প্রাচীন মিশর ছিল প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা। বর্তমান যুগে এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা অবশ্য এ ধারণার সাথে একমত নন। যারা সুমেরিয়া নিয়ে অধ্যায়ন করেন, উদাহরণস্বরূপ, স্যামুয়েল নোয়া ক্রামার (Samuel Noah Kramer), সুমেরীয় বিষয়ে একজন মহান বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন এবং History Begins at Sumer- নামে একটি বই লিখেছিলেন, যেখানে তিনি লিখেছিলেন- সুমেরিয়াতেই সবকিছু প্রথম শুরু হয়েছিল। কিন্তু তিনি ভুল ছিলেন, ইতিহাস সুমেরিয়া থেকে শুরু হয়নি, এটি সত্যি সত্যি মিশর থেকেই শুরু হয়েছিল।
কিন্তু মিশরীয় সভ্যতা বা সংস্কৃতি প্রাচীন বিশ্বের এতগুলো সভ্যতা বা সংস্কৃতির মধ্যে এত বিশেষ কিছু কেন?
মিশরে অনেক ‘প্রথম’ আছে, যা আমরা সবাই জানি, এবং এটিই মিশরকে অন্যান্য সভ্যতা থেকে ‘অনন্য’ করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, আবারো সুমেরিয়ানদের কথা বলতে পারি। সুমেরীয়রা মিশরীয়দের পিরামিড নির্মাণ করেননি। সুমেরীয়রা মিশরীয়দের মত অবিশ্বাস্য সব মন্দির তৈরী করেননি। সুমেরীয়রা মিশরীয়দের মত চিকিৎসা বিদ্যা জানতো না। আবার যদি ধর্মের কথাই চিন্তা করি, বেশিরভাগ মানুষই এটি শুনে অবাক হবেন যে, বিশ্বের প্রথম ‘একেশ্বরবাদ’ – এক দেবতার প্রতি বিশ্বাস- এ ধারণা প্রথম একজন মিশরীয় ফারাও দ্বারাই উপস্থাপিত হয়েছিল। মিশরেই প্রথম একেশ্বরবাদ শুরু হয়েছিল, যেভাবে মিশরেই প্রথম শুরু হয়েছিল ‘মমিকরণ প্রক্রিয়া’। মিশরীয়রা মমিকরণ পদ্ধতিকে বিজ্ঞানসম্মত করেছিলেন।
অথবা আমরা মিশরের পৌরানিক কাহিনীর কথাও বলতে পারি। কোনো পৌরাণিক কাহিনীই মিশরের মত এত সমৃদ্ধ নয়। মিশর অবিশ্বাস্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, গ্রিক- বিখ্যাত গ্রিক সভ্যতা- তারাও প্রাচীন মিশরকে শ্রদ্ধা করতেন। আমরা যদি গ্রিক ঐতিহাসিকদের লেখা খুব ভালোভাবে পড়ি, তাহলে দেখা যাবে, তারা সবাই প্রায় একই কথা বলেছেন, ‘আমরা মিশর থেকে আমাদের সভ্যতা পেয়েছি’।
বইয়ের নামঃ মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত লেখকঃ এস এম নিয়াজ মাওলা প্রকাশনীঃ জাগৃতি রেটিংঃ ৯.৫/১০
মিথলজি, আর তা যদি হয় প্রাচীন মিশর নিয়ে, তাহলে তো আগ্রহ জন্মাবেই। কিছু না, বলছিলাম, নিয়াজ মাওলা ভাইয়ের "মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত" বইটির কথা। ২০২১ সালের বইমেলায় প্রাচীন মিশর নিয়ে কৌতুহলউদ্দীপক বইটি বের হয়। শুরু থেকেই পড়ার ইচ্ছা ছিল। অবশেষে কিনে ফেললাম বৃহৎ আকারের বইটি। তারপর অল্প অল্প করে ডুব দিলাম প্রাচীন নীলনদের সভ্যতার ভিতরে।
মিথলজি বলতে আমরা আসলে কি বুঝি? মিথলজি কি শুধু মনগড়া কিছু গল্প, নাকি এর পিছনে আছে কিছু সত্য ঘটনা? Joseph Campbell এর একটি উক্তি এক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়, “Mythology is not a lie, mythology is poetry, it is metaphorical. It has been well said that mythology is the penultimate truth--penultimate because the ultimate cannot be put into words. It is beyond words,beyond images” প্রাচীন মিশরের ক্ষেত্রে একথাটি আরো উপযুক্ত। ওসিরিস, আইসিস এর মিশর, প্রাচীন আখ্যানগুলো অদ্ভুত শিহরন জাগায়। মিশরের এই প্রাচীন মিথগুলোা যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে নিয়াজ ভাই এর লেখনীতে। প্রতিটি উপকথার পিছনের কথা, ঐতিহাসিক তথ্যগুলো বইটিকে আরো পূর্ণতা দিয়েছে।
"মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত" কি শুধু মিথলজির বই? নাকি ইতিহাসের ? নাকি দুটোই? সত্যি বলতে প্রথমে মনে হতে পারে, বইটিতে শুধু প্রাচীন মিশরীয় মিথের কথা এসেছে। কিন্তু প্রাচীন মিশরের ইতিহাস ও মিথলজি কে কি আলাদা করা সম্ভব? আদতে তা সম্ভব নয়।মিশরের নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে গিজার দ্যা গ্রেট পিরামিডের ছবি।মিশরকে আমরা চিনি পিরামিডের দেশ হিসেবে, মমির দেশ হিসেবে। মিশরীয় সভ্যতা তো এক দিনের নয়, কয়েক হাজার বছরের। কত ফারাও, রাজপরিবারের কাহিনি জড়িয়ে আছে মিশরের প্রতিটি পিরামিডের ভিতরে। মমিকরন প্রক্রিয়া,প্যাপিরাস, পিরামিড সৃষ্টি নিজেই তো এক একটি মিথ। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে "মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত" বইটির প্রতিটি অধ্যায়ে।
মিথলজি নিয়ে কথা বলার আগে জানা দরকার, মিথলজির উৎস কি? সাধারনত প্রাচীন মিথগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গল্প বলার ছলে প্রবাহিত হয়। অনেক কিছু সংযোজন হয়, কিছু পরিবর্তিত হয়।একসময় মূল রুপটি খুজে পাওয়া দুরহঃ হয়ে উঠে। মিশরের মিথলজির ক্ষেত্রে কিছু বিষয় লক্ষ্য করার মতো। অন্য সভ্যতায় যেমন মিথগুলোর লিখিত রুপ পাওয়া যায় না, মিশরের ক্ষেত্রে তা নয়। মিশরের ছিল আদিমতম লেখনি পদ্ধতি, হায়ারোগ্লিফিক্স। প্রতিটি পিরামিডের পাঠসমূহ, বিভিন্ন স্টেলার লিপি থেকে আমরা প্রাচীন মিশরের মিথলজি সম্পর্কে ধারনা পেতে পারি। মিশরীয় পুরানের উৎস আলোচনার মাধ্যমে শুরু হয়েছে "মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত" বইটি। এরপর ধীরে ধীরে প্রাচীন মিশরের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে বইটির প্রথম পর্বে।
এরপর কথা বলা যাক, মিশরীয়দের সমাধি নিয়ে। পরকালে পুনর্জন্মের ধারনা থেকে, প্রাচীন মিশরীয়দের মৃতদেহ সংরক্ষন করার চিন্তা মাথায় আসে। সাধারন কবর থেকে ক্রমান্বয়ে তারা তৈরি করে মাস্তাবা, সেখান থেকে একসময় পিরামিডের জন্ম হয় জোসেরের ধাপ পিরামিড এর মাধ্যমে। ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হয় খুফুর দ্যা গ্রেট পিরামিড। সময়ের সাথে সাথে পিরামিডের ধারনা পরিবর্তিত হয়ে, শুরু হয় সমাধি মন্দির তৈরি। ফারাও এবং তার পরিবার সমাহিত হতে থাকেন ভ্যালি অফ কিংস এ। মিশরীয় সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ অংশ নিয়ে বর্ননা করা হয়েছে বইটির দ্বিতীয় পর্বে। তৃতীয় পর্বটি সবচেয়ে চমকপ্রদক।এখানে মিশরীয়দের জীবন ও মৃত্যুর ধর্মের কথা, মিশরীয় বিভিন্ন দেবতার কথা বলা হয়েছে। মিশরীয়দের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল, মাত বা ভারসাম্য। এই ভারসাম্য বজায় রাখার উপর নির্ভর করত, তাদের জীবন। এজন্য তারা পুজা করত বিভিন্ন শক্তিকে। রা বা সূর্য , ওসিরিস, আইসিস, থোথ ছিলেন আদিম দেবতা। এরপর ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় আমুন, আনুবিস,হাপি সহ অসংখ্য দেবতা। অনেক সময় অনেক মানুষ দেবতা হয়ে উঠেন, যেমন ইমহোটেপ,যিনি ছিলেন ধাপ পিরামিডের স্থপতি। আবার এই বহু দেবতার মিশর থেকেই একসময় একেশ্বরবাদিতার জন্ম হয় আখেনাতেন নামের এক বিপ্লবী ফারাও এর মাধ্যমে।
