Jump to ratings and reviews
Rate this book

ঝিনুক নীরবে সহো

Rate this book
‘‘হা সুখী মানুষ, তোমরাই শুধু জানলে না
অসুখ কত ভালো
কতো চিরহরিৎ বৃক্ষের মতো শ্যামল
কত পরোপকার
কত সুন্দর’’
-এমন উচ্চারণ কেবল মাত্র একজন কবিই করতে পারেন, যিনি খুব অল্প বয়সে অসুখের যন্ত্রণায় বুঁদ হয়েছিলেন। কবির বন্ধুর ভাষ্যে ‘‘একটুখানি আয়ুষ্মতী ঘুম চেয়েছিলেন’’-আবুল হাসানের অকাল মৃত্যুর পূর্বে বিনিদ্র রাত্রিগুলো এভাবেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছিল। তারপর সেই কালঘুম তাকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দিল, নিয়ে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে-রয়ে গেল শুধু থোকা থোকা দুঃখের মতো অসামান্য টলটলে সব কবিতা এবং সতীর্থদের বেদনামাখনো স্মৃতি এবং একখানি সুরাইয়া খানম মিথ।

304 pages, Hardcover

First published July 1, 2021

4 people are currently reading
80 people want to read

About the author

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
13 (27%)
4 stars
21 (43%)
3 stars
10 (20%)
2 stars
3 (6%)
1 star
1 (2%)
Displaying 1 - 14 of 14 reviews
Profile Image for Shotabdi.
818 reviews194 followers
September 10, 2021
বাংলা ভাষার শুদ্ধতম কবি যদি জীবনানন্দ হয়ে থাকেন, তবে পবিত্রতম কবি বোধহয় আবুল হাসান।
একজন মানুষ রক্তের প্রতি কণায়, প্রতি নিঃশ্বাসে কবিতা বয়ে বেড়ালে তবেই বোধহয় এমন আপাদমস্তক কবি হওয়া যায়।
১৯৪৭-১৯৭৫, ইতিহাসের দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়, এই কবির জীবনকাল। এই অদ্ভুত টাইমফ্রেম যেন বলে যায় এক কবি এসেছিলেন জীবনের, ইতিহাসের দুর্বিষহ ভার বইতে, আর এক দুর্গত সময়ের নীরব সাক্ষী হতে। তাই পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ এই টাইমফ্রেমটুকুতেই তাঁর বিচরণ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইল।
কেবল ২৮ বছর জীবনকাল নিয়ে আসা এই কবির জীবন এক অভূতপূর্ব মায়া আর ঘটনাপ্রবাহে ভরা। সেই সময় তিনি বেঁচে ছিলেন, যে সময়ে বাংলা সাহিত্য দেখছে একের পর এক অসাধারণ কবিদের উত্থান। কলকাতা আর আমাদের নয় তখন। ঢাকা কেন্দ্রিক সাহিত্য নতুনভাবে বিকশিত হচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আবুল হাসান এক ত্রয়ীর নাম। তবুও তরুণ কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন এই কবি।
তাঁর জীবন কিংবা এই ডকু-ফিকশন জুড়ে এসেছেন তাঁর কবি বন্ধুরা, এসেছেন আহমদ ছফা, এসেছেন মানসপুত্র কবি আবিদ আজাদ আর এসেছেন হাসানের অসংখ্য কবিতার প্রেরণাদায়ী স্বপ্নসুন্দরী সুরাইয়া খানম।
সুরাইয়া খানমই জীবনের শেষ প্রান্তে বনলতা সেন সেজে এই কবিকে দিয়েছিলেন দুদণ্ড শান্তি।
আবুল হাসানের হার্টের ব্যারাম সেই কবে থেকেই, বোহেমিয়ান জীবন যাপন করে সেটাকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে নিজেই করলেন পরিণত। কবিতা লেখা চলল এর মধ্যেও, চিকিৎসার জন্য বার্লিন যেতে হল, পরিচয় হল রাইনহার্ট বলে এক শিল্পীর সঙ্গে।
বার্লিন থেকে ফেরার পর তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত নারী, আহমদ ছফার 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' এর শামারোখ ওরফে সুরাইয়া খানমের প্রেমে মেতে উঠলেন। যেন ৪টা মাস কিশোর প্রেমিক হয়ে জীবনের শেষের আগের সুধাটুকু পান করে নিলেন প্রাণপণে।
সুরাইয়া খানম, প্রেমিকা নাকি সর্বনাশী কে বলবে! তাঁর স্বাধীনচেতা, স্বেচ্ছাচারী জীবন এবং সর্বগ্রাসী প্রেম হাসানকে ক্রমে সরিয়ে দিয়েছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু নির্মল ওরফে নির্মলেন্দু গুণের কাছ থেকে৷
তবে আবুল হাসান স্বল্পায়ু জীবনেও ভালোবাসা পেয়েছিলেন অনেক। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব ছিল না, সবচাইতে বেশি ছিল তাঁর কবিতার গুণমুগ্ধরা।
আবুল হাসানের কবিতা তেমন পড়া হয়নি আমার। কয়েকটা পড়েছি, বহুল চর্চিত যেকটি। কিন্তু মোশতাক আহমেদের এই বইটি আমাকে আবুল হাসানের কবিতাকে ভালোবাসতে শেখাল। বহু আগে সুনীল যেমন শিখিয়েছিলেন জীবনানন্দকে ভালোবাসতে, আজ আমি আবারো প্রবলভাবে গোঁত্তা খেয়ে প্রায় আমার বয়সে নীরব বিপ্লব সৃষ্টি করে অকালে চলে যাওয়া এক কবির কবিতার প্রেমে পড়লাম।
লেখককে এই কারণে কৃতজ্ঞতা।
Profile Image for Ashkin Ayub.
464 reviews228 followers
November 6, 2022



বস্তু আর ভাবকে সমন্বয় করতে পারলেই কবিতা হয়। বস্তু আর ফ্যাক্ট কি তবে এক? ফ্যাক্ট হলো কিছু পরীক্ষিত সত্যের বিন্যাস। কবিতার মধ্যে দিয়ে সত্যকে ঠিকঠাক ধরতে পারা যায় হয়ত।

তবে শব্দ দিয়ে অনুভূতির স্তরকে ছোঁয়া দুরূহ আর সেখানে অজস্র ক্লিশে অবস্থা আর অন্তরায় থাকে। শব্দ দিয়ে অনুভূতির স্তরকে সামান্য ছোঁয়া যায়। তাই সেই শব্দ শিরার ভিতর থেকে সেঁচে আনতে হয়। ফলত শব্দ হয়ে ওঠে পরম, ব্রহ্মার মতো।

আর ক্লিশে তখনই হয় যখন বাক্য শব্দ প্রধান হয়ে যায়। আমার অনেক শব্দ বলতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু আমি ভেবে দেখলাম বিষয়টা আমি দুইটা শব্দেই চাইলে বলতে পারছি। তো আমার সেই দুইটা শব্দকেই খুঁজে বের করতে হবে। ভবঘুরেদের প্রধান হিসাবে আমিও গোলাপের নিচে নিহত হতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার ক্লিশে জীবনে শব্দের ব্যবসা করতে গিয়ে কখন ভেসে গেলাম, সেটাও খুঁজে বের করতে হবে।

আবুল হাসানের জগত, যা কখনো নৃতাত্ত্বিক ও যাপনিক ক্ষেত্র থেকে বহুদুরে কিংবা এমন এক কল্পলোক। যেখানে তাঁর শৈশবের বিভ্রম নিয়ে, যা আলেয়া হয়ে আছে। নাহলে এমন সংবেদনশীল বিবর্ণতার শিখা জ্বালানোর কারন কি থাকতে পারে?

লোরকা বলেছিলেন, একজন কবি সবসময় নৈরাজ্যবাদী। কিন্তু ফ্যাসিবাদের এসব ক্রূর স্বর্ণযুগে, আবুল হাসান এইসব থেকে আশ্চর্যভাবে দূরে সরে গিয়ে যে মায়াচোখে পৃথিবীকে দেখেছেন তা অনুধাবন করতে করতে হয়তো কেটে যাবে সমস্ত জীবন।

নির্বাণ আসুক সবার প্রাণে, এই কামনায়।

Profile Image for Adham Alif.
334 reviews80 followers
April 18, 2025
"গোলাপের নিচে নিহত হে কবি কিশোর আমিও ভবঘুরেদের প্রধান ছিলাম।
জ্যোৎস্নায় ফেরা জাগুয়ার চাঁদ দাঁতে ফালা ফালা করেছে আমারও প্রেমিক হৃদয়!"

