এক দুপুরে ভাত খেতে বসেছি। আমার মেজো মেয়ে কী-একটা দুষ্টুমি করায় মা’র কাছে বকা খেয়েছে। মুখ অন্ধকার করে ভাতের থালা সামনে নিয়ে বসে আছে। অনেক সাধাসাধি করেও তাকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, মা, তোমাকে আমি আমার ছেলেবেলার একটা গল্প বলব। গল্প গুনে তুমি যদি হেসে ফেলো তা হলে কিন্তু ভাত খেতে হবে। আমি গল্প শুরু করলম। সে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল না হাসার। শেষ পর্যন্ত খিলখিল করে হেসে ফেলে বলল, তুমি যদি তোমার ছেলেবেলাম আরেকটা গল্প বল তা হলে ভাত খাব। আমি যে একসময় তাদের মতো ছোট ছিলাম এবং খুব দুষ্ট ছিলাম এই বিস্ময়ই তাদের জন্য ছেলেবেলাটা লিখে ফেললে কেমন হয়। বিশ-পঁচিশ পৃষ্ঠা লিখেও ফেললাম। আমার বড় মেয়ে খুব উৎসাহ নিয়ে পান্ডুলিপি আমার মাকে পড়াল। মা’র মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি শীতল গলায় আমাকে বললেন, এইসব কী লিখেছিস? নিজের আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে রসিকতা? আমার ছোট বোনও পান্ডুলিপি পড়ল। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমাকে নিয়ে মকড়সা প্রসঙ্গে যে গল্পটা লিখেছ ঐটা কেটে দাও। লোকে কী ভাববে? পান্ডুলিপির খবর ছড়িয় পড়ল। আমার চোটমামা খুলনা থেকে চলে এলেন পড়ার জন্য। তিনি পড়লেন এবং কোনো কথা না বলে খুলনা চলে গেলেন। বুঝলাম তাঁর পছন্দ হয় নি। তবু একসময় শেষ করলাম এবং কোথাও কোনো ভুলটুল আছে কি না তা যাচাই করবার জন্য নিজেই নানিজানকে পড়ে শোনালাম। নানিজান বললেন, অনেক ভুলভ্রান্তি আছে। এই ধর, তুই লিখলি তোর মা পাগল হয়ে গিয়েছিল। পাগল হবে কীজন্যে? মানুষ চিনত না। উলটাপালটা কথা বলত-এর বেশি তো কিছু না। এটাকে পাগল বলে? আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম। আমার মেজো মেয়ে বলল, তুমি মন খারাপ করছ কেন? লেকাটা তো মোটামুটি ভালোই হয়েছে। তবে তুমি একটা জিনিস লিখতে ভুলে গেছ। কোন জিনিস মা? ছেলেবেলায় দুধ আর ডিম খেতে তোমার কেমন খারাপ লাগত তা তো লেখনি। দুধ ডিম তো মা তোমরা খাচ্ছ। আমরা খেতে পারিনি। এত পয়সা আমার বাবা-মা’র ছিল না। মেজো মেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আহা কী সুখের ছিল তোমাদের ছেলেবেলা! সেই সুখের খানিকটা ভাগ আজকের পাঠক-পাঠিকাদের দেয়ার জন্যেই এই লেখা। ছেলেবেলা লেখার সময় শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম। যতক্ষণ লিখেছি গভীর আনন্দে হৃদয় আচ্ছন হয়ে ছিল। পেছনে ফিরে তাকানো যে এত আনন্দময় হবে কে জানত?
Humayun Ahmed (Bengali: হুমায়ূন আহমেদ; 13 November 1948 – 19 July 2012) was a Bangladeshi author, dramatist, screenwriter, playwright and filmmaker. He was the most famous and popular author, dramatist and filmmaker ever to grace the cultural world of Bangladesh since its independence in 1971. Dawn referred to him as the cultural legend of Bangladesh. Humayun started his journey to reach fame with the publication of his novel Nondito Noroke (In Blissful Hell) in 1972, which remains one of his most famous works. He wrote over 250 fiction and non-fiction books, all of which were bestsellers in Bangladesh, most of them were number one bestsellers of their respective years by a wide margin. In recognition to the works of Humayun, Times of India wrote, "Humayun was a custodian of the Bangladeshi literary culture whose contribution single-handedly shifted the capital of Bengali literature from Kolkata to Dhaka without any war or revolution." Ahmed's writing style was characterized as "Magic Realism." Sunil Gangopadhyay described him as the most popular writer in the Bengali language for a century and according to him, Ahmed was even more popular than Sarat Chandra Chattopadhyay. Ahmed's books have been the top sellers at the Ekushey Book Fair during every years of the 1990s and 2000s.
Early life: Humayun Ahmed was born in Mohongonj, Netrokona, but his village home is Kutubpur, Mymensingh, Bangladesh (then East Pakistan). His father, Faizur Rahman Ahmed, a police officer and writer, was killed by Pakistani military during the liberation war of Bangladesh in 1971, and his mother is Ayesha Foyez. Humayun's younger brother, Muhammed Zafar Iqbal, a university professor, is also a very popular author of mostly science fiction genre and Children's Literature. Another brother, Ahsan Habib, the editor of Unmad, a cartoon magazine, and one of the most famous Cartoonist in the country.
