখা অনির্বাণ’ স্মৃতিসৌধ, কামচাটকার আগ্নেয়গিরি আর সেন্ পিটার্সবার্গে ভ্লাদিমির নবোকভের পৈতৃক প্রাসাদ, এইসব কিছুর ওপর দিয়ে আমি উড়তে লাগলাম এক মায়াভরা চোখের ভেতরে পৃথিবীর প্রারম্ভ ও কালগ্রাসকে দেখতে দেখতে। কেবল নারীর চোখই পারে পুরুষকে এভাবে সময়ের বৃত্তের ওপারে নিয়ে যেতে,.......(পৃষ্ঠা-৪৭)। …”ও ভ্যালেন্তিনা, মস্কোর রোদ কেমন কলহাস্যেভরা, দিঘল;ও ভ্যালেন্তিনা, উত্তর মেরুতে রাতগুলো যখন নামে তখন ফ্লেমিঙ্গো পাখিগুলো লেকের পাড় গুলজার করে ছাড়ে; ও ভালোবাসা, তুমি একই সঙ্গো তোরাহ ও ত্রিপিটক, দুই ঊরুর কাছাকাছি মসৃণতা, আর আমরা অদূষিত ওই মিলনগুলোর শেষে অদূষিত ঘুমের মধ্যেই হারিয়ে যাই; ও ভ্যালেন্তিনা, সে অর্থে প্রেম ও মৃত্যু কাছাকাছি সময়েই আসে” (পৃষ্ঠা-১১১)। “আমি লক্ষ্য করলাম, ট্যাক্সির ভেতর ভরে গেছে ভ্যালেন্তিনার দীর্ঘ কালো চুলে আজ সকালে লাগানো শ্যাম্পুর সুবাসে। সেই গন্ধ সুখী, আনন্দঘন ও স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ভোররাতে ঘুমের শেষে নিশা অবসানের গন্ধ, যার মধ্যে তাম্রযুগের পৃথিবীর প্রথমাবস্থার টোন ও ডেফিনেশন বিদ্যমান”(পৃষ্ঠা-১৯৫)। ভ্যালেন্তিনা নামের মাদকতাময় মেয়ে লেপ্টে থাকে প্রেম-কাম, রোমান্স আর মায়াময় সৌন্দর্যের প্রতিভূ হয়ে শেষাবধি। বর্ণনাসমূহ ঔপন্যাসিকের গভীর জীবনদৃষ্টি ও অনুপূঙ্খ বয়ানকৃতির প্রমাণবহ। ৩. আধুনিক ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ চরিত্রের বেদনা, মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট ও বিশেষ মূহুর্তকে প্রকৃতির মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে অপরূপ শিল্প সৃজন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের শিল্পকৌশলটি চেতন-অবচেতনে ব্যবহৃত হতে দেখি এখানে। মাসরুরের অন্যতম শিল্পরূপ বুঝতে ওই টেকনিকটি স্মরণে রাখতে হবে। নায়ক ও ভ্যালেন্তিনাকে রেখে সাদাত পানি বা কোক আনতে গেলে অন্তর্বাস সমস্যায় একহাতে জ্যাকেট ধরে অন্যহাতে বুক-পিঠ চুলকাতে থাকে ভ্যালেন্তিনা। এই অস্বস্তি ছড়িয়ে যায় আকাশনীলে... “এ মুহূর্তে আকাশ বেয়ে বহুদূরে, এমন যে, অন্য আকাশের গা ধরে কোনাকুনি, উড়ে যেতে লাগল চার চারটে প্লেন, সাদা ধোঁয়া ছড়িয়ে আর নি:শব্দে। দূরে একটা গাছ , বোঝাই যাচ্ছে উইপিং সাইপ্রেস, মাত্র একখানা। ….আকাশে প্লেনগুলো এক পাক খেয়ে এদিকে ফিরে আসছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে তারা যেন নীলকে তাড়াচ্ছে, নীলকে ধোঁয়ায় সাদা করে দেবার খেলা খেলছে একরকম” (পৃষ্ঠা-৪৪)। মস্কো আন্ডারগ্রাউন্ড দেখার ঘোর থেকে বের হয়ে নায়ক যখন আবিষ্কার করে কামালসহ রাতে তারা নোভিনস্কি বুলভারসংলগ্ন যে গলির মধ্যে বেন্টলি গাড়ি বা ফোর ডাইমেনশন গেমের কনসোলের কাছে এসেছিল-সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। নায়কের হতচকিত, হতভম্ব মূহূর্তের পরিপার্শ্ব: “আমি একবার গাড়িটার দিকে তাকালাম, একবার কামালের দিকে, আরেকবার পায়ের নিচের পিচ ও সামনের বড় হাইওয়েটার দিকে, যেখানে অজস্র গাড়ি এ মুহূর্তে পড়িমরি ছুটে যাচ্ছে রাতের বিশ্রামের