Jump to ratings and reviews
Rate this book

হেমলকের নিমন্ত্রণ

Rate this book
কয়েকজন মহাপ্রতিভাবান মানুষ অদ্ভুত এক পাগলামি শুরু করেছিলেন। তাদের মধুর সেই পাগলামিতে জন্ম হয়েছিল সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণতন্ত্র, থিয়েটার, চিকিৎসা, দর্শনসহ মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সবকিছু। সেই পাগলামিকে একটি মাত্র মিষ্টি গল্পে নিয়ে এসেছেন কথা সাহিত্যিক সুজন দেবনাথ। সক্রেটিস একজন তুমুল প্রেমিক। তিনি স্ত্রীর সাথে খুনসুটিমাখা ঝগড়া করছেন, চুপিচুপি যাচ্ছেন শহরের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী মেয়ে আসপাশিয়ার কাছে, আবার বয়স্ক এক নারীর কাছে শিখছেন প্রেম। সেই প্রেম থেকে প্লেটো খুঁজছেন শরীরের আকর্ষণ ছাড়া সাধু-সন্ন্যাসী ধরনের নতুন এক প্রেম। তার নাম প্লেটোনিক প্রেম। ইতিহাসের জনক হেরোডটাস লিখতে শুরু করছেন পৃথিবীর প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ। থেলিস নামে এক লোকের ভাবনা থেকে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন জিনিস, নাম বিজ্ঞান। শুরু হচ্ছে অলিম্পিক গেমস, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সভ্য উপায়ে মানে মারামারি কাটাকাটি না করে বীর হওয়ার লড়াই। এথেন্সের মানুষ আবিষ্কার করছে গণতন্ত্র। পাহাড়ের উপরে বসছে পৃথিবীর প্রথম সংসদ। পিথাগোরাস বের করেছেন জ্যামিতির সূত্র, গোল্ডেন রেশিও। সেই রেশিও দিয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ভবন পার্থেনন ডিজাইন করছেন শিল্পী ফিডিয়াস। চিকিৎসাবিদ্যার জনক হিপোক্রাটিস ডাক্তারদের জন্য লিখতে বসলেন ‘হিপোক্রাটিক শপথ’। সক্রেটিস খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে দুষ্টুমি মিশিয়ে ‘সুন্দর জীবন’-এর গল্প বলছেন। তার দুষ্টুমিভরা প্রশ্ন থেকে প্লেটো শিখছেন জীবনের অর্থ। জন্ম হচ্ছে দর্শন ও নৈতিকতা। ম্যারাথন ময়দান থেকে এক দৌড়ে যুদ্ধের খবর আনতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন ফিডিপিডিস। সেই থেকে শুরু হচ্ছে ম্যারাথন দৌড়। লাখো সৈন্যের মোকাবেলায় মাত্র তিনশ জনকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন স্পার্টার রাজা লিওনিদাস। এথেন্সের থিয়েটারে এসেছেন প্রথম অভিনয় শিল্পী থেসপিস। মঞ্চে উঠেছেন ট্রাজেডি নাটকের জনক ইস্কিলাস, অভিনয় করছেন ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’। সফোক্লিস লিখতে বসেছেন সর্বকালের সেরা ট্রাজেডি ‘রাজা ইদিপাস’। হোমারের কবিতা আবৃত্তি করছেন ইউরিপিডিস। তিনি পাহাড়ের গুহায় বসে লিখছেন ‘ট্রয়ের মেয়েরা’। কমেডি নাটকের জনক এরিস্টোফানিস ভয়ংকর মিথ্যা কথায় সক্রেটিসকে আক্রমণ করে লিখছেন প্রহসন নাটক ‘মেঘ’। সেই ক্ষোভে প্লেটো তার সব নাটক কবিতা পুড়িয়ে দিয়ে কবি থেকে হয়ে যাচ্ছেন কঠিন দার্শনিক। তার আদর্শরাষ্ট্র থেকে নির্বাসন দিচ্ছেন কবি-সাহিত্যিকদের। কিছু মানুষের গোঁড়ামির জন্য হত্যা করা হচ্ছে সক্রেটিসকে। তিনি আসামী হয়ে দাঁড়াচ্ছেন আদালতে, পালানোর সবরকম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি পালাচ্ছেন না, শান্তভাবে চুমুক দিচ্ছেন হেমলক পেয়ালায়। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময়ে মানুষের জ্ঞানের জন্মের রোমাঞ্চকর বিষয়গুলো জীবন্ত করে একটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য গল্প বাংলাভাষীদের জন্য নিয়ে এসেছেন সুজন দেবনাথ। সেই মিষ্টি গল্পটির নাম-‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’।

550 pages, Hardcover

First published February 1, 2021

70 people are currently reading
516 people want to read

About the author

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
143 (65%)
4 stars
51 (23%)
3 stars
16 (7%)
2 stars
6 (2%)
1 star
1 (<1%)
Displaying 1 - 30 of 68 reviews
Profile Image for Shakil Mahmud.
90 reviews41 followers
April 16, 2021
'হেমলকের নিমন্ত্রণ' নাম শুনেই এতক্ষনে বুঝে গেছেন এই বইয়ের মূল চরিত্র হচ্ছেন সক্রেটিস। সক্রেটিস ছাড়াও তার সময়ের অন্যান্য দার্শনিক এবং ক্ল্যাসিকাল গ্রিসের সাহিত্য, ট্রাজেডি ও কমেডি নাটক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণতন্ত্র, দর্শন, চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে এক চমৎকার উপন্যাস লিখেছেন বাংলাদেশী কুটনীতিক সুজন দেবনাথ। এটা আসলে ঠিক উপন্যাস না। আবার পুরোপুরিভাবে হিস্টোরিক্যাল ফিকশনও বলা যায় না। কারন, বইয়ের শুরুতেই লেখক বলে দিয়েছেন যে, এই কাহিনীতে তিনি কোন কাল্পনিক চরিত্র আনেননি। তারমানে সমস্ত চরিত্রই আসল এবং ঐতিহাসিক। ইতিহাসের কাহিনী ক্রম ঠিক রেখে একটা গল্পের ধাচে লেখক আসলে ইতিহাস গ্রন্থই লিখেছেন বলা যায়। এবার বইটি নিয়ে কিছু বলা যাক।

প্রাচীন গ্রিস বিভক্ত ছিল অনেকগুলো নগররাষ্ট্রে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নগররাষ্ট্র হল এথেন্স, স্পার্টা, থিবস ইত্যাদি । আমরা সবাই মোটামুটি এটা জানি যে এথেন্স হলো বিশ্বের গণতন্ত্রের সূতিকাগার। স্পার্টা বিখ্যাত ছিল যোদ্ধা জাতি হিসেবে। সেখানে গণতন্ত্র নামে কোন বস্তুর অস্তিত্ব ছিলনা। ছিল শুধু রাজতন্ত্র। কিন্তু এথেন্স ছিল জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলা, ভাস্কর্য, নাটক, সাহিত্য এসব দিক দিয়ে শীর্ষে। এথেন্স কে বলা হত জ্ঞানের নগরী। এই বইয়ের কাহিনী যেই সময় থেকে শুরু হয়, সেই সময় এথেন্সে চলছিলো গণতান্ত্রিক নেতা পেরিক্লিসের (Pericles) সময়কাল। পেরিক্লিস ছিলেন তখনকার গণতন্ত্রের প্রধান নেতা এবং ক্ল্যাসিকাল এথেন্সের সব রকমের জ্ঞান-বিজ্ঞান, নাটক, দর্শন, সাহিত্য চর্চার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তার সময়টাই মূলত ছিলো এথেন্সের স্বর্নযুগ যাকে Age of Pericles বলা হয়ে থাকে। গ্রিসের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান দেবী এথিনার মন্দির 'পার্থেনন' পেরিক্লিসেরই অমর কীর্তি।

পেরিক্লিসের আমলেই এথেন্সে উত্থান ঘটেছিলো প্রতিভাবান এক ব্যাক্তির, যাকে বলা হয় সর্বকালের সেরা দার্শনিক, যিনি জ্ঞান অন্বেষণ নিয়ে শুরু করেছিলেন এক অদ্ভুত পাগলামি - তার নাম সক্রেটিস। সক্রেটিসের জ্ঞানান্বেষণ পদ্ধতি ছিল সবার থেকে ভিন্ন - তিনি প্রশ্নের মাধ্যমে জ্ঞানের গভীরে পৌছাতেন। তার এই প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলা কে বলা হয় "সক্রেটিক মেথড", যা এখনও এই আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ছাত্রীদের কে পড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় । সক্রেটিস এথেন্সের রাস্তায় হেঁটে হেঁটে যুবক তরুনদের ধরে ধরে বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন আর তাদের মাথায় নতুন নতুন আইডিয়ার জন্ম দিতেন। সক্রেটিস তাই নিজেকে "জ্ঞানের ধাত্রী" বা "Midwife to knowledge" বলে পরিচয় দিতেন। জ্ঞান বিষয়ে সক্রেটিসের সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হচ্ছেঃ "আমি শুধু একটি জিনিসই জানি। সেটি হচ্ছে - আমি আসলে কিছুই জানিনা।"

বিশ্বের সেরা দার্শনিক হবার পরেও সক্রেটিসের উপরে এথেন্সের লোকজন ছিলো ভীষণ ক্ষ্যাপা । কারন তাদের ধারণা ছিল সক্রেটিস এথেন্সের তরুন সমাজকে নষ্ট করে ফেলছে, তাদের মাথায় প্রশ্নের বীজ ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তাদেরকে বিনা প্রশ্নে কোনোকিছু মেনে না নিতে শিখাচ্ছে যেটা কিনা মুরুব্বিদের কাছে চরম বেয়াদবি। এজন্য এথেন্সের বুড়োরা সক্রেটিসকে দুই চোখে দেখতে পারতো না, তাকে দেখলে পাগল বলে এড়িয়ে যেতো বা তাড়িয়ে দিতো। সক্রেটিসের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন দুইজন যারা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাথে ছিলেন - ক্রিতো আর চেরোফোন। উচ্চবংশের ছেলে প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। প্লেটো ছিলেন জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্যের এক দুর্দান্ত প্রতিভা। তিনি কবি হিসেবে অল্প বয়সেই অনেক খ্যাতি লাভ করেছেন। যদিও পরে সক্রেটিসের দর্শনের স্পর্শে তিনি কবিতা/নাটক সব ছেড়ে দার্শনিক হয়ে যান। এছাড়াও সমগ্র এথেন্সের জ্ঞান পিপাসু সমস্ত যুবকদের কাছে সক্রেটিস ছিলেন আইডল। তার সময়েই এথেন্সে দর্শন, নাটক, ইতিহাস এসবের চরম উন্নতি ঘটে। তার সময়েই এথেন্স আর স্পার্টার মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত 'পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ' নামক ২৭ বছরের এক দীর্ঘ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

এই বইয়ে আরো জানা যায় কিভাবে ট্র্যাজেডি নাটকের উৎপত্তি ঘটলো, কিভাবে এথেন্সের তথা বিশ্বের প্রথম থিয়েটার 'ডিওনিসাস থিয়েটার' বানানো হলো, গ্রিস অঞ্চলের বিখ্যাত বসফরাস প্রনালীর নাম কিভাবে এলো, ক্লিসথেনিস কিভাবে প্রথম গণতন্ত্র আবিস্কার করলেন , Ostracism বা নির্বাসন এর ধারণা টা কিভাবে এলো, গ্রিসের নারী কবি শাপোর কারনে কিভাবে নারীর সাথে নারীর প্রেম বা Lesbianism তত্ত্বটির উদ্ভব ঘটলো ইত্যাদি সব চমকপ্রদ তথ্য। এ বইয়ে রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন আড়াই হাজার বছর আগের সক্রেটিস, সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটো, পৃথিবীর প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ "The Histories"এর প্রণেতা হেরোডটাস, বিজ্ঞানের জনক থেলিস, পৃথিবীর প্রথম ট্রাজেডি নাট্যকার এস্কিলাস, অন্যতম বিখ্যাত ট্রাজেডি নাট্যকার সফোক্লিস ও ইউরিপিডিস, পৃথিবীর প্রথম প্রহসন বা স্যাটায়ার নাট্যকার এরিস্টোফানিস, বিশ্বের চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক হিপোক্রাটিস প্রমুখ ইতিহাস বিখ্যাত লোকেরা। ওই সময়ের ক্ল্যাসিকাল গ্রিসের এসব বাঘা বাঘা ব্যাক্তিদের কাহিনী লেখক যথাযথ পরিমান তথ্য সহকারে গল্পের ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন এই বইতে। আরো একটি বিশেষ তথ্য জানা যায় যে, বিজ্ঞানের জনক থেলিসই প্রথম গ্রিক দেবদেবীর তত্ত্ব বাদ দিয়ে প্রকৃতির দর্শন শুরু করেন। সক্রেটিস তার গুরু বিখ্যাত দার্শনিক এনাক্সাগোরাসের পরামর্শে থেলিসের লিখা বইগুলো পড়েই দর্শনের দীক্ষা নেন, যা থেকে তিনি অনেক চিন্তা ভাবনা করে পরবর্তীতে দর্শনের নতুন এক শাখার জন্ম দেন, যা আমাদের কাছে এখন সুপরিচিত - এথিক্স বা মোরালিটি বা ন্যায়-নৈতিকতা। গ্রিক দেবদেবী জিউস, এথেনা, আফ্রোদিতি, পোসাইডন, প্রমিথিউস, হারকিউলিস প্রমুখ এর বিভিন্ন মিথের কথাও উঠে এসেছে এই বইতে।

এবার তৎকালীন গ্রিসের নারীদের নিয়ে কিছু বলা যাক। প্রাচীন গ্রিসে নারীদের বেসিক্যালি কোন ক্ষমতা ছিলোনা সন্তান জন্ম দেয়া আর দাসীগিরি করা ছাড়া। নিজের ঘরের লোকজন ছাড়া বাইরের কারো সামনে বের হওয়া এবং বাজারে বা শহরে বের হওয়া ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। গণতান্ত্রিক এথেন্সের সংসদে সবার ভোট দেয়ার অধিকার থাকলেও সংসদের আশেপাশে নারীদের পা দেওয়াও ছিল নিষিদ্ধ। এমনকি নগরের প্রধান বিনোদন কেন্দ্র ডিওনিসাস থিয়েটারে নাটক দেখাও ছিল নিষিদ্ধ। সোজা বাংলায় - খাচায় বন্দী পশুর সাথে নারীদের খুব একটা তফাত ছিলনা। নারীদের এই শোচনীয় অবস্থার ভেতরেও সেই সময়ে এথেন্সে এক নারী দার্শনিকের আবির্ভাব ঘটে ছাইয়ের স্তুপ থেকে ফিনিক্স পাখির জন্ম নেয়ার মতো, যিনি ছিলেন ওই সময়ের এথেন্সের একমাত্র নারী যিনি একাধারে জ্ঞান, রাজনীতি ও দর্শন চর্চা করতেন। আসপাশিয়া নাম্নী সেই জ্ঞানী দার্শনিক নারী ছিলেন মারাত্নক সুন্দরীও বটে। তিনি ছিলেন সক্রেটিসের জ্ঞান চর্চার প্রধান একজন সংগী এবং শুভাকাঙ্খী। তখনকার নারীবিদ্বেষী এথেন্সের কাছে স্বাভাবিকভাবেই এই নারীকে হতে হয়েছে পর্যদুস্ত এবং নানা হেনস্তার শিকার। এই সুন্দরী প্রজ্ঞাবান নারীর রূপ এবং গুণে প্রভাবিত হয়ে তাকে নিজের ঘরনী করে নেন সেই সময়ের এথেন্সের প্রধান নেতা পেরিক্লিস। এই নারী ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন পেরিক্লিসের একটি ভাষণ লিখার কারনে। স্পার্টার সাথে যুদ্ধে যারা মারা গেছেন তাদেরকে দাফন করার অনুষ্ঠানে পেরিক্লিস এক সুবিখ্যাত, হৃদয়স্পর্শী ভাষণ প্রদান করেন, প্লেটোর মতানুযায়ী সেই ভাষণের নাম "Pericles' Funeral Oration"। পেরিক্লিসের সেই দুর্দান্ত ভাষণ লিখে ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন এই বিদূষী মহিলা।

যুগে যুগে যত মনীষীই জ্ঞানের পিছে ছুটতে গিয়ে সমাজের প্রচলিত ধারণা গুলোকে প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জ করেছেন, তা���ের সবাইকেই হতে হয়েছে চরম হেনস্তার শিকার। যুগে যুগে তারা হয়েছেন বঞ্চিত এবং লাঞ্চিত এবং ষড়যন্ত্রের শিকার। সক্রেটিসের গুরু এনাক্সাগোরাসও হয়েছিলেন ষড়যন্ত্রের শিকার। এনাক্সাগোরাসের দোষ ছিলো একটাই - তিনি বলেছিলেন সূর্য চন্দ্র এগুলোতে কোন দেবতার কারসাজি নেই। সূর্য হচ্ছে মূলত গলিত উত্তপ্ত ধাতুর এক বিশাল পিন্ড। এদিকে গ্রিকরা সূর্য চন্দ্র এগুলোকে দেবতা ভাবতেন। তাদের চোখে এনাক্সাগোরাসের এই মতামত ছিল ব্লাসফেমি এবং এই ব্লাসফেমির মামলায় শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হতে হয় এনাক্সাগোরাসকে। একইভাবে খোদ সক্রেটিসও শিকার হন ষড়যন্ত্রের এবং হেমলকের বিষ খেয়ে মরতে হয় সর্বকালের সেরা দার্শনিককে। এরকম আরো অনেক ইন্টারেস্টিং তথ্যে ঠাসা এই সুবিশাল ৫৫০ পেজের বইটি।

প্রাচীন গ্রিসের ওই সময়টার প্রতি অনেক আগ্রহ থাকায় আমি এই বইটি সংগ্রহ করি। গ্রিসের সেই ক্ল্যাসিকাল সময়ের ঘটনাবলী জানতে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য এই বইটি হাইলি রিকোমেন্ডেড।
Profile Image for Shotabdi.
819 reviews194 followers
March 26, 2024
২.৫/৫

বড় ব্যাপ্তির ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গেলে মোটামুটি একটি বা দুটি প্রধান চরিত্রকে ঘিরে কাহিনী এগুতে হয়। তারা হতে পারে কাল্পনিক বা ঐতিহাসিক চরিত্র। সুনীলের টাইম ট্রিলজিতে এরকমই আছে। নয়তো এলোমেলো হয়ে যায় ঘটনাবলি।
এখানে সুজন দেবনাথ মূল চরিত্র হিসেবে নিয়েছেন সক্রেটিসকে। বলা ভালো, সক্রেটিসই এই উপন্যাসের প্রাণপুরুষ। তাঁর কাহিনীই ব্যাপৃত হয়েছে উপন্যাস জুড়ে। পাশাপাশি চলে এসেছেন হোমার, সফোক্লিস, ইউরিপিডিস, আসপাশিয়া, পেরিক্লিস, প্লেটো, এনিতাস ইত্যাদি সমস্ত ঐতিহাসিকভাবে সত্য চরিত্র। এসেছে মিথোলজির নানা কাহিনী, এসেছে ইশপের কথা।
কাহিনীর বিন্যাস এবং তথ্যে উপন্যাসটিকে বেশ ভালোই বলা চলে।
কিন্তু ভাষা, উপস্থাপনা এবং সঠিকভাবে চরিত্র অঙ্কনে লেখক শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। একটা সার্থক উপন্যাস কেবল সত্যি ঘটনা আর তথ্যের সমাবেশেই হয়ে যায় না। সুন্দর উপযোগী ভাষা এবং চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য ঠিকভাবে যুগোপযোগীরূপে ফুটিয়ে না তুললে সেটাকে সাহিত্যের পদমর্যাদা দেয়া যায় কি না সে ব্যাপারেই আমার সন্দেহ হয়।
গোটা উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমি সেই উপস্থাপনের কারণে বারবার বিরক্ত হয়েছি। সক্রেটিসের মুখের কথা শুনে মনে হচ্ছিল সে যেন পাড়ার কোন ফাজিল ছেলে। তার বন্ধু বান্ধবসহ তারা যেন কোন ইঁচড়েপাকা ছেলেছোকরাদের দল।
প্রাচীন গ্রিসের কাহিনীতে বাংলা উপন্যাসে কেউ প্রাচীন গ্রিসের ভাষা আশা করে না, সেটা সম্ভব ও না। তাই বলে একালের ভাষা ব্যবহারও যে উপন্যাসকে হালকা করে ফেলে সে ব্যাপারে লেখকের বোধহয় একটু সচেতন থাকা উচিত ছিল।
জ্ঞানকুমার, নালিশ কুমার, নছল্লা করা ইত্যাদি একেবারেই বাজে শব্দচয়ন গোটা উপন্যাসের আবহ নষ্ট করেছে বলেই আমার মনে হয়েছে।
এটা নন ফিকশন হিসেবে লিখলে লেখক বোধহয় আরো ভালো করতেন।
Profile Image for Akash Saha.
156 reviews25 followers
October 12, 2021
'হেমলকের নিমন্ত্রণ ' - নামটি শুনলে যে কেউ বুঝে নিবে বইটি সক্রেটিসের জীবনের উপর। লেখক সুজন দেবনাথ অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় এত তথ্যমূলক উপন্যাসটি লিখেছেন। সক্রেটিসের জন্ম থেকে শুরু করে দার্শনিক হয়ে উঠার গল্প শুনিয়েছেন লেখক তার সাবলীল লেখনীর মাধ্যমে। সমকালীন সময়ের গ্রিক নগররাষ্ট্র সম্পর্কে, তাদের জীবন সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে বইটি পড়ে। এছাড়া সক্রেটিসের দর্শন, তার মৃত্যু পাঠকের মনে চিন্তার খোরাক যোগাবে।

বইটি লিখতে লেখক অনেক পরিশ্রম করেছেন, প্রচুর রেফারেন্স আনা সত্ত্বেও বইটি টিপিক্যাল ইতিহাসের বই এর মতো নয়, সাধারণ মানুষের কথ্য ভংগীতে লেখা হয়েছে ৫৫০ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি। তবে কথ্যভাষায় লিখলেও কিছু শব্দ কানে বেধেছে, যেগুলো ঠিক বইয়ের পাতায় মানায় না। বাকিটুকু পার্ফেক্ট বলা চলে, গ্রিক দর্শন নিয়ে পাঠককে আগ্রহী করতে যথেষ্ট।
Profile Image for Tahjiba Adrita.
103 reviews34 followers
January 26, 2022
বইটির সঙ্গে আমার পরিচয় একদম হুট করেই। একদিন বিকালে বাতিঘরে এই বই সেই বই ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে এই বইটি হাতে পরে যায়। "হেমলকের নিমন্ত্রণ" নাম দেখে মনে হয়েছিল বইটি কোনো ভারতীয় লেখকের লেখা,কেন মনে হয়েছিল আমি জানি না। কিন্তু ফ্ল্যাপের লেখা পড়ে আর প্রকাশনী দেখে বুঝলাম আরেহ না এতো বাংলাদেশী লেখক।এরপর একটু নড়ে চড়ে উঠলাম, প্রথম কয়েক পেইজ পড়ে বুঝলাম বই টা সম্ভবত সক্রেটিস কে নিয়ে লেখা। প্রথম কয়েক পেইজ পড়ে বাকি পেইজগুলো পড়ার আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় ধুম করেই বইটি কিনে ফেলি।তখনো খুব বেশী এক্সপেকটেশন ছিলো না বইটি নিয়ে,কিন্তু পেইজের পর পেইজ শেষ হয় আর বইটির প্রতি আকর্ষণ যেনো আরো বেড়ে যায়। এত অসাধারণ তথ্যবহুল লেখা বর্তমান সময়ে খুব কম চোখে পড়েছে।লেখক অনেক গবেষণা করে উপন্যাস টি লেখেছেন।অনেক তথ্যবহুল একটি লেখা কিন্তু উপন্যাসের মান কমেনি একটুও।একমুহূর্তের জন্যেও বিরক্তি আসেনি।কী এক অদ্ভুত আকর্ষণ, এই আকর্ষণ কী লেখকের লেখনী শক্তির নাকি সক্রেটিসের নিজের এই প্রশ্নের উত্তর জানি না আমি। সক্রেটিস বলেছিলেন "know thyself /নিজেকে জানো" কিন্তু সক্রেটিস কে জানতে হলে কী করতে হবে?সক্রেটিস কে জানতে হলে জানতে হবে সক্রেটিস এর সময় কে,সক্রেটিস এর পারিপার্শ্বিক কে,জানতে হবে এথেন্স কে যে শহরে হেঁটে বেড়িয়েছেন তিনি। এথেন্স শহর,সেই সময় সবকিছু মিলিয়েই তো সক্রেটিস। সক্রেটিস হচ্ছেন আসলে নিজেই একটা সময়,যে সময়ের হাত ধরে এসেছে আমাদের বর্তমান সময়।আমার মনে হতো দর্শন বুঝি খুব বিরক্তিকর কোন বিষয়,এই উপন্যাস পডে বুঝলাম দর্শন কত সুন্দর,কত জীবন ঘনিষ্ঠ। দর্শন ছাড়াও এই উপন্যাসে এসেছে বিজ্ঞান,সাহিত্য,স্থাপত্য,চিকিৎসা সব বিষয়ের কথা।এসেছে রাজনীতি গণতন্ত্র। সব মিলিয়েই আসলে সক্রেটিস এর সময়কাল।