আবুল হাসানের লেখা অনেক লাইন আমার মাথায় প্রায়শই ঘুরপাক খায়। বহু মানুষের মতো তাকে নিয়ে মাতামাতি এবং আগ্রহ রয়েছে আমারও। মাত্র ২৮ বছরের স্বল্পায়ু জীবনে আবুল হাসান তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়া অগ্রন্থিত কিছু কবিতা মিলিয়ে তার কবিতার সংখ্যা একেবারে কম নয়। কিন্তু হাসানের আক্ষেপ ছিলো কারণ তিনি  আরো লেখতে চেয়েছিলেন, বেশকিছু বলার রয়ে গিয়েছিল তার। পাঠক হিসেবে তার সমস্ত কবিতা পড়ার পরও আক্ষেপ থেকে যায় আরো কয়েকটা দিন যদি তিনি বেশি বাচতেন তবে আরো কিছু মনে গেথে যাওয়ার মতো লাইন পাওয়া যেত। সেই সঙ্গে ব্যাক্তি আবুল হাসানকেও জানার ইচ্ছা তীব্র হয়। ঠিক কোন প্রেক্ষিতে তিনি আবিষ্কার করলেন মানুষ তার চিবুকের নিকটও ভীষণ অচেনা অথবা তার বাবাকে কেন চামেলী হাতে ব্যর্থ মানুষ হিসেবে ঘোষণা দিলেন? ব্যাক্তি হাসানের জগতে প্রবেশের একটা সুযোগ মনে হলো এই বই। 

বইতে কবির ছেলেবেলার কথা একেবারেই নেই বলতে গেলে। তাই জানা যায়না ঠিক কোন কোন উপাদানগুলো তাকে এ পথে উৎসাহ জুগিয়েছে। তার পাঠ্যাভ্যাস সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়না। লেখক ঘটনাগুলো শুরু করেছেন মূলত ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে। যখন মোটামুটি নিয়মিত কবিতা লেখায় ডুবে আছেন হাসান। একটা সাহিত্যিক বলয়ের মধ্যে ততোদিনে তিনি বিরাজ করেছেন। ষাটের দশকের সাহিত্যিক পরিমণ্ডল ছিলো বেশ প্রভাবশালী। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত সব চরিত্ররা তখন সাহিত্যচর্চায় ব্যস্ত ছিলেন। হাসানের সাথে তাদের পরিচয় ছিলো, নিয়মিতই নানান কারণে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। সেই হিসেবে এসব ঘটনা পড়তে গিয়ে সাহিত্যের সেই জগতে একপাক ঘুরে আসার সুযোগ মিলে যায়। বিশেষ করে নির্মলেন্দু গুণ, আহমদ ছফা, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, সুরাইয়া খানম, শামসুর রহমান, মাহমুদুল হক, রাহাত খান, শওকত ওসমান, আবিদ আজাদ সহ অনেকের দেখাই পাওয়া যায় ঘটনাচক্রে।

আবুল হাসান প্রকৃতই কবি ছিলেন। তার বাউন্ডুলে জীবনের ধ্যান-জ্ঞান সমস্তকিছু জুড়েই ছিলো কবিতা। তবে কবিতা লেখার পেছনে কোনো না কোনো ঘটনার সম্পৃক্ততা থাকে। এই বইতে সেরকম কিছু ঘটনা পাওয়া যায়। তার ব্যাক্তিজীবনের বাইরে গিয়েও ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী দেশ এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সেসবের প্রভাব তার কবিতায় পড়েছে। এজন্য তিনি লিখতে পেরেছিলেন,

"মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম;
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলোনা !
পৃথিবীতে তবু আমার মতো��� কেউ রাত জেগে
নুলো ভিখিরীর গান, দারিদ্রের এত অভিমান দেখলোনা !"

লেখক মোশতাক আহমদ এটাকে ডকু ফিকশন জনরায় ফেলেছেন। এই ডকু ফিকশন লেখার জন্য তিনি বেশকিছু বইপত্তর, পত্রিকার সাক্ষাৎকার এবং হাসানের সাথে পরিচয় ছিলো এমন লোকদের সাথে আলাপ করে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। হাসানকে জানার জন্য যেহেতু ভালো কোনো গ্রন্থ বাজারে নেই তাই এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু মুশকিল হলো সেসব তথ্য উপস্থাপনটা ঠিক জুতসই হয়নি। শাহাদুজ্জামানের "একজন কমলালেবু" এর মতো দারুণ কিছু লেখার মতো উপাদান তার হাতে ছিলো কিন্তু আফসোস মোশতাক আহমদ সেটা ডেলিভার করতে পারলেন না। তিনি ঘটনাগুলো বর্ণনা করলেন আলাদা আলাদা অধ্যায়ের মতো করে। তাতে করে ঘটনার নিরবিচ্ছিন্নতা বজায় থাকেনি, পাঠের আনন্দ কিছুটা হলেও মিয়িয়ে গেছে ওতে। বইটার আবেদনও কমে গেছে অই এক কারণে। 
প্রকৃত রেটিং দশে সাত বা পাচে সাড়ে তিন তারা।

(পেন্ডুলামের সংস্করণটা যত্ন করে বানানো। কিন্তু ওটা বাজারে আর পাওয়া যায়না। বর্তমানে বাতিঘরের সংস্করণটা সহজলভ্য। তবে পেন্ডুলামেরটার হাতে নেয়ার পর ওটা আর ভালো লাগেনা।)
Profile Image for Mehedi Hassan.
46 reviews19 followers
August 30, 2023
প্রচ্ছদে খুব ছোট করে (সুরাইয়া খানমের কাটা গলার নিচে আর নির্মলেন্দু গুণের মাথার উপরে) লেখা রয়েছে, "ডকু-ফিকশন"। বইটি পড়তে গিয়ে এই "ডকু-ফিকশন"-এর মাজেজাটা বেশ বোঝা গেল। আবার এও বুঝতে পারলাম, কেন ফিকশনের আগেই ডকু শব্দটা রয়েছে। ভাগ্যিস রয়েছে, তা না হলে এই ফিকশন যে ডাকু-ফিকশন হয়ে যেত, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
.
দেখুন, ফিকশন মানে হল প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা। কালো হরফে আঁকা কতকগুলো আঁকিবুঁকিতে একটা জীবন্ত চিত্র তৈয়ার করা। অমুক জঙ্গলে বাঘ আছে, এটা শুধুই একটা তথ্য। কিন্তু "অমুক জঙ্গলে একবার আমার দাদা কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের খপ্পরে পড়েছিল, বাঘ আমার দাদাকে কী দৌড়ানিটাই না দিয়েছিল, উফফফ..." এটা হল ফিকশন। মজাটা দেখুন, ফিকশন আপনাকে ডকুমেন্টের মতো একই তথ্য দিচ্ছে, কিন্তু একই সাথে সে আপনাকে যুক্তও করছে তার গল্পে।
.
মোশতাক আহমদের "ঝিনুক নীরবে সহো"-তে আমি ঠিক যুক্ত হতে পারলাম না। বলা বাহুল্য এ নিতান্তই আমার অপারগতা। তবে হ্যাঁ, প্রচুর তথ্য জেনেছি। কবি আবুল হাসানের জীবনকে তথ্যে তথ্যে যতটা জানানো যায়, এমনকি তাঁর শবেরও সব তথ্য জানিয়েছেন তিনি পাঠককে। কিন্তু দুঃখটা হল, আমাকে তিনি যুক্ত করতে পারেননি কবির নিঃসঙ্গতার সাথে, কবির একাকীত্বের সাথে, অভিমানের সাথে, অসহায়ত্বের সাথে, অনুরাগের সাথে, প্রেমের সাথে, পাগলামির সাথে, বিরহের সাথে। কবি কোথায় কত নম্বর রুমে কার কার সাথে ছিল, কী কী খাবার সে পছন্দ করত, ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য পরপর তুলে ধরাই যদি ডকু-ফিকশনের মূল উদ্দেশ্য হয়, তবে বলব, " ইহা একটি অতি উৎকৃষ্ট মানের ডকু-ফিকশন হইয়াছে!" কিন্তু যদি কবির জীবনকে, জীবনবোধকে, তাঁর সময়কে শব্দে শব্দে পাঠকের সাথে একাত্ম করাটাও এই লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে সেখানে বেশ কিছু নম্বর কাটা যাবে লেখক মোশতাক আহমদের।
.
বইটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, একজন লেখকের খুব ইচ্ছে হয়েছে একটা উপন্যাস লেখার, কিন্তু উপন্যাস লেখার মতো শক্তি সে ধরে না, কিন্তু সে আসলে খুব করে চায় সেই উপন্যাসটি লিখতে, আর যখন সে তা পারে না ঠিক তখনই এই ধরণের "ডকু-ফিকশন" নাম্মী আধ-খ্যাঁচড়া জিনিস বের হয়।
.
বইয়ে কবি আবুল হাসানের লেখা, হৃদয়কে আর্দ্র করার মতো বিশাল একটা চিঠি রয়েছে। পড়তে পারেন।
Profile Image for আহসানুল করিম.
Author 3 books27 followers
December 23, 2021
কবি আবুল হাসান, তাঁর প্রতিভা, তাঁর সংক্ষিপ্ত স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন, তাঁর প্রেম, সেই জীবন আর প্রেমকে ঘিরে জমে ওঠা মিথ, গুণমুগ্ধ আর ভালোবাসার মানুষদের স্মৃতিচারণ, লেখকের নিজস্ব কিছু কল্পনা - এই নিয়ে 'ঝিনুক নীরবে সহো' ডকু-ফিকশন। প্রায় উপন্যাস পড়ার আনন্দ নিয়ে পড়েছি। হয়ত এরপরে কবির কবিতাগুলো নতুন আলোয় পড়া হবে। আগে পড়া কবিতাগুলোতে খুঁজে পাবো নতুন কিছু উপলব্ধি।

