মানব জাতি ও সভ্যতার এ দশ হাজার বছরের ইতিহাসে যথার্থ নায়কের ভূমিকা পালন করেছেন আল্লাহ প্রেরিত নবী ও রাসূলগণ। এ নবী ও রাসূলগণের সংখ্যা এক লক্ষ চল্লিশ হাজারেরও বেশি। তাদের অধিকাংশই ছিলেন সমাজপতি, জাতীয় নেতা এবং কেউ কেউ আবার বৃহত্তম রাষ্ট্রও শাসন করে গেছেন। নবীদের পর তাঁদের প্রতিনিধিবৃন্দ তাঁদের ধারাকে অব্যাহত রেখেছেন। এভাবে মানব সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সমাজ নবীদের শিক্ষার ভিত্তিতে বিকাশ লাভ করেছে। মানব সমাজ ও সংস্কৃতিতে যাবতীয় নৈতিক ও সগুণাবলী এবং সদাচার নবীদের শিক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। পরবর্তীকালে নবীদের শিক্ষা হতে বিচ্যুত হয়ে সমাজ ও সংস্কৃতিতে অসম্পৃত্তি ও অসৎগুণাবলীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি চরম পাপাচার, শিরক, মূর্তি পূজা, অন্যায় ও অসৎকর্মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়ার পর এক পর্যায়ে এসে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে । এভাবে পৃথিবীর বুক থেকে একের পর এক বিভিন্ন সভ্যতার বিলােপ সাধন হয়েছে।
এভাবে হাজার হাজার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মানব জাতি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে । লক্ষাধিক নবীর প্রচেষ্টা ও সাধনায় মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতি উন্নতি ও অগ্রগতির বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে। হাজার হাজার বছরের কার্যধারা সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সংযােগ ও সম্পর্ক গড়ে তােলে । ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে সর্বত্র যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। এ অবস্থায় সারা বিশ্বে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির একজন মহাসংগঠক ও স্থপতির প্রয়ােজন দেখা দেয়। মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্ব মানবতার জন্য রহমতস্বরূপ শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করে সেই প্রয়ােজনও পূর্ণ করে দেন।
~সুচিপত্র~ ১.পূর্বকথা ২. প্রাচীন বাংলা ৩. প্রাক-ইসলাম যুগ ৪. ইসলামের প্রচার ও প্রসার ৫. ইসলাম প্রচারের দ্বিতীয় পর্যায় ৬. ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় রাজশক্তির ভূমিকা ৭. ইসল্মার প্রচারের তৃতীয় পর্যায় ৮. ইসলাম প্রচার ও প্রিষ্ঠায় রাজশক্তির ভূমিকা ৯. সমাজ-সংস্কৃতি-শিক্ষা
আবদুল মান্নান তালিবের জন্ম ১৫ মার্চ ১৯৩৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের অর্জুনপুর গ্রামে। তার পিতার নাম তালেব আলী মোল্লা এবং মাতার নাম মেহেরুন্নেসা। তিনি ছিলেন সাত ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে পঞ্চম।
আবদুল মান্নান তালিব বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তি। তিনি আল-কুরআন, আল-হাদীস, ফিকহ্, ইতিহাস, অর্থনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা চিন্তাবিদ, গবেষক ও লেখক। যদিও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন, ইসলাম ছিল তাঁর চিন্তা-চেতনার মূল কেন্দ্র। তাঁর রচিত সাহিত্যকে মোট তিন ভাগে ভাগ করা যায়ঃ মৌলিক রচনা, অনুবাদ সাহিত্য, এবং শিশু-কিশোর সাহিত্য।
তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। এইচএসসি পাস করেন ঢাকা বোর্ড থেকে ১৯৬৬ সালে। অতঃপর জামেয়া আশরাফিয়া, লাহোর থেকে দাওরা-ই-হাদিস বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং হাদিস শাস্ত্রের ওপর গভীর জ্ঞান অনুসন্ধান করেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফারসি ও হিন্দি এই ছয়টি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। এ সকল ভাষা থেকে সাহিত্যসহ গবেষণাধর্মী অনেক গ্রন্থ তিনি অনুবাদ করেছেন।
আবদুল মান্নান তালিবের কর্মময় জীবন শুরু হয় মূলত সাংবাদিকতার মাধ্যমে। তিনি ইসলামিক রিসার্চ একাডেমি ঢাকার রিসার্চ স্কলার ছিলেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। তারপর রিসার্চ স্কলার ছিলেন বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত। ১৯৮৭ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বাংলা সাহিত্য পরিষদের পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ১৯৯৯ থেকে ইসলামিক ‘ল’ রিসার্চ সেন্টার এন্ড লিগ্যাল এইড বাংলাদেশ এর ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
