সারা ভারতবর্ষে বহুকাল ধরে সবচেয়ে প্রিয় ও পরিচিত দুটি নাম, রাধা আর কৃষ্ণ। এই দু’জনের যে প্রণয়-কাহিনী, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে তার তুলনা মেলে না। এই প্রণয়-কাহিনী ছড়িয়ে আছে নানান পুরাণ ও কাব্যে, গ্রাম্য গাথায়, লৌকিক গানে। পরম পণ্ডিত বা ভক্ত থেকে শুরু করে অতি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত হাজার হাজার বছর এই কাহিনীকে আপন করে রেখেছেন। তবে, এ পর্যন্ত বাংলা গদ্যে এই কাহিনীর নির্ভরযোগ্য, নিখাদ, সমগ্র রূপ রচিত হয়নি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমস্ত কাব্য মন্থন করে এই রসসমৃদ্ধ ভাষ্যটি আপন ভাষায় রচনা করেছেন। কৃষ্ণের অনেক পরিচয়। বৃন্দাবনের যে-কৃষ্ণ সাধারণ মানুষের মতন, যিনি দুরন্ত রাখাল এবং যিনি রাধার প্রেমিক, শুধু তাঁর কথা বলা হয়েছে এখানে। আর রাধা যেন সম্পূর্ণ কাব্যেরই সৃষ্টি। এখানে এঁরা দেব-দেবী নন। কোনো অলৌকিকের প্রভাব নেই, এঁরা চিরকালের প্রেমিক-প্রেমিকা। বইটি শেষ করার পরেও একটু অতৃপ্তি থেকে যাবে, মনে হবে আর একটু কেন লেখা হলো না! এই অতৃপ্তিই এই ভালোবাসাকে অমর করেছে। অনেকে তাঁকে কবি হিসেবে জানেন; অনেকে জানেন কথাসাহিত্যিক হিসেকে। কিন্তু সাহিত্যের যাঁরা মনোযোগী পাঠক, তাঁরা জানেন যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনায় পদ্য আর গদ্যবন্ধের দ্বন্দ্ব কত সহজে মিটে যায়, এবং কবিতা আর কথাসাহিত্যের মধ্যে কত অক্লেশে তিনি মিলন ঘটিয়ে দেন। তাঁর কবিতা যেমন বিনা দ্বিধায় মাঝে-মাঝে গদ্যের সমতটে নেমে আসে, তাঁর গদ্যও তেমনি অবলীলাক্রমে উঠে যায় কবিতার শিখরে। আসলে, কবিতাই লিখুন আর গল্প-উপন্যাস-রম্যরচনাই লিখুন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য সর্বদা দুটি স্তরকে ছুঁয়ে থাকে। একই লেখার একটি স্তরে তিনি জনপ্রিয় লেখক, সর্বজনের গ্রাহ্য, আবার অন্য স্তরে তিনি এমন-কিছু আনন্দ কিংবা বেদনার স্পর্শ ঘটিয়ে দেন, যার তাৎপর্য হয়তো ঠিক তন্মুহূর্তেই সকলের কাছে ধরা পড়ে না, কিন্তু যা আছে বলেই, একবার পড়া হয়ে যাবার পরেও, একটু সূক্ষরুচির পাঠককে আবার নতুন করে সেই লেখার মধ্যে নিবিষ্ট হতে হয়। তাঁর মনে হয়, এর মধ্যে এমন-কিছু রহস্য আছে, প্রথম-পাঠে যার আভাসমাত্র মিলেছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুধুই গল্প বলেন না, গল্পের মধ্য দিয়ে সত্যের দিকে এগিয়ে যান। বলা বাহুল্য, তাঁর যাত্রা এখানে প্রেম-বিষয়ক একটি পরম সত্যের দিকে।
Sunil Gangopadhyay (Bengali: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়) was a famous Indian poet and novelist. Born in Faridpur, Bangladesh, Gangopadhyay obtained his Master's degree in Bengali from the University of Calcutta, In 1953 he started a Bengali poetry magazine Krittibas. Later he wrote for many different publications.
Ganguly created the Bengali fictional character Kakababu and wrote a series of novels on this character which became significant in Indian children's literature. He received Sahitya Academy award in 1985 for his novel Those Days (সেই সময়). Gangopadhyay used the pen names Nil Lohit, Sanatan Pathak, and Nil Upadhyay.
Works: Author of well over 200 books, Sunil was a prolific writer who has excelled in different genres but declares poetry to be his "first love". His Nikhilesh and Neera series of poems (some of which have been translated as For You, Neera and Murmur in the Woods) have been extremely popular.
As in poetry, Sunil was known for his unique style in prose. His first novel was Atmaprakash (আত্মপ্রকাশ) and it was also the first writing from a new comer in literature published in the prestigious magazine- Desh (1965).The novel had inspiration from ' On the road' by Jack Kerouac. His historical fiction Sei Somoy (translated into English by Aruna Chakravorty as Those Days) received the Indian Sahitya Academy award in 1985. Shei Somoy continues to be a best seller more than two decade after its first publication. The same is true for Prothom Alo (প্রথম আলো, also translated recently by Aruna Chakravorty as First Light), another best selling historical fiction and Purbo-Paschim (পূর্ব-পশ্চিম, translated as East-West) a raw depiction of the partition and its aftermath seen through the eyes of three generations of Bengalis in West Bengal, Bangladesh and elsewhere. He is also the winner of the Bankim Puraskar (1982), and the Ananda Puraskar (twice, in 1972 and 1989).
