মাঝেমধ্যে এমন এক-একটা বই হাতে আসে, যাদের নিয়ে কিছু লেখার ভাষা খুঁজে পাই না। মনে হয়, কীভাবে, কোন অবিশ্বাস্য কল্পনাশক্তি আর লেখনীর সমন্বয়ে রচিত হল এমন একটি লেখা? সে-সব লেখা এতটাই ব্যতিক্রমী, এতটাই ঐশ্বর্যমণ্ডিত, আর এতটাই ধারালো, যে নিজের যাবতীয় তুচ্ছতা আর গ্লানিও নগণ্য হয়ে যায় তার সামনে। মাথায় থেকে যায় শব্দ, বাক্য, যতিচিহ্নের মতো আপাত নীরস বস্তু দিয়ে গড়ে তোলা এক জাদুকরি দুনিয়া— যেখানে রণ, রক্ত, সফলতা... এমন সবকিছু ছাপিয়ে বিচিত্র আলো-ছায়ার নকশা সৃষ্টি করে চলে ভালো আর কালো, মনুষ্যত্ব আর অন্য কিছু। অসিশপ্ত তেমনই একটি বই। এই কাহিনির পটভূমি অম্বালিকা নামক একটি গ্রহ। সেখানকার মূল বাসিন্দা, যাদের মানুষ 'ভিন্নর' নামে চেনে, হারিয়ে গেছে বহুযুগ আছে। কিন্তু তাদের ফেলে রাখা প্রযুক্তি আর বাঁচার অদম্য ইচ্ছেকে সম্বল করে সেখানে মানুষ গড়ে তুলেছে বিভিন্ন বসতি। এই গ্রহের পরিবেশ রীতিমতো বিপদসঙ্কুল। সহসা তেমনই এক বিপদের সামনে পড়ে নরম মনের রজত জড়বৎ হয়ে গেছিল। তার পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ। বাবা'র আদেশে তলোয়ারবাজি শেখার জন্য এক আখড়ায় যোগ দেয় রজত— যাতে সে 'সত্যিকারের পুরুষ' হয়ে উঠতে পারে। যন্ত্রণাদায়ক সেই শিক্ষারই এক অধ্যায়ের পর হতাশ রজত অপ্রত্যাশিতভাবে খুঁজে পেয়েছিল ভিন্নরদের একটি বাংকার। কিন্তু সেখানে সে নতুন কোনো প্রযুক্তি পায়নি। তার বদলে তাকে খুঁজে পেয়েছিল কেউ... বা কিছু। তারপরেই অসিসর্বস্ব এক ভয়াবহ পথের পথিক হয় রজত। আখড়া, বাড়ি, হোমিগঞ্জ, হকিন্সাবাদ, দৌলতনগর— সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তার অসির দাপট। আর তারই সঙ্গে, ক্রমেই মানবিকতা হারিয়ে ফেলতে থাকা রিপুসর্বস্ব মানুষদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে সর্বত্র বিস্তৃত হয় এক অন্যরকম অন্ধকার। তারপর কী হল? অসির অভিশাপ কি গোটা অম্বালিকা-কেই ঠেলে দিল ধ্বংসের পথে? নাকি কোনো গোপন আগুন শুদ্ধ করে দিল তাকে? এই শ্বাসরোধী কাহিনিই অসিশপ্ত। প্রথাগত আদি-মধ্য-অন্তের কাঠামোর মধ্যে ন্যারেটিভকে আবদ্ধ রেখেও এতে লেখক সামগ্রিকভাবে যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, তা আক্ষরিক অর্থে অভাবনীয়। কেন?
