স্বাধীনতা-উত্তর চল্লিশ দশকের উত্তর কলকাতায়, ছোট্ট নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের নানান কষ্টের মধ্যে কুসুমদিই সতুর একমাত্র আলো! কুসুমদি ওকে যা বলে, ও সেটাই করার চেষ্টা করে। আর সেইসব কাজের মধ্যে দিয়েই ও ক্রমশ দেখতে পায় কুসুমদির জীবনের লুকোনো আরেকটা দিক! ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে কলকাতার আলো ছায়ার মধ্যে ক্রমশ কুসুমদির সঙ্গে সতু জড়িয়ে পড়তে থাকে নানান ঘটনায়। আর একটা একটা দিন করে এগিয়ে আসতে থাকে ওদের পাড়ার প্রথম দুর্গা পুজো! এর পাশাপাশি প্রায় সত্তর বছরের পরের একটা গল্পও আমরা দেখতে পাই সেই সতুদের পাড়াতেই। যেখানে এখনও নব্বই বছরের সতু বসবাস করে। গল্পের এই অংশে আমরা দেখি প্রাক্তন ফুটবলার হাট্টিমকে। দেখি হাট্টিমের এক সময়ের প্রেমিকা ইজনাকেও। দেখি রাখো, পিন্টুদা, মাদুলি, মুদ্রা, পাতাদা-সহ আরও অনেকে। এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পাড়ার দুর্গা পুজো করাটাই হয়ে ওঠে সবার লক্ষ্য! কিন্তু অর্থনৈতিক বাধা আসে। তা হলে কি এবারও পুজো হবে না? ‘ছাতিম’, এমনই দুই সময়ের সমান্তরাল প্রবাহের গল্প শোনায়। শোনায় ভালবাসা আর বন্ধুত্বের নিখাদ জীবন কাহিনি।
স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯ জুন ১৯৭৬, কলকাতায়। বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। পৈতৃক ব্যবসায় যুক্ত। প্রথম ছোটগল্প ‘উনিশ কুড়ি’-র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত। প্রথম ধারাবাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত। শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার ২০১৪, এবিপি এবেলা অজেয় সম্মান ২০১৭, বর্ষালিপি সম্মান ২০১৮, এবিপি আনন্দ সেরা বাঙালি (সাহিত্য) ২০১৯, সানডে টাইমস লিটেরারি অ্যাওয়ার্ড ২০২২, সেন্ট জেভিয়ার্স দশভুজা বাঙালি ২০২৩, কবি কৃত্তিবাস সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩, উৎসব পুরস্কার ২০২৪, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড ২০২৪, আনন্দ পুরস্কার (উপন্যাস: '‘শূন্য পথের মল্লিকা') ২০২৫ ইত্যাদি পুরস্কারে সম্মানিত ।
যাহ! এমনটা তো হবার কথা ছিল না। বইখানা যে ভালো লেগে গেলো! এইবারে?