Sunil wrote in many other genres including travelogues, children's fiction, short stories, features, and essays. Though he wrote all types of children's fiction, one character created by him that stands out above the rest, was Kakababu, the crippled adventurer, accompanied by his Teenager nephew Santu, and his friend Jojo. Since 1974, Sunil Gangopadhyay wrote over 35 novels of this wildly popular series.
Death: Sunil Gangopadhyay died at 2:05 AM on 23 October 2012 at his South Kolkata residence, following a heart attack. He was suffering from prostate cancer for some time and went to Mumbai for treatment. Gangopadhyay's body was cremated on 25 October at Keoratola crematorium, Kolkata.
Awards & Honours: He was honored with Ananda Award (1972, 1979) and Sahitya Academy Award (1984).
খুব আশ্চর্যের কথা। হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থগুলো, যেমন রামায়ণ, মহাভারত, প্রাচীনতর পুরাণ গ্রন্থ— কোথাও শ্রীরাধিকার উল্লেখ নেই। রাধার প্রথম দেখা পাওয়া যায় অনেক পরে, দ্বাদশ শতকে, মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জয়দেবের সংস্কৃত ভাষায় লেখা "গীতগোবিন্দ" কাব্যে। সুতরাং আমরা কল্পনা করে নিতেই পারি, ঐতিহাসিক না-হোক, এমনকি পৌরাণিক সূত্রেও শ্রীরাধিকার অস্তিত্ব ছিল না। তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে অনেক পরে, কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। কী উদ্দেশ্যে?
হিন্দু দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো ভক্তিবাদ। ভক্তিবাদের মতো একটি সুগভীর দর্শনকে সামান্য কয়েকটা কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলা যায়, শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে মেনে নেওয়া সত্ত্বেও, তিনি "একাই একশো" নন। তাঁর মতো দিগ্বিজয়ী মানুষেরও একটা দ্বৈত অথচ বিপরীত সত্তা থাকতে হবে। একটা প্রবল পিছুটান থাকতে হবে। শ্রীরাধিকা হলেন কৃষ্ণের সেই পিছুটান। ভক্তিবাদের এই দারুন দুঃসাহসিক তত্ত্বটি সমগ্র ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের প্রাণ স্পর্শ করেছিল একসময়। রাধাই হলেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। "হ্লাদিনী" মানে - আনন্দের উৎস। The fountain of bliss!
বৈষ্ণব পদাবলীতে, যেখানে শ্রীরাধিকার প্রাসঙ্গিকতা এমনকি কৃষ্ণেরও উপরে, সেই পদাবলী সাহিত্য পড়লে বোঝা যায়, পুরুষ হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ হতে পারেন সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু তাঁর অস্তিত্বের মূলটি গাঁথা রয়েছে রাধার হৃদয়ে। কানু বিনা যেমন রাই নেই, রাই বিনা তেমনি কানুও অসম্পূর্ণ হয়ে আছেন। তাঁরা দুজন সারাজীবন কাছে থাকতে পারেন নি। তাঁদের প্রেম সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। তবু বৈষ্ণব সাহিত্যে এই প্রেমকেই সবচেয়ে উঁচুতে জায়গা দেওয়া হয়েছে।
অভিমান, বিরহ, বিষাদ এবং দিগন্ত প্রসারিত প্রতীক্ষারই আরেক নাম দেওয়া হয়েছে "প্রেম"। এই যে বুকফাটা অসহায় তৃষ্ণা, এই শূন্যতার অনুভূতিকেই যুগ যুগ ধরে ব্যক্ত করার চেষ্টা করে এসেছে মানুষ। প্রেমিক মানুষ। ভিখারি মানুষ। রাধাকে বলেছিলেন কৃষ্ণ, আলিঙ্গনও যদি না করো, একবার আমার দিকে না-ও যদি তাকাও, একবার স্পর্শ না করো, তোমার ওই খণ্ডিত চন্দ্রকলার মতো পায়ের নখে অন্তত একবার চুম্বন করতে দিও? ভগবানকে এভাবে ভিখারি বানাতে পারা কম সাহসের কথা নয়!