পড়তে পড়তে লেখকের মত করেই কিছুটা যেন কবিকে ভালোবেসে ফেললাম।

প্রচ্ছদ ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। মুদ্রণপ্রমাদ কমই ছিল।
Profile Image for Zillur  Rahman Shohag.
46 reviews3 followers
May 29, 2022
আমার এ যাবত পড়া সবচেয়ে দূর্বল ডকু ফিকশান।
পার্সোনাল রেটিং ১.৫
Profile Image for প্রিয়াক্ষী ঘোষ.
361 reviews34 followers
August 26, 2023
" হে সুখী মানুষ, তোমরাই শুধু জানলে না
অসুখ কত ভালো
কতো চিরহরিৎ বৃক্ষের মতো শ্যামল
কত পরোপকার
কত সুন্দর "

ষাটের দশকের একজন আধুনিক কবি আবুল হাসান। পেশায় একজন সাংবাদিক হলেও মনে প্রাণে তিনি একজন কবি ছিলেন। নিজেকে কবি হিসেবে তৈরি করতে একটু সময় লাগলেও তিনি তা পেরেছে। আশ্চর্যজনক ভাবে নাম পাল্টানোর সাথে সাথে তাঁর কবিতা লেখার ধরনটাও যায় পাল্টে।আবুল হোসেন মিয়া থেকে হয়ে ওঠেন আবুল হাসান। যে নামে তিনি সাহিত্যেজগতে নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছেন।

জন্ম, বেড়ে ওঠা, জীবনের প্রতি পদে নিজের সাথে লড়াই করে একটু একটু করে তিনি আবুল হাসান হয়ে উঠেছেন। পেয়েছে বন্ধুর সাহচার্য, অবহেলা টা জীবন উপরএসে হয়তো কবিতা হয়ে উঠেছে।
২৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল, পিজি হাসপাতালের ১২০ নম্বর কেবিনে অসুস্থ কবি মৃত্যুবরণ করেন।

মোশতাম আহমদ এর " ঝিনুক নীরবে সহো " ( ডকু-ফিকশন) বইটা মূলত আবুল হাসান এর জীবনী ভিত্তিক বই। বইটাতে লেখকের জন্ম, শৈশব বা ছোট বয়সের কোন তথ্য নাই। শুরুটা কবির মৃত্যুর মূহুর্তের ঘটনা দিয়ে, তার পর পেছনে ফিরে দেখা। তবে এ ফিরে দেখাটা ঢাকায় কাটানো দিনগুলোই বেশী। বন্ধু বা কবি মহলের সাথে সখ্যতা নিজের আবাস, আশেপাশের ঘনিষ্ঠজন, দেশের পরিস্থিতি এগুলোই উঠে এসেছে। প্রথম থেকেই সমৃদ্ধ একটা জীবন যা কারোরই হয়তো থাকে না, কবিরও ছিলো না, সময়ের সাথে দুঃখ কষ্ট সহ্য করে সুন্দর সব কবিতার মাঝে নিজের সমৃদ্ধ জীবনটা রেখে গেছেন যা নিয়ে এই বই।
তথ্য বহুল একটা বই, কবির বিচিত্র জীবন ও দারুণ সব কবিতা নিয়ে, সাথে অন্য অনেক কবি লেখকের স্মৃতিতে কবির স্থান সব মিলিয়ে দারুণ এক বিষয় বস্তু নিয়ে বইটা, ঝা চকচকে প্রচ্ছদ, এমন প্রচ্ছদ দেখলে এমনিতেই মনভাল হয়ে যায়, কিন্তু

বইটা আমার ভালো লাগে নাই।
খুবই খাপছাড়া এলোমেলো লেগেছে আমার কাছে। বিক্ষিপ্ত ঘটনা গুলো এক সাথে এক সুতায় বাঁধার বদলে এলোমেলো আর বিক্ষিপ্ত ভাবেই থেকে গেছে বলে মনে হয়েছে।
Profile Image for Manzila.
166 reviews159 followers
March 25, 2025
টেনেটুনে আড়াই আসলে
Profile Image for Tareq R..
11 reviews2 followers
August 10, 2021
বাংলাদেশের কবিতাঙ্গনের সাথে আমার পরিচয় খুব ই সামান্য । এই ডকু-ফিকশন পড়তে গিয়ে একাত্তর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের কবিদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় ঘটে । এক সময়ের ব্যাপক জনপ্রিয় কবি আবুল হাসান আবার নতুন করে লাইম-লাইটে আসে এই বই এর মাধ্যমে ।

বোহেমিয়ান এই কবি খুব অল্প সময়ে তখনকার কবিদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পায় কবি হিসাবে, শুধুমাত্র স্বীকৃতই নয়, বরং তার এই ক্ষীণায়ু জীবনে সতীর্থ এবং অগ্রজ কবিদের ভালোবাসা তাকে আভিভুত করে । কবির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু নির্মলেন্দু গুণ সহ আরো অনেক কবি সম্পর্কে জানা যায় এই বই এর মাধ্যমে । তখনকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক সুরাইয়া খানমের সাথে কবির রোমাঞ্চকর প্রণয়ের কথাও আমরা জানতে পারবো এই ডকু ফিকশন থেকে ।

“এই বইয়ের প্রথম বাক্যটিই পাঠককে ডেকে নেবে বিষণ্ণ গীতল এক জগতে, যেখান থেকে পাঠক আর বেরুতে পারবেন না সমাপ্তিতে না পৌঁছে।”- এই কথাটি আমার কাছে অতি রঞ্জিত মনে হয়েছে । বই এর প্রাথমিক ভাগ কবির বোহেমিয়ান জীবন এর কথাই বার বার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, আমার কাছে মনে হয়,এই পুনরাবৃত্তি না করে বই এর পৃষ্ঠা সংখ্যা কমানো যেতো, এবং সেটা বই কে আরো আকর্ষণীয় করতো ।

বাংলা সাহিত্যের একজন নগন্য পাঠক হিসাবে নিজেকে দাবি করলেও, কবিতা জগত আমার কাছে অজানা, আর বই টি পড়ে শেষ করার পরা বাংলা কবিতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আমাকে । বাংলা সাহিত্যের একজন পাঠক হিসাবে, সবার ই বই টি পড়ে দেখা কাম্য ।

1 review
June 21, 2024
'প্রেমিকারা নয়, নাম ধরে যারা ডাকে তারা ঝিঁঝিঁ'
- (হাসানের জন্য এলিজি, নির্মলেন্দু গুণ)

কেনো কবি আবুল হাসান-কে ডাকতে হবে? কেনো শুধু ঝিঁঝিঁ নয়, বাংলা কবিতার পাঠককে; এই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঘটনাবলীর দর্শককে 'আবুল হাসান' নামক একজন কবির নাম জানাতে হবে?

কেননা, এই বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রটির জন্মের আগে ও অব্যবহিত পরের মাত্র এক দশকের মধ্যে যে কয়েকজন বিশিষ্ট কবি ঐ সময়টুকুতে কবিতার পাঠককুলকে আবিষ্ট, একই সঙ্গে মোহাচ্ছন্ন ও মোহমুক্ত করেছেন, আবুল হাসান তাদের মধ্যে বিশিষ্টতম। ইতিহাস সাক্ষী, যে ছাত্রনেতা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, যে ছাপোষা মধ্যবিত্ত নিজস্ব জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যে বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী সেই নিজস্ব 'বাঙালী জাতীয়তাবাদ' অপরের মনে বপন করেছে, যে গৃহী নিরীহ মানুষ পালিয়ে থাকতে চেয়েছে, যে গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক কাঠামোতে বেড়ে ওঠা যুবক-যুবতী সেই সময়ে একে অপরের প্রেমে বুঁদ থেকে জীবন দিতে চেয়েছে, তারা সবাই আবুল হাসান এর কবিতার পাঠক। সেই কবিকে তার অন্তরাত্মা সহ চিনে নিতে পারাটা তাই এই সময়ে বসে ঐ সময়ের পাঠ, ঠিক হাসানের কবিতা পাঠের মতো।

ষাট ও সত্তরের দশকে আমেরিকার বীট জেনারেশনের প্রভাবে কৃত্তিবাস কেন্দ্রিক কবিতা চর্চা এবং ইউরোপীয় নৈরাজ্যবাদ এর প্রভাবে 'হাংরি জেনারেশন' এর কবিতা চর্চা পশ্চিমবঙ্গে রচিত বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশ থেকে‌ আগত শরণার্থীদের ঢল, অর্থনৈতিক স্থবিরতা প্রভৃতি ঘাত প্রতিঘাতে পশ্চিমবঙ্গের কবিতার পালাবদল ঘটতে থাকে। এই সময়ের কবিগণ তিরিশের কবিদের সমালোচনা করেছেন, যে তারা পাশ্চাত্য 'সুররিয়ালিজম' কে বাংলায় আরোপিত করেছেন; যা বাংলার নিজস্ব নয়। ঠিক তেমনি ষাট ও সত্তরের পশ্চিমবঙ্গের কবিগণ ঐ সময়ের পাশ্চাত্য সাহিত্য আন্দোলনের অনেক কিছু বাংলা কবিতায় আরোপণ করেছেন। বিপরীতে পূর্ববঙ্গে ষাট দশকে ভাষা ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রভাব ও সত্তরের দশকে নতুন স্বাধীন ভূখন্ডের এক অনন্য কাব্য-ভাষা তৈরির তাগিদ কবিদেরকে বারবার তাড়িত করেছে।