অহরহ ট্রেনজার্নি করতে হয়। লম্বা সফরগুলোয় চেষ্টা করি এমন কিছু পড়বার যা জটিল নয়, যা সহজেই পিঠব্যাগে এটে যায়। সঙ্গে যদি বাই-চান্স মনটা একটু ভালো করে দেয়, তাহলে পোয়া বারো। স্মরণজিৎ চক্রবর্তী, আমার বাড়িতে কদর পান। আমার কাছে খুব একটা নয়। ওনার যাই পড়েছি খুব বেশি কোনোটাই ভালো লাগেনি। তবে বলতে লজ্জা নেই, খারাপ জিনিসকে দাগিয়ে দিতে যেরম দ্বিধা হয় না, সেরকম কিছু ভালো লাগলেও সেটার প্রতি অবজ্ঞা করা অন্যায়।
লেখকের বই কোনোদিনই খুব একটা প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করি না। যাকে বলে, lowering your standards, এবারেও তাই করলাম। এবং দিব্যি লাগলো। উপন্যাসটি কিন্তু অসাধারন নয়, কালজয়ী সাহিত্য আরো নয়। মোটের ওপর যাকে বলে, প্রেডিক্টাবল। গল্পজুড়ে হেন কিছু নেই, যা আপনি আগেভাগেই আন্দাজ করে নিতে পারবেন না। তবুও বইটি পড়ে আরাম। লেখকের গদ্য মায়াময়, কোন এক কবেকার মিঠে নস্টালজিয়া ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে ওনার লেখা প্রতিটি শব্দে।
আফসোস হয়, উনি যদি নিজের লেখা প্লটগুলো নিয়ে আরো কিছুটা এক্সপেরিমেন্ট করতেন? সেই একই ধাঁচে লেখার বাইরে বেড়িয়ে, অন্য কিছু? মন বলে উনি পারতেন এবং ভালোই পারতেন। কিন্তু আফসোস তিনি খুব একটা অন্য পাড়ায় যান না, সিগনেচার রম-কম লিখেই ওনার পাঠকপ্রিয়তা। যাইহোক, যার যা রোচে। এই গল্পের ছোট কলেবরেই দুটো ভিন্ন টাইমলাইন নিয়ে খেলেছেন লেখক। এবং ভালোই সাজিয়েছেন গল্পের গুটি। পরিমিত লেখনীর সঙ্গে তার চেনা চাঁচাছোলা সংলাপ, সাথে মিশে পাড়াতুতো সম্পর্ক, কেটে যাওয়া প্রেম, অদ্ভূত নাম, সিচুয়েশনাল কমেডি, ফুটবল এবং দুর্গাপূজোর প্রতিশ্রুতি!
এই যাহ, ভুলে যাচ্ছি। মোক্ষম কথা! বইতে আর আছে ভালোবাসা। খুব বাস্তবসম্মত কঠিন ভালোবাসা নয়, বলাই বাহুল্য। তবে এ জিনিসের মিষ্টতা উপেক্ষা করা মুশকিল। পরিচিত সংজ্ঞা ও অপরিচিত পরিণতির আনাচে-কানাচেই রোপিত বেশ কয়েকটি সম্পর্কের গপ্পো। সমস্ত বোকাটে প্রেমিকগুলোর জন্যে কোথায় গিয়ে যেন মন-কেমন করে ওঠে অচিরেই। মনে হয়, থাক না, মাঝে মধ্যে এমনটাতে ক্ষতি কি? কিছু কিছু সম্পর্কের সমাপ্তির ধরন, শেষ বিকেলের সেই লালরঙা করুন সূর্যটির মতন। যেতে হয় বলে সে যায়। আড়ালে অন্তরালে সে আছে, এবং থেকেই যাবে। অপেক্ষা করাবে আবার কালকের জন্যে। অনেকেই এই অপেক্ষাটি যেচে করে। বইটি যেন তাদেরকে নিয়েই লেখা।
..... আচ্ছা, ভালোবাসার মানুষরা কি হারিয়ে যায় ? মিলিয়ে যায় সময়ের ভাঁজে ? না তো, তারা যে ভালোবাসা হয়ে থেকে যায় । দিনের রোদ্দুরে, রাতের জ্যোৎস্নায় তারা বেঁচে থাকে । হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে তুলো বীজের মতো তারা পৌঁছে যায় অন্য মানুষের কাছে । বলে, এ জীবন অতটাও খারাপ নয় । এই পৃথিবীতে আর যাই হোক না কেন, ভালবাসাই মানুষকে আগলে রাখে । প্রতিটা মনখারাপের পরে সেই আবার নতুন গল্প শুরু করে । পাতা আনে গাছে, কুঁড়ি ফোটায়, জীবন জাগিয়ে তোলে আবার । আর বলে... আছে, আছে, এখনও বেঁচে থাকার মানে আছে । বলে, ভালোবাসা যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষ হারবে না । ততদিন মানুষ ফিরে ফিরে আসবে । না পেলেও, প্রিয় মানুষকে লালন করবে মনে । তাকে যত্নে বাঁচিয়ে রাখবে আজীবনের ভালোবাসায় ।
▫️উপন্যাসের নামটাই কেমন অদ্ভুত ! "ছাতিম"...কী ভীষন মায়াবী ! নামটা শুনলেই কেমন যেন একটা মনকেমন করা মিষ্টি সুগন্ধ নাকে এসে লাগে । উপন্যাসের এইরকম 'সরল' অথচ 'মায়াময়' নামকরণ আর কোনো লেখক করেন কি ?