এই উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রতি পর্বের শুরু তে মনীষীদের উক্তি আর যে কোনো তথ্যে বিস্তারিত ফুটনোট,এই দুইটি বই টির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়।অনেক জায়গায় অনেক চরিত্র বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, অগোছালো লাগতে পারে কিন্তু লেখকের গল্প বলার ক্ষমতা দিয়ে এই ব্যাপার উপেক্ষা করা যায়।লেখক এমন এক গল্প বলেছেন যেখানে সক্রেটিস কে একজন জলজ্যান্ত মানুষ হিসেবে কল্পনা করতে পাঠক বাধ্য যেখানে সক্রেটিস হাসে,কথা বলে,হেঁটে বেড়ায়,জ্ঞান বিতরন করে।অনেক বড় উপন্যাস তাও কেন যেনো মনে হচ্ছে অনেক তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো। উপন্যাস টি নিয়ে আরো আলোচনা দরকার,প্রথম উপন্যাস হিসেবে লেখক নিসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার।

উপন্যাস টি শেষ হওয়ার পরে প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে এত যুগ পরে এসেও আদৌ কী আমরা জাগতিক নিয়মের বাইরে অন্যরকম কিছু কে সহজে মেনে নিতে পারি? ভিন্নমত পোষণ কারীদের কে কী সমাজ এখনো মেনে নিতে পারে? যারা একটু ভিন্ন ভাবে চিন্তা করে তাদের কী আড়ালে আমরা এখনো পাগল ডাকি না? আসলে গলদ টা কোথায়? আমরা কী পরিবর্তন মেনে নিতে পারি না? নাকি বদলাতে আমাদের ভয় হয়?
Profile Image for Kripasindhu  Joy.
543 reviews
March 24, 2025
এই বই পড়তে গিয়ে বেশ কিছু জায়গায় বিরক্তি জন্মেছে।
প্রথমটা হলো, গল্প বলার ধরনে। গল্প না বলে ইতিহাসের বই লিখছেন বলেই বেশি মনে হয়েছে। ঐতিহাসিক উপন্যাসে রূপান্তর করতে পারেননি। গল্পের ভেতরে কিভাবে ইতিহাস আনতে হয় সেই কাজে লেখক দক্ষ নন। এইজন্য অনেক সময় দেখা গিয়েছে পাতার পর পাতা শুধু ইতিহাস-বিষয়ক ফিচার লেখা হয়েছে।

দ্বিতীয়টা হলো, ভাষা। কাহিনি হলো আড়াই হাজা�� বছর আগের কিন্তু ভাষা হালকা-পাতলা, পটকার মতো। ভূমিকাতেই লেখক জানিয়েছেন তিনি একবিংশ শতাব্দীর মতো করে লিখেছেন। লেখার ধরন এই বইটাকে আরও খারাপ করে দিয়েছে।

একেবারে শুরুর দিকেই পদার্থবিজ্ঞানের একটি বিষয় নিয়ে উদাহরণ দিয়েছেন। যার অস্তিত্ব সেই সময়ে ছিলই না। বিষয়টা অনেকটা একশ বছর আগের কোনো মানুষের হাতে আইফোন তুলে দেওয়া।
আরেকটি হলো, নাটুকেপনা আর ন্যাকামী। সক্রেটিস হলো নালিশ কুমার! প্লেটো হলো চওড়া বাবু! এটা উপন্যাস নাকি বাচ্চাদের জন্য লেখা কোনো রূপকথা?

লেখক যে এই বইটি লেখার জন্য পরিশ্রম করেছেন তা বেশ স্পষ্ট। কিন্তু ভাল করার অনেক কিছুই ছিল। প্লট সম্ভাবনাময়। যদি একে উপন্যাস হিসেবে লিখতেন তবে সাহিত্যের জন্য এটি বড় সম্পদ হতে পারতো।
Profile Image for Musharrat Zahin.
404 reviews489 followers
June 7, 2024
এই বইটা নিয়ে এর আগে তেমন কোনো লেখা আমার চোখে পড়েনি। এইবারের বইমেলায় হুট করেই বইটা হাতে নিই, আর দুই-চার পাতা পড়ে ঠিক করে ফেলি যে বইটা আমি নিচ্ছি৷ 'হেমলকের নিমন্ত্রণ' নাম দেখে কেন জানি মনে হয়েছিল লেখক হয়তো ভারতীয় কেউ হবেন। কিন্তু যখন জানতে পারি যে এইটা বাংলাদেশি লেখকের লেখা, বেশ অবাক হয়েছিলাম। কারণ অনেকদিন পরে এমন ইন-ডেপথ গবেষণা করে লেখা একটা বই পড়লাম। ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যবইগুলোয় দেখতাম বিশ্বে যা কিছু প্রথম আবিষ্কার হয়েছে, তার প্রায় সবকিছুই যেন গ্রীকদের করা। এই যেমন গণতন্ত্র, দর্শন, অলিম্পিক, ম্যারাথন, বীজগণিত, এথিক্স, জিমনেশিয়াম, জিমন্যাস্ট, লজিক, লাইব্রেরি, জাদুঘর, উপন্যাস, চিকিৎসাবিদ্যাসহ আরো নানান জিনিসের কারিগর এই গ্রিকরাই। তাই এই বইটার পরিসর এত বড় যে সবকিছু নিয়ে একটু একটু করে লিখতে গেলেও আলাদা একটা বই লেখা হয়ে যাবে। আবার লিখতে যেয়ে খেয়াল হলো নানান ব্যস্ততায় প্রায় এক মাস নিজের জন্য কিছু লেখা হয়নি। তাই মনমতো শব্দও মাথায় আসছে না, রিভিউ লেখার প্যাটার্নের খেইটাও খোয়া গেছে। 

.

.

.

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এথেন্সে ছিল জ্ঞানের ছড়াছড়ি। মনে হচ্ছিল সবাই কোনো না কোনো বিষয় আবিষ্কার করে যাচ্ছে। সবাই পাল্লা দিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের একের পর এক সৃষ্টিশীল কর্ম তৈরি করে যাচ্ছে! নাটক, সাহিত্য, গণতন্ত্র, ইতিহাস, দর্শন, চিকিৎসা, ভাস্কর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন, রাজনীতি– সবকিছুর আঁতুড়ঘর যেন এই এথেন্স। 



এই শহরেই জন্ম নেন সক্রেটিস। কিন্তু তাঁর চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণ সাধারণ মানুষের চাইতে একেবারেই ভিন্ন। বাবা ভাস্কর্য বানালেও, তাঁর এসব নিয়ে কোন মাথাব্যথাই নেই। তাঁর প্রিয় কাজ হল মানুষের সাথে প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলা। শুধু একা খেলেই সে ক্ষান্ত হয় না, তাঁর সমবয়সী অন্যদেরও সে এই খেলা শিখিয়ে দেয়। দেব-দেবীদের মানা গ্রীকদের কাছে তখন সক্রেটিস আতংকের নাম। কারণ তাঁরা কোনোভাবেই সক্রেটিসের যুক্তির কাছে পেরে ওঠেন না। তাই তরুণদের কাছে তিনি জনপ্রিয় হলেও তাদের বাবাদের কাছে আতঙ্কের নামও সক্রেটিস। তাদের দাবি ছেলেদের নষ্ট করে ফেলছে সক্রেটিস। প্রশ্ন করার এই খেলাটার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘সক্রেটিস মেথড’। এটা যেন বয়স্ক সবার ঘুম হারাম করে ফেলছে। 



এখন যে গণতন্ত্রের গান গাওয়া হয়, তার শুরুটাও হয়েছিল গ্রীসেই। অবশ্য সেটা সক্রেটিসেরও আগের আমলে। তবে সক্রেটিসের আমলে আমরা দেখতে পাই গণতন্ত্রের পূজারী পেরিক্লিসকে৷ সেই সময়ের এথেন্স কিভাব্র পরিচালনা করা হতো, সেটাও ছিল একটা দেখার মতো জিনিস। এথেন্সের সবাই গণতন্ত্রক্ত সাদরে গ্রহণ করলেও সক্রেটিস কখনোই গণতন্ত্রের সাথে একমত ছিলেন না। কারণ মানুষ বুদ্ধি দিয়ে বিচার করার চেয়ে আবেগ দিয়ে চিন্তা করতে বেশি পছন্দ করে। অন্য কেউ কিছু বোঝালে সেটাতেও হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলায়। সক্রেটিস বলেন, গণতন্ত্র হলো মূর্খদের শাসন। গণতন্ত্রে চাইলে সংখ্যাগরিষ্ঠরা অযোগ্য কাউকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিতে পারেন, তাই সক্রেটিস গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। ফলে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি থাকে কি সেখানে থাকে। এই গণতন্ত্রই হয়তো পেরিক্লিসের ডাউনফল কিংবা সক্রেটিসের মৃত্যুর প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 



এই বইয়ে সেই সময়কার গ্রিক নারীদের কথাও বলা হয়েছে। তখন তারা সবার আড়ালেই থাকতেন। পুরুষেরা জ্ঞান চর্চা করলেও নারীদের সেই সুযোগটা ছিল না। গণতান্ত্রিক এথেন্সের সংসদে সবার ভোট দেয়ার অধিকার থাকলেও সংসদের আশেপাশে নারীদের পা দেওয়াও ছিল নিষিদ্ধ।  কিন্তু তাদের ব্যতিক্রম ছিলেন আশপিয়া। ওই সময়ের এথেন্সের একমাত্র নারী যিনি একাধারে জ্ঞান, রাজনীতি ও দর্শন চর্চা করতেন। সবাইকে আশপিয়াকে তাঁর সৌন্দর্যের জন্য চিনলেও, সক্রেটিস তাঁকে চিনতেন সবচেয়ে জ্ঞানী নারী হিসেবে। সক্রেটিস নিজের চেয়েও বড় করে আশপাশিয়াকে দেখে। আশপাশিয়ার কাছ থেকে প্রায়ই সেই জ্ঞানার্জনের জন্য আসে। আশপিয়ার জ্ঞানের প্রেমে পড়েই তাঁকে বিয়ে করেন পেরিক্লিস। সেই থেকে পেরিক্লিসের সব সিদ্ধান্তের পেছনেই আশপিয়ার বড় অবদান থাকে। তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন পেরিক্লিসের একটি ভাষণ লিখার কারনে। স্পার্টার সাথে যুদ্ধে যারা মারা গেছেন তাদেরকে দাফন করার অনুষ্ঠানে পেরিক্লিস এক সুবিখ্যাত, হৃদয়স্পর্শী ভাষণ প্রদান করেন, সেই ভাষণের নাম "Pericles' Funeral Oration"। পেরিক্লিসের সেই দুর্দান্ত ভাষণ আপনি ইন্টারনেটে খুঁজে পাবেন। 



সক্রেটিসের সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, "আমি শুধু একটি জিনিসই জানি। সেটি হচ্ছে - আমি আসলে কিছুই জানিনা।" কী শক্তিশালী একটা বাক্য। সক্রেটিসের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন দুইজন যারা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সাথে ছিলেন - ক্রিতো আর চেরোফোন। উচ্চবংশের ছেলে প্লেটো ছিলেন সক্রেটিসের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্র। প্লেটো ছিলেন জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্যের এক দুর্দান্ত প্রতিভা।  তার সময়েই এথেন্সে দর্শন, নাটক, ইতিহাস এসবের চরম উন্নতি ঘটে। এই সময়েই এথেন্স আর স্পার্টার মধ্যে ইতিহাস বিখ্যাত 'পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধ' নামক ২৭ বছরের এক দীর্ঘ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বইয়ে এই যুদ্ধের বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে। 



প্রাচীন গ্রিস কিন্তু কেবল এথেন্স না, স্পার্টা, থিবসসহ অন্যান্য নগররাষ্ট্রও ছিল। যুদ্ধে বা রাজতন্ত্রে স্পার্টা এগিয়ে থাকলেও, জ্ঞান ও গণতন্ত্র চর্চায় এথেন্স ছিল সবচেয়ে এগিয়ে। এথেন্স ছিল জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্পকলা, ভাস্কর্য, নাটক, সাহিত্য এসব দিক দিয়ে শীর্ষে। এথেন্সকে বলা হত জ্ঞানের নগরী। আর পেরিক্লিস ছিলেন সেই নগরীর নায়ক। তিনিই এথেন্সে সব রকমের জ্ঞান-বিজ্ঞান, নাটক, দর্শন, সাহিত্য চর্চা চালু রেখেছিলেন। গ্রিসের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান দেবী এথিনার মন্দির 'পার্থেনন' তাঁর সিদ্ধান্তেই বানানো। তবে এথেন্সের ধনী শ্রেণির কাজ বলতে তখন কিছুই ছিল নাহ। যা করার সব দাসেরাই করে ফেলতো,জলপাই বাগান চাষ করে,জলপাই তেল বিক্রি করে দেবী এথিনা আর দেবতা জিউসের দয়ায় এথেন্স ছিল স্বাবলম্বী।



কী নেই এই বইয়ে? এখানে আছে ট্রয় নগরীর কথা, কেন এই যুদ্ধের এমন পরিণতি হয়েছে সে কথাও আছে। আছে পিথাগোরাস ও তাঁর শিষ্যদের কথা, ম্যারাথন দৌড়ের উৎপত্তির কথা, ট্র্যাজেডির জনক সফেক্লিস এবং তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইউরিপিডিসের কথা। প্রাচীন গ্রিসে অ্যাপলোকে চিকিৎসার দেবতা মনে করা হতো। গ্রিসের মানুষরা ভাবতেন যে দেবতার বংশের বাইরে কেউ সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করতে পারবেন না। কিন্তু প্লেগের সময় সেই প্রথা ভেঙে এগিয়ে আসেন হিপোক্রেটস। তিনি তাঁর শিষ্যদের চিকিৎসাবিজ্ঞ��নে দীক্ষিত করেন। সেই সময় তিনি তাঁর শিষ্যদের যেই শপথ বাক্য পাঠ করান, সেই একই শপথ বাক্য আজো মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা প্রথম ক্লাসে পাঠ করেন। 



'গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ' হিসেবে খ্যাত “অলিম্পিক গেমস” এর শুরুটা কিভাবে হয় সেই ইতিহাসও আছে এখানে। এই বইয়ে আরো জানা যায় কিভাবে ট্র্যাজেডি নাটকের উৎপত্তি ঘটলো, কিভাবে বিশ্বের প্রথম থিয়েটার 'ডিওনিসাস থিয়েটার' বানানো হলো, ক্লিসথেনিস কিভাব��� প্রথম গণতন্ত্র আবিস্কার করলেন , Ostracism বা নির্বাসন এর ধারণা টা কিভাবে এলো, গ্রিসের নারী কবি শাপোর কারনে কিভাবে নারীর সাথে নারীর প্রেম বা Lesbianism তত্ত্বটির উদ্ভব ঘটলো ইত্যাদি সব চমকপ্রদ তথ্য। 



এই বইয়ে আরও উঠে এসেছে কিভাবে সক্রেটিস তার গুরু বিখ্যাত দার্শনিক এনাক্সাগোরাসের পরামর্শে থেলিসের লিখা বইগুলো পড়েই দর্শনের দীক্ষা নেন, যা থেকে তিনি অনেক চিন্তা ভাবনা করে পরবর্তীতে দর্শনের নতুন এক শাখার জন্ম দেন, যা আমাদের কাছে এখন সুপরিচিত - এথিক্স বা মোরালিটি বা ন্যায়-নৈতিকতা।  এথেন্সকে পুণ: নির্মাণ করা স্থপতি ফিডিয়াস, সক্রেটিসের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা দেওয়া এনিতাস,ম্যালিয়াস থেকে শুরু করে গ্রিক দেবদেবী জিউস, এথেনা, আফ্রোদিতি, পোসাইডন, প্রমিথিউস, হারকিউলিস ইত্যাদির কথাও উঠে এসেছে এই বইতে।



আরও হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসির কথা যে কিভাবে গ্রিকের মানুষেরা এটা ধর্মগ্রন্থের মতো মান্য করতেম, প্রমিথিউসের ঘটনা নিয়ে এস্কিলাসের লেখা বিশ্বের প্রথম ট্র‍্যাজেডির, এসেছে এস্কিলাসের ছাত্র সফোক্লিসের কথা যিনি মঞ্চাভিনয়ের পাশাপাশি রচনা করেন মৌলিক ট্র‍্যাজেডি 'কিং ইডিপাস'। আছে সেই ডেলফির মন্দিরের কথা, যেখানে মানুষ সত্যের সন্ধানে যায়। আর এখানেই সক্রেটিসকে সেই সময়ের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। আছে ইতিহাসের জনক হেরাডোটাসের কথা, যিনি নাকি গ্রিসের সমস্ত ইতিহাস মুখস্থ করে ফেলেছেন। এমনকি ম্যারাথন যুদ্ধের বর্ণনায়ও তার মুখে ফুলঝুরি। সক্রেটিস শুনে অবাক হয়ে বললেন এসব ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিপিবদ্ধ করো। বিশাল মোটা পেপিরাস কাগজে হেরাডোটাস লিখে ফেললেন ইতিহাসের প্রথম বই The Histories।


এই যে আমরা সক্রেটিস নিয়ে এত জানতে পারছি, তার সমস্ত কৃতিত্ব তাঁর ছাত্র প্লেটোর। শেষ বয়সে এসে তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ছাত্রটির দেখা পেলেন। মূলত প্লেটোর লেখায় আমরা পরিপূর্ণভাবে সক্রেটিসকে চিনতে পারি। প্লেটো না লিখলে হয়তো সক্রেটিস অনাবিষ্কৃত রয়ে যেত।

.

.

.

সক্রেটিসের শেষ পরিণতিটা খুবই পীড়াদায়ক। সক্রেটিসকে নিয়ে এমন এক কমেডি নাটক লিখলেন কমেডির জনক এরিস্টোফেনিস, যার কারণে সবাই সক্রেটিসকে ঘৃণা করা শুরু করে দিলো। সবাই ধরে নিলো যে নাটকের কথাই ঠিক। সক্রেটিস আসলে এমনই। যেই এথেন্সের জন্য তিনি এত ভাবেন, সেই এথেন্সের মানুষই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ালো। 'দ্য ডেথ অব সক্রেটিস' পেইন্টিংটা আগে দেখার কারণে তাঁর মৃত্যু নিয়ে একটা আইডিয়া ছিল। বইয়ে পড়ার পর দৃশ্যটা চোখের সামনে আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। একটা মানুষ এক জীবনে এতটা ভাগ্যবান হতে পারলেই নিজের মৃত্যুর সময় এতগুলো কাছের মানুষকে একসঙ্গে পায়। 



প্রাচীন গ্রিস থেকেই কিন্তু দর্শন নিয়ে কথাটা শুরু হয়। যদিও আমার কাছে দর্শন জিনিসটাই খুবই বিরক্তিকর লাগতো। কিন্তু এই বইটা পড়ার পর সম্পূর্ণ চিন্তাধারাটাই বদলে যায়। সক্রেটিসের জনপ্রিয় উক্তি, "Know Thyself" কী ছোট্ট কিন্তু জটিল একটা বাক্য! আমার কাছে এই বইয়ের সবচেয়ে প্রিয় দিক হলো প্রতি পর্বের শুরুতে মনীষীদের উক্তি, যে কোনো তথ্যে বিস্তারিত ফুটনোট আর রেফারেন্স অংশটা। এগুলো ঘাঁটতে যেয়ে আমি আরো দারুণ কিছু বই আর বিষয়ের সন্ধান পাই। 



লেখকের লেখার ধরন দারুণ! এত সুন্দর করে ছোট ছোট বাক্যে যেভাবে পুরো বইটি লিখে গেছেন তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এই বইয়ের যেই জিনিসটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটা হল প্রতিটা পর্বের শুরুতে থাকা বিভিন্ন উক্তি এবং পেইজের নিচে থাকা ফুটনোট ও বইয়ের শেষে থাকা রেফারেন্স। এইটা থেকে যে আরও কত বইয়ের সন্ধান পেয়েছি। বইটা পড়েই বোঝা গেছে যে কী পরিমাণ পরিশ্রম করে উনাকে এই বই লিখতে হয়েছে। বইটা পড়ার পুরোটা সময় আমি ডুবে ছিলাম সেই আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছরের পুরোনো এথেন্সে। বইয়ের বিষয়গুলো এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যেন মনে হচ্ছিল টাইম ট্রাভেল করছি। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এথেন্সের আগোরা, ম্যারাথন যুদ্ধের খবরটা দৌড়ে নিয়ে আসা, জেনথিপির গালিগালাজ, থিয়েটারের নাটক, সিমনের জুতার দোকান, আসপাশিয়া ও পেরিক্লিসের বাড়ি, হিপোক্রেটিসের দীক্ষা দেওয়ার দৃশ্য, দেবী এথিনার মন্দির, সবশেষে এক পেয়ালা হেমলক এবং সক্রেটীয় যুগের সমাপ্তি। এইটাই লেখকের সার্থকতা। 
Profile Image for Mahrufa Mery.
202 reviews115 followers
December 31, 2022
এই বছরের পড়া শেষ এবং সেরা বই! পরে রিভিউ দিবনে। হ্যাপি থার্টি ফার্স্ট!
Profile Image for Zakaria Minhaz.
260 reviews23 followers
June 11, 2024
#Book_Mortem 172

#হেমলকের_নিমন্ত্রণ

আমার একটা অদ্ভুত ইচ্ছে আছে। মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তার কাছে যদি কিছু চাওয়ার সুযোগ পাই, তাহলে এই পুরো পৃথিবীটা কীভাবে একের পর এক ঘটনার মাধ্যমে আজকে রূপ ধারণ করেছে তা দেখতে চাইবো। এক সময়ের পৃথিবীতে এক দুইজন মানুষের সিদ্ধান্তই আজকের পুরো পৃথিবীর রূপরেখা গড়ে দিয়েছে। এখনকার পৃথিবীতে সেটা সম্ভব হয় না অনেক কারনেই। আমার দেখতে ইচ্ছে করে সেইসব সময়গুলোকে যার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আজকের পৃথিবী।

