দুই বাংলা যখন এক ছিল, সেই সময়কার গল্প ‘সকালবেলার আলো’। পদ্মাপারের ছোটো এক রেল-কলোনিতে বেড়ে উঠছে কিশোর নীলমাধব ইস্কুলের নানা বন্ধু-অবন্ধুর সংসর্গে। হঠাৎ তার প্রিয়তম বন্ধুর মৃত্যু, সেই বন্ধুর স্নেহশীলা বিধবা দিদিরও ফিরে যাওয়া তার ছেড়ে-আসা শ্বশুরবাড়িতে, আর এক বন্ধুর সপরিবার বদলি হওয়া অন্য শহরে একেবারেই একলা হয়ে পড়ে নীলমাধব। এর পরপরই ঘটল অবিশ্বাস্য এক দেশভাগ। পুজোর ছুটিতে দেশের বাড়িতে গিয়ে একমাস থাকবার যে আনন্দে মশগুল থাকত নীলমাধবরা, এবারেও সেটা ঘটল, কিন্তু যেন শেষবারের মতো। এবারের থাকাটা মাত্র সাতদিনের। ওরই মধ্যে তার প্রিয় এক মামিমার অভাবিত অন্তর্ধানের তীব্র আঘাতে বিপর্যস্ত নীলু। কষ্টে-আনন্দে মেশানো সেই গল্প ‘সুপুরিবনের সারি’। বিচ্ছেদ, মৃত্যু, দুঃখবেদনার অভিজ্ঞতা বহন করে নীলমাধব এখন কলকাতার মহানাগরিক আবর্তে যেন নতুন জীবন দেখতে পায়। কলেজ বা হস্টেলে উজ্জ্বল বন্ধুদের মধ্য দিয়ে নতুন দিগ্দর্শন হতে থাকে তার সংস্কৃতি আর রাজনীতির জগতে, আবার ওই একই সঙ্গে তরুণ মনে স্বাভাবিক প্রেমের উন্মেষ আর তার অচির-ব্যর্থতায় পৌঁছানো এইসব নিয়ে ‘শহরপথের ধুলো’। দেশভাগের আগে-পরের স্মৃতিমাখা এই ত্রয়ী কিশোর উপন্যাস শঙ্খ ঘোষের অনন্য এক সৃষ্টি।
Shankha Ghosh (Bengali: শঙ্খ ঘোষ; b. 1932) is a Bengali Indian poet and critic. Ghosh was born on February 6, 1932 at Chandpur of what is now Bangladesh. Shankha Ghosh is regarded one of the most prolific writers in Bengali. He got his undergraduate degree in Arts in Bengali language from the Presidency College, Kolkata in 1951 and subsequently his Master's degree from the University of Calcutta. He taught at many educational institutes, including Bangabasi College, City College (all affiliated to the University of Calcutta) and at Jadavpur University, all in Kolkata. He retired from Jadavpur University in 1992. He joined the Iowa Writer's Workshop, USA in 1960's. He has also taught Delhi University, the Indian Institute of Advanced Studies at Shimla, and at the Visva-Bharati University. Awards: Narsingh Das Puraskar (1977, for Muurkha baro, saamaajik nay) Sahitya Akademi Award (1977, for Baabarer praarthanaa) Rabindra-Puraskar (1989, for Dhum legechhe hrit kamale) Saraswati Samman for his anthology Gandharba Kabitaguccha[1] Sahitya Akademi Award for translation (1999, for translation of raktakalyaan) Desikottam by Visva-Bharati (1999) Padma Bhushan by the Government of India (2011)
১.সকালবেলার আলো (৪/৫)- শীতের সকালের একটা মিঠেকড়া রোদ থাকে না? যে রোদে বসলে আরামে চোখ বুজে যায়,উঠতে ইচ্ছে করে না, অপরিসীম আলস্য ঘিরে ধরে,পৃথিবীটাকে মনে হয় খুব সুখের! অথচ সেই রোদটা চটজলদি হারিয়ে যায়, যেমন আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় শৈশব। নীলুর তথা লেখকের ছেলেবেলার গল্প হচ্ছে "সকালবেলার আলো।" শৈশব আনন্দের সময়, কিন্তু তাতেও থাকে অপ্রাপ্তি, অনেক ছোট ছোট দুঃখ। এই আনন্দ আর দুঃখের দ্বৈরথেই বড় হই আমরা। লেখকের ভাষা এ বইতে সকালের স্নিগ্ধ রোদের মতো মিহি ও মিষ্টি।
২.সুপুরিবনের সারি (৪.৫/৫)- সবকিছু হারানোর পরেও একটা মানুষের কী থাকে? ফেরার মতো একটা ঘর থাকে, সেই ঘরের মানুষজন থাকে আর থাকে স্মৃতি। কেমন হবে মানুষের সেই ঘরটুকু কেড়ে নিলে? তার স্মৃতিটুকু কেড়ে নিলে? ঘর হারানোর মুহূর্তে কেমন লাগে তার? যা ছিলো হাতের তালুর মতো চেনা, যা ছিলো নিজের অস্তিত্বের অপরিহার্য অংশ- এখন তাই পর হয়ে যাচ্ছে। "আমার ঘর" এ ফেরার অনুমতি নেই আমারই। কেননা এখন সেটা "বিদেশ" হয়ে গেছে!! ১৯৪৭ এর দেশভাগের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে লেখা "সুপুরিবনের সারি" বুকে তীব্র এক আলোড়ন তোলে। কী নিঃস্পৃহভাবে কী ভয়ংকর নিষ্ঠুরতার গল্প বলে গিয়েছেন লেখক!!
৩.শহরপথের ধুলো(৪/৫) -এটা স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের শহর কলকাতার গল্প। নীলু এখন অনেক বড়। দেশভাগ হয়ে গেছে। শহরজুড়ে উদ্বাস্তু।মানুষের চাকরি নেই। চারিদিকে হাহাকার। জীবনে এরই মধ্যে বসন্ত আসে নীলুর। শহরের ধুলো মেখে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে সে। স্বপ্ন ভাঙে,হৃদয় ভাঙে মানুষের। নীলুর শৈশব, পদ্মা, সুপুরিবন, দেশভাগ, হতাশা, গান্ধীহত্যা, প্রেম - সবকিছু মিলে তোলপাড় ঘটে যায় জীবনে, জন্ম হয় এক কবির।
শঙ্খ ঘোষের গদ্য এমনিতেই আমার খুব প্রিয়। সেই মিঠে গদ্যে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সোনালী সময় অর্থাৎ কৈশোরের গল্প যে খুব দারুণ হবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কথার আঁচড়ে আঁচড়ে মুহূর্ত সৃষ্টিতে তিনি অতিশয় দক্ষ শিল্পী। তাই তাঁর লেখা পড়লে মনের ভিতর একটা চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়ে যায়।
কিশোরকথা' বইটি তিনটি কিশোর উপন্যাস সংকলিত হয়েছে। যদিও তিনি উপন্যাস দাবি করেছেন তবে আমরা জানি যে এ শিল্পীর নিজেরই জীবনের আত্মকথন। আমি এখানে তিনটি আলাদা উপন্যাসিকা না ভেবে সব মিলিয়ে একটা উপন্যাসের মতোই পড়েছি। ছেলেবেলা থেকে কৈশোরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত কিশোরকথার বিস্তৃতি। সকালবেলার আলোর নির্মল ছবি দিয়ে গল্পের শুরু, তারপর সুপুরিবনের সারিতে নিজেকে হারিয়ে অবশেষে শহরপথের ধুলোতে নিজেকে আবিষ্কার মধ্য দিয়ে এই চমৎকার আত্মকথনের ইতি।