🗒️ এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু কি ? সেই একঘেঁয়ে প্রেমের গল্প তো, যা বছরের পর বছর চলে আসছে ?
▫️হ্যাঁ, ঠিক তাই... সেই একঘেঁয়ে প্রেমের গল্প । আচ্ছা বলুন তো প্রেমের গল্প কি সত্যিই একঘেঁয়ে হয় ? ‛ভালোবাসা‘ কি সত্যিই আমাদের বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে ? তাহলে আমরা সারাজীবন একটা মানুষকে ভালোবেসে কাটিয়ে দিতে পারি কিভাবে ? একঘেঁয়েমি লাগবে ভেবে বছর বছর ভালোবাসার মানুষটিকে বদলে ফেলি নাকি আমরা ? করি না তো ? তাহলে ভালোবাসার গল্প একঘেঁয়ে হয় কিভাবে ?
▫️মেনে নিলাম উনি প্রতিবছর ‛একই গল্প’ ভিন্ন মোড়কে পাঠকদেরকে উপহার দেন । কিন্তু তবুও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পাঠক সেই লেখা শেষ অবধি পড়ে, অনুভব করে, এবং কোথাও গিয়ে একাত্ম হয়ে যায় ওনার গল্পের সাথে । এই যে আমার মতো যারা ব্যর্থ, ভাঙাচোরা মানুষ... তারা দিনশেষে ‛স্মরণজিৎ’ নামের বটগাছের তলায় শান্তিতে দু-দন্ড বসতে পারে, জিরিয়ে নেয় এবং আবার উঠে দাঁড়ায় আগামীকালের লড়াইয়ের জন্য । আজকের এই মূল্যবােধহীন, স্বার্থপর, সোশ্যাল মিডিয়া-সর্বস্ব পৃথিবীতে দাড়িয়ে এইরকম সহজ, সরল ভাষায় ভালোবাসার গল্প আর কতজন লিখতে পারে বলুন তো ?
▫️আমার কাছে স্মরণজিৎ চক্রবর্তী ‛আধুনিক রূপকথার জাদুকর’... আর আমি কখনোই চাইবো না এক্সপেরিমেন্টের নামে তিনি তার সহজাত ‛ম্যাজিক’ থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করুন ।
Chattim is a tender and evocative novel by Smaranjit Chakraborty that beautifully captures the nostalgia of youth, friendship, and the bittersweet passage of time. Written in his signature lyrical style, the book draws readers into a world of memories rooted in Bengal’s cultural ethos. It resonates through its simplicity, emotional honesty, and quiet reflections on love and loss, making it a moving read for anyone who has ever looked back at their own formative years with longing.
উত্তর কলকাতার এক পাড়া। তিরানব্বই বছরের বুড়োদাদুর ইচ্ছে পাড়ায় তাদের নিজস্ব দুর্গাপুজো হোক। বহু বছরের পুরোনো; একজনের কাছে তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি তাঁকে প্রতিনিয়ত স্বপ্নে তাড়া করে বেড়ায়। তাঁকে ভুলতে দেয়না কিছু একটা...। এদিকে বুড়োদাদুর ইচ্ছেয় পাড়ার সকলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুজোটা করার জন্য, পাড়ার সার্বজনীন পিন্টুদা, রিনা বৌদি, মাদুলি, পাতাদা, রাখো, হাট্টিম আর