কয়েক বছর জুড়ে লেখা গদ্যের সংকলন এই বই। এখানে আছেন উর্দু ভাষার কবি, কবিতা, গল্পের অনুবাদ। আছে কবিতা নিয়ে আলােচনা। পাবেন মির্জা গালিবকে, সঙ্গে যাকে তিনি নিজের সমকক্ষ মনে করতেন সেই মীর তকি মীর। আছেন মান্টো, আরও সঙ্গীদের নিয়ে ইনতিযার হুসেইন। এদের কাল বহু শত বছর আগে থেকে সমকাল পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁরা কেউ ছিলেন ইরানে, কেউ দিল্লিতে, কেউ বা এখনাে জীবিত আছেন আমাদের বাংলাদেশে। এক জমজমাট আসর থেকে তুলে আনা আমাদের কাছে বিস্মৃত এক কলতান।
জাভেদ হুসেনের জন্ম ১লা আগস্ট ১৯৭৬, কুমিল্লায়। সোভিয়েত পরবর্তীত সক্রিয় মার্কসীয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি। মার্ক্সের লেখা এবং মার্ক্সীয় দর্শন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়াও তিনি একজন গালিব গবেষক। উর্দু-ফার্সি সাহিত্য বিষয়ে রয়েছে তাঁর বিস্তৃত জানাশোনা। মূল উর্দু ও ফার্সি থেকে অনূদিত বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে।
বইটি পড়ার আগ পর্যন্ত উর্দু সাহিত্য বলতে আমার দৌড় ছিলো " সাদাত হাসান মান্টো" পর্যন্ত। সত্যি কথা বলতে মান্টো ছাড়া উর্দু সাহিত্যের কোনো লেখকের নামও তেমন ভালো করে জানতাম না। মান্টোর কিছু অনুবাদ বই পড়েছিলাম এবং তাকে নিয়ে নির্মিত মুভিটা দেখেছিলাম। বইটা শেষ করার পরে উর্দু সাহিত্য নিয়ে অনেক কিছু জানলাম এবং উর্দু ভাষায় লেখালেখি নিয়ে যে মনোভাব ছিলো তা আমূল-পরিবর্তন হয়। . বইটা দেখে হয়তো ভাবতে পারেন যে বইটা মির্জা গালিব কেন্দ্রিক, কিন্তু বইটা আসলে অনেক কবি-সাহিত্যিকেদের নিয়েই যারা উর্দু ভাষায় লেখালেখি করেছেন। বইটা আপনাকে কখনো রাখবে মির্জা গালিবের কাছে, কখনো নিয়ে যাবে মীর তকি মীর নয়তে সাদাত হাসান মান্টোর কাছে, আবার কখনও নিয়ে যাবে ইনতিযার হুসেইন নয়তো বাহাদুর শাহ জাফরের কাছে। . বইটা ছোট ছোট অনেকগুলো প্রবন্ধ নিয়ে রচিত, প্রবন্ধগুলো আলাদা হলেও একটা সুতোয় সবগুলো গাঁথা তা হলো উর্দু সাহিত্য, কবি, কবিতা, দেশ ভাগ নয়তো বেদনা নিয়ে। বইটাতে ৩টা অংশ রয়েছে যার প্রথম অংশ বিবিধ লেখা, সেখানে মোট ২২ টা লেখা রয়েছে। এরপর আসে গল্প যেখানে রয়েছে ৬ টা ছোট গল্প এবং শেষে আছে ৬ টা প্রবন্ধ। একটা গল্প অনেক পছন্দ হয়েছে যেটার নাম উল্লেখ্য করলাম তা হলো " আলা"। . উর্দু সাহিত্যের কবি, কবিতা, দেশভাগের ইতিহাস বইটাতে বারবার ফুটে উঠেছে। এইসব জানতে চাইলে বইটা পড়তে পারেন। শেষ করছি মির্জা গালিবের একটা কবিতা দিয়ে, -" ইশকনে গালিব কো নিকম্মা কর দিয়া, বরনা হাম ভি আদমি থে কাম কা)"
রক্তের দাগ মুছে ফিরে দেখা দেশভাগ। হিন্দু-মুসলমান বা শয়তান-ফেরেশতা বা আমি-তুমির আড়ালে থেকে যাওয়া মানুষের বুকের ভিতরের রক্ত ক্ষরণ, গালিবের উছিলায় উর্দু ভাষার বহু সাহিত্যিকের বয়ান হাজির করেছেন জাভেদ হুসেন। ইতিহাসের আমি-তুমির সাদা-কালোর বাইরে যে ধূসর এলাকা থাকে, যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সাদা আর কালো সেই অঞ্চলের দিকে নজর টেনে নিয়ে গেছেন। এখন এমন এক সময় যখন বারবার রক্ত-পুঁজ ঝরছে সীমান্তের এইপারে-ঐপারে। কিন্তু আমরা মনে করতে পারছি না, আমরা মনে করতে পারছি না যে আঘাতটা কখন-কিভাবে লেগেছিল। এখন এমন এক সময়, যখন যা অনুভব করি তা অন্যকে বুঝাতে পারি না, তবুও সেই না পারার বেদনা অন্তত বুঝাতে হয়। কারণ যেই নৈতিকতা মানুষের হিংস্র অমানবিকতাকে যুক্তি দিয়ে জায়েজ করতে চায়, এক গোষ্ঠীর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা কেবল অপর গোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাকে দাবীয়ে রেখেই অর্জন করতে পারে, সেই মুক্তির সপক্ষে দাঁড়িয়ে উল্লাস করি কোন যুক্তিতে?
পড়তে পড়তে মনে হতেই পারে, মনে হতে পারে যে আমি-তুমির মেরুকরণের ভেদ মিটিয়ে, মানুষের নতুন কল্পনার জরুরত এখনকার সময়ের সবচেয়ে জরুরী কাজ হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এখন সময় নতুন কল্পনার, যেই কল্পনার সামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়ে, নিজেদের ইতিহাসের দিকে তাকিয়েই আমরা ঠাই খুঁজে পাব, আমরা ভবিষ্যতের দিকে সিনাটান করে তাকাতে পারব। তার আগ পর্যন্ত, মির্জা গালিবের সাথে আরও কয়েকজন।