প্রথমত, এর ভাষা অন্যরকম। ভিন্ন মানসিকতার মানুষের বাচনভঙ্গি বোঝানোর জন্য, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির কথায় তাদের পেশার প্রভাব স্পষ্ট করার জন্য, সর্বোপরি ক্ষয়িষ্ণু ও বিকৃত এক সমাজের বিত্তীয় বৈভবের দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য এতে বহু ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তার একটিও দুর্বোধ্য নয়; তা সত্বেও সেগুলোর এই গ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ উল্লেখ করা হয়েছে আলাদাভাবে। ফলে এটি পড়ার সময় চরিত্রদের কার্যকলাপ শুধু পড়া নয়, প্রায় শোনার মতোই অভিজ্ঞতা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, লেখকের ভুবন-নির্মাণ বা ওয়ার্ল্ড-বিল্ডিং নৈপুণ্য স্রেফ লা-জবাব। অম্বালিকার মানুষজনই শুধু নয়, আকাশ-বাতাস, জঙ্গল, পশু, বৃষ্টির গন্ধ হোক বা দেশি মদের নেশা— প্রতিটি খুঁটিনাটি চোখের সামনে একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আক্ষরিক অর্থেই এই বই পড়া হয়ে উঠেছে এক অবগাহন— যেখানে আশপাশ থেকে তথাকথিত স্থান-কাল-পাত্র মুছে গিয়ে জেগে থাকে শুধু অম্বালিকা আর তার নানা চরিত্র ও ঘটনা। তৃতীয়ত, অসিযুদ্ধের নানা কৌশল, তাদের প্রতিটি নড়াচড়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দর্শন, সর্বোপরি এক যোদ্ধার মনোজগতের নানা দিক, তার পূর্ণতা ও শূন্যতা— এগুলো এর আগে বাংলায় কোনো বইয়ে পড়ার সুযোগই হয়নি। যে লড়াইগুলো এখানে দেখানো হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিতে যুযুধানদের পায়ের চলন, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, তলোয়ার ধরার পদ্ধতি, এমনকি আঘাতের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। অথচ এই তথ্যগুলো একবারও অতিরিক্ত বা ইনফোডাম্পিং বলে মনে হয়নি! বরং এই রুদ্ধশ্বাস গল্পেও এমন কথা বা প্রসঙ্গগুলো যখন এসেছে, তখন মনে হয়েছে যে লেখক ঢিমে আঁচে আমাদের ভাপাচ্ছেন। চতুর্থত, একটিও অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার না করে এই গল্পে মনুষ্যত্বের ক্রমবিলোপ আর রক্ষণাবেক্ষণ— দুটিই দেখিয়েছেন লেখক। রক্ত ও আর্তনাদের মধ্যেই দু'ফোঁটা চোখের জল বা হালকা হাসির সেই প্রয়োগ বুঝিয়ে দিয়েছে, লেখক অম্বালিকা তথা তার বাসিন্দাদের ওপর থেকে সবটুকু বিশ্বাস এখনও হারাননি। পঞ্চমত, এই ঘন-সন্নিবিষ্ট বিবরণ ও ঘটনা-দুর্ঘটনায় ভরা কাহিনিটি শেষ না করে থামা প্রায় অসম্ভব ছিল। আবারও বলি, বর্ণনা ও সংলাপ, গতি ও মননের মিশ্রণে এটি পড়া এমনই এক অভিজ্ঞতা ছিল যাকে সিনেমা দেখার সঙ্গেই একমাত্র তুলনা করা চলে। এই বইয়ের কিছু কি আমার খারাপ লেগেছে? মাথা খারাপ! এমন একটা লেখা বাংলায় পড়তে পেয়েছি— এজন্যই নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করছি। বইটির ছাপা ও লে-আউট দুর্দান্ত। ভেতরে মানচিত্রগুলো থাকায় অম্বালিকাকে নিজের মতো করে ভেবে নেওয়া সহজতর হয়েছে। ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের দুর্ধর্ষ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ বইটির মধ্যে নিহিত সর্বনাশের বীজ বুকে নিয়ে ঝলসে ওঠা এক তরবারির ধারালো ও বিষাক্ত ভাবটিকে স্পষ্ট করে তুলেছে— এও আলাদাভাবে স্বীকার্য। সব মিলিয়ে বলব, কল্পবিজ্ঞান বা অ্যাকশন থ্রিলারের গণ্ডি পেরিয়ে এ বই এক দুর্গম পথ ধরে মহাযাত্রার কথা বলেছে। সে পথের একদিকে আছে অমানব, অবমানব, আর লোভের বশে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলা এক চরিত্র; অন্যদিকে আছে ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে মনুষ্যত্বের ক্ষীণ শিখাটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা ক'জন। এমন এক যাত্রার সাক্ষী হতে চাইলে অতি-অতি অবশ্যই এই বইটিকে পড়ুন। অলমিতি।
ফ্যান্টাসি এবং কল্পকাহিনীর মিশ্রণে বইটাতে বেশ নতুনত্ব ছিল। বিশেষ করে লেখক অম্বালিকার জগতকে খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। পড়তে পড়তে যেন মনে হচ্ছিল আমি সেই জগতে হারিয়ে গিয়েছি। নতুন নতুন প্রাণী যেমন উটিয়া বাঁদর এবং নীলগাই, ভিন্নর এগুলি এগুলোতে বেশ নতুনত্ব ছিল। কিন্তু প্রধান দুর্বলতা ছিল চরিত্র গঠনে। একমাত্র প্রধান চরিত্র রজত ছাড়া আর কারো চরিত্র খুব বেশি মন কাড়েনি। অথচ বিভিন্ন চরিত্রের সমন্বয়ে আরো ব্যাপ্তি আনার সুযোগ ছিল। শেষের দিকে অনেকটাই তাড়াহুড়ো লেগেছে। মনে হয়েছে, মাত্র দুশো পাঁচ পেইজে বইটা শেষ না করে আরও একশো দুশো পেজ বেশি হলে লেখক আরও বেশি ওয়ার্ল্ডবিল্ডিং এবং চরিত্র গঠনের সুযোগ পেতেন। তার পরেও বাংলা সাহিত্যে এমন সাইন্স ফিকশন এবং ফ্যান্টাসি সমন্বয় খুব কমই পেয়েছি। বিশেষ করে এটা ভাল লেগেছে যে লেখক কোনভাবেই রজতের চরিত্রকে সহানুভূতি দেখানোর চেষ্টা করেননি। দুঃখের বিষয় হল, রবি, মিতা এবং হিমুর চরিত্র সেভাবে ফুটে ওঠেনি যেভাবে লেখক চেয়েছেন। আর রিমার চরিত্র যেভাবে শুরু হয়েছিলো, তাতে আরো অনেক কিছু করবার সুযোগ ছিলো, অথচ হঠাতই যেন শেষ হয়ে গেলো। তবে হুজরাইন শুভা আর অসীমের স্বল্প উপস্থিতি মন কেড়েছে। রাজনৈতিক বিশয়গুলো এলেও সেভাবে মূর্ত হবার সু্যোগ পায় নি, অথচ লেখকের এখানে অনেক সু্যোগ ছিলো। তবে ভিন গ্রহের ভিন্ন পরিবেশ, প্রযুক্তি, প্রাণী সবই ভালো লেগেছে। কিন্তু আরো ভালো হতে পারতো। ৫ তারা দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এই সব কারণে ৩ তারাতেই থেমে যেতে হলো।
৩.৫ দেওয়ার মত। সম্পাদনায় টুকটাক নানা ভুল, জায়গার নাম চরিত্��ের নাম ইত্যাদি গুলিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার। ভুবন নির্মাণের কাজে খানিক ঢিলে পড়েছে মনে হল, অন্তত অর্থতৃষ্ণা যতটা আশা দেখিয়েছিল ততটা পাওয়া গেল না এখানে।
নতুন শব্দনির্মাণ করতেই হচ্ছে যখন, সেগুলো আরও একটু বেশি বাংলা ঘেঁষা হলে বোধহয় মন্দ হত না। ভিন্নরের পাশে বাংকার, যোধবণিকের পাশে ইনস্পেক্টর চোখে লাগে।