ইজনা সবাই যে যার সাধ্যমতো চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত। ইজনা আর হাট্টিম বহুবছরের সম্পর্কের পর কোনো এক সন্ধ্যার কোনো এক অপ্রীতিকর ঘটনার পর, পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। যদিও হাট্টিম সেই সন্ধ্যার জন্য প্রতিনিয়ত অপরাধবোধে ভোগে আর আজও মনে মনে ইজনার প্রতীক্ষা করতে থাকে, যদি কোনোদিন সে ফিরে আসে আবার...।
এদিকে উত্তর কলকাতার সেই পাড়ায় ১৯৪২ সালের ঘটনাক্রম, সমান্তরালে বয়ে চলে এই উপন্যাসে। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখে সতু, বড় ক্লাবের হয়ে খেলতে চায় ��ে। তার জীবনের এবং খেলাধুলার গুরু মনে করে হরেনদা কে। নানা রকম situation এ হরেনদা তাকে বড় দাদার মতো আগলে রাখে আর নানান সদুপদেশ দেয়। যেগুলো শুনে 'নশা', সতুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু; চটে গেলেও সতুর ভালোই লাগে। সতুর একমাত্র ভাই অমর, যার ছোটো থেকেই একটা নার্ভ ক্রমে শুকিয়ে আসছে যা আস্তে আস্তে কেড়ে নিচ্ছে তার দৃষ্টিশক্তি, একই সাথে অমর তার বয়সী আর পাঁচজনের থেকে একটু আলাদা, যে কারণে এই সমাজ তাকে সামনে বা পেছনে পাগলের তকমা দিয়ে যায়... এই ভাই কে খুব ভালোবাসে সতু একই সাথে তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যায় ভাই এর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। ওপার বাংলা থেকে এসে এই পাড়ায় যাঁদের বাড়িতে ভাড়া থাকে সতুরা তাঁদের বাড়ির মেয়ে কুসুমদি, ভালো নাম 'সপ্তপর্নী'। বয়সের তফাৎ ৫-৬ বছরের হলেও সতু ভীষণ ভালোবেসে ফেলে কুসুমদি কে। কী পরিণতি হবে এই অসম প্রেমের?
পাড়ার ছাতিম গাছ কিভাবে জুড়ে রেখেছে ২টো ভিন্ন যুগের দুই ভালোবাসার আখ্যানকে, কিভাবে সমান্তরালে বয়ে গেছে ২টো যুগ যার সাক্ষী থেকে বেড়ে উঠেছে ওই ছাতিম গাছ তা নিয়েই এই আখ্যান। প্রাকস্বাধীনতার ভারতবর্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নানান মানুষের জীবনের ওঠাপড়ার সাথে কিভাবে মিলেমিশে গেছে আজকের পাড়ার এই দুর্গাপুজো তাই নিয়েই এই কাহিনী।
প্রতিটি চরিত্র এতো নিখুঁত সাবলীলতা আর বাস্তবিকতার সংমিশ্রণে তৈরি যে তাঁদের নিজেদের আশেপাশে যেনো প্রতিনিয়তই খুঁজে পাওয়া যায়। অনবদ্য লেখনী (বলাই বাহুল্য), আর তাঁর সাথে সচ্ছ সুন্দর গতিময় কাহিনী। না পড়লেই সত্যিই অনেকটা অপ্রাপ্তি। পরি, যুবক সিংহের মতো রোদ্দুর, মাদকতা মাখানো ছাতিম এর গন্ধ আর কাহিনী শেষের চোখ ছলছল এইটুকু পাওয়ার জন্য অন্তত বইটি হাতে তুলে নেওয়ার যায়...।
"কে বলে শুধু রক্তমাংসের মধ্যে কাউকে পাওয়ার ভেতরে জীবনের পূর্ণতা লুকিয়ে থাকে !"
