এই সংকলনটিকে একদিকে চার মহাদেশের বিভিন্ন কাল,ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা কল্পবিজ্ঞানের প্রতিনিধিত্বমূলক কাহিনির সংগ্রহ হিসেবে দেখা যায়। একইসঙ্গে, সায়েন্স ফিকশনের বিভিন্ন কৌশলকে ব্যবহার করে লিখিয়েদের সমসময়ের বাসভূমির জীবন, যন্ত্রনা, রাজনীতি অথবা নিছকই রোমান্টিক কল্পনাবিলাসের নথি হিসেবেও পাঠক এ-গ্রন্থের পাঠ নিতে পারেন।
বইটা বহুদিন আগে পড়া হলেও তার পাঠ-প্রতিক্রিয়া অ্যাদ্দিনে দিচ্ছি বলে আগেই দুঃখপ্রকাশ করছি। আসলে বোঝেনই তো, বয়স হচ্ছে, সবদিকে খেয়াল থাকে না। যাইহোক... এই বইটির সঙ্গে এপার বাংলায় প্রকাশিত আর পাঁচটা অনূদিত গল্প-সংকলনের দুটো বড়ো পার্থক্য আছে। সেগুলো হল~ ১) বিষয়টিতে সম্পাদকের নিজস্ব জ্ঞানগম্যি প্রশ্নাতীত হওয়ায় কোনো অনুবাদকই 'রোবটের চোখে জল' বা 'ভূত বনাম ভিনগ্রহী' টাইপের ছাইপাঁশ দিয়ে পাতা ভরাট করেননি। বরং প্রত্যেকেই এমন কোনো-না-কোনো গল্প বেছে নিয়েছেন যা প্রথাগত কল্পগল্পের তুলনায় অন্যরকম— হয়তো বা আরও একটু বেশি মানবিক। ২) এই সংকলনের সবক'জন অনুবাদকই নবীন প্রজন্মের প্রতিনিধি— যা শুধু ব্যতিক্রমী নয়, দুঃসাহসিকও বটে। গল্পগুলো সিরিয়াসলি বৈচিত্র্যময়, অনুবাদও ঝরঝরে এবং মূলানুগ। কল্পবিজ্ঞানের নামে তথাকথিত মূলধারার পত্রপত্রিকায় যা চালানো হয় সেইসব হাবিজাবির বদলে অন্যরকম, একটু ছকভাঙা কল্পবিজ্ঞান পড়তে চাইলে এই সংকলনটিকে উপেক্ষা করবেন না।
একটানে পড়া, চুমুকের পর চুমুক—এক অলৌকিক ট্রিপ: ‘FTL’ সংকলনের পাঠ-প্রতিক্রিয়া
অনুবাদিত কল্পবিজ্ঞান, নস্টালজিয়া, এবং মানবিকতার স্টারম্যাপ
শেষ কবে একটানে কোনো গল্পসংকলন পড়েছি মনে নেই। আজ বৃষ্টিভেজা শহরে, এই বইটা মনে করিয়ে দিল সেই দেবসাহিত্য কুটিরের শৈশব, দুহাতে শার্লক হোমসের অনুবাদ, অনবদ্য অদ্রীশ বর্ধনময় কৈশোর, আর ননী ভৌমিকের রুশ কল্পবিজ্ঞানের তরতরে দিনগুলি। তবে nostalgia স্রেফ আলতো ছোঁয়া দেয়, পুরো বইটা যেন একধরনের তাজা ককটেল—যেখানে translation একটা পারফেক্ট lemon mixed Vodka on the rocks।
FTL (Faster Than Light) সংকলনের প্রতিটি গল্প যেন একেকটা বিচিত্র গ্রহ, যেখানে editor দীপ ঘোষ নিজেই একটা ইন্টেলিজেন্ট স্পেসপোর্ট খুলে রেখেছেন। গল্প বেছে নেওয়া, অনুবাদকদের নির্বাচন, আর সেই অনুবাদ—সব মিলিয়ে এই বইটা একটা ছোটখাট মার্স মিশনই বলতে হয়।
একটু খোলসা করি।
একঝাঁক অনুবাদকের ‘ফার্স্ট কন্ট্যাক্ট’—জীবন্ত, সাহসী, এবং বাংলা-প্রেমে ভেজা
এই সংকলনের দ্বিতীয় বড়ো চমক—অনুবাদকরা প্রত্যেকেই নবীন প্রজন্মের। কিন্তু তাঁরা শুধু অনুবাদক নন — তাঁরা নিজেরাও মূল ধারার বাংলা কল্পবিজ্ঞানের লেখক। মানে, translation এখানে শুধু nine to five job নয়, একধরনের আত্মীয়তা। ফলে যেটা হয়েছে, গল্পগুলোর অনুবাদে একটা natural fluency এসেছে — না আছে বাংলার over-literary, না ইংরেজির উৎকট গন্ধের আধিক্য।
