‘আমি নিজে বৈচিত্র্যের ভক্ত৷ এবং বেশিরভাগ মানুষই তাই ৷ আর করোনা প্যান্ডেমিকের যে দুঃসময় আমরা পেরোচ্ছি তাকে সহনীয় করতে বোধহয় কিছু বৈচিত্র্য হলে ম্রিয়মাণ মন একটু অক্সিজেন পায় ৷ এই গ্রন্থটি সেই উদ্দেশ্যে গ্রন্থিত নয়, কিন্তু ঘটনাক্রমে এটি নানা বিচিত্র রচনার সমাবেশ ৷ ফলে নানা রসের এক ফিউশন ৷’ - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
‘ফুটপাথের দোকান’-এ পাঠকের জন্য সাজানো আছে বরেণ্য সাহিত্যিকের ৬টি বড় ও ছোট গল্প৷ ২টি মুক্তগদ্য, ৩টি ভ্রমণ, ১২টি স্মরণ, ২টি সাহিত্য এবং ১টি চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখা ৷
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক।
তিনি ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ময়মনসিংহে (বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ) জন্মগ্রহণ করেন—যেখানে তাঁর জীবনের প্রথম এগারো বছর কাটে। ভারত বিভাজনের সময় তাঁর পরিবার কলকাতা চলে আসে। এই সময় রেলওয়েতে চাকুরিরত পিতার সঙ্গে তিনি অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের বিভিন্ন স্থানে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শীর্ষেন্দু একজন বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকা ও দেশ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত।
তাঁর প্রথম গল্প জলতরঙ্গ শিরোনামে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সাত বছর পরে সেই একই পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে তাঁর প্রথম উপন্যাস ঘুণ পোকা প্রকাশিত হয়। ছোটদের জন্য লেখা তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি।
লেখক শীর্ষেন্দুর লেখা সবসময় কেমন যেন আপনাকে অন্য একটা সময়ে নিয়ে যাবে। তার উপর এই বইয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের লেখা। পড়তে পড়তে মনে হবে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মতো এক রিয়েলিটি থেকে আরেক রিয়েলিটিতে ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছি। এই বইয়ে সব মিলিয়ে ২৬টি লেখা রয়েছে। সবগুলো নিয়ে আলাদা আলাদা কথা বলাটা আমার কাছে অনেক সময় একঘেয়েমি মনে হয়। তাই সব মিলিয়েই বলবো।
বইয়ের শুরুটা কিন্তু ফুটপাথের দোকান দিয়েই। অনেকে হয়তো মনে করতে প্রথম গল্প বলে বইয়ের নাম এটা অথবা এই গল্পের নামে প্রচ্ছদ বলে হয়তো এই গল্পটি প্রথমে দেয়া। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে এই সংকলন বইয়ের সাথে ফুটপাথের একটা মিল আছে। আপনি যদি ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকেন সারাদিন বিভিন্ন মানুষের জীবনের বিভিন্ন ধারা দেখবেন। হয়তো প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে আপনার জীবনের অর্থ আপনার কাছে পাল্টে যাবে অনেকটা বিভিন্ন রিয়েলিটির মতো। ফুটপাথের দোকান গল্পটি মূলত দুজনের কথোপকথন। একজন আরেকজনকে তার প্রেম-বিয়ে ও জীবনের উত্থান পতনের কাহিনী বলছে। কাহিনী যেমনই চিত্তাকর্ষক ঠিক তেমনই উল্লেখযোগ্য ও মজার হচ্ছে যিনি শুনছেন তার হঠাৎ হঠাৎ বলে উঠা উক্তি গুলো। গল্প অংশে লেখক বিমল করকে নিয়ে একটি লেখা রয়েছে। যেখানে বিমল করের লেখনী প্রতিভার অসাধারণ প্রশংসা করা হয়। এই লেখা পড়ে বিমল করের দুটি বই পড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। একটি হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা দেওয়াল এবং আরেকটি হচ্ছে অসময় যেটির জন্য উনি সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। এরপর রাসমেলা নিয়ে একটি গল্প, একটু আধ্যাত্বিক দুটি গল্প এবং বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে সুন্দর একটি গল্প রয়েছে। সবগুলো গল্পই বৈচিত্র্যময়।