Education and Early Career: Ahmed went to schools in Sylhet, Comilla, Chittagong, Dinajpur and Bogra as his father lived in different places upon official assignment. Ahmed passed SSC exam from Bogra Zilla School in 1965. He stood second in the merit list in Rajshahi Education Board. He passed HSC exam from Dhaka College in 1967. He studied Chemistry in Dhaka University and earned BSc (Honors) and MSc with First Class distinction.
Upon graduation Ahmed joined Bangladesh Agricultural University as a lecturer. After six months he joined Dhaka University as a faculty of the Department of Chemistry. Later he attended North Dakota State University for his PhD studies. He grew his interest in Polymer Chemistry and earned his PhD in that subject. He returned to Bangladesh and resumed his teaching career in Dhaka University. In mid 1990s he left the faculty job to devote all his time to writing, playwright and film production.
Marriages and Personal Life: In 1973, Humayun Ahmed married Gultekin. They had three daughters — Nova, Sheela, Bipasha and one son — Nuhash. In 2003 Humayun divorced Gultekin and married Meher Afroj Shaon in 2005. From the second marriage he had two sons — Nishad and Ninit.
Death: In 2011 Ahmed had been diagnosed with colorectal cancer. He died on 19 July 2012 at 11.20 PM BST at Bellevue Hospital in New York City. He was buried in Nuhash Palli, his farm house.
কারো শৈশব কী এতো সুন্দর হতে পারে? মনে হয় আমার শৈশব ও এতো সুন্দর ছিল যদিও কিছু মনে নেই ঠিকমতো।যাইহোক যখন আমি বইটি পড়ছিলাম তখন যেন আমি আমার শৈশবে ফিরে গেছি। গভীর আনন্দে মন আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। পেছনের দিনগুলিতে ফিরে তাকাতে, সেইসব দিনের কথা স্মরণ করতে যে আনন্দ, রোমাঞ্চ অনুভূত হয় তা এ-বই পড়ে দিগুণ হয়ে যায়।
বইটিতে লেখক বর্ণনা করেছেন তার সোনালী দিনগুলোর কথা, বাবা-মা, ভাইবোনদের সাথে কাটানো সময়গুলো। বাবার চাকরির বদলির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, সেখানে কাটানো শৈশব, মজার স্মৃতি, দুষ্টুমির কথাও আছে। তার দাদারবাড়ি- নানারবাড়ি স্মৃতিকথা আলাদা করে বর্ণনা করেছেন। বইটা সত্যিই টেনে নিয়ে যাবে তার রঙিন শৈশবে।
"সৌন্দর্য কে ধরতে না পারার বেদনায় কাটলো আমার শৈশব কৈশোর যৌবন"
প্রিয় হুমায়ূন,যে সৌন্দর্য যে ভালোবাসা আপনি মুক্তহস্তে লেখনীর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন সারাজীবন, রঙিন স্মৃতির আলপনায় রাঙিয়েছেন আমাদের জীবন,সেই বর্ণিল সময়ের কথকতা আজো যেভাবে জোছনা মাখা রাতের মতো মোহনীয় করে রাখে তা বোধহয় আপনার এই নিজের কাছে লুকিয়ে চুরিয়ে না রেখে রামধনুর রঙের মতো বিলিয়ে দেওয়া সেই অনাবিল আনন্দগুলো অন্যদের মাঝে বিলীন করে দেওয়ার জন্যই সম্ভব হয়েছে
আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন,জেনে রাখুন আমার মতো এই নগন্য পাঠকের মনে
হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিকথামূলক রচনাগুলো সবসময়ই অত্যন্ত সুখপাঠ্য হয়। একেবারেই পুচকে থাকতে তাঁর প্রথমবার আমেরিকা ভ্রমণের স্মৃতি নিয়ে লেখা 'হোটেল গ্রেভারইন' পড়ে কীভাবে বিস্মায়াবিষ্ট হয়ে পড়েছিলাম তা আজো মনে পড়ে। সেই প্রথম বোধহয় আমি কোন বইয়ের প্রেমে পড়ি। এরপর সময়ের পরিক্রমায় আরো অসংখ্যবার অগণিত বইয়ের প্রণয়পাশে আবদ্ধ হবার সুযোগ পেয়েছি বটে, তবে সেই প্রথম প্রেমের কথা তো আর ভুলে যায় না। তখন 'হোটেল গ্রেভারইন' এর বদলে 'আমার ছেলেবেলা' পড়লে আরো গভীর ধরনের কোন প্রেমে পড়তাম সেরকমই আজ মনে হচ্ছে৷ পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁ, নিতান্তই দরিদ্র মানুষগুলো, তাদের জীবন, আশা, স্বপ্ন, এমনকি স্বপ্নভঙ্গের কথাগুলোও লেখক কী জাদুময় স্পর্শে জীবন্ত করে তুলেছেন। যতক্ষণ বইটা পড়ছিলাম কী এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। পৃথিবীকে এমনিভাবেও দেখা যায়? আহা!