কিশোরবেলার স্বপ্ন স্বপ্ন সময়টা নিয়ে লিখলেও লেখক বাস্তবতার খেই হারিয়ে শুধু স্বপ্নময় জগতের কথা লিখেননি। বরং স্বপ্নে ডানা মেলে উড়তে থাকা কিশোর কিভাবে বাস্তবের ধুলোমাখা মাটিতে পা দিয়ে হাঁটতে শিখে সেই কাহিনী ই তিনি বলেছেন। তাই আমাদের হ্নদয় পড়তে পড়তে বিষণ্ণ হয়ে উঠে।কারন আমরা নিজেরাও ডানা ভেঙে লুসিফারের মতো স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পতিত হয়ে বিহ্বল সময় করে এসেছি। কেউ কেউ তো এখনো সেই পতনের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি।
কিশোরকথা' শঙ্খ ঘোষের অনুরাগীদের জন্য তো বটেই, আমার মতে কৈশোরপার করা প্রত্যেকটি পাঠকের জন্য অবশ্যপাঠ্য।
"আবার আমাদের দেখা হবে কখনো দেখা হবে তুলসীতলায় দেখা হবে বাঁশের সাঁকোয় দেখা হবে সুপুরি বনের কিনারে আমরা ঘুরে বেড়াবো শহরের ভাঙা অ্যাসফল্টে অ্যাসফল্টে গনগনে দুপুরে কিংবা অবিশ্বাসের রাতে কিন্তু আমাদের ঘিরে থাকবে অদৃশ্য কত সুতনুকা হাওয়া ওই তুলসী কিংবা সাঁকোর কিংবা সুপুরির হাত তুলে নিয়ে বলব, এই তো, এইরকমই, শুধু দু-একটা ব্যথা বাকি রয়ে গেল আজও যাবার সময় হলে চোখের চাওয়ায় ভিজিয়ে নেবো চোখ বুকের ওপর ছুঁয়ে যাবো আঙুলের একটি পালক যেন আমাদের সামনে কোথাও কোনো অপঘাত নেই আর মৃত্যু নেই দিগন্ত অবধি"
কিশোরকথা বইটি শঙ্খ ঘোষের আত্মজৈবনিক উপন্যাসত্রয়ী। প্রথম বই 'সকালবেলার আলো' সকালের আলোর মতই মিষ্টি ও বিষাদময়। এখানে পদ্মপাড়ের নীলমাধব ও তার বন্ধু হারানোর গল্প বলা হয়েছে। পরের বই 'সুপুরিবনের সারি' আমার সবচেয়ে প্রিয়। এখানে নীলুরা সবাই এপার বাংলায় পূজো করতে এসেছিল, এসেই ফুলমামীর সাথে দেখা, যে কিনা পরবর্তীতে হারিয়ে যায়। একদিকে দেশভাগ আরেকদিকে ফুলমামীকে হারানো, খুবই বিষাদময় ঘটনা। সবার শেষে 'শহরপথের ধুলো'। এখানে দেশভাগের পরবর্তী ঘটনা। নীলু একটা হোমে ভর্তি হয়, সেখান থেকে পড়াশুনা করে এবং মাঝে মাঝে চিন্ময় কাকার সাথে এক দুইবার মিছিলে বের হয়। গান্ধীজীর হত্যা থেকে শুরু করে সত্যেন বসের সাথে দেখা হয় নীলুদের।
উপরের কবিতাটা আমার খুবই পছন্দের। আরেকটা কবিতার অংশবিশেষ ভালো লেগেছে। এটা আমাদের নীলু লিখেছে--
" সন্ধ্যাবেলার অন্ধকারে একলা বুকে তুলো শহরপথের ধুলো ম্লান করে দেয় যতই সে তো ততই করে ঋণী তাকেই যেন চিনি...."
বইটার প্রচ্ছদ আমার ভালো না লাগলেও অন্যসব কিছুই ভালো লেগেছে। বাঁধন থেকে শুরু করে, ভিতরের কাগজ, ছোট ছোট ইলাস্ট্রেশন সবকিছুই অনেক ভালো হয়েছে। বলতেই হচ্ছে বাতিঘরের চমৎকার একটা কাজ।
'"কেউ যে রাগ করে না এটা ভালো। পৃথিবীতে যদি কেউ কারো ওপর রাগ না করত তাহলে কত যে ভালো হতো, সেকথা কাউকে বোঝানো যায় না"'
এই হালকা শীত-শীত বিকেলে বইটা পড়ে শেষ করলাম।। বইটা শেষ করার একদম উপযুক্ত সময়.... পড়তে পড়তে বেশ ভালো লাগা কাজ করছিল। লেখক শঙ্খ ঘোষ যেন মায়া মেখে দিয়েছেন পুরো গল্পতে।। কি সুন্দর-স্নিগ্ধ তার লেখা 🌻 আর সাথে ছিল সুন্দর সব illustration, যার কারণে পড়তে আরো ভালো লাগছিলো। তবে সবসময় কি ভাল লাগা থাকে..?? আনন্দের পরে আসে মর্মপীড়া, ঠিক যেমন আলোর পরে অন্ধকার।। এই বইতেও ঠিক তেমনি৷ ভাল লাগতে লাগতে শেষে এসে কেমন মন খারাপের এক বিষণ্ণ বাতাস লাগিয়ে দিয়ে গেলো...
দুই বাংলা যখন এক ছিল, এ হলো সেই সময়ের গল্প।। এ হলো নীলু, বরুণ, কেশব-এর গল্প।। তারা তিনজনে মিলে এক।। যেখানে যাবে একসাথে যাবে.... তাদের বাচ্চা-বাচ্চা কর্মকাণ্ড, তাদের বাচ্চা-বাচ্চা সব প্রশ্ন এবং চিন্তা, বাচ্চা-বাচ্চা সব উপলব্ধি..... তারা পদ্মার ধারে ঘুরতে যায়, একসাথে খেলে, ক্লাসে একসাথে বসে, কিছু করার পরিকল্পনা করলে একসাথে করে।। কিন্তু ঐ যে বললাম? সবসময় কি একসাথে থাকা সম্ভব?? নিয়তি যে কোথায় নিয়ে ফেলে তা আমরা কেউ জানি না
'"ভাবতে ভাবতে আকাশের দিকে চোখ ফেরাল নীলু। আজও তেমনি ছোটো ছোটো ঢেউয়ের মতো হাওয়া লাগছে গায়ে, হালকা হয়ে যায় মন। আচ্ছা, মন বলে কিছু আছে না কি? কোথায় থাকে মন? স্বাস্থ্য-বই পড়ে তো শরীরের সব জানা গেছে, তার মধ্যে মনের কথা নেই তো! কিন্তু নীলুর মনে হয় যে বুকের কাছে বুকের নীচে যেন মনের বাসা। আর এখন যেন সেই বাসা ছেড়ে মন বেরিয়ে পড়েছে দূরের ���থে, বুকটা তাই হালকা লাগে। বেরিয়ে পড়েছে ওই ইস্কুলবাড়িতে, ইস্কুলবাড়ির পাশ কাটিয়ে বটগাছের মাথার ওপর দিয়ে আকাশে! আকাশে আকাশে খেলা করে মন"'
---------------------------------------
** সুপুরিবনের সারি **
"সুখের দুটি পায়রা এসে বসছে জুড়ে একটি ডাল আমার সেথা কীই-বা অধিকার! জাগাই কেন বৃথাই সেথা মৃত আশার ব্যর্থ তাল মনোমাঝেই থাক্ সে হাহাকার"
'সকালবেলার আলো'র কিছুদিন পরের এই গল্প। এটি হলো স্বাধীনতার পরের গল্প, যেখানে দু-টুকরো হয়েছে দেশ। "সকালবেলার আলো" গল্পের নীলুকে পাব আমরা এখানে। নীলু পুজোর ছুটির সময়ে চললো মামাবাড়িতে পুজো করবে বলে। কিন্তু এইবার সেই আমেজ নেই। কারণ এইবার তাদের সাথে যাচ্ছে না ছোটোমামা, মেজোমামা। অর্থাৎ অনেকের সাথে কাটানো পুজোর আমেজটা ঠিক নেই। যার কারণে নীলুর বেশ মন খারাপ। কিন্তু এখানেও নীলুর ছুটে বেড়ানোর কমতি ছিলো না। কিন্তু বাড়ির সকলে বলাবলি করছে তারা নাকি কলকাতায় চলে যাবে, কারণ দেশ ভাগ হয়েছে এবং এই দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে এবং পাকিস্তানিরা দখল করে রেখেছে দেশটি।। তা নিয়েও নীলুর দুশ্চিন্তার সীমা নেই। সে ভাবে, তাহলে কি আর আসা হবে না এই গ্রামে?? এই গ্রামের স্নিগ্ধ, সবুজ গন্ধ কি আর পাওয়া হবে না??