তবু এমত উদ্যোগ আশা জাগায়। রশোমনভিত্তিক মঙ্গলদেউড়ির পরে সোর্ড অফ ডুমের উপর ভিত্তি করে লেখা অসিশপ্ত পড়ার পরে ভবিষ্যতে অম্বালিকায় আরও দুই একবার ফেরার জন্য অপেক্ষা থাকবে। সুমিত বর্ধনের কলমে জোর আছে। ডাম্বলডোর যেমন বলেছিলেন, যাহা সহজ এবং যাহা সঠিক তার মধ্যে যথাযথটিকে তিনি খুঁজে নেবেন, এই কামনা।
সুমিত বর্ধনের ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং ক্ষমতা অসাধারণ। সেই "অর্থতৃষ্ণা" থেকে দেখে আসছি৷ এই উপন্যাসেও তাই। কাজের ফাঁকে বইটা নিয়ে বসে অম্বালিকাতে ঘুরতে গেছি, যেখানে মানব সভ্যতা সামনে এগনোর বদলে পশ্চাৎমুখী হয়ে গেছে। যেখানে ব্লিম্পে চেপে আকাশে ভ্রমণ করতে হয়। যেখানে আগ্নেয়াস্ত্রের অভাবে লোকেরা ধরেছে তরোয়াল। যেখানে হানাহানি আর অরাজকতায় ভরে গেছে চারদিক।
এমনিতেই কুরোশাওয়ার ফ্যান, তাই অনেক তরোয়ালবাজদের নিয়ে লেখা এই উপন্যাস আমার উপভোগ করার কথা। কিন্তু চরিত্রগুলোর জন্য তা সবসময় সম্ভব হয় নি। একমাত্র রজত, যে সমাজের আর অশুভশক্তির জন্য এক রক্তপিপাসু তলোয়ারবাজে পরিণত হয়, তাকে ছাড়া বাকিদের তেমন মনে ধরে নি। হিমু, মিতা আর রবিকে নিয়ে যদি আরেকটু সময় কাটানো যেত, তো বেশ ভাল হত।
PS: তলোয়ারবাজের নানা রকম 'তরিকা' আর যোদ্ধাদের নানারকম আধ্যাত্মিক 'স্তম্ভ', এইসব ছোট ছোট ডিটেইলসগুলোর জন্যই মূলগল্পটা একটা ভাল সাই-ফাই আর ফ্যান্টাসির মিশ্রণ হতে পেরেছে। এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে আরও গল্প লেখা হলে, সেগুলো পড়ার ইচ্ছে রইল।
কখনো কখনো এক-একটি উপন্যাস পাঠককে এমন এক জগতে টেনে নিয়ে যায়, যার থেকে সহজে ফিরে আসা সম্ভব হয় না — সেই নতুন জগৎকে কেবল ‘ভালো লেগেছে’ বলা শিষ্টাচারের অসম্মান হয়। সুমিত বর্ধনের অসিশপ্ত তেমনই এক আশ্চর্য কাহিনি — ধ্বংস, যুদ্ধ, আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন এবং মানবিকতার বিবর্ণ ছায়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক নান্দনিক-দার্শনিক অনুসন্ধান।
'অম্বালিকা' নামের কাল্পনিক গ্রহে বসতি গড়ে তুলেছে মানুষ; এই গ্রহ একসময় ছিল ‘ভিন্নর’ নামক উন্নত প্রজাতির আবাসভূমি, যারা হারিয়ে গেছে কোনো অজ্ঞাত ইতিহাসের চোরাবালিতে। তাদের ফেলে যাওয়া প্রযুক্তি, বসতি এবং অস্তিত্বের ছায়ার ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়েছে একটি জগত—যেখানে আধুনিকতা নেই, কিন্তু রক্তস্নাত মধ্যযুগীয় তলোয়ারবাজির প্রভুত্ব আছে। এই বিপজ্জনক, ধূসর গ্রহে শুরু হয় রজতের আত্মপরিক্রমার কাহিনি — যা একটি ছেলেকে সম্পূর্ণ রূপান্তরিত করে গড়ে তোলে অসি-ধারী এক মৃত্যুদূতে।
এই বইটির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার ‘ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং’। এই শব্দবন্ধ বাংলা সাহিত্যে একটু বেমানান মনে হলেও, অসিশপ্তের জন্য এটি ব্যবহার না করে উপায় নেই। অম্বালিকার ভূগোল, জলবায়ু, পশুপ্রাণী, রাজনীতি, সামাজিক রীতিনীতি এবং ধর্মীয় চর্চা — সব মিলিয়ে এটি যেন এক কল্পলোকের গুণগত পুনর্নির্মাণ। এখানকার সমাজ পিছিয়ে গিয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের যুগ থেকে তলোয়ারের উপাসনায়। এখানে ‘অসি’ কেবল অস্ত্র নয়, এক মনস্তত্ত্ব, এক দর্শন, এমনকি এক অস্তিত্ব। ভাষার দিক থেকে সুমিত বর্ধন এমন এক ঘনত্বের স্তর তৈরি করেছেন, যেখানে একাধিক স্তরে একই শব্দের আলাদা আলাদা ব্যঞ্জনা আছে। প্রত্যেক চরিত্রের মুখে আলাদা ভাষাভঙ্গি, ভিন্ন জীবনদৃষ্টি ফুটে উঠেছে—যা কল্পনার জগৎকে বাস্তবতায় পরিণত করেছে।