যাহোক প্রাচীন পৃথিবী সম্পর্কে আমার এই জানার আগ্রহের একটা অংশ পূরণ হলো হেমলকের নিমন্ত্রণ বইটির মাধ্যমে। লেখক সুজন দেবনাথের সুন্দর এবং প্রাঞ্জল লিখনশৈলীর মাধ্যমে গল্পে গল্পে পৃথিবীর অনেক "প্রথমের" শুরু সম্পর্কে বেশ চমৎকার একটা ধারণা পেলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমি চলে গিয়েছি আড়াই হাজার বছর আগের সেই এথেন্সে। কল্পনায় বসে রয়েছি এজিয়ান সাগরের পাড়ে। হেঁটে বেড়িয়েছি আগোরার পথ ধরে, এলোপেকি পাহাড়ে বসে উপভোগ করেছি ভরা পূর্ণিমা রাতের সৌন্দর্য, হাত তালি দিয়েছি ডিওনিসাসের থিয়েটারে বসে। কিছু বই থাকে না যেগুলো পড়ার পর মনের খোরাক মিটেছে টাইপ অনুভূতি হয়, এটা তেমনি একটা বই। এমন বইয়ের রিভিউ লেখা কষ্টের কাজ, তবুও শুরু করা যাক।

আমি পৃথিবীতে এসেছি শুধুই ভালোবাসার জন্য, কখনোই ঘৃণা করার জন্য নয়। -- সফোক্লিস

চমৎকার একটা ভূমিকার পর বইয়ের প্রথম বাক্যটা পড়েই আমি আসলে বইটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। মনে মনে ভেবেছিলাম বইটির গদ্যশৈলী হয়তো একটু গুরুগম্ভীর প্রকৃতির হবে। কোথায় কী! এ যে একেবারে তরল, হালকা চালের রসিকতা সম্পন্ন লেখা। এভাবেই কি হিউমার সম্পন্ন একটা গল্পের মাধ্যমে তাহলে আমি জানতে যাচ্ছি পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, দর্শন, ইতিহাস, স্থাপত্য, ট্রাজেডি, কমেডি, চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যাপারে? এত সহজ আর সুন্দরভাবে কি পুরোটা বই জুড়ে লেখক লিখে যেতে পারবেন? দুটো প্রশ্নের উত্তরই, হ্যা। বইয়ের প্রতিটি চরিত্রই ঐতিহাসিক এবং বাস্তব। এই বাস্তব চরিত্রদের মাঝে কখনো সক্রেটিস, কখনো বা ইউরিপিডিস কিংবা পেরিক্লিস, ফিডিয়াস, হেরোডোটাস, সফোক্লিস, হিপোক্রাটিসদের বয়ানে লেখক একে একে তুলে এনেছেন গণতন্ত্র শুরুর ইতিহাস, চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাস, পৃথিবীর প্রথম ঐতিহাসিক গ্রন্থের ইতিহাস, অলিম্পিক, ম্যারাথন শুরুর ইতিহাস। পাশাপাশি এথেন্সের তৎকালীন আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশও উঠে এসেছে বইতে। এসেছে গ্রীক দেবতাদের কথা, ট্রয় কিংবা পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের কথা, হোমারের ইলিয়াদ এবং অডেসির কথাও। প্রতিটা অধ্যায় শুরু হয়েছে সে সময়কার বিভিন্ন মনীষীদের চমৎকার সব উক্তি দিয়ে। একেকটা উক্তি মনের অন্দরকে নাড়িয়ে দেয়ার মত।

শুরুর দিকের বড় একটা অংশ হিউমার দিয়ে সাজিয়েছেন লেখক। সক্রেটিস ও তার বন্ধুদের খুনসুটি আর প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা শুরুর এক চতুর্থাংশের মূল উপজিব্য। এসব হাস্যরসের ফাঁকেই আমরা জেনে যাই, পৃথিবীর প্রথম থিয়েটার এবং মঞ্চ নাটক শুরু হওয়ার ইতিহাস সম্পর্কে। চেরোফোনের উৎসাহী কণ্ঠে জানতে পারি পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এথেন্স নগর গড়ে উঠার গল্প। আর ইউরিপিডিস আমাদেরকে জানান ট্রয়ের যুদ্ধের ���টনা। এ সময়ে বইয়ে এমন অনেকগুলো বাক্য আছে যা মার্ক করে রাখার মতো। তবে তার মাঝে: ভালোবাসার সবচেয়ে শুদ্ধতম রূপ হলো, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা--- এই বাক্যটা আমার সবচেয়ে প্রিয়।

পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো নিজেকে জানা আর সবচেয়ে সহজ কাজ হলো অন্যকে উপদেশ দেওয়া। -- থেলিস

ধীরে ধীরে বইয়ের টোন কিছুটা গাম্ভীর্য ধারণ করতে শুরু করে। গল্পে চলে আসে এথেন্সের রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপার। আর সক্রেটিস থেকে ফোকাস সড়ে যায় পেরিক্লিসের দিকে। পেরিক্লিস আর আশপাশিয়ার ভালোবাসার গল্পের মাঝে, বক্তৃতার স্বরে পেরিক্লিস আমাদেরকে জানিয়ে দিয়ে যান ডেমোক্রেসি শুরুর প্রেক্ষাপট। পরিচয় হয় সলোন নামের এক মহামানবের সাথে। ইতিহাসের শাস্ত্রের জনক হেরোডোটাসের সাথেও পরিচয় হয় আমাদের। তার বয়ানে আমরা জানতে পারি পারস্য এবং গ্রীসের মধ্যে হওয়া প্রথম  "ম্যারাথন" যুদ্ধ সম্পর্কে। যে যুদ্ধে ফিডিপিডিসের দৌড়ের সম্মানে আজও ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। গল্পে গল্পে জানা হয় অলিম্পিক প্রতিযোগিতা সম্পর্কে। আমার জানা ছিল না গ্রীক পূরাণের বীর হারকিউলিসের কল্যানে খেলার মাঠের নাম স্টেডিয়াম হয়েছে! স্পার্টার বীর রাজা লিওনিদাসের ৩০০ সেনা নিয়ে পারস্যকে রুখে দেয়া যুদ্ধের গল্পও বলে ফেলেন লেখক। হেরোডোটাস আর সফোক্লিসের আড্ডায় জেনে নেই গ্রিক ট্রাজেডির জনক এস্কিলাসের আদ্যোপান্ত। এছাড়াও এথেন্সকে রূপসী নগরে সাজানোর সব পরিকল্পনা আর তার কারিগরদের ব্যাপারেও গল্পে গল্পে জানিয়ে যান লেখক। বইয়ের মধ্যম ভাগের এই অংশের সবচেয়ে মজাদার অংশ হলো চেরোফোন আর সক্রেটিসের ডেলফির ওরাকলের কাছে যাওয়ার অংশটুকু।

মানুষ মাত্রই ভুল করে। কিন্তু যে মানুষ ভুল বুঝতে পারামাত্র সংশোধন করে, সেই হলো ভালো মানুষ। মানুষের একমাত্র অপরাধ হলো অহংকার। -- সফোক্লিস।

গ্রীসের দেবতা ভিত্তিক চিকিৎসা ব্যবস্থা বাদ দিয়ে নতুন ধরণের এক চিকিৎসা ব্যবস্থার চিন্তা এসেছে এক কস দ্বীপের এক তরুণের মাথায়। তার নাম হিপোক্রাটিস। চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক এই ভদ্রলোক। এমনকি আজও সকল ডাক্তারদেরকে উনার লেখার শপথবানী পাঠ করতে হয় ডাক্তারি পাশ করার পর। পৃথিবী বদলে দেয়া তার ডাক্তারি সম্পর্কে সবটাই লেখক জানিয়ে গিয়েছেন যথারীতি গল্পের মাধ্যমে। পৃথিবীর প্রথম ইতিহাস গ্রন্থের লেখক হেরোডোটাস কীভাবে নিজের সেই বইয়ের মাধ্যমে প্রাচ্য আর পশ্চিমের মাঝে এখনো বহমান সংঘাতের সূচনা করে দিয়ে যান, সেটাও জানা যাবে বইয়ের এই পর্যায়ে। সৃষ্টিসুখের উল্লাস ছেড়ে আমরা চলে আসি স্পার্টা আর এথেন্সের মধ্যকার দীর্ঘ এক যুদ্ধের শুরুর পরিস্থিতিতে। স্পার্টার আক্রমণে কীভাবে শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন আর জ্ঞানের মহিমায় উদ্ভাসিত এথেন্স ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে থাকে সেটাও পাঠক জেনে যাবে এখানে। স্পার্টার পাশাপাশি এথেন্সে আঘাত হানে ভয়াবহ প্লেগ। যে প্লেগে এথেন্স হয়ে যায় লাশের নগরী। মারা যায় তাদের সকল সূর্য সন্তানেরা। যে পেরিক্লিস দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে এথেন্সকে পৃথিবীর সেরা নগরে পরিণত করেছিলেন, সেই পেরিক্লিসের বিরুদ্ধেই চলে যায় এথেন্সের নাগরিকরা। একের পর এক বন্ধু বিয়োগ আর মামলায় বিপর্যস্ত পেরিক্লিস পড়েন সর্বনাশা প্লেগের থাবার নিচে। এই সময়টার কি করুণ এক বর্ণনা যে লেখক লিখেছেন! পেরিক্লিসের শেষ সময়টার সে বর্ণনা পড়ার সময়ে কখন যে চোখ ভিজে উঠেছে তা টেরই পাইনি।

তোমার সাথে যেটি করলে তুমি কষ্ট পাও,
সেটি কোনোদিন অন্যের সাথে কোরো না। -- সক্রেটিস

ধীরে ধীরে চলে এলাম আমরা বইয়ের শেষ ধাপে এবং সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি সক্রেটিসের মৃত্যুর অংশ। বইয়ের মাঝামাঝিতেই আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় এক চরিত্রের সাথে। যার কারনেই এই শেষ অংকের করুণ দৃশ্যের সূচনা হয়। সক্রেটিস কেন হেমলক পান করতে রাজী হলেন, কেন মেনে নিলেন প্রহসনের এই বিচার, কেনোই বা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জেল থেকে পালাতে রাজী হলেন না তার সবটাই উঠে এসেছে এখানে। মরে গিয়েও অমর হয়ে রইলেন সক্রেটিস নিজের কর্মের দ্বারা। আড়াই হাজার বছর পরেও ইতিহাস তাকে মনে রেখেছে। এর বড় একটা কৃতিত্ব দার্শনিক প্লেটোর। প্লেটোর জন্ম থেকে উত্থান সবটাই অল্প কথায় চমৎকারভাবে জানিয়েছেন লেখক। বইয়ের শেষ অংশ পড়ে মন খারাপ হলেও, বইটা আসলে বিরাট একটা তৃপ্তি এনে দিয়েছে আমার পাঠক মনটাকে। নিঃসন্দেহে আমার পড়া শ্রেষ্ঠ বইগুলোর মাঝে অন্যতম সেরা বই এটা।

ব্যক্তিগত রেটিং: ১০/১০ ( লেখকের গদ্যশৈলীর দরুণ এমন ইতিহাস সমৃদ্ধ বইও হয়ে গিয়েছে একটা গল্পের বইয়ের মতো। লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ এমন বই উপহার দেয়ার জন্য। উনার কাছ থেকে এমন আরো অন্যান্য দেশের ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হলো। সকল ধরণের পাঠকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বই এটা। কেউ এই বইটা ফেলে রাখবেন না প্লিজ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পড়ে ফেলুন। শুধু গল্প বা ইতিহাসের জন্য না, নিজের আত্ম-উন্নয়নের জন্য, নিজেকে আরো পরিশুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও বইটা পড়া উচিত। এই বইটাকে মনে ধারণ করতে পারলে হিংসা, ঘৃণা, রাগ আর অহংকারকে দমিয়ে রাখা শিখতে পারা সম্ভব বলে মনে করি )

প্রোডাকশন: বইটির প্রোডাকশন অত্যন্ত চমৎকার। পেইজ কোয়ালিটি হতে বাঁধাই সবই ভালো। বর্তমানে থাকা বইয়ের নতুন এডিশনের প্রচ্ছদের তুলনায়, আমার কাছে থাকা আগের এডিশনের প্রচ্ছদটা আমার খুব খুব পছন্দের। বইয়ের শেষ লাইনটা পড়লে এই প্রচ্ছদটার মাহাত্ম্য আরো বেড়ে যায়। এমন একটা বই হিসেবে বইটির দামও বেশ সহনীয় বলেই মনে করি। প্রকাশনীকেও ধন্যবাদ বইটির জন্য।

🪤 লেখক: সুজন দেবনাথ
🪤 প্রচ্ছদ: নিবেদিতা নাথ এবং জামাল আহমেদ
🪤 প্রকাশনী: অন্বেষা প্রকাশন
🪤 পৃষ্টা সংখ্যা: ৫৪৮
🪤 মূদ্রিত মূল্য: ৮০০ টাকা
Profile Image for K M Abrar.
27 reviews21 followers
May 4, 2025
সক্রেটিসের নাম শুনলেই মাথায় কঠিন দর্শনের কথা চলে আসাটা অস্বাভাবিক না। সক্রেটিসের জীবনী নির্ভর উপন্যাস দেখে ভেবেছিলাম মনে হয় হেমলকের নিমন্ত্রণ কঠিন কোনো উপন্যাসই হয় নাকি। কিন্তু আমার ভুল বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। এতো দারুণ করে লেখক সক্রেটিস কে বইয়ে তুলে ধরেছেন মনে হয়েছে যেনো ওই সময়ে আমি নিজেই সক্রেটিসের সামনে উপস্থিত ছিলাম। মাস্ট রিড একটা বই।
Profile Image for Farhan.
20 reviews3 followers
April 29, 2025
"আমরা জীবনভর সক্রেটিসের কাছ থেকে মধু নিলাম। আর বিনিময়ে তাকে দিলাম হেমলক বিষ।"
Profile Image for Md. Rahat Khan.
50 reviews5 followers
June 8, 2024
অনবদ্য একটা উপন্যাস পড়ে শেষ করলাম। ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস বরাবরই পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। হেমলকের নিমন্ত্রণ বইটা অনেক দিন ধরে পড়ার ইচ্ছা ছিল। অবশেষে শেষ হল।

দর্শনের জনক সক্রেটিসের শহর এথেন্স তথা প্রাচীন গ্রীসের গৌরবময় ইতিহাসকে তুলে আনা হয়েছে বইতে। এথেন্স প্রাচীন গ্রীসের একটি নগরী। যাকে বলা হয় শিক্ষার নগরী, আলোর নগরী। এথেন্স পৃথিবীকে কি দেইনি? পৃথিবীতে প্রথম গনতন্ত্র , জাতীয় সংসদ,ভোটের প্রথা চালু থেকে শুরু করে বিজ্ঞান শাস্ত্রে, চিকিৎসা শাস্ত্রে, থিয়েটার, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্যের দ্বারা  সম্মৃদ্ধ করেছে বিশ্বকে। এখানেই জম্মেছেন দর্শনের জ��ক সক্রেটিস, প্লেটো, নাটকে ট্রাজেডির জনক এস্কিলাস, সফোক্লিস, ইউরোপিডিস, ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস, গনতন্ত্রের জনক ক্লিসথেনিস, কমেডির জনক এরিস্টোফানিস, বিজ্ঞানী থেলিসের জম্ম এই এথেন্সে। ম্যারাথনের যুদ্ধ, অলিম্পিকের যাত্রার শুরু এখানে।

গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পাশাপাশি কলঙ্কজনক অধ্যায়ও রয়েছে এথেন্সের। তখনকার সময়ের মানুষের ধর্মান্ধতা ছিলো আকাশছোঁয়া।  যার বলি হয়েছে অনেকে। বাদ যায়নি সক্রেটিসও। যুবক সম্প্রদায় নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ নাকচ হওয়ার পর আনা হয় ধর্মদ্রোহিতার মত অভিযোগ। সক্রেটিস দেবতা মানেন না। সবাইকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দিচ্ছেন। আদালতে বিচারকদের ভোটে তার মৃত্যুদন্ড হয়। এথেন্সের আইনি নিয়মে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি নিজেই  সিদ্ধান্ত নেন কোন উপায়ে সে মরতে চায়। সক্রেটিস নির্বিকারভাবে  সিদ্ধান্ত নেন তিনি হেমলক গাছের বিষ পানে মারা যাবেন। হেমলকের বিষে নীল হয়ে জীবনের সূর্য অস্ত যায় সক্রেটিসের।

বিশাল পরিসরের এই উপন্যাসে বিস্তর অনুষঙ্গের সমাবেশ ঘটিয়েছেন লেখক। তার গল্প বলার ভঙ্গিটা চমৎকার লেগেছে। প্রেম-ভালোবাসা-দ্রোহের আবেশ ঘটিয়েছেন সুনিপুনভাবে।  কল্পনার মিশেলে বাস্তবতাকে তুলে এনেছেন বিস্মতির অতল গহ্বর থেকে।
Profile Image for Muntasir Dhip.
165 reviews4 followers
September 20, 2024
আপাতত কিছু বলতে পারছি না। শুধু এতটুকুন বলে রাখি " সেরাআআআ"
Profile Image for Sakib A. Jami.
335 reviews36 followers
August 17, 2023
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কোনো এক সময়। যে সময়ে বদলে গিয়েছিল পৃথিবীর ভাগ্য। প্রাচীন এই সময়ে একে একে জন্ম নিয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের একের পর এক সৃষ্টিশীল কর্ম! বদলে দিয়েছিল মানুষের বিনোদনের ক্ষেত্র। সৃষ্টি হয়েছিল জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার। সেই সময় গ্রীক দেশের এথেন্স শহর তেমন কিছু মানুষের পদচারণায় মুখর ছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল এখানে। জন্ম নিয়েছিল নাটক, সাহিত্যের মতো বিনোদনের ক্ষেত্র। ইতিহাসের সাথে পরিচিতি ঘটেছিল মানুষের। যে গণতন্ত্রের গল্প করা হয়, তারও যেন হাতেখড়ি সেই সময়টাতেই। দর্শন বিদ্যার অমূল্য পরিবর্তন ঘটেছিল তখন। নামকরা দার্শনিকদের মিলনমেলা ছিল। যাদের হয়তো বইয়ের পাতাতে জানা যায়, তারা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যেই জীবন্ত কিছু সৃজনশীল মানুষের গল্প “হেমলকের নিমন্ত্রণ”—এ আপনাকে স্বাগত।

সক্রেটিস! নামটির সাথে বোধহয় পরিচয় নেই, এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। আপনি জানেন কী জানেন না, এই মানুষটির কথা স্কুল-কলেজে ঠিকই পড়ে থাকবেন। বিখ্যাত দার্শনিক হিসেবে যাঁকে সবাই আদর্শ মনে করে। সেই সক্রেটিসের জীবন কেমন ছিল, জানেন? সক্রেটিস দেখতে খুব একটা ভালো না। তাই ছোটবেলায় তার বন্ধু ছিল না। আমাদের শিশুদের হয়তো আমরা মনের অজান্তেই শিখিয়ে দিই— কদাকার, কুৎসিত যেকোনো কিছু থেকে দূরে থাকতে হয়। হয়তো সেই শিক্ষা নিয়েই দেখতে শুনতে ভালো না, এমন মানুষের থেকেও আমরা দূরে থাকতে চাই। সক্রেটিসের বদলে যাওয়ার শুরু সেখান থেকেই।

যেখানে কেউ আপন মনে করে না, কোনো বন্ধু নেই— সেখান থেকে সবচেয়ে বেশি শিষ্য যার; তিনি সক্রেটিস। মানুষের অবয়বের দুর্বলতা কমিয়ে দিতে পারে কথা বলার শক্তি। সক্রেটিস সেই শক্তিতে শক্তিমান। কথার খেলায় সবসময় বিজয়ী সক্রেটিসের পাশে জুটে গেল কিছু বন্ধু। যারা সক্রেটিস ছাড়া কিছু বুঝে না। কথার খেলায় কিংবা প্রশ্নের খেলায় জীবন সম্পর্কে যে ধারণা অর্জন করা যায়, পাঠ্যপুস্তক পড়েও হয়তো সেই শিক্ষা লাভ করা যায় না। শিক্ষার যে ব্যতিক্রম এ ধারা, তার সূচনা করেছিলেন সক্রেটিস। তরুণদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় এক নাম। তাঁর কোনো বিদ্যালয় ছিল না। গ্রিসের অলিতে-গলিতে, রাস্তায়-পথেঘাটে— সব জায়গা ছিল শিক্ষার ক্ষেত্র। যেখানে পারতেন সেখানেই আসর জমিয়ে ফেলতেন। তরুণরা ছুটে আসত, গল্পের খেলায়, কথার খেলায় বা প্রশ্নের খেলায় নিজেকে নিমগ্ন রাখত। এ যেন জীবন বদলে দেওয়ার কারিগর।

তরুণরা পছন্দ করলেই গুরুজনেরা পছন্দ করবে কেন? তাদের প্রশ্ন করা যায় না। বয়সে কম কেউ যদি প্রশ্ন করে নাস্তানাবুদ করে, তাহলে সে ভালো থাকবে কেন? চরম বেয়াদব! আর এই বেয়াদবদের তৈরি করছে কে? সক্রেটিস! তাই তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হলেও তাদের বাবাদের কাছে আতঙ্কের নামও সক্রেটিস। তাদের দাবি ছেলেদের নষ্ট করে ফেলছে সক্রেটিস। ‘সক্রেটিস মেথড’ যেন সবার ঘুম হারাম করে ফেলছে। ও হ্যাঁ, সক্রেটিস ও তার সাথীদের প্রশ্ন প্রশ্ন খেলার একটা নাম আছে। যাকে ‘সক্রেটিস মেথড’ বলা হয়। সক্রেটিস ও তাঁর মেথড নিয়ে সবচেয়ে বেশি পাশে ছিল দুই বন্ধু চেরোফোন ও ক্রিতো। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পাশে ছিল ক্রিতো। বন্ধুর হাত কখনো ছাড়েনি সে।

গ্রিসের সেই সময় নারীদের জন্য সুখকর ছিল না। ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষেধ ছিল। বাইরে শুধু পুরুষদের বিচরণ থাকবে। আর নারীরা থাকবে অন্দরমহলে। সিস্টেমের অংশ সবাই হয়ে গেলেও কেউ কেউ সেই সিস্টেম ভেঙে বেরিয়ে আসার তোড়জোড় করে। আশপাশিয়া মেয়েটা তেমনই। সে এথেন্সের কেউ না। বাইরে থেকে আগত বলেই হয়তো নিয়মের এই কারাগার ভাঙতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তার সাথে কীভাবে যেন মিশে গিয়েছিল সক্রেটিস। বরং নিজের চেয়েও বড়ো করে আশপাশিয়াকে দেখে সে। আশপাশিয়ার কাছে শিক্ষার জন্য আসে। যেই সক্রেটিসের চারিপাশে মানুষ ঘোরে, সেই সক্রেটিস ঘোরে আশপাশিয়া নামের এক মেয়ের আশেপাশে। এই আশপাশিয়ার স্বপ্ন অনেক বিশাল। নিজেকে উপরে দেখতে চায়। তাই হয়তো এথেন্স শহরের মাথা পেরিক্লিসকে নিজের বন্ধনে বেঁধে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। একই সাথে সে-ও হয়ে উঠেছে এথেন্স শহরের অলিখিত কর্ত্রী।

আজ যে গণতন্ত্রের জয়গান গাওয়া হয়, তার সূচনা হয়েছিল কোথায়? সুদূর অতীতে খোঁজ নিতে গেলে দেখা যাবে সময়টা সেই আড়াই কী তিন হাজার বছর পূর্বের কোনো এক সময়কে নির্ধারণ করছে। রাজা-রানী-প্রজা ছাড়া কোনো রাজ্য চলতে পারে না। একনায়কতন্ত্র যেন মূল কথা, যেখানে সাধারণ মানুষের কথা শোনার সময় আছে কার? সেই ধারা ভেঙে এথেন্স প্রচার করল গণতন্ত্রের বাণী। যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জনমত নির্বিশেষে সকলের সম্মতিক্রমে। গনতন্ত্র যেন প্রতিষ্ঠা পেল। আর সেই গণতন্ত্রের নেতা হয়ে পেরিক্লিস সবার চেয়ে সম্মানিত। গণতন্ত্রের পূজারী সে। কোনোভাবেই এর অমর্যাদা করবে না। কিন্তু মানুষ বরাবরই আবেগী জাতি। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করার চেয়ে আবেগ দিয়ে চিন্তা করতে বেশি পছন্দ করে। কিংবা অন্য কেউ কিছু বোঝালে সেটাতেও ফলে সহমত জ্ঞাপন করে। ফলে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি থাকে কি না, সেখানে একটা বড়ো ধরনের প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকে যায়। পেরিক্লিস হয়তো শেষ সময়ে বুঝেছেন, গণতন্ত্রের সুফলের পাশাপাশি কুফল নেহাত-ই কম নয়। তাই তো তার অনেক কাছের মানুষকে হারিয়ে যেতে হয়েছে গণতন্ত্রের রোষানলের স্বীকার হয়ে।

‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ হিসেবে খ্যাত “অলিম্পিক গেমস”—এর শুরুটা কোথায়, জানেন? সেখানেও গ্রিসের নামটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চার বছর পরপর এই গেমসের সূচনা গ্রিসেরই এক রাজ্য থেকে। সেখানে প্রতি চার বছর অন্তর একটি খেলার আসর বসত। অতীতে কাউকে বীর হিসেবে বিবেচনা করা হতো যু দ্ধের পারদর্শিতা দেখে। সেখানে এক অন্যরকম কিছুর চিন্তাতেই অলিম্পিকের উৎপত্তি। যু দ্ধ, র ক্ত ছাড়াও যে বীর হওয়া যায়; অলিম্পিক যেন ��েই চিহ্ন রাখতে তৈরি। এই খেলায় সেরা সবসময় স্পার্টা। এথেন্সের নামগন্ধ নেই কোথাও। তবুও কোনো এক আসরে এক ব্যতিক্রম ব্যক্তির আবির্ভাব হলো। তাকে নিয়ে গিয়েছিল পেরিক্লিস। না, কোনো খেলায় নয়। গল্প বলে আসর জমিয়ে দিয়ে সেদিন এথেন্সের নাম উজ্জ্বল করেছিল একজন। তিনি হেরেডোটাস। তার বিখ্যাত রচিত গ্রন্থে পরিচিতি পেয়েছিল এক নতুন ধারা। আজ যে আমরা ইতিহাস সম্পর্কে জানি, সেই ইতিহাসের ধারণার সূচনা ঘটেছিল তখন। ইতিহাসের প্রবর্তক হিসেবে হেরেডোটাস বিশ্বে আজও অমলিন।

অসুখের সাথে মানুষের সখ্যতা বেশ পুরনো। নানান অসুস্থতায় প্রাচীনকাল থেকে দেবতাদের অভিশাপ জ্ঞাপন করত মানুষ। তেমনি সুস্থতাকে বলা হতো দেবতার আশীর্বাদ। প্রাচীন গ্রিসে সবকিছুতে দেবতাদের আনাগোনা ছিল। দেবতাদের নাম নিয়ে কিছু করা হতো না। গ্রিসে দেবতা অ্যাপলোকে চিকিৎসার দেবতা মনে করা হতো। আরও মনে করা হতো দেবতার বংশের কেউ ছাড়া মানুষের চিকিৎসা করা যাবে না। সেই ধারা ভাঙতেই যেন এসেছিলেন হিপোক্রাটিস। সেবার প্লেগের ভয়াল থাবায় যেন মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই। হিপোক্রাটিস তাই দেবতার উত্তরসূরি থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের শিক্ষার উপকরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তৈরি হয় ইতিহাসের প্রথম চিকিৎসা বিদ্যালয়। দেবতাদের আশীর্বাদে নয়, নিয়মমাফিক চললে আর নিজের স্বাস্থের দিকে নজর দিলেই সুস্থতা আসন্ন। নিজে ও তার শিষ্যদের প্রচেষ্টায় প্লেগের ভয়াবহতা একসময় কমে আসে। জনপ্রিয় হয়ে ওঠে হিপোক্রাটিস। ডাক্তারদের জন্য তৈরি করে দিলেন ‘হিপোক্রাটিক শপথ’।

যুদ্ধ একসময় খুবই সাধারণ ছিল। পাশাপাশি রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এথেন্সের সাথে একসময় পারস্যের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে একজন খবরি ছিল। যার কাজ যুদ্ধের খবর পৌঁছে দেওয়া। ম্যারাথন ময়দানে সেদিন যুদ্ধের বিজয়ের কথা এথেন্সবাসীকে পৌঁছে দিতে দৌড় শুরু করেন ফিডিপিদিস। সেই দৌড় যেন জীবনের তার শেষ দৌড়! মৃত্যুর কোলে ঢলে যাওয়ার মুহূর্তে হয়ে যান ইতিহাস। ম্যারাথন দৌড়ের সূচনা সেখানে থেকে। এই গল্পে একজন সফেক্লিস আছেন। তিনি সফল ট্র্যাজেডির জনক। তার রচনায় দর্শক বিভোর থাকত। তারও আগে ট্র্যাজেডির জনক এস্কিলিস-এর গল্প এখানে শোভা পায়। আছে সফেক্লিসের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইউরিপিডিস। লিখেছেন নারীদের জীবনের কথা, ‘ট্রয়ের মেয়েরা’। তাদের নাটকে কত যে গল্পের উপলক্ষ্য পেয়েছে মানুষ! একসময় নিঃশেষ হয় জীবন, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই মিললে যে অমরত্বের সুধা পান করা হয়।

প্লেটোকে বলা হয় সময়ের চেয়ে আগানো ক্ষুরধার মস্তিষ্কের লেখক। যে লিখলেই লিখতে পারে। যখন তখন লিখতে পারে। ছোটো থেকেই মস্তিষ্কে শান দিতে দিতে কীভাবে যেন সক্রেটিসের ভক্ত হয়ে গেল সে। শেষ সময় পর্যন্ত ছিল সক্রেটিসের সাথে। সক্রেটিসকে নিয়ে অনেক লেখা লিখে অমর করে তুলেছেন গুরুকে। সক্রেটিসের শত্রু চারিপাশে। সেই শত্রুতার রেশ ধরেই মঞ্চস্থ হলো নাটক ‘মেঘ’। এক কুৎসিত সক্রেটিসকে যেখানে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। অপমান অপদস্ত করে লেখা সেই নাটক থেকে মানুষ ভুলে গেল সক্রেটিস আসলে কে। সক্রেটিসকে নিয়ে লেখা সেই নাটকের রচয়িতা কমেডির জনক এরিস্টোফেনিস। এমন নাটক দেখে রাগে দুঃখে নিজের সব লেখনী পুড়িয়ে ফেলে প্লেটো। প্লেটো এমন এক আদর্শ নগরীর কল্পনা করে, যেখানে থাকবে না কোনো কবি-সাহিত্যিক। কলমের সবচেয়ে শক্তি অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। সময়কে ধরে রেখে সত্য ঘটনা মানুষের সামনে তুলে ধরা। সেই কলম যদি সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, তবে কি কলমের উপর ভরসা থাকে? একজনের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে কারো লেখনী। মিথ্যার পাহাড় গড়ে তুলতে পারে।

সক্রেটিস বারবার খুঁজেন সুন্দর জীবনের মানে কী? একে তাকে প্রশ্ন করেন, কিন্তু উত্তর মেলে না। জীবনের খোঁজে ছুটে চলেন প্রতিনিয়ত। আর সেই জন্য নিজের সংসার নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই তাঁর। জেনিথিপি প্রতিনিয়ত গালমন্দ করে স্বামীকে। তবুও কোনো বিকার নেই স্বামীর। এমন এক সংসার তবুও টিকে আছে। অদৃশ্য ভালোবাসার বন্ধনে মোড়া— যা দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। সক্রেটিসের জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া। কেউ জনপ্রিয় হলে, তার শত্রুরও অভাব হয় না। সক্রেটিসেরও আছে। এনিতাসের দাবি, তার ছেলেকে নষ্ট করেছে সক্রেটিস। মামলা হলো। সবসময় নীতি নৈতিকতার কথা তোলা সক্রেটিস কই এভাবে পালিয়ে যাবে? আদালতে দাঁড়িয়ে ঠিক একই সক্রেটিস। যে কখনো মাথা নত করবে না। কিন্তু শত্রুপক্ষ মানবে কেন? বৃদ্ধ সক্রেটিসের যে দিন ঘনিয়ে আসছে।

এই গল্পে আছে ট্রয় নগরীর যুদ্ধ। এক নারীর রূপের ঝলকে ধ্বংস হয়ে গেল গোটা এক নগরী। সত্য, মিথ্যার কারসাজি উঠে এসেছে লেখকের লেখায়। আছে পিথাগোরাস ও তার শিষ্যদের কথা। যাদের জ্যামিতিক আবিষ্কার আজ পাঠ্য বইয়ে শোভা পায়। থেলিস নামক একজনের ভাবনার ফসল হিসেবে জন্ম নিয়েছে বিজ্ঞান। গ্রিসের এতসব ইতিহাস লেখক রচনা করেছেন রয়ে সয়ে। কখনো আবেগে ভাসিয়েছেন, কখনো হাসিমুখে মেনে নিতে হয়েছে সবকিছু। আমি বারবার একটা কথা মনে করি, একজন লেখক অনেক বই লিখতে পারেন। তবে তার সৃষ্টিকর্মে এমন কিছু লেখার প্রয়োজন হয়, যা তাকে অমরত্ব দেবে। “হেমলকের নিমন্ত্রণ” লেখক সুজন দেবনাথকে সেই অমরত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট। দারুণ এক উপাখ্যান।

শেষটা দারুণ বললেও কম হবে। ইতিহাস নিয়ে ঘটার সুবাদে শেষ ঘটনা জানি। অনেকেই জানেন। তারপরও লেখক যেভাবে বর্ণনা করেছেন, চোখের সামনে যেন দৃশ্য উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। শেষ অনুভূতি বিষাদময়। একজন মানুষ কতটা জনপ্রিয় হলে, শেষ সময়ে এতজনকে পাশে পেতে পারে! জীবনের সার্থকতা তো এখানেই। মৃত্যু এখানে শেষ নয়। মৃত্যুর পরও প্রিয় মানুষেরা বাঁচিয়ে রাখার যে তীব্র প্রয়াস জানান দেয়, তাতেই মৃত্যু হেরে যায়।

লেখকের লেখনী দারুণ। ছোটো ছোটো বাক্যে পুরো বইটি বর্ণনা করেছেন। কিছুটা হুমায়ূন আহমেদের ছোঁয়া লক্ষণীয়। লেখনশৈলীতে, শব্দচয়নেও। আমি বিষয়টা ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। সহজ, সাবলীল গদ্যে পড়তে আরাম লাগে। “হেমলকের নিমন্ত্রণ” বইটি লিখতে লেখক অনেক পরিশ্রম করেছেন। তার ছাপ পুরো বই জুড়ে লক্ষনীয়। অনেক তথ্য উপাত্তের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে ননফিকশন জাতীয় বই পড়ার অনুভূতি হচ্ছিল। এমনভাবে ইতিহাস রচনা করলে পড়তে মন্দ লাগে না।

বইটির চরিত্রগুলো সব বাস্তব। যারা আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে পৃথিবীতে নিশ্বাস ফেলেছেন। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের ক্ষেত্রে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আজও তাদের স্মরণ করা হয় কোনো না জন্য ক্ষেত্রে। এমন মানুষদের নিয়ে লেখা খুব একটা সহজ নয়। সেই সহজ কাজ করেছেন লেখক। বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছেন। তবে আশপাশিয়াকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, শেষে এসে কোথায় যেন হারিয়ে গেল! হয়তো প্রয়োজন ছিল না বলেই। কিন্তু আরও কিছু জানার আগ্রহ ছিল। শেষ সময়ে এসে কীভাবে জীবনের লড়াইটা একা একা লড়ে গিয়েছে, জানতে চাইছিলাম।

আমি মুগ্ধ হয়েছি প্রকাশনীর প্রডাকশন কোয়ালিটিতে। সাড়ে পাঁচশ পৃষ্ঠার বইয়ের মূল্য আটশ’ টাকা। বিশাল এই বইয়ে আমার সর্বসাকুল্যে হয়তো দুইটা ছাপার ভুল বা বানান ভুল চোখে পড়েছে। পৃষ্ঠার মান, বাঁধাই সব যেন অসাধারণ কিছু। অন্বেষা প্রকাশনী এই দিকে সেরা কাজ দেখিয়েছে। অভিযোগ করার কিছু নেই। প্রচ্ছদ যেন দেশের যে তীব্র বিষাদ, তারই প্রতিচ্ছবি।

পরিশেষে, টাইম ট্রাভেল বলতে কিছু হয় না। তবুও কিছু সময় হয়তো অজান্তেই টাইম ট্রাভেল হয়ে যায়। কিছু বইয়ের পাতাতে হারিয়ে যেতে হয় সময়ের চেয়েও আগের কোনো স���য়ে। আড়াই হাজার বছর পূর্বের এক সময়ে আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম। এক নিমন্ত্রণে ভুলে গিয়েছিলাম সময়ের বেড়াজাল। সক্রেটিস, প্লেটো, ইউরিপিডিস, ক্রিতোদের সাথে আমিও ঘুরেছি এথেন্সের পথেঘাটে। হেমলকের এ নিমন্ত্রণ যে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই...

▪️বই : হেমলকের নিমন্ত্রণ
▪️লেখক : সুজন দেবনাথ
▪️প্রকাশনী : অন্বেষা প্রকাশনী
▪️পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৫৫০
▪️মুদ্রিত মূল্য : ৮০০
▪️ব্যক্তিগত রেটিং : ৫/৫
Profile Image for Maysha Rashid.
10 reviews7 followers
December 10, 2025
এথেন্স আলোর নগরী যতটা আলো নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলো তত গুণ অন্ধকারের সাথেই শেষ হলো সক্রেটিসের হেমলক পান ও হেমলকের নিমন্ত্রণ!!
Profile Image for Asib Gazi.
87 reviews1 follower
September 24, 2024
প্রাচীন গ্রিস এবং তৎকালীন দর্শন,সাহিত্য,বিজ্ঞান নিয়ে সহজ ভাষায় দ্রতগতীর বই। লেখনীতে হুমায়ূন আহমেদের টোন আছে তাই পড়তেও আরাম। জটিল বিষয়গুলো সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন এজন্য লেখককে ধন্যবাদ।
40 reviews3 followers
June 12, 2021
সোনালি যুগের গ্রিক ফিলোসফারদের মুন্সিয়ানা কোন জায়গায়? জ্ঞান তৈরির প্রসেস আবিষ্কারে। আমরা তাদের কথা পড়বার সময় দেখি, তাদের বহু বহু আবিষ্কার পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু সেই আবিষ্কারের প্রসেস আমরা এখনো ব্যবহার করি। অলৌকিক এর বাইরে গিয়ে কোনো ঘটনার কারণ নির্ণয়ের যে ধারা তারা শুরু করেছিলেন, সেইটা হাজার হাজার বছরেও বিলুপ্ত হয় নাই, হবেও না। এইখানেই তাদের সার্থকতা।

এই বইটা গ্রিক দর্শনের বই না। কারিকুলামে আমরা সক্রেটিস প্লেটো এরিস্টটলের বিভিন্ন উক্তি পড়তাম। কারিকুলামের দোষ হলো, এদের মানুষ হিসাবে দেখাতে পারায় সে ব্যর্থ। কিন্তু এই বইটাতে এরা ক্যারেকটার, রক্ত মাংসের মানুষ। সক্রেটিস হাঁটছেন, আলাপ করছেন, প্লেটো শুনছেন, জেনথিপি ক্ষেপে যাচ্ছেন, ওইদিকে সফক্লিস লিখছেন, ইউরিপিডিস লিখছেন, পার্থেনন তৈরি হচ্ছে ফিদিয়াসের নেতৃত্বে, এথেন্স কে সোনালি সময় উপহার দিচ্ছেন পেরিক্লিস, আস্পাশিয়া কী চমৎকার করে তাকে পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার স্পার্টার সাথে যুদ্ধ, এথেন্সে প্লেগ, চিকিৎসা শাস্ত্র জন্ম নিচ্ছে হিপোক্রেটিস এর হাতে, হিস্টরিয়া লিখছেন হিরোডটাস। বইটা পুরো সেই মোটামুটি একশো বছর সময়কালকে গল্পের মতন বলে যায়। বিশেষত পার্থেনন তৈরি হবার অংশটা আমি বারবার পড়বো। স্পয়লার দিলাম না, আরো অনেক কিছুই আছে।

বাংলা ভাষায় কি এরকম বই আরেকটা আমি পড়েছি? না। তাই বইটা পড়তে হবে, উপহার দিতে হবে। চমৎকার বই।
Profile Image for Mirza Imran.
52 reviews13 followers
June 22, 2021
"ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে। বড় প্রেম বিরহের জন্য উপযোগী, সংসারের জন্য নয়। সংসার হলো দুটি মানুষের প্রতিদিনের ঝগড়া-ঝাটি, রাগ-ক্রোধ, অভিমান মিশানো একঘেয়ে অম্ল-মধুর জিনিস। তার জন্য দরকার সাধারণ, একঘেয়ে ছোট্ট প্রেম। বড় প্রেমে এগুলো খাপ খায় না। বড় প্রেম হলো হঠাৎ উচ্ছ্বাস, যা দুজনকে ভাসিয়ে নেয়, আশেপাশের মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। এই প্রেম দিয়ে ভালো সাহিত্য হয়, কিন্তু ভালো সংসার হয় না। এই প্রেম দুটি জীবনকে পুড়িয়ে দেয়, প্রত্যাশার আগুনে জ্বালিয়ে দেয় সংসার। হেলেন আর প্যারিসের প্রেমে পুড়ে যায় ট্রয় নগর। বড় প্রেম কোন কিছুকে ধরে রাখে না, ধরে রাখে ছোট প্রেম। তাই অনেক আশা নিয়ে শুরু হওয়া বড় বড় প্রেমের সংসার সুখী হয় না, সুখী হয় ছোট প্রেমের সংসার।

ছোট প্রেম নিজে ছোট বলে অন্যায় রাগ-ক্রোধকে জায়গা দিতে পারে, আর জায়গা দিতে দিতে ছোট প্রেমের ব্যক্তিত্ব বড় হয়ে ওঠে, সে সেক্রিফাইস করতে শিখে যায়। আর বড় প্রেম নিজে বড় বলে একটি ছোট্ট অভিমানকেও জায়গা দিতে পারে না, ছাড় না দিতে দিতে বড় প্রেমের ব্যক্তিত্ব ছোট হয়ে যায়, সেক্রিফাইস কি জিনিস সেটাই ভুলে যায়। তাই ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে।"
Profile Image for Sharmin Sultana  Shamoly.
89 reviews23 followers
March 26, 2024
চমৎকার!
সক্রেটিসের সাথে আড্ডার পরিভ্রমণ।
Profile Image for প্রিয়াক্ষী ঘোষ.
361 reviews34 followers
August 17, 2024
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। বাংলা থেকে বহুদূরের এক সভ্য জনগোষ্ঠী যারা ছিল সময়ের থেকে কয়েকশ ধাপ এগিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময় এবং সেই সময়ে কিছু সৃষ্টিশীল মানুষের জন্ম হয় গ্রিকে। গ্রিকের এথেন্স ছিল সুন্দর মনোরম এক শহর। এই শহরে জন্ম নেওয়া কিছু প্রতিভাবান মানুষের পাগলামি থেকে জন্ম হয়েছিল গনতন্ত্র, চিকিৎসা, দর্শন, সহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস সহ জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রায় সবকিছু।
সেই সব প্রতিভাবান মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন সক্রেটিস। তিনি নিজে কিছু না লিখলেও শিষ্যদের মাধ্যমে তিনি নিজের প্রতিভা রেখে গেছেন।
সারাজীবন খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে তিনি "সুন্দর জীবন" এর গল্প বলেছেন। যার ফলে প্লেটো শিখেছেন জীবনের অর্থ। জন্ম হলো দর্শন ও নৈতিকতার। প্লেটো ছিলেন মূলত একজন কবি, কিন্তু সক্রেটিসের ছোঁয়ায় হয়ে গেলেন কঠিন দার্শনিক।

সেই সময়টা ছিল মূলত সৃষ্টিশীল সময়।
ইতিহাসের জনক হেরোডটাস লিখতে শুরু করলেন পৃথিবীর প্রথম ইতিহাসের বই।
থেলিস নামের এক লোকের ভাবনা থেকে জন্ম নিলো এক নতুন জিনিস, যার নাম বিজ্ঞান।

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম শুরু হয় সভ্য উপায়ে ( মারামারি কাটাকাটি না করে) বীর হওয়ার লড়াই, নাম তার অলিম্পিক গেমস।
এথেন্সের মানুষই প্রথম আবিষ্কার করলো গনতন্ত্র, পাহাড়ের উপরে বসে শুরু হলো পৃথিবীর প্রথম সংসদ।
পিথাগোরাস বের করলেন জ্যামিতিক সূত্র, গোল্ডেন রেশিও। সেই রেশিও দিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভবন পার্থেনন ডিজাইন করেছেন শিল্পী ফিডিয়াস।
চিকিৎসাবিদ্যার জনক হিপোক্রাটিস ডাক্তারদের জন্য লিখলেন ' হিপোক্রেটিস শপথ'।
ম্যারাথন মাঠ থেকে এক দৌড়ে যুদ্ধের খবর আনতে গিয়ে মারা গেলেন ফিডিপিডিস। সেই থেকে শুরু হলো ম্যারাথন।
এথেন্সের থিয়েটারে প্রথম অভিনয় শিল্পী থেসপিস।
প্রথম ট্রাজেডি নাটকের জনক ইস্কিলাস। অভিনয় করেছেন ' প্রমিথিউস বাউন্ড'।
সফোক্লিস লিখলেন সর্বকালের সেরা ট্রাজেডি 'রাজা ইদিপাস'।
হোমারের কবিতা আবৃত্তি করে পাহাড়ের গুহায় বসে ইউরিপিডিস লিখলেন ' ট্রয়ের মেয়েরা'।
কমেডি নাটকের জনক এরিস্টোফানিস সক্রেটিস কে না জেনে না চিনে অন্যের কথায় ভয়ঙ্কর রকমের মিথ্যা দিয়ে সক্রেটিসকে নিয়ে লিখলেন প্রহসন নাটক 'মেঘ'।
সেই রাগে ক্ষোভে প্লেটো নিজের লেখা সব কবিতা পুড়িয়ে ফেলে হয়ে গেলেন দার্শনিক এবং তার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে নির্বাসন দিলেন কবি -সাহিত্যিকদের।
কিছু মানুষের ব্যক্তিগত আক্রোশ আর গোঁড়ামির জন্য আসামি হতে হলো সক্রেটিসকে।
পৃথিবীর ইতিহাসে জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্ম ও রোমাঞ্চকর দারুণ সব তথ্য নিয়ে এই উপন্যাস সুজন দেবনাথের " হেমলকের নিমন্ত্রণ "।
Profile Image for Md.Asif Iqbal.
8 reviews1 follower
October 12, 2024
জীবনের সামান্য বই পড়ার মাঝে। আমি যেকোন বই ধরার সময় মনে হতো বইটা শেষ হবে আমার বই পড়ার তালিকায় আরেকটা বই জমা হবে। কোনো সময় আমার মনে হয় নি এই বইটি শেষ না হোক, চলতে থাকুক আজীবন। মনে হয় নি ইস যদি বই এর পৃষ্ঠা সংযোজন হতে থাকতো সময়ের সাথে সাথে, বইটি আর কখনো যদি শেষ না হতো।

আমি হেমলকের নিমন্ত্রন এ এমন একটা রস পেয়েছি। আমি দর্শন ভালোবাসি। আমি এই বইতে দর্শন এর ইতিহাস জেনেছি, সাথে সাথে বিজ্ঞান, সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচার, চিকিৎসা, গণতন্ত্র, নাটক, স্থাপনাশিল্প, গণিত, মিথলোজি, প্রেম, কৌতুক সব কিছুর রসই পেয়েছি।