খোঁজে” (পৃষ্ঠা-১০১)। হোটেলকক্ষে প্রেমহীন দেহকর্মের পর নায়ক ও ভ্যালেন্তিন�� ক্লান্ত, অবসন্ন, নৈ:শব্দের ভিক্টিম। প্রকৃতি-পরিপার্শ্ব জেগে ওঠে : “বাইরে দূরে হোটেলের গাড়িগুলো রাস্তার ওদিক থেকে ছুটে হোটেলের দিকে এসে এই হোটেলের গায়ে বাড়ি খেয়ে অন্যদিকে সরে সরে যাচ্ছে পিচ্ছিল এক ঢঙে, আর রাতের আলো চাঁদের সরে যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরে যাচ্ছে একই দিকে” (পৃষ্ঠা-১৬৮)। ওসিপ নিগ্রহ ও মৃত্যুর নথি হাতে পাওয়ার পর নায়ক একের পর এক ঘটনা উদ্ঘাটনে অস্থির, নির্ঘুম; দেশে ফেরার তাড়ায় শশব্যস্ত। এমন এক রাতে ভ্যালেন্তিনার কাছ থেকে ক্ষুদেবার্তা আসে রাশিয়ার সবচেয়ে ভাল পিস্তল মাকারভ নিয়ে। সে রাতে ডেকে ওঠে ভাটিখানার ডগা নামের কুকুর: “ বাইরে স্মোলেনেস্কায়া স্টেশনের দিকে আমাদের ভাটিখানার ডগা নামের কুকুরটা ডেকে উঠল ঘেউ ঘেউ করে। আমি জানালার দিকে গেলাম। রাস্তার আলোর রিফ্লেকশন হোটেল রুমের জানালার পুরোটা জুড়ে, তাই আমাকের অনেক্ষণ ধরে খুলতে হলো জানালাটা”....(পৃষ্ঠা -১৭৯)। ৪. মাসরুর আরেফিনের সাহিত্যের নিগূঢ় লক্ষ্য ও বক্তব্য একটিই: সভ্যতা, সমাজ-রাষ্ট্রের সিস্টেমের কদর্যরূপ সম্পর্কে সচেতনতার প্ররোচণা। এবং তা নৈতিক বা আদর্শগত কোন অবস্থান না নিয়েই। বিশ্বশিল্পীদের মতো কালের কোপানল থেকে বাঁচতে তিনি গ্রহণ করেন সার্কাসের লাফিয়ে চলা বালকের বেশ, আশ্রয় নেন নির্মম ঐতিহাসিক ঘটনার। বার বারই বলছি,তাঁর উপজীব্য ভূতলবিশ্বের অন্ত:সলিলে বহমান রক্তপাতপ্রবণ সিস্টেমের খোলনলচে অনুসন্ধান। নিগ্রহ, বাকস্বাধীনতা, কমিউনিজমের পতন, ধনী-দরিদ্রের চিরায়ত বৈষম্য, বিকৃত সমকাম, সংখ্যালঘুর শঙ্কিত মনস্তত্ত্ব,হত্যা, প্রেমহীন পরকিয়ার মতো সমকালীনতায় ডুব দিয়ে সময় ও সিস্টেমকে তুলে আনা এ লেখার উদ্দিষ্ট। উপন্যাসের অর্ধেকাংশের পর গল্পকেন্দ্রে কর্তৃত্ব করা ওসিপ নিগ্রহরহস্য উদ্ঘাটন কার্যত: সমকালের গালে তীব্রবেগ চপেটাঘাতের শিল্পান্তর। বলার কথাটি সর্বত্রই পাড়া হচ্ছে। লেখকের বাকপ্রতিমা কখনো পৃথিবীর সিস্টেমসন্ধানে ব্রতি, কখনো কমিউনিজমে ডিল্যুশন ও পতনজনিত হতাশায় মোড়া। কথা একবাক্যেরই : পৃথিবীর সামনের উঠোনে পাতাবাহারের গাছ, পেছনের জঙ্গলে বাচ্চা মেয়ে খাম-খামের কান্না। “আমার মনে কেন যেন এই্ প্রশ্ন জাগল যে, আগে যেমন পুরো মানবজাতির আশা ও আশাহীনতাকে দুই মেরুর দিকে ঠেলে দিয়ে পৃথিবীকে টানটান করে ধরে রেখেছিল মার্কসবাদ, সেই দিনের কি আজ সম্ভবত শেষ? এখনকার সবচেয়ে বড় কম্যুনিস্টও তো আর আমাদের মানে কোনো আশার আলো জাগান না” .........“আমি নির্বোধের মতো আমাকে ধরে টানতে থাকা সাদাতকে বললাম, প্রলেতারিয়েতের অবস্থাই জীবনের ‘সত্য’, মানলাম, ওই কথা আমি নিজেও মানি, ওই কথা মানবার মধ্যই জীবনের একটা মানে খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু ওই ‘সত্য’কে স্টার্টিং-পয়েন্ট ধরে বাকি সব যাত্রা শুরু করার যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত ছিল অত অত বইয়ে, সেসব বই আজ আর পড়াও যায় না, খুলেও দেখা যায় না” (পৃষ্ঠা-৪০-৪১)। “রাশিয়া বুঝল যে, এই পৃথিবীর সবচাইতে