রজতের রূপান্তর এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু। এক নরম, দুর্বল এবং বারবার অপমানিত কিশোর কীভাবে এক বিভীষিকাময় যুদ্ধযন্ত্র হয়ে ওঠে, তার এক অন্তর্মুখী রূপরেখা লেখক এঁকেছেন অসাধারণ কৃতিত্ব সহকারে। অসির সঙ্গে রজতের সংযোগ ক্রমেই তাকে মানবিক বোধ থেকে displace করে হিংস্রতার দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু এই রূপান্তর আর পাঁচটা শারীরিক ট্রান্সফরমেশনের মতো নয় — এটা একেকটা আবেগ, সম্পর্ক, প্রত্যাখ্যান ও নিগ্রহের পারস্পরিক সেতুবন্ধনের ফল। হিমু, মিতা, রিমা, রবি, অতীন — যারা রজতের জীবনে এসেছেন — তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে রজতের সম্পর্ক এই রূপান্তরের একেকটা স্তর তৈরি করে।
এই উপন্যাসকে যদি বিশ্ব ফ্যান্টাসি সাহিত্যের শীর্ষ রচনাগুলোর সঙ্গে তুলনা করতে হয়, তবে Ursula K. Le Guin-এর Earthsea সিরিজ তো প্রথমেই আসবেই, কিন্তু এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। অসিশপ্ত যেন এক মহাযাত্রা, যেখানে Le Guin-এর ‘নেমিং’-এর মতোই প্রতিটি অসি, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি যুদ্ধ একটি অস্তিত্ববাদী বোধের দরজা খুলে দেয়। যেমন Le Guin ভাষাকে ব্যবহার করেন সত্তাকে নির্মাণের যন্ত্র হিসেবে, তেমনি সুমিত বর্ধনের অসিগুলি হয়ে ওঠে আত্মপরিচয়ের প্রতীক, দর্শন ও রক্তের অনুরণনে মোড়া।
কিন্তু অসিশপ্ত কেবল Le Guin-এ থেমে নেই। এতে Neil Gaiman-এর American Gods বা The Sandman সিরিজের মতোই একটি মিথ-সজাগ আধুনিকতা রয়েছে—যেখানে দেবতা, মানুষ এবং অস্তিত্বের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে সময়, প্রশ্ন করে বিশ্বাস। এই উপন্যাসে রয়েছে সেই গা-ছমছমে, অথচ বুদ্ধিদীপ্ত mythopoeia, যা Gaiman-এর লেখাকে যুগপৎ ব্যক্তিগত ও মহাকাব্যিক করে তোলে।
এবং যদি Pullman-এর His Dark Materials সিরিজের কথা উঠেই পড়ে, তাহলে বলা যায়—অসিশপ্ত তাঁর সাহসী উত্তরাধিকার। Pullman যেখানে ধর্ম ও জ্ঞানের সীমান্তে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন প্রতিষ্ঠানের দিকে, সুমিত বর্ধন সেখানে অস্ত্র, ধর্ম, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মোড়কে প্রশ্ন করেন পরমতত্ত্বকে, খোঁজেন আত্মজ্ঞানের ভেতরকার 'অসি'।
অথচ এই পুরো উপন্যাসের শিকড় কিন্তু প্রবলভাবে ভারতীয়। অসিশপ্ত-এর ভিতর দিয়ে যেন উঠে আসে বেদ-পুরাণের সেই অলক্ষ্য ধারা, যেখানে অস্ত্র কেবল হত্যা করে না, সে জাগ্রত করে. এখানেও আছে রামায়ণ-মহাভারতের মতো ‘ধর্মক্ষত্রে’ যুদ্ধ, যেখানে প্রতিপক্ষ আসলে এক গভীর আত্মপ্রশ্ন।