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর। এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর।
মহাভারতের সফিস্টিকেটেড কৃষ্ণের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীর এই প্রেমিক কৃষ্ণের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আসামের কামরূপী আঙ্গিকের একটা লোকসংগীত আছে। "ও রে কলঙ্কিনী রাধা, কদম ডালে বসিয়া আছে কানু হারামজাদা, মাঈ তুই জলে না যাইও"। যাঁকে দেবতা বলে স্তুতি করা হয়, সেই দেবতাকেই "হারামজাদা" নামে সম্বোধন করা হয়েছে! দেবতার সঙ্গে এই যে বন্ধুর মতো আচরণ, সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যের এটাই essence! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এই উপন্যাসে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের এই লৌকিক এবং ক্যাজুয়াল বৈশিষ্ট্যকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
পুরোপুরি সফল হননি তিনি। আবহমানকাল ধরে চলে আসা রাধাকৃষ্ণের কাহিনিকে তাঁর স্বকীয় পাকা হাতে effortlessly প্রকাশ করতে পারেননি তিনি। তবু দুইজন নরনারীর পারস্পরিক প্রণয়ের সর্বগ্রাসী আকুতিকে বেশ খানিকটা দেখাতে পেরেছেন। রাধা আর কৃষ্ণের ব্যতিক্রমী প্রেমের গল্পটা জানার জন্যেও খুব সম্ভবত এই বইটির চেয়ে ভালো উপায় আর নেই। অন্তত বাংলায় বোধহয় নেই। আজকে দোল পূর্ণিমার দিন বিকেলবেলা বইটা পড়া শেষ করে, রাধা আর কৃষ্ণের চিরন্তন বেদনাকে উপলব্ধি করতে করতে মাথায় ঘুরছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখা একটা গানের কয়েকটা লাইন।
ধীরে ধীরে পহুঁছত যমুনা কে তীর সুনসান পনঘট মৃদুল সমীর ক্ষণ ক্ষণ মাধব বিরহ মদির উসে কাহে ভুল না পাও ? মথুরা নগরপতী কাহে তুম গোকুল যাও ?
তিনি কোথায় শিখেছেন এই বাঁশি বাজানোর কায়দা, তা আমি জানিনা। তবু বাঁশির আওয়াজ যে আজও শোনা যায় এই কথাটা কে অস্বীকার করতে পারে? আগুনের শিখার মতো বিরহের এই গল্পটা এভাবেই চলতে থাকবে যুগ যুগ ব্যাপী। যতদিন মানুষ প্রেমিক থাকবে। যতদিন মানুষ প্রতীক্ষারত থাকবে। যতদিন মানুষ ভিখারি থাকবে।
আর কি কখনো কবে এমন সন্ধ্যা হবে ? জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা।
"প্রেম পবিত্র। এই প্রেম বয়স মানে না,মানে না কোন বাঁধা। তাই শত বাঁধা পেরিয়ে এক হয়েছিল কৃষ্ণ রাধা।"
শ্রীকৃষ্ণের প্রেম আখ্যান সকলে জানে। তাও মানুষ জানতে চায়। এই প্রেম আখ্যান মদিরার মতো,মানুষ চাতকের মতো বসে তা পান করে। তাও তৃষ্ণা মিটে না।
লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও চেয়েছেন,এই অমৃত আখ্যান মানুষকে জানাতে। তিনি সফল। অসাধারণ একটা বই। অবশ্য আমার কাছে বই পড়ছি বলে মনে হয়নি,আমার বার বার মনে হয়েছে আমি একটা কবিতা পড়ছি। প্রেমের কবিতা।
শেষ করার পর,থমকে গেছি। কেন শেষ হলো এটা,জগতে সুন্দর কেন এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। হায়!
"জীবনটা বড় ছোট। আর যারা ভালোবাসে, তাদের সময় আরও দ্রুত চলে যায়..." . . কৃষ্ণের জীবনে রাধা পরম প্রেম, তাঁর পরশমণি। সেই প্রেমের গুরুত্ব এতটাই বেশি যে, সর্বদাই রাধার নাম আসে কৃষ্ণের আগে। কারণ তাঁকে ভগবানের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ভাবা হয়েছে। যেমন বৈষ্ণব ভক্তিতে ভক্তকে ঈশ্বরের চেয়ে আগে রাখা হয়।
সে কারণেই রাম-সীতা, দশরথ-কৌশল্যা, লক্ষ্মণ-উর্মিলা, যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদী, দুর্যোধন-ভানুমতী, অর্জুন-সুভদ্রাসহ রামায়ণ ও মহাভারতে অজস্র যুগলের কথা উল্লেখ করা হলেও রাধাকৃষ্ণর মতো সুরেলা ধারার যুগল আর কেউ নেই।
রাই ছাড়া কানু নেই, কানু ছাড়া রাইও অসম্পূর্ণ। . . সুনীলের সহজ বয়ানে 'রাধাকৃষ্ণ' এর কাহিনি পড়তে ভালো লাগে বেশ। একইসাথে মনে পড়ে যায়, ঋতুপর্ণ ঘোষের 'রেইনকোট' সিনেমার কথা। বেকার যুবক মনু গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছে চাকরীর খোঁজে। এক বৃষ্টিস্নাত দিনে মনু এসে দাঁড়ায় নীরুর বাড়ির দোরগোড়ায়। নীরু তার কে? বর্তমানে হয়তো কেউ না, কিন্তু এক সময় কত কিছুই না ছিল।
মনু জানে—বহুদিন হলো নীরু শহরে এসেছে, হয়েছে সংসারী। তারপরেও একদিনের জন্য তাঁদের পুনর্মিলন হয়, আকাশ থেকে কুলকুল জল ঝরে যাওয়া বিষণ্ণ দিনে। দু'জনেই দু'জনকে বোঝায় তাদের জীবন সুখের। কিন্তু, নীরুর অগোচরে তার ঘরের দিকে তাকালেই বোঝা যায় সুসময় মাড়িয়ে আসা বিবর্ণ বেদনা। মনুর ধার করা রেইনকোট থেকেও বের হয়ে আসে উপচে পড়া দারিদ্র্য। এত আড়াল, দ্বন্দ্ব, মিথ্যা ও অভিমানের মাঝেও কোথাও যেন বেজে যায় দু এক ছত্র প্রেমের গান।
এই সিনেমার ঋতুপর্ণ তাঁর লেখা শীর্ষ সংগীতে জানতে চান, "মথুরা নগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও?"
