সিমকার্ডের সাথে একটি হত্যার কী সম্পর্ক? গ্রামে হঠাৎ মারা যাচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা, এক নারী সবাইকে চিনতে পারলেও তাকে চেনা যাচ্ছে না, এক কামরার ঘর আটকে রেখেছে চারটি মানুষকে, জন্মদিনের উৎসবে ছোট হয়ে যাচ্ছে একজন,বাড়ি থেকে বের হয়ে কেউ সাতবার বন্ধ করছে দরজা, এদিকে এক ম্যাজিশিয়ান আঁকছে কবিতা- তবে কি অদৃশ্য মহামারীতে আক্রান্ত জগৎ অকস্মাৎ বদলে দিচ্ছে সব কিছু?
পাঠক কি পারবে 'মাহরীন ফেরদৌস' এর এই বিচিত্র গল্পজগতের অংশ হয়ে উঠতে?
মূল ফ্ল্যাপ হতেঃ
অরিগামির গোলকধাঁধায় গ্রন্থটির গল্পজগৎ সাদাকালো চোখে দেখার, নাকি অন্তর্গত দৃষ্টি দিয়ে স্পর্শ করার? এই ভাবনা আসতে পারে বইটি পড়ার সময়। আঁধার, বিভ্রম, রূপান্তর, বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা একত্রিত করে গল্পকার বুনেছেন এসব কাহিনি। বিপরীতমুখী ভাবনা নিয়ে বলে যাওয়া গল্পগুলোর কোথাও আছে সমকালীন সংকট, ব্যক্তির মানসিক টানাপড়েন, প্রেমের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, কোথাও-বা সমান্তরাল মহাবিশ্বে চেনা চরিত্রকে আবিষ্কারের গোপন নির্যাস।
চৌদ্দটি গল্পের আলো-ছায়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চারপাশের চেনা জগৎ। কিন্তু তারই গভীরে যে এত বিষাদ, এত আনন্দ এবং নতুন করে জীবনকে উদযাপনের আয়োজন ছিল সেসবই গল্পকারের সহজ কথাবয়নে উঠে এসেছে। সহজভাবে কাহিনিগুলো এগিয়ে গেলেও তারই মধ্যে চেতনার রং ছড়িয়ে পড়ে। কোথাও দুলে ওঠে রহস্যময়তার সূক্ষ্ম ঝালর। আর এভাবেই মাহরীন ফেরদৌসের গল্প পাঠককে নিয়ে যাবে নতুন এবং অভাবিত এক জগতের ভেতর।
Mahrin Ferdous is the author of eleven books across adult and children’s literature. Her fiction inhabits the border of surrealism and magic realism, where social upheaval collides with psychological dislocation and the hidden architectures of memory. Her stories blur reality and the uncanny, drawing readers into worlds that are unsettling yet deeply human.
In 2019, she was named one of Bangladesh’s five most promising young writers by Banglalink Telecom. She received the BRAC Bank–Samakal Literary Award in 2022 for her contributions to Bangla literature. Beyond her books, she serves as Vice President of the Pencil Foundation, a nonprofit dedicated to youth creativity and social engagement.
She now lives in New York, where she continues to write and work.