এমন খুবই কম হয়েছে যে কোনো বই পড়ার পর শব্দ গোছাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। আসলে কিছু বইয়ের রিভিউ হয় না। এমন বইগুলো এতোটাই অভিভূত করে ফেলে যে যতই লিখি না কেন কমই মনে হয়। এইজন্য বেশ কয়েকবার মনে হয়েছিল কিছু না লিখি তবুও মনে হলো বইয়ের কিছু অংশ ও নিজের উপলব্ধি না লিখলে নিজের সাথেই অন্যায় হয়ে যায়।
কোথায় জানি একবার পড়েছিলাম মিসির আলি, হিমু ও শুভ্র চরিত্র হুমায়ূন আহমেদের ছায়া অবলম্বনে লেখা।বইটা পড়ার সময় ব্যাপারটা বুঝলাম। বারবার মনে হচ্ছিল লেখকের মধ্যে হিমুকে দেখছি। লেখকের খামখেয়ালি আচরণ নিজস্ব নাকি বংশানুক্রমে প্রাপ্ত বেশ কয়েকবার মনে হয়েছিল। জবাব পেয়েছি বইয়ে।
❝এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি বারবার দুঃখ পেয়েছি। বারবার হৃদয় হা-হা করে উঠেছে। চারপাশের মানুষদের নিষ্ঠুরতা, হৃদয়হীনতায় আহত হয়ে কতবার মনে হয়েছে- এই পৃথিবী বড়ই বিষাদময়! আমি এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোনো পৃথিবীতে যেতে চাই, যে-পৃথিবীতে মানুষ নেই। চারপাশে পত্রপুষ্পশোভিত বৃক্ষরাজি। আকাশে চিরপূর্ণিমার চাঁদ, যে-চাঁদের ছায়া পড়েছে ময়ূরাক্ষী নামের এক নদীতে। সেই নদীর স্বচ্ছ জলে সারাক্ষণ খেলা করে জোছনার ফুল। দুরের বন থেকে ভেসে আসে অপার্থিব সংগীত।❞
সন্তানের আগমনের সময় থেকেই বাবা-মা স্বপ্ন সাজাতে থাকেন বিশেষ করে ছেলে হবে নাকি মেয়ে। আগেই প্রস্তুতি স্বরূপ কেনাকাটাও করে ফেলেন অনেকেই। লেখকের বেলায়ও এমনটা হয়েছে। ফলাফল দীর্ঘদিন ওনাকে মেয়েদের পোশাক পরতে ও বড় চুল রাখতে হয়েছে। এই অংশ কল্পনা করে প্রচুর হেসেছি। দস্যিপনা হোক বা ঘুরাঘুরি লেখকের সাথে সঙ্গী হিসেবে অধিকাংশ সময়ই ছিল ছোট বোন শেফু। তাঁদের একসাথে ঘুরাঘুরি, দুষ্টুমি পড়ে মজা পেয়েছি। দেশের সর্বস্তরে চোর-ডাকাত বসে আছে এই কথা স্কুলের দুধ ও মাখনের টিনের ঘটনাটা আবারও মনে করিয়ে দিলো।
সন্তানদের নাম পরিবর্তন নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের বাবার কাজকর্ম অদ্ভুত। বর্তমান সময়ে এমন হলে তো বাচ্চাকাচ্চাদের সরকারি অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই জীবন শেষ হয়ে যাবে। হুমায়ূন আহমেদ থেকে "শব্দের জাদুকর" হয়ে ওঠার পিছে ওনার বাবার অবদান সবচেয়ে বেশি মনে হয়েছে। সন্তানদের বলা ওনার একটা কথা আমার খুবই ভালো লেগেছে, "তোমরা বড় হবার চেষ্টা করো। অনেক বড়, যাতে সারা দেশের মানুষ তোমাদের জন্মদিনের উৎসব করে। বাবা-মা'র করতে না হয়"। কর্মের মধ্যেই তো অমরত্ব বিদ্যমান। সাহিত্যের প্রতি প্রবল ভালোবাসা ও হুটহাট খামখেয়ালি কাজকারবার ওনার সন্তানরা সম্ভবত বাবার থেকেই পেয়েছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে রেখে যাওয়া বাবার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ চার হাজারের মতো বই লুট হয়ে যায় পাক-হানাদার বাহিনীর কারণে। সারাজীবন ধরে অল্প অল্প করে জমানো বই আর কতো স্মৃতি হঠাৎই হাতছাড়া হলে কেমন লাগে ভেবে কষ্ট লেগেছে। সাহিত্যিকদের উৎসাহিত করতে ওনার কৌশল আসলেই অভিনব। সংসার চালানোর জন্য লেখকের মা'য়ের বিপুল সংগ্রামের কথাও বইয়ে ফুটে উঠেছে। বিপরীত মেরুর দু'টো মানুষের টোনাটুনির সংসার।
শৈশবের স্মৃতি আমাদের কমবেশি সবারই মনে আছে কিন্তু লেখকের লেখা পড়ে আসলেই মানতে হবে ওনার স্মৃতিশক্তি ভালো। একবার পড়লে পড়া ভুলেন না কেন এখন বুঝলাম। সুখ-দুঃখের স্মৃতি, অনুভূতি ও অতীত নিয়ে সুন্দর একটা বই।
অনেক দিন আগে প্রথমবার বইটা পড়েছিলাম। পড়েছিলাম হবে না, শুনেছিলাম। আমি তখন বাসের ভেতরে, সন্ধ্যা লাগার ���গ মুহূর্তে ভাবলাম একটা অডিওবুক শুনি। সত্যি গল্প টা মনে নেই কিন্তু গল্প টা প্রকৃতির সাথে মিশিয়ে মনের ভেতরে যে আবহ তৈরী করেছিল তা এখনো রি-লিভ করতে পারি! রেটিং গল্পে নয়, আমার অনুভূতির জন্য।