মনু কেন যায় নীরুর কাছে? রাজা কংসকে উৎখাত করে কৃষ্ণ হয়েছিল মথুরার নতুন শাসক। কিন্তু এরপর সে আর ফিরে যায়নি গোকুলে, রাধার কাছে। রাধার অপেক্ষা অনন্তকালের। নীরুর অপেক্ষাও ব্যথিত কুসুম। তাই, মনুর কলকাতায় যাওয়াকে ঋতু গানে গানে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। কৃষ্ণের প্রসঙ্গ ত��লে এনে অপষ্ট স্বরে বলেন, 'এই পৃথিবীর এতশত দুরন্ত দু:খের দেশে, তোমার এতদিন পর তাকে মনে পড়লো? এতদিন পর...'
এ কাহিনী কে না জানে! কিন্তু সুনীল যখন তার চোখ দিয়ে পাঠকদের দেখায় তখন সবই নতুন করে অপূর্ব লাগে। এতো ছোট্ট একখানা বই কেন তা নিয়ে অভিযোগ রয়েই যাবে। আরো ডিটেইলে লিখতেন!
"জীবনটা বড় ছোট। আর যারা ভালোবাসে, তাদের সময় আরও দ্রুত চলে যায়।"
বি. দ্র. রাধা কৃষ্ণের যেকোনো কাহিনী পড়ার পরই তীব্র ফেমিনিজম ভর করে ও দুনিয়ার সব পুরুষরে কাইট্টা ফেলতে মন চায়। এর প্রতিকার কী, বন্ধুগণ?
এ-কাহিনি এক অমর ও শাশ্বত প্রেমের। তাতে এক নারী ও এক পুরুষের মধ্যে তৈরি হওয়া সম্পর্কের ছবিটি আছে। সেই ছবি কাম, ক্রোধ, হতাশা ও মুগ্ধতার রঙে উজ্জ্বল। তাতে আছে নিয়ম-ভাঙার উচ্ছ্বাস আর অপরাধবোধ। আছে অন্যের চোখে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার আকুলতা। আছে বিরহ আর শূন্যতা। তাহলে কী নেই? নেই কোনো অলৌকিক আখ্যান। নেই কোনো গূঢ় তত্ত্ব বা ব্যাখ্যা। নেই মহাভারত ও তার রাজনীতি। নেই শ্রীকৃষ্ণ। এ-কাহিনি শুধুই রাধা ও কানু'র। পড়তে গেলে দেখবেন, এতে কোনো বৈপ্লবিক ব্যখ্যা বা দাবি নেই। দু'টি রক্তমাংসের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার অত্যন্ত সরল অথচ সুললিত বিবরণ এটি। আমরা এই গল্পগুলো পড়ে, শুনে, দেখে এসেছি আজন্ম। সুনীলের কাব্যিক কলমেও এই কাহিনিতে অতিরিক্ত কোনো মাত্রা সংযোজিত হয় না। বরং তাঁর কানাইয়ের আচরণ দেখে মনে হয়, এ যেন পরবর্তীকালে 'পূর্ব পশ্চিম'-এর বাবলু'রই পূর্বাভাস। তবু এই বই বিশিষ্ট হয়ে ওঠে দু'টি কারণে।
প্রথমত, কাহিনির একেবারে শেষে মথুরা'র রাজা হয়ে ওঠা কিশোরের সোনার খাঁচায় বসবাস, আর বৃন্দাবনে চিরন্তন অপেক্ষায় থাকা এক নারী'র দিনযাপন— শুধু এই অধ্যায়টিই একে এক অনন্য স্তরে পৌঁছে দেয়। দ্বিতীয়ত, বিপুল গুহ'র প্রচ্ছদ এবং মোট বারোটি রঙিন অলংকরণ একে শুধু উপন্যাস না রেখে এক শিল্পসুষমান্বিত সংগ্রহে পরিণত করে। আবারও বলি, এ এক ব্যর্থ প্রেমের বহুপ্রচলিত কাহিনি— যাতে নতুন কিচ্ছু নেই। তবে পুরোনো, চেনা জিনিসকেই তো বিপন্ন একাকিত্বে সবচেয়ে বেশি করে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। তাই যদি কখনও আকাশপারে মেঘের খেলা দেখে আপনার বড়ো একা লাগে, তখন এই বইটিকে হাতে তুলে নিতে পারেন। ছোট্ট বই, কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যেই আপনি এক চান্দের সাম্পান পেয়ে যাবেন— যা আপনাকে নিয়ে যাবে বিষণ্ণ একাকিত্ব থেকে অনেক দূরে।
সরল বিরহ মাখা মধুর প্রেমের গল্প। এই বুঝি প্রেম, এই বুঝি মিলন। কৃষ্ণ রাধার কাছে আর ফিসে আসেনি। যমুনার তীরে তমাল গাছের তলায় পূর্ণিমা রাতে বাঁশি আর বাজেনি। তবুও বেজেছে বাঁশি রাধার মনে।
সেই পাগল করা বাঁশির সুরে কাঁপে বাতাস, কাঁপে রাধা, কাঁপে জল, কাঁপে তমাল পাতা। আর কাঁপে আকাশ। একসময় মনে হয় সেই দুরন্ত দুর্দান্ত মেঘবর্ণ ছেলেটি ছুটে ছুটে আসছে বন-পাথার পেরিয়ে! এক সময় সে রাধার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর হাসিতে-কান্নায় আদরে-সোহাগে মানে-অভিমানে রাত ভোর হয়ে যায়। এ রাধার একান্ত নিজস্ব কানু, এ তাকে ছেড়ে থাকবে কী করে?