মাহরীন ফেরদৌসের ভাষা গীতিময়।কথনের ভেতর একধরনের অন্তর্নিহিত ছন্দ আর সুর আছে।এই ছন্দ আর সুর বেশ একটা আবেশ সৃষ্টি করে। গল্পগুলো পড়তে পড়তে আমরা জানতে পারি (বা স্মৃতি থেকে পুনরুদ্ধার করতে পারি) পৃথিবীর সব গল্পই আসলে ভুলে থাকার গল্প।সহসা আমাদের মনে পড়ে বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়।সবকিছু ছেড়ে দূরের কারও জন্য তার সাথেই আমরা জলের মতো ঘুরতে থাকি।পৃথিবীর শেষ গান শুনতে তৃষিত চিত্তে অপেক্ষা করি।মধ্যরাতে খোলা উঠানে উত্তরের বাতাসে অচেনা এক তৃষ্ণার ঘ্রাণ তীব্র হয়ে ওঠে কখনো কখনো। কিছু গল্প স্থান, কাল, পাত্রভেদে যে কোনো সময়ের হতে পারে।এ চিরন্তনতা পাঠকের মনে বিস্ময় ও বিষাদের রেশ রেখে যায়।কিছু গল্প বারবার পড়ার মতো।যেমন: ভুলে থাকার গল্প,প্যারাকজম, চেকলিস্ট, মথ।কিছু গল্প সাবেকি ধরনের ;পুরোনো মহীরুহ গল্পকারেরা সেসব লিখে গেছেন।এই গল্পগুলোর প্রতি লেখিকা নির্দয় হতে পারতেন। যা হোক,আপাতত নতুন একজন লেখিকা (যার অন্য বইগুলোও খুঁজে খুঁজে পড়তে হবে) আবিষ্কারের আনন্দটুকু উপভোগ করি।
একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টি যেখানে শেষ হয়, ঠিক সেখান থেকে একজন ফটোগ্রাফারের দৃষ্টির শুরু হয়। আলোকচিত্রের মাধ্যমে মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দী করার এই প্রবণতা থেকেই অনেক সাধারণ, অতি তুচ্ছ দৃশ্যও ধরা পড়তে পারে অন্যরকম আলোয়। একজন লেখকও ঠিক সেই কাজটাই করেন। পারস্পারিক যোগসূত্রহীন,আপাত বিশৃঙ্খল সাধারণ সব দৃশ্য- অভিজ্ঞতাকে অর্থ দিয়ে বিশেষ করে তোলেন অক্ষরের বুননের উপর নিজস্ব ভাবনার রঙ চড়িয়ে। নতুন খেলনা হাতে পেয়ে শিশুর মুখের হাসি অথবা আনন্দের আড়ালে দীর্ঘলয়ে বাজতে থাকা জীবন নামক খলনায়কের বিকট হাসি এই দুইয়ের মাঝে জীবনের কতশত মজা, বিষণ্ণতা,একাকীত্ব সবই বিশেষ হয়ে উঠতে পারে যদি সেসব কিছুই মোড় নেয় এক অকল্পনীয় অপ্রত্যাশিত গতিপথে। চারপাশের যে জীবন আমরা দেখি,যে জীবন যাপন করি, সেসবের মধ্য থেকেই কখনও জেগে ওঠে ভাঁজ করা কাগজের নৌকার মতো কিছু একটা। নানা দিক থেকে তাকে উপস্থাপন করাই লেখকের কাজ। বাতিল,অতি-সাধারণ সামান্য সব কথা,দৃশ্য,ফেলে আসা দিনগুলো যারা রোজ টোকা দেয় মনের দরজায় তাদের নতুন পোশাক পরিয়ে দিতে পারেন তিনি। মুদ্রার উল্টোপিঠে বিশেষ,অপ্রচল ঘটনার বিন্যাস-সমাবেশও গল্প হয়ে উঠতে পারে, তবে সেই গল্পের প্রতি কেন্দ্রীভূত মনোযোগ স্থির কক্ষপথে বেশ সহজেই ঘুরতে পারে, মনোযোগ ধরে রাখার জন্য বিশেষ আয়োজনের প্রয়োজন হয় না।