তাছাড়া ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ইউকে, আমেরিকা, সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া, আরব আমিরাত, মিশর প্রভৃতি দেশের স্কলারদের সাথে আবদুল মান্নান তালিব সাহেবের মত বিনিময় হতো। ইউসুফ আল কারদাভী, মাওলানা ইউসুফ ইসলাহি, আহমদ তুতুনজি, নঈম সিদ্দিকী, খুররম মুরাদ অনেকের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি কবি নজরুল ইসলাম ও কবি ফররুখ আহমদের কবিতা উর্দু ভাষায় অনুবাদ করে উর্দু ভাষীদের কাছে নজরুল ও ফররুখকে পরিচিত করেছেন। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী দিকনির্দেশনা দিতে বহু নতুন বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার প্রবন্ধের সংখ্যা তিনশ’ এর বেশি। মৌলিক রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা সব মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৭৬টি। অনেক মূল্যবান গ্রন্থ অপ্রকাশিত রয়েছে।
ব্যাক্তিগতভাবে আবদুল মান্নান তালিব ছিলেন অত্যন্ত সচ্চরিত্রবান, সত্যবাদী সদালাপী, সদাচারী, ভদ্র, অমায়িক ও নিরীহ প্রকৃতির শান্ত-শিষ্ট আদর্শ মানুষ। মানুশের যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তিনি নিজে সকলের আন্তরিক ভালবাসা অর্জন করেছেন। ইসলামই ছিল তাঁর চলার পথে একমাত্র দিক-দর্শন। ইসলামের বিজয় ও সার্বিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তিনি সারা জীবন কাজ করে গেছেন।
তিনি ২২ সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে ঢাকার শান্তিবাগে নিজ বাসায় ইন্তিকাল করেন। ২০১৫ সালে আবুল আসাদের (Abul Asad) সম্পাদনায় তাঁর স্মারকগ্রন্থ 'পথিকৃৎ' প্রকাশ করা হয় বাংলা সাহিত্য পরিষদের পক্ষ থেকে।
লেখক আবদুল মান্নান তালিব বাংলাদেশে ইসলাম বইতে প্রাচীন বাংলা থেকে শুরু করে উপনিবেশের সময় কাল পর্যন্ত এদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন এবং পাশাপাশি এ প্রচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সংস্কৃতিক ভুমিকা নিয়েও আলোচনা করেছেন। এমন নয় যে বাধাহীন পরিবেশেই এ দেশে ইসলামের প্রবেশাধিকার ঘটেছিল বরং পদে পদে একে সম্মুখীন হতে হয়েছে ভিন জাতি-গোষ্ঠী রাজশক্তির অত্যাচার, কুসংস্কারের বেড়াজাল এমনকি এহেন অবস্থা পরিত্রাণের ক্ষেত্রে আত্তরক্ষার লড়াই পর্যন্ত। অসংখ্য সূফী, দরবেশ, আধ্যাতিক ব্যাক্তিত্ব, ধর্মীয় পণ্ডিত ব্যাক্তিবর্গের শত বছরের প্রচেষ্টার ফলে পাওয়া ইসলামের চিত্র উঠে এসেছে এ বইতে, উঠে এসেছে ক্ষমতা, সম্পদের লালসায় প্রকৃত ইসলামের রুপ বিকৃতকারী এক শ্রেনীর নামধারী মুসলিম শাসক, ব্যাক্তিবর্গ থেকে শুরু করে রুচিহীন আধ্যাতিকদের কথাও। তারপরও ইসলাম হারিয়ে যায়নি বরং শত বাধা পেড়িয়ে আজও তার স্বকীয়তা বজায় রেখে বয়ে চলেছে, যদিওবা অজ্ঞতার বেড়াজালে অনেকেই হারিয়েছে এ স্বকীয়তার পাশ ধরে নিজেকে বহমান রাখতে।
কিতাবখানিতে বাংলাদেশে ইসলামের ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখকের চিন্তার গভীরতা উল্লেখযোগ্য। বাংলার ইতিহাস আর বাঙালি মুসলিমের ইতিহাস ইসলামের একদম শুরুর সময় থেকেই একসঙ্গে চলতে শুরু করেছে। লেখক এ অঞ্চলে ইসলামের প্রচারকে তিনটি আলাদা সময়ে ভাগ করেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরব বণিকদের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরেই হয়ত প্রথম তাওহীদের দাওয়াত এসে পৌঁছায়। পরবর্তীতে অসংখ্য ওলি আউলিয়া পীর মাশায়েখদের পদধূলিতে এ অঞ্চলে মুসলিমদের প্রসার ঘটেছে। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা, বর্ণপ্রথার অমানবীয় প্রেষণ, এবং ইসলামের রাষ্ট্রীয় শক্তি লাভ সহ ইসলাম প্রচারের প্রথমভাগে দাওয়াতি কার্যক্রম ছিল বেগবান। কিন্তু এ ধারা সবসময় মসৃণ থাকে নি। বাংলায় ইসলামী চেতনার উত্থান এবং পতনের ইতিহাস জানতে বইটি খুবই সহায়ক, লেখকের সহজবোধ্য কিন্তু সুচিন্তিত শব্দ চয়নের প্রশংসা করতেই হয়। যেকোনো ঘটনার বর্ণনা দিতে লেখক যথেষ্ট রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন আবার একই সাথে প্রচলিত জনশ্রুতিরও উল্লেখ করেছেন। যা তৎকালীন সমাজের মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষেত্রেও সহায়ক।
বইটা নিঃসন্দেহে লেখকের অনেক পরিশ্রমের ফল । বইটিতে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ অঞ্চল ইসলাম প্রচারক দেরকে তুলে ধরা হয়েছে এবং তাদের বিভিন্ন কিংবদন্তি । কিন্তু আমার কাছে কেমন যেন বিদঘুটে লেগেছে ।