প্রথম বইটির চেয়ে এই বইটিতে লেখা বেশ পরিপক্ব মনে হলো। বেশ ভাল লাগলো পড়তে।। অনেক অংশ ছিলো যেগুলো ভাল লাগার কারণে বারবার পড়েছি।। এমন বইগুলো সবসময় একটা ভাল অনুভূতি দেয়। পড়তে পড়তে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। আর শঙ্খ ঘোষ যেন কিছু সময়ের জন্য আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন 🌻🌻
"সকালবেলার ওই পাখি যে উড়তে আমায় ডাকছে নিজে সেই কথাটা বলব আমি কাকে! এসব তো কেউ বুঝবে না গো সবাই আমায় বলবে পাগল গোপন কথা গোপনে তাই থাকে"
-----------------------------------------
** শহরপথের ধুলো **
"সন্ধ্যাবেলার অন্ধকারে একলা বুকে তুলো শহরপথের ধুলো ম্লান করে দেয় যতই সে তো ততই করে ঋণী তাকেই যেন চিনি"
"সুপুরিবনের সারি" পেরিয়ে এবার নীলু চলে এলো কলকাতাতে। দেশভাগের পরে এবার নীলুর মতো অনেকেই চলে এলো কলকাতায়। নীলু বাবা-মা ভাবতে থাকলো নীলুকে লেখাপড়ার জন্য কোথায় দেওয়া যেতে পারে। পরে তারা ঠিক করলো একটা হোস্টেল। আসলে একে হোস্টেল বলা ঠিক হবে না, এটাকে নাম দেওয়া হয়েছে "হোম"। অনেক সন্ন্যাসী এই হোম পরিচালনা করেন। এই সন্ন্যাসীর অনেকে শিক্ষক, অনেকে বাচ্চাদের দেখবালের দায়িত্বে, অনেকে বাচ্চাদের সমস্যার কথা শুনে, এমন এক-একজনের এক-একরকমের দায়িত্ব। তো এখানে এসে ভালো চলতে থাকে নীলুর, অনেক বন্ধু মিলে। এই " হোম" এর মজার বিষয় হলো এখানের বাচ্চারা অনেক সময় ধরে বাইরে থাকলেও কেউ কিছু বলে না।
তো "সকালবেলার আলো" এবং "সুপুরিবনের সারি" এর পরে নীলুর গল্পের শেষ হলো এই "শহরপথের ধুলো" দিয়ে। এই গল্পে শেষের দিকে আছে রক্তারক্তি। কারা যেন গান্ধীকে মেরে ফেলেছে এবং তা নিয়ে শুরু হলো মিছিল।
শঙ্খ ঘোষের এই গল্পেও ছিল মায়া লাগানো পরিবেশ। উনি এত সুন্দর করে গল্পটা বলেন যেন পাঠককে জড়িয়ে রেখেছেন গল্পের সাথে। প্রথম দুই গল্পের মতো এটাতেও মুগ্ধ হলাম। বেশ ভালো লাগলো। মাঝেমাঝে নিজকে নিলুর মতো মনে হচ্ছিল। শঙ্খ ঘোষ আমাদের নিয়ে চলেছেন যেন কিশোর কালে এবং শুনিয়েছেন কিশোরকথার গান। এই যে তিনটা উপন্যাসের যাত্রা(সকালবেলার আলো, সুপুরিবনের সারি এবং শহরপথের ধুলো), এই যাত্রা অনেকদিন মনে গেঁথে থাকবে এবং অনেকদিন মনে থাকবে নীলু কথা 🌻
এ বছরটা ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে আর ছোটদের বই পড়তে পড়তেই কাটিয়ে দিলাম। শৈশবের বেশ একটা সময় কেটেছে দাদাবাড়িতে।সেই শীতের সকালে টিনের চালে টুপ টুপ শিশিরের শব্দে ঘুম থেকে উঠতাম,দাদার হাত ধরে দরগাহপাড়া যেতাম পুরি-ডাল দিয়ে নাশতা করতে।দাদার সাথে বাগান করতাম,দাদা মাটিতে চিহ্ন এঁকে দিয়ে বলতেন- "দাদা,এইখানে ঢেঁড়সের বিচি তিনটা করে বুনে দিও",গরমের দুপুরে নদীতে দাদাকে আঁকড়ে ধরে গোসল করতাম,দাদীর কয়টা মুরগী খোপে ঢুকলো খেয়াল রাখতাম। এরপরে ঢাকাবাসী হওয়ার পর ভাই-বোনেরা সব দাদাবাড়িতে জড়ো হতাম প্রতি ঈদে,হই-হুল্লোড় হতো,মারামারি-কান্নাকাটি-হাসাহাসি--সে কি জমজমাটি!
দাদা আর নেই।আমরাও কী আর আগের মতো আছি?সেই জমজমাটি ভাব শীতের শিশিরের মতোই উবে গেছে। তবুও তো যাই দাদাবাড়ি,দরগাহপাড়া যাই,পুরি ডাল খাই,নদী দেখি আর স্মৃতিতে বাঁচি। তবুও তো নিজের বাপ-দাদার ভিটা আছে বারেবারে ফিরে যাওয়ার আর ফিরে চাওয়ার?
নীলু তথা লেখকের সেই সুযোগটুকু ও ছিলো না।কিশোরকথা বইটিতে লেখকের শৈশব-কৈশোরের নানা স্মৃতি উঠে এসেছে তিনটি মায়া মায়া গল্পের মাধ্যমে। ১.সকালবেলার আলোঃ গল্পটি সকালের আলোর মতোই মিষ্টি আবার ঝুপ করে নামা সন্ধ্যার মতোই বিষাদময়।বন্ধুরা মিলে ঝাঁকা ভর্তি ইলিশ মাছ কেনার আনন্দময় ঘটনা থেকে বন্ধুর জ্বরের জন্য বরফ কেনার মতো আকস্মিক পরিবর্তন-ই বুঝি জীবন। ২.সুপুরিবনের সারিঃ নীলু এখানে একটু বড়ই।আমার মতোই সে পুজোর ছুটিতে প্রতিবার নানাবাড়ি যায়,হইহুল্লোড় করে,কিন্তু এবারের নানাবাড়ি আসাটা বড়ো আলাদা,দেশটাই যে আলাদা হয়ে যাচ্ছে।পরের বার কি আসতে পারবে সে?আর কোনোবার কি ফিরে আসতে পারবে?দেশ ছেড়ে যত দূরেই যাক সে,নানাবাড়ির ওই সুপুরিবনের সারি সবসময় তার মনের সীমা ঘেঁষে থাকবেই।
৩.শহরপথের ধুলোঃ নীলুর কৈশোরে এবং কলকাতা শহরে পদার্পণ। যতোই তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক হাওয়া নীলুর গায়ে লাগুক না কেন,আদৌতে নীলু শহরপথের ধুলোর মতোই-কলকাতার বুকে থাকলেও ফাঁক পেলেই উড়ে যায়।কোথায়? সেই ফেলে আসা দেশের বাড়িতেই হয়তোবা।দেশের সকালবেলার আলোতে বা সুপুরিবনের সারির মাঝে।
সবকিছু মিলিয়ে ভারি মিষ্টি,মায়া আর বিষাদে মাখানো বইখানা। নিজে রিলেট করতে পেরেছি জন্যেই মনে হয় আরো বেশি ভালো লেগেছে।
ভালো নাম নীলমাধব। সবাই ডাকে নীলু। ছোট্ট নীলু স্কুলে পড়ে। সেখানে তার আরো দুইটা বন্ধু আছে কেশব,বরুন। তারা তিনটি তে মিলে দারুণ সময় কাটায়। খুব চমৎকার ভাবে হেসে খেলে পার হয়ে যাচ্ছিল তাদের সময়। কিন্তু হঠাৎ একটা ঝড় এলো ছোট্ট নীলুর জীবনে! নীলুর রঙিন শৈশবকে ফিকে করার চেষ্টা করল সেই ঝড়!
