মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে যে প্রজ্ঞা ও আত্মসংযমবোধের গভীরতা, অভিজ্ঞতা ও উন্মেষ দরকার , তা হয়তো আমার নেই । ষাট দশকের বিবর্তিত কবিতা-ধারার পুরোধা যিনি ,তাঁর প্রেমের কবিতাও যে স্বতন্ত্র এবং পাঠকের আত্মস্থগ্রন্থিকে অন্য রকমের স্বাদ দেবে , আজকে আর বলার প্রয়োজন আছে কি ! বিশ শতকের ষাট দশকের সেই চিরযুবক মলয় রায়চৌধুরী একুশ শতকের দ্বিতীয় অধ্যায় জুড়েও যে প্রেম ও কবিতা-প্রেমিকা নিয়ে রাজত্ব করবেন , এটাই স্বাভাবিক । তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ও একান্ত ব্যক্তিগত ভঙ্গিমায় তিনি যা লেখেন , তাতে সনাতন চিন্তাধারার ধ্যানধারণা ভেঙে যায় , গুঁড়িয়ে যায় শালীন – অশালীন গণ্ডী । তিনি অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই হয়তো বলেন , হয়তো একটু চিৎকার করেই বলেন , কিছু কথা হয়তো চিৎকার করেই বলতে হয় !
আসলে সত্যের সামনে একজন ঋষি , একজন কবি ও একজন ঈশ্বর সমান । সত্য যেহেতু সর্বদা সত্য এবং তার গ্রহণযোগ্যতা বাস্তবধর্মী , তাই সাধারণ মানুষ সবসময় সেই সত্যের সম্মুখীন হতে সাহস পায় না । দ্বিধাযুক্ত মানুষ মানিয়ে চলতে চলতে এক সময় থেমে যায় । মলয় এই ব্যাপারে আপোষহীন । নিজের রহস্যময় অভিজ্ঞতা ও কবিতা-ভাবনাকে শব্দানুভাবের মধ্যে দিয়ে প্রকাশের ব্যাপারে তিনি দ্বিধাহীন ।
আটপৌরে সামাজিক মানুষের চিন্তাভাবনার স্থিরতা নেই , নির্দিষ্ট কোনও দিশাও নেই । আজকে যে সম্পদ ডাস্টবিনে প’ড়ে আছে , আগামীদিনে হয়তো সেটাই শোবার ঘরে শোভা বৃদ্ধি করবে । আত্মবিস্মৃতির মানুষ খুব বেশিদিন এক অবস্থানে থাকতে পারে না । তাই মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা বর্তমানে কিছু-কিছু পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলেও একদিন যে হবে না , এমন জোর করে বলার মানুষটিও কি আছে ? এখন ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি বারংবার প্রকাশিত হয়, এবং বলার প্রয়োজন হয় না যে সেটি কে কবে রচনা করেছিলেন।
মলয় রায়চৌধুরী কবি-প্রেমিকের বয়সকে বেঁধে রেখেছেন সুনির্দিষ্ট একটা বয়সের মধ্যে । কিংবা কবি-প্রেমিকের বয়স বলেও কিছু হয় না, যেমন হয়নি রবীন্দ্রনাথের, জীবনানন্দের, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের । বয়স একটা সংখ্যা ছাড়া যেন আর কিছু নয় । বয়স আমাদের মরতে শেখায় , কিন্তু ভালোবাসা শেখায় জীবনকে উপভোগ করতে ! আয়ু একটা শ্বাসের নাম , শ্বাস ফুরলে আয়ু ফুরিয়ে যায় । কিন্তু ফুরিয়ে যাওয়ার আগে কি ফুরিয়ে যাওয়া মানায় ! ভালোবাসা বাদ দিয়ে পৃথিবীতে এসে মানুষ যেটুকু অর্জন করেছে তা হল , হিংসা , দ্বেষ , লোভ , ও ক্ষয় । দেহের সঙ্গে এইসব কিছুই যাবে না জেনেও মানুষ ক্রমশ ভালোবাসা থেকে দূরে যত সরেছে , তত বেশি করে জড়িয়ে ধরেছে এইসব রিপু-জনিত ক্ষয় ! তাই মলয় রায়চৌধুরী সজ্ঞানেই, শার্ল বোদলেয়ার, পাবলো নেরুদা, এমিলি ডিকিনসন, জন কিটস, মায়া অ্যাঞ্জেলু, সিলভিয়া প্লাথ, টমাস হার্ডি প্রমুখ ইউরোপীয় ভাষার কবি-প্রেমিকদের মতো একইভাবে ভালোবাসার মধ্যে প্রবেশ করেছেন , আর এই ভালোবাসা চক্রব্যূহ নয় । এই ভালোবাসার মধ্যে প্রতিদিন পাখি জন্মায় , পাখি সভ্যতার মধ্যে দিয়ে কবি এগিয়ে যান চিরকালীন সেই প্রেমসত্যর দিকে