যে কালখন্ডে, সবচেয়ে অশিক্ষিত সম্প্রদায় বলতে শিক্ষকদের বোঝায়, একটি বইয়ের নাম "পোস্টমডার্ন ব্রূহাহা" হলে, যেহেতু নামটিই গ্রন্থটির প্রবেশবিন্দু, নামকরণ নিয়ে কয়েকটি কথা বলে ফেলতে হচ্ছে। 'পোস্টমডার্ন' শব্দ ও ভাবকল্পটির উদ্ভাবক হলেন নিকারাগুয়ার কবি ফেদেরিকো দ্য ওনিস। যাঁরা ভাবকল্পটিতে দেরিদা, ফুকো, লাঁকা, লিওতার খুঁজে বেড়ান, এই বইটি তাঁদের না পড়াই কাজের কাজ হবে। ফেদেরিকো দ্য ওনিস "পোস্টমডার্ন" শব্দটি ১৯৩৪ সনে সম্পাদিত "আনতোলোজিয়া দ্য লা পোয়েজিয়া এসপানোলা এ হিসপানোমারিকানা" গ্রন্থে প্রয়োগ করেছিলেন কয়েকটি কারণে। ওই কারণগুলোর জন্যেই তিনি "পোস্টমডার্ন" শব্দটি উদ্ভাবন করতে বাধ্য হন।
গিল গনহালেস দ্য আভিলা ১৫২২ খৃষ্টাব্দে নিকারাগুয়াকে স্পেন সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করার পর সেখানে ইউরোপের লোকেরা ভাগ্য ফেরাবার ধান্দায় লাগাতার আসা-যাওয়া আরম্ভ করেন। আফ্রিকা থেকে জাহাজভর্তি ক্রীতদাস আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে কেনা-বেচার সময়ে তাঁদের একাংশ নিকারাগুয়ার জনজীবনে প্রবেশ করেন। দক্ষিণ ভারতীয় দ্বীপগুলোয় যে সমস্ত ভারতীয় কৃষি শ্রমিকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁদের অনেকে পৌঁছে ছিলেন নিকারাগুয়ায়। রেড ইন্ডিয়ানরা সেদেশে আগে থাকতেই ছিলেন। ১৮৩৪ সনে নিকারাগুয়া স্বাধীন হয় বটে কিন্তু ১৯১২ সন থেকে মার্কিন মিলিটারি সেখানে ঘাঁটি গাড়ে। প্রতিবাদে আগুস্তো সেজার সানদিনোর নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। যে বছর সানদিনো আততায়ীর হাতে খুন হন সে বছরেই প্রকাশিত হল ফেদেরিকো দ্য ওনিসের সংকলন।
মার্কিনীরা নিকারাগুয়া থেকে পাত্তারি গুটোবার সময় জেনারাল আনাসতাসিও সোমোজা নামে এক খলনায়ককে নিকারাগুয়ার তখতে বসিয়ে গেলে সোমোজা পরিবার সে দেশের অর্থনীতিকে বরবাদ করে বিশ শতকের শেষ কয় বছরের পশ্চিমবাংলার মতন কাঙাল করে দিয়েছিল। মার্কিন সৈন্যরা ঘাঁটি গুটিয়ে ফেলেছিল ১৯৩৩ সনে। তবে, ১৯৩৬ সনে জেনারাল সোমোজাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে স্থায়ী তখতে বসানোর কাজে সাহায্যের জন্যে বেশ-কিছু মার্কিন সরকারী বুদ্ধিজীবীরা থেকে গিয়েছিল নিকারাগুয়ায়, যারা আমেরিকায় ফেরার সময়ে 'পোস্টমডার্ন' শব্দটা নিজেদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। সোমোজা পরিবারের অত্যাচারের দরুণ নিকারাগুয়ার বহু স্প্যানিশভাষী কবি-লেখকরা ব্রাজিলে পালিয়ে যান, যেখানে তাঁদের নামকরণ হয় লুসিও-ব্রাজিলিয়া। ব্রাজিল একটি পর্তুগীজভাষী দেশ। নিকারাগুয়া থেকে স্পেনে এবং ব্রাজিল থেকে পর্তুগালে নতুন ধারণাটি পৌঁছোলেও ইউরোপে সে সময়ে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি ভাবকল্পটিকে, কেননা সাম্রাজ্যবাদ যে নবতর চেহারায় তখন রূপান্তরিত হচ্ছিল সে কাঠামোয় স্পেন আর পর্তুগাল গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে কিন্তু প্রসার ঘটছিল ভাবকল্পটির এবং ১৯৪২ সনে ডাডলি ফিটস এই নতুন ধারণার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেন "অ্যানথলজি অব কনটেমপোরারি ল্যাটিন অ্যামেরিকান পোয়েট্রি" সংকলনগ্রন্থের ভূমিকায়।
