প্রথম খণ্ডে সিন্ধু বিজয় থেকে শুরু করে দিল্লি সুলতানাতের পতন পর্যন্ত বিস্তৃত ইতিহাস আলোচিত হয়েছে, সিন্ধু বিজয় (৭১২ খ্রি.), মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযান থেকে শুরু করে গজনভি, ঘুরি, দিল্লি সুলতানাত শাসনের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, যুদ্ধ, শাসনব্যবস্থা ও অর্থনীতির বিশ্লেষণ আছে ।
এই বই পাঠের মাধ্যমে আপনি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম শাসনের গৌরবময় অধ্যায়, তার চ্যালেঞ্জ ও অবদান সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি পাবেন।
জাতিগতভাবে আমরা বাঙালি বা বাংলাদেশি হলেও আমাদের আরেকটা পরিচয় আছে; আমরা মুসলিম। সূদুর আরব হতে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে ধর্ম প্রচারকগণ আমাদের অঞ্চলে আগমন করেছিলেন এবং তারই প্রভাবে আজকে এই অঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামের জন্মস্থান থেকে যথেষ্ট দূরত্ব হওয়া সত্ত্বেও আরব জনগোষ্ঠীর পর বৃহত্তম একটি জাতি হিসেবে ইসলামের পতাকা তুলে ধরেছে এই অঞ্চলের মুসলিমরা। এই অসাধ্য সাধনে যতটা না তরবারির জোর কাজ করেছে, তার চাইতে বেশি প্রভাব রেখেছে ইসলামের সুশাসন ও সৌন্দর্য। 'সিন্ধু থেকে বঙ্গ' বইটির প্রথম খন্ডে ভারতবর্ষে ইসলামের প্রাথমিক যুগ, ইসলাম পূর্ববর্তী অবস্থা থেকে মোঘল শাসনের পূর্ব সময় এবং বাংলায় সুলতানি শাসনামল পর্যন্ত ইতিহাসকে স্থান দেওয়া হয়েছে।
ইসলাম ধর্মের পূর্বে ভারতবর্ষে প্রধান তিনটি ধর্ম ছিল; হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম। জৈন ধর্ম ম্রিয়মাণ, বৌদ্ধ কিছুটা গৌরব নিয়ে থাকলেও হিন্দু ধর্মই প্রধান ধর্মে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। হিন্দু ধর্মের শ্রেণিবিভেদের কারণেই বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা দিনদিন বাড়তে থাকে। ইরান হতে বিক্ষিপ্ত এক জনগোষ্ঠী যারা নিজেদের আর্য বলে পরিচয় দেয়, তারাই ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত। ইসলাম ধর্মের আগমনে নিম্নবর্গের হিন্দুরা বিপুল পরিমাণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আস্তে আস্তে এই অঞ্চলে মুসলিমদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। ইসলামপূর্ব যুগে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ফলে ক্ষমতাও ছিল তাদের হাতে। এতে করে ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ ছিল বেশি।
পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রবেশ করেছিল হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবদ্দশাতেই। তবে তার বিস্তার সীমিত ছিল। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু জয়ের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে শাসনতান্ত্রিকভাবে ইসলাম প্রবেশ করে। মুসলিমদের বসবাস সিন্ধু বিজয়ের পূর্ব থেকেই ছিল। কারণ আরব বণিকরা বহু আগে থেকেই ভারতে বাণিজ্য করে আসছে। এসব বণিকদের সাথেই ইসলামের প্রাথমিক যুগে ভারতে ইসলাম প্রবেশ করে। মাদ্রাজের মালাবারে সর্বপ্রথম ইসলামের প্রবেশ ঘটে এবং মসজিদ নির্মিত হয়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে মুহাম্মদ বিন কাসিম রাজা দাহিরকে পরাজিত করে সিন্ধু জয় করলেও বেশিদিন শাসন করতে পারেন নি। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যুর পর সিন্ধু হতে মুসলিমদের কর্তৃত্ব খর্ব হয়।
সিন্ধুতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থার পতনের পর গজনি বংশের উত্থান হয়। এই বংশের সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন। তবে কোনোবারই ভারতে স্থায়ীভাবে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করেন নি। তিনি শুধু আক্রমণ করে ধন-সম্পদ সংগ্রহ করেই নিজ এলাকায় ফেরত চলে যান। সুলতান মাহমুদকে প্রতিরোধ করার মতো কোনো হিন্দু রাজা তখন ছিলেন না। কারণ হিন্দু রাজারা নিজেরাই অন্তর্কোন্দলে লিপ্ত ছিলেন। গজনি বংশের পতনের পর ঘুর বংশের শাসন শুরু হয় এবং ঘুর সম্রাটরাই ভারতবর্ষে স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসনের শুরু করেন। ত্বরাইনের প্রথম যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহান মুহাম্মদ ঘুরীকে পরাজিত করলেও দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। এরপর মুহাম্মদ ঘুরী দিল্লি অধিকার করে শাসনভার তাঁর বিশ্বস্ত সহচর কুতুবউদ্দিন আইবেকের উপর ন্যস্ত করেন। কুতুবউদ্দিন