শঙ্খ ঘোষের লেখার সাথে পরিচয় অনেক আগে। কিছুদিন আগে উনার বই "ছোট্ট একটা স্কুল পড়েছিলাম"। বইটা অসম্ভব ভালো লেগেছিল। লেখকের লেখাগুলো যেন লেখা নয়,মুক্তো। এত দারুণ লেখনী। সেই চমৎকার লেখনীর বজায় ছিল " সকালবেলার আলো" বইটাতে। একেবারে মুগ্ধ করে রাখে বইতে। আত্মজৈবনিক উপন্যাসের প্রথম বইটা দারুণ লাগলো।
২) সুপুরিবনের সারি
ছোট্ট নীলু মামা বাড়ি যাচ্ছে পূজোয়। প্রতি বছর যায় তারা। খুব হুল্লোড় হয়,পূজা মানেই তো আনন্দ। তাই এবারো নীলু খুব আশা নিয়ে বসে আছে, আগের সেই হুল্লোড় আরেকবার ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখে তার ভাই বোনরা কেউ আসে নি। শুধু মামা মামি এসেছে। ফুলোমামি ও কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে। এই নিয়ে সবার মন খারাপ। এবার নীলু প্রথম আঘাত পেল ভাই বোনদের না পেয়ে,দ্বিতীয় আঘাত টা দিল বন্ধু হারুন। কারণ নীলু মামা বাড়ি গেলে প্রতিবার হারুন দেখা করতে আসে,দুই জন মিলে গল্প গুজব মজা করে। কিন্তু এবার একটা বারের জন্য হারুন এলো না নীলুদের বাড়িতে।
ভাই বোন কেউ না থাকায় পূজোয় আগের আমেজ নীলু পাচ্ছে না। চারপাশ টা কেমন তার অচেনা লাগছিল। পরিচিত অনেক মানুষ নেই। যারা আছে তারা সবাই আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছে। বড়রা সবাই আলোচনা করছে দেশ ভাগ হয়ে গেছে!
শ্রদ্ধেয় লেখক শঙ্খ ঘোষের কিশোর সিরিজের তৃতীয় বই এটা। প্রথম দুইটা মত এটাও অসাধারণ ছিল। তবে কেমন যেন একটা বিষাদ মাখা গল্পটা। দেশ ভাগের বিষণ্ণ একটা গল্প। যে দেশ কে আমি হাতের তালুর মত চিনি, জানি সে দেশে আমি আগন্তুক! কি অদ্ভুত! কি নির্মম!
৩) শহর পথের ধুলো
ছোট্ট নীলু বড় হয়েছে। এমন তাকে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য জায়গায় পাড়ি জমাতে হল। কারণ এখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। নতুন দেশে এসে নীলুরা ভারি বিপাকে পড়ল। দূর সম্পর্কের এক দিদার বাড়িতে উঠল সবাই মিলে।
ছোট্ট বাড়ি লোক জন অনেক তাই নীলু পড়ার কথা চিন্তা করে বাবা তাকে হোমে ভর্তি করে দিল। কলেজ টা নীলু এখানেই পড়বে। সেই রীতিনীতি ভিন্ন। নীলুকে সে সব মেনে চলতে হয়। এর মধ্যে তার অনেক বন্ধু হয়ে যায়। তাও,নীলু এখানে স্বস্তি পায় না। বার বার তার মনে পড়ে ফেলে আসা জন্মভূমি'র কথা। তাই সুযোগ পেলেই নীলু পমিকে শোনাতো তার দেশে বাড়ির গল্প। তাও কি নীলু সম্পূর্ণ ভালো ছিল নতুন দেশে,নতুন হোমে!
শ্রদ্ধেয় লেখক শঙ্খ ঘোষের আত্মজীবনী মূলক ৪র্থ উপন্যাসের নাম "শহর পথের ধুলো"। এই উপন্যাসে লেখক শুনিয়েছেন নতুন জায়গার গল্প,যেখানে তিনি নিজের জন্মভূমি ছেড়ে উঠে এসেছেন। এই উপন্যাসগুলো অনবদ্য।
এই তিনটা উপন্যাস মিলে "কিশোর কথা" । দারুণ একটা বই। সবার অন্তত একবার পড়া উচিত।
কিশোরকথা বইটি মূলত ট্রিলজি। তিনটি উপন্যাসের সমন্বয়ে এই বইটি। যদিও বা লেখক তার শয্যাশায়ী মেয়েকে গল্প শোনবার জন্য প্রথম উপন্যাসটি রচনা করেন। তারপর পরবর্তীকালে প্রায় দীর্ঘ সময় গ্যাপ দিয়ে দিয়ে বাকি দুটো বইও বের হয়। এই বইয়ের প্রথম গল্পটি ছিলো সকালবেলার আলো। গল্পখানাও সকাল বেলার আলোর মতোই ফুটফুটে। কত প্রাণবন্ত আর সাবলীল! মনে হয়েছে আমার ছোটবেলার স্মৃতিকেই যেন রোমন্থন করেছেন লেখক। নীলু, বরুণ, কেশব যেন আমারই সাথী। এরপরে পর্ব হলো সুপুরিবনের সারি। এই গল্পে লেগে আছে দেশভাগ এবং পুজোর আমেজ। আবহমান বাঙলার সংস্কৃতির একটা অংশ। ছেড়ে যাওয়ার আগের কষ্ট। ভাগ হয়ে যাওয়া দেশের কথা। এই পর্ব যেমন আমাকে পুলকিত করেছে তেমনই একটা চাপা কষ্টও সাথে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এই বইয়ের অন্তিম পর্ব হলো শহরপথের ধুলো। দেশ ছাড়ার পর দেশ ছাড়া মানুষগুলো কেমন আছে? নিজেদের স্বদেশ ভাগ হওয়ার স্বাদ কেমন? কী নিদারুণ চাপা একটা কষ্ট। গোটা দেশটাই ভাগ হয়ে গেলো? নীলুর সেই ছোটবেলা এখন শুধুই স্বপ্ন।
প্রথমেই যেকথা বলবো তা হলো এই বই সকল বয়সীদের আনন্দ দিবে। আদপে কিশোরদের জন্য হলেও নিশ্চিতভাবে বড়দেরও পুলকিত করবে নির্দ্বিধায়। মন ভালো দেওয়ার মতোই একটি বই। শুধু আফসোস লেখক এত সুন্দর বইটি হাতে নিয়ে দেখে যেতে পারলেন না। গল্পের নীলুকে লেখক কী সুন্দর ভাবেই না গড়েছেন! দেশ আর দেশভাগের পরবর্তীকাল নিয়ে এই লেখা খুবই সাবলীল এবং সহজবোধ্য। যদি কখনো দ্বিতীয়বার কোনো বই পড়তে হয়, তবে এই বইটা আমি আবার পড়বো।
শঙ্খ ঘোষের কাজের সাথে আমি আগে পরিচিত ছিলাম না। এমনকি তাঁর নামটাও বই কিনতে যেয়েই প্রথম শুনলাম। বাতিঘরে নিয়ে জোয়া আপু বইটা দেখায় বললো এইটা পড়েছো? বললাম, না। আপু বলে, পড়ে দেখো, সুন্দর আছে।
১. সকালবেলার আলো: শৈশব খুব দ্রুত চলে যায়। কিন্তু কিছু কিছু বিক্ষিপ্ত স্মৃতি সাড়া জীবনের জন্য দাগ কেটে যায়। সেই শৈশবেরই ছোট ছোট খুশির মূহুর্ত, বিষাদময় কাহিনী- এসব নিয়েই "সকালবেলার আলো"। এখানে আছে নিখাদ বন্ধুত্বের গল্প। বইয়ের শুরুটা বেশ সুন্দর, কিন্তু শেষটা বিষাদময়। এই তো প্রিয় বন্ধুদের সাথে দৌড় ঝাঁপ করতে করতে প্রিয় বন্ধুদেরকে বিদায় জানানো– এইভাবেই শেষ হয় প্রথম উপন্যাস।
২. সুপুরিবনের সারি: দেশভাগের পরপর সময়ের কাহিনী এইটা৷ ওপার বাংলা থেকে নীলুরা এপার বাংলায় এসেছে, কারণ এবার নানা-মামাদের সাথে পূজা করবে। কিন্তু আগের মতো সেই আনন্দভাবটা এখানে নেই৷ কারণ বড়রা বলাবলি করছে, এখান থেকে সব গুটিয়ে কলকাতায় চলে যেতে হবে, এটা নাকি এখন আর তাদের দেশ না। এসব শুনে বেশ অবাক হয় নীলু। তাহলে কি আর কখনো এখানে আসা হবে না? এমনই দোদুল্যমান অভিমানী অবস্থায় শেষ হয় এই উপন্যাস।