মমিকরন প্রক্রিয়া সবসময়ই ছিল এক বিস্ময়। মিশরীয়রা ধীরে ধীরে এই প্রক্রিয়ায় চুড়ান্ত পারদর্শিতা লাভ করেছিল। মমিকরন ও সমাধি তৈরির কারনে মিশর সম্পর্কে আমরা এত কিছু জানতে পেরেছি। মমিকরন, ওসিরিসের পুরানচক্র , মৃত্যুপরবর্তি আচার অনুষ্ঠান এবং মৃত্যুপরবর্তি জীবন নিয়ে মিশরীয়দের ধারনা বর্নিত হয়েছে তৃতীয় পর্বে।
চতুর্থ পর্বে প্রাচীন মিশরের ধর্ম, জাদুবিদ্যা, চিকিৎসা, ওরাকল নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এই পর্বে সাধারন মানুষদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি , লোকাচার প্রভৃতি সম্পর্কে লেখক আলোকপাত করেছেন।
পঞ্চম পর্বটি হল, আমরা এতক্ষণ যে বিষয়টির জন্য অপেক্ষা করছিলাম,সেই মিথলজি নিয়ে। ্পর্বটির নাম “প্যাপিরাস সাহিত্য”; যা মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস ও মিথলজির একটি গ্রহণযোগ্য উৎস।প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন গল্প নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এই পর্বে। ইন্টারেস্টিং বিষয় হল, গল্পগুলো কালানুক্রমে সাজানো হয়েছে, যা থেকে মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস, সভ্যতার উত্থান- পতন সম্পর্কে চমৎকার ধারনা পাওয়া যায়। এছাড়া প্রতিটি গল্পের শেষে লেখক গল্পের ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা গল্পগুলোকে বুঝতে সাহায্য করেছে। কারণ , অধিকাংশ মিশরীয় মিথ অনেকটা মেটাফরিক।
ষষ্ঠ পর্বটি হল, প্রাচীন মিশরের গল্প। ঠিক গল্প না বলে ইতিহাস বলাই শ্রেয়। মিশরের রাজবংশগুলোর ইতিহাস না জানলে, মিশরকে নিয়ে জানা অনেকটা অপূর্নই থেকে যায়। কারন মিশরের ধর্ম, দেবতা, আচার অনেকটা ফারাও ও অভিজাত সম্প্রদায়ের উপর নির্ভরশীল ছিল।প্রাচীন রাজবংশ থেকে শুরু করে রামেসিস, তুতেনখামেন হয়ে একদম ক্লিওপেট্রার যুগ পর্যন্ত সংক্ষেপে বর্নিত হয়েছে এই পর্বে। বলা হয়েছে,বিভিন্ন রাজবংশ সম্পর্কিত কিছু গল্প ও কিংবদন্তি। এছাড়া প্রতিটি রাজপরিবারের বংশানুক্রমের তালিকা দেয়া হয়েছে,যা বইটিকে আরও সহজপাঠ্য করেছে।
এই হল ছয় পর্বে "মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত" ।ছয় পর্বের এই বৃহৎ আকারের বইটি(৯৫২ পৃষ্ঠা) প্রাচীন মিশরকে জানতে সাহায্য করবে। মিশরীয় সভ্যতা নিয়ে আগ্রহী পাঠকদের তৃষ্ণা মিটাতে "মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত" এর বাংলায় বিকল্প কোন বই এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। মিশরীয় সভ্যতার প্রতিটি ছোট-বড় বিষয় ফুটে উঠেছে বইটিতে। অনেক সময় নিয়ে, অনেক গবেষনা ও প্রতিটি তথ্য যাচাই করে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, অনেক রেফারেন্স সংযুক্ত করা হয়েছে। কেউ মিশরীয় সভ্যতার উপর কোনো উপন্যাস বা গল্প লিখতে চাইলে বইটি থেকে অনেক কিছু ধার করা সম্ভব, রেফারেন্স বইয়ের মতো।
"মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত" বইটি হাতে পাওয়ার পর প্রথমে মনে হয়েছিল, এত বড় বই, তার উপর ইতিহাসধর্মী- শেষ করতে পারব তো? এই রকম বই সাধারনত একটু ধীরগতির হয়। কিন্তু বইটি ইতিহাসধর্মী হলেও, লেখকের সাবলীল লেখনীর জন্য পড়তে কখনো বিরক্ত লাগেনি, বরং বই এর মধ্যে যেন বুঁদ হয়ে ছিলাম পুরো ইদের ছুটিতে। ধাপে ধাপে মিশরীয় সভ্যতার গল্প বলা হয়েছে বইটিতে। মিশর সম্পর্কে যদি কারো এতটুকু ধারনাও না থাকে, তবুও নির্দ্বিধায় পড়ে ফেলতে পারবেন বইটি। শুধু জানার আগ্রহ থাকলেই চলবে।
"মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত" বইটির প্রচ্ছদ, পৃষ্ঠা, অধ্যায়বিন্যাস সবই অসাধারন। তবে কিছু বিষয় চোখে পড়ার মতো। প্রথমতঃ এত বড় বই হওয়া সত্ত্বেও ফিতা বা বুকমার্ক নেই। এছাড়া কিছু রজ্ঞিন ছবি সন্নিবেশিত করলে বইটি আরো সুন্দর হতো। বইয়ের শেষে মিশরীয় দেবতাদের তালিকা সংযুক্ত করলে পড়তে আরেকটু সহজ হত। আশাকরি, পরবর্তি সংস্করণে লেখক ও প্রকাশক বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখবেন।
সবশেষে বলতেই হয়, আগ্রহী পাঠকদের জন্য সংগ্রহে রাখার মত একটি বই "মিশরীয় মিথলজি: আদি থেকে অন্ত" ।বইটি মিশরীয় সভ্যতা নিয়ে পাঠকের আগ্রহ বাড়িয়ে দিবে। লেখকের পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় রইলাম।
"When we lose our myths we lose our place in the universe." -Madeleine L'Engle
মিশর! বুড়ো পৃথিবীর ইতিহাসের অনন্য এক সভ্যতা। যে সভ্যতা অন্যসব সভ্যতার মতো নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। যা আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে অঙ্কুরিত হয়ে বিকশিত হয়ে ঢালপালা ছড়িয়ে গড়ে উঠেছিলো। তারা অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো অনেক অনেক বেশি। উন্নতির সর্বোচ্চ শেখরে অবস্থান করেছিলো মিশরীয়রা। নিজেদের দেশকে কমেট নামে ডাকতো। তাদের কাছে জ্ঞান ছিলো শ্রদ্ধা ও প্রজ্ঞার বিষয় এবং একই সাথে গোপনীয়। পৃথিবীর বুকে যত সভ্যতা গড়ে উঠে হারিয়ে গিয়েছে তাদের প্রত্যকের রয়েছে ইতিহাস এবং পুরাণ। মিশরেরও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি পুরানো এই সভ্যতাকে উন্মুক্ত করতে প্রত্নতত্ত্ববিদদের লক্ষ লক্ষ টন বালি খনন করতে হয়েছে। ধুলোয় ঢাকা এক অসূর্যম্পশ্যা ইতিহাস তারপরে সূর্যের আলো পেয়েছে। নিজের স্বরূপ মেলে ধরেছে আমাদের কাছে। মিশর যেমন অনন্য ঠিক তেমনই তার সমকক্ষ অদ্বিতীয়। মিশর নিজের স্থানে নিজেই রাজা!