"একদেশে জন্মেছিল চম্পক, আর এক দেশে নীলকমল। তবু স্রোতে ভাসতে ভাসতে একদিন ওদের দেখা হয়ে গেল। ওদের মিলনই ছিল নিয়তি।"
"এক আঙুল মালা গাঁথে, আর এক আঙুল বাঁশি বাজায়। এখন মালাও গাঁথা হয় না, তাই তমালের নীচে কেউ আর বাঁশি বাজায় না।"
"কেউ কনকশয্যায় শুয়ে কাঁদে। কেউ ভূমিশয্যায়। কিন্তু চোখের জল এক।"
আমি প্রচলিত রিভিউ লিখতে বসিনি। শুধু বইয়ে উল্লিখিত রাধা আর কৃষ্ণের জীবাত্মা-পরমাত্মার অমর প্রেমের উপাখ্যানের কিছু ভালো লাগার চরণ শেয়ার করছি। সৌন্দর্যের অবতার রাধাকে দেখে নন্দের প্রথম উপলব্ধি "ওদের মধ্যে সবচেয়ে যে ফুটফুটে, যার মুখখানিকে পদ্ম বলে ভুল করে মৌমাছি এসে বসতে পারে.... " আবার ছোট্ট কৃষ্ণকে দেখে রাধার মন্তব্য -- "দেখ দেখ কী সুন্দর ছেলেটি, টানা টানা চোখ, তিলফুলের মতন নাক! দেখ দেখ বিশাখা, কী রকম খটখট করে হাসছে। " দুরন্ত থেকে দুর্দান্ত হওয়া কিশোর কানাইয়ের গায়ের বর্ণ লেখক চমৎকার উপমার আশ্রয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন। "শ্রাবণ মাসের মেঘের মতন গায়ের রঙ, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। "
আর সবশেষে পরিণত কৃষ্ণের রাধাকে দেখে সম্বিত ভুলে যাওয়ার সেই বর্ণনা -
"তার মাথার চুলে ছিলো সিঁদুরের টিপ, যেন সঙ্গে সজল মেঘে নতুন সূর্য উঠেছে। সোনার পদ্মের মতন তার মুখ, তাই দেখে চাঁদ লজ্জা পেয়ে দু'লক্ষ যোজন দূরের আকাশে চলে গেছে। তার কাজলটানা চোখ দুটি খুবই উজ্জ্বল অথচ যেন আলস্যমাখা। তার কোমর খুব সরু কিন্তু গুরুভার নিতম্বদেশ। সে রাজহংসীর মত ছন্দময় ধীর ভাবে হাঁটে... "
পুরো বইটিতে খুবই চমৎকার আলেখ্যযুক্ত আদি, অকৃত্রিম ভালোবাসার বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং শেষতম বিরহের অংশটুকু বরং খর্বাকারে দেয়া হয়েছে এবং উভয়ের অন্তিম পরিণতি উল্লেখিত হয়নি৷ সব মিলিয়ে ট্রাজিক এক উপন্যাস এবং চাঁদের কিরণে যমুনার পাড়ে তমাল গাছের নিচে দীপ জ্বালিয়ে রাধার যে পরিণতিহীন প্রতীক্ষা ; সেটি অবশ্যই পাঠককে কিছুক্ষণের জন্য এক অন্যরকম অনুভূতির খোঁচায় বিদ্ধ করবে।
এই বইটা পড়ার সময় যে অনুভূতি আমার হয়েছে তা আবেগ তাড়িত নয় একদম নিখাত অনুভূতি। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী আবহমানকাল রয়ে গ্যাছে বাংলার তমাল আর কদমের ঘোরে।আমি যেনো সেটুকু উপলব্ধি করতে পারছিলেম প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করার সময়। বইটা শেষ কেনো হল! শেষ না হলেই ভালো হতো।
সুনীল বাবুর লেখা "রাধাকৃষ্ণ" এক অমর প্রেমের আখ্যান। রোমিও- জুলিয়েট বা শিরিন-ফরহাদ এর মতো যে আখ্যানে আছে দুর্বার প্রেম, আছে বিরহ। এ আখ্যান রাধা ও কানুর। কানু বা কানাই তখনও শ্রীকৃষ্ণ হয়ে ওঠেনি। এ আখ্যান তখনের। এখানে নেই কোন অলৌকিক বর্ণনা। সুনীল বাবু একান্তই মানব প্রেমের আখ্যান লিখেছেন দারুন সাবলীল ভাবে।
সুনীলের লেখা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। কিছুদিন আগেও উন��র গভীর গোপন উপন্যাসটা পড়া হয়েছিল। ভালো লেগেছে। এছাড়া সুদূর ঝর্ণার জলে, ছবির দেশে কবিতার দেশে, সেই সময়, প্রথম আলো, পূর্ব পশ্চিম, অর্ধেক জীবন, মনের মানুষ, আত্মপ্রকাশ, অরণ্যের দিনরাত্রি সুনীলের লেখা এসব বই আমাকে মুগ্ধ করেছে।