আমি এই বইটা অবশ্য পাঠ্য একটা বই হিসেবে পরামর্শ দিতে চায়। যেখানে পাঠক হারিয়ে যাবে সক্রেটিস এর সাথে এক সুন্দর জ্ঞানের দেশ এনথেনায়, করবে প্রশ্ন প্ৰশ্ন খেলা।
Profile Image for Parvez Alam.
306 reviews12 followers
February 4, 2022
এককথায় অসাধারণ পাঠ অভিজ্ঞতা। এ বই দিয়ে পৌঁছে গিয়েছি আড়াই হাজার বছর আগের অন্য এক পৃথিবীতে। সক্রেটিস, প্লেটো, হেরাডটাস, সফোক্লিস, হিপোক্রেটস -এর সময়ে গণতন্ত্র, থিয়েটার, সাহিত্য, কমেডি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্রে জন্ম নিয়ে ৫৫০ পেজে বিশাল এক উপন্যাস। কয়েকজন মহাপ্রতিভাবান মানুষ অদ্ভুত এক পাগলামি শুরু করেছিলেন। তাদের মধুর এই পাগলামিতে জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্র, থিয়েটার, সাহিত্য, কবেডি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন, চিকিৎসাসহ মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সবকিছু। এই উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রতি পর্বের শুরু তে মনীষীদের উক্তি আর যে কোনো তথ্যে বিস্তারিত ১৪০টি ফুটনোট , এই দুইটি বই টির সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়।
Profile Image for Ashik.
220 reviews40 followers
March 17, 2023
খুব কম বইয়ে ৫ তারকা দিতে পেরেছি। এই বইটিতে ৫ তারকা না দিলে অন্যায় হবে।
Profile Image for Gazi Nishad.
1 review
September 17, 2021
হেমলকের নিমন্ত্রণঃ একুশ শতকের চোখে ক্ল্যাসিক্যাল এথেন্সঃ

প্রেম ও জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা ।। গাজী নিষাদ

চলমান শতাব্দীতে “হেমলকের নিমন্ত্রণ” আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক নতুন সংযোজন যা পশ্চিম ও প্রাচ্যের সম্পর্কের ধারার মাঝে আরও এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে। এটাকে বলা যেতে পারে পশ্চিম ও প্রাচ্যের মধ্যকার সচেতন জীবনবোধ ও ডিওটেমিক মিলনের ফসল। যেই ফসলের পিতা ও বাহক একজন বিশ্বভ্রামক বাঙালী কবি। গবেষক, গল্পকার, উপন্যাসিক, কবি, ও কূটনীতিক সুজন দেবনাথ, তাঁর এথেন্সবাসের অভিজ্ঞতা ও সূক্ষ্ম আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গির এক অন্যতম নিদর্শন উপন্যাস ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’। ২০২০ সালে বইটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের অন্বেষা প্রকাশন।

এথেন্সের সক্রেটিস কমিউনিটি নামে একটি ফোরাম বইটিকে সক্রেটিস বিষয়ক সাহিত্যের ( Socratic literature) এক অনন্য সংযোজন হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সক্রেটিসের জন্মদিন উপলক্ষে ২০২০ সালের জুনে এথেন্সে সক্রেটিস কমিউনিটি দ্বারা একটি অনলাইন প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়েছিল যেখানে মিঃ সুজন দেবনাথকে তাঁর বই ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’ উপস্থাপনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই ফোরাম গ্রীক পাঠকদের জন্য এই বইটিকে‘Η ΓΕΥΣΗ ΤΟΥ ΚΩΝΕΙΟΥ’ শিরোনামে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করার প্রস্তাব করে । ২০২১ সালে এই ফোরাম ‘সক্রেটিস এবং শাস্ত্রীয় এথেন্সের সাহিত্যে’ অবদানের জন্যে মিঃ দেবনাথকে ‘সক্রেটিস কমিউনিটি অ্যাওয়ার্ড’ নামে একটি বিশেষ পুরষ্কার দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

গল্পটি নিয়ে সক্রেটিস কমিউনিটির ড. প্রোমাকস সুবাক্কাস মন্তব্য করেন-

Undoubtedly, this is a unique and wonderful addition to the world literature on Socrates. This crispy and vivid story connects all the great men of the Greek Classical Time in a brilliant way.

লেখক প্রথমে গল্পের প্লটকে কলার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে গল্প বা উপন্যাসের মাধ্যমকে বেছে নেওয়ার পেছনে যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর মতে, মানুষ গল্পজীবী প্রাণী।

“মানুষের জীবন একটা গল্প। মানুষ প্রতি মুহূর্তে গল্প বানায়। প্রয়োজনে বানায়, এমনি এমনিও বানায়। মানুষ গল্প শুনতেও ভালোবাসে। মানুষ গল্পভুক। মানুষের মস্তিষ্ক এমনভাবে তৈরি যে মানুষ কোনো বিষয়ের শুধু গল্পটুকু মনে রাখে। বাকি সবকিছু ভুলে যায়।”

তাই ইতিহাসের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময়কে আঁকার জন্যে তিনি গল্পকে বেছে নিয়েছেন।

[ টীকা- লেখকের যুক্তির সাথে সংযোজিত মতামত– গল্প নিজে এমন একটা ল্যান্ডস্কেপ যা গল্পের মাধ্যমেই নিজের সঠিক জায়গাটুকু খুঁজে পায়, সংগীত, কাব্য বা চিত্রকলায় নয়। আরও ব্যাপকভাবে পার্থক্য করলে-

“গদ্য হলো বাস্তব আর কবিতা নাটক। যেমন, গদ্য হলো একটা unrefined আইডেন্টিটি (যেমন কোনো ব্যক্তির পার্সোনালিটি, যা সবসময় চোখে পড়ে), কবিতা হলো সেই ব্যক্তির হঠাত কোনো পার্টিতে যাওয়া সাজের মতো যা অনেকটা refined. গদ্যের নিজস্ব পরিপাটি অবস্থান আছে, আবার কবিতা নিজেকে কড়া মেকাপে আচ্ছাদিত করলেও তার ভিতরটা কাননবালার হৃদয়ের মতো tragic. কখনো গদ্য কবিতা ও কবিতা গদ্য হয়ে উঠে তখন কিছুটা এই বিষয়গুলি ভেঙে যায়৷

গদ্য চ্যালেঞ্জিং, কবিতাকে চ্যালেঞ্জ করা যায়না।” ]

বইয়ের ভূমিকায় মূল গল্পের সাথে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবার পর্বে লেখক গ্রীস ও এথেন্স বিষয়ে তাঁর বিগত অনুরাগ ও অনুসন্ধানের কথা স্মৃতিচারণ করেন। কীভাবে তিনি স্কুলে পড়ার সময় থেকেই গ্রীস ও এথেন্সের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন এবং প্রাচীন গ্রীক সমাজের বৃহত্তর জ্ঞানতৃষা ও মনীষীদের কথা জেনেছিলেন। এপর্যায়ে পুরো বইটির সাথে লেখক আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন এভাবে-

“সেই সময় যখন ইউরোপের সভ্যতা ছিল আঁতুড়ঘরে। আঁতুড়ঘরের নাম এথেন্স। এথেন্স শহরে মাত্র দুটি প্রজন্মে জন্ম নিয়েছিলো বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণতন্ত্র, সাহিত্যের ট্রাজেডি ও কমেডি, দর্শন, চিকিৎসাশাস্ত্র, স্থাপত্য, নৈতিকতাসহ জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রায় সব শাখা। সেই জন্মের গল্পই ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’।”

আর গল্পের সূত্রপাতের গল্পে লেখক বলেন-

“সময়টি ছিল খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতক। এসময় এথেন্স এবং আশপাশের কটি শহরে জন্ম হয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা। একটি সময়ে একটি শহরে বুদ্ধিবৃত্তির এরকম সমাবেশ পৃথিবীর ইতিহাসে আর হয়নি। সেই সময়ের প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে আমি চাকরি করতে আসলাম এথেন্সে। মাত্র এয়ারপোর্টে নেমেছি। আমার স্ত্রী নিবেদিতা বলল, ‘আচ্ছা, এখানে হেমলক কোথায় খায়?’ প্রশ্ন শুনে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। হেমলকের মতো মারাত্মক বিষ খেতে হবে নাকি! ভয়ে ভয়ে নানান প্রশ্ন করে বুঝলাম, ‘হেমলক কোথায় খায়’ মানে হলো সক্রেটিস কোন জায়গায় হেমলক পান করেছিলেন? তো খুঁজতে শুরু করলাম সক্রেটিসের হেমলক পানের জায়গাটি। সেই খোঁজ থেকেই এই বইয়ের শুরু।”

সুজন দেবনাথ উপন্যাসটি রচনা করেছেন তিনটা প্রাথমিক অনুসন্ধানকে ঘিরে।

“আমার অনুসন্ধান ছিল মোটামুটি তিনভাবে। সেই সময়টিকে পড়ে ফেলা, তারপর নিজের চোখে ঘটনার জায়গাগুলো দেখা, এরপর জটিলতা থাকলে কোনো গ্রিক বিশেষজ্ঞের সা���ে কথা বলা। এই অনুসন্ধান থেকেই ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ’। গল্পের পটভূমি খ্রিস্টের জন্মের আগের পঞ্চম শতক। বছর হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব ৫১০ থেকে ৩৯৯ অব্দ পর্যন্ত। গণতন্ত্রের জন্ম হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫০৮ আর সক্রেটিসের মৃত্যু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতককে পণ্ডিতগণ বলেন গ্রিসের ক্লাসিক্যাল সময়। আমি এ সময়টাকে ধরতে চেয়েছি।”

পরিসর বৃহৎ হলেও গল্পের টাইমলাইন স্পষ্ট। এবার ২০২১ শতকে দাঁড়িয়ে লেখক উপস্থাপন করেছেন খ্রীস্টপূর্ব ৫১০ থেকে ৩৯৯ অব্দকে গল্পে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে তাঁর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা।

“অনুভব করতে চেয়েছি সক্রেটিস কিভাবে এথেন্সের আগোরার পথে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কঠিন দর্শনের কথা সহজ করে বলতেন। কারা কোন আদালতে ঠিক কিভাবে বিচারের নামে হত্যা করলো সক্রেটিসকে। হেরোডটাস কোথায় বসে কোন অবস্থায় লেখা শুরু করলেন পৃথিবীর প্রথম ‘ইতিহাস’। গণতন্ত্রের মতো একটি অভিনব ব্যবস্থা কোন মানুষগুলো কিভাবে আবিষ্কার করলো। চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রাটিস ঠিক কোন সময় ডাক্তারদের জন্য লিখলেন তার চমৎকার ‘হিপোক্রাটিক শপথ’। পৃথিবীর সমস্ত সাহিত্যের কাঠামো গ্রিক ট্রাজেডি আর কমেডি। এই গল্পে আমি দেখতে চেয়েছি সেই থিয়েটার, যেখানে গ্রিক ট্রাজেডি জন্ম নিয়েছিল। কথা বলতে চেয়েছি পৃথিবীর প্রথম অভিনয়শিল্পীদের সাথে। ঢুকতে চেয়েছি হোমারের অন্ধ কুঠুরিতে, সফোক্লিসের নাটক লেখার মনে, ইউরিপিডিসের ট্রাজিডির গুহায়। আমি তাদের লেখাকে তাদের মতো করে ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছি।”

লেখকের এই বক্তব্যকে এখানে যেরকম ভাবসিদ্ধ ও কল্পনামিশ্রিত অভিজ্ঞতার অনুভব মনে হয়, পরক্ষণেই তার পরের কথাগুলি প্রমাণ করে, তার চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার তুলি কতোটা সূক্ষ্ম ও বাস্তব। একইসাথে তথ্যবহুল। কারণ বইটির শিরোনাম “হেমলকের নিমন্ত্রণ” হলেও তাঁর গল্পের সীমা হেমলক ও সক্রেটিসের জীবন পেরিয়ে আরও দূরে বিস্তৃত, যেখানে এসেছে তৎকালীন এথেন্সের মানুষের জীবনাচার- বিশ্বাস- সংস্কৃতি, পরিবেশ, ও সমাজব্যবস্থা । একইসাথে এই সময়কালের আলোচিত প্রতিপাদ্য, এর বহুপ্রকাশিত জ্ঞানকলা যা বহু ব্যক্তি মনীষীর বিপুল ও সার্থক আগমনে যুগপৎভাবে পুষ্ট। তবে নিঃসন্দেহে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সক্রেটিস ও সক্রেটিসের জীবন, বলা যায়, তাকে ঘিরেই এই গল্প আবর্তিত হয়েছে। আর গল্পের ভূগোল ক্ল্যাসিক্যাল এথেন্স। traditional এথেন্স যেই সময়কালে এক নতুন যুগস্রষ্টির সম্ভাবনায় উজ্জীবিত ও আলোকিত। যেই যুগসন্ধি এথেন্সকে সভ্যতার এক পরিণত ও অগ্রসর জাতিতে পরিণত করেছিলো। সুজন দেবনাথ সেই বিকশিত মহাসমারোহকে তার উপন্যাসে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন।

লেখকের ভাষায়- “খ্রিস্ট পূর্ব ৪৭২ অব্দে ইউরোপের প্রথম ট্রাজেডি লিখেন এস্কিলাস। ট্রাজেডির নাম ‘Persia’ বা পারস্য’। মানুষ যতো সুখেই থাকুক না কেন, মানুষের অন্তরে চিরকালের একটা দুঃখ-কোঠা আছে, মানুষ নিজের অজান্তেই নিজের হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগায়। তাই বেদনার সাহিত্যই মানুষের মনে গভীরভাবে থেকে যায়। সেজন্য আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কালজয়ী সাহিত্যের প্রায় সবই আসলে ট্রাজেডি। সেই ট্রাজেডি কিভাবে লেখা শুরু করলেন এস্কিলাস, কি ছিলো তার প্রেক্ষাপট, সেগুলোই গল্পের মধ্যে নিয়ে এসেছি। এরিস্টটলের মতে, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ট্রাজেডি সফোক্লিসের ‘রাজা ইদিপাস’। রাজা ইদিপাসের কাহিনী পড়েছে আর ধাক্কা লাগেনি, এমন মানুষ পৃথিবীতে নেই। আমি মানতেই পারতাম না নিজের মাকে বিয়ে করে ফেলার মতো নির্মম আর ভয়াবহ কাহিনী সফোক্লিসের মতো একজন বিশাল লেখক কেন লিখলেন! সেই প্রশ্নটি আমার একেবারে ছোট্টকালের। এই প্রশ্নের উত্তর আমাকে কেউ দিতে পারেনি। এই গল্পে আমি সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। আমি দেখতে চেয়েছি, ঠিক কখন সফোক্লিস উচ্চারণ করলেন, ‘আমি পৃথিবীতে এসেছি শুধুই ভালোবাসার জন্য, কখনই ঘৃণা করার জন্য নয়।’ প্লেটো ছিলেন একজন কবি। সক্রেটিসের ছোঁয়ায় সেই কবি প্লেটো কবিতা ছুড়ে ফেলে হয়ে গেলেন কঠিন নির্দয় দার্শনিক। তার কল্পনার আদর্শ রাষ্ট্র থেকে কবি সাহিত্যিকদের দিলেন নির্বাসন। প্লেটোর কবি থেকে দার্শনিকে বিবর্তন পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছে। প্লেটো দর্শন না লিখলে পৃথিবীই হতো অন্যরকম। প্লেটোর এই পরিবর্তনকে আমি খুঁজতে চেয়েছি। ইউরোপে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের বদলে যাওয়া দেখতে চেয়েছি। কিভাবে মিশরের অনুভূতিহীন ভাস্কর্য বদলে গিয়ে মানুষের মতো হলো, ঠিক কখন পাথরগুলো হাত পা বাঁকা করে আড়চোখে তাকাতে শুরু করলো, সেটি খুঁজতে চেয়েছি।”

লেখকের মতে, তাঁর উপন্যাসের কোনো চরিত্রই কল্পনাশ্রয়ী নয়৷ ইতিহাসের প্রতিটি বাস্তব চরিত্র থেকে এই গল্পের নির্যাস সংগ্রহ করেছেন। সেই সময়ের একঝাঁক সৃষ্টিশীল মানুষের জীবন ও সৃষ্টিকে তিনি একটা কাহিনীতে আনার চেষ্টা করেছেন, আর সেই কাহিনির মুখ্য চরিত্র সক্রেটিস ও তার জীবন। যার সাথে সমান্তরালভাবে এই গল্প তার পরিণতি খুঁজেছে।

“দার্শনিক প্লেটো; ইতিহাসের জনক হেরোডটাস; ট্রাজেডি নাটকের তিন পিতাসফোক্লিস, ইউরিপিডিস ও এস্কিলাস; কমেডি নাটকের জনক এরিস্টোফানিস; চিকিৎশাস্ত্রের জনক হিপোক্রাটিস; এথেন্সের গণতন্ত্র ও জ্ঞানচর্চার প্রধান পৃষ্ঠপোষক পেরিক্লিস; নারী দার্শনিক আসপাশিয়া; স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের প্রধান শিল্পী ফিডিয়াস; সক্রেটিসের স্ত্রী জেনথিপি এবং তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু দার্শনিক ক্রিতো, চেরোফোন এবং সিমন। এছাড়া গল্পের ছায়ায় আছেন দার্শনিক পিথাগোরাস, বিজ্ঞানের জনক থেলিস এবং নগর পরিকল্পনা শাস্ত্রের জনক হিপোডেমাস।”

সক্রেটিসের জীবন বিষয়ে লেখক তথ্যের ধোঁয়াশার কথা উল্লেখ করেছেন, কারণ সক্রেটিস নিজে কিছু লিখে যাননি বরং তাকে নিয়ে লিখেছেন প্লেটো, সক্রেটিসের ছাত্র জেনোফোন এবং নাট্যকার এরিস্টোফেনিস। আর এরমধ্যে নির্ভরযোগ্য প্লেটোর রচনাবলি। তিনি তার গল্পের বাস্তবতার বিষয়ে বলেন-

” পণ্ডিতেরা মনে করেন, প্লেটো তার কিছু বইয়ে সক্রেটিসের প্রকৃত জীবন কথা লিখেছেন আর বেশির ভাগ বইয়ে প্লেটোর নিজের ধারণা সক্রেটিসের মুখে সংলাপ হিসেবে বসিয়ে দিয়েছেন। তাই প্লেটোর লেখার কোনটি সক্রেটিসের কথা আর কোনটি প্লেটোর নিজের কথা, সেটি প্লেটো ছাড়া আর কেউ বলতে পারেন না। সেজন্য প্রকৃত সক্রেটিসকে কোনভাবেই নিশ্চিত করে জানা সম্ভব নয়। সক্রেটিস সব সময়ই একটি ধোঁয়াশা। সক্রেটিসকে নিয়ে এই ধোঁয়াশাকে পণ্ডিতগণ বলেন সক্রেটিস সমস্যা। এই সমস্যাকে মেনে নিয়েই আমি মানুষ সক্রেটিসকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। প্লেটোর রচনা ছাড়া হেরোডটাসের ইতিহাস, হোমারের ইলিয়াদ ও অডিসি, এরিস্টটলের রচনা এবং তখনকার নাট্যকারদের লেখা নাটকগুলোই সেই সময়কে বোঝার একমাত্র উপায়। এরপরে আড়াই হাজার বছর ধরে সেই সময়কে নিয়ে যারাই লিখেছেন, লেখকের নিজের কল্পনা মিশে গেছে তাদের লেখায়। সেখান থেকে শুদ্ধ কাহিনী বের করা অসম্ভব। তাই আমার কাহিনী একশভাগ শুদ্ধ বলে দাবি করবো না। তবে আমি জেনে বুঝে কোনো ভুল তথ্য দেইনি। আমি কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনকে বদলে দেইনি। একটিও কাল্পনিক চরিত্র নেইনি।”

এখান থেকে এটা বুঝা যায় যে এই উপন্যাস শুধু নিছক একটি গল্প নয়, এটি ইতিহাসের এক অসামান্য দলিলও বটে। যার কথনরীতিটা গল্পের ফর্মে ও লেখকের কল্পনাশ্রয়ী হলেও যেই গল্প থেকে উঠে আসা ঘটনাগুলি তথ্যসূত্রে প্রমাণিত। যেমনভাবে কোনো ‘শব্দ’ সৃষ্টি হয়। আমরা প্রায়ই জানিনা আমাদের ব্যবহৃত শব্দগুলির আবিষ্কারক কারা, কিন্তু এটা আমরাই, যারা শব্দ তৈরি করে। ফলে শব্দ বা বক্তব্যকে য��ি আমরা এই উপন্যাসে ব্যক্তিকে ছাপিয়ে দেখি তাহলেও সেই শব্দের/পদের আড়ালে এক হেমলকপায়ী ব্যক্তি সক্রেটিসেরই জীবন উঠে আসে, সেখানে আমরা পৌঁছুতে পারি আর না পারি। সুজন দেবনাথ আড়াই হাজার বছর আগের সেই ব্যক্তি সক্রেটিসকে খুঁজেছেন, যিনি শুধু একজন শিক্ষক ( বা তৎকালীন এথেন্সবাসীদের একাংশের কথায় তরুণদের বিপথে চালনাকারী), বা দার্শনিক নন, একজন সংবেদনশীল প্রেমিক, বন্ধু, বা সর্বোপরি একজন সাধারণ মানুষ, কোনো মনীষী নয়। লেখক সেই সময়কার এথেন্সের হৃদয় ও সেই হৃদয়ের রক্তপাতকে ছুঁতে চেয়েছেন। যার রক্তিম উৎস হলো ‘সক্রেটিস’।

এরপর লেখক বেদনাভরে বলেন, “আমাকে যেটি কষ্ট দিয়েছে, সেটি হলো এথেন্সের এমন সৃষ্টিশীল সময়ে কোথাও মেয়েরা নেই। মেয়েদের প্রতি এমন অবিচার আর কোন যুগের মানুষ করেননি। আমার ধারণা মেয়েদের অংশ নিতে দেয়া হয়নি বলেই, এথেন্সের অবিশ্বাস্য সুন্দর যাত্রাটি মাত্র দুটি প্রজন্মেই শেষ হয়ে গেছে। এই বই লিখতে গিয়ে নারী চরিত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু নারী ছাড়া কি সাহিত্য হয়? অবশেষে অনেক খুঁজে দুজন নারীকে নিয়েছি। একজন সে সময়ের সবচেয়ে বিদুষী নারী দার্শনিক আসপাশিয়া, আরেকজন সক্রেটিসের স্ত্রী জেনথিপি। আসপাশিয়া এই বইয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সেই নারীবিবর্জিত জ্ঞানীদের ভিড়ে শুধু নিজের বুদ্ধি দিয়ে সময়টিকে বাজিয়েছিলেন আসপাশিয়া। আর সক্রেটিসের স্ত্রী জেনথিপির বিষয়ে আমার মনে হয় প্লেটো থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সব লেখক তার ওপর অন্যায় করেছেন। প্লেটো সারা জীবনে এক লাখের বেশি শব্দ লিখেছেন, সবগুলোই সক্রেটিসকে নিয়ে, কিন্তু জেনথিপির কথা বলেছেন মাত্র দুইটি জায়গায়। সব লেখক জেনথিপি শুধুই একজন মুখরা নারী বলেছেন। কিন্তু আমার গল্পে তিনি শুধু মুখরা নারী নন; অভিমান ও প্রেমমাখা রক্ত-মাংসের একজন নারী যে ¯স্বামীকে তীব্রভাবে ভালোবাসে কিন্তু ¯স্বামীর অবহেলা সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিতে সারাদিন বকাঝকা করে।”

এখান থেকে তৎকালীন এথেন্সের নারীদের অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়, যেকারণে জ্ঞানকলায় এতো সমৃদ্ধি আসার পরেও এথেন্সের এই যুগটিকে এই দিক থেকে একপ্রকার অন্ধকারাচ্ছন্নই বলা চলে। কারণ নারীর বিকাশ ছাড়া একমাত্র পুরুষের বিকাশ দিয়ে কোনো যুগকাল পরিপূর্ণ হয়না। আর সেই যুগকালের অন্তর্মিলিত সুর মহানাদে বেজে উঠেনা।