ফেদেরিকো দ্য ওনিস তাঁর চোখের সামনেই দেখেছিলেন এমন এক স্প্যানিশভাষী জনসমুদায় যাদের সংস্কৃতি, ভাষা, আচার-আচরণ, সংসারযাত্রা, ভাবনাচিন্তা ইত্যাদির সঙ্গে মূল স্পেন ভূখন্ডের আর যোগাযোগ নেই। যাদের অতীত এবং রক্তে মিশ্রণ ঘটেছে মূলবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে বহিরাগত অন্যান্য দেশের মানুষের। তিনি লক্ষ্য করলেন যে নিকারাগুয়া ও অন্যান্য লাতিন আমেরিকান কবিতার শব্দবিন্যাস ও অবয়বে প্রভূত প্রভাব ফেলেছে স্থানিকতা; বিশেষ করে স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তির পর সেখানকার সাহিত্যে এসেছে উত্তরঔপনিবেশিক অনন্যতা; কবি-লেখকরা ইউরোপের সাহিত্য থেকে আলাদা হতে চাইছেন; ইউরোপে তখন যাকে মডার্ন সাহিত্য বলা হচ্ছে তাকে বর্জন করতে চাইছেন। স্থানীয় কবিতার পরিবর্তিত আদলটিকে তিনি 'পোস্টমডার্ন' নামে চিহ্নিত করলেন। সেসময়ে লিওতার, ফুকো, দেরিদারা সব মায়ের কোলে। "পোস্টমডার্ন ব্রূহাহা" গ্রন্থের পাঠবস্তুগুলো, অতএব, ফেদেরিকো দ্য ওনিসের মস্তিষ্ক খাটিয়ে পরখ করতে হবে।
'ব্রূহাহা' শব্দটি মূলত হিব্রু। হিব্রু থেকে তা প্রবেশ করে ফরাসি ভাষায়, তারপর তা থেকে ইংরেজিতে এবং এখন ইংরেজি থেকে বাংলায়। শব্দটিতে আছে ইহুদিদের ভ্রাম্যমান সত্তা। যে সময়ে শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল তখন তাঁরা নিজের অস্তিত্বকে নিজেদের দেশ মনে করতেন। যেন তাঁর দেহটিই তাঁর ভূখন্ড, তাঁর স্বদেশ। ইহুদিদের, সেমিটিক অতীতের বা ওল্ড টেস্টামেন্টের কারণে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরও, আনন্দোৎসবের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। শোকদিবস ও কৃচ্ছ্রসাধনের পরব বেশি। ভিন্ন দেশে, ভিন্ন সমাজে, ভিন্ন সংস্কৃতিতে শোকাবহ দিনগুলোর চাপ থেকে বেরোবার জন্যে তাঁরা প্রয়োজন বোধ করেছেন কার্যকারণহীন ও ব্যাখ্যাতীত আনন্দোৎসবের, হল্লা, হৈ-চৈ, মৌজমস্তির। এই ব্যাপারটিকেই তাঁরা বলতেন 'ব্রূহাহা'।
"পোস্টমডার্ন ব্রূহাহা" গ্রন্থের চারজন লেখকই থাকেন দিল্লিতে, সেই যেখানে পৃথ্বীরাজ চৌহান রাজত্ব করতেন, কুতুবুদ্দিন আয়বক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ক্রীতদাসের রাজত্ব, গিয়াসুদ্দিন তুঘলক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খামখেয়ালির রাজবংশ, বাবর সূত্রপাত করেছিলেন মোগল সাম্রাজ্য, শাহেনশাহ আওরঙজেব নিজের টুপি নিজে সেলাই করতেন, সেই যেখানে ইংল্যান্ডের রানী ভারত সম্রাজ্ঞীর খেতাব পেয়েছিলেন, যেখানে বসে বাংলা ভাগের হুকুমনামা জারি করে