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে যখন মিশর সম্পর্কে আমার জ্ঞান শূন্যের কাছাকাছি ছিলো তখন মিশর নাম শুনলে চোখের পর্দায় দুটো জিনিস ভেসে উঠতো। প্রথমত পিরামিড এবং দ্বিতীয়ত মমি। এরপর রায় সাহেবের শেয়াল দেবতা রহস্য পড়ে জানতে পারি মিশরীয় দেবতা আনুবিস সম্পর্কে, যিনি শেয়ালমুখো এবং মমিকরণের দেবতা। এরপর ইউটিউব বা বিভিন্ন সাইটে গিয়ে পড়তাম কিংবা ভিডিও দেখতাম। কিন্তু মিশরের মিথ সম্পূর্ণটা কোথাও যে পাবো সেটাও কখনো ভাবিনি। এরপরে জাগৃতি ২০২১ বই মেলায় নিয়ে এলো 'মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত'। করোনা আর লকডাউন এর মাঝে বইমেলা। সবার লেজে গোবরে হয়েছে এবার। তবে কিছু ভালো বই বের হলে নিঃসন্দেহে তার মধ্যে একটি থাকবে বইটি।
দুটো গ্রীক শব্দ মিলে এই মিথোলজি শব্দটি গঠিত হয়েছে। গ্রীক ‘মিথোস বা মাইথোস’ শব্দ থেকে এই মিথ শব্দটি তৈরি হয়েছে, যার মানে দাঁড়ায় ‘স্টোরি বা গল্প’। তবে মিশরের ইতিহাস এবং মিথ বা পুরাণ একে অপেরর সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িত। যেমন ধরুন মিশরে সম্ভবত দুজন মানুষকে দেবত্ব লাভ করতে দেখা যায়, এখন উনাদের একটা ইতিহাস তো আছেই কারণ তারা সমাজের উঁচু স্থানের। তারা সমাজে কোনো ভূমিকা ছাড়া এত উপরে যেতে পারতো না। ঠিক তেমন ভাবেই তাদের নিয়ে আরো অনেক কিছু তৈরি হবে দেবত্ব প্রমাণের জন্য যা পুরাণের জন্ম দিবে। মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত বইটি মূলত মিথ নির্ভর হলেও এখানে ইতিহাসও আলোচ্য হয়েছে।
★বই সংক্ষেপ
প্রথম পর্ব: সূচনা পর্ব
বইয়ের প্রথম অধ্যায় সূচনা পর্ব যেখানে লেখক আলোকপাত করেছেন কীভাবে নীল নদের তীরে একটি সভ্যতা(মিশরীয়) গড়ে উঠেছে, তার উৎপত্তি। পুরাণের উৎস। এছাড়া বর্তমান সময়ের মানুষের মধ্যে কখন মিশর নিয়ে আগ্রহ শুরু হয়। তবে এই অধ্যায়ের আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো হায়ারোগ্লিফিক্স ভাষা এবং তার পাঠোদ্ধারসহ প্রাচীন মিশরীয়দের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ। যা তারা লিপিবদ্ধ করেছে কখনো কখনো পিরামিডে কখনো কফিনে কখনো মন্দিরের দেয়ালে। যা হারিয়ে যাওয়া মিশরের সভ্যতা সম্পর্কে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনসহ ধর্মীয় আচার ব্যবহার সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিয়ে থাকবে। প্রাচীন মিশরীয়রা জ্ঞানকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। তবে তা সবার জন্য উন্মুক্তও ছিলো না। এই অধ্যায়ে প্রাচীন মিশর যে সুতায় গিঁট দেওয়া আছে তার একটি হয়তো খুলতে পারবেন।
দ্বিতীয় পর্ব: সমাধি থেকে মন্দির
এই অধ্যায়ের নাম দেখেই হয়তো ধারণা হয়ে গিয়েছে কী নিয়ে এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। এখানের দুটো বিষয়ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিশরের রহস্য হলো প্রথমত সমাধি আর দ্বিতীয়ত তাদের ঐতিহ্যকে এখনো দৃশ্যমান করে রেখেছে মন্দির, তবে সমাধিও একই কাজ করে। এখানে একটু ভেঙ্গে বলি বা স্পয়লার দিই, প্রাচীন মিশরে প্রথমে মমি তৈরি হতো না। মানুষের মৃত্যুর পর যখন তাদের দাফন করা হতো তারপর মরুভূমির পরিবেশে প্রকৃতিক ভাবে মমি তৈরি হয়েছিলো প্রথমে। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় কয়েকদিন পর মরুভূমির শেয়াল সমাধি খুঁড়ে মৃতদেহ বের করে নিয়ে আসে কিংবা মরুভূমির ঝড়ে মৃতদেহ বাইরে বের করে নিয়ে আসে। তখন তারা দেখতে পেতো মৃতদেহ গুলো প্রকৃতিক ভাবে মমি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো শেয়াল যদি মৃতদেহ নষ্ট করে দেয় বা ঝড়ে মৃতদেহ নষ্ট হয়ে যায় তবে তারা পরবর্তী জীবনে যেতে পারবে না। তো তারা প্রথমে তৈরি করলো মাস্তাবা, এরপর ফারাও জোসের একটি মাস্তাবার উপর আরেকটি মাস্তাবা এভাবে করে তৈরি করলেন বিশ্বের প্রথম পিরামিড, যা জোসেরের ধাপ-পিরামিড নামে পরিচিত। এরপর আরো পিরামিড তৈরি হয়, সবশেষে রাজাদের উপত্যকা যেখানে আবিষ্কৃত হয়েছে বিখ্যাত রাজা তুতানখামুনের সমাধি যা বিশ্বের কাছে প্রথম মিশরীয় সমাধি যা লুট হয়নি ডাকাত দ্বারা। তবে বিশদ জানার জন্য বইয়ের কাছে আসতে হবে আপনাদের। মিশরীয়রা অনেক বড় বড় মন্দির তৈরি করেছিলেন, দেবতাদের খুশি করার জন্য। যার মধ্যে কিছু এখনো অক্ষত আর কিছু ধ্বংস প্রায়। মিশরের আঁধার হলো পিরামিড আর মন্দির। এই দুই আঁধারের সমন্বয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়।
তৃতীয় পর্ব: জীবন ও মৃত্যুর ধর্ম
মিশর সম্পর্কে আলোচনা হবে অথচ তাদের আরাধ্য'রা আসবেন না, তা কখনো সম্ভব? তৃতীয় অধ্যায়কে বলা যেতে পারে এই বইয়ের ভিত্তি। কেন বলছি ভিত্তি? কারণ একটি সভ্যতা সৃষ্টির পর থেকে, সে সভ্যতা নির্মাণ আর ধর্মীয় বিশ্বাস হলো সেই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তির একটি। মিশরীয়রা বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী একটি জাতি।(ব্যতিক্রম- আখেনাতেন একেশ্বরবাদ প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন। তবে মৃত্যুর পর তা পুনরায় আগের মতো হয়ে গিয়েছিলো। আখেনাতেনকে পৃথিবীর প্রথম একেশ্বরবাদের সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখা হয়।) শুরু থেকেই মিশরীয়রা বহু ঈশ্বরের পূজায় অভ্যস্ত। তাদের সেই দেবতাদের সৃষ্টি কীভাবে হয়েছিলো কীভাবে দেবতরা মা'তকে বিশৃঙ্খলা হাত থেকে রক্ষা করেন তার ব্যাখা করা হয়েছে। আগেই বলেছি এই অধ্যায় এই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তার আরেকটি কারণ হলো মমিকরণ প্রক্রিয়াও এই অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। মমিরকণ আমাদের কাছে একটা রহস্যই ছিলো বলতে গেলে। পুরাণ মতে মমিরকণ কীভাবে শুরু হয়েছে সেখান থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার রীতিনীতি তো রীতিমতো উত্তেজনাকর। মিশর রহস্য যে আমাদের কাছে অনেকটাই উন্মোচিত হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে এই অধ্যায়ে। প্রাচীন মিশরীয়দের রীতিনীতি অনেক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে পালিত হতো। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তাদের জন্য। তাছাড়া মমিরকণ অনুষ্ঠান আর মমিকে কোনে প্রকার ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তারা যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সেটাও ফুঁটে উঠে। কারণ মমি ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাদের পরবর্তী জীবনে আর যাওয়া হবে না...