৩. শহরপথের ধুলো: এত সাধের দেশভাগ, এরপরেও মানুষের মধ্যে রেষারেষি চলছেই। " ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়" রব চারিদিকে। এতদিন ধর্মের কারণে হতো, এখন রিফিউজি আর স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে হচ্ছে৷ এমন পরিবেশ নীলুর জন্য একদম নতুন। সবে তো কৈশোরের পাখনা গজিয়েছে। এতকিছুর মাঝেও আমরা দেখতে পাই, কী করে নীলু, অর্থাৎ লেখকের মাঝে কবি সত্তা জন্মালো। লেখকের কলকাতার কলেজ ও হোস্টেল জীবন, বেদনা ও বিচ্ছেদ নিয়েই শেষ হয়েছে এই উপন্যাস ত্রয়ীর শেষটা। . . . বেশ মায়া মায়া একটা বই বইটা পড়ে ছোটবেলার সেই 'অদ্ভুতুড়ে' সিরিজ পড়ার সময়কার কথা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন পর লাইট নিভিয়ে টর্চের আলোয় একটা বই পড়লাম। বইটা এত সুন্দর যে শেষ না করে ঘুমাতে ইচ্ছে করছিল নাম তিনটা উপন্যাস পড়েই বেশ মুগ্ধ হয়েছি। যেহেতু আত্মজীবনীমূলক বই, তাই নীলু তথা লেখকের শৈশব-কৈশোরের নানা স্মৃতি উঠে এসেছে এই ত্রয়ী উপন্যাসে। ওপার বাংলার বেশিরভাগ বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকদের লেখায় আমরা প্রায়ই দেশভাগের একটা করুণ চিত্র দেখতে পাই। শঙ্খ ঘোষও নিজের ছোটবেলার গল্পে সেই দেশভাগের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী আক্ষেপটাই তুলে ধরেছেন। একইসাথে ৩টা উপন্যাস একটা বইয়ে মলাট বন্দি করেছে বাতিঘর। বইয়ের সাইজটা ছোটবেলার গল্পের বইগুলোর মতো। ভেতরে সুন্দর কিছু ইলাস্ট্রেশনও আছে। লেখক একদম গল্পের মতো করে সাবলীলভাবে নিজের ছোটবেলার গল্প বলে গেছেন। তবে তার মানে এই না যে কেবল ছোটদের জন্যই এই বই। বড়রাও নির্দ্বিধায় পড়তে পারবে।
১. সকাল বেলার আলো : নীলমাধব, আমাদের ছোট্ট নীলু তখন পূর্ববঙ্গের এক গাঁয়ের স্কুলে পড়ে। সেই সময়ের স্কুল জীবন, মাস্টারমশাই, বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা-আড্ডা, বন্ধুবিচ্ছেদ এইসকলই বইয়ের উপজীব্য বিষয়। ২. সুপুরিবনের সারি : নীলু এখন একটু বড় হয়েছে। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে সেই সাথে ভেঙে দু টুকরোও হয়েছে। নীলুরা শেষবারের মতন পূর্ববঙ্গে দাদুর বাড়ি এসেছে দুর্গাপুজায়। পুজা হচ্ছে কিন্তু হুল্লোড় হচ্ছে না কারো মনেই যে শান্তি নেই। এই সময়েই নীলুর কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয়। ৩. শহর পথের ধুলো : নীলু এখন কলেজ পড়ুয়া। দাদুরা রয়ে গেলেন পূর্ববঙ্গেই আর পরিবারের সকলে স্থায়ী হলেন কলকাতায়। পরাধীন থাকতে তবু দেশটাকে নিজের বলা যেত কিন্তু স্বাধীন হয়ে এই মানুষগুলো দেশ হারিয়ে হয়ে গেলেন রিভিউজি। তিনখানা বই-ই ভালো লেগেছে। কখনো নীলুর সাথে বন্ধুদের হুল্লোড়ে পাঠকও মেতে উঠেন আবার বন্ধুর বিয়োগব্যথা নীলুর মতন পাঠকের মনেও সমানভাবেই আঘাত করে। দেশ হারিয়ে পাঠকও নীলুর সাথেই হোন দেশান্তরী। বইয়ের সবই ঠিক আছে। তবু কোথাও যেন একটু কমতি রহিয়া গেল। বরাবরই দেখেছি কবিদের গদ্য খুব মায়াময় হয়। কিন্তু এই বই পড়ার সময়ে আলাদা করে মিঠা গদ্যের স্বাদটুকু পাওয়া গেল না।
সকালবেলার আলো, সুপুরিবনের সারি, শহরপথের ধুলো। নাম তিনটেই কত মিঠে! নীলমাধব ও���ফে নীলুর শৈশব থেকে কৈশোর হয়ে যৌবনে পদার্পণের এক গল্প এটি, যদিও বিস্তৃত রয়েছে তিনটি পৃথক উপন্যাসে। প্রথম উপন্যাস সকালবেলার আলো, যেখানে এক স্কুল ছাত্র নীলুর সাথে তার অপর দুই বন্ধু বরুণ এবং কেশবের নিষ্পাপ বন্ধুত্ব বর্ণিত হয়েছে৷ এর সাথে এসেছে পদ্মাপাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা, স্কুলের মিঠে কড়া শাসন এবং কোমলে কঠোরে মেশানো শিক্ষকদের কথা। দেশে তখন এক অস্থির সময়। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন এর তৎপরতা চলছে। তবে দুইভাগ হয়ে যাবে দেশ, নিমেষেই পালটে যাবে দেশের নাম, তা কেউ জানত না তখনো। কেশবের রুগ্ন শরীর, বৃষ্টিতে ইলিশ নিয়ে ছোটার পর তার মৃত্যু মনটা ভারী করে দেয়। পরে বদলি হয়ে যায় বরুণের পরিবার ও। একা হয়ে যায় নীলমাধব। সুপুরিবনের সারি উপন্যাসটি দেশের মতোই এক ক্রান্তিকাল উপস্থাপন করে। কে কবে ভাবতে পেরেছিল দু টুকরো হয়ে যাবে গোটা দেশ কেবল ধর্মের ভিত্তিতে? ইতিহাসে এমন অত্যাশ্চর্য এবং নির্মম ঘটনা আর কবেই বা ঘটেছে? নীলু দেখতে পায় চেনা প্রকৃতির মধ্যেও কেমন বদলে যাচ্ছে চেনা হারুণ, হোসেনরা। বদলে যাচ্ছেন তার নিজের বাবা-কাকারা, দেশ ছেড়ে ওপারে চলে যেতে হবে অজস্র হিন্দুদের। তাই গ্রামের এত এত দূর্গামণ্ডপ এবার খালি। বিশাল মামাবাড়ি এবার খাঁ খাঁ। দূর্গা পূজোর কোন মজা সেবার অনুভব করে না নীলু। সে বুঝতে পারে একটা তার ছিঁড়ে গেছে, প্রাণপণ চেষ্টাতেও আর সেই তার জোড়া লাগছে না। এরপর শহরপথের ধুলো। শহর কলকাতাতে রিফিউজি হিসেবে আগমন। রামকৃষ্ণ মিশনে শুরু কলেজ জীবন। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মাঝে মাঝে কৈশোরিক দুঃসাহস হানা দেয়। বন্ধুত্ব হয় যোগেনের সাথে, পমির সাথে। স্বাধীনতা এলেও শহরে বিশৃঙ্খলা। ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় শ্লোগানে মুখরিত শহরের একটা অংশ৷ এই ডামাডোলের মধ্যেই নীলমাধবের মধ্য থেকে ফুটে উঠতে শুরু করে এক ভবিষ্যতের কবি।
শঙ্খ ঘোষের সহজ মিষ্টি গদ্যে লেখা এই তিনটি আত্মজৈবনিক কিশোর উপন্যাস একই সাথে কয়েক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয়। যে অনুভূতিতে রয়েছে সরলতা, বিস্ময়, সুখ, দুঃখ, অপার আনন্দ এবং শোকের এক বৈচিত্র্যময় সমাহার। কবিদের গদ্য সবসময়ই দারুণ সুন্দর হতে দেখেছি আমি। সবসময়ের প্রিয় কিশোর উপন্যাসের তালিকায় ঢুকে গেল বইটি।
সকালবেলার আলো নামটা যেমন, উপন্যাসটাও ঠিক তেমনি। সকালের ঠান্ডা, নরম আলোর মতো। বন্ধুত্বগুলো খুব নিখাদ, খুব সরল আর ভীষণ মায়াবী। ছবিগুলোও এত সুন্দর! পুরনো পুরনো। যে সময়ের গল্প পড়ছি, সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। বইটা অদ্ভুত সুন্দর। 'দীপু নাম্বার টু', 'নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়'এর কথা মনে পড়ে গেল।
"ছোট্ট একটা স্কুল" বইয়ে শঙ্খ ঘোষের সাথে পরিচয়। এখানেও একই ভঙ্গিমায় যত্ন করে বর্ণনা করেছেন কাহিনী গুলি। মোট তিনটি অংশে বিভক্ত এই বইয়ে (উপন্যাসিকা ত্রয়ী) লেখকের কিশোর বয়সের কিছু খন্ড চিত্র ফুটে উঠেছে। শুধু তাই নয়, সাথে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দেশভাগের আগে পরের জীবন ব্যবস্থার প্রভাব কিশোরমনে কিভাবে পড়েছে, সেগুলিও সুন্দর করে বুনে দিয়েছেন লেখার ভেতর।
উনার এই দুটো বইয়ে সব থেকে শান্তি লেগেছে কাহিনী বর্ণনা, এতো সুন্দর করে লেখা, যেন পাঠক নিজেই গল্পের অংশ। পাঁচ তারা। হাসবেন, কাদবেন, আপনার হৃদয় কে ছুঁয়ে যাবে চরিত্র গুলি। আরো কিছু কি চাই পাঠকের?