সুজন দেবনাথ গল্পে তার ব্যবহৃত শব্দের প্রবাহধারা নিয়ে মত দিয়েছেন, “ভাষার ব্যাপারে আমি এই বইয়ে অত্যন্ত সচেতনভাবে একুশ শতকের তরুণদের মুখের ভাষাটিকে প্রমিত ভাবে আনতে চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি সব যুগেই একটা প্রমিত মানদণ্ড রেখে সে যুগের মুখের ভাষাটিই সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে। এছাড়া আমার মনে হয়েছে সক্রেটিস সবসময় wit আর রসিকতা মিশিয়ে তরুণদের সাথে কথা বলতেন। সেজন্য এই বইয়ে আমি ইচ্ছে করেই এই সময়ের তরুণদের মুখের প্রাঞ্জল ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করেছি।”

“হেমলকের নিমন্ত্রণ” বইটি লেখক এমনভাবে সাজিয়েছেন যে একজন পাঠক, এটিকে অনেকগুলি ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্রীয় গল্পের প্লট হিসেবে দেখতে পারেন। কেউ দেখতে পারেন ক্ল্যাসিক্যাল এথেন্সে জ্ঞানকলার বহুবিধ শাখার উৎপত্তির গল্প হিসেবে, প্রথম গণতন্ত্রের উত্থানের গল্প হিসেবে, তৎকালীন এথেন্স শহরের গল্প হিসেবে, একটা সমাজব্যবস্থার কাঠামোর পরিবর্তনের গল্প, সক্রেটিস-প্লেটো, পেরিক্লিস, আসপাশিয়া, ডিওটিমার মতো দার্শনিক, শিক্ষক, রাজনীতিকের, বা কয়েকজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প হিসেবে। বা নিছক শুধুই একটা গল্প হিসেবে। তবে যেভাবেই দেখা হোক না কেন, এর প্রতিটি ভিন্ন আঙ্গিকই একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তবে গল্পটির উল্লেখযোগ্য প্লট যে প্রেম তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যেটা গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠক অনুভব করতে পারবেন।

“”ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে। বড় প্রেম বিরহের জন্য উপযোগী, সংসারের জন্য নয়। সংসার হলো দুটি মানুষের প্রতিদিনের ঝগড়া-ঝাটি, রাগ-ক্রোধ, অভিমান মিশানো একঘেয়ে অম্ল-মধুর জিনিস। তার জন্য দরকার সাধারণ, একঘেয়ে ছোট্ট প্রেম। বড় প্রেমে এগুলো খাপ খায় না। বড় প্রেম হলো হঠাৎ উচ্ছ্বাস, যা দুজনকে ভাসিয়ে নেয়, আশেপাশের মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। এই প্রেম দিয়ে ভালো সাহিত্য হয়, কিন্তু ভালো সংসার হয় না। এই প্রেম দুটি জীবনকে পুড়িয়ে দেয়, প্রত্যাশার আগুনে জ্বালিয়ে দেয় সংসার। হেলেন আর প্যারিসের প্রেমে পুড়ে যায় ট্রয় নগর। বড় প্রেম কোন কিছুকে ধরে রাখে না, ধরে রাখে ছোট প্রেম। তাই অনেক আশা নিয়ে শুরু হওয়া বড় বড় প্রেমের সংসার সুখী হয় না, সুখী হয় ছোট প্রেমের সংসার।

ছোট প্রেম নিজে ছোট বলে অন্যায় রাগ-ক্রোধকে জায়গা দিতে পারে, আর জায়গা দিতে দিতে ছোট প্রেমের ব্যক্তিত্ব বড় হয়ে ওঠে, সে সেক্রিফাইস করতে শিখে যায়। আর বড় প্রেম নিজে বড় বলে একটি ছোট্ট অভিমানকেও জায়গা দিতে পারে না, ছাড় না দিতে দিতে বড় প্রেমের ব্যক্তিত্ব ছোট হয়ে যায়, সেক্রিফাইস কি জিনিস সেটাই ভুলে যায়। তাই ছোট প্রেম সংসার গড়ে আর বড় প্রেম সংসার ভাঙে।”

এভাবে গল্পের অগ্রগতির সাথে আমরা দার্শনিক সুজন দেবনাথেরও দেখা পাই, যেখানে গল্পের এক নিভৃত পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার অনুসন্ধিৎসু চিন্তা ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ রেখে গেছেন।

গল্পের স্থানগুলি এতো জীবন্তভাবে বর্ণিত হয়েছে যে চোখে গ্লাভস পরে সীটবেল্ট বেঁধে নিয়ে অনায়াসে একটা টাইম ট্রাভেল করা যায়। আড়াইহাজার বছর আগের এথেন্স নগরী। এথেন্সের আগোরা, সিমনের জুতার দোকান, আসপাশিয়া ও পেরিক্লিসের বাড়ি, শহরের একটা পাড়া এলোপেকি, আপনমনে রাস্তায় হেঁটে চলা সক্রেটিস। তার সাথে প্রিয় বন্ধু ক্রিতো। দূরে দেবী এথিনার মন্দির। আর এই পথ ধরেই একদিন হিমশীতল কারাকক্ষ, যেখানে সক্রেটিসের জন্যে অপেক্ষমাণ এক পেয়ালা হেমলক। আর সেইসাথে একটা যুগের সমাপ্তি এবং এক নতুন যুগের সূচনা।

লেখকের অপরিসীম মনোযোগ, পরিশ্রম আর কাব্যিক স্পর্শ একটা বিপুল সময়ের ফ্রেমকে জীবন্ত করে তুলেছে পাঠকের সামনে। একইসাথে লেখক খোঁজ করেছে সক্রেটিস বিষয়ে বিজ্ঞ বর্তমান সময়ের দুর্লভ কয়েকজন ব্যক্তিকে( যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এভমিখানোস মোসকোনাস , বর্তমান এথেন্সে যিনি সক্রেটিসের সময়ের ডায়ালেক্টে কথা বলতে পারা একমাত্র জীবিত মানুষ), তারসাথে খুঁজেছে সেই যুগকালের সাথে এই যুগকালের রেখাকে, সমসাময়িক বিশ্বনীতি ও নান্দনিকতাকে, সর্বোপরি যাকিছু জীবন ও সংসার থেকে উঠে আসে-তাকে।

গাজী নিষাদ (গাজী ফজলে রাব্বি)
শান্তিনিকেতন
gazinishad7@gmail.com
Profile Image for Shekh Elora.
5 reviews4 followers
January 5, 2025
ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত যত গুলো বৈজ্ঞানিক নাম পড়েছি তার প্রায় সবগুলোর সাথে গ্রিসের নাম জড়িত। আমি ভীষণ অবাক হতাম এই ভেবে যে একটা জায়গার নাম-ই কেন! বিষ্ময়ের সীমা ছিলোনা এগুলো পড়তে যেয়ে।
অনার্স-মাস্টার্স পড়ার সময় আমি মোটামুটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উপর বিরক্ত হতে শুরু করেছি যে নন-মেজর বিষয়গুলোরও জনক প্রায় সব ওই এজিয়ান সাগরের আশেপাশের বাসিন্দা।
এরপরে তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সাথে সখ্যতা হয়। পাঠচক্র এবং কেন্দ্রের গ্যালারিতে সায়ীদ স্যারের পছন্দের বই পড়তে পড়তে একসময় আবিষ্কার করলাম গ্রিসের মিথলজি, শক্তি, মনস্তত্ব এবং দর্শন।
২০১৬ সালের পর থেকে আমাকে যতবার যে কেউ প্রশ্ন করেছে "পৃথিবীর যে কোন ��কটি দেশের ভিসা দেওয়া হলে তুমি কোনটি চাইবে?" আমি এক শব্দে বলেছি 'গ্রিস'। একেবারে প্রত্যেকেই অবাক হয়েছে এই উত্তরে।
আমি কেমন করে বোঝাবো যে আমি এজিয়ান সাগরের নীল জলের কিনারে বসে সফোক্লিসের মত বেদনা অনুভব করতে চাই, কস দ্বীপে হিপোক্রাটিসের অশ্বথ গাছটি পরখ করতে চাই, ঠিক কোন প্রেক্ষাপটে হিপোক্রাটিক শপথ লেখা হয়েছিলো, প্লেটোনিক প্রেম কেন আসলো, কেন প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে কবি, নাট্যকার, শিল্পীদের নির্বাসন দিয়ে দার্শনিক রাজাকে শাসক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, কেন ম্যারাথনে দৌড়ের প্রতিযোগিতা হয়, পেরিক্লিসের গনতন্ত্রের সুন্দর নগরীর ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আমি ৭০ বছরের কোন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করতে চাই হেমলক গাছ কোথায় দেখা যাবে, পৃথিবীর জ্ঞানের সূতিকাগারে থেকেও কেন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষকে চিনতে পারেনি গ্রিস, এমন দেবদেবী ভক্ত ডেমোস'রা ডেলফির ওরাকলের স্বীকৃতি সত্বেও কেন সক্রেটিসকে মানতে চায়নি, জেলখানার ঠিক কোন কক্ষে সক্রেটিস আর জেনথপি শেষ রাতটি কাটিয়েছিলেন, পার্থেননের মন্দিরে এথিনার মূর্তির গোল্ডেন রেশিয়ো কী, প্রোটাগোরাসের ১.৬২ মানের জ্যামিতিক নকশাটি কেমন ছিলো, পীথাগোরাসের ৬০ ডিগ্রি মাপে আর কত মূর্তি বানানো হয়েছিলো, কেন পৃথিবীর প্রথম নারী দার্শনিক আশপাশিয়া শুধু ব্যক্তিত্বের অভাবে ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেলেন, এথেন্স থেকে সভ্যতা যাযাবরের মত সেই যে ভ্রমনে বের হলো আর ফিরলো না কেন!
আসলে গ্রিস নিয়ে আমার যত প্রশ্ন তা নিয়েও একটি বই লেখা যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমার তুমুল আগ্রহ গ্রিক জাতি নিয়ে। আমার অনেক জিজ্ঞাসার এমন গোছানো উত্তর এত সহজে পাবো তা সত্যি আমি ভাবিনি। পৃথিবী সৃষ্টির এই সুন্দর সাজোয়া জগতে বইটি আমার কাছে অমৃতের সন্ধানের মতই মনে হয়েছে।
লেখকের শেষ লাইনের মত বলছি-
"মরণ সাগরের উপর দিয়ে অনাগত কালের পথ-সন্ধানী মানুষের জন্য নিমন্ত্রন নিয়ে আসছে একটি পাখি-পাখিটির ঠোঁটে এক পেয়ালা হেমলক।"
Profile Image for Shreyashi Bhattacharjee Dutta.
81 reviews9 followers
October 13, 2025
গ্রীসের এথেন্সে একদিন সন্ধ্যায় এক পিতা খুব শাসন করছেন তাঁর ছেলেকে। বাড়ির পাশে লোক জমেছে সেই মজা দেখতে। ছেলেটি আর কেউ নন মহান দার্শনিক সক্রেটিস। তাঁর পিতা তাঁকে কবিতার লাইন বলে বলে মারছেন। কারণ তিনি মানুষকে উদ্ভট প্রশ্ন করছেন এবং সব কাজের ব্যাখ্যা খুঁজে সবাইকে নাজেহাল করে দিচ্ছেন। এই নিয়ে রোজ লোকে নালিশ করছে সক্রেটিসের বাড়িতে।


এথেন্স এমন একটি দেশ যেখানে গণতন্ত্র চলে। তখন এমন একটি সমাজ যখন হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসি সকলের মুখস্থ, সেখানে সবেতে দেবদেবীর প্রাধান্য দেওয়া হয়, এমনকি চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্ম হয়নি। মানুষের অসুখ করলে দেবদেবীর কাছে পুজো দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করা হয়, সেখানে যোদ্ধা ও বীরেরা তরুণদের আদর্শ। 

তেমন একটি সমাজে হিপক্রাটিস কয়েকজন ছাত্রকে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন চিকিৎসা শাস্ত্রের গ্রন্থ, অন্যদিকে সক্রেটিস প্রথম শোনালেন যে বীরের জীবন নয়, আমাদের দরকার সৎ পথে, শান্তিপূর্ণ হয়ে জীবন কাটানো, যাকে তিনি বলেন ' সুন্দর জীবন '। শুধু দর্শন বা চিকিৎসা শাস্ত্র নয়, সেই সময়ে এথেন্স নিয়েছিল নাটক, রাজনীতি, শিল্প, জ্যামিতি ইত্যাদি বিষয়ে এক অগ্রণী ভূমিকা। গণতন্ত্রের বেছে নেওয়া এথেন্সের নেতা পেরিক্লিস ঢেলে সাজিয়ে তুলছেন শহর, তাঁকে সেই কাজে সাহায্য করছেন শিল্পী ফিডিয়াস। 


মোটের ওপর, 550 পাতার এই বিশাল উপন্যাস পাঠককে নিয়ে যাবে প্রাচীন গ্রীসের সমাজে, মুগ্ধ করবে মানুষের যুক্তিবাদী মানসিকতা, নতুন উদ্ভাবনের ঐকান্তিক চেষ্টা, অপরদিকে কিছু গোঁড়া ও কট্টরপন্থী মানুষের কুকীর্তি হৃদয় ভেঙে দিতে বাধ্য। সক্রেটিসের সম্বন্ধে জানতে আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালীন শেষবার পড়েছি। তারপর আর কোনোদিন তাঁর সম্পর্কে কৌতূহল জাগেনি। কিন্তু এই বইটি পড়ার পর সেই যুগ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়ে গেছে। মাঝখানে গুগল সার্চ করে করে অনেককিছু জেনে নিয়েছি। 

খুব ভালো লেগেছে। একদম দারুন।
Profile Image for Anup Kumar Saha.
13 reviews
January 7, 2025
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রিসের একদল সৃষ্টিপাগল মানুষ মেতে উঠেছিলেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে সেই মানুষগুলো তৈরি করেছিলেন সভ্যতার বেদিমূল। তাঁদের সেই পাগলামোতেই সৃষ্টি হয়েছিল সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, থিয়েটার, চিকিৎসা, অর্থনীতি, দর্শনসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখা। আর এ-সকল পাগলামোর কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল নগররাষ্ট্র এথেন্স। হেমলকের নিমন্ত্রণ এথেন্সের সেইসব জ্ঞানপাগল মানুষগুলোকে নিয়েই। গল্পের সব চরিত্র ঐতিহাসিক, তাই বলাই যায়, গল্পের আড়ালে এ-এক ইতিহাসগ্রন্থ। সক্রেটিস, প্লেটো, হেরাডটাস, পেরিক্লিস, সফোক্লিসসহ নানা ঐতিহাসিক চরিত্র রয়েছে এখানে। তবে মূল চরিত্র সক্রেটিস— তাঁকে ঘিরেই কাহিনীর ডালপালা। সক্রেটিসের পাগলামো, সুন্দর জীবনের স্বপ্ন, প্রথা ভেঙে তরুণদের প্রশ্ন করতে শেখানো, আর এসবের ফলে জ্ঞানের দিগন্তে নতুন যাত্রা— এসবই গল্পের মূল উপজীব্য।

বইটি সুখপাঠ্য, কাহিনী বর্ণনা মসৃণ, আগ্রহ-জাগানিয়া; তবে, অতি সমসাময়িক শব্দের ব্যবহার প্রচুর, কিছু জায়গায় তা বিষয়বস্তুর গম্ভীরতাকে হালকা করেছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, প্রয়োজনীয় ফুটনোট— যেগুলো কাহিনীর মিনিং ও ব্যাকগ্রাউন্ডকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। বইয়ের পেছনে লম্বা রেফারেন্স দেখে বোঝা যায়, কত পরিশ্রমের ফল এই বই। বলাই যায়, লেখকের পরিশ্রম সার্থক।
Profile Image for Mahbuba Dominique.
4 reviews27 followers
May 22, 2025
বইটি বেশ তথ্যবহুল এবং ঘটনাগুলোও ইন্টারেস্টিং। কিন্তু যেমন উৎসাহ নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম, তেমনভাবে শেষ করতে পারলাম না। লেখক বইটিকে humorous বানাতে গিয়ে একই কথা ঘুরে ফিরে বারবার লিখছেন। এটা না করলে ৫৩০ পৃষ্ঠার মূল কাহিনীর বই অনায়াসে ৪০০ পৃষ্ঠারও কমে শেষ করতে পারতেন।
Profile Image for Rehnuma.
445 reviews21 followers
Read
October 1, 2024
❛শুধু বেঁচে থাকা কোনো কাজের কথা নয়,
সুন্দরভাবে বেঁচে থাকাই মানুষের উদ্দেশ্য।❜
- সক্রেটিস

সত্য সুন্দর ও নির্মম। সত্য সবাই একইভাবে গ্রহণ করতে পারে না। অতি প্রাচীনকালে তো এই সত্যের প্রতিষ্ঠায় প্রাণ গেছে কত জ্ঞানীর। তবুও জ্ঞান আরাধ্য। এই আরাধ্য জ্ঞানের আতুরঘর বলা যায় গ্রিসকে। ঠিক করে বললে এথেন্সকে।
আজ থেকে দুই-আড়াই বছর আগের কথা। অনেক ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে এথেন্সে তখন চলছে জ্ঞানবিপ্লব। বিজ্ঞান, চিকিৎসা, শিল্প, সংস্কৃতি থেকে শুরু করে এহেন জিনিস নেই যা সেখানে চর্চা হয়না। এথেন্সে তখন গণতন্ত্রের জোয়ার। একনায়ক পেরিয়ে এথেন্স প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করলো, ❛আমরা সবাই রাজা❜। অর্থাৎ এখানে ধনী-গরীব সবাই সমান। সবার মতের মূল্য আছে। সলোনের আইনকে নিয়েই তৈরি হলো এথেন্সের ��ণতন্ত্র। তখন সেই গ���তন্ত্রের নেতা পেরিক্লিস। তার খ্যাতি বিস্তৃত।
এথেন্সে আছে সক্রেটিস। হ্যাঁ, এজোয়ান সাগরের তীর ঘেঁষে ইমিতোস নামক একটি পাহাড়ের কোলে এলোপেকি পাড়ায় বাস করে সে। সক্রেটিসের কথা জানেনা এমন মানুষ নেই। আমাদের ইতিহাস, অতীত, দর্শনের সাথে এই নামটি গভীরভাবে জড়িত। এই সক্রেটিস নিয়ে এথেন্সবাসী আছে সমস্যায়। তার সমস্যা সে খালি প্রশ্ন-প্রশ্ন খেলে। বুড়োদের কাছে সে মহা ধড়িবাজ, ছেলেপুলেদের মাথা নষ্টের কারিগর। কিন্তু অল্প বয়স্ক ছেলেদের কাছে সক্রেটিস গুরু। তার সাথে যেই কথা বলতে যায় সে হয়ে যায়, ❛সক্রেটিফাইড❜। তারও প্রশ্ন রোগে ধরে (সক্রেটিস মেথড)। এই রোগের বিশাল রোগী তার বন্ধু ক্রিতো এবং চেরোফোন।
সক্রেটিস জ্ঞানের ধাত্রী। সবকিছুর মূলে যেতে চায় সে।
যেমন, এই যে এথেন্সে গণতন্ত্রের জোয়ার হচ্ছে, আমাদের সক্রেটিস এর পক্ষে না। তার মতে এথেন্সে গণতন্ত্র দিয়ে ভালোর পাশাপাশি অনিষ্টও করা সোজা। কয়জন আনাড়ি মানুষের ভোটে একটা বড়ো সিদ্ধান্ত নেয়াকে সে ঠিক মনে করে না।
এইযে এথেন্সে সংস্কৃতির মেলা হয়। এথেন্সের মানুষ নাটক বলতে অজ্ঞান। শিশুরা ছোটো থেকেই হোমারের ❛ইলিয়াদ❜, ❛ওডিসি❜ একেবারে মুখস্ত করে ফেলে। এগুলো তাদের কাছে ধর্মগ্রন্থের মতো। প্রতি অনুষ্ঠানে তাদের আগোরায় (থিয়েটার) অভিনীত হয় এই নাটকের বিভিন্ন অংশ। প্রতিযোগিতা হয়। সবসময় প্রথম পুরস্কার জেতে নাট্যকার সফোক্লিস। এথেন্সেই জন্ম প্রথম অঙ্গভঙ্গি করে নাটকের। তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছিলেন গ্রিক ট্র্যাজেডির জনক এস্কিলাস। তারই ছাত্র সফোক্লিস। ট্র্যাজেডিকে দিয়েছেন আরো অনন্য মাত্রা।