কেনো আবুল হাসান এত বিশিষ্ট হয়ে যেতে পারলেন? কবির কাব্য-ভাষা গড়ে ওঠে তার জীবন যাপনের ইতিহাসে, তার ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দ-বিষাদ, প্রাপ্তি আর হতাশাকে ঘিরে। এই উপন্যাসে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো আছে- আবুল হাসান এর আনন্দ ছিলো তার পরিবার (বিশেষ করে মা ও বোন) ও বরিশাল, তার বিষাদ ছিলো চিরদুখী ও পরাধীন এই বাংলার জনগোষ্ঠীর নিঃসঙ্গ আত্মা ও চেতনা, তার একমাত্র সুখ ও মুক্তি ছিলো শুধু কবিতা লিখে যাওয়া, তার প্রাপ্তি ছিলো অন্যান্য কবিদের বন্ধুত্ব ও সহচর্য, তার হতাশা ছিলো রোগে নিঃশেষ জীবনীশক্তি ও একটি সফল প্রেমের অবশ্যম্ভাবী বিয়োগান্তক পরিণতি। এই সব নিয়েই কবি আবুল হাসানের কবিতা ও জীবন।

এই দেশের নিজস্ব যে সাহিত্যিক কাঠামো, তার প্রতিষ্ঠায় লেখকদের যে ভাষা তাত্ত্বিক ও লেখনীর অবদান, তাতে কবিদের অবদান এক অভূতপূর্ব ভুবন নির্মাণে। মহৎ কবি শুধুই শব্দ, রূপ, ছন্দ দিয়ে তার নিজস্ব ভুবন তৈরি করেন না; তার বেদনা, নিঃসঙ্গতা আর অভিজ্ঞতা পরতে পরতে মিশে যায় সেই ভুবনের পারে পারে। কবি আবুল হাসান সেইরকম এক অনন্য ভুবনে পারে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন এই দেশের জন্ম, শৈশবের নিদারুণ ঘাত- প্রতিঘাত।

আবুল হাসানের জীবনযাত্রা এই বইয়ে বিধৃত হয়েছে যে অধ্যায়গুলোর সমাহারে, তার নামকরণ অনেকটা আমাদের মহাকাব্য গুলোর মতো- একেকটা অধ্যায় মানুষ ও কবি আবুল হাসানের জীবনের একেকটা পর্ব। যেমন- অভিষেক পর্ব, উদ্বাস্তু-উন্মূল পর্ব, অগ্নি দহন পর্ব, বুনো দহন পর্ব, অমৃতের অহংকার পর্ব, কল্যাণ মাধুরী পর্ব ও পরিত্রাণ পর্ব। কবির জীবনের আখ্যান, সে তো মহাকাব্যিক হতেই পারে। কিন্তু অধ্যায়ের অন্তর্গত পরিচ্ছেদ গুলোর শিরোনাম উক্তি আর পংক্তির সমাহার - কখনো হাসানের কবিতা থেকে আবার কখনো অন্য কোনো কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃত। যেমন: স্বাধীনতার ঠিক পরের পরিচ্ছেদটির নাম: 'উদিত দুঃখের দেশ।' যেমনটা হাসান লিখেছিলেন:

"উদিত দুঃখের দেশ, হে কবিতা, হে দুধভাত তুমি ফিরে এসো।
মানুষের লোকালয়ে ললিতলোভনকান্তি কবিদের মতো তুমি বেঁচে থাকো
তুমি ফের ঘুরে ঘুরে ডাকো সুসময়!
রমণীর বুকের স্তনে আজ শিশুদের দুধ নেই প্রেমিক পুরুষ তাই দুধ আনতে গেছে দূর বনে।
শিমুল ফুলের কাছে শিশির আনতে গেছে সমস্ত সকাল!"

আবার রক্ষীবাহিনী আর লাল বাহিনীর সেইসব পাল্টাপাল্টি রাজনীতির সময়ে একটি পরিচ্ছেদের নাম: 'ফুলের মালায় বেরিয়ে আসছে অবেলায় অজগর'। হাসানের কবিতা যেমন বলছে:

"ভালো লাগছে। ফুল ও পূর্ণিমা, পুরাতন ভালোবাসা ভালো লাগছে।
মানুষ এখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে ফিরছে। মানুষকে ভালো লাগছে।
মানুষকে মারা আজ কোনো কঠিন ব্যাপার নয়; সব সহজ।"


আবার 'বুনো দহন পর্ব' অধ্যায়ের এক পরিচ্ছেদের নাম- 'ফসলবিলাসী হাওয়ার জন্য', যা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'শাশ্বতী' কবিতার এক পংক্তি। এই শিরোনামের পরিচ্ছেদে কবি পরিচয়ের বাইরে এক সাংবাদিক আবুল হাসান লিখে চলেছেন 'গণকণ্ঠ' পত্রিকার উপসম্পাদকীয়। দেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলছে, তখন এক কবির কলম থেকে বেরোনো কলাম লেখক তুলে দিচ্ছেন উপন্যাসের পাতায়, আবুল হাসান বুঝিয়ে দিচ্ছেন, আবহমান বাংলায় ধান কেনো ও কিভাবে আমাদের সবকিছু: "ধান আমাদের সচেতন মূল্যবোধ। ধান আমাদের 'যুদ্ধ নয়, শান্তি'র স্লোগান। ধান আমাদের বৈদেশিক মুদ্রাও। ধান আমাদের পবিত্র টাকা। ধান আমাদের শিক্ষা। ধান আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ। ধান আমাদের কলকারখানার উৎপাদন।"

সেই উত্তাল সময়ে যারাই কবিতা লিখেছেন, সময়ের অস্থিরতা তাদের কবিমনকে আঁকড়ে ধরেছে, যেমন: সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী। কাউকে কাউকে সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে, যেমন- শামসুর রাহমান। কেউ সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলেছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা, যেমন: আল মাহমুদ। আবুল হাসান ছিলেন রাজনীতি সচেতন এবং অবশ্যই সমাজ সচেতন। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, তার কবিতায় রাজনীতির গন্ধ নেই, বিদ্রোহের বারুদ নেই, রক্তে ঢেউ তোলা উক্তি নেই; যেমনটা আছে বন্ধু নির্মলেন্দু গুণের কবিতায়। তাহলে কি আছে হাসানের কবিতায়? কেনো তা আচ্ছন্ন করে থাকে চিত্ত? আহমদ ছফার বয়ানে লেখক বলে দিচ্ছেন: হাসানের কবিতার সেই অনন্য গুণ- এক আশ্চর্য সংবেদনশীলতা, যা আবার জলঝরনার ধ্বনির মত দ্যোতনায় তৈরি। হাসানের জীবনের যত দুঃখ- বিষাদ, যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা মিশে আছে সেইসব ধ্বনির সাথে। পাঠমাত্র পাঠকের স্নায়ুতে সংবেদনের আবেদন রেখে যায়। দৈনন্দিন কাজের ভীড়ে আর জাতীয় জীবনের ঘনঘটায় নিমগ্ন পাঠক ফিরে ফিরে আসে সেই অনুভূতির সংবেদনশীলতার কাছে। তাই বলে কি হাস���নের কবিতায় সমাজ-বাস্তবতা নেই? চন্দ্রবিজয়ী অ্যাপোলো-১১ এর নভোযাত্রী নীল আর্মস্ট্রং ঢাকায় এলেন। হাসানের কবিতায় লেখা:

"মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা,
.......
মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামলো না।"
(জন্মমৃত্যু জীবনযাপন, আবুল হাসান)

যে হাসান নিরন্তর সাধনার দ্বারা শুধু কবি হতে চেয়েছিলেন, আর কিছুই নয়; পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে করতে স্বাধীনতার পরের অস্থির নৈরাজ্যকর সময়ে তিনি লিখেছেন:

"আমার চোয়ালে রক্ত হে অর্জুন আমি জানতাম, আমি ঠিকই জানতাম
আমি শিশু হত্যা থামাতে পারবো না, যুবতী হত্যাও নয়!
ভ্রণহত্যা! সেতো আরও সাঙ্ঘাতিক, আমি জানতাম হে অর্জুন
মানুষ জন্ম চায় না, মানুষের মৃত্যুই আজ ধ্রুব!
আমার নাভিতে রক্ত আমি জানতাম আমি ঠিকই জানতাম
আমি মানুষের এই রোষ থামাতে পারব না, উন্মত্ততা থামাতে পারবো না।"
দুর্ভিক্ষ ও রাষ্ট্রবিপ্লব আমি থামাতে পারবো না!
চালের আড়ত থেকে অভিনব চাল চুরি থামাতে পারবো না,
রিলিফের কাপড়ে আমি মানুষের অধঃপতন ঢাকতে পারবো না!"
(কুরুক্ষেত্রে আলাপ, আবুল হাসান)

ইতিহাস সচেতন পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না, এখানে কুরুক্ষেত্র কোথায় আর কৃষ্ণই বা কে?