দীপ ঘোষ, সুপ্রিয় দাস, ঋজু গাঙ্গুলী, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, অঙ্কিতা—সবার হাতেই অনুবাদ যেন একটা ‘রিসেট বোতাম’ টিপে দিয়েছে বাংলার কল্পবিজ্ঞানে।
গল্প-গ্যালাক্সি: এক গল্প থেকে অন্য গল্পে যেন স্পেসওয়াক
১. “আপদ” – অনুবাদ: দীপ ঘোষ:
রুশ লেখিকা ইয়েলেনা খারিয়াচেভার এই গল্পটা পড়ে ফেলতেই মনে পড়ে গেলঃ "হাস্যরসের ভিতরে বিষ, আর বিষের ভিতরে জীবন।"
বাহ্যিকভাবে খুব সাধারণ, কিন্তু ভেতরে একেবারে ব্ল্যাক হিউমার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই Gogol meets Galaxy Quest টাইপ। এটা এক পেনশনার রুশ মহিলার দৈনন্দিন জীবনে এক নাছোড়বান্দা এলিয়েনের অনুপ্রবেশের গল্প। সেই এলিয়েনটা ওকে শান্তি দিচ্ছে না, ছায়া হয়ে থেকেও উল্টোদিকে তার সমস্ত আর্থিক সমস্যার সমাধান করছে। ব্যক্তিগতভাবে এটা আমার সবচেয়ে পছন্দের—না শুধু অনুবাদের সূক্ষ্মতার জন্য নয়, বরং হাস্যরসের পিছনে যে যন্ত্রণাটুকু বিদ্যমান, সেটা দীপ অসাধারণভাবে এনেছেন।
২. “ঘুমের মধ্যে মুক্তি” – অনুবাদ: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
পোলিশ কল্পবিজ্ঞান লেখক সিওনঝেকের এই গল্পটা “দ্য স্যান্ডম্যান” আর “ইটারনাল সানশাইন…”-এর একটা মিলিত পাঠ। এক সাইকোলজিস্ট, তার ক্লায়েন্টের স্মৃতি মুছে দেয়ার যন্ত্র, এবং ধীরে ধীরে সেই সাইকোলজিস্টের নিজস্ব আত্মবিস্মরণের গল্প—যা শেষমেশ একটা মেটা-টুইস্টে গিয়ে পৌঁছায়। দেবজ্যোতির অনুবাদে রয়েছে clinical সরলতা, কিন্তু কোথাও একটা হৃদয়বত্তার সুতো ঝুলছে পুরোটা জুড়ে। এক ধরণের বিষণ্ণ বিজ্ঞান।
৩. “নারীর চোখে পুরুষ”—জাপানি ও ভারতীয় গল্প
বইয়ের শুরুতে এবং শেষে দুটি গল্প যেন দুটি অক্ষাংশ। জাপানি লেখিকা হীরো আইওয়াতার গল্প ১৯২০-এর দশকে লেখা হলেও, আজও কাঁটার মত বেঁধে যায়। সেখানে পুরুষটা এক অদ্ভুত বস্তু—পাশে থেকেও দূরে, ঘনিষ্ঠ হয়েও অধরা। অন্যদিকে ভারতীয় লেখিকার গল্পটা ১৯৮০-এর—এক জনপদে, যেখানে নারীর যৌনতা ও agency পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর সামনে একরকম বিদ্রোহ। এই দুই গল্প যেন একটা দীর্ঘ বৃত্ত আঁকে—নারীর দেখা পুরুষ, দুই দশকের ব্যবধানে, দুই সংস্কৃতিতে।
বৈচিত্র্যই আসল শক্তি—‘FTL’-এর ১১টি গল্প, ১১ রকমের টেক্সচার
এই বইয়ে আছেন আর্জেন্টিনার স্পেকুলেটিভ পাপ, ফ্রান্সের এলিয়েন দর্শন, ব্রিটেনের পোস্ট-রিলিজিয়াস অ্যাংস্ট, রাশিয়ার পোস্ট-সোভিয়েত অলৌকিকতা—প্রত্যেকটা গল্প একেকটা চিন্তার ছোট ধাক্কা।
কিছু কিছু গল্প পড়ে মনে হয়, “এই তো sci-fi—যা মানবিক জিজ্ঞাসাকে কেন্দ্র করে, না যে স্রেফ টেকনোলজির মোড়কে।” মনে পড়ে যায় Ursula Le Guin-এর কথা: “Science fiction is not about the future, it's about now.”