কলকাতা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইন্ডিয়ার রাজধানী, যেখানে দেশভাগের আগে লুকোচুরি খেলতেন এডউইনা আর জবাহিরলাল, যেখানের পথে ঘাটে শিখ সম্প্রদায়ের তিন হাজার পুরুষ-নারী-শিশুকে জবাই করার নাদিরশাহী উৎসব পালিত হয়েছিল, যেখানে নিজের স্ত্রীকে খুন করে তন্দুরে পুড়িয়েছিলেন দেশসেবক, যেখানে কোটি কোটি টাকা সুটকেসে আবদ্ধ হয়ে পৌঁছে যায় মন্ত্রী আর আমলাদের বাড়িতে, যেখানে সোনার বাংলা থেকে ঝি-গিরি করতে বেরিয়ে প্রতিবছর হাজার হাজার বাঙালি মেয়েরা টিকে থাকেন যমুনাতীরের ঝুগগি ঝুপড়িতে। "পোস্টমডার্ন ব্রূহাহায়" অংশগ্রহণকারী চারজন সপ্তাহান্তে যেখানে একত্রিত হন, হয়ত সেখানেই পাশাখেলায় হেরে গিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির, আর বস্ত্র-হরণ হয়েছিল দ্রৌপদীর। স্বদেশী বা বিদেশী সবাই এই শহরেই যে কেন 'পোস্ট' ব...
আমি মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে একমত । উত্তরাধুনিক কবিতার সমস্ত বৈশিষ্ট্য আছে এই চারজন কবির কবিতায় । উত্তরাধুনিক বা পোস্টমর্ডান কবিতার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যঃ ১. বিষয়কেন্দ্রিকতার অভাব। পোস্টমডার্ন কবিতায় কোনো নির্দিষ্ট বিষয় কেন্দ্র, ভাবনা কেন্দ্র থাকবে না। ২. পোস্টমর্ডান কবিতায় যুক্তি কাঠামো অনুক্রম অনুপস্থিত থাকবে। কবিতাটি close ended হয় না Open ended হয়, কবিতাটি শেষ হলেও মনে হবে তা শেষ হয়নি। ৩. পোস্টমর্ডান কবিতা বহুরৈখিক, বহুকৌণিক, বহুত্ববাদী ও বিদিশাময়। এর যে কোনো দিকে ছড়িয়ে পড়ার অভিমুখ খোলা থাকে। ৪. পোস্টমর্ডাননিজম কোনো পূর্ব নির্ধারিত সূত্র নয়, জীবনকে দেখেশুনে মনে মনে তার লক্ষণগুলো যোগসূত্র ঠাউরে নিয়ে পোস্টমর্ডান পোস্টমর্ডাননিজমের যাত্রা শুরু। পোস্টমর্ডাননিজম কোনো আন্দোলন নয়, একটা কালখ-ের প্রবণতা মাত্র। ৫. পোস্টমর্ডান কবিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হলো যুক্তিতে ফাটল ধরানো লজিক্যাল ক্রাক ক্লেফটের উপস্থিতিতেই এর লক্ষণ হিসেবে বিবেচ্য। ৬. পোস্টমর্ডাননিজম কবিতা কোনো আদর্শ খাড়া করতে চায় না, এর গতি যে কোনো যাত্রার দিকে ইঙ্গিত দেয়। ৭. পোস্ট মর্ডাননিজম কবিতায় কবির ইমেজ তৈরি সম্ভব নয়। ৮. পোস্টমর্ডাননিজম কবিতা যে কোনো সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, ফলে কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় একে আবদ্ধ করা যায় না। ৯. আধুনিক কবিতা ছিলো সা¤্রাজ্যবাদী চিন্তাচেতনা সমৃদ্ধ এবং এই চেতনা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। পোস্টমর্ডান কবিতায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার উপস্থিতি নেই। ১০. জীবনের যে কোনো এলাকা থেকে পোস্টমর্ডান কবি তার কবিতার মাল মশলা বা উপাদান সংগ্রহ করতে পারেন। এটা কবিতায় চলছে না, ওটা কবিতায় খাটে না, এই ধরনের বাছ বিচার পোস্টমর্ডান কবিরা অগ্রাহ্য করেন।