চতুর্থ পর্ব: প্রাচীন মিশরের জনপ্রিয��� ধর্ম
প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার থেকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গিয়েছিলেন। তবে শুধু চিকিৎসা নয় চিকিৎসার পাশাপাশি জাদুও ছিলো তাদের চর্চার বিষয়। যার দ্বারা তারা মানুষকে সুস্থ করে তুলতেন। এখানে তাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে, তার পাশাপাশি জাদু, মিশরীয়দের পঞ্জিকা, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠানে নাচ এবং গানের ভূমিকা পূর্বপুরুষেরদের পূজার বিষয় আলোচনা করেছেন লেখক। তাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়ও আছে। প্রাচীন মিশরে প্রথম ঝামেলা বিহীন সন্তান প্রসবের রীতি চালু হয়। তাছাড়া ধর্মীয় কারণে অনেক কিছু নিষিদ্ধ জিনিস ছিল। এসবের সমন্বয় হলো পঞ্চম অধ্যায়।
পঞ্চম পর্ব: প্যাপিরাস সাহিত্য
প্রাচীন সময়ে কাগজ ছিলো না। যার ফলে কোনোকিছু লিখতে বা লিপিবদ্ধ করতে হলে প্যাপিরাস ছিলো মাধ্যম। তাছাড়া কখনো কখনো মন্দির বা স���াধির দেয়ালেও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লিপিবদ্ধ করা হয়েছিলো। সাহিত্য মাঝে মাঝে একটা সভ্যতার গোপন কথা বলে। সত্যকে রং চড়িয়ে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন এবং তার সাথে রচিত রচনায় চলমান সংস্কৃতির ভাবধারা ঢুকিয়ে সাহিত্য রচনাও নতুন নয়। মিশরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজার রাজত্ব কালে বিভিন্ন সাহিত্য রচিত হয়েছে। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা হারানো সভ্যতার সমাজ বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা জানতে। এই অধ্যায়ে বেশ কয়েকটি চমকপ্রদ গল্প আছে। যেমন বাগ্মী কৃষকের গল্প, যাদুকরের গল্প, সিনুহের গল্প, দুই ভাইয়ের গল্প, ফারাও এবং বুদ্ধিমান চোর, লাল জুতোওয়ালী মেয়েটির গল্প ইত্যাদি। এই গল্পগুলো ভিন্ন ভিন্ন ফারাওয়ের সময়ে রচিত। যা মিশরের সাহিত্য এবং তখনকার অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেয়।
ষষ্ঠ অধ্যায়: প্রাচীন মিশরের গল্প
অতঃপর সর্বশেষ অধ্যায়... এই বইয়ের আরেকটি মূল ভিত্তি। তবে কোনো অধ্যায়'ই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে সব অধ্যায় গুরুত্বপূর্ণ। একটি ছাড়া অন্যটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কিন্তু তবুও এই সর্বশেষ এবং এই বইয়ের সর্ববৃহৎ অধ্যায়টি ছাড়া বই ৯৫০ পৃষ্ঠার না হয়ে ৬০০ পৃষ্ঠার হতো। বলতে পারেন কী আছে এতে? ইতিহাস, হ্যাঁ হারানো মিশরের ইতিহাস, হারিয়ে যাওয়া সাম্রাজ্যের ইতিহাস, হারানো ফারাওদের গৌরবময় স্বর্ণালি ইতিহাস আছে। ইতিহাস একদিন সৃষ্টি হয় না বা লিখিত হয় না। আর প্রাচীন মিশরের ইতিহাস তো সৃষ্টি হয়েছে তিন হাজার বছেররও বেশি সময় ধরে। অনেকটা তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটি ভবন। যা একদিন ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে, তবে তার আগে গৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো: মিশরের ফারাও(যাকে দেবতার প্রতিনিধি বলা হয়ে থাকে), মিশরের সাধারণ মানুষ, মিশরের প্রকৃতি ইত্যাদি। ফারাওরা ছিলেম প্রাচীন মিশরের পথপ্রদর্শক। তারা তাদের ক্ষমতাবলে তাদের রাজত্ব কালকে একটি নির্দিষ্ট পথে নিয়ে যেতে পারতেন। ফারাও চতুর এবং ক্ষমতাশালী হলে মিশর সমৃদ্ধ হতো আর দূর্বল ফারাও মিশরের অনিষ্ট ডেকে আনতো। মিশরের তিন হাজার বছরের ইতিহাসে ৩২টি রাজ পরিবার শাষণ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মিশরকে উন্নতি, খ্যাতি এবং সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শেখরে আহরোণ করিয়েছেন। চতুর্থ রাজবংশের সময়কে মিশরের স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। কারণ এই সময় মিশর ধনে সম্পদে ফুলেফেঁপে উঠেছিলো। পিরামিড ছিলো এই সময়ের আবিষ্কার। ঠিক তেমনই ষষ্ঠ রাজবংশের পতন মিশরকে অন্ধকারে নিয়ে গিয়েছে। মিশর এমন এক সভ্যতা যে সভ্যতা তিনবার অন্ধকারে পরিণত হয়েছে আবার সেই অন্ধকার থেকেই আলোতে এসেছে। ফারাও খুফুর পিরামিড আজ প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি। বালক ফারাও তুতানখামুন অষ্টাদশ রাজবংশের আরেক বিস্ময়। উনিশতম রাজবংশের ফারাও দ্বিতীয় রামেসিস- রামেসিস দ্য গ্রেট রামেসিস মিশরেরকে ঘুরিয়ে দিলেন তার আশ্চর্য ক্ষমতাবলে। মজার বিষয় হলো তার পাসপোর্ট আছে। রানী ক্লিওপেট্রা আরেক বিস্ময়! যার শাসনের মধ্যে দিয়ে মিশরের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছিলো। তিনিই সর্বশেষ ফারাও মিশরের। নীল নদের তীরে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে যে সভ্যতার বিকাশ হয়েছিলো তাট সমাপ্তিও হয়ে গিয়েছে। মিশরের বুকে মিশর ধারণ করে আছে আরো অজানা বহু রহস্য, বহু জ্ঞান। যা আহরণের জন্য মানুষ মিশর যায়। হারানো সভ্যতার নিজের অস্তিত্ব হারিয়েছে শুধু টিকে আছে মন্দির, পিরামিড, প্যাপিরাস কিংবা সমাধিগুলো। যেগুলো আজকে পৃথিবীর কাছে তাদের পুরানো ঐতিহ্য আর রহস্যকে উন্মোচিত করছে একটু একটু করে।
⚫পাঠক পর্যালোচনা
এই পর্যন্ত যত বই পড়েছি সবগুলো বইয়ের চেয়ে এই বইতে বেশি সময় দিয়েছি। সম্ভবত ২ মাস ১১ দিনের মতো। আমি চেয়েছি বইটা একটু একটু করে শেষ করবো। এতবড় বিশাল বই যেটা আবার একটা হারানো সভ্যতার আদী থেকে অন্ত পর্যন্ত ধরে রেখেছে সেটা নিয়ে পড়ার আগে যেমন কৌতুহল কাজ করছিলো ঠিক তেমনই কাজ করছিলো ভয়। ভয় করার কারণ হলো এতো এতো তথ্য কতটুকই বা মনে রাখতে পারবো সেটাই ছিলো চিন্তার কারণ। তবুও শেষ করেছি এবং ইচ্ছে করে অনেকটা সময় নিয়েই। কারণ বইটার কাছাকাছি যেতে চেয়েছি লেখকের কষ্ট করা পরিশ্রমকে স্বার্থক করতে চেয়ছি। কোনো সন্দেহ নেই আমি সম্পূর্ণ সফল না হলেও অনেকটা সফল হয়েছি। এই বইটি মিশর সম্পর্কে আমাকে এতো অজানা তথ্য দিয়েছে যা রীতিমতো মাঝে মাঝে থ্রিলার বইয়ের থ্রিলই মনে হয়েছে। তবে নন-ফিকশনের অভিজ্ঞতা তেমন নেই বলে মাঝে মাঝে ব্লকে পরেছি ২/৩ দিনের করে ৩/৪ বার। লেখক ভেঙ্গে ভেঙ্গে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন, নীচে পয়েন্ট দিয়েও মাঝে মাঝে অজানা ইনফরমেশনগুলো মার্ক করে দিয়েছেন। খুব সুন্দর ভাবে একটার পর একটা বিষয়কে উপস্থাপন করেছেন। যার ফলে একটা ধারাবাহিকতা বজায় ছিলো। একটা টপিকের হাত ধরে রিলেটেড করে অন্য টপিক এনেছেন। তবে লেখক আরেকটা ধন্যবাদ প্রাপ্য, কারণ মাঝে মাঝে এক টপিকের বিষয় অন্য টপিকে এসেছে, লেখক ঐসব জায়গায় বলে দিয়েছেন সেসব টপিক কোথায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যার ফলে শুধু পাতা উল্টিয়ে দেখে নিয়েছি। মিশর সম্পর্কে আমার ধ্যান ধারণা শূন্য ছিলো সেটা আগেই বলেছি তবুও বেশ ভালোভাবেই শেষ করেছি বইটা। কারণ লেখক ছোটো-ছোটো বিষয়গুলোও খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন এবং খুটিনাটি বিষয়ও আলাপ করেছেন। যা বইটাকে সহজপাঠ্য করে দিয়েছে।