"সকালবেলার আলো" গল্পের নায়ক নীলু তথা লেখকের জীবনের শৈশবের কথা। নীলু,বরুণ আর কেশবের গল্প। বাসুদি' আর পদ্মাপাড়ের গল্প। আমরা আজও যেমন চাই শৈশবে ফিরে। শৈশবের সেই সরলতাময় সময়ে নিজেকে আবার নিয়ে যেতে। কেননা শৈশব আমাদের মনের সেই মিষ্টি স্মৃতি যা আমরা আজীবন নিজেদের সাথে নিয়ে চলি। লেখকের ভাষা এত মিষ্টি আর সাবলীল যে তার বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছিলো আমিও নীলু,বরুণ কিংবা কেশবের সাথে পদ্মার পাড়ে যাচ্ছি। কেশবের সেই শেষ চাহনি যেনো আমি দেখতে পাচ্ছি। একটু মন খারাপ আর আরেকটা ভালো লাগার মিশ্রণ সকালবেলার মিষ্টি আলো।
"সুপুরিবনের সারি" দেশভাগের বিচ্ছেদের গল্প। যে দেশ এতদিন আমার ছিলো। যার গন্ধে ভরা মাটি,গাছপালা আমাদের ছিলো তা হঠাৎ করেই অন্য কারো, অন্য দেশ হয়ে যাবার গল্প। প্রতিটা মানুষের একটা নিজস্ব ঘর থাকে। দিনশেষে বলতে পারা যায়, এটা আমার ঘর। কিন্তু হুট করে একদিন সব উলট-পালট হয়ে যায়। ৪৭' এর দেশভাগের সময় নীলু'রা তাদের ঘর তাদের সুপুরিবনের সারি সবকিছু তাদের আর থাকে না। যা এতদিন আপন ছিলো। হঠাৎ করেই সেটা পর হয়ে যায়। হারুন তার আর বন্ধু থাকে না। সুপুরিবনের সারি গল্পটা লেখকের শৈশব পেরিয়ে তার পরের জীবনের গল্প। বিষাদেমোড়া একটা গল্প।
"শহরপথের ধুলো" কলকাতার গল্প। দেশভাগের পর নীলু'রা সপরিবারে কলকাতা যাপনের গল্প। চিমনিকাকু'র বিপ্লব কিংবা যোগেনের সুকুমার বা সুভাষের কবিতা আওড়ানো। নীলু'র কলকাতাকে চেনা। বিষাদ,প্রেম,বিচ্ছেদ,দায়িত্ব সব কিছুর সঙ্গে পরিচয় ঘটে নীলু'র। এ সবকিছু উতরিয়ে জন্ম হয় নতুন এক কবির। জন্ম হয় কবি শঙ্খ ঘোষের।
শঙ্খ ঘোষ যে কী চমৎকার কবিতা লেখেন এটা আমার জানা ছিলো। কিন্তু এত দারুণ যে তার গল্পশৈলী তা জানা ছিলো না। প্রতিটা বাক্যেই যেনো উপলব্ধি করার মতো। এক কথায় বইটি একখানা সন্দেশ।
★সকাল বেলার আলোঃ নীলমাধব ওরফে নীলুর গল্পটা শুরু হয় পদ্মাপাড়ের রেল কলোনিতে। ছোটবেলার প্রাণের বন্ধু কেশব, বরুণের সাথে আনন্দময় সব দিন। তারপর একদিন হুট করেই বিচ্ছেদ ছোট্ট নীলুকে জীবন নিয়ে প্রশ্ন করতে শিখিয়ে দেয়। সেই ছোট্টবেলার স্কুল ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে শীতের সকালে উঠানে বসে মিঠে কড়া রোদের যে আরাম আরাম বোধ হতো। আবার মন খারাপও হতো এই ভেবে যে এইতো ছুটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তেমন এক মিষ্টি শৈশবের গল্প।
রেটিংসঃ ⭐⭐⭐⭐⭐/5
★সুপুরিবনের সারিঃ নীলু এবার আরেকটু বড়। চোখের সামনে দেখতে পেলো দেশ ভাগের মতো অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। এই স্বাধীনতা মানে যে নিজের দেশ আর নিজের রইলো না এটা কে কবে ভেবেছিলো? পূজোর ছুটিটাও এবার অন্যরকম। বিষাদে মাখা। তার কৈশোর মনেও তেতো সত্যটা জেনে গিয়েছিলো এবার সত্যিকারেই দেশের বাড়ি ছাড়া হচ্ছে। দেশ ছাড়া হচ্ছে। লেখক তার তীব্র কষ্টের এক গল্প কি অবলীলায় বর্ণনা করে গেলেন। মনে হচ্ছিলো আমিই সব ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
রেটিংসঃ 4.5/5
★শহরপথের ধূলোঃ শেষ পর্বে পদ্মপাড়ের সেই নীলুর বড় হয়ে উঠা কলকাতার ধূলোমাখা পথে। বিচ্ছেদ, মৃত্যু, দুঃখবেদনা আর অজস্র সুখ স্মৃতি পিছনে ফেলে হোস্টেল জীবনের শুরু তার মতোই দেশ ছেড়ে আসা ছেলেপুলেদের সাথে নতুন করে বন্ধুত্ব জমে উঠতে সময় লাগে না। এই শহরের ধূলোই নীলুর প্রথম মন ভাঙার কষ্ট ধারণ করে রাখলো। এই ধূলোই জানলো এক অনবদ��য কবির উন্মেষ হলো আজ।
রেটিংসঃ 4.5/5
দেশ ভাগের আগে ও পরের স্মৃতিমাখা শঙ্খ ঘোষের এই কিশোর উপন্যাস এক অনন্য সৃষ্টি।
নীলু, বরুন, কেশব তিন বন্ধু,। পড়ে একই ক্লাসে। কেশবের অসুস্থতার কারনে প্রতিদিন সকালে নদীর পাড়ে হাঁটতে যেতে হয়, সাথে যায় দুই বন্ধু নীলু আর বরুন। সেই সকাল থেকে সারাটা দিন কাটে একসাথে। স্কুল শেষ বাড়ী ফেরা বিকালে আবার সেই খেলার মাঠে। এক দিন হঠাৎ করেই কেশব বেশী অসুস্থ হয়ে পড়ে, ডাক্তার বাবু বলেন তাড়াতাড়ি বরফ লাগবে, নীলু আর বরুণ ছুটে যায় নদীর পাড়ের বরফকল থেকে বরফ আনতে। খুব তাড়াতাড়ি তারা বরফ নিয়ে ফেরে কিন্তু ততোক্ষণে বরফের প্রয়োজন যায় শেষ হয়ে। কষ্ট করে আনা বরফ আস্তে আস্তে গলে ��ল হতে থাকে কারো খেয়ালই থাকে না।
'কিশোরকথা' লেখক শঙ্খ ঘোষ এর আত্মজীবনী, এতে মোট তিনটি উপন্যাস একসাথে। তিনটি উপন্যাস বলা হলেও এটা আসলে তিনটি পর্বে ভাগ। ধারাবাহিক ভাবে লেখা তিনটি খন্ড।
লেখক মূলত উনার মেয়েকে শোনার জন্য এটার প্রথম পর্বটা লিখে ছিলেন যা 'সকালবেলার আলো' নামে প্রকাশ পায়। এটা সেই সময়ের কথা যখন দুই বাংলা এক ছিলো, পদ্মা পাড়ের এক রেল কলোনির জীবন, যেখানে ছোট নীলমাধব( নীলু) বন্ধুদের সাথে বেড়ে ওঠে।
এর পরই বাংলা ভাগ হয়ে তৈরি হলো দুটি দেশ। সেই দেশ ভাগের পর মামার বাড়ীতে পূজার ছুটিতে একমাস থাকার কাহিনি টা নিয়েই দ্বিতীয় পর্ব ' সুপুরিবনের সারি'।
জীবনের পথ চলাতে নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে জীবন কি তা বুঝতে গিয়ে নীলু দেখলো মৃত্যু, বিচ্ছেদ! জীবনের দুঃখবেদনা সাথে নিয়ে কলকাতার কলেজ ও হোস্টেল জীবনের স্মৃতি নিয়ে লেখা তৃতীয় পর্ব ' শহরপথের ধুলো'।