আমার জানামতে আমি হুমায়ূন আহমেদ স্যারের সকল বইই পড়েছি। এদিক সেদিক কিছু বই হয়তো মিস যেতে পারে। তবে বেশীরভাগ যে পড়া তা আমি মোটামুটি নিশ্চিত। এই ভদ্রলোকের কাছে আমি প্রবলভাবে ঋণী। আমার অনেক অনেক অনুভূতির জন্ম উনার লেখা পড়ে। তবুও আমার ধারণা আমি যে সময়ে উনার বইগুলো পড়েছি সেই সময়ে সবকিছু হয়তো ভালোভাবে আমার ব্রেন প্রসেস করতে পারেনি। উনার সকল বই কালেক্ট করার ইচ্ছা অনেক আগে থেকেই। একটা একটা করে এগিয়ে যাচ্ছি সেদিকে। ভাবলাম শুধু সংগ্রহ কেনো, আবার সবগুলা বই নতুন করে পড়লে কেমন হয়! সেই ভাবনা থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি প্রতি মাসে অন্তত ১-২টা করে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বইও পড়বো। শুরুটা করলাম উনার "আত্মজৈবনিক রচনাসমগ্র" হাতে নিয়ে। সমগ্রের প্রথম বই "আমার ছেলেবেলা" নিয়ে নিজের মনোভাব লিখে রাখার লোভটা সামলাতে পারলাম না।
আমার ছেলেবেলা ১০৩ পৃষ্ঠার একদম পিচ্চি একটা আত্মজীবনী মূলক লেখা। এখানে উনার শৈশবের বেশ কিছু লেখা উঠে এসেছে। উনার সাথে ঘটা ঘটনাবলীর কিছু কিছু আমাদের সাথেও ঘটেছিলো ছোটবেলায়। তবে আপাত এই সাধারণ ঘটনাবলীই উনার লেখার জাদুতে হয়ে উঠেছে অনন্যসাধারণ। বইটা আবার কিছু ছোট ছোট নামের অধ্যায়ে বিভক্ত। আমি প্রতিটা অধ্যায়ের কিছু খুঁটিনাটি এবং পছন্দের কিছু লাইন নিয়ে আমার লেখাটা সাজাচ্ছি।
শোনা কথাঃ আমাদের জীবনের বড় একটা অংশ জুড়েই তো আছে ভুল এবং ভ্রান্তি।
বাবা-মা'র প্রথম সন্তান হচ্ছে চমৎকার একটি জীবন্ত খেলনা। এই খেলনার সবই ভালো। খেলনা যখন হাসে, বাবা-মা হাসেন। খেলনা যখন কাঁদে, বাবা-মা'র মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।
এমন আরো চমৎকার সব উক্তি রয়েছে ছোট এই অধ্যায়ে। এখানে মূলত নিজের জন্ম থেকে শুরু করে ২ বছর বয়স পর্যন্ত অন্যের মুখের শোনা কথার স্মৃতিগুলো লেখক উল্লেখ করেছেন। এই সামান্য লেখার মধ্যে উনার বাবা মায়ের সাংসারিক জীবনের অভাব, মায়ের অসুস্থতা আর নানাজানের দিল দরিয়া স্বভাবের ধারণা পাঠক পেয়ে যাবেন।
একজন অদ্ভুত বাবাঃ বইয়ের এই অংশ পড়ার সময় আমার ধারণা সকল পাঠকই তাদের শৈশবে এমন একজন বাবার অভাববোধ করবে। এই যে হুমায়ূন আহমেদের অসংখ্য খামখেয়ালি স্বভাব ছিলো, আমার ধারণা তার বড় একটা অংশই তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। নিদারুণ অভাবের সংসারে হুট করে বেহালা কিনে ফেলা কিংবা প্রভিডেন্ট ফান্ডের সব টাকা তুলে ঘোড়া কিনে ফেলার মতো কাজ কোনো স্বাভাবিক বাবাই করবেন বলে মনে হয় না। উনার আরো চমৎকার অদ্ভুত সব ঘটনা দিয়ে সাজানো এই পর্বের শেষটুকু বেশ করুণ। ভাবতে অবাক লাগে এমন একজন মানুষের জীবনে কি নিষ্ঠুর পরিণতিই না অপেক্ষা করছিলো!
আমার মাঃ এই পর্বে উনার বাবা মায়ের বিয়ে এবং নানা দাদার ব্যাপারে সামান্য কিছু কথা লেখা হয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সাহসীকতা এবং বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারেও জানা যায়। উনার মায়ের ইএসপি ক্ষমতার ব্যাপারে বললেও তার কোনো নমুনা দেননি তিনি এখানে। এই পর্বে উনার দাদাজানের একটা দোয়া বেশ ভালো লেগেছে,
হে পরম করুণাময়, আমার পুত্রকন্যা এবং তাদের পুত্রকন্যাদের তুমি কখনো অর্থবিত্ত দিও না। তাদের জীবনে যেনো অর্থকষ্ট লেগেই থাকে। কারন টাকাপয়সা মানুষকে ছোট করে। আমি আমার সন্তানসন্ততিদের মধ্যে "ছোট মানুষ" চাই না। বড় মানুষ চাই।
জোছনার ফুলঃ সিলেটের নিজের বাসার চমৎকার বর্ণনা দিয়ে এই পর্বটা শুরু হয়। এরপর সেখান থেকে উনার ছোট বয়সে পাওয়া অমানবিক শাস্তির ব্যাপারে কিছু কথা লেখা হয়। সকল বাবা মায়ের এই অংশ থেকে কিছু শেখা উচিত বলে আমি মনে করি। এরপর উঠে আসে এক আইসক্রিমওয়ালার কথা। বড় মন খারাপ লাগে মানুষটার জন্য। এরপর আসে স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর্ব। এখানের একটা ঘটনার বর্ণনা লেখকের ভাষাতেই না হয় পড়ে নিন!!