আইবেকের নির্দেশেই ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি পূর্ব দিকে সীমানা বৃদ্ধিতে অগ্রসর হন। রাজা লক্ষ্মণ সেনকে হটিয়ে তিনি বঙ্গে মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। কুতুবউদ্দিন আইবেকের পর দিল্লির সিংহাসনে বসেন তাঁর জামাতা শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ। এরপর খিলজি বংশ, তুঘলক বংশ, সৈয়দ বংশ ও লোদি বংশের শাসকগণ দিল্লি শাসন করেন। খিলজি বংশের শাসনামলে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করতে পারলেও তুঘলক বংশের শাসনামলের শেষদিকে তৈমুরের ভারত আক্রমণ ও দিল্লি অধিকার ব্যাপক প্রাণহানি ঘটায়। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করার মাধ্যমে দিল্লিতে সুলতানি শাসনের অবসান ঘটান।
বাংলা ছোট একটা অঞ্চল হলেও এই অঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি এর জলবায়ুর কারণে। বাংলা অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন পীর-দরবেশরা। হযরত শাহজালাল (র) এর সিলেট বিজয়ের মাধ্যমে বাংলা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার একটি শক্ত অবস্থান লাভ করে। দিল্লিতে সুলতানি শাসনের যুগে বাংলার শাসকরা দিল্লির অধীনস্থ ছিল। তবে দেখা যায় প্রায়ই এসব শাসক বিদ্রোহ করে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন। দিল্লির সুলতানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ইলিয়াস শাহী ও হোসেন শাহী বংশ বাংলা শাসন করেছে।
বিস্তৃত একটি সময়কালকে লেখক দুই মলাটের মাঝে স্থান দিয়েছেন। লেখকের এহেন উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। বইটির খোঁজ পেয়েছিলাম ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে। অনেকেই প্রিভিউ দিয়েছিলেন। আর ইতিহাসের প্রতি আগ্রহ থেকে বইটি সংগ্রহ করি। দুই খন্ডের বইটি বেশ তথ্যবহুল। ইতিহাসের পাশাপাশি তৎকালীন সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে সমাজব্যবস্থার তুলনামূলক চিত্র লেখক বিশ্লেষণ করেছেন। লেখক ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন পাশাপাশি তথ্যসূত্রগুলো উল্লেখ করে দিয়েছেন। পাঠকের সন্দেহ হলে সহজেই সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে যাচাই করে নিতে পারবেন।
একটি নন-ফিকশন ইতিহাস বইয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য কী হওয়া উচিৎ? শুধু তথ্যের সমাবেশ করলেই কিন্তু সহজপাঠ্য হয়ে উঠেনা। বইটাকে পাঠকের কাছে সাবলীল করে তুলতে পারলে পাঠক আগ্রহ নিয়ে পড়তে পারে। এমন না যে নীরস ইতিহাসের বই হয় না! কিন্তু অগোছালো বাক্যবিন্যাস ও পুনরাবৃত্তি বিরক্তির কারণ হয়ে উঠলে সেটি মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়। বইটি পড়তে গিয়ে প্রথম যে বিষয়টি নজরে এসেছে তা হলো, ধারাবাহিকতা বজায় না রেখে ঘটনাপ্রবাহ। শিকড়ের ইতিহাস অধ্যায়ে যে সিন্ধু বিজয়ের ঘটনাবলী রয়েছে, সেই একই ঘটনা আবার পরে গিয়ে বর্ননা করা হয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা সংবাদ শিরোনামের পর বিস্তারিত সংবাদের মতো। ভারতীয় সমাজের শিক্ষাব্যবস্থার অধ্যায়টা এত আগেই সামনে আনার আদৌ দরকার ছিল? ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইতিহাসটা উল্লেখপূর্বক শিক্ষাব্যবস্থা বর্ননা করলে ঘটনাপ্রবাহ বুঝতে সুবিধা হতো।
ইংরেজিতে একটা কথা আছে 'History Repeat Itself.' অর্থাৎ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু বইটিতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ছিল অনেক জায়গায়। এমনকি হুবহু অনুচ্ছেদের পুনরাবৃত্তি ছিল। সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেছিলেন- এই বাক্যটি সম্ভবত লেখকের ১৭ বার লেখার ইচ্ছা ছিল। মুসলিমদের জয়ের ঘটনা বিস্তারিত বর্ননা করলেও পরাজয়ের ঘটনাগুলো নিয়ে লেখকের তেমন আগ্রহ লক্ষ করিনি। এই ব্যাপারটা লেখক���র বোঝা উচিত ছিল, মুদ্রার পিঠ দুইটি।
এই অঞ্চলে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল, এটা যেমন সত্য। তেমনিভাবে সত্য উত্তরোত্তর মুসলিমদের শক্ত অবস্থান সৃষ্টি। সুদূর হেজাজ হতে ভারতবর্ষে ইসলামের প্রচার-প্রসারে বিভিন্ন বিষয়াদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেই ঘটনাগুলোকেই ছাপার অক্ষরে পাওয়া যাবে বইটিতে। ইতিহাসে আগ্রহী হলে পড়বেন, তবে পড়ার আগে নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনায় রাখতে পারেন। হ্যাপি রিডিং।