জীবনটা একটা খেলা, হার জিৎ লেগেই আছে তাইনা ? হাট্টিম এরও ঠিক তাই মনে হয়েছিল। আসলে আমাদের বর্তমান সমাজ খুব খামখেয়ালি। তাদের কাছে ভালোবাসাটা একটা খেলার মতো, আজ একটা খেলনা ভাল্লাগছে, খেলতে ইচ্ছে না হলে কাল আর একটা। কিন্তু ভালোবাসা কি সত্যি খেলা ? যদি খেলা না হয় তাহলে কি ? হয়তো সাধনা । কাউকে পাওয়ার জন্য তার শরীর ছোঁয়ার দরকার পরেনা , দরকার পরে তার মন ছোঁয়ার। অধিকার বোধ জাগানোর নাম ভালোবাসা না। ভালোবাসাকে ভালো থাকতে দেখে ভালো থাকা হলো ভালোবাসা। হাট্টিম , সতু , ইজানা , কুসুম দি ,সবাই একটা অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা। আর সেই সুতো টার নাম হলো ভালোবাসা। গগনের চরিত্রটা ছোট হলেও মন ছুঁয়ে গেছে , আর যার কথা না বললে নয় সে অমর। অমর এর কথা গুলো এত সুন্দর করে লেখক তুলে ধরেছেন। আমি ঠিক মতো শব্দ পাচ্ছিনা মনের ভাব টা প্রকাশ করার। তবে বলবো সতু বুঝেছিল ভালোবাসা কি তাই সে ভালোবাসতে পেরেছিল ।
গল্পটা শীতের দিনে রোদের নরম আদর হয়ে আমার মনে ঘর করে নিয়েছে। যে ঘর ঘেরা একটা ছাতিমের গাছ দিয়ে । বইটা অবশ্যই একবার পড়ে দেখবেন। হতাশ হবেন না।
🌼 এই বইটা আমি ইচ্ছা করেই রেখে দিয়েছিলাম পুজোর আগে পড়ব বলে — শুধুমাত্র নামটার জন্য। কিন্তু গল্পের মধ্যে পুজোর সাথে একটা ডাইরেক্ট লিঙ্ক পেয়ে যাবো ভাবতে পারিনি। “ছাতিম” নামটা যেন নিজেই একটা গন্ধ — ছাতিম ফুলের সেই পরিচিত সুবাস, আর সেই সুবাসের সঙ্গেই মিশে থাকে পুজো আসছে আসছে সেই বিশেষ অনুভূতি।
📖 একদম স্মরণজিতের স্টাইলে একটা দারুণ রম কম হলো ছাতিম। ছাতিম দুটো প্রজন্মের গল্প বলে। একটা স্বাধীনতার আগের সময়- সেখানে আছে সতু আর কুসুমদি। কুসুমদির প্রতি সতুর মনে আছে নীরব ভালোবাসা। স্বাধীনতার আগের এই গল্প আসলে কলকাতায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমি তে। কুসুমদির সাথে সতু নানা ঘটনায় জড়িয়ে পরে, শেষে একটা ছাতিম গাছ, বা সপ্তপর্ণী তে আটকে থাকে সবকিছু ।
⏳ এরপর গল্প এসে পৌঁছায় ৭০ বছর পর সেই একই পাড়ায় যেখানে আছে হাট্টিম সে ইন্ডিয়া টিম এর প্রাক্তন ফুটবলার,চোটের জন্য আর খেলে না। আছে তার পুরোনো প্রেম ইজনা, আছে সতু — এখন বয়স ৯০, আর আছে আরও কিছু চরিত্র- রাখো, পিন্টুদা, পাতা দা, মুদ্রা, মাদুলি । এই নতুন প্রজন্মের গল্পে লেখক আমাদের একটা নয় দুটো মিষ্টি প্রেমের গল্প বলেন , একটা হাট্টিম - ইজনা এর, আর একটা হাট্টিম এর বন্ধু রাখো ও মুদ্রা এর। রাখো ও মুদ্রার প্রেমের পরিসরটা ছোট হলেও তা বেশ মিষ্টি ও মন ছুয়ে যায়।
🏠 সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছে লেখক একটা সুন্দর পাড়ার গল্প বলেছেন যেখানকার লোকগুলো বড্ড সরল , স্বার্থহীন, যা আজকের দিনে দেখা যায় না। সেই পাড়ায় পুজো আসছে আসছে একটা ভাব লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। আর ঠিক সেই পাড়ার হাওয়ায় ছড়িয়ে থাকে ছাতিম ফুলের সুবাস যেখানে সতুর কাছে আছে কুসুমদির দেওয়া সপ্তপর্ণী।