⚫ লেখনশৈলী, বর্ণনাভঙ্গি এবং বইয়ের বুনন
সহজ কথায় বাংলায়, সুন্দর বর্ণনাসহ এই বই খুব ভালো একটা স্থান করে নিয়েছে। লেখক যতটা সম্ভবত লেখাকে এবং তার বর্ণনাকে সহজ আর প্রাঞ্জল করেছেন। ফলে কঠিন বিষয়গুলোও আমার মতো একজন সাধারণ পাঠকের ধরতে অসুবিধা হয়নি। লেখক যে এত বড় বই রচনা করতে গিয়েও সহজপাঠ্য এবং সুন্দর করে গড়ে তুলেছেন সেটাই অনেক। একটা বিষয়ের যখন উপস্থাপনা সুন্দর হয় তখন বিষয়টার সৌন্দর্যও বেড়ে যায় অনেকখানি। সুন্দর উপস্থাপনা আর একটার পর একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং বিষয়গুলোকে একটার সাথে অন্যটার সম্পর্ক স্থাপন করে পরবর্তী বিষয়ে যাওটা মুখের কথা না। যেটা বই বইয়ে লেখক করেছেন।
⚫লেখক
লেখকের এটি চতুর্থ বই। আমার এটি লেখকের পড়া প্রথম বই। প্রথমে সম্ভবত দুটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো। তৃতীয় বইটি হলো, "গ্রীক মিথলজি আদি থেকে অন্ত"। যেটা মিথলজি আদী থেকে অন্ত সিরিজের প্রথম বই এবং মিশরীয় হলো দ্বিতীয় বই এই সিরিজের। পরবর্তীতে লেখকের এই মিথলজি সিরিজের তৃতীয় আসতে যাচ্ছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে সম্ভবত ২০২২ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হবে " মিথলজির আদি থেকে অন্ত - ওলেমেক থেকে ইনকা" আশা করি বইটি এটির মতোই পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করবে।
⚫সম্পাদনা
এতবড় একটি বই সম্পাদনা মুখের কথা না। শুনেছি বই মেলায় আনার জন্য একটু তারাহুরো ছিলো। বইটি প্রায় সব ভালোই। মাঝে মাঝে একটু বাক্যের কঠিনতা থেকে গিয়েছে, যা একটু চোখে লেগেছে। তবে আরেকটা বিষয় হলো সূচির সাথে বইয়ের পেইজ সামঞ্জস্য নেই। এক পেইজ আগে পরে হয়ে গিয়েছে অনেক জায়গায়। আশা করি পরবর্তী মুদ্রণে এসব ঠিক হয়ে সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি বই আসবে। বানান ভুলও তেমন একটা নাই। তবে আছে যা খুবই অল্প এবং চোখে লাগার মতো না।
⚫প্রচ্ছদ, বাঁধাই এবং আনুষঙ্গিক সব
বইয়ের প্রচ্ছদকার ছিলেন চারু শিল্পী। খুব সুন্দর একটি প্রচ্ছদ তিনি উপহার দিয়েছেন। যা বইয়ের সাথে খাপেখাপে মিলে যায়। তবে পরের কাভার আঠা দিয়ে লাগানো না থাকলে আমার ভালো লাগতো এতে ওটা খুলে পড়া যেতো। আর বাঁধাই আরেকটু যদি উন্নত হতো তাহলেই সেরা হতো। কারণ বই অনেক মোটা হওয়ার কারণে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে এই মনে ��য় বই খুলে আসবে। যার জন্য ভয়ে ছিলাম। তবে সেরকম কিছু ঘটেনি। আরেকটা জিনিস হলো বুকমার্ক ছিলো না। লেখক কোনো একটা লাইভে বলেছিলেন বইমেলার ব্যস্ততায় বিষয়টা চোখ এড়িয়ে গিয়েছে আশা করছি সেই সমস্যার সমাধানও পরবর্তী মুদ্রণে ঠিক হয়ে যাবে।
বই- মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত লেখক- এস এম নিয়াজ মাওলা প্রকাশন- জাগৃতি প্রকাশনী প্রকাশকাল- ২০২১ বইমেলা প্রচ্ছদ- চারু শিল্পী মুদ্রিত মূল্য- ১৩৩৫
So that the lover of myths, which are a compact of wonders, is by the same token a lover of wisdom. - ARISTOTLE
Mythology বলতে আমরা কি বুঝি? সরাসরি বাংলায় এর মানে হলো পুরাণ। লোকগাথা,কিংবদন্তি,প্রাচীন ধর্মীয় জীবনগাঁথা। অনেক কল্পনা,গল্প, অলৌকিকতার মিশ্রণে ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী হচ্ছে এই পুরাণ।কেউ যদি আমার মত ইতিহাস এর পাশাপাশি কল্পলোকের প্রেমিক ও হয়ে থাকেন, তাহলে মিথলজি আপনার জন্য। কারণ প্রাচীন মানবসভ্যতার সবকিছুই আপনি এই কল্পনা প্রসূত সত্যমিথ্যা এর মিশেলেই খুঁজে পাবেন। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করবেন সেই প্রাচীন আমলের আমাদের পূর্বপুরুষরা ঠিক আমাদের মতই এই মর্ত্যে নিজেদের সবচেয়ে সফল এবং বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তারাও প্রকৃতির রহস্য খুঁজতো, সেই রহস্যের সমাধানে মিশাতো নানা রঙের সব গল্প। জীবনের প্রয়োজনে তারাও নানা কাজে ব্যস্ত থাকত,উৎসব করতো, দুর্যোগে ভয় পেত, যুদ্ধ - ধর্ম - সমাজ - পরিবার সবকিছু মিলিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতো। কালের বিবর্তনে এইসব সভ্যতা হারিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের রেখে যাওয়া স্মৃতি এখনো পৃথিবীর বুকে চির অম্লান।যুগে যুগে মানুষ তাদের ইতিহাস কে জানতে চেয়েছে, বর্তমানের সমস্যা সমাধানে ইতিহাসের আশ্রয় নিয়েছে,আস্তে আস্তে সেই সব পুরাণ এর রহস্য উদঘাটন করেছে কিন্তু তবু অজানাকে জানার এই স্পৃহা তাদের কখনো শেষ হয়ে যায় নি। তাই যতবারই এরকম বড় বড় মিথলজির বই সামনে আসে, আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি সেই সময়ে ফিরে যাওয়ার জন্য, যেখানে মানুষ ভাবতো সূর্য দেবতা রূপে নৌকারথে চড়ে প্রতিদিন পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাত্রা করে, কিংবা বিশাল বিশাল সমাধি নির্মাণের মাধ্যমে পরকালের নতুন জীবন অনন্ত শান্তিময় করা যাবে। এ যেন ঠিক সেই সভ্যতার মধ্যেই একটু করে বেচেঁ থাকা। আর তাই মিথলজি সংক্রান্ত যেকোনো বই আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। এইজন্য প্রথমেই লেখককে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই যে এত পরিশ্রম আর সাধনার মাধ্যমে এরকম বৃহৎ পরিসরে আমাদেরকে এই বইটি উপহার দেয়ার জন্য।
মিশর।একটি দেশের নাম যা শুনলেই খুব সাধারণ কিছু ছবি মানসপটে ভেসে উঠে, সেই ত্রিভুজাকার পিরামিড নাহয় নাকভাঙা সিংহমানব আর ধূ ধূ মরুভূমি। তার চেয়েও বেশি মনে হয় সাদা কাপড়ে পেঁচানো মমি কে আমাদের জেনারেশন বেশি চিনবে,কারণ আমাদের পপ কালচারে মমি মানেই হরর কিছু, যেকোনো সময় জেগে উঠে হামলা করবে বলে! ছোটবেলায় স্কুবি ডু তে দেখা সেই হরর মমি, তারপর লাইভ অ্যাকশন মুভি দ্যা মামি, কিশোর বয়সে রিক রিওরডান এর কেইন ক্রণিকলস সহ আরো কতভাবে যে এই মিশর ছোটবেলা থেকেই আমাদের কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তা বলা বাহুল্য। আমাদের সবার মনে ঘুরপাক খেত কিভাবে এত বড় পিরামিড এত পূর্বে মানুষ নির্মাণ করলো? কিভাবেই বা তারা এত সুন্দর করে মৃতদেহ সংরক্ষণ করতো? এইসব রহস্যের আবছা আবছা সব কাহিনী এতদিন জানতাম। কিন্তু কখনোই পরিষ্কার ভাবে একসাথে কোথাও পড়িনি। তাই যখন এই আদি থেকে অন্ত এর খোঁজ পেলাম বিশাল সাইজ দেখেই লোভ সামলাতে পারিনি। প্রায় ১০০০ পৃষ্ঠার বইটির প্রায় অর্ধেকটা পড়ে শেষ করেছি, পুরোটা পড়ার আগেই তাই একটু দম ফালানো দরকার।নাহলে এতসব তথ্য, গল্প সব গোল পাকিয়ে যাবে। বইটির প্রথম তিনটি অংশ নিয়ে কেমন লাগলো তাই বলি!