তিনটি উপন্যাসে মিশে আছে দেশ বিভাগের আগের থেকে শুরু করে পরের নানা টুকরো স্মৃতি। প্রথম উপন্যাস অরুনা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পায়। বাকি দুইটি উপন্যাস পত্রিকায় প্রকাশ পেলেও বইয়ের আকার পায়নি। সেই তিনটি উপন্যাস এক মলাটে বেঁধে দিলেন বাতিঘর। কিন্তু সে মলাট বন্দী বইটা লেখক ছুঁয়ে দেখতে পারলেন না।
লেখক শঙ্খ ঘোষ ভূমিকার প্রথমে বলেছেন," গল্প-উপন্যাস লিখবার জন্য মনের যে গড়ন বা প্রবনতা থাকবার কথা, আমার তা একেবারে নেই।"----লেখক এই কথাটা ভুল বলেছেন তা বইটা পড়ার পর মনে হলো। সহজ সাবলীল এক লেখা, যেনো গল্প বলে গেলেন, আমি শুনে গেলাম। বইয়ের আকারটা ছোটবেলার পাঠ্যবইয়ের মতই, এটা খুব ভালো লেগেছে তাছাড়া বইয়ের ভিতরে সুন্দর সব ছবি দেওয়া চমৎকার এক বই।
কিছু বই হয়, যেগুলো ঠিক যেন ভোরের আলোর মত, ঘাসে পড়া শিশির বিন্দুর মত, অথবা নিঃসঙ্গ বিকেলের মনখারাপের মত। তার প্রত্যেকটি শব্দ, বাক্য, মনের মধ্যে এক অনুভূতির প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। শঙ্খ ঘোষের এই কিশোর উপন্যাস সংকলনটি এমন একটি বই। অবিভক্ত বাংলা, দেশভাগ এবং তার পরের যুগের প্রেক্ষাপটে কিশোর নীলমাধবের বড় হয়ে ওঠার গল্প বলে তিনটি উপন্যাস।
যে তিনটি উপন্যাস এই বইটিতে স্থান পেয়েছে তা হল:
১. সকালবেলার আলো : যুদ্ধ চলছে। জাপানিরা যে কোন মুহুর্তে বোম ফেলতে পারে। অবিভক্ত বাংলায় পদ্মাপারের রেল কলোনিতে থাকে নীলু, বরুণ আর কেশব। তাদের প্রত্যেক সকালে পদ্মার পারে বেড়াতে যাওয়া, ঝড়ের রাতে ইলিশ মাছ কিনতে যাওয়া, একসাথে স্কুলে পড়া, এসব মিলে এক অপূর্ব শৈশবের কথন এই উপন্যাসটি। নিমেষেই চরিত্রগুলি আপনার হয়ে ওঠে।
২. সুপুরিবনের সারি : ভারত স্বাধীন। কিন্তু দেশ ভাগের মূল্যে। নীলু চলেছে তার বাড়ি, তার মাতুতালয়ে, পুজো কাটাতে, সম্ভবত শেষ বারের জন্য। পুজোর ঢাকে বিষাদের সুর। গ্রাম ছেড়ে সবাই কলকাতা যেতে ব্যস্ত। নীলু দেখে, দেশভাগ কিভাবে মানুষকে পাল্টে দিয়েছে। তার খেলার সাথী হারুন, যে একসময় তার প্রাণ বাঁচিয়েছিল, যাকে সে শুনিয়েছিল কারবালা-প্রান্তরের গল্প, সে আর তাদের মধ্যে পড়ে না। সবকিছুতেই মধ্যেই যেন ' আমরা - ওরা ' বর্তমান। দেখা হয় ফুলমামীর সাথে, যাকে নিজের প্রথম কবিতা শোনায় নীলু। উপন্যাসটি শেষ হয় অবর্ণনীয় বেদনার সুরে, যা যন্ত্রণাবিদ্ধ করে পাঠককে। পূর্ববঙ্গের স্মৃতিমেদুরতা এবং দেশভাগের যন্ত্রণার যে ছবি এই উপন্যাসটি আঁকে, তা কোনোদিন ভোলার নয়।
৩. শহরপথের ধুলো : কলকাতায় এসে পৌঁছয় নীলু। ভর্তি হয় মিশন দ্বারা চালিত এক স্টুডেন্টস হোমে। একসাথে বন্ধুদের মাঝে বড় হওয়ার সাথে, একাত্ম হতে থাকে এই নতুন শহরের সাথে। উদ্বাস্তুদের প্রতি লোকেদের অনীহা, তাদের শ্রেণীসংগ্রাম, এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু। নানা ব্যক্তিত্ব, ঐতিহাসিক ঘটনা, লেখক নিপুণ ভাবে বুনে দিয়েছেন ঘটনাবলীর সাথে। উপন্যাসের শেষে মনে হয় যেন এক স্বচ্ছ, সুন্দর ছবি আস্তে আস্তে মলিন হয়ে গেছে।
লেখার বিষয়বস্তু ছাড়াও বইটির নির্মাণ খুব ভালো লেগেছে। দেবব্রত ঘোষের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ বইটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। উপন্যাসগুলি আলাদা ভাবে কলকাতার অরুণা প্রকাশনী বার করে, এবং একত্রে দেজ এর ছোটদের গদ্য বইটিতেও পাওয়া যায়। তবুও ছবিগুলোর জন্য এই বইটি নিতেই পারেন।
প্রকাশনী 'বাতিঘর' কে অসংখ্য ধন্যবাদ, কিংবদন্তী লেখকের এমন সুন্দর ত্রয়ী উপন্যাস একত্রে সংকলন করে একসাথে পড়বার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। এই বই আরো পাঠকের হাতে পৌঁছক।
ভাগ্যিস ভূখন্ড ভাগ করা গেলেও ফেলে আসা সময়কে, অতীতকে ভাগ করা যায় না। হয়তো কোন নির্দিষ্ট আদর্শের তাঁবেদারেরা ইতিহাসের পাতা নিয়ে কাটাকুটি খেলে। কিন্তু প্রাক্তন সময়ের গাঁয়ে সে পক্ষপাতের আঁচড় কখনো দাগ কাটে না।
বাল্যসখা কেশবের স্মৃতি ও মৃত্যুস্মৃতি নীলমাধবের চিন্তাজগতে একটা সরু স্রোতস্বিনীর মত বয়ে যায় আজীবন। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত নীলকন্ঠপাখির খোঁজের বড়কর্তা মনীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগে বলা গ্যাৎচোরেতশালা খন্ডিত বাংলার আকাশে বাতাসের রেণু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পিতা কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় মৃত্যুর আগে প্রিয় মাতৃভূমি মাদারীপুরে একটি ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন গ্রামের বাড়ীটার একটা কবজা বদলাতে, অনেক ফলবতী লেবু গাছটা দেখতে, গোয়ালন্দ স্টীমার ঘাটের হোটেলে ভাত খেতে। কিছুই পূরণ হয়নি। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে সে আক্ষেপের উৎস আজীবনের দুঃখ ও সুখস্মৃতি সেই মাইজপাড়া গ্রামের যা তাঁকে ব্যাকুল করেছে, আপ্লুত করেছে কিন্তু কোমাও সেই স্মৃতি কেঁড়ে নিতে পারেনি।