কিন্তু লেখকের 'রাধাকৃষ্ণ' উপন্যাসটি পড়ে সুনীলকে যেনো এখানে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম। এতো সুন্দর উপমার ব্যবহার সুনীলের আর কোন উপন্যাসে পড়েছি বলে মনে হয় না। রূপ, প্রেম, কাম, বিষাদ সব ক্ষেত্রেই চমৎকার সব বিশেষণ লেখক ব্যবহার করেছেন। আগে বুদ্ধদেব গুহ পড়লে ভাবতাম আদরও এতো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায়! সুনীলের এই উপন্যাসটা এইক্ষেত্রে দারুন উপস্থাপন ছিল।
প্রেমের উপন্যাস পড়তে পছন্দ করলে এটা পড়তে পারেন অবশ্যই।
সারা ভারতবর্ষে শুধু নয়, বিশ্বসাহিত্যে প্রণয়কাহিনিতে যে নাম দুটি সবার আগে আসে তা হল-- রাধা-কৃষ্ণ। বাংলার নান পুরাণ, কাব্য গাঁথা ও লৌকিক গানে এ প্রণয় কাহিনি ছড়িয়ে আছে। বিজ্ঞজন ও ভক্তরা আপন করে রেখেছেন বহুদিন ধরে এই কাহিনি। তবে এই কাহিনি প্রথম নিখাঁদ গদ্যে তুলে এনেছেন লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কাব্য গাঁথা ও লৌকিক গান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে "রাধাকৃষ্ণ " বইটাতে গদ্য রুপ দিয়েছেন।
কৃষ্ণের শৈশব ও বেড়ে ওঠা, রাধার সাথে পরিচয়, বাল্যকালে বন্ধু ও ভাইয়ের সাথে নানান ঘটনা বহুল যে জীবন কাটিয়েছেন তার কিছু অংশ এখানে তুলে আনা হয়েছে। রাধাকৃষ্ণ কাহিনি চমৎকার এক গদ্য রুপ।
রেটিং ৩.৫ সহজ সরল সাদামাটা ভাষায় লেখা সেই আদ্যিকালের এক ভালোবাসাবাসির গল্প। রাধাকৃষ্ণ নিয়ে এতো এতো গান, কবিতা, বর্ণনা জানার কারণে আগেই সন্দেহ ছিল এইরকম শুষ্ক গদ্যে সুনীল যথাযথ মান দিতে পারবে কি না, প্রমাণও হলো ভয়টা নিতান্ত অমূলক ছিল না। বেদুনিয়াবি আবেগ লাগল না, বরং নিত্যিদিনের মন হারানোর কেত্তনই মনে হল। কিছু কিছু দৃশ্যে মনেই হবে না কানু ঈশ্বর, হৃদয়ঘটিত যন্ত্রণা যে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল সবখানের বাসিন্দাদের একইভাবে ভোগায়, এই সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস দিকটার জন্যই একখান তারা বেশি। রাইকে নিয়ে আর নাই বলি, সে কুল হারালো, সংসার হারালো, শেষমেশ যার জন্য এতো আয়োজন, সেই কানুরেও হারালো... সাধে কি আর "বনমালী, তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা" গায়! বইয়ের শেষপাতায় গিয়ে বুঝলাম ঈশ্বরের থেকেও তাই নশ্বর মানুষই উদার, তা না হলে সবকিছুর পর "আমার পরাণ যেমতি করিছে সেমতি হউক সে" এমন তুচ্ছ শাপ কেউ দিতে পারে?
রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কাহিনীর কথা একটু হলেও আমাদের জানা আছে।না জানা হলেও কিছু কিছু গান শুনে হয়তোবা আমরা এদের বিষয়ে ধারণা পেয়েছি। এদের প্রেমটা আসলে কিরূপ ছিল? জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে এই উপন্যাসটি। রাধা ও কৃষ্ণ।এদেরকে,মূলত কৃষ্ণকে আমরা হিন্দুধর্মের কোনো দেব হিসেবেই জানি। কিন্তু এই উপন্যাসে কোনো দেবদেবী নয় বরং দুজন মানব-মানবীর প্রেমকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। হ্যাঁ,তাদের মধ্যে যে প্রেম ছিল সেটা অস্বীকার করা যাবে না।তবে উপন্যাস পড়ে আমার যেটা মনে হয়েছে,মানসিক প্রেমের চেয়ে তাদের মধ্যে শারীরিক প্রেমটাই বেশী ছিল। আসলে দুটোই ছিল,তবে একটি সাইডকে একটু বেশীই হাইলাইট করা হয়েছে,তাই আমার কাছে এরকম মনে হয়েছে। সাধারণ প্রেমের উপন্যাসের চরিত্রদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়,এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। তবে এত কাঠখড় পুড়িয়ে,শেষে যে ফলাফলটা আপনি দেখবেন।তা দেখে আপনি হতাশ না হয়ে পারবেন না।ভাববেন,ঘটনাটা এরকম না হলেও পারতো। আচ্ছা এটা কি জানেন?