মেঝেতে পাটি পাতা। সেই পাটির উপর বসে পড়াশুনা। ছেলেমেয়ে সবাই পড়ে। মেয়েরা বসে প্রথম দিকে, তাদের পেছনে ছেলেরা। আমি খানিক্ষন বিচার-বিবেচনা করে সবচে রূপবতী বালিকার পাশে ঠেলেঠুলে জায়গা করে বসে পড়লাম। রূপবতী বালিকা অত্যন্ত হৃদয়হীন ভঙ্গিতে তুই তুই করে সিলেটি ভাষায় বলল, এই, তোর প্যান্টের ভেতরের সবকিছু দেখা যায়। ক্লাসের সবক'টা ছেলেমেয়ে একসঙ্গে হেসে উঠলো। মেয়েদের আক্রমণ করা অনুচিত বিবেচনা করে সবচে উচ্চ স্বরে যে-ছেলেটা হেসেছে, তার উপর ঝাপিয়ে পড়লাম।
এরপর লেখকের পরিচয় হয় শংকর নামের এক ছেলের সঙ্গে, সে অংশগুলোও ব্যাপক মজাদার। পড়ে বিমালানন্দ উপভোগ করেছি। সব লিখে দিলে তো আর বই পড়ার দরকার হবে না, তবে এই পর্বটা আসলেই দূর্দান্ত।
মাথামোটা শংকর এবং গ্রীন বয়েজ ফুটবল ক্লাবঃ বিড়ি খাওয়ার কোর্স দিয়ে শুরু এই এক পেইজের পর্বটা বেশ মজাদার। শংকর পাশ করলেই ফুটবল পাওয়ার ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর ছিলো।
নানার বাড়ি দাদার বাড়িঃ
চার থেকে পাঁচ ঘন্টা গৌরীপুর জংশনে যাত্রাবিরতি। কী আনন্দ! কী আনন্দ! স্টেশনের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ঘুরে বেড়াও। ওভারব্রিজে উঠে তাকিয়ে দ্যাখো পিপীলিকার সারির মতো ট্রেনের সারি। দূরের দিগন্তে বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। সেই ক্ষেতে নেমেছে সাদা বকের দল। তারা উড়ে উড়ে যাচ্ছে, আবার এসে বসেছে। আরো অনেক দূরে মেঘের কোলে নীলরঙা গারো পাহাড়। এইগুলি কি এই পৃথিবীর দৃশ্য? না, এই পৃথিবীর দৃশ্য নয়- ধুলোমাটির এই পৃথিবী এতো সুন্দর হতে পারে?
কি চমৎকার বর্ণনা। এই পর্বে লেখকের নানার বাড়ি আর দাদার বাড়ি সম্পর্কে জানতে পারবে পাঠক। কি চমৎকার সময় যে এক সময় কাটাতাম আমরা গ্রামের বাড়ি গেলে তা নতুন করে উপলব্ধি করলাম এই পর্ব পড়তে গিয়ে। এই স্মার্ট দুনিয়ার বাইরে কি অসাধারণ চমৎকার সব দিন এক সময় কাটাতো আগেরকার শিশু কিশোরেরা!
পারুল আপাঃ পারুল আপার অংশটা বিষন্ন, বিষাদে ভরপুর। আনুষঙ্গিক ভাবে বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে যথারীতি। নারী পুরুষের গুপ্ত সম্পর্কের ব্যাপারে লেখকের জানা হয় এই পর্বে।
স্বপ্নলোকের চাবিঃ লেখকের সাহিত্যের সাথে পরিচয় ঘটে এই পর্বে। যথারীতি আকর্ষণীয়ভাবে বর্ণনা করেছেন সেটা। উনার চোখের সমস্যার ব্যাপারটাও ঘটে একই সময়ে। ছোটবেলায় বাড়িতে মেহমান আসলে সেটা আমাদের কাছে ঈদের আনন্দের সমান হতো। এটা লেখক আবার মনে করিয়ে দিলেন এখানে।
সাহিত্য বাসরঃ তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, তবে লেখকদের নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের যে আড্ডা হতো নিয়ম করে তার পিছনে উনার বাবার এই "সাহিত্য বাসর" অংশটুকুর কোনো ভূমিকা থাকলেও থাকতে পারে।
পদ্মপাতার জলঃ ধনী এবং গরীবের ভেদাভেদ যে সে সময়েও সমাজে ছিলো তাইই ফুঁটে উঠেছে এই পর্বের শুরুতে। উনার বাবার কবিতা লেখার শখ, উনার মামার কবি হয়ে উঠা এবং মজাদার সব কর্মকান্ডও এই পর্বে ঠাঁই পেয়েছে। খাদ্যাভাবে নিজের কোলের শিশুকে বিক্রি করে দেয়ার একটা ঘটনা মনে বেশ ধাক্কা দিয়েছে। সমাজ তো এখনো সেই জায়গাতেই রয়ে গিয়েছে, তাহলে আমাদের উন্নতিটা হলো কই?