বড় সমস্যা, এর নাম্বার ওয়ান সমস্যা হচ্ছে-বিপ্লবের পরে কী সমাজ হবে তা এ্যাকুরেটলি বলতে না পারার সমস্যা। হা- হা। আসল সত্যটা শুনবি? কম্যুনিজম চইলা যাইতে যাইতে রাশিয়া বুঝল, বিপ্লবের পরে কী তা বলতে পারা কোনো সমস্যাই না। ওইটা বলা আর করা আসলে সহজ, অনেক সহজ। বিপ্লবের পরে আবার বিপ্লবের আগেরই সমাজ”(পৃষ্ঠা-৬৯)। “আমি বললাম, ‘সিস্টেমের ডেফিনেশনে যা সমাজের সত্য, তা আমাদের এমন এক ধোঁকা দেয় যে, আমার বাইরে অন্য সত্য নেই। বলে যে, তোমার অন্য কোন সত্য মানার অর্থই হবে পৃথিবীতে তোমার না-টেকা, না-থাকা। এইটা হুমকি, মানে এমন যে, সিস্টেমকে বিশ্বাস করো, তা হলে তুমি থাকবে” পৃষ্ঠা-১২২)। (সংক্ষেপিত)
মাসরুর আরেফিনের 'আন্ডারগ্রাউন্ড শুরু হয় বরিশালের শৈশব কাতরতা নিয়ে বড় ভাইকে খোঁজতে এক প্রখ্যাত নিউজ এডিটরের রাশিয়া চলে আসা দিয়ে। যিনি মানুষের এই পৃথিবীতে মানুষের আচরণের কোনো মানে খোঁজে পাচ্ছেন না। রাশিয়া এসে বন্ধুর ছোট ভাইয়ের কাছে নিজের ভাইয়ের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনে ভাবছিলেন দূর্ভাগ্য যাপন করতে মানুষের রাশিয়া আসা লাগে কেন? দুর্দশা তো সারা পৃথিবী জুড়েই। বরিশাল বসেই তো করতে পারত দুঃখ।
২৬ বছর পর ভাইয়ের সাথে দেখা হবে । যে ভাই সর্বহারা পার্টি করত । খুনের দায় নিয়ে রাশিয়া এসে পালিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। ভাইকে এই দুঃখের জীবন থেকে মুক্ত করতে এসে তিনি পড়ে গেলেন পৃথিবীর সিস্টেমে। যেই সিস্টেমের নাম আন্ডারগ্রাউন্ড । উপন্যাস নায়কের বন্ধু কামাল যিনি ছোট বেলার এক অসুখী পরিবার থেকে উঠে আসে। যিনি কিনা একই সাথে প্রদীপ স্যারের কাছে ছোটবেলায় 'লুজ খেলার' শিকার। রাশিয়া এসে হয়ে উঠেন প্রভাবশালী এক মানুষ। যার প্রভাব জানে নায়কের বন্ধুর ছোট ভাই সাদাত আর ভ্যালেন্তিনাও। তারাও সিস্টেমের দায়ে দুঃখ দুর্দশায় কাটাচ্ছেন রাশিয়া এসে। তাই তারা নায়কের কাছে সাহায্য চান যে কামাল যাতে ওদের সাহায্য করে। সাদাতকে সাহায্য করতেও যে পুতিনের ৩৫ নম্বর সার্কেলে থাকা ওই কামালকে লাগবে ওটাও এক সিস্টেমেরই খেলা।
কিন্তু কামাল সাহায্য করবে ভ্যালেন্তিনার সাথে বিছানায় শুতে পারলেই। যে নায়কের ভাইকে সাহায্য করার কথা মনেও করলো না যেহেতু সেখানে কোনো স্বার্থ নেই কামালের।
এইরকম এক ব্যবসায়িক মাইন্ডেড আচরণ দিয়েও দেখা যায় স্বার্থ ছাড়া চলবে না কিছুই পৃথিবীতে। পরে কামালের সাথে বাস্তবের মতো অবাস্তব এক আন্ডারগ্রাউন্ডে ভ্রমণে দেখে , আসল মস্কো দেখেন। আসল মস্কো এমন যে সেই মস্কোর সাথে মনে হবে, ঢাকা, দিল্লী কিংবা সারা পৃথিবী একই। মানে কেমনে চলছে এই পৃথিবী সেখানেই বোঝার চেষ্টা করা যায়।
কথা বলতে না দেওয়াই সিস্টেম। রাশান কবি ওসিপ মান্দেলশ্্তামকে খুন করে যে বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার বিষয় সেটা খেয়াল করলেই বোঝা যায় পৃথিবীর মূল সত্য। এইভাবে আস্তে আস্তে গল্প এগিয়ে যায় ওসিপ মান্দেলশ্্তাম খুনের সময়ের দিকে ওসিপ মান্দেলশতাম জাদুঘরে গিয়ে।
দেখা যায় রাশিয়ায় নায়কের ভাই কী চাতুরতায় আর কষ্টে কাটাচ্ছেন জীবন।