প্রথমেই বইটির সবচেয়ে সুন্দর অংশ যেটা সেটা হলো এর প্রচ্ছদ।দেখলেই মনে হয় একটা আধ্যাত্মিক প্রাচীনত্ব যেন মিশে আছে পুরো বইয়ে। প্রথম পর্ব হচ্ছে সূচনা পর্ব; যার মূল বক্তব্যই হচ্ছে কিভাবে মিশরে এই প্রাচীন সভ্যতার সূচনা হয়েছে। কিভাবে পৃথিবীর অন্যতম নীল নদের কোলে একদল মানুষ বসতি গড়ে নিজেদের একটি বিশাল উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তুলেছিল।মূলত আধুনিক সভ্যতার মানুষ কিভাবে এই হারিয়ে যাওয়া অতীত কে খুজে পেল, তাদের সমাধি, স্থাপত্য, সাহিত্য, ভাষা সবকিছুর উদ্ধার ও রহস্য সমাধান করলো তাই এই পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। কিভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং তাদের রাজনীতি এই অতীত উদ্ধারে ভূমিকা রেখেছে,কিভাবে ইতিহাসের কিছু বিখ্যাত মানুষ যারা আজীবন চেষ্টা করে গেছেন মিশর কে সমাধান করার জন্যে আর কিভাবে প্রাচীন সেই সভ্যতার নানা উপাদান তাদেরকে সাহায্য করেছে এইসব নিয়েই সূচনা পর্ব।
তারপর শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব: সমাধি থেকে মন্দির। মিশরীয় সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক বলতে গেলে যে কেউ এই পিরামিড আর মমির নামই বলবে স্বাভাবিক। মজার ব্যাপার হলো, ব্যাপারটা আরেকটু বৃহত্তর ক্ষেত্রে সঠিক। তার মানে মিশরীয়দের সবকিছুই আবর্তিত হতো তাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়েই। পরকালের উদ্দেশ্যেই তাদের এইসব সমাধি, মন্দির আর স্থাপত্য নির্মাণ। এই সমাধির বুকেই তাদের সাহিত্য রচিত, তাদের পুরাণ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সবকিছুই তারা লিখে রাখতো তাদের সমাধিতে। কারণ তারা তাদের জীবন কে অনেক ভালোবাসতো, আর মৃত্যু ছিল তাদের জন্য ভয়ংকর। এই বিভীষিকা আর ভয় থেকে বাঁচতে তারা আবিস্কার করলো জমকালো এক মৃত্যু পরবর্তী জীবন, যা ছিল এই বর্তমান জীবনের চেয়েও বেশি বিচিত্র। আর তাই পুরো জাতি তাদের সর্বস্ব দিয়ে দিত এইসব সমাধি আর মন্দির নির্মাণে। এর ফলে তাদের সভ্যতার খুঁটিনাটি অনেক কিছুই আমরা এইসব স্থাপত্য থেকেই সহজে পেয়ে যাই। প্রায় চার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বুকে ৩২ টি রাজবংশ কিভাবে এই মরুভূমি আর নীল নদের তীরে বিভিন্ন অতুলনীয় স্থাপনা তৈরি করেছে তাই এই পর্বের মূল বক্তব্য। প্রায় প্রতি যুগেই তাদের স্থাপত্যবিদ্যা অভাবনীয় উন্নতি লাভ করে, সেই সাথে বর্তমান যুগে উন্নতি হয় সেই সব স্থাপনার খোঁজে প্রত্নতত্ত্ববিদ্যা। লেখক অতি নিপুণভাবে তাদের স্থাপনশৈলী বর্ণনা করেছেন। কোথায় কোন জায়গা থেকে কি কি উদ্ধার হয়েছে, এবং এখন সেগুলো কোথায় আছে সবকিছুই টুকে রাখা হয়েছে বইটিতে।কখনো মিশর ভ্রমণ করলে হয়তো বইটি একটি চমৎকার গাইড হিসাবেও কাজ করবে।
তৃতীয় পর্ব ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়: জীবন ও মৃত্যুর ধর্ম। মিশরীয়রা জাতি হিসাবে ছিল খুবই ধর্মভীরু।সেই সাথে তাদের মধ্যে রাজকীয়তা, আভিজাত্য আর জাকজমকতাও ছিল বেশ। যুগে যুগে বেশ কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন বা বহিরাগতদের আগ্রাসনের ফলেও মিশরীয়রা তাদের পুরাণ কে কখনো পুরোপুরি বদলে ফেলতো না।অধিকাংশ সময়ই তারা নতুন কোনো মতবাদ কে পুরনোর সাথে মিশিয়ে তারপর সেটা গ্রহণ করে নিত।তারা দেবতাদের কে মানুষের মতোই মনে করতো, যাতে তারা তাদের মধ্যে নিজেদের জীবনের প্রতিফলন দেখতে পারে। ফলে দেখা যায়, তাদের দেবতারা মানুষের মতোই উত্থান পতনের ভিতর দিয়ে ক্রমবর্ধমান।সব মিথলজি বা পুরাণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে সৃষ্টিতত্ত্ব এবং তাদের দেবতাদের স্বরূপ। এই পর্বে এগুলোই আলোচনা করা হয়েছে। কিভাবে বিভিন্ন সময়ে তাদের সমাজের প্রয়োজন হিসাবে তারা সৃষ্টিতত্বকে পরিবর্তন করেছে, কিংবা বিভিন্ন দেবতাদের কাজ কিংবা নাম পরিবর্তন করেছে এগুলোও উঠে এসেছে এখানে। অন্য সব সৃষ্টিতত্ত্ব এর সাথে মিল অমিল, বা দেবতাদের গ্রীক কাউন্টার পার্ট লেখক সুন্দর করে উল্লেখ করেছেন।এইসব ধর্মীয় ইতিহাস, রীতিনীতি সবকিছুই মিশরীয়রা তাদের সমাধির মধ্যেই চিত্রাকারে লিখে গিয়েছে। যা আমাদের জন্যে ছিল একেকটি মাইলফলক। মিশরীয়রা নিজেরা যা দেখতো যার সম্মুখীন হতো তাকেই তারা ধর্মীয় বিশ্বাসে অন্তর্ভুক্ত করে নিত। যেমন একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে তাদের শৃগাল দেবতা আনুবিস, কুমির দেবতা সোবেক কিংবা বাজপাখির মুখ থাকা হোরাস কে নিয়ে। ��্রাচীন মিশরে মৃতদেহ ভক্ষণকারি এই তিনটি প্রাণীই ছিল মিশরীয় দের মৃতদেহ রক্ষার জন্য প্রধান হুমকিস্বরূপ।তাই তারা এই প্রাণীদের কেই দেবতা বানিয়ে ভক্তি করা শুরু করলো, যাতে তারা মৃতদেহ কে নষ্ট না করে। দেবতাদের আজব আজব সব কাহিনী ছাড়াও এই পর্বে আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে মমিকরণ প্রক্রিয়া। মিশরীয়রা কিন্তু নিজেরা কোনো কারণ ছাড়াই এই মমি করার ধারণা আবিষ্কার করেনি।মিশরে যখন মৃতদেহ স���াধিস্থ করার প্রচলন ছিল না, প্রাকৃতিক ভাবেই বালির নিচে চাপা পড়ে দেহগুলো বছরের পর বছর অবিকৃত থাকতো।তাই যখন মিশরীয়রা এই ব্যাপারটা দেখলো তখনই তারা কৃত্রিমভাবে বালি ছাড়াই কিভাবে মৃতদেহ অবিকৃত রাখা যায় তা আবিষ্কার করলো।সেটাই হচ্ছে মমীকরণ প্রক্রিয়া।সেই সময় এই বিষয়টি ছিল একটি শিল্প, যা এখনো আসলে একটি বিস্ময়কর বিষয়। এই প্রক্রিয়া পুরোপুরি বুঝতে আধুনিক গবেষকদের সেই প্রাচীন উপকরন দিয়েই নিজেদের মমি তৈরি করতে হয়েছিল!! কিভাবে তারা এত যুগ যুগ আগে এত অভাবনীয় শৈল্পিক জ্ঞানের চর্চা করতো তা আজও রহস্যময়।
চতুর্থ পর্ব হচ্ছে প্রাচীন মিশরের জনপ্রিয় ধর্ম।নামেই বুঝা যায়, এই পর্বে আলোচনা করা হয়েছে মিশরীয় পুরাণের ধর্মপালন, ধর্মের সাথে জীবনের সম্পর্ক,পূজা উৎসব আর জীবনযাপনের বহু রীতিনীতি। মিশরীয় সমাজের অত্যাবশ্যকীয় একটি অংশ ছিল জাদুবিদ্যা, যা যুগের পর যুগ এখনো বিভিন্ন রহস্য উপন্যাস আর চলচ্চিত্রের কল্পনার খোরাক হয়ে আসছে।বস্তুত, জাদুবিদ্যা ছিল মিশরের চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি অন্যতম রীতি।প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার চেয়ে চিকিৎসায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। বইয়ের ভেতর পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লেখক, যিনি নিজে একজন চিকিৎসক, খুব সহজেই বিভিন্ন উদাহরণ বর্ণনা করেছেন। এর সাথেও মিশরের প্রাচীন উৎসব, সংস্কৃতি, নাচগান, পুজাপার্বন সহ বিভিন্ন সামাজিক ঘটনাবলীর বর্ণনা এই পর্বে আছে।