আমার বন্ধু উনুঃ উনু নামের নতুন এক বন্ধু পেয়ে যান লেখক এখানে। খুবই চমকপ্রদ তার গল্প। পাঠক পড়ে শুরুতে ভালো লাগায় আর শেষে বিষাদে আচ্ছন্ন হবেন।
জগদলের দিনঃ লেখকের বাবার বদলির সুবাদে জগদল যাওয়া হয় উনার পরিবারের সকলের। ভীষণ বন্য পরিবেশ, সাপ, বিছের উপদ্রব, রহস্যময় জঙ্গল সবকিছুর চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় এখানে। এবং যথারীতি কোনোটাতেই বাহুল্যতা নেই। আরতি নামের এক মেয়ের প্রেম পড়েন লেখক এই জায়গায়।
তা ছাড়া ম্যালেরিয়া অসুখটা আমার বেশ পছন্দ হল। যখন জ্বর আসে তখন কি প্রচন্ড শীতই-না লাগে! শীতের জন্যই বোধহয় শরীরে এক ধরণের আবেশ সৃষ্টি হয়। জ্বর যখন বাড়তে থাকে তখন চোখের সামনের প্রতিটা জিনিস আকৃতিতে ছোট হতে থাকে। দেখতে বড় অদ্ভুত লাগে। এক সময় নিজেকে বিশাল দৈত্যের মতো মনে হয়। কি আশ্চর্য অনুভূতি!
জ্বর নিয়ে এমন চমৎকার লেখা আগে কখনো পড়েছি বলে মনে পড়ে না। আমার মনে আছে ছোটবেলায় আমার জ্বর হলেও এখনকার মতো কাবু হয়ে যেতাম না। তখনকার অসুখ বিসুখ গুলোও এখনকার মতো হিংস্র ছিলো না। এই পর্বে বেঙ্গল টাইগার নামে এক কুকুরের স্মৃতিচারন করেন লেখক। যার কারনে লেখকের ছোট ভাই বেঁচে যায়। নিজের জীবন বিপন্ন করে শিশু বাচ্চাকে বাঁচায় এই কুকুরটা। অথচ তাকেই শেষ পর্যন্ত মারতে বাধ্য হন লেখকের বাবা। গল্পের মর্মস্পর্শী অংশ এটুকু।
শেষ পর্বে শঙখনদীঃ লেখকের বাবার আবারো বদলীর সুবাদে এবার রাঙ্গামাটি যাওয়া হয় লেখকের। যথারীতি সেখানের দূরন্ত কিছু বর্ণনা আর ঘটনা জানা হয় লেখকের বয়ানে। রাঙ্গামাটি থেকে বান্দরবান যেতে আবার। সেখানে দেখা বহুরূপী নামক এক মানুষের উল্লেখ করেন লেখক। আমি কখনো এই রকম কিছু আগে শুনিনি। এখানে লেখকের স্কুলের একটা ঘটনা যেভাবে উনার বাবা সামাল দেন, তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। সন্তানের ভুলের জন্য যেমন তাকে মাফ চাইতে হয়, তেমনি সন্তানের মান অপমান আর অভিমানের দিকেও নজর দিতে হয়; এই শিক্ষা আমি নিয়েছি এই অংশ থেকে। লেখকের প্রথম লেখালিখির সূত্রপাতও এখান থেকেই। শেষে একটা করুণ ঘটনার বর্ণনা আর জোছনার ফুল ধরার আকুতি নিয়ে লেখা শেষ করেন তিনি।
তুমি এতো পাগল কেন? তার এই সামান্য কথা_কী যে ভালো লাগলো! সেই ভালোলাগায় একধরণের কষ্টও মিশে ছিল। যে কষ্টের জন্ম এই পৃথিবীতে নয়_অন্য কোন অজানা ভুবনে।
#ব্যক্তিগত_রেটিংঃ ১০/১০ (ইয়াপ, পিউর বায়াসড রেটিং। হুমায়ূন আহমেদ স্যারের বইয়ের দেয়া আমার বেশীরভাগ রেটিং এমনই হবে। তাই এটা আপনারা এড়িয়ে গেলেই ভালো হবে বলে আমার মনে হয়।)
#পরিশিষ্টঃ কিভাবে মন উজাড় করে ভালোবাসতে হয়, কিভাবে ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ভাবতে হয়, কিভাবে দুঃখের সাগরে হাবুডুবু খেতে হয়, কিভাবে প্রকৃতির মাঝে রোমান্টিকতা খুঁজে পেতে হয়; তার সবকিছুই আমি শিখেছি এই ভদ্রলোকের লেখা পড়ে। আর তাই যতোই পরিণত বয়সে এসে উনার বই পড়ি না কেনো, মনটা আমার সেই তারুন্যেই চলে যাবে উনার লেখা পড়ার সময়ে। আমাদের ওই সময়ের সমাজটাও ভিন্ন ছিলো, আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের সকল জটিলতা নিজের লেখায় নিয়ে এসে তিনি আজীবনের জন্য আমাদের আত্মার মানুষ হয়ে গিয়েছেন। আর তাই আমার রিভিউতে আমি উনার সম্পর্কে কোনো ধরণের তীর্যক মন্তব্য আশা করবো না কারো কাছ থেকে। আপনাদের ভালো না লাগলে রিভিউ এড়িয়ে যাবেন।
পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনঝঙ্গা দেখা কিংবা দিনাজপুরে পাতাঝরা বনে হাড়হিম করা রোমাঞ্চকরসব প্রাণীর গর্জন-কলতান শোনা, রাজার বাড়িতে থাকা কিংবা খাগড়াছড়িতে মুরং রাজার মেয়ের সাথে একই ক্লাসে পড়াশোনা করা , সবই ঘটেছিল এই জাদুকরের জীবনে, তার জীবনের শুরুটাই ছিল স্বপ্নময় ।