✨ সব মিলিয়ে ছাতিম সতু, হাট্টিম আর ইজনা এই তিনজনের POV তে এক সমান্তরাল প্রেমের গল্প বলেছেন লেখক। প্রেম, বিরহ, বন্ধুত্ব, পাড়ার পুজো, ফুটবল সব মিলিয়ে এটা একটা feel good মার্কা উপন্যাস। 👉 পুজোর আগে পড়লে মনের ভিতর একরাশ আলো ছড়িয়ে দেবে।
দুই প্রজন্মের প্রেমের গল্প। আগের প্রজন্মের প্রেম এই প্রজন্মের জুটিতে পূর্ণতা পেল। সতু আর কুসুমদির অনুচ্চারিত প্রেম হাট্টিম আর ইজনার মধ্যে পূর্ণতা পেল। কুসুমদি আর তিনুদার প্রেম তার মাঝখানে সতু। সতুর শেষ বয়সে এসে হাট্টিম আর ইজানার ভেঙ্গে যাওয়া প্রেম গল্পের শেষে এসে জুড়ে যায়। মাঝে আছে মুদ্রা আর রাখোর প্রেম। আছে সিমির গগনের সঙ্গে প্রেম প্রেম খেলা। প্রেম নিয়ে গগন বাস্তব জেনেও সিমির সঙ্গে জোট বাঁধে আবার জোট ভাঙাতে গগনের মন একদম ডুবে যায়। কিন্তু ভেঙ্গে পরে না। এতে আছে বাঙালির রক্তে চিরকালীন আলোড়ন তোলা ফুটবল আর দুর্গাপুজো। যে দুর্গাপুজো কুসুমদির কারনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সতুই আবার শেষ বয়সে পাড়ার ছেলেদের উজ্জীবিত করে নতুন করে দুর্গাপুজো করার। গল্পের শেষ হয় দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি দিয়ে। গোটা গল্পটার প্রধান উপজীব্য এরাই।
This entire review has been hidden because of spoilers.
আমি যত বড় হচ্ছি পুজো নিয়ে মাতামাতি আমার কমে আসছে। লাস্ট কয় বছর ধরে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছি পড়ার ঠাকুর বাদে সেভাবে আর কোন ঠাকুর দেখছি না, জোর জবরদস্তি নিজেকে বাড়ি থেকে বার করতে হচ্ছে ,পুজোর যে আবেশ তা আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, কেন গেছে সে সম্পর্কে আমি আর আসলাম না, তবে এই পুজো পুজো অনুভূতিতে এরকম একটা মিষ্টি বই পড়তে বেশ ভালো লেগেছে আমার, আজকাল যেখানে মানুষ মানুষের স্বার্থ ছাড়া এক পা নড়ে না সেখানে ম্যাজিশিয়ানের কলমে একটা পাড়া সবাই মিলে একজোট হয়ে এক বৃদ্ধ মানুষের ইচ্ছা পূরণের জন্য কতদূর যেতে পারে তার আখ্যান ছাতিম, ছাতিম শুধু সতুর একতরফা ভালোবাসা নয়, বা কোন প্রেমে আখ্যান নয় ছাতিম একটি পাড়া, দুটি প্রজন্ম, এ���ং দুই প্রজন্মে বন্ধুত্ব , ফুটবল দূর্গা পূজা ওকিছু সম্পূর্ণ ও কিছু অসম্পূর্ণ প্রেমের আখ্যান।
ভদ্রলোকের সব বই প্রায় একই রকম। একটা চুপচাপ, জেদীগোছের নায়ক। তার একটা ঠোঁটকাটা ফটফট করা বন্ধু। দৃঢ়চেতা নায়িকা। অনেকখানি প্রেম, মাঝে বিরহ, শেষে মধুর সমাপন। এখানেও ঘটনা প্রায় একই শুধু পার্থক্য হচ্ছে বাকি উপন্যাসগুলো ওয়ানডে আর এটা দুই ইনিংস ধরে ব্যাটিং করা টেস্ট ম্যাচ৷ প্রথম ইনিংস ফলো-অনে পরে শেষ ইনিংস এ ম্যাচ জয়। কি হবে না হবে আগেই বুঝে যাওয়া সত্ত্বেও পড়তে খারাপ লাগবে না।
শীতের দুপুরে নরম রোদ্দুরের আদর গায়ে মেখে মনের মাঝে ছাতিম ঘেরা একটা সুন্দর ঘর করে নিয়েছে উপন্যাসটা। কিছু লেখা এমনিই সুন্দর হয়, এমনিই ভালো লাগে। এটাই স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর ম্যাজিক....