রাধা কিন্তু কৃষ্ণের এক দূরসম্পর্কের মামী ছিল।রাধার বিয়ে হয়েছিল,কৃষ্ণের মামা আয়ান ঘোষের সাথে। সবদিক বিবেচনা করে এটাকে একটি ট্র্যাজিক প্রেমের উপন্যাস বলা যায়।সত্যিই একটু বেশী অসাধারণ একটা উপন্যাস।
সমস্যা একটাই,যেটা আমার সবসময় হয়, উপন্যাসটা বড্ড বেশী ছোট,আর একটু বড় হলেই বা ক্ষতি কি ছিল?
দোল উপলক্ষ্যে বইটির সন্ধান পাই। তারপর পড়ে দেখি যে প্রশ্নের উত্তর পাবো ভেবেছিলাম, তা এখানেও অধরা। নেহাত লোককথা, কীর্তনে, হয়ত পুরাণেও বোধকরি বলে যে রাধাকৃষ্ণের প্রেম যুক্তি দিয়ে বিচার না করতে। তা সে শুধু রাই আর কানুই কেন, সব প্রেমই যুক্তির অনধিগম্য। তবু পড়তে বসে মনে হয় এ তো রীতিমত ইভটিজিং, ইনসেস্ট, অ্যাডাল্ট্রি..রাধা কি স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত নইলে এমন হেনস্থাকারীর প্রেমে পাগল হয়! তবু ওই যুক্তি খাটে না শেষমেশ। কত গান, কবিতা,পদ চিরায়ত হয়ে যায় শুধু এই প্রেমকে সম্বল করে। কত কদম গাছ, যমুনার তীরে আসার আকুল আহ্বান, সাস নানদিয়ার গালি তুচ্ছ করা এই সব কিছু চিরকালীন হয়ে থেকে যায়। ভারতের ভাগ্যনিয়ন্তা তুখর কূটনীতিক বাসুদেবকে আর কজনই বা মনে রেখেছে! গোঠের রাখাল, ঘোষজায়া শ্রীমতির বিবাহবহির্ভূত, বয়সে ছোট প্রেমিকটিই লোকপূজ্য, আজও। শুধু দ্বারকানাথ, পার্থসারথি,কৃষ্ণাসখা আর কোনও দিনও বৃন্দাবন ফিরল না কেন, তার কতবার মনে পড়েছিল শ্রীরাধিকাকে সে প্রশ্নের উত্তরে ইতিহাসের মতন এই বইটিও নীরব।
রাধা কৃষ্ণ এর কাহিনী এত বিস্তারিতভাবে আগে পড়া হয়নি। তবে এখানেও পুরো কাহিনী নেই। শেষ হবার পর মনে হচ্ছিল, কেন এমন হুট করে বইটা শেষ করে দিল। তাদের দুজনের জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাহিনী কেন দিল না! সুনীলের সহজ সরল লেখা পড়তে খুব ভালো লাগলেও মাঝে মাঝে পুরাতন কাব্য-শ্লোকের উপমার সাথে আধুনিক ভাষাটা ঠিক যাচ্ছিল না যেন। তবে বইটাতে ব্যবহৃত ছবিগুলো খুবই সুন্দর। আমি আসলে ছবি দেখেই বইটা কিনেছি। রাধাকৃষ্ণ এর কাহিনী আগেও পড়েছি, কাব্যে-গদ্যে, এখানেও আবার পড়লাম, তবু আজ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারলাম না এই কাহিনী এত বিখ্যাত হবার কারণ কি!
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের জগতে এক উজ্জ্বল জোতিষ্ক । কবি সুনীল অপেক্ষা ঔপন্যাসিক অথবা গল্পকার সুনীল ই বেশী জনপ্রিয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার আঙ্গিক, রচনা শৈলী, রিষয়বস্তু সবই আমাদের মনে দাগ রেখে যায়। এই লেখকের লেখা রাধাকৃষ্ণ বইটিও এর ব্যতিক্রম নয় । আজ অবধি হিন্দু ধর্মের এই দুই প্রাচীন চরিত্রদের নিয়ে গবেষণা এবং লেখালিখির শেষ নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা রাধাকৃষ্ণ সেই ভীড়ের মধ্যেও সতন্ত্র । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বলিষ্ঠ এবং বাস্তবমুখী । তাই তাঁর এই ব্যতিক্রমী বিষয়ের লেখাটি পড়বার জন্য কৌতুহল জাগে। অবশ্যই বইটি হতাশ করেনি।বহু গবেষণার ফল এই বই। লেখক এই বইতে রাধা এবং কৃষ্ণের প্রথম মিলন থেকে শেষ মিলন অবধি তুলে ধরেছেন। এইখানেই বইটির নামকরনের সার্থকতা । সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুললিতছন্দে রাধাকৃষ্ণের প্রণয় ব্যক্ত করছেন । আমি তাঁর একজন গুণমুগ্ধ পাঠিকা তাই চাহিদাও বেশী। তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা এই বহু লিখিত এবং বহু পঠিত ঘটনাবলি সম্বন্ধে কিছু লেখা থাকলে আরো ভাল লাগত।
প্রেম মানুষের একটি ‘দৈব গুণ’। দেবকুলেও এই প্রেমের সদর্প পদচারণা, যার বিরহ ব্যথায় কাতর হয়েছিলেন রাধা-কৃষ্ণও। শ্রীকৃষ্ণের প্রেমের আখ্যান জানে না এমন কম মানুষ-ই খুঁজে পাওয়া যাবে। তাও মানুষ এই আখ্যান বার বার জানতে চায়।
রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী নিয়ে মধ্যযুগে রচিত বাংলা ভাষার প্রথম কাব্য গ্রন্থ 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'। এটিই প্রথম বাংলায় রচিত কৃষ্ণকথা বিষয়ক কাব্য।