হুমায়ূন আহমেদকে জানার জন্য উনার আত্মজীবনী বা Autobiography জানার কোনো বিকল্প নেই। কারণ মানুষের প্রতিভার বীজ সুপ্তাবস্থায় ই জীবন শুরুর দিকেই কোনো না কোনো ভাবে রোপিত হয়ে থাকে, এইক্ষেত্রে কাউকে না কাউকে নিয়ামকের ভূমিকা অবশ্যই পালন করতে হবে সাথে সুপ্তাবস্থাকে উপযুক্ত ভাবে লালায়িতও করতে হয়। হুমায়ূনের ক্ষেত্রে সেই নিয়ামক তার বাবা। পুরাটা গল্প জুড়ে একজন হুমায়ূন আহমেদ গড়ে উঠার জন্য হুমায়ূনের বাবার অপরিসীম অবদানের কথা বারংবার এই গল্পের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে 🧡 তবে আমার পড়া হুমায়ূনের সেরা Autobiography হচ্ছে, " হোটেল গ্রেভার ইন "
" সৌন্দর্যকে ধরতে না-পারার বেদনায় কাটল আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন। " শেষের এ লেখাটুকু পড়ে, আমার নিজেরই কেনো জানি কষ্ট হচ্ছে। শৈশব আনন্দে কেটেছে, এ কথা সবার মুখ থেকে শুনি। কিন্তু, ঠিক ঠিক মনে করতে পারি না আমার শৈশব কেমন ছিলো। খুব ছোটবেলার কথা মনে করতে গেলে একটা জিনিসই মনে পড়ে, আমার সেজো বোনটা মারা যাওয়ার পর নানাভাই কিভাবে হাত পা ছুঁড়ে কান্না করেছিলেন। চোখের সামনেই ভেসে উঠে ঘটনাটা। স্মৃতি ভান্ডারে শৈশবের যে ক'টা স্মৃতি আছে, তা হিসেব করলে আমি কখনোই শৈশব ফিরে পেতে চাই না। মানুষের শৈশব এত্ত সুন্দর হতে পারে, এই বইটা না পড়লে বুঝতেই পারতাম না। লেখক তার জীবনে সৌন্দর্যের অনেকটাই ধরতে পেরেছেন। খুব হিংসে হচ্ছিলো, এমন একটা শৈশব কেনো পেলাম না!!
হুমায়ুন আহমেদ এর শৈশব থেকে কিশোর বয়সের নানা বৈচিত্র্যময় ঘটনার বর্ননা দেয়া হয়েছে বইটিতে। গল্প বলার স্টাইল নিয়ে আসলেই তেমন কিছু বলার সাহস নেই। বইটা পড়ার পরে কিছুক্ষন চুপ করে বসে ছিলাম। তার তৈরি করা চরিত্র নিয়ে ভাবছিলাম। জীবন থেকে নেয়া বাস্তব চরিত্র গুলোর কিছু অংশ কি হিমু/ মিসির আলি বা এরকম অন্য চরিত্র /ঘটনা গুলোতে পড়েছিল? পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল খুব কাছ থেকে তাকে দেখছি :)
স্যারের লেখা যারা খুবই পছন্দ করেন তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য।
হুমায়ুন আহমেদের সেরা দশটা বইয়ের তালিকা করতে দিলে আমি নির্দ্বিধায় সে তালিকা শুরু করব “আমার ছেলেবেলা” দিয়ে। বইটা খুব সম্ভব আমি প্রথম পড়ি ক্লাস ফোর / ফাইভে থাকতে, বলা চলে তখন আমার নিজেরই ‘ছেলেবেলা’ চলছে! তাই ভালোলাগার অনুভূতিগুলো মনে আছে, মনে আছে কেমন গড়াগড়ি খেয়ে হেসেছি পাতায় পাতায়, কিন্তু সেই অর্থে কাহিনীর কিছুই মনে নেই। (এই কাহিনী মনে না থাকা নিয়ে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছে ঠিক এরপরেই যে বইটা শেষ করেছি, মুজতবা আলীর ‘জলে-ডাঙায়’ পড়তে গিয়ে, সে গল্পও হয়ত করা যাবে অন্য কোনদিন)।
২০২৩-সালে ব্যক্তিগত একটা ইচ্ছে হল, বছরে মোট যতগুলো বই-ই পড়ি না কেন, প্রতি মাসে নূন্যতম একটা বই পড়ব। মার্চ মাসের দিন বিশেক চলে গেলেও কোন বই ধরতে না পারায় তাই হাতে তুলে নিলাম হুমায়ুন আহমেদের বই, যার লেখা চাইলে আলোর চাইতেও বেশি বেগে পড়া যায়! হলোও তা, চোখের নিমিষেই শেষ। তবে এবারের রেশটা আরও অনেক গভীর, প্রগাঢ়। কারণ সেই ক্লাস ৪/৫ এর আমি আর এখনকার আমির পার্থক্য হল, আমি জীবনের বড় একটা সময় সিলেটে কাটিয়ে এসেছি, চোখ বন্ধ করলেই মীরাবাজার চোখে ভাসে, দেখতে পাই কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ। টুকটাক ঘুরাঘুরির অভ্যেস থাকায় আদিদিগন্ত বিস্তৃত হাওরের