অনুবাদের ভাষা ও স্বাদ—এ যেন ঘরোয়া রান্নায় বিদেশি সুগন্ধি
উদাহরণস্বরূপ, দেবজ্যোতির অনুবাদে যখন চরিত্র বলে, “সে আমাকে আমারই স্বপ্নে আটকে রাখে,” তখন মনে হয়—হ্যাঁ, এ বাংলারই লাইন, কিন্তু গায়ে একটা অন্যরকম শীতলতা।
অঙ্কিতা বা ঋজু গাঙ্গুলীর অনুবাদেও একটা রিদম আছে। এঁরা মূল লেখকদের ন্যারেটিভ টোন মেন্টেন করেছেন ঠিকই, তবে বাংলা পাঠকের জন্য রসদটাও রেখে দিয়েছেন। নতুন প্রজন্মের পাঠক যেমন পড়ে মজা পাবে, তেমনই রেট্রো পাঠকরাও হারাবেন না।
অন্য সংকলনের তুলনায় FTL কেন আলাদা?
সোজা কথা, এই বইতে কেউ “রোবটের চোখে জল” টাইপ emo sci-fi লেখেনি। না এখানে প্লাস্টিক সায়বোর্গের প্রেম কাহিনি, না একঘেয়ে টাইম ট্রাভেল ড্রামা। বরং—অন্যরকম, ছকভাঙা, আবেগঘন।
কয়েক বছর আগে (দু'বছর আগে কী?) Joydhak-এর ‘বিশ্ব কল্পবিজ্ঞান সংকলন’ কিংবা এক দশক আগের ‘বিজ্ঞানচিন্তা’ সঙ্কলনের সঙ্গে তুলনা করলে পরিষ্কার বোঝা যায়—‘FTL’ অনেক বেশি human-centered, grounded, nuanced।
এই বই কারা পড়বে? শুধু কিশোররা? নাকি হিপস্টার সায়েন্স ফিকশন পাঠকও?
এই বই একাধারে সেই মধ্যবয়স্ক পাঠকের, যে অতীতে ‘অবকাশ’ ম্যাগাজিনে ইজরায়েলি গল্প পড়েছেন। আবার সেই তরুণীর, যিনি হাতে ফোন নিয়ে পড়তে পড়তে মনে মনে নিজেকেই কল্প করছেন গল্পের চরিত্র। এই সংকলন বলে—কল্পবিজ্ঞান মানে শুধু স্পেসশিপ না। কল্পবিজ্ঞান মানে স্পেস within, এবং between us.
শেষ কথা: হে পাঠক, বইয়ের কাছে ফিরে যান
“FTL” কেবল বই না। এটি এক নতুন বাংলা কল্পবিজ্ঞানের পাসপোর্ট—যা ট্রান্সলেশনকে ফের একবার প্রমাণ করে দেয়, ভাষা নয়, মানবিকতা-ই আসল ফর্ম অফ কমিউনিকেশন।
তাই বলি—অন্যরকম কিছু পড়তে চাইলে, sci-fi-তে একটা human reboot চাইলে, এবার “FTL”-এ হাত বাড়ান।
হয়তো আপনার পছন্দের গল্প "আপদ" হবে, বা "ঘুমের মধ্যে মুক্তি"। হয়তো শেষ গল্পটা পড়ে আপনার নিজেরই কোনো পুরনো তন্দ্রার আবেশ কেটে যাবে।
কিন্তু একবার শুরু করলে, complete না করে উঠতে পারবেন না।