❛আমি পৃথিবীতে এসেছি শুধুই ভালোবাসার জন্য,
কখনই ঘৃণা করার জন্য নয়।❜
- সফোক্লিস

সক্রেটিস এসব নাটক দেখতে যায়না। নাটক, কবি, সাহিত্য তার বানোয়াট লাগে। শুধুমাত্র ইউরিপিডিস যদি তাকে নিয়ে যায় তবেই সে যায় নাটক দেখতে। ইউরিপিডিস তাকে নাটক দেখায়, সাথে ধারাভাষ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। এছাড়াও মঞ্চে ইউরিপিডিসের নাটক অভিনীত হলেই কেবল সে যায় দেখতে।
এথেন্সে এত শিল্পের কদর, জ্ঞানের কদর কিন্তু কদর নেই কেবল নারীদের। নারীরা ঘরের বাইরে বের হতে পারে না। শুধুমাত্র নাটক মঞ্চস্থ বলেই কেবল দেখতে যেতে পারে তাও চাদরে ঢেকে। এথেন্সে এই জ্ঞানের জয়ে নারীরা দাসেদের পর্যায়ে। সেই সময়েই ভিন্ন ভাবে চলতো আসপাশিয়া। সে পাশের মিলেটাস নগরের। তাই বাইরে চলাফেরা করে। থাকে এথেন্সের বাজে নগরী কেরামেকাসে। কিন্তু সক্রেটিস তাকে পছন্দ করে। এমন এলাকার মেয়েকে সক্রেটিস পছন্দ করছে এর পিছে নিশ্চয়ই জ্ঞানের ব্যাপার আছে। আসপাশিয়া সে যুগের নারীদের মধ্যে অনেক এগিয়ে। অনেক জ্ঞানী। যেসব বিষয় নিয়ে পুরুষরাও কখনো চিন্তা করে না সেসব বিষিয়ে তার জ্ঞান প্রখর। সক্রেটিস তাকে গুরু মানে। আসপাশিয়াকে বিউটি উইথ ব্রেইন বলা যায়। দেবী এথিনা বা হেলেনের মতো রূপবতী সে।
আসপাশিয়া সে যুগের নিয়মভাঙ্গা নারীদের মধ্যে একজন। যার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিল গণতন্ত্রের নেতা পেরিক্লিস। কিন্তু তাকে ঘরে তোলার উপায় নেই! নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা রা আইন করেছিল সে। বিদেশি কাউকে বিয়ে করা যাবে না। এথেন্সে লোক বহুবিবাহও করতে পারে না। তবে এখন উপায়?
সক্রেটিসের মতে পেরিক্লিস ঝানু রাজনীতিবিদ। আসপাশিয়াকে ঘরে তোলার জন্য সে যে কাজ করেছিল সেটা ইতিহাসে নজির হয়ে থাকবে। নিজের স্ত্রীকে দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে উপপত্নী হিসেবে ঘরে তোলেন সুন্দরী আসপাশিয়াকে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আসপাশিয়া হয়ে উঠেছিল পেরিক্লিসের সহচরী, সহধর্মিনী। রাজনীতির বুদ্ধি, দেশ চালানোর বুদ্ধি থেকে শুরু করে তার বক্তৃতা গুলো লিখে দিত সে। কিন্তু এথেন্সের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে হারিয়ে গেলো বা নামহীন হয়ে থাকলো তার অবদান।
খ্যাতির বিড়ম্বনা আছে। খ্যাতির সাথে যেমন থাকে শুভাকাঙ্ক্ষী তেমনই থাকে শ ত্রুপক্ষ। পেরিক্লিসও তার বাইরে নয়। এমনেই এথেন্সের লোক আসপাশিয়াকে ঘরে তোলা এবং তাকে জনসম্মুখে নিয়ে আসা নিয়ে কানাঘুষা করে। সেই সুযোগই কাজে লাগায় তারা।
এথেন্সে কেন সারাবিশ্বেই ধর্ম এক জমজমাট ব্যবসায়ের নাম। ধর্মের দোহাই, ধর্মের নামে কত অনাচার হয়েছে তার তালিকা করে শেষ করা যাবে না। এথেন্সে ধর্ম স্পর্শকাতর ব্যাপার। এই ধর্ম না মানার নানা মা মলায় পেরিক্লিসের কাছের লোকজনকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাকে দুর্বল করে দিতে মা মলা করে তার ঘনিষ্ঠ লোকদের বিরুদ্ধে, কেউ পালিয়ে যায়, করো মৃ ত্যু দন্ড হয়। শেষ ছোবল হিসেবে মা মলা করে আসপাশিয়ার বিরুদ্ধেও।অনেক কষ্টে আসপাশিয়াকে রক্ষা করতে পারে সে।
অলিম্পিক গেমসকে বলা হয়, ❛দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ❜। এই খেলার সৃষ্টি হয়েছে গ্রিসে। এর পিছে আছে কাহিনি। র ক্তা র ক্তি ছাড়া বীর হওয়ার উপায় এই খেলা। প্রতিবছর স্পার্টা হারিয়ে দেয় এথেন্সকে। তবে পেরিক্লিস এবার অনেক আশাবাদী। খেলায় হারলেও এমন এক মোক্ষম অ স্ত্র এনেছে যাতে স্পার্টা জিতলেও মুখে মুখে এথেন্সের নাম হবে। সেই অ স্ত্রের নাম হেরোডোটাস (ইতিহাসের জনক, স্থান: মিলেটাস)। ঘুরেছে প্রায় সারা পৃথিবী (তখনকার মানুষ ইউরোপ, এশিয়া আর আফ্রিকা নিয়েই পৃথিবী জানতেন)। সে গল্প বলেছিল ম্যারাথন দৌড়ের সেই ইতিহাসের। যেখানে ফিডিপিডিসের ম্যারাথন প্রান্তরে সেই ম রণ দৌড়ের ঘটনা বলে যার থেকেই এসেছে ম্যারাথন দৌড়, এথেন্সের গণতন্ত্রের কথা বলে। মানুষ তন্ময় হয়ে শুনে সে গল্প। পেরিক্লিস তাকে এনেছেন অলিম্পিকের মঞ্চে। সেখানেও কাহিনি বলে বাজিমাত করে সে। এরপর একসময় রচনা করে পৃথিবীর প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ। নয় খন্ডের এই গ্রন্থের নাম দেন, ❛The Histories❜।
এদিকে সক্রেটিস তার জ্ঞান বিতরণ করে যাচ্ছে। আগের কালেও উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেকে লাইনে আনতে মোক্ষম উপায় ছিল তার বিয়ে দেয়া। ঘর-সংসারে মন দিলে মাথা ঠিক থাকবে। তাই ক্রিতো, চেরোফোন, সক্রেটিসের মায়েরা ফন্দি করল ছেলেদের বিয়ে দেয়ার। কিন্তু বাকিরা তো বড়লোক। মেয়ে পাওয়া সমস্যা না। তাই চটপট তাদের বিয়েও হয়ে গেলো। মেয়ে মিলল না সক্রেটিসের। কীভাবে মিলবে? তাকে মেয়ে দিবে কোন শ্বশুর? এথেন্সের সব বুড়োর চোখে সে বি ষ। তবুও ভাগ্যের জেরে পেয়ে গেলো জেনথিপিকে। সক্রেটিসও বিয়ের সূত্রে বাঁধা পড়ল। কিন্তু তাই বলে তার প্রথম প্রেমিকা জ্ঞানকে সে ভুলে যায়নি। শুধু বিয়ে ছাড়া তার জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখনো সে ওই খালি পা, যেটুক প্রয়োজন গা ঢাকার সেটুক ঢেকেই জ্ঞান বিতরণ করে। পাদুকাশিল্পী সিমনের দোকানে,জিমনেশিয়ামে সারাদিন চলে জ্ঞানের খেলা। সক্রেটিস বলে ❛নিজেকে জানো❜। ডেলফির মন্দিরের খচিত এই লেখা সে নিজের মনে গেঁথে নিয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গ আর প্রবীণদের মুখ ঝামটায় চলছে জীবন।
এরইমধ্যে স্পার্টার সাথে যু দ্ধ শুরু হলো এথেন্সের। তাকে যু দ্ধেও যেতে হলো। প্রাণ হারালো অনেক যুবক। ম রার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো এথেন্সে প্লেগের প্রকোপ দেখা দিলো। সবখানে শুধু রোগী আর লা শ।
আগের যুগে চিকিৎসা বিদ্যা ছিল পুরোটাই দেবতা নির্ভর। আর রোগ ছিল দেবতার অভিশাপ। তেমন চিকিৎসা ছিল না। খালি তুকতাক আর বলি দেয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময়ে হিপক্রাটিস নিয়ে এলেন চিকিৎসা ব্যবস্থার অনন্য উপায়। গ্রিসের দেবতা প্রেমী লোকেদের অনুভূতিতে আঘাত না করেই বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন তিনি। তার চেষ্টায় এথেন্সও প্লেগমুক্ত হলো। কিন্তু প্রাণ দিলেন এথেন্সের গণতন্ত্রের প্রাণ পুরুষ পেরিক্লিস।
সক্রেটিস এখন আর তরুণ নেই। সেও মধ্যবয়সে এসেছে। এখন তাকে লোকে চাচা ডাকে। কিন্তু তাই বলে তার জ্ঞানের বাত্তি নি���েনি। সেটা জ্বলছেই। প্রবীণ বয়সে সে পেলো তার সবথেকে কাছের শিষ্য প্লেটোকে। এই নামের সাথে পরিচিতি নেই এমন মানুষ আছে কি? সময়ের থেকে অনেক আগানো প্লেটোও একসময় হয়ে গেলো সক্রেটিফাইড। তার মাধ্যমেই আমরা জানতে পারলাম সক্রেটিস নামক এই পৃথিবীর সেরা জ্ঞানী মানুষের দর্শন।
এথেন্সে ঘটেছে আরেক বিপ্লব। আগে ট্র্যাজেডি দিয়ে থিয়েটারে সবাই নাকের পানি চোখের পানি একত্রে করে ফেলত। এখন এক লোক নাটক বানাচ্ছে যাতে মানুষ হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। নেতাদের নিয়ে কমেডি তৈরি করছে। প্রথমবার নাটকে প্রহসনের আবির্ভাব ঘটানো এই নাট্যকারের নাম এরিস্টোফানিস (প্রহসনের জনক)। সে এনিতাসের কথায় সক্রেটিসকে না জেনেই বানিয়ে ফেলল নাটক ❛The Clouds (মেঘ)❜।যেখানে সক্রেটিসকে বাজেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। থিয়েটারে নাটক দেখে সবাই দুয়োধ্বনি দিতে লাগলো,

সক্রেটিস ভুয়া, উচিত শিক্ষা পেয়েছে
সক্রেটিস ভুয়া, জান নিয়ে পালাইছে।

এটা দেখে তো থিয়েটারে চেরোফোন, ক্রিতো হাউমাউ করে কান্না। বন্ধুর মিথ্যা অপবাদে এমন করে কাঁদে এমন বন্ধু পাওয়া ঠিক কতটা ভাগ্যের?
এই চেরোফোনই একবার তাকে জ্ঞানী প্রমাণ করতে ডেলফির মন্দিরের পুরোহিতের কাছে গিয়ে কত হাঙ্গামা করলো। আজ বন্ধুর অপমানে তারা বিলাপ করে কাদঁছে। এরও অনেক বছর পর আবারও একই এনিতাসের চক্রান্তে এই নাটক মঞ্চস্থ হলে হাউমাউ করে কান্না জুড়েছিল সক্রেটিসের সেরা শিষ্য প্লেটো। সেই যে অভিমান করে তার সব লেখা জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
প্রায় পঁচিশ বছরের যু দ্ধের পর এথেন্স অবশেষে হেরে যায় স্পার্টার কাছে। মাঝে অনেক চড়াই উতরাই শেষে শেষ হয় এথেন্সের গণতন্ত্র। একনায়কের যাত্রা শুরু হয়। সেটাও বেশিদিন টিকে না। আবার আসিন হয় গণতন্ত্র। এরমধ্যেই সক্রেটিস তিন সন্তানের জনক হয়ে বয়স সত্তরে পৌঁছেছে।
সুন্দর জীবনের খোঁজে সে এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। তার প্রশ্ন শেষ হয়নি। এরইমধ্যে চলেছে জেনথিপি আর সক্রেটিসের দুষ্টু-মিষ্টি সংসার। জেনথিপি আর সক্রেটিসের ভালোবাসা অনন্য। সেখানে এক অন্যের জন্য একদম যাই যাই মনোভাব নেই। যা আছে সেটা হয়তো আত্মিক। প্রকাশ হয়না। তাইতো কোনোদিন পায়ে চটি না লাগানো সক্রেটিস বউয়ের কথায় গায়ে ভালো জামা, পায়ে পাদুকা পরে সিম্পোজিয়ামে অংশ নিয়েছিল। জেনথিপি সারাদিন স্বামীকে এই উদাসীনতার জন্য শাপ শাপান্ত করলেও ভালোবাসা ছিল।
এখনো বন্ধুত্ব আছে নাট্যকার ইউরিপিডিসের সাথে সক্রেটিসের। ইউরিপিডিসের জীবন ট্র্যাজেডি। সে এত ভালো নাটক লিখলেও কোনোদিন প্রথম হতে পারেনি। কেন?
হয়তো সে সময়ের থেকে অনেক আগানো একজন লেখক ছিল। যে মেয়েদের মনের কথা লিখতো। তার রচিত ❛ট্রয়ের নারীরা❜ দেখে সবাই চোখের পানি ফেললেও প্রথম হতে পারেনি। হয়তো বিচারকরা বুঝতোই না তার নাটকের বার্তা। যেমনি এথেন্সবাসী বুঝত না সক্রেটিসের দর্শনকে।
এরপর এলো সেই কাল সময়। এনিতাস, যে তরুণ বয়স থেকেই ঘৃণা করতো সক্রেটিসকে সে লোক নিয়ে মা মলা করে বসলো সক্রেটিসের নামে। আবারো এখানে পুঁজি ধর্ম। সক্রেটিস ধর্ম অবমাননা করে। এথেন্সবাসী ছিঃ ছিঃ করে উঠলো।
সক্রেটিস অনুসারীরা কেঁদে বুক ভাসালো। বেঁচে থাকা বন্ধু ক্রিতো অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু সক্রেটিস নিজেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করলো না। আসামীর বয়ানে সে ওই জ্ঞান বিতরণ করে গেলো। ফলাফল - মৃ ত্যুদন্ড।
ঠিক হলো তাকে পান করতে হবে হে ম ল ক। সে বি ষপানের আগে সময় পেলো ২৯ দিন। সেখানেই হয়ে গেলো সক্রেটিসের জ্ঞানের স্কুল। এরপর নির্দিষ্ট দিনে সবাইকে কাঁদিয়ে সক্রেটিস হাতে তুলে নিলেন এক পেয়ালা হে ম ল ক। নিভে গেলো সর্বকালের সেরা জ্ঞানী সক্রেটিসের জীবন প্রদীপ। যে পেয়ালা ভর্তি করে লোককে সুন্দর জীবনের দর্শন শেখাতো শেষ বয়সে এসে উপহার পেলো পেয়ালা ভর্তি হে ম ল ক।
বলা যায়,

ম রণ সাগরের উপর দিয়ে অনাগত কালের পথ-সন্ধানী মানুষের জন্য নিমন্ত্রণ নিয়ে আসছে একটি পাখি ---- পাখিটির ঠোঁটে এক পেয়ালা হে ম ল ক।


পাঠ প্রতিক্রিয়া:

কী পড়লাম এটা! সময় ভ্রমণ বুঝি এমনই হয়! বলছিলাম সুজন দেবনাথের লেখা এথেন্সের ❛সক্রেটিস কমিউনিটি❜ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ গল্পের পুরস্কার প্রাপ্ত উপন্যাস ❝হে ম ল কে র নিমন্ত্রণ❞ এর কথা।
একটা কাহিনি এমনভাবেও বলা যায়! গল্পের আকারে লেখা এই আড়াই হাজার বছর আগের ইতিহাস যেন পেয়ালা ভর্তি আব-এ-হায়াত।
বেশ সময় নিয়ে বইটা পড়েছি। শুরুর ২৫০ পৃষ্ঠা পড়তে সময় নিয়েছি প্রায় ৮দিনের বেশি। কিন্তু গতকাল কী জানি হলো বইটা থেকে নিজেকে আলাদা করতেই পারছিলাম না। রাতের মধ্যেই ৫৫০ পৃষ্ঠার মধুর ধারা পান করে ফেলেছি। মনে হলো সক্রেটিসের সাথে শেষের দিকে যেন আমিও এক পেয়ালা হে ম ল ক পান করলাম।
কী নেই এই বইতে? সক্রেটিসের সময়ের এথেন্সের জয়জয়কার, বিজ্ঞান, সাহিত্য, খেলা, সংস্কৃতি, চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি, থিয়েটার সবকিছু এনেছেন। একে ওয়ান হে ল অফ অ্যা রাইড বলা যেতেই পারে। লেখকের সাথে আমিও অতীতের চাকায় ঘুরে চলে গেছিলাম সে সময়ে। কাহিনির কথাগুলো যেন স্বচক্ষে দেখছিলাম আমি নিজেই।
এথেন্সের একনায়ক থেকে মুক্তি, ড্রেকোর র ক্ত আইন সলোনের আইন, ক্লিসথেনিসের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অভিনয়ের যাত্রায় থেসপিস, থেলিসের বিজ্ঞান আবিষ্কার, এস্কিলাসের ট্র্যাজেডি থেকে সফোক্লিসের ট্র্যাজেডি, এরিস্টোফানিসের প্রহসন, হেরোডোটাসের ইতিহাস রচনা, ম্যারাথন দৌড়, অলিম্পিক গেমস, মিস্টার এথেন্স সহ সে সময়ের উন্নতির প্রতিটা দিক তুলে ধরেছেন লেখক। যার সমাপ্তি হয়েছে খুব হৃদয়বিদারক ভাবে।
পেরিক্লিসের এথেন্সকে সুন্দর করার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য ফিডিয়াসের শিল্পে তৈরি মূর্তি, ভাস্কর্য সবকিছু ছিল অনবদ্য। পিথাগোরাসের জ্যামিতিক মাপকে পুঁজি করে এথেন্সে যে শৈল্পিক ছোঁয়া সেটা দারুণ।
পুরো বই লেখক এত সুন্দর করে সাজিয়েছেন যেখানে এইতো খুব দারুণ লাগছে আবার পরক্ষণেই বিস্বাদের ছোঁয়া লাগছে। বইতে ট্র্যাজেডির কথা যেমনভাবে আলাপ হয়েছে সেখানে এথেন্সবাসী আর গ্রিসের বিখ্যাত মানুষগুলোর জীবনের ট্রাজেডিগুলো জেনে খুব খারাপ লাগছিল।
এথেন্সবাসী আসলে সে কালে কেমন ছিল? খুব জ্ঞানী? নাকি নেহায়েতই বোকা? নাকি তারা যা শুনে তাতেই ধেই ধেই করে নাচে?
যদি এমনটাই না হবে তো কেন এনাক্সোগোরাস, ডেমন, ফিডিয়াসের মতোন লোকেদের সাথে এমন হবে?
জ্ঞানের কথা বললেই কেন তাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে হেনস্থা করা হবে?
গণতন্ত্রকে এথেন্স সে সময় যেভাবে ব্যবহার করছিল সেটাই বা কতটা যৌক্তিক ছিল? সক্রেটিস তো ঠিকই বলেছিল। বদ্যির দরকার যেখানে সেখানে যদি কামারের কাছে সমাধান চাই মিলবে?
বইয়ের মূল চরিত্র সক্রেটিস। তাকে ঘিরেই পুরো কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। সাথে এনেছেন অনেক মিথ, মিথের পিছের কারণ। এরপর এসেছে পেরিক্লিসের জীবন এবং প্রেম। আসপশিয়ার দর্শন, জ্ঞান এসেছে। বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায় জ্ঞানের মুক্তা ঝরেছে শুধু। অনেক কিছুই অজানা ছিল, যা পড়তে গিয়ে জেনেছি।
অনেক বাস্তব চরিত্রের জীবনের ঘটনা অন্যরকমভাবে জানার সুযোগ হয়েছে।
তবে বইতে আমার কাছে সক্রেটিসের জ্ঞানের আলোর থেকেও বেশি আলোকিত আর মহিমান্বিত লেগেছে তার বন্ধুত্ব। দিনশেষে সক্রেটিস এক পেয়ালা হে ম ল কের শিকার হলেও সে জীবনে পেয়েছিল অমূল্য কিছু শিষ্য আর বন্ধু। ক্রিতো, চেরোফোন, সিমন, প্লেটো এদের কথা ভুলে যাওয়া যাবে না। বন্ধুর বিপদে স্বার্থ ভুলে এভাবে এগোনো যায় সেটা ক্রিতো, চেরোফোনকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আজকালের বন্ধুত্ব যেখানে অনেকক্ষেত্রেই টাকায় পরিমাপ হয় সেখানে সক্রেটিসের বন্ধুত্ব ছিল ��্ঞানের। জ্ঞানের স্বার্থেই কি এত গভীর বন্ধুত্ব ছিল এদের?
উপন্যাসে আগত প্রতিটি চরিত্রের উত্থান পতন ছিল। সেই উত্থান পতিন বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, ❛কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়❜। দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মানুষকেও জনতার সম্মুখে হাতজোড় করতে হয়েছে। গণতন্ত্রের জনককেও করুন পরিনতি বরণ করতে হয়েছে। দেশকে সুন্দর করে তোলার শিল্পীকেও অবমাননার শিকার হতে হয়েছে।

তাইতো প্লেটো বলেছিলেন,
❛দয়াশীল হও- তোমার চারপাশে যাদের দেখছো,
সবাই একটি কঠিন যু দ্ধের মধ্যে আছে।❜

প্রতিটি অধ্যায়ের সূচনা লেখক এক একটি বাণী দিয়ে শুরু করেছেন। একটা স্মুথ যাত্রা বলতে যা বোঝায় সেটাই ছিল। এই এথেন্সবাসী একজনকে মাথায় তুলছে তো এই আবার মাটিতে ফেলছে। আজকের বন্ধু মাঝেমাঝে শত্রু হয়ে যাচ্ছে। আবার একগুঁয়ে থেকে সক্রেটিফাইড হয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ শুরু থেকেই কূটচাল করছে তো করছেই। একেবারে হে ম ল ক পান করিয়ে নিস্তার হয়েছে।
উপন্যাস এত বিস্তৃত যে যাই বলি তাই কম মনে হয়। এই বইয়ের স্বাদ নিজে আস্বাদন করতে পারলেই এর আসল মর্ম বুঝা সম্ভব বলে মনে করি।
তবে আমার খেদ রয়ে গেছিলো। এথেন্স এত সমৃদ্ধ নগর তবুও সেখানে নারীরা বিবর্জিত। সেখানে ডিওটিমার মতো দার্শনিক যে কিনা প্রেমকে আত্মিক ব্যাপার হিসেবে আখ্যা দেন, প্রেমের দারুণ সংজ্ঞা দেন সে শুধু একজন পুরোহিত হিসেবেই স্বীকৃতি পেয়েছিল। আসপাশিয়ার মতো জ্ঞানী ব্যক্তি পর্দার আড়ালেই রয়ে গেলো। তার শেষটা অসমাপ্ত রয়ে গেলো। যুগে যুগে নারীদের উপরেই যত নিয়মের শেকল। কিন্তু দ্বিচক্রযানের দুটো চাকা সমান না চললে সেখানে উন্নতি কতটা হয়?
উপন্যাসের শেষ অংশ ট্রাজেডিরও ট্র্যাজেডি। আজীবন অনাড়ম্বর জীবন কাটানো মানুষটা, যে প্রয়োজনে অতিরিক্ত পরিধান, পরিহার থেকে দূরে থাকতো, যে শুধু বলতো, ❛আমি শুধু একটি জিনিসই জানি, সেটি হলো- আমি কিছুই জানি না❜ তার মতো মানুষের এমন করুণ পরিণতি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যে পালায়নি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। যে দোষে দোষী হয়ে গরল পানের বিধান হলো শেষকালে সেই দোষকেই চোখে আঙুল দিয়ে ভুল প্রমাণ করে গেলো। শেষের দিকের জেনথিপি আর সক্রেটিসের কাটানো সময়ের কথাগুলো পড়তে গিয়ে বারবার চমকে যাচ্ছিলাম।
সক্রেটিসের প্রয়াণের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছে উপন্যাস। ভূমিকায় লেখক আশা দিয়েছেন সক্রেটিস পরবর্তী প্লেটো, এরিস্টটল, আলেকজান্ডার দি গ্রেট নিয়েও লিখবেন। অপেক্ষায় রইলাম।
গল্পের ছলে ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরতে, ইতিহাসের প্রথম কিছুর কথা জানতে, মিথের পিছের কারণ জানতে হলে এই বইটি সহায়ক হিসেবে পড়া যায়।


❛তুমি যাকে খুঁজছো, সেটি তুমি নিজেই।
তুমি নিজের তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু❜
- সফোক্লিস

আসলেই যদি তাই হয় তবে কেন আমরা অন্যের পিছে ছুটি?
92 reviews
October 2, 2024
হেমলকের নিমন্ত্রণ

(স্ট্যাতাস ক্যুয়ো'র বিলুপ্তি)

❝এথেন্স কাউকে অনুকরণ করে না,
এথেন্সই সবার জন্য উদাহরণ।❞

আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের কথা। বিজ্ঞানের জনক থেলিস, দর্শনের জনক সক্রেটিস, ট্রাজেডির জনক এস্কিলাস, কমেডির জনক এরিস্টোফানিস, চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক হিপোক্রাটিস, ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যকে জীবন্ত করে তোলা ফিডিয়াস, নগর পরিকল্পনা শাস্ত্রের জনক হিপোডেমাস, গণতন্ত্রকে নতুন মাত্রা দেওয়া পেরিক্লিস, এরিস্টটল, প্লেটো, পিথাগোরাস— মানবসভ্যতার নবনির্মাণে নেতৃত্ব দেওয়া এইসব রথী-মহারথীরা জন্মেছিলেন একটি সভ্যতায়। বর্তমান এই যান্ত্রিক সভ্যতার সমস্ত রকম মৌলিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখার জন্ম হয় এখানেই। বিজ্ঞান, দর্শন, ট্রাজেডি, স্থাপত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র সবদিক দিয়ে সর্বেসর্বা করে একদল পাগল গ্রিস আরেকটু ভেতরে গিয়ে বললে এথেন্সকে করে তুলেছিল রূপকথার রাজ্য। যেন মানুষের ছদ্মবেশে নেমে এসেছিল অলিম্পাসের সব দেবতারা।

দুর্ভাগ্য এরিসদের দাপটে এথিনার সেই রাজত্ব টিকে ছিল মুষ্টিমেয় দু'শ বছর। তার অনেককাল পর লিয়ো ভিঞ্চির মতো একবিংশ শতাব্দীর এক বাঙালি লেখক অবতরণ করলেন এথেন্সের মাটিতে। লেখকদের যা স্বভাব; বিস্তর পড়াশোনা করে তথ্য-উপাত্ত জুড়ে দিয়ে লিখে ফেললেন হেমলকের নিমন্ত্রণের মতো ইট সমান আয়তনের বই। হেরোডোটাসের দেখানো পথে ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ' আমাদের যে সময়টাতে ঘুরিয়ে আনে ওটাকেই বলা হয় গ্রিসের ক্লাসিক্যাল যুগ। মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময়গুলোর একটি। তাই এটি গণতন্ত্র, থিয়েটার, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্মের ইতিহাস।