মধ্যে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে এসেছি, মোহনগঞ্জে কাজল ভাইয়ের বাড়িতে বসে জ্যোৎস্না গিলে এসেছি, বান্দবানের খাড়া পাহাড় বাইতে গিয়ে তৃষ্ণায় কাঠফাটা জিহ্বা নিয়ে ফেরত এসেছি, গিলে এসেছি পাহাড়ের অপার্থিব সৌন্দর্য্য… আর এই সবগুলো জায়গার কথাই ‘আমার ছেলেবেলা’য় উল্লেখ আছে। হুমায়ূন সাহেবের জন্ম নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে, তার নানাবাড়িতে, গল্পের শুরুও সেখানেই। এরপর ডানপিটে হুমায়ূনের বেড়ে ওঠা সিলেট শহরের মীরাবাজারের এক বাড়িতে, বইয়ের বিরাট এক অংশজুড়ে আছে সিলেটে তার ছেলেবেলার কাহিনী। ইনফ্যাক্ট এই বইয়ের সিংহভাগই সিলেট, মোহনগঞ্জ আর বারহাট্টায় (দাদাবাড়ি)। শেষ দিকে অল্প কিছু অংশ আছে দিনাজপুরে আর বান্দরবানে। মধ্যে মধ্যে আছে ট্রেডমার্ক হুমায়ূন রসিকতা, সেসব রসিকতার ভেতরে ভেতরেই হুট করে এসে হাজির হয় গভীরভাবে ভাবার মতন কিছু বাক্য। ছেলেবেলার গল্প বলতে গিয়ে এসেছে অসংখ্য চরিত্র, অনুমিতভাবেই যাদের বেশিরভাগেরই উপস্থিতি খুবই অল্প সময়ের জন্যে।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি, বাঙালি সেই অর্থে বান্দরবান যাওয়া শুরু করেছে এই কদিন হল, পঞ্চগড় থেকে যে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, সে খবরও মানুষ (ম্যাস-পিপল অর্থে) পেতে শুরু করেছে শুক্কুর শুক্কুর আষ্টদিন। অথচ হুমায়ূন সাহেব তার শৈশবকালে, সেই পঞ্চাশের দশকে পঞ্চগড় থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছেন, বান্দরবানের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়েছেন, সেসব কথা লিখে রেখেছেন ১৯৯১ সালে প্রকাশিত এক বইয়ে, যে বইও কী না লিখতে আরম্ভ করেছিলেন তার মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাবার খাওয়ার সময়!
এত বছর পরে এসেও সেই একই মুগ্ধতা, একই ঘোরলাগা অনুভূতি, পড়া শেষে সেই একই আনন্দ। জয়তু হুমায়ূন সাহেব!
কি সুন্দর কি সুন্দর! অদ্ভুত ব্যাপার। হুমায়ুন আহমেদের পরিবার বা তার আত্বিয়-সজন দের প্রতিটা ক্যারেক্টারই মনে হচ্ছিল তার কোনো না কোনো বই এ আগে পড়া কোনো ক্যারেক্টার। লেখক কি তার বইগুলো লেখার সময় অজান্তেই তার নিজের আশে পাশের মানুষদের আদলে তার চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছে নাকি তার এই ছেলেবেলার গল্প গুলো সবই গল্প এবং লেখার সময় সেই আগের লেখা চরিত্র গুলোই ফিরে এসেছে কে জানে!! হয়ত প্রথম টাই।
গল্পের জাদুকরের নিজের জীবনও যেনো গল্পের মতো। এতো ঘটনা এতো কিছুর ভিতর দিয়ে তার ছেলেবেলা কেটেছে। আমার আফসোস হয় এখনকার ছেলে মেয়েদের দেখলে। তাদের শৈশব কেটে যাচ্ছে মোবাইল ফোনের মধ্যে।
বইটক্র ভালোলাগা, বিস্ময়বোধ কখনোই হয়তো শেষ হবে না। একজন হুমায়ূন আহমেদের হুমায়ূন আহমেদ হয়ে উঠাটাই যেনো বইয়ের পাতায় পাতায়। হুমায়ূন আহমেদের বাবা একজন অসাধারণ মানুষ...
By far, the best Humayun Ahmed book I've read. Really a lot of fun, and the way he portrayed his childhood, almost felt like a fantasy. Amazing in a word!
চোখের সামনে দিয়ে নিজের ছেলেবেলাটাও যেন ভেসে গেল। লেখক এর শৈশবের বিচিত্র ঘটনা মনে দাগ কেটেছে যেভাবে, ঠিক তেমনি ভাবে আমার শৈশবের স্মৃতিগুলোকেও জাগিয়ে দিয়ে গেছে। অসাধারণ এক ভ্রমণ ছিল লেখকের শৈশবের জগতে। সাধারণ কিছু কথাকেও যে অসাধারণ ভাবে উপস্থাপন করা যায় ,তার জলজ্যান্ত প্রমাণ বইটি। তবে হুমায়ুন সাহেব এ কাজ অনায়াসেই করে ফেলেন। লেখক এর শৈশব পুনরায় স্মরণ করতে না চাইলেও ,নিজের শৈশবের স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলতে হলেও বইটি পুনর্পাঠের হকদার।