পঞ্চম পর্বে আলাদা করে বর্ণিত হয়েছে মিশরীয় সাহিত্য। প্রাচীন সেই প্যাপিরাসে কিংবা সমাধির দেয়ালে অদ্ভুত সব চিত্রের মাধ্যমে যারা তাদের জীবনের সব গল্প এঁকে গিয়েছেন, তারা চেয়েছিলেন ভবিষ্যতের মানুষ এইসব গল্প জানুক, তাদের সোনালী সভ্যতা নিয়ে মেতে উঠুক।আজ শত বছর পরে তাদের কথাই যেন বাস্তবে ঘটে যাচ্ছে।এই পর্বে মিশরীয় দের রূপকথার মত বিভিন্ন গল্প পড়ে মনে হয়েছে, অন্যান্য দেশের চেয়ে তাদের গল্পগুলো অনেকটাই অভিনব এবং গভীর অনুধাবনমূলক। প্রায় প্রতিটি গল্পেই খুব সুক্ষ্মভাবে অনেক দার্শনিক মতামত এমন ভাবে বলা হয়েছে যাতে একবার চোখ বুলিয়ে বোঝা যায় না। মিশরীয়রা তাদের ধর্মের প্রতি অনুরাগ প্রতিটি গল্পেই খুব ফলাও করে বলতো, কেননা তারা ছিল খুবই ধর্মভীরু জাতি।
এরপর শেষ পর্ব, যার নাম প্রাচীন মিশরের গল্প।এর আগে যদিও প্রাচীন মিশর নিয়েই লেখা ছিল সবকিছু, কিন্তু এই পর্বের বিশেষত্ব হচ্ছে, এখানে সময়ের পরিক্রমায় ধারাবাহিক ভাবে আগের সব পর্বের কাহিনী একসাথে করে কিভাবে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা শুরু থেকে শেষ হয়েছে তার একদম চমৎকার বর্ণনা। পুরো বইয়ের এই পর্বই আমার সবচেয়ে প্রিয়, একটানা দুদিন পড়ে শেষ করেছি। পর্বের শুরু একদম প্রাগৈতিহাসিক যুগে।কিভাবে মানুষ মিশরের ভূখণ্ডে, নীল নদের অববাহিকায় প্রথম বসতি গড়ে তোলে, কিভাবে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী একটি জাতি হিসেবে গড়ে তোলে তা শুরুতেই আমরা জানতে পারি। তারপর একে একে সবগুলো রাজবংশের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে লেখক বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে এতদিন আগের পর্বে যা যা পড়েছি সবকিছুর সময় অনুযায়ী আবার উল্লেখ করে তা বর্ণনা করেছেন।এই দিক টা আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে।মিশরের প্রায় বত্রিশ টি রাজবংশ ছিল।এর মধ্যে বিভিন্ন সময় মিশরের খারাপ সময় গেছে, কিন্তু তারপরে আবার তারা প্রবল উদ্যমে ফিরে এসেছে নীলের বুকে।প্রথম রাজবংশের উত্থান, তৃতীয় রাজবংশ থেকে সমাধি সংস্কৃতির সূচনা, চতুর্থ রাজবংশের বিখ্যাত খুফুর পিরামিড, পঞ্চম রাজবংশের ধর্মীয় পরিবর্তন নিয়ে মিশরের প্রাচীন সাম্রাজ্য।এরপরে মিশর অন্ধকারে ডুবে যায়, কিন্তু আবার একাদশতম রাজবংশের মাধ্যমে প্রবলভাবে মধ্যবর্তী সাম্রাজ্যে ফিরে আসে। এই সময়েই কোন এক ফারাও এর শাসনামলে বিবলীয় জোসেফ, বা কোরআনের ইউসুফ আ. এর কাহিনী ঘটে যায়, যা লেখন অত্যন্ত সুন্দর ভাবে যাচাই বাছাই এর সাথে বর্ণনা করেছেন।তারপর এসে অষ্টাদশ রাজবংশের সেই বিখ্যাত তুতেনখামেনের কাহিনী, যার গল্প পড়ার জন্য আমি শুরু থেকে মুখিয়ে ছিলাম। মিশরের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজবংশ ছিল ১৯তম রামিসেস রাজবংশ, সেই সময়ের প্রকৃত ইতিহাস এর আগে ঝাপসা জানলেও, এই বইয়ে সবকিছুই যেন পরিষ্কার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। বাইবেল এর এক্সোডাসের সময়কাল নিয়ে বিভ্রান্তি নিয়েও লেখক চমৎকার যুক্তি দিয়েছেন। এই রাজবংশের পর থেকে মিশরে আস্তে আস্তে সোনালী সূর্য নিভতে শুরু করে, কিন্তু বইয়ের শেষ ভাগে, মূলত মিশরীয় ইতিহাসের শেষটাও তাদের পুরো সময়কালের মতোই চমকপ্রদ ছিল।কিভাবে প্রাচীন গ্রীক, রোমান, পারসিক আর ইসরায়েলিদের জন্য একে একে মিশর তার পুরনো জৌলুস হারায় তা এক অনন্য কাহিনী। একটি আশ্চর্যের ব্যাপার যা আমার কাছে লেগেছে তা হচ্ছে প্রায় সব সভ্যতার মানুষই মিশর দখল করে সেই মিশরীয়দের ধর্মে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন, কিন্তু কখনোই মিশরীয়দের ধর্মমত বা জীবনযাত্রা কে পরিবর্তন করতে পারেননি। এখান থেকেই বোঝা যায় তারা কতটা আধ্যাত্মিকভাবে শক্তিশালী ছিল।বইয়ের শেষ কাহিনী ছিল দ্বাবিংশতম রাজবংশের শেষ রাণী ক্লিওপেট্রার। যাকে নিয়ে এখন পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতেই সবার কাছে আলোচনা চলে।নাটক, থিয়েটার, গল্প উপন্যাস, চলচ্চিত্র এমনকি নারীসমাজের সবকিছুর মধ্যেই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রতীক হয়ে আছেন এই ক্লিওপেট্রা।আর তার মধ্য দিয়েই প্রায় চার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় মিশরীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
সামগ্রিক পর্যালোচনা: বিশদভাবে বলতে গেলে, আদি থেকে অন্ত বইটি আদতেই বাংলা ভাষায় মিশর নিয়ে একটি অন্যতম সৃষ্টি হয়ে থাকবে। যদিও কলেবরে বিশাল বই, কিন্তু মিশরের জন্য এই বিশালত্ব যথার্থই মানানসই।বর্ণনা ছিল সাবলীল, বানান ভুল চোখে পড়েনি।লেখক কনটেক্সট অনুযায়ী একই কাহিনী একের অধিকবার বর্ণনা করেছেন পাঠকের সুবিধার্থে, যা একটি ভালো দিক ছিল।প্রচ্ছদ খুবই সুন্দর আগেও বলেছি, প্রোডাকশন চমৎকার।তবে বইয়ে কোন বুকমার্ক দেয়া হয়নি।সবমিলিয়ে একজন মিথলজি ভক্তের কাছে এরকম বই আসলে একটি অকল্পনীয় সুন্দর উপহার বলা যায়। তাই লেখক কে ধন্যবাদ দিব এত চমৎকার একটি বই আমাদের উপহার দেয়ার জন্যে।
লেখক নিয়ে অবশ্য কিছু কথা না বললেই না, ব্যক্তিগত ভাবে না চিনলেও, যখন আমি শুনেছিলাম তিনি একজন চিকিৎসক, খুব অবাক হয়ে ভেবেছি এত সময় কিভাবে পেল উনি? নিজে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষানবীশ হওয়ায় হয়তো আমার কাছে খুবই অনুপ্রেরণামূলক ছিল বিষয়টা। একজন মানুষ কতটা ডেডিকেটেড হলে এই পেশায় থেকেও এরকম সাহিত্য রচনা করতে পারেন আমি জানিনা। আশা করি আপনি আমাদের আরো অসংখ্য রচনা উপহার দিবেন, আমরাও সব পুরাণ একেবারে হাতের মুঠোয় নিয়ে নিব।