সুমিত বর্ধনের কল্পনাজগতে অস্ত্র আর যুদ্ধভাবনা তাই পশ্চিমা ফ্যান্টাসির টেমপ্লেট নয় — এ এক ভারতীয় আখ্যানধারার আধুনিক পুনরাবিষ্কার। যেন কালিদাসের রঘুবংশম্, বা ভবভূতির উত্তররামচরিতম্ এসে মিশে গেছে Samit Basu বা Amish-এর পরবর্তীকালের myth-fantasy ভাবনায়—কিন্তু অনেক বেশি ধ্রুপদী, অনেক বেশি উন্নত দর্শনচর্চার অভিঘাত নিয়ে।
এই উপন্যাস তাই শুধু একটা ফ্যান্টাসি নয়, এটা এক দার্শনিক মহাকাব্য। একাধারে তলোয়ারের গল্প, আবার অন্ধকারে নিজের ছায়া খোঁজার গল্প। অসিশপ্ত সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে, যেখানে ফ্যান্টাসি আর আত্মজিজ্ঞাসা হাত মিলিয়ে লেখে নতুন কাব্য।
আবার মনে পড়ে যায় N.K. Jemisin-এর Broken Earth Trilogy—যেখানে গ্রহ নিজেই এক চরিত্র, এক প্রাচীন রাগে ফুঁসতে থাকা সত্তা, যাকে থামানোর ক্ষমতা মানুষের নেই, শুধু একটু বোঝার চেষ্টা করা চলে। Jemisin তাঁর উপন্যাসে ভূতাত্ত্বিক শক্তিকে রূপ দেন ম্যাজিকের, অথচ সেই ম্যাজিক ভর করে এক বৈজ্ঞানিক বাস্তবতায়। সুমিত বর্ধন ঠিক বিপরীত দিক থেকে এগিয়ে এসে প্রযুক্তিকে ঘিরে তৈরি করেন এক গা-ছমছমে, ধর্মীয় মহিমায় মোড়া আধ্যাত্মিক আবহ—যেখানে কোডও হয়ে ওঠে মন্ত্র, অস্ত্র হয়ে ওঠে তপস্যা, আর অ্যালগরিদমও যেন কোনো প্রাচীন ঋষির বাক্য।
উভয় ক্ষেত্রেই, মানুষ শুধু নায়ক নয়—সে এক বিপন্ন, বিভ্রান্ত, আত্���ঘাতী সত্তা। নিজেই নিজের ধ্বংসরথের সারথি। Jemisin যেখানে প্রাকৃতিক প্রতিশোধের অভিঘাতে মানুষের অহংকারকে ভেঙে দেন, সুমিত সেখানে ইতিহাস, ধর্ম ও অস্তিত্বের প্রশ্নে গেঁথে দেন এক গভীর সংকট: আমরা কি ঈশ্বরের ছায়া, না প্রযুক্তির উপাসক, না কি নিজের হাতেই নিজেকে বিলুপ্ত করার একমাত্র কারিগর?
এখানে গ্রহ, অস্ত্র, দেবতা—সবই যেন এক বৃহত্তর বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করে। অসিশপ্ত-এর জগৎ তাই কেবল কল্প���ার নয়, বরং সময়ের কণ্ঠস্বর, ভবিষ্যতের পূর্বাভাস।
Tolkien-এর সঙ্গে তুলনা করলে প্রথমেই যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়, তা হলো — বর্ধনের বিশ্বনির্মাণ ঠিক তেমনই সুবিন্যস্ত, তেমনই পাণ্ডিত্যনির্ভর। কিন্তু এখানেই আসে একটি মৌলিক পার্থক্য — Tolkien-এর মহাবিশ্বে এক মহাকাব্যিক, নৈতিক স্পষ্টতা রয়েছে। সেখানে শুভ ও অশুভের মধ্যকার রেখাটি তীক্ষ্ণ। অন্যদিকে অসিশপ্ত সেই রেখাটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
Tolkien-এর জগতে আশাবাদ আছে — 'there is still hope for men', বলে ঘোষিত হয়। অথচ অসিশপ্ত-এ সেই আশার স্থান নিয়েছে এক দুর্ভাবনাগ্রস্ত, ক্লান্ত, এবং অনেক বেশি দ্বন্দ্বপূর্ণ মানবতা। এখানে কোনো নির্ভরযোগ্য Gandalf নেই, নেই কোন Frodo যার নিষ্কলুষতা আমাদের রক্ষা করতে পারে। এই জগতে সবাই কোনো না কোনোভাবে ধ্বংসের অংশীদার — চেতনায়, কর্মে, অথবা নীরবতায়। এখানে নায়ক নয়, প্রতিটি চরিত্রই একেকটি পরিত্যক্ত ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি — প্রত্যেকেই চেষ্টা করছে দানবের গর্জনের মধ্যে নিজের অস্তিত্বটুকু রক্ষা করতে।