জীবনানন্দ যেমন তিরিশের কবি হয়েও বাকি সবার থেকে আলাদা, আবুল হাসান ও তার প্রজন্মের অন্যদের থেকে পৃথক। জীবনানন্দের সাথে হাসানের মিল শুধু বরিশালে। জীবনানন্দের কবিতায় নদীবিধৌত এই ব-দ্বীপের প্রকৃতি, প্রাণী, পাখি, মানুষ ও তার ম্লান নাগরিক সংকট যেভাবে বিশেষ হয়ে উঠেছে, তার পিছনে বরিশালের একটি বড় অবদান আছে। আবুল হাসানের কবিতা খুব একটা প্রকৃতি ও বোধ কেন্দ্রিক নয়, বরং ব্যক্তিমানুষের নিজস্ব অনুভূতি ও আর্তির চারপাশে ঘুরে ঘুরে ফেরে। কবি হিসেবে কাটানো জীবনের প্রায় পুরোটাই মহানগর হয়ে ওঠা ঢাকা কেন্দ্রিক হলেও হাসানের মন থেকে বরিশাল হারিয়ে যায় নি। জীবনের অন্তে এসে পূর্ব জার্মানিতে বসে ভিনদেশী বন্ধু রাইনহার্টকে আবুল হাসান বলছেন:
"বার্লিনে আমি বরিশাল দেখি, আর কিছু নয়। ....
আসলে আমি যা তা ওই বরিশাল। ....
আমি যদি ক্ষীণমাত্র কবি হই- তা হলে তা ওই বরিশালের বেদনার্ত আশীর্বাদের দরুণ। .....
জীবনানন্দ কি কবি হতেন যদি ওই শহর তার জন্মভূমি না হতো? যার কৈশোরের ও যৌবনের পাদপীঠ? আমার তো বিশ্বাসই হয় না।" আক্ষেপ ফুটে ওঠে: "বরিশাল যদি বুকভরা উপার্জন হয় তা হলে ঢাকা আমার সেই উপার্জনের সব কেড়ে নেওয়া বেতাল বদমাশ।"

জীবনান্তে এরকম বেদনার্ত অনুভূতি প্রকাশ করলেও এই ঢাকাতেই কবি হাসানের উদ্ভব, উত্থান, খ্যাতি প্রতিষ্ঠা আর মানুষ হাসানের প্রেম, বিরহ, বেদনা, রোগ এবং মৃত্যু। আর এই ঢাকার রাজপথ, অলি-গলি, মদের দোকান, বইমেলা, পত্রিকা অফিস, প্রেস, ক্যান্টিন সাক্ষী হয়ে আছে এক অদ্ভুত বন্ধুত্বের: আবুল-নির্মল।

দুইজনের বাড়ি আলাদা, ধর্ম আলাদা, চিন্তার ধারা আলাদা, কবিতার ভাষা আলাদা- তবুও হরিহর আত্মা আবুল হাসান ও নির্মলেন্দু গুণ পুরো উপন্যাস জুড়ে আছেন বন্ধুত্বে, দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র্য ভাগাভাগিতে, মনোমালিন্যে, অভিমানে। সুনীল-শক্তির বিখ্যাত বোহেমিয়ান জীবনের সাথে তুলনায় দাঁড় করিয়ে নগর ঢাকার প্রেক্ষাপটে লেখক রচনা করেছেন আবুল-নির্মল গাঁথা। সব আন্দোলন- সংগ্রামের, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কেন্দ্র ঢাকা সাক্ষী হয়ে রইছে দুই কবিবন্ধুর দুর্বিনীত জীবন যাপনে, স্পর্ধায়। নির্মল ছুটে যাচ্ছেন জনসভা থেকে পথসভায়, পুলিশের তাড়ায় ফেরার হয়ে পড়ছেন। আবুল তখন আশ্রয় নিচ্ছেন অন্য এক কবিবন্ধুর বাসায়। হার্টের রোগী আবুল হাসপাতালে ভর্তি হলে নির্মল চলে আসছেন বন্ধুর কাছে, আবার নির্মলের বোন (তারও হার্টের সমস্যা) হাসপাতালে ছুটে আসছেন আবুল- সে তো তারও বোন। এর মধ্যে কবিতা নিয়ে হচ্ছে ঝগড়া, বাতিল করছেন একে অপরের কবিতা, অভিমানে একে-অপরকে উৎসর্গ করছেন না নিজের কবিতার বই। সুদূর পূর্ব জার্মানিতে আবুলের মুখ থেকে নির্মলের কথা শুনতে শুনতে আরেক অভিন্ন হৃদয় বন্ধু রাইনহার্ট আর্তুর-ভেলেনের সাথে তুলনা করে নামকরণ করলেন: আবুল-নির্মল। আবুল হাসান উত্তর দেন: "হ্যাঁ, ধ্বনিগত মিল থাকলেও ওদের নরক আর আমাদের নরক ভিন্নতর।" আবুল হাসানের বিখ্যাত প্রেমের ফলে দুজনের বন্ধুত্বে ভাটা পড়ে। সুরাইয়া সহ্য করতে পারেন না নির্মলকে, যতবার দেখা হতে যায়, কিছুটা জোর করে সরিয়ে নিয়ে যান আবুলকে নির্মল থেকে দূরে। নির্মলকে লেখা শেষ চিঠি লেখক তুলে দিয়েছেন এই উপন্যাসে কোনো কাটছাঁট না করেই। অভিমানী আবুল হাসানের কলম থেকে যেনো বা বেরিয়ে আসছে এক পরম সত্য: "আর একমাত্র পুরুষ এবং একজন পুরুষই ভালোবাসার স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পারে- কারণ রমণীরা অতি নশ্বর- কিন্তু সেই নশ্বরতার বেদনাবোধ কেবল কবি পুরুষেরাই একমাত্র গ্রহণ করতে পারে।"

আবুল হাসানের জীবনের আরেক উল্লেখযোগ্য বন্ধু পূর্ব জার্মানির শিল্পী রাইনহার্ট হেভিকে। তাদের বন্ধুত্ব ও চিঠিপত্র নিয়ে আরো একটি বই প্রকাশিত হলেও কবির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বন্ধু বলে উপন্যাসের একটি পুরো অধ্যায় পূর্ব জার্মানি আর রাইনহার্ট কে নিয়ে। জীবদ্দশায় দূরতম এক দরিদ্র দেশের কবিবন্ধুকে রাইনহার্ট যে কখনো ভোলেননি, তার প্রমাণে শিল্পীর আঁকা কবির স্কেচ, জার্মান ভাষায় কবির অনূদিত কবিতার বই-এর কভার সহ আরো সব দুর্লভ ছবি রয়েছে এই অধ্যায়ের পাতায় পাতায়। দুই বন্ধুর কথোপকথনের ছলে লেখক দুই শিল্পী মননের অন্তরাত্মা উন্মোচন করেছেন। রাইনহার্টের সাথে আড্ডার ফাঁকে যখন হাসান বলছেন- "জীবনে ও যৌবনে মানুষের যা শ্রেয় এবং প্রেয় তা হলো দীর্ঘশ্বাসের দীর্ঘতম বেদনাবোধ"; তখন এই হিরন্ময় উক্তি হাসানের কবি জীবনের সমস্ত সৃষ্টির জ্বালামুখ হিসেবে রয়ে যায়- এই বইয়ের পৃষ্ঠায়।

আবুল হাসান- সুরাইয়া প্রেমকাহিনী সত্তরের দশকে বাংলাদেশের সাহিত্য পরিমন্ডলে বহুল চর্চিত এবং আলোচিত প্রেমকাহিনী। সাহিত্য- সিনেমার মতো দ্রোহী ও বাঁধভাঙা প্রেমের জোয়ারে ভেসেছেন এবং আশপাশের মানুষকেও ঈর্ষাকাতর বানে ভাসিয়েছেন এই দুইজন। এই প্রেমকাহিনী উপজীব্য করে রচিত হয়েছে দুইটি উপন্যাস- একটির লেখক আহমদ ছফা, আরেকটি লিখেছেন দিলারা হাশেম (যিনি সম্পর্কে সুরাইয়ার বড় বোন)। ছফা রচিত 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' যদি প্রতিনায়ক ও প্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক আহমদ ছফার দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়, দিলারা হাশেমের উপন্যাস 'আমলকির মৌ' হয়তো অনেকটাই সুরাইয়ার মানসপট থেকে লেখা। এই উপন্যাসে লেখক আবুল হাসানের চোখ দিয়ে দেখতে চেয়েছেন এই প্রেমের উত্থান ও পরিণতি। একটি অসুস্থ ও বেদনার্ত হৃদয় নিয়ে মানুষ আবুল হাসান একরাশ মুগ্ধতা ও ভক্তি নিয়ে আর্তি জানিয়েছেন সুরাইয়ার হৃদয়ের কাছে, সেই 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী' হৃদয়ের আশ্রয়ে কবি আবুল হাসান উন্মোচিত হয়েছেন হাজারো পাঠকের কাছে, অনন্য সব প্রেমের কবিতা হয়ে।

"অতবড় চোখ নিয়ে, অতবড় খোঁপা নিয়ে
অতবড় দীর্ঘশ্বাস বুকের নিঃশ্বাস নিয়ে
যত তুমি মেলে দাও কোমরের কোমল সারস....."
(প্রেমিকের প্রতিদ্বন্দ্বী, আবুল হাসান)

