ডিসেম্বর প্রায় দোরগোড়ায়। শহরবাসীও ধীরে ধীরে লেপ-কম্বলের নীচে আশ্রয় নিচ্ছে। ভিড় জমতে শুরু করেছে ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতেও (Tourist spot)। ঘুরতে যাওয়ার অভিনব জায়গা খুঁজতে আপনিও নিশ্চয়ই স্মরণাপন্ন হচ্ছেন বিভিন্ন ট্র্যাভেল সাইটগুলোর! আচ্ছা, ভাবুন তো, এই ভ্রমণকাহিনিই যদি লেখেন কার্টুনিস্ট দেবাশীষ দেব! চোখের সামনে অসাধারণ সব ছবি ভেসে উঠল তো?
ঠিকই ধরেছেন। বাজারে এসেছে নতুন ভ্রমণকাহিনির ই-বুক (e-book)। সৌজন্যে দেবাশীস দেব। ঘুরতে গিয়ে বা ট্রেকিংয়ে গিয়েও ছবি আঁকতে ভোলেন না তিনি। সঙ্গে সেইসব চেনা-অচেনা জায়গার নানা গল্পও লিখে রাখেন। এইসব অভিজ্ঞতার গল্প এবং ছবি নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ভ্রমণ সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘বেড়ানোর ডাইরি’।
এই বইয়ের মূল আকর্ষণ দেবাশীষ দেবের আঁকা ছবিগুলো। কী যে সুন্দর! তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে আর ইচ্ছে করে ছুটে চলে যেতে সেলেরিগাঁওয়ে বা মানস নদীর তীরে। য়্যজেন বুদ্যাঁ (ফরাসি ওপেন এয়ার পেইন্টার) এর মতে- "যা কিছু সরাসরি সামনে থেকে আঁকা, তা সবসময় এমন বলিষ্ঠ, জোরালো এবং প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে যে, তাকে স্টুডিওতে বসে নতুনভাবে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব... " এই কথাকে আপ্তবাক্য মেনেই লেখক বেরিয়ে পড়েছিলেন খাতা পেন্সিল হাতে পথে-ঘাটে, যেমন তোপসেকে সঙ্গী করে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে ছবি আঁকার পাঠ দিতে গিয়েছিল ফেলুদা। লেখকের সঙ্গী এখানে পাপড়ি দেব, তাঁর স্ত্রী। মাঝে মাঝে ছেলে এবং বন্ধু-বন্ধুপত্নীও রয়েছেন। লেখক ঘুরেছেন আর এঁকেছেন। শান্তিনিকেতনের সবুজ মায়া, জয়পুরের গোলাপী রঙ, অস্কার জেতা পরিচালকের সোনা কা কিলা, উদয়পুরের শুভ্র পবিত্রতা, ধোবিঘাটের ব্যস্ততা, আরাকু ভ্যালির চমৎকার প্রকৃতি, কালিম্পং, কেদার-বদ্রী, শিলং, ওখরে কী নেই সেই তালিকায়! অপার্থিব সৌন্দর্যের পাশাপাশি জায়গাগুলোর গাঁ, সরলা পল্লী বালা, সমর্থ মানুষ আর বাজার-হাট ও ছিল আঁকবার বিষয়। আঁকার পাশাপাশি বেড়াবার ছোট ছোট গল্প। কেদার ভ্রমণের সময় ফেলুদারা যে লাঠি কিনেছিল ২ টাকা দিয়ে, যার নিচে লোহার পেরেক মতো লাগানো ছিল, সেটি ফেরত দিলে আবার ১ টাকা ফেরত ও পাওয়া যেত। সেই লাঠির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ টাকায়, ফেরত দিলে ১০ টাকাও ফেরত পাওয়া যায়! লেখকের জীবনে এবং লেখায় সত্যজিৎ রায়ের যে একটা প্রভাব রয়েছে তা পড়লেই বোঝা যায়। নানান সময় তাঁর কাজের রেফারেন্স ব্যবহার করেছেন আর যেসব জায়গায় ফেলুদা গিয়েছিল সেগুলোর বর্ণনাতেও সেই ছেলেবেলার পাঠস্মৃতিটা বেশ সজীব হয়ে ওঠে। আবার যেসব জায়গায় ফেলুদা যায়নি কখনো যেমন মানসের তীর বা মুনসিয়ারি, চৌখোরি, পরেশনাথ ইত্যাদি সেসব পাহাড়ি জায়গা সম্পর্কেও চমৎকার আগ্রহোদ্দীপক বিবরণ রয়েছে। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গাঁ গুলোতে একটা শীতের সন্ধ্যা বিদ্যুতবিহীন অবস্থায় কম্বল-মুড়ি দিয়ে আড্ডা দিতে দিতে কাটালে, সাথে গরম কফি আর পকৌড়া থাকলে কী চমৎকার একটা ব্যাপার হবে না?
ছবির পাশাপাশি লেখাগুলো পড়তে পড়তে কখনো মনে পড়ছিল কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘের কথা আবার কখনো সদ্য দেখা টুংকুলুং এ একেনের বিদ্যুতবিহীন রেস্ট হাউজের কথা আবার মনে পড়ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব মায়াময় আলোর খেলার কথা। এক দুইটা বই এমন থাকে যে হাতে নিয়ে যখনই পাতা উল্টাই মন নিমেষে ভালো হয়ে যায় আর সেসব বই আজীবনের পাঁচ তারা লিস্টে জাঁকিয়ে বসে থাকে। আমার কাছে দেবাশীষ দেবের বেড়ানোর ডায়রি ঠিক তেমন একটি বই হয়েই রয়ে যাবে।
বইটার আসল রত্ন হোল ছবিগুলো। "অসামান্য", "অসাধারণ" নতুন করে বলার কিছু নেই , কিন্তু ছবিগুলো হৃদয়ের কোন তন্তুতে যেন হালকা ছুঁয়ে যায়। মনে হয় ছুটে জায়গাগুলোয় চলে যাই।
সঙ্গে স্বাদু গদ্য, সহজ ভাষায় লেখা। পড়ে ভালোই লাগলো 😊