বাস্তবের সক্রেটিসকে আমরা কেউ দেখিনি। কোনো মানুষকে গভীরভাবে জানার উত্তম উপায়টি হলো তাঁর লেখা। আশ্চর্যজনকভাবে সক্রেটিসের মতো ব্যক্তিত্ব এক ছত্রও লিখেননি তার আয়ুষ্কালে। ফলস্বরূপ সক্রেটিসকে আমরা ততটুকুই বুঝতে পারি যতটুকু তার শিষ্যরা বোঝাতে চেয়েছেন। যেটুকু প্লেটো বা জেনোফোন চেয়েছেন। এই সক্রেটিসের সাথে যে বাস্তবের সক্রেটিসের অনেক পার্থক্য তা বলাই বাহুল্য। তাই এখানে সেই সক্রেটিস নিয়েই কথা বলব যে সক্রেটিসকে প্লেটো চক্ষুদান করেছিলেন; অর্ধশতাধিক বই থেকে নির্যাস নিয়ে যে সক্রেটিসকে ‘হেমলকের নিমন্ত্রণ' দেখাতে পেরেছে। উল্লেখ্য উপন্যাস হলেও লেখক জোর দিয়ে বলেছেন, ‘তিনি জেনেবুঝে কোনো ভুল তথ্য দেননি। কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনকে বদলে দেননি। একটিও কাল্পনিক চরিত্র নেননি।' পাতায় পাতায় তথ্যসূত্রগুলো খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দিয়েছেন।

(প্রথাবিরোধী)

❝মহাপুরুষেরা তাদের যুগে
চলে আসা রেওয়াজের হুজুগে
ভন্ড আখ্যা পেয়েই থাকেন
জিসাস ক্রাইস্ট-ও ক্রুশে ঝুলেছেন।❞
-দানিকেন

কালের আবর্তনে পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ এসেছেন যারা তার সময় থেকে এগিয়ে ছিলেন। ঘুণেধরা সমাজের তৈরি ধ্যান-ধারণাকে নির্দ্বিধায় মানতেন না। আর দশজনের মতো পরম্পরাকে আঁকড়ে ধরতেন না। যাদের বিচিত্র সব কাজ পাল্টে দেয় মানবসভ্যতার সম্ভাবনাকে, ইতিহাসের গতিপথকে। এদের আপাতদৃষ্টিতে বলা হয় প্রথাবিরোধী। সক্রেটিস, হিপোক্রাটিস, পেরিক্লিস, প্লেটো প্রমুখরা ছিলেন এমনই যা বিশ্বাস করতেন, যা হৃদয়ে ধারণ করতেন তার জন্য প্রাণ বাজি রাখতেন। নির্মম বাস্তবতায় তারা বেঁচে থাকেন অন্যদের সময়ে।

প্রচলিত সমাজব্যবস্থা এসব চিন্তা করতে জানা, এগিয়ে থাকা, ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষদের নিরন্তর পদদলিত করেছে। সক্রেটিস, গ্যালিলিও, খনা সবাই এই একসারির। সত্যকে বারবার চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলমান।

সক্রেটিসের পূর্ববর্তী দার্শনিকরা ছিলেন অর্ধপৌরাণিক। তাদের চিন্তার ক্ষেত্র ছিল অলিম্পিয়ান গড, আকাশ, বাতাস, পাতাল এসব। তিনিই প্রথম দার্শনিক যিনি মানুষের মনের গহীনে উঁকি দেন। মানবজাতির মাঝে ছড়িয়ে দেন দেবতা অ্যাপোলোর মন্দিরের দেয়ালের সেই জাদুকরী কথাটি— ‘নিজেকে জানো।' মানুষকে সত্যের পথে জাগিয়ে রাখার জন্যে তিনি নিজেকে তুলনা করেছেন মিওপস নামে এক হুল ফোটানো মক্ষীকার সাথে। অহিংসার বাণী প্রচার করা যোদ্ধা সক্রেটিসও হঠাৎ করে চমকে দেয়।

(গণতন্ত্র)

বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যবস্থাটি হলো গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রের জন্মও এথেন্সে। পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের আমূল পরিবর্তন করে ফেলে এই মানুষতন্ত্র। তবুও মানুষ নিয়ে কাজ করা সক্রেটিস তৎকালীন গণতন্ত্রের বিরোধী বক্তব্য ব্যক্ত করতেন। তাঁর মতে— “আমরা প্রত্যেক কাজের জন্য, সেই কাজের একজন বিশেষজ্ঞের কাছে যাই। জুতা বানাতে মুচি, ঘর বানাতে রাজমিস্ত্রি। এখানে গণতন্ত্রে নেতা হতে কোনো যোগ্যতা লাগে না। কিছু মানুষ গলাবাজি করতে পারলেই কাজ হয়ে যায়। এখানে সরকারি কাজে লোক নিয়োগ হয় লটারিতে।” তবে তার অর্থ এই নয় যে, তিনি স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করেছেন। তাদের বিভীষিকাময় রূপ দেখে শাসকের হুমকির পরও কোনো অন্যায় কাজ করানো যায়নি তাঁকে দিয়ে। গণতন্ত্রের জন্ম, তাঁর উৎকর্ষ সাধনের গল্পটা দারুণভাবে বলেছেন লেখক। তাই এই গল্পের বড়ো একটা অংশজুড়ে আছেন এথেন্সের গণতন্ত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব পেরিক্লিস।

যুগ পাল্টেছে পরিস্থিতি নয়। সেই সময় এক নাট্যকার দুষ্ট লোকের কথায় ভুলে তাঁর দর্শন নিয়ে কমেডি লেখে সক্রেটিসের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। সাধারণ মানুষ এমনই সঠিকটা না বুঝলেও ভুলটাকে সত্য মেনে নেয় একটুও না ভেবেই। প্রতিনিয়তই মিথ্যা ছড়িয়ে মানুষের জীবনকে নরক করে তুলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।

(দর্শন)

সক্রেটিসের দর্শনের প্রথম পদক্ষেপ হলো মিনিমালিজম। প্রাচুর্যকে ত্যাগ করে কেবল কেবল প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো নিয়ে জীবনধারণ করা। নিজে কখনও জুতা পরেননি। শীত-গ্রীষ্ম তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল করতে পারত না। শালীনতা রক্ষার্থে পোশাকও পরতেন অল্প। আর তাঁর দর্শনের মূল বিষয় হলো মানুষের উচিত একটি সুন্দর জীবন অতিবাহিত করা। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন দেবতা-নির্ভর জীবনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের নিয়মে বাঁচতে। সক্রেটিস আর বাউলবাদের দর্শনের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করতে চাওয়া মানে খড়ের গাদায় সুই খোঁজা। ঈশপের গল্পগুলোতেও সক্রেটিসের আদর্শ খুঁজে পাওয়া যায়।

অনেকসময় শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীর ওপর বেজার হলে যতক্ষণ না আটকায় ততক্ষণ প্রশ্ন করতে থাকেন। কিছুটা এই পদ্ধতিতেই সক্রেটিস দর্শনের শিক্ষা দিতেন। প্রশ্ন আর উত্তরের এই খেলাই সক্রেটিক মেথড। সাধারণ মানুষের মাঝে দর্শনের প্রতি আকর্ষণ আর আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করার জন্য তিনি হিউমারও মেশাতেন। তাই এই গল্প পড়ার সময় মাঝেমধ্যেই মুখ বাঁকাতে হয়।

এই পদ্ধতিটা বেশ কার্যকরী। যুক্তিসংগত প্রশ্ন করতে জানলে মানুষের কাছ থেকে দারুণ সব উত্তর নিংড়ে বের নেওয়া যায়। যা হয়তো স্বাভাবিক কথাবার্তায় ঐ ব্যক্তি নিজেই বলতে পারতেন না। এমন উত্তর দিয়ে আমরা নিজেরাই রোমাঞ্চ বোধ করি।

সক্রেটিস গোঁয়ারগোবিন্দ। সত্তর বৎসর বয়সে প্রাণ রক্ষার তাগিদে গ্যালিলিও তাঁর সারাজীবনের শিক্ষাকে নিজেই ভুল আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সত্তরেই সক্রেটিস সত্যকে অস্বীকার করার চেয়ে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছিলেন। তিনি নজরুলের সেই ‘আমি'। যিনি নিজের উপলব্ধি করা আদর্শ থেকে এক চুলও বিচ্যুত হননি। বেঁচে থাকার জন্যে আপোষ করেননি সত্যের সাথে। এভাবে নিজের কাছে জিতে তিনি জীবনের সবচেয়ে বড়ো জয়টা অর্জন করেছিলেন।

❝দর্শন একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয়।❞

সেকালে লোকেরা চিন্তা বিক্রি করত। তা দিয়ে জীবিকা নির্বাহও হয়ে যেত। এখন জ্ঞান মুক্ত হয়ে গেছে। পথে ঘাটে পড়ে আছে। শুধু কুড়িয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। তাই এ যুগে দর্শন সরাসরি অর্থনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে অসমর্থ। তারপরও নিকোলাস কাজানজাকিসের জোরবার কথা ধার নিয়ে বলতে হয়— “আমি তো দুনিয়ায় অশ্ব কি বৃষ হয়ে জন্মিনি যে কেবল খাওয়ার উদ্দেশ্যেই বাঁচব।" মানুষ যখন তার সত্যিকারের মানবিক বোধে চলে আসে, চিন্তা করতে শিখে ফেলে তখন খুঁজতে থাকে জীবনের অর্থ, উদ্দেশ্য। সেই মুহূর্তে পরম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় দর্শন।

হেমলকের নিমন্ত্রণ মোটাদাগে দর্শন না হলেও দর্শনের সৌন্দর্য, গুরুত্ব একটু হলেও অনুধাবন করতে শেখায়। বিজ্ঞানের মতো দর্শনও স্ববিরোধী। নানা মুনির নানা মত। তবুও বিজ্ঞানের সাথে দর্শনের চর্চাটা সমান তালে চললে বোধহয় রবার্ট ওপেনহাইমারের মতো মানুষরা এতটা এগোতেন না। পৃথিবীর বাতাসকে বিষমুক্ত করার জন্য দর্শনের প্রয়োজন আছে বইকি।

উইল ডুরান্ট হিস্ট্রি অব ফিলোসোফিতে লিখেছিলেন ‘সত্য আমাদের ধনী করবে না কিন্তু করবে মুক্ত।' দর্শনের উপস্থিতিতে কোনো বিষয় মহৎ হতে পারে। কোনো সাহিত্যের গভীরতা বাড়ে। দর্শন আসলে নীতিশাস্ত্র।

(গ্রিক পুরাণ)

জ্ঞানের সাম্রাজ্যের জন্য গ্রিস যতটুকু না, তার চেয়েও বেশি পরিচিতি পেয়েছে গ্রিক পুরাণ।সবদেশের ইতিহাসে, কোনোকিছুর উৎপত্তিতে পুরাণের একটা যোগসূত্র থাকেই। তাই হেমলকের নিমন্ত্রণে মাঝেমধ্যেই পুরাণের বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলী এসে গল্পের গতি বৃদ্ধি করেছে। সৌন্দর্য আর মাধুর্যে তাকে করেছে সজ্জিত। সক্রেটিস মিশে গেছেন রাজা ইদিপাসের সাথে। এলসিবিয়াডিস একিলিস। গ্রিক পুরাণের প্রবাদপুরুষ হোমারের আগমনও অনিবার্য ছিল।

(প্রেম)

হেমলকের নিমন্ত্রণে বিভিন্ন প্রকার প্রেমের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সক্রেটিসেরও বিশেষ আগ্রহ ছিল এই প্রেমের তত্ত্বে। ক্লাসিক্যাল সময়েও গ্রিসের নারীরা ছিলেন চরম অবহেলিত, চার দেয়ালের মাঝে সীমাবদ্ধ জীবন। এমনই করুণ সে অবস্থা যে সক্রেটিসের মতো যুগনায়ক উচ্চারণ করেছিলেন— “নারী না হয়ে আমি যে পুরুষ হয়ে জন্মেছি তার জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।" সক্রেটিসের স্ত্রী জেনথিপিকে নিয়েও খুব বেশি লেখা পাওয়া যায় না। লেখক সেই অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণ করার চেষ্টা করেছেন। সক্রেটিসের সাথে জেনথিপির খুনসুটি জমিয়ে দিয়েছেন। এখানে নিস্পৃহ সক্রেটিস হয়ে যান প্রেমিক সক্রেটিস। আরেকটি মনে রাখার মতো প্রেমের গল্প হলো পেরিক্লিস আর এই গল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী নারীচরিত্র দার্শনিক আসপাশিয়ার প্রেম। এই প্রেম একটা সমুদ্রে প্রবহমান জাহাজের মতো। বারবার এমন ঝড় উঠে যে এই বুঝি খানখান হয়ে গেল। ট্রাজেডির ইতিহাসে মধুরেণ সমাপয়েৎ আশা করাটাই বোকামি।

(ডেথ অব সক্রেটিস)

❝মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করেন।❞

স্রষ্টা কাউকে নিরাশ করেন না। মস্তিষ্ককে কাজে লাগাতে জানা মানুষদের জন্যে যেমন রেখেছেন সুবিস্তৃত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তেমনি পরম্পরাপ্রেমী ‘পরিবর্তন ছাড়া কোনোকিছু চিরস্থায়ী নয়'-এ অবিশ্বাসী মানুষদেরকে হাতিয়ার হিসেবে তুলে দিয়েছেন হেমলক।

সক্রেটিসকে নিয়ে ফরাসি শিল্পী জ্যাক লুই ডেভিডের একটা চিত্র— হেমলকের পেয়ালা হাতে লজ্জিত কারারক্ষী, বিছানায় বসে এক হাত পেয়ালা নিতে উদ্যত এবং অন্য হাতের আঙুল উপরের দিকে হেলিয়ে শিষ্যদের উদ্দেশ্যে উপদেশরত সক্রেটিস, বাইরে তাঁর স্ত্রী জেনথিপি; পৃথিবীর ট্রাজেডিতে গেঁথে আছে।

ছাত্রের অপরাধের ভার গুরুকেও বহন করতে হয়। সক্রেটিসকে যা তাড়া করেছে জীবনভর। তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটা গুরুতর অভিযোগ হলো তিনি নাস্তিক। যা তাঁর সারাজীবনকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। ভল্টেয়ার লিখেছেন দুই এথেন্সবাসী সক্রেটিসকে নিয়ে আলাপের একপর্যায়ে বলেছিল— “যে এক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে সে নাস্তিক।" সক্রেটিস শেষ মুহূর্তের শ্রীমদ্ভগবদগীতার দর্শনের প্রতিধ্বনি তুলেছেন।

❝সক্রেটিস বলছেন, তিনি ফিরে আসবেন। মৃত্যুর সাথে সাথে দেহ নষ্ট হয়ে যায়। আত্মা নষ্ট হয় না, আত্মা অমর। আত্মা অন্য দেহ হয়ে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। অন্য রূপে আসে। সেজন্য আমি আবার ফিরে আসব।❞

ঐদিন সূর্যাস্তের সাথে এথেন্সের সবচেয়ে জ্বলজ্বলে সূর্যটি হেমলকের প্রভাবে ডুবে গেছিল। তবে ঐসময় সেই সূর্যটি জানতেন সূর্য এত তাড়াতাড়ি মরে না। তা সবাইকে আলোকিত করে যুগ�� যুগে। তাই তো মৃত্যুকালে অমন কথাগুলো বলতে পেরেছিলেন।

(গদ্যশৈলী)

সাধারণত এই ধরনের বইয়ের ক্ষেত্রে একটা ধারা প্রচলিত আছে যে, লেখকের শব্দচয়ন এমন হতে হবে যেন তা পুরোপুরি ঐ সময়ের অনুভূতিকে ধারণ করে। ব্যতিক্রমীভাবে লেখক খুব সচেতনভাবেই ক্লাসিক্যাল সময়ের এই গল্পকে ধরতে চেয়েছেন আধুনিক বাংলা ভাষায়। আর এখানেই এই বইয়ের কিছুটা অসংলগ্নতা চোখে লাগে।

ভাষা পরিবর্তনশীল। সম্বোধনও। তাছাড়া দেশ অনুযায়ী পার্থক্য তো আছেই। আমরা যখন একটা বাংলা উপন্যাস হাতে তুলে নিই সেটিকে বিশুদ্ধ বাংলা বই হিসেবেই চাই। এ কথাও ঠিক যে বাংলার নিজস্ব শব্দভাণ্ডার খুব একটা সমৃদ্ধ নয় এবং কিছু শব্দ বড্ড সেকেলে হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দুই হাজার বছর আগে বাংলায়ও কেউ বন্ধুকে ‘ধুর মিয়া' বলেছে কি না সন্দেহ। মাঝে মাঝে দুয়েকটা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার গল্পের সময়কালের প্রবাহটা নষ্ট করে দিচ্ছিল যার যথেষ্ট বিকল্প প্রচলিত বাংলায় ছিল। স্মার্ট থেকে প্রতিভাবান কথাটা খুব কম মানানসই হতো না। আর আছে ঝাক্কাসের মতো খেলো কিছু বিশেষণ। আশার কথা এসব শুরুর দিকেই একটু হোঁচট খাওয়ায়। লেখক গল্পের যত গভীরে গেছেন এসব অসংলগ্নতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। বর্তমান বাংলা ভাষায় হওয়ার কারণেই গল্পটি আরও জীবন্ত হয়ে ওঠেছে।

রূপকের ব্যবহার যথার্থ ছিল। একজায়গায় সক্রেটিসকে নীলকণ্ঠ বলা হয়েছে। যিনি সংসার রক্ষার্থে বিষপান করেছিলেন তাকে নীলকণ্ঠ বলা হয়। সক্রেটিস সত্য আর ন্যায়ের পথে অবিচল ছিলেন। হেমলকের মতো বিষ পান করেছিলেন এই কারণে।

এই বইয়ের সবচেয়ে বড়ো গুণ অবশ্যই এর সরলতা, সাবলীলতা, প্রাঞ্জলতা। ধারাবাহিকভাবে ইতিহাসকে শৃঙ্খলিত করেছেন। প্রতিটি পরিচ্ছেদ শুরু করেছেন এমন কিছু কালজয়ী কথা দিয়ে, যেখানে চোখ আটকে থাকে অনেকক্ষণ। ক্লাসিক একটা সময়, শ্রেষ্ঠ কিছু মানুষ, তাদের জীবনের অবিস্মরণীয় ঘটনা, দর্শন আর বিজ্ঞান এত সহজভঙ্গিতে চাঁচাছোলা ভাষায় পাঠকের মনে গেঁথে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। জীবনী নাকি উপন্যাস তা নিয়ে পাঠক বরাবরই দোলাচলে থাকবেন। এমনই নাটকীয় বর্ণাঢ্য সেই সময়। তবে এত লম্বা একটা পথ পুরোপুরি মসৃণ হয় না কখনও। বিস্তৃতিতে মাঝেমধ্যে হোঁচট খেলে তা থেকে উত্তরণের পথ জ্ঞানপিপাসু পাঠককেই খুঁজে নিতে হবে।

সক্রেটিসকে নিয়ে যা-ই লেখা হয়েছে একটা বিষয় খুব সাধারণ। বডি শেমিং। শারীরিক অবয়বের জন্য কটাক্ষ, সমালোচনা। এই ব্যাপারটা রসিয়ে রসিয়ে লিখতে লেখকরা খুব মজা পান। ইতিহাসে এমন জঘন্যতার শিকার আর কেউ হয়েছেন কিনা জানা নেই। বর্ণনাভঙ্গি, শব্দচয়নে সক্রেটিসকে মহাপুরুষ হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। পড়ে আমার মনে হয়েছে সক্রেটিস দোষেগুণে পরিপূর্ণ রক্তমাংসের মানুষ ছিলেন। পেরিক্লিসেরও কিছু কাজ বেশ বিতর্ক করার মতো বিশেষ করে প্রেমিকাকে বিয়ে করার জন্য আগের স্ত্রীকে ত্যাগ করা। কিন্তু এক্ষেত্রে তাকে দেখানো হয়েছে অতিমানব হিসেবে। ঐতিহাসিকেরা নিরপেক্ষ হতে পারেন না।

‘হেমলকের নিমন্ত্রণ'— পাঠকের আগ্রহকে একাই কব্জা করে ফেলে নামটি। বিষয়বস্তুর ভাব-গাম্ভীর্যকে সম্পূর্ণ ধারণ করেছে এই নাম। এই বইয়ের সম্পূর্ণ ভাবকে ধারণ করে আরেকটি নাম“দ্য হেমলক কাপ: সক্রেটিস, এথেন্স অ্যান্ড দ্য সার্চ ফর দ্য গুড লাইফ"। যেটা ইতোমধ্যেই বেটানি হিউজের একটি বইয়ের নাম। প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদের রং সেই সময়কে অনুভব করাতে সক্ষম। মুদ্রণ প্রমাদহীন মানসম্মত সম্পাদনা। হিপোক্রাটিসের একটা উক্তির এক্সপেরিয়েন্স বানানটা ভুল। হলদেটে দারুণ সব পাতা, বাঁধাই সবমিলিয়ে মানানসই দামের কারণে মন জয় করে নেয় প্রকাশনী।

যদি জানতে চান সক্রেটিসকে; কিংবা কোন জীয়ন কাঠির সন্ধানে নির্বিকারচিত্তে হেমলক পান করলেন সুন্দরভাবে বাঁচতে চাওয়া একটি মানুষ, কতগুলো পাগল কীভাবে মানবসভ্যতার ধারাকে পাল্টে দেয়; বাংলা ভাষায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্লাসিক্যাল সময়টায় ঘুরে আসার জন্যে হলেও হেমলকের নিমন্ত্রণে অবগাহন করতেই হবে। যেহেতু অনেক বই নিয়ে গবেষণা করে এমন বই লেখা তাই এ একটি অনেকগুলো বইপড়ার অনুভূতি হয়ই।

হেমলকের নিমন্ত্রণ এক জ্ঞানের মহাযাত্রা। সুন্দর জীবনের প্রতি আহ্বান। এথেন্সের সাধারণ মানুষদের ভাষ্যমতে পাগলদের জীবনগাথা। এককথায় মনের মতো বই। দর্শনের রাজ্যটাই ঢুকতে চাইলে হেমলকের নিমন্ত্রণের মতো বাহন বিরল। নতুন চোখে দেখবেন অলিম্পিক, গণতন্ত্র এবং দর্শনকে। কখনও হাসি, কখনও কান্না, কখনও যুদ্ধ, কখনও হিংসা, কখনও মূর্খামি, কখনও গোঁয়ার্তুমি। ট্রাজিডির জন্ম নিয়ে এই আখ্যানের পর্দা ট্রাজেডিতেই টানা হয়। লেখককে ধন্যবাদ বাংলা ভাষাকে এমন এক তরতাজা বই উপহার দেওয়ার জন্যে ।

আপাতদৃষ্টিতে এই আধো উপন্যাস আধো জীবনীর কোনো অসম্পূর্ণতা চোখে পড়ে না। কিন্তু সক্রেটিসের সাথেই তো আর জ্ঞানের যাত্রা শেষ হয় না। আনন্দের কথা প্লেটোর দর্শন, একাডেমি প্রতিষ্ঠা, এরিস্টটল থেকে আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয় সবকিছু একীভূত করে আসছে হেলমকের নিমন্ত্রণের দ্বিতীয় পর্ব। তাই বলতে হয় ঘুমের ঘোর ঘনিয়ে এলেও গানের পালা সাঙ্গ হয়নি।

গুডরিডস রেটিং: ৪.৫২/৫.০০
ব্যক্তিগত রেটিং: ৭.৬/১০

লেখক: সুজন দেবনাথ
ধরন: ঐতিহাসিক উপন্যাস, জীবনী
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৫৫২
মুদ্রিত মূল্য: ৮০০ টাকা
প্রকাশন: অন্বেষা

❝পৃথিবীতে যতদিন অন্তত একজনও প্রথাবিরোধী মানুষ থাকবে, ততদিন পৃথিবী মানুষের।❞
Displaying 1 - 30 of 68 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.