এই ট্র্যাজেডি তাই হেলেনিস্টিক নয় — এটি আধুনিক, স্যাঁতসেঁতে, পরাবাস্তবতায় ঢাকা এক অস্তিত্ববাদী অরণ্য, যেখানে কোনো "Return of the King" নেই — শুধু আছে এক অনিশ্চিত জ্ঞান, এবং এক বিশৃঙ্খল মুক্তির ইঙ্গিত।
যেখানে Tolkien এখনও বিশ্বাস করেন নায়কত্বের সম্ভাবনায়, সুমিত সেখানে দাঁড়ান Camus, Beckett আর Dostoevsky-এর ছায়ায়। তাঁর ফ্যান্টাসি তাই "secondary world"-এর escapism নয়, বরং এক বিবমিষাময় truth serum—যা খেলে পাঠক বুঝে ফেলে, মানুষ আর দানবের মাঝে পার্থক্য যতটা ভাবা হয়েছিল, আদতে তা ততটা নয়।
সব মিলিয়ে, অসিশপ্ত যেন এক প্রতিধ্বনি—Tolkien-এর পরিপাটি মধ্যযুগীয় নৈতিকতার বিরুদ্ধে এক আধুনিক জগতের এলোমেলো অথচ তীক্ষ্ণ চিৎকার।
অসিশপ্ত বাংলা ভাষার এক বিরল ফ্যান্টাসি, কারণ এটি লোককথা বা পৌরাণিক পুনর্নির্মাণে আটকে না থেকে নিজের মতো করে এক নতুন বাস্তবতা গড়ে তোলে। সুমিত বর্ধনের ভাষা প্রায় ধর্মগ্রন্থীয়—এক ধরনের শ্লোকসুলভ টোনে তিনি রচনা করেছেন রক্ত, ঘাম, নিঃশ্বাস আর দর্শনের সহাবস্থানে এক জগৎ। এই জগৎ কোনও নির্দিষ্ট বয়সের পাঠকের জন্য নয়। শিশু-কিশোরের জন্য নয়। এটি সেই পাঠকের জন্য, যিনি সাহিত্যে জটিলতা, রূপক, ধূসরতা এবং দার্শনিকতা খুঁজে পান।
এই উপন্যাস কেবল কাহিনির জোরে দাঁড়িয়ে নেই। বইটির অলংকরণ, ম্যাপ, প্রচ্ছদ, টাইপসেটিং—সবকিছু মিলিয়ে একটি দৃষ্টিনন্দন এক্সপেরিয়েন্স। বিশেষ করে ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্যের প্রচ্ছদ ও ম্যাপমেকিং এই বইকে ‘গ্রাফিক নভেল’-এর নান্দনিকতায় উত্তীর্ন করেছে। পাঠক কাহিনির সঙ্গে নিজেকে অম্বালিকার মানচিত্রে চিহ্নিত করতে পারেন—এ এক অনন্য রোমাঞ্চ।
এই উপন্যাসের এক একটি অসিযুদ্ধ যেন বডি থিয়েটারের ভাষায় লেখা—দেহের প্রতিটি অঙ্গ, শ্বাস, ভঙ্গি, ক্ষিপ্রতা, করোটির অভ্যন্তরেও তার প্রতিধ্বনি রয়েছে। তবু এই শ্বাসরুদ্ধকর হিংস্রতায় ডুবে থেকেও লেখক আশা ছাড়েন না। মাঝে মাঝে দু’ফোঁটা করুণা, অথবা একটুকরো সংলাপ—একটি মানবিক ইঙ্গিত রেখে যায়, যা বলে দেয় যে, ‘সব শেষ হয়ে যায়নি।’
শেষে এটুকুই বলার যে 'অসিশপ্ত' একটি নিছক কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস নয়। এটি বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানচিহ্ন। এটি দেখিয়ে দেয় যে, আমরা শুধু ‘প্যারাডাইম শিফট’ ঘটাতে পারি না, বেঞ্চ সেই প্যারাডাইমের ভাষা, দর্শন, এবং নান্দনিকতা নিজের মতো করে তৈরি করতেও পারি।
যদি কেউ বলেন, “বাংলায় ভালো ফ্যান্টাসি হয় না”—তাহলে তাদের হাতে তুলে দিন অসিশপ্ত। যারা লা ফাঁস বা গোদা রোমান্টিক সাহিত্য চায়, তারা হয়তো পছন্দ করবেন না বিশেষ। কিন্তু যারা সাহস করে মানব অস্তিত্বের জটিল পথচলাকে ছুঁতে চান, তাদের জন্য এই বই এক অনিবার্য পাঠ।