তার পর বহুজন বহুভাবে এবং বহুভাষায় এই রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে নিয়ে লিখেছেন এবং বলেছেন।
লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও চেয়েছেন, এই অমৃত আখ্যান মানুষকে সহজভাবে জানাতে এবং বুঝাতে। আমি মনে করে তাতে তিনি সম্পূর্ণ সফল হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধার প্রেমের আখ্যান খুব সহজভাবে বলেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আমার কাছে সত্যি বলতে দারুণ লেগেছে। এই বইয়ের আরেকটা ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে এখানে অলৌকিক কিছু বলা হয় নি বা তুলে ধরা হয়নি ; সবকিছু সাধারণ এবং সাদামাটা ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
যায়হোক আপনারা যারা এখনো বইটা পড়েননি, তারা পড়ে নিতে পারেন। বেশ ভালো সময় কাটবে।
এই ছোট্ট সুন্দর বইটি শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধাকে নিয়ে। ইতিহাসের জটিল সব প্রেক্ষাপট সহজ করে বর্ণনায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জুড়ি মেলা ভার! যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল তাঁর সময় ট্রিলজি। এরপর তাঁর ছবির দেশে কবিতার দেশে এবং ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গের কথা না বললেই নয়! সেই ধারাবাহিকতায়ই পৌরাণিক কাহিনীগুলোকে জানার আগ্রহ থেকে এই ছোট্ট সুন্দর বইটি পড়া।
কৃষ্ণ এবং রাধাকে নিয়ে যতটুকু জানি তার বেশিরভাগই ছোটবেলার কার্টুন নেটওয়ার্কের বিভিন্ন কার্টুন দেখে পাওয়া। তখন থেকেই ভারতীয় মিথোলজি নিয়ে আগ্রহ ছিল। এবার ভাবলাম আগ্রহকে বাস্তব করি! আস্তে আস্তে মহাভারতও পড়া শুরু করি। যদিও রাধার এই কাহিনীগুলো মহাভারতের কাহিনী নয়। তাও সুনীল যেহেতু লিখেছেন কাজেই বই পড়ে ফেলতে আপত্তি নেই!
আমার এই বইটি বাংলাদেশের মাটিগন্ধা থেকে প্রকাশিত। তারা সুনীলের বেশ কিছু বই প্রকাশ করেছে। বইটা কেনার পরে জানতে পারলুম যে কলকাতার বইটার প্রচ্ছদ নাকি বেশি কুটু! আফসোস!
ভারতবর্ষের ইতিহাসে বহুকাল ধরে রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়কাহিনী ছড়িয়ে আছে নানান পুরাণ ও কাব্যে, গ্রাম্য-গাথায়, লৌকিক গানে। পরম পণ্ডিত বা ভক্ত থেকে শুরু করে অতি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত হাজার হাজার বছর এই কাহিনীকে আপন করে রেখেছেন। তবে এখনও অবধি বাংলা গদ্যে এই কাহিনীর কোনো নির্ভরযোগ্য ও সমগ্র রূপ রচিত হয়নি। সুলেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সমস্ত কাব্য মন্থন করে এই রসসমৃদ্ধ ভাষ্যটি রচনা করেছেন।
দেবদেবী পরিচয়ের আড়ালে রাধা ও কৃষ্ণের যে সাধারণ মানবের একটি জীবন ছিল, সেই জীবনকে উপন্যাসের পাতায় এঁকেছেন লেখক। এখানে কোনো অলৌকিকতার প্রভাব নেই, এঁরা চিরকালের প্রেমিক-প্রেমিকা। বইটি সমাপ্ত করার পরেও পাঠকের মনে একটু অতৃপ্তি থেকে যাবে আর এই অতৃপ্তিই এই ভালোবাসাকে অমর করেছে।
বইয়ের মাঝে মাঝে অফসেট পেপারে পৌরাণিক কিছু চিত্র বইটিকে বিশেষ করেছে।
ছোট বই। রাধাকৃষ্ণের জীবনের বিশেষত, রাধার সঙ্গে কৃষ্ণের কাটানো মুহূর্তের কিছুটা অংশ তুলে ধরা হয়েছে। যেহুতু পুরো গল্প টা ডিটেইলস এ অনেক জায়গাতেই আমরা চর্চা করে থাকি সেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অসাধারন বিবরণের মাঝে হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়ায় অভিমানের সাথে জানাচ্ছি এই বই টা আমার ঠিক মন ভরাতে পারেনি।
চেনা প্রেমের গল্প এটি... এর যেনো সব চেয়ে মধুর এর বিচ্ছেদ ও বিরহ... ছোট্ট বই শেষ করে বুকের ভিতরের কান্না ঠেলে বেরোতে চায়... কৃষ্ণ কানু থেকে রাজা হল আর রাধা তার পথ চেয়ে বসেই রইলো... চিরকালের ছাড়া ছাড়ি