লেখক ঐ সময়ের অন্য আরো কুশীলব দের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন তথ্য, আবিষ্কার করেছেন কাউকে উপহার দেওয়া কবিতা, খনন করেছেন দুজনের সম্পর্ক কবিতার চরণ থেকে চরণে। লেখক দেখিয়েছেন কিভাবে এই প্রেম কবি হিসেবে আবুল হাসানকে দিয়েছে পরিপূর্ণতা, সফলতা; মানুষ হিসেবে একই সাথে দিয়েছে দহন ও শান্তি; বন্ধু হিসেবে করে দিয়েছে নিঃসঙ্গ। হাসানের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুরাইয়া এই অসুস্থ, বিষণ্ন হৃদয়ের শুশ্রূষা করেছেন।

হাসানের শেষ কয়েকটা দিন, পিজি হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়ের খুব বিশ্বস্ত চিত্র ফুটে উঠেছে শেষ কয়েকটি পরিচ্ছেদে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসা একটি অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু কিভাবে অপেক্ষায় রাখে এক কবিকে, কিভাবে শোকের দেয়াল তুলতে থাকে মা-বোন-প্রেমিকা-বন্ধুর কাছে, তা ফুটিয়ে তুলতে শেষের দিকে লেখা কবিতা গুলো একের পর এক তুলে দিয়েছেন:

"বনভূমিকে বলো, বনভূমি, অইখানে একটি মানুষ
লম্বালম্বি শুয়ে আছে, অসুস্থ মানুষ
হেম���্তে হলুদ পাতা যেরকম ঝরে যায়,
ও এখন সেরকম ঝরে যাবে, ওর চুল, ওর চোখ
ওর নখ, অমল আঙ্গুল সব ঝরে যাবে,
......
ও এখন মাটি হতে চায়, শুধু মাটি
চকের গুঁড়ার মতো ঘরে ফিরে যেতে চায়,
বনভূমিকে বলো, বনভূমি ওকে আর শুইয়ে রেখো না!"
(বনভূমিকে বলো, আবুল হাসান)

কবি আবুল হাসান এর কোনো আনুষ্ঠানিক জীবনী গ্রন্থ নেই। এই উপন্যাস সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারবে কিনা তা পাঠক ও সময় ই বলে দেবে। এই উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে কয়েকটি বিষয় খুব স্পষ্ট- কবি আবুল হাসানের কবিতার প্রতি লেখকের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও কবির ঘটনাবহুল জীবনের প্রায় প্রতিটি পর্বের অসংখ্য উপাদান খনন করে তুলে আনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর মতো আবুল হাসান এরও অভ্যাস ছিলো, যত্রতত্র যেকোনো পাঠক, সম্পাদক, বন্ধুদের অনুরোধে চিরকুটের মতো ছোট ছোট কাগজে কবিতা লিখে উপহার দেবার। লেখক এরকম অনেক কবিতা উদ্ধার করেছেন, কবিতার ভাব ও ভাষার সাথে মিলিয়ে বিভিন্ন অধ্যায়ে ও পরিচ্ছেদে সন্নিবেশ করেছেন। বন্ধু, অগ্রজ সাহাত্যিকদের কাছে লেখা বেশ কিছু চিঠি রয়েছে এই উপন্যাসে, তার মধ্যে জীবনের শেষ প্রান্তে বার্লিন থেকে বন্ধু মাহফুজ কে লেখা একটি দীর্ঘ চিঠি এবং বন্ধু নির্মলেন্দু গুণ কে লেখা আরেকটি চিঠি কবি আবুল হাসানের নিঃসঙ্গ মনন ও চেতনার একাকীত্বের এক গভীর প্রতিফলন। লেখক অবিকল চিঠি দুটি তুলে দিয়ে পাঠককে হাসানের আত্মার আকুতি বোঝাতে পেরেছেন। এই সব কিছু নিয়েই, এই টেক্সটি যতটা না প্রকৃতার্থে উপন্যাস, তার চেয়েও বেশি ডকু-ফিকশন।

কবি আবুল হাসানের কবিতা পাঠে আমাদের মধ্যে ভালোবাসা নতুন করে জন্ম নিক। আর এই উপন্যাস পাঠে তাকে, অর্থাৎ তার নিঃসঙ্গ, ব্যথাতুর অন্তরাত্মাকে ধরা-ছোঁয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তা আরো তীব্র হোক।

"ভালোবেসে যারে ছুঁই, সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে।"
-(হাসানের জন্য এলিজি, নির্মলেন্দু গুণ)
Profile Image for Zahidul Islam Sobuz.
94 reviews3 followers
August 28, 2022
অনেক হাইপ আর সরল গদ্য দেখে নিয়েছিলাম। কিন্তু পড়ার পর মনে হয়েছে এত দুর্বল লেখা তো জীবনে কমই পড়া হয়। হাইপের পেছনে আর দৌড়ানো যাবে না বোঝলাম।
Profile Image for Jobayer Rahman.
51 reviews21 followers
May 23, 2025
এই বইয়ের সূচনাই পাঠককে টেনে নেয় এক সুরভিত বিষণ্ণ জগতে, যেখান থেকে তারা বেরোতে পারবেন না যতক্ষণ না শেষ পাতাটি উল্টে যায়। বিশেষ করে যদি পাঠক নিজেই হন এক রকম কবিতার নেশায় বিভোর, এক রোমান্টিক বিষণ্ণতার মধ্যে আটকে থাকা মানুষ যার যাপন আর কাব্যের মাঝে কোনো সেতু মিলছে না তবে তার জন্য এই বই হয়ে উঠবে এক ধরনের জাদুময় মোহ। একইসঙ্গে, যাদের জীবনে শিল্প-সাহিত্য বা সংস্কৃতির সামান্যতম ছোঁয়াও রয়েছে, তারাও এই বইয়ে খুঁজে পাবেন নিজেদের চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি। কারণ, এই ডকু-ফিকশন কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এমন একজন কবিকে, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার সবচেয়ে সংবেদনশীল, স্বপ্নভেজা অথচ অল্পজীবনের এক উজ্জ্বল মুখ আবুল হাসান।

বিশ্বসাহিত্যে স্বল্পায়ু হয়েও তীব্র প্রভাব ফেলেছেন এমন কবি-সাহিত্যিকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আমরা তো হরহামেশাই কীটস বা কাফকার নাম নিই; আবার নিজেদের ভাষাতেও স্মরণ করি কবিকিশোর সুকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা কথাসাহিত্যিক সোমেন চন্দকে। আবুল হাসানও বাংলা কবিতার অনুরাগীদের অনেকের মনে সেই তালিকার একজন হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর কবিজীবন নিয়ে বিশদ আলোচনা খুব বেশি দেখা যায় না। অথচ, তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনটা যে একেবারে কবিতার জন্যই নিবেদিত ছিল এই তথ্য অনেকের কাছেই অজানা রয়ে গেছে।

এত অল্প বয়সে কবিতায় এমন সিদ্ধিলাভ, সমসাময়িক পাঠকের কাছে নিজের লেখা একান্ত অনিবার্য হয়ে ওঠা, এবং সমকালের প্রবীণ কবিদের কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ স্বীকৃতি পাওয়া এসব গুণাবলীর একত্র উপস্থিতি আবুল হাসানের বাইরে আর কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। এমন অর্জন তো আনন্দের হওয়ার কথা। কিন্তু এই ডকু-ফিকশনের পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে আমরা টের পাই, এই কবিকে চলে যেতে হয়েছে অপার অতৃপ্তির হাহাকার নিয়ে।

কারণ, মৃত্যুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনিও জানতেন বাংলা কবিতার ভুবনকে তিনি দিতে পারতেন আরও অনেক কিছু। অনেক নতুন রঙ, নতুন ধ্বনি, নতুন সৌরসুর খুঁজে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। এবং সেই চাওয়া ধরা আছে তাঁরই কবিতার পঙক্তিতে,

'আনবো অঢেল উষ্ণ মহাকাল, বসন্ত বৈকাল,
উড়ু উড়ু সমুদ্রের হাওয়া,
বৈদেশিক বাণিজ্যে টাওয়ার বাক্সে টোকা দিয়ে
আনবো আলোর নতি, নীল মুদ্রা, মৈত্রী ও বসতি।'

বরিশালের ঝনঝনিয়া গ্রামের এক তরুণ ১৯৬৫ সালে প্রথমবার পা রাখে ঢাকায়। নামমাত্র কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়া। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ভর্তি হয়েছিল, তবে ডিগ্রির পিছু নেয়নি। কারণ, তার ঢাকায় আসার আসল উদ্দেশ্য ছিল অন্য সে চেয়েছিল কবি হতে।

শৈশবে সে ছিল একজন কোরআনে হাফেজ। পরবর্তীতে ধর্মাচরণ থেকে সরে এলেও তেলাওয়াতের সুর তার মধ্যে গেঁথে ছিল অমোচনীয়ভাবে। ফলে সুরের প্রতি ছিল তার এক গভীর আকর্ষণ আবেগের, অনুভবের, এবং আত্মিক সংযোগের জায়গা থেকে। সেই আকর্ষণই কি তার কবিতাকে করে তুলেছিল এমন সুরময়, এমন কাব্যিক? সেই কিশোর, যে একসময় পরিচিত ছিল আবুল হোসেন মিয়া নামে, ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছিল কবি আবুল হাসানে।

প্রথম কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন ‘আবুল হোসেন’ নামে। কবিতাটি হাতে পেয়ে শামসুর রাহমান পাঠ করলেন, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ধন্দে পড়ে গেলেন এই ভাষা, এই কাব্যভঙ্গি তো মেলেই না ‘নববসন্ত’-এর কবি আবুল হোসেনের সাথে! দেখা হলে একটু বিদ্রুপের সুরেই প্রশ্ন করেছিলেন পূর্বসূরি কবিদের না জেনে শুনে কি কবিতা লেখা যায়?