জাপানি সাহিত্যের ধাঁচে নির্মিত এক কল্পিত গ্রহ অম্বালিকা-কে কেন্দ্র করে লেখক এক অরাজক সমাজব্যবস্থার গল্প রচনা করেছেন। কীভাবে রজত এক "ডারপোক, না মরদ" ব্যক্তি থেকে এক রক্তপিপাসু, খুনে যোদ্ধায় রূপান্তরিত হয়, তার বর্ণনা রয়েছে এই উপন্যাসে। পাশাপাশি, একজন সাধারণ গ্রাম্য মেয়ের—রিমার—উচ্চশ্রেণির শহুরে সমাজে নিজের স্থান করে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাও সমান্তরালভাবে উঠে এসেছে।
গল্পে বেশ কিছু চমকপ্রদ মোড় ও ঘটনার মোচড় আছে, যা পাঠককে ধরে রাখে। যদিও সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না, যার ফলে অনুমান করা যায়—এর একটি দ্বিতীয় পর্ব ভবিষ্যতে প্রকাশ পেতে চলেছে।
গল্পটি অসাধারণ না হলেও একেবারে খারাপও বলা যায় না—মাঝারি মানের একটি কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক রচনা। তবে যেটি বইটিকে আলাদা করে তোলে তা হল—প্রোডাকশন কোয়ালিটি ও অসাধারণ অলংকরণ।
বইটির শুরুতেই রঙিন একটি মানচিত্র দেওয়া হয়েছে অম্বালিকার, যা বাংলা বইয়ের জগতে এক অভিনব সংযোজন। বানান বা মুদ্রণজনিত ত্রুটি চোখে পড়েনি, যা প্রশংসনীয়।
প্রথমেই বলে রাখি সুমিতবাবুর লেখনী এই প্রথম পড়লাম। কয়েকমাস আগে কলবিশ্বের কিছু বই সংগ্রহ করেছিলাম, এই বইটির নাম এবং প্রচ্ছদ দেখে আমার ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক কোনো যোদ্ধার জীবনসংগ্রামের উপন্যাস মনে হয়েছিল, তারপর কৈফিয়ত পড়ে মনেহলো এই বইটা একবার পড়ে দেখতেই হচ্ছে, তার উপর বইটির মানচিত্র আর অলঙ্করণ গুলো দেখে বেশ পুলকিত হই।
বইটা শেষ করার পর সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। লেখকের অদ্বিতীয় লেখনীর সাথে আছে অসীম ক্ষমতা, চরম বিশৃঙ্খলা, অজানা প্রেক্ষাপট, অনুরক্তি, রাজনীতি, অনুশোচনা এবং বিষণ্নতার স্রোত।
আমার মনে হয়েছে যদি চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আরেকটু গুরুত্ব দেওয়া যেত তাহলে কিছু জায়গায় সেটা পাঠকদের উপর আরো বেশি প্রভাব ফেলতে পারতো ।
সর্বোপরি এরকম একটা উপন্যাস বাংলায় পড়তে পেরে, লেখকের লেখনী এবং বইটির production quality দেখে আমি 4.5 স্টার দিলাম।👍
লেখকের অর্থতৃষ্ণা পড়ার পর তার বাকি বইগুলো পড়ে দেখার উৎসাহ জন্মায়। এই বইটি এক নতুন ভুবন রচনা করে ভালো মন্দের এক লড়াইকে তুলে আনা হয়েছে অসি যুদ্ধের পটভূমিকায়। বইটির শুরু এক নতুন অচেনা জগৎকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই নতুন জগৎ বুঝতে বইটিতে থাকা মানচিত্র গুলি আমায় বেশ সাহায্য করেছে। এছাড়াও অসি চালানোর কায়দা গুলির ছবিও এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে। বইটির কেন্দ্রে এক নীতি, মায়া, মমতা হীন এক পরিবর্তিত মানুষ। এবং তার বিপক্ষে পুরো মানব সমাজের প্রতিরোধ নিয়েই গল্পঃ এগিয়ে চলেছে। বইটি সুখপাঠ্য, নতুন গ্রহের নতুন প্রযুক���তি বলতে এখানে তেমন কিছু বলা নেই। অনেক অসি যুদ্ধের বিবরণ আছে যা আমার মতে গল্পের মধ্যে অনাবশ্যক , তবে এরকম বিষয় নিয়ে গল্পঃ লেখার জন্য লেখকের সাধুবাদ প্রাপ্য।