দেশভাগ নিয়ে যখন ভাবতে বসি, লিখতে বসি স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী, কথাসাহিত্য সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সম্প্রতি শেষ করলাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ তথা শঙ্খ ঘোষের লেখা 'কিশোরকথা' আত্মজৈবনিক উপন্যাসত্রয়ী। প্রায় চল্লিশ বছর জীবন অতিবাহিত করার পরে শঙ্খ ঘোষ তাঁর বাল্যকালের প্রথম স্মৃতিচারণ করেন 'সকালবেলার আলো' উপন্যাসে। এই রচনায় দেশভাগের কথা গুরুত্ব পেয়েছে প্রচ্ছন্নভাবে। একজন মানুষ বাল্যকাল থেকে মাতৃভূমির সাথে কী নিবিড় শিকড়ের বন্ধনে আবন্ধিত হয় সেই শিকড়ের অঙ্কুরোদগমের সন্ধান দিয়েছেন এই রচনায়। বাল্য বন্ধু কেশব আর বরুণের সাথে কাটানো সময়, এডভেঞ্চার, স্কুলের স্মৃতি, এমনকি স্কুলের সবথেকে দুষ্ট ছেলে বুল্টুর কথা, গ্রামের একমাত্র মানসিকহীন ভারসাম্যহীন বিজয়ের পাগলামি সবকিছু আমাদের বুঝিয়ে দেন ছোটবেলার সময়টা একটা ভূখণ্ডের সাথে কীভাবে একটা মানুষকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে দেয়। সে হয়তো সময়ের স্রোতে অন্য কোথাও গিয়ে পড়ে কিন্তু বুকের ভেতর এই সময়টা হৃদপিণ্ডের মত সদা উজ্জীবিত রয়ে যায়।
ত্রয়ীর দ্বিতীয় উপন্যাস 'সুপুরিবনের সারি' উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমি খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। নীলমাধবের শেষবারের মত মামাবাড়ি যাওয়া। শেষ দুর্গাপূজা। যে মামাবাড়িকে নীলমাধব ওরফে নীলু ছোটবেলা থেকে নিজের বাড়ি বলেই জেনেছিল। প্রথম উপন্যাসে দেশভাগ প্রচ্ছন্ন থেকে এই উপন্যাস সুতীব্র বাস্তবতার দৃশ্যপটে আঘাত করে। লিখতে গিয়েও আমার স্মৃতিপটে এখন সজীব হয়ে উঠছে, নীলুর মামাবাড়ির বাড়ি, ঠাকুর দালান, সিঁড়িপথে চিলেকোঠা, গ্রামের লাইব্রেরি, ফুলমামি, মেজোমামা, দাদু আর হারুনের কথা। নিঃসঙ্গ এক কবি ফুলমামির হাতেই নীলুর কবিতা লেখার হাতেখড়ি। যার প্ররোচনায় নীলু প্রথম পদ্য লাইনের সৃষ্টি করে, "সুখের দুইটা পায়রা এসে বসেছে জুড়ে একটি ডাল আমার সেখা কীই-বা অধিকার! জাগাই কেন বৃথাই সেখা মৃত আশার ব্যর্থ তাল মনোমাঝেই থাক সে হাহাকার।"
তারপর ভবিষ্যতে নীলুই একদিন সত্যি কবি হয়ে ওঠে, সুপুরিবনের সারির মত লিখে চলে সারি সারি অপূর্ব সব পদ্যলাইনের সারি।
"একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি … তোমার জন্যে গলির কোণে ভাবি আমার মুখ দেখাব মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।"
হারুনের কথাও কী আলাদা করে না বলে পারা যায়। সাম্প্রদায়িকতা বিষ বাষ্প একটি কিশোর হৃদয়কে গ্রাস করতে গিয়ে পরাজিত হয়। সেই পরাজয় যে বড় মধুর। যে হারুন একদিন নীলুকে একদিন জলে ডুবে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল সেই একদিন নীলুকে বলে, "এইসব (দেশ) একদিন আমাগো (মুসলিমদের) হইয়া যাইবো' কিন্তু তবু কৈশোর যদি একবার সরলতার সাথে সাক্ষাৎ করে সে হয়ে ওঠে যেন উপলব্যথিত এক পাহাড়ি নদী। তাই নীলু শেষ যাত্রাকালে হারুন ছুটে আসে, চিৎকার করে আকাশ ফাটিয়ে বলে, 'এই যে আমি, নীলাই। এই-যে রে! আসিস কিন্তু আবার, সামনের বার। আসবি তো? কী রে আসবি তো? আবার আসিস। আসবি?' হারুন যদি কবি হতো হয়তো সে যেন সেদিন শামসুর রহমানের মত উচ্চস্বরে সবাইকে জানিয়ে দিতো,
“আকাশের নীলিমা এখনো হয়নি ফেরারী, শুদ্ধাচারী গাছপালা আজো সবুজের পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো। এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও পরাজিত সৈনিকের মতো সুধাংশু যাবে না। সুধাংশু যাবে না।”
কিন্তু সুধাংশুদের চলে যেতে হয়। নীলমাধবকেও চলে যতে হয়েছিল। শুধু যেতে যেতে বলে গিয়েছিল, 'প্রণাম তোমায় শেষ। প্রণাম তোমায় দ্বাদশীর বিকেল। প্রণাম, ওই খালের মুখে নদীর জলের ঢেউ। প্রণাম তোমায় তুলসীতলা, মঠ। প্রণাম ফুলমামি। প্রণাম তবে প্রণাম তোমায় সুপুরিবনের সারি।
ত্রয়ীর শেষ উপন্যাস 'শহরপথের ধুলো'। যেখানে নীলমাধব এসে নতুন পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে। ভর্তি হয় রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী পরিচালিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কৈশোরের প্রান্ত শেষে তারুণ্য উঁকি দিতে শুরু করে। দেশভাগের পরেও জীবনের কখনো প্রতিকূল, কখনো অনুকূল বহমানতা এই উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে ওঠে। এই উপন্যাসটি ত্রয়ীর শেষ অংশ হলেও এখান থেকে নীলুর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। নতুন দেশে নতুন জীবন। পড়তে পড়তে নীলুর পরবর্তী জীবনের আরও কথা জানতে তৃষ্ণা জানে। কিন্তু দুঃসংবাদ শুনতে পাই যে, লেখকের গদ্যে বিচ্ছিন্নভাবে অনেক স্মৃতিকথা থেকে থাকলেও কোন পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী পাঠকদের জন্য রেখে যাননি।
জন্মদিনে উপহার পাওয়া বাতিঘরের বইটির ছাপা, বাঁধা, কাগজের মান মুগ্ধ করেছে। আর শিল্পী দেবব্রত ঘোষের আঁকা একগুচ্ছ অলঙ্করণ পাঠ্যসময়কে আরও উপভোগ্য করে তুলেছিল। ধন্যবাদ বন্ধু আবিরকে জন্মদিনে এইবেশি চমৎকার একটা বই উপহার করার জন্য।