আসলেই, ‘আবুল হোসেন’ নামটি তখনও বাংলাদেশের কবিতাক্ষেত্রে এক প্রতিষ্ঠিত পরিচিতি, যিনি আজও নিজের শক্তিময় কাব্যভাষা নিয়ে সক্রিয়। সেই একই নামে আরেকজন কবি লেখা চালিয়ে গেলে পাঠকের মনে বিভ্রান্তি ঘটবেই।

সমাধানটা এল রফিক আজাদের কাছ থেকে। তিনিই নতুন করে নাম রাখলেন ‘আবুল হাসান’।
আর সেই নামের আড়ালেই জন্ম নিল এক অননুকরণীয় কাব্যস্বরের। তারপর যেন থেমে থাকেনি কিছুই অসংখ্য কবিতা ঝরে পড়তে লাগল অবিরাম, অজস্র শব্দে গড়ে উঠল এক ব্যক্তিগত বিষণ্ণতা ও তীব্র অনুভবের জগৎ। চারপাশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম, তাঁর কবিতার সম্মোহনী শক্তি।

অল্পদিনেই কোরআনের হাফেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হয়ে উঠলেন বোহেমিয়ান, উড়নচণ্ডী, ধূমপায়ী, মদ্যপায়ী, বেশ্যাগমনকারী। কেন এই রূপান্তর? কেউ হয়তো বুঝিয়েছিল, কবি হতে হলে এমনটাই হতে হয়। জীবনের ধারাটিকে এইভাবেই প্রবাহিত করতে হয়। [যার বা যাদের প্ররোচনায় এইভাবে জীবনের খাতটিকে অপচয়ের দিকে ধাবিত করলেন, হাসানের অকাল মৃত্যুর জন্য সে বা তারাই দায়ী। কৈশোরে বাতজ্বর বা রিউম্যাটিক ফিভারে আক্রান্ত হাসানের পূর্ণ চিকিৎসা হয়নি। তার হৃদযন্ত্রে, বিশেষ করে হার্টের ভাল্বগুলোতে জটিল রোগ সৃষ্টি হবার আশঙ্কা থেকেই গিয়েছিল। তার জীবনযাপন, নেশা, খাবারে অনিয়ম, ঠিকই সেই মৃত্যুবান নিক্ষেপ করেছিল হাসানের হৃদপিণ্ডে। তাতেই তার মৃত্যু ১৯৭৫ সালে। যদিও আবুল হাসান কাউকে দায়ী করে যাননি।]

কবি হবার জন্য সবকিছু করেছেন হাসান। কলেজজীবনে বরিশালের প্রেমিকা রাজিয়া সুলতানা রাজিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। একবারও দেখা করেননি। কোনো উত্তর লেখেননি রাজিয়ার চিঠির। কবিতা ছাড়া অন্য কোনো প্রেমিকা চাই না তার। নির্মলেন্দু গুণের সাথে একরাতে গিয়েছিলেন ইংলিশ রোডের শুঁড়িখানায়। সেখানে গুণ বললেন 'তোমার লাইফ পোয়েট্রি। আমার লাইফও পোয়েট্রি। কিন্তু রাজিয়ার লাইফ জিওমেট্রি। পোয়েট্রি এন্ড জিওমেট্রি নেভার লিভ টুগেদার।' হাসানেরও পূর্ণ সম্মতি– 'পোয়��ট্রি এন্ড জিওমেট্রি নেভার লিভ টুগেদার। চিয়ার্স।'
পরবর্তীতে নিজেকে বা সেই প্রেমিকাকে সান্তনা দিতেই কি লেখেন?:
'এই কবিতা তোমার মতো সহজ থাকুক সুশিক্ষিতা
এর গায়ে থাক রাত্রি জাগার একটু নাহয় ক্লান্তি হলুদ,
জিভ দিয়ে জিভ ছোঁয়া চুমুর গন্ধ থাকুক এই কবিতায়।'
নির্মলেন্দু গুণ ময়মনসিংহের বারহাট্টা থেকে পাকাপাকি ঢাকায় চলে এলে শুরু হয়েছিল দুই কবির বন্ধুত্বের এক আশ্চর্য অধ্যায়। তারা একসাথে দিন কাটান। রাত কাটান কমলাপুর রেলস্টেশনে, সদরঘাটের কোনো নৌকায়, রমনা পার্কে। রাতে রাস্তায় চলতে চলতে কোনো কবি বা লেখকের ডেরা চিনতে পারলে সটান ঢুকে পড়েন সেই বাড়িতে বা মেসে– আজ আমরা রাতে এখানেই থাকব।
রাহাত খান লিখেছিলেন– 'এই তরুণ কবিদ্বয় ঢাকা শহরের কখন কোথায় থাকেন, কখন কী খান, তারা নিজেরাও তা জানেন না। তাদের জন্য ঢাকা শহরের অনেক বাসাতেই রান্না হয়। অনেক সময় ইটের বালিশে মাথা পেতে তারা পথের পাশে, রেলস্টেশনে, মসজিদে রাত কাটান। ওরা মনে করেন ইটের বালিশে ঘুমালে কবিদের মাথা শক্ত হয়।'
শুঁড়িখানাতে বসেই দু'জনে লিখলেন 'বোহেমিয়ান কবির সংবিধান'। তাতে লেখা ছিল–
"আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে পড়ব, ক্লাস করব, ঘুরব-বেড়াব, কিন্তু ডিগ্রি লাভের চেষ্টা করব না পরীক্ষা দেব না বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরী মেয়েদের সাথে প্রেম করার চেষ্টা করব বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারব।
সতীর্থ হিসাবে যে বন্ধু-মহলটি গড়ে উঠবে, আমাদের অন্ন-বস্ত্র এবং বাসস্থানের অভাব পূরণ করার জন্যে তাকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় নাম লেখাতে বিনিয়োগকৃত টাকা উসুল করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা ব্যবহার করব, আমাদের কবিতা রচনা, প্রকাশ ও প্রচারের জন্য। যেহেতু আমরা উপার্জনমুখী বিদ্যা আয়ত্ত করছি না, সেহেতু আমাদের জীবন হবে অনেকটাই পরনির্ভর, বন্ধু-নির্ভর, ভক্ত-নির্ভর, পৃষ্ঠপোষক-নির্ভর।"
এই সংবিধান মেনেই কি হাসান যখন যাকে সামনে পেতেন হাত পাততেন তার কাছে? সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কামাল বিন মাহতাব, রাহাত খান, আহমদ ছফার কাছে? আহমদ ছফা নিজেরই নিয়মিত উপার্জনের কোনো পথ ছিল না। তার প্রথম উপন্যাস ছাপা হবে। প্রকাশকের কাছ থেকে অগ্রিম দেড় হাজার টাকা নিয়ে এসেছেন। রাতে শশাঙ্ক পালের সাথে তার ঘরে উপস্থিত আবুল হাসান। ভার্সিটির পরীক্ষার ফি দিতে না পারায় পরীক্ষা দিতে পারবেন না। নাম কাটা গেছে পরীক্ষার্থীর তালিকা থেকে। ছফা তৎক্ষণাৎ দিয়ে দিলেন সাড়ে তিনশো টাকা। বললেন যে অর্থাভাবে তারও ইউনিভার্সিটি থেকে নাম কাটা পড়েছিল বলে প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষা দিচ্ছেন। তিনি চান না হাসানকেও তার ভাগ্য বরণ করতে হোক। দুইদিন পরে আবার হাসান উপস্থিত। আরো একশো টাকা লাগবে। সেমিস্টার ফি দিতে হবে। নইলে পরীক্ষায় বসতে দেবে না। ছফা এবারও টাকা দিলেন। কিন্তু হাসান পরীক্ষা দিলেন না। লিখলেন কবিতা–
'ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেপ সমস্ত কাগজ।
আমি বাজে ছেলে, আমি লাস্ট বেঞ্চ, আমি পারবো না!
ক্ষমা করবেন বৃক্ষ, আপনার শাখায় আমি সত্য পাখি বসাতে পারবো না!'
এতকিছুর পরেও সবাই হাসানকে ভালোবাসতেন। কারণ আর কিছুই না। হাসানের কবিতার অজস্রতা আর অনন্যতা। নিউ মার্কেটের নলেজ হোমে পেঙ্গুইন সিরিজের ইংরেজি কবিতার বই দেখতে দেখতে অন্যমনস্কতার ভঙ্গি করে বই হাতে হাসান বেরিয়ে গেলে বিব্রত জাহিদুল হক গেলেন বইয়ের দাম দিতে। মালিক মজলিশ সাহেব হেসে বললেন– আপনারাও আগে আবুল হাসানের মতো কবিতা লিখুন। তারপরে অন্যমনস্কতার ভঙ্গি করে বই হাতে বেরিয়ে গেলে আপনাদেরও কিছু বলব না।