মিশরীয় মিথলজি আদি থেকে অন্ত বইটার কলেবর অত্যন্ত বড়। ৭৫২ পৃষ্ঠার এত বড় বই একটা বই একটানা পড়ে শেষ করা যা তা কথা না। বইটার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই খুব মনোযোগ দিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়েছি আমি এই দাবি করব না। এই দাবি আসলে সম্ভবও না। এই বইয়ের ইনডেক্সই প্রায় দশপৃষ্ঠার মতো। তাহলে বুঝুন বইয়ের ভিতরে আসলে কত কিছু নিয়ে আসা হয়েছে। পুরো বইটাকে কয়েক পর্ব ভাগ করা হয়েছে প্রথম আছে সূচনা পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব হচ্ছে সমাধি থেকে মন্দির, তৃতীয় পর্ব জীবন ও মৃত্যুর ধর্ম, চতুর্থ পর্ব আছে প্রাচীন মিশরের জনপ্রিয় ধর্মগুলো নিয়ে আলোচনা, পঞ্চম পর্বে পাপিরাস সাহিত্য নিয়ে আলোচনা এবং ষষ্ঠ পর্বে প্রাচীন মিশরের গল্পগুলো তুলে ধরা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে ষষ্ঠ পর্বের প্রাচীন মিশরের গল্পগুলোয় খুবই আকর্ষণীয় ছিল। যদিও বেশিরভাগ গল্পই সম্ভবত অনুবাদ করে লেখা হয়েছে। এই পর্বে লেখাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। আমি কারণ লেখাগুলো খুবই আকর্ষণীয় ছিল। প্রতিটা পর্বের লেখাই যথেষ্ট বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে লেখা হয়েছে। প্রাচীন মিশরের ইতিহাস, পিরামিড ও তাদের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রায় সবারই আগ্রহ আছে। লেখক এক্ষেত্রে প্রায় প্রতিটা বিষয় তার এই বইটি তুলে এনেছেন বিস্তারিতভাবে লেখার মাধ্যমে। সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রাচীন মিশরের মিথোলজি নিয়ে এত বিস্তৃত বই আমি আগে পড়িনি এবং এর আগে সম্ভবত লেখাও হয়নি। এক্ষেত্রে লেখক নিয়াজ মওলাকে অবশ্যই বিশেষভাবে একটা ধন্যবাদ দিতে হয় এত চমৎকার একটা বই বাংলা সাহিত্যে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বইয়ের শেষে রেফারেন্স বইগুলোর নাম আর সংখ্যা দেখলেই বুঝা যায় লেখক কতটা কষ্ট করেছেন এই বইটা লেখার জন্য। রেফারেন্সগুলো দেওয়ার জন্য লেখার গুণগত মান সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। এই বইটা আসলে একবারে টানা শেষ করে পড়ে রেখে দেওয়ার মতো না। বরং এটা একটা রেফারেন্স বই হিসেবে নিজের লাইব্রেরীতে রেখে দেওয়া যায়। যখন সুনির্দিষ্ট কোন একটা টপিক সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা করবে এই বইটা বের করে পড়ে নিলেই হবে। কেননা এতটা বড় ও বিস্তৃত করেই বইটা লেখা হয়েছে যে পুরোটা একবারে মনে রাখা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। বইয়ের লেখার সাথে সংশ্লিষ্ট ছবি ডায়াগ্রাম রেফারেন্স ইত্যাদি লেখা থাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে এবং আগ্রহী পাঠকরা খুব সহজেই লেখা পড়ার সাথে সাথে সেই ছবিগুলো দেখলে বুঝতে পারবেন যে কোন টপিকে লেখাটা উপস্থাপন করা হয়েছে। সাধারণত আমরা যে সাইজের বই পড়ি তার তুলনায় এই বইটা আকারে অনেক বড়, পৃষ্ঠার আকারও অনেক বড়। তবে বইয়ের বাঁধের কাজ খুবই মজবুত হয়েছে এবং পৃষ্ঠাগুলো বেশ শক্ত এবং ভালো মানের দেয়া হয়েছে। প্রকাশনার মান যথেষ্ট ভালো, বানান ভুল কিংবা ছাপার কোয়ালিটি সম্পর্কে আসলে কোন প্রশ্ন তোলা যায় না। তুলনামূলকভাবে বইটার দাম অনেক বেশি হলেও বইটাতে যে পরিমাণ কনটেন্ট আনা হয়েছে, যত বিস্তারিত হবে বিভিন্ন বিষয়গুলো তুলে আনা হয়েছে, সেক্ষেত্রে দামটা আমার কাছে খুব বেশি মনে হয়নি। যারা মিশরীয় অতীত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চান কিংবা মিথলজি সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করেন, তারা নির্দ্বিধায় এই বইটা পড়তে পারেন। এবং বইটা পড়ার পরে সত্যিই উপলব্ধি করবেন কত চমৎকার একটা বই লেখা হয়েছে। নিয়াজ মাওলা ভাইয়ের সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় থাকার কারণে লেখা সম্পর্কে উনার প্যাশন নিয়ে যথেষ্ট ভালো ধারণা আছে আমার। এই বইটা প্রকাশ করার জন্য উনি কতটা কষ্ট করেছেন সেটা যে কোন পাঠক মাত্রই উপলব্ধি করতে পারবেন। এত চমৎকার অসাধারণ একটা মিথোলজির বই পাঠকদের কাছে তুলে দেওয়ার জন্য উনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ। বাংলা সাহিত্যে মিথলজির উপরে অন্যতম সেরা বই এটা।
মিশরীয় মিথলজি সম্পর্কে যতটুকু জানা শোনা ছিল তার পুরোটায় ছিল ইংরেজিতে (বিভিন্ন ওয়েবসাইট, Blog, আর গবেষনা পত্র থেকে)। এই বইটি সম্ভবত মিশরীয় মিথলজির উপর বাংলা ভাষায় রচিত সবচেয়ে কম্পাট গ্রন্থ। সুবিশাল এই বইটি পড়তে কিছুটা সময় লাগলেও কখনোই (বিরক্ত, ক্লান্তীকর) খারাপ লাগে নি। তার থেকে বড় কথা বইটিতে আমাদের দেশিয় পাঠকদের বেশ কিছু প্রশ্ন সেটা ধর্মীয়, হলিউড মুভিয়, কিংবা গুজব নিয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। ফারাওদের কাহিনীর ধারাবাহিকতা আর ঐতিহাসিক উপখ্যানগুলো রমঞ্চকর। মিশরীয় ঈশ্বরদের উৎপত্তি ও বিবর্তন নিয়ে বর্ণনা আরো বিশদ হলে আরো ভালো হত। কিছু বানান ভুল, আর টাইপিং মিশটেক আছে, ছবি গুলো সাদাকালো উপস্থিতি প্রায় ছবিই কালো প্রলেপ হয়েছে (সেক্ষেত্রে ইন্টারনেটে সার্চ দিতে দেখতে হয়েছে)। কিছু ইংরেজি অক্ষর সরাসরি বিজয় কি বোর্ড এর উদ্ভট শব্দ হয়েছে। আশা করা যায় পরবর্তী প্রকাশনায় এই দিকগুলো উতরে যাবে।
যদি মিথলজির বই বলতে কিছু দেবতা আর তাঁদের গল্প ভাবেন। তবে বইটা আপনার জন্য চমক। মিশরীয় মিথলজি আর ইতিহাস কে আলাদা রাখা বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ মিশরীয় ফারাওদের বলা হতো দেবতার প্রতিনিধি। মিশরীয়দের জীবনের এমন কোন অংশ ছিল না যা ধর্মের প্রভাবমুক্ত। আরো একটা বাধা ছিল লিখিত দলিলের অভাব। হ্যাঁ মিশর হায়ারোগ্লিফিকের দেশ, তবে সাধারণ মানুষেরা লিখতে জানতেন না। এসবের ছাপ এসেছে বইয়ে। বইটা কখনো কখনো মনে হচ্ছিল মিথলজি না বরং ইতিহাস । মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস, সমাধি এবং মন্দিরের বিবর্তন, বিবিধ ধর্মীয় গ্রন্থ, স্থানীয় ধর্মমতে বিভিন্ন সৃষ্টিতত্ত্ব, বিভিন্ন রাজবংশে প্রচলিত গল্প, সবশেষে বিভিন্ন রাজা ও রাজবংশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সবমিলিয়ে বইটি একটি তথ্যের খনি। আমার সংগ্রহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বই। তবে বইয়ের প্রডাকশন কোয়ালিটি দামের তুলনায় দুর্বল।
If you are a fan of mythology and want to about each and every thing about that time than it is a good good book which have covered almost every aspect of egyptian mythology.