মুক্তগদ্য অংশে প্রেমের রকমফের নিয়ে একটি রচনা ও চানাচুরতন্ত্র-গণতন্ত্র নিয়ে একটা রচনা রয়েছে। ভ্রমনের অংশে কুম্ভমেলা নিয়ে বিশদ একটা বিবরণ আছে। বিবরণ পড়ে যেতে ইচ্ছে করবে আবার মানুষের ভিড়ের কথা ইচ্ছাটা হয়তো মরে যাবে। প্রায়ই মানুষ মারা যায় ভিড়ের মধ্যে পড়ে। দার্জিলিং-মিরিক নিয়ে লেখাটা আমাকে নস্টালজিক করে ফেলে। আর যে কারণে ভ্রমণ কাহিনী পড়ি না কারণ পড়লেই ব্যাকপ্যাক নিয়ে বের হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। এখন যেমন আবার দার্জিলিং যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
এরপর একটা বড় অংশ রয়েছে কালজয়ী মানুষদের নিয়ে স্মরণ করে লেখা। যেমন এর মধ্যে অতীব প্রতিভাবান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। লেখকের লেখায় এটা পরিস্কার উনি এই দুজনের অতীব ভক্ত। সৌমিত্রের অভিনয় গুণ ও উনার আবৃত্তির কথা উঠে এসেছে এবং সাথে উঠে এসেছে উনার কাজ করার আগ্ৰহ। আর লেখক সুনীল লেখার প্রশংসার সাথে উঠে এসেছে উনার একটু এলোমেলো জীবনযাপন। এত কিছু করার পরেও সুনীল কিভাবে লেখার জন্য সময় বের করতো এটা নিয়ে শীর্ষেন্দু কে খাবি খেতে দেখা যায়। আরো রয়েছে আনন্দ পাবলিশারস এর বাদল, লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবী, নবনীতা, সুচিত্রা ভট্টাচার্য প্রমুখ। আরো রয়েছে বক্সার মোহাম্মদ আলীর কথা। রয়েছে ফুটবলার ম্যারাডোনার কথা; যদিও লেখক বলেছেন উনার পছন্দের তালিকায় ম্যারাডোনা তিন নম্বরে। একে রয়েছেন পেলে ও দুইয়ে রয়েছেন জর্জ বেস্ট। কিন্তু বুঝলাম লেখাটি তিন নম্বর পছন্দকে নিয়ে কেন!
সাহিত্য অংশে ঘনাদা ও ঘনাদা চরিত্রের স্রষ্টা প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নিয়ে লেখা। এই লেখাটি না পড়লে জানতাম না প্রেমেন্দ্র মিত্র একজন বড় মাপের কবি ছিলেন এবং যাকে জীবনানন্দ দাশ গুরু মানতেন। আর একটি লেখা রয়েছে কলকাতার বইমেলা নিয়ে। চলচ্চিত্র অংশে একটাই লেখা রয়েছে যাতে একজন বাঙালি নায়ক ও পরিচালকের কথায় প্রশংসিত হয়েছে। আমার মনে হয় একজনের হিসেব করলে লেখকের পছন্দটি কোনো চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের সাথে দ্বিমতে যাবার সম্ভাবনা কম। হয়তো এই লেখাটি যারা পড়ছেন তারাও বুঝে ফেলেছেন কোন নায়ক আর পরিচালকের কথা লেখক লিখেছেন।
বইটি পড়তে আরাম লাগবে। প্রচ্ছদটি খুবই রুচিশীল হয়েছে। এজন্য রঞ্জন দত্তকে বিশেষ ধন্যবাদ। #ধৃসরকল্পনা
বইটা কিনেছিলাম বাতিঘর থেকে। কোন জানাশোনা ছিল না এর ব্যাপারে। গুডরিডসে ঢুঁ মেরেও কিছুই খুঁজে পাই নি। কিন্তু প্রচ্ছদ দেখে ভালো লেগে যায়। আর শীর্ষেন্দুর মুখোপাধ্যায় তো পছন্দের লেখকদের মধ্যেই পড়েন। তাই নিয়ে নেওয়া আর কি। কিছু গল্প, স্মৃতিচারণ, প্রবন্ধ নিয়েই মূলত এই বই। আহামরি কিছু পাই নি যা মনে দাগ কাটবে। পড়লাম, ভুলে গেলাম, এমন আর কি। আর শীর্ষেন্দুর উপন্যাস পড়তে পড়তে এমন অবস্থা হয়েছে যে, ছোট গল্পগুলো পড়ে মনে হলো, “ও মা! শেষ হয়ে গেল! আরেকটু লিখতো!” এতেই মনে হয় ছোট গল্পের সার্থকতা। সে যাক গে। এই বই দিয়ে আমি আমার ২০২১ এর নতুন বই পড়ার ইতি টানলাম। আগামী বছর আবার শুরু করবো। বুকশেলফের অনেক নতুন বই নিশ্চিত আমাকে বকাঝকা করছে!
এই বই লেখার কোন প্রয়োজন ছিল না। এটা না প্রকাশিত হলেও 'শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়' শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়'ই রইতেন। সম্ভবত এই বইটির মূল ভিত্তি 'ব্র্যান্ড শীর্ষেন্দু'ই। কতকগুলি গল্প,কতকগুলি গোবেচারা গদ্য আর কিছু মাঝারি মানের প্রবন্ধের সংকলন। পাঠককে গছিয়ে দিতে পারলেই প্রকাশকের লক্ষ্মীলাভ।