মালিটোলার গণিকাপল্লী উচ্ছেদ করা হচ্ছে। গঠিত হয়েছে উচ্ছেদ কমিটি। তারা সভা-সমিতি করে বেড়াচ্ছে। আবুল হাসান প্রস্তাব করলেন এই উচ্ছেদের প্রতিবাদে সেখানে গিয়ে সাহিত্যসভা করার। হাসানের সাথে যোগ দিলেন শশাঙ্ক পাল, ভুঁইয়া ইকবাল, আবু বাকার, আলী ইমাম, শামসুদ্দিন আসালত, শাহযাদ ফিরদাউস, বুলবুল চৌধুরীসহ আরো কয়েকজন। সেখানে কবিতাপাঠ হলো, গান হলো, গণিকাদের অধিকারের কথা উচ্চারিত হলো। তাদের সাথে যোগ দিয়ে গান গাইলেন যৌনকর্মীরাও। লেখক-কবিদের এই সংহতি এই ভালোবাসা এই মানবিকবোধ চোখে জল এনে দিয়েছে যৌনকর্মীদের। অনুষ্ঠান শেষে তারা সাধ্যমতো আপ্যায়ন করল কবিদের।
বাংলাদেশের কবিদের এমন অভিনব সাহিত্যসভা আগেও কখনো হয়নি। পরেও না।
হাসান যৌনবর্মীদের দেখতেন কবিসুলভ মমতার দৃষ্টিতেই। একটি চিঠিতে লিখেছিলেন– 'আমি বেশ্যালয়ে গমন করেছি হয়তো– তাদের স্তন স্পর্শ করেছি– চুমো খেয়েছি কিন্তু মমতায়; আমি পাপ করিনি তাদের সাথে'।
হাসান কখনো মিছিলে যাননি। ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের সময়ও না। আড্ডা দিতে দিতে নির্মলেন্দু গুণ উঠে গিয়ে মিছিলে যোগ দিতেন। রাজনীতি নিয়ে হাসানের আগ্রহ নেই। কিন্তু স্বাধীকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে তো কোনো প্রকৃত কবি নীরব থাকতে পারেন না। হাসানও সেই সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন তার মতো করেই। কবিতা তো লিখেছেনই, সেইসাথে বিভিন্ন পত্রিকায় জোরালো কলাম লিখেছেন বাঙালির ন্যায্য অধিকারের সপক্ষে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা। কিন্তু ১৯৭৩-৭৪ এর মাৎসন্যায় এবং দুর্ভিক্ষ বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতে বাধ্য করেছিল তাকে। সত্য বটে, সেই সময় জাসদ, সর্বহারা পার্টি, নকশালপন্থী বিভিন্ন গ্রুপ দেশজুড়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছিল। তবে একই সাথে আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, পারমিটবাজি, নেতাদের অযোগ্যতা, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার মিলে মানুষকে দুঃসহ অবস্থায় নিপতিত করেছিল। ছাত্রলীগের সমালোচনা করায় সেই সময়ের আরেক বোহেমিয়ান কবি গোলাম সাবদার সিদ্দিকীকে বিচারের সম্মুখীন করেছিল ছাত্রনেতারা। অনেকের অনুরোধে লঘু শাস্তি পেয়েছিলেন সাবদার সিদ্দিকীকে। তা হচ্ছে কবিকে শাহবাগে প্রকাশ্যে নগ্ন দাঁড় করিয়ে রাখা। দুর্ভিক্ষের সময়েও অভুক্তদের লঙ্গরখানা থেকে চালচুরির ঘটনা ঘটছিল অহরহ। সহ্য করতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধা, মুজিবের অন্ধভক্ত, কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন– 'ভাত দে হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো'। সেজন্য তাকে বিপদে পড়তে হয়েছিল।
আবুল হাসান পরোক্ষে বঙ্গবন্ধুকে ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে অভিহিত করে লিখেছিলেন কবিতা–
'হে অর্জুন আমি জানতাম, আমি ঠিকই জানতাম
আমি শিশুহত্যা থামাতে পারবো না, যুবতী হত্যাও নয়

চালের আড়ত থেকে অভিনব চালচুরি থামাতে পারবো না
রিলিফের কাপড়ে আমি মানুষের অধঃপতন ঢাকতে পারবো না

ভাই পলায়নে যাবে, বোন তার বাসনা হারাবে আমি জানতাম
ফুল ফুটবে না, ফুল ফুটবে না, ফুল আর ফুটবে না, ফুল আর কখনো ফুটবে না।
বকুল বৃক্ষদের এইভাবে খুন করা হবে সব গীতিকার পাখিদের
এইভাবে গলা, ডানা, স্বরলিপি শব্দের পালকগুলি
ভেঙে দেওয়া হবে, আমি জানতাম।'
কোনোদিন রাজনীতিতে নাম না লেখানো আবুল হাসান ১৯৭৫ সালে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। অবশ্য সুরাইয়া খানমের প্ররোচনায়। সেই সময়টিতে সুরাইয়া খানমের কোনো কথা ফেলে দেওয়া হাসানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আবুল হাসান-সুরাইয়া খানম আখ্যান ছিল সেই সময়ের আলোচিত ঘটনা।
সুরাইয়া পরমাসুন্দরী, বিদুষী, পোশাকে-আসাকে ব্যতিক্রমী উজ্জ্বল, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে এসেছেন, ঢাবা ভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক, কবিতা লেখেন ইংরেজি ও বাংলায়, পছন্দের বাংলা কবিতা অনুবাদ করেন ইংরেজিতে, মেশেন শিল্পসাহিত্য জগতের সব কেউকেটার সাথে, তবে কেউ মাত্রা ছাড়ালেই অপমান করেন তাকে, এমনকী পায়ের জুতা খুলে মারেন– সবমিলিয়ে সুরাইয়া সর্বত্র আলোচিত এক নাম।
সুরাইয়া আবুল হাসা���ের কবিতার ভক্ত। হাসানের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটিয়ে দেন আহমদ ছফা। তাদের বন্ধুত্বকে প্রেমে রুপান্তরিত করতে ভূমিকা রাখেন নির্মলেন্দু গুণ। বার্লিনে সরকারি সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করতে গিয়েছিলেন আবুল হাসান। কিন্তু তার হার্টের অবস্থা তখন এতই খারাপ যে সেখানকার চিকিৎসকরা তার অপারেশন করতে রাজি হন না। বার্লিন থেকে দেশে ফিরে নিজের গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছিলেন কবি। কিন্তু যাননি। রয়ে গেলেন ঢাকা শহরেই। কারণ কি সেই সুরাইয়া খাতুনের প্রেম?
সেই প্রেমের উপাখ্যান এই ডকু-ফিকশনের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে। পাঠক সেই আখ্যানে অবগাহন করতে পারবেন।
আর একটি প্রায় না জানা অধ্যায় আছে এই বইতে। সে হচ্ছে বার্লিনে চিকিৎসাকালীন সময়ে আবুল হাসানের দিনযাপন, সেখানকার তরুণ কবি, শিল্পী, চিত্রকরদের হৃদয় জয় করার গল্প। প্রকৃত কবিকে চিনতে ভাষার ব্যবধান চিরস্থায়ী দেয়াল তুলে রাখতে পারে না, আবুল হাসানের বার্লিন-জীবন সেই প্রমাণ রেখে গেছে। সে দেশের কবি-চিত্রকরদের হৃদয় জয় করতে হাসানের বেশি সময় লাগেনি। উপন্যাসের মতোই সুখপাঠ্য সেই অধ্যায়টি এই গ্রন্থের অমূল্য সম্পদ।
মোশতাক আহমদ এই ডকু-ফিকশন শুরু করেছেন পিজি হাসপাতালে কবির মৃত্যুদৃশ্য দিয়ে। শেষ হয়েছে জানাজা আর বনানী কবরস্থানে সমাহিত করার বিষণ্ণ, করুণ, হৃদয়স্পর্শী বর্ণনার মাধ্যমে।

তবে এই ডকু-ফিকশনে কিন্তু কেবলমাত্র আবুল হাসান উপস্থিত নেই। উপস্থিত আছেন সেই সময়কালের সকল প্রবীণ-তরুণ কবি-সাহিত্যিক। সিকান্দার আবু জাফর, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, আহমদ ছফা, মাহমুদুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, জাহিদুল হক, আবিদ আজাদ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু, শাহাদত চৌধুরীসহ সেই সময়কালের ছোট কিন্তু সমৃদ্ধ সাহিত্যজগত। আর বিপুল জীবন্ত উপস্থিতি আছে ঢাকা শহরের, যা কারো কাছে হৃদয়হীন কংক্রিটের জনপদ, কারো কাছে কবিতার তীর্থভূমি।

ছবি :- একজন কমলালেবু
This entire review has been hidden because of spoilers.
Profile Image for Kabita.
11 reviews
September 6, 2024
দারূণ পাঠ অভিজ্ঞতা । গবেষণা, কবিতা, প্রবন্ধ--- সব কিছুর মজা পাওয়া যাবে এক বইতেই।
Displaying 1 - 14 of 14 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.