মাহরীন ফেরদৌসের "অরিগামির গোলকধাঁধায়" বইয়ের গল্পগুলোতেও এই সাধারণের বিশেষ হয়ে ওঠার পাশাপাশি অপ্রচল নতুনত্বের দেখাও মেলে। তার গল্পে এক নাগরিক সন্ধ্যায় আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ের আলো-আঁধারিতে জীবনের নির্মমতায় চুরমার হওয়া জেরিনকে আমরা আত্মাহুতির বদলে মথের অতিকায় পিচ্ছিল শরীরে বদলে যেতে দেখি। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই পরের গল্পে, আহত চাঁদের কিংবা বিষণ্ণ রাতের মতো একা একা বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দেন তিনি। ধীরে ধীরে নিয়ে যান এমন এক ঘুণে ধরা মস্তিষ্কের প্যারাকজমের জগতে যেখানে কর্পোরেট কালচার আর সিজিআইতে ভরপুর কৃত্রিম জগত থেকে পালবার জন্য এক তরুণী বান্ধবীর ফ্ল্যাটের উল্টোপাশের ফ্ল্যাটটার নাম না জানা ছেলেটার মাঝে খুঁজে নেন এস্কেপ। আমরা জানতে পারবো সেই রূপকথার গল্প যেখানে অদৃশ্য মহামারীতে হঠাৎ এক গ্রামের শিশু বৃদ্ধরা মারা যেতে থাকে। চন্দন গাছ কেঁদে ওঠে নিষ্পাপ শিশুর মতো। মহামারী থেকে প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া এক নূহের নৌকার সাথে দেখা হয়ে যায় পূর্ণচন্দ্রের। ঠিক মধ্যরাতে সেই চাঁদের গায়ে মস্তবড় একটা বাঁকা নৌকার ছায়া পড়ে। রাবিতা,রেবেকা কিংবা রক্তিমের জীবনে যখন মধ্যরাত শেষ হতে যখন কিছু সময় বাকি, সেই সময় উত্তরের বাতাসে তৃষ্ণার ঘ্রাণকে ফেলে উঠোন পেরিয়ে আমরা পারফিউম ইন্ডাস্ট্রির এক কর্ত্রীর সাজানো শরীরে অঞ্জন দত্তের মালাকে খুঁজে পাই, তার মনের ভিতরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে স্মৃতি হাতড়ে খুঁজতে চেষ্টা করি, সে তার ক্লাসমেট রুবিকে আসলেও কি চেনে? "আপনারা কি কখনো একাকীত্ব অনুভব করেছেন? সত্যিকারের একাকীত্ব। কোনো কবির বানোয়াট কবিতার মতো নয়। কিংবা কখনো উপেক্ষার কিংবা অপেক্ষার ঘ্রাণ নিতে পেরেছেন?"
এক কামরার ঘরে এইসব প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে আমাদের মনে ধোঁয়াশা আর বাস্তবতার সংঘর্ষ তৈরি করেন তিনি। এবার আমরা নিজেদের জীবনের দগদগে অথচ টুকরো স্মৃতির গল্প ভুলে থাকার চক্রে ঢুকে পড়ি। বিস্কুটের গুঁড়োর মতো এক বিকেলে কখন যে অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত এক ব্যক্তির চেকলিস্ট চেক করতে থাকি সেটা টেরও পাই না। ক্রমশ রাতে নামে,হাজার বছরের পুরোনো সেই রাত। এক ম্যাজিশিয়ানের কবিতা আঁকার গল্প শুনতে শুনতে মনিদ্র অন্ধকারের রাতে আমরা পথ চলতে থাকি। সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে সেই ত্রুটিপূর্ণ অঙ্গের বোনকে দেখতে পাই সে অসম্ভব গম্ভীর ও শীতল স্বরে নিজের ছোট ভাইকে চিনিয়ে দিয়ে ভুল ভাঙে আমাদের মতোই কতিপয় ভ্রান্ত পথচারীদের। জোসেফের দেয়া অরেঞ্জ পাই,কুকি কাস্টার্ড কিংবা পপি সিড দেয়া পেস্ট্রির ঘ্রাণ শুঁকতে শুঁকতে এক ভীষণ বৃষ্টি দিনে হাজির হই নর্থ স্ট্রিটে। যেখানে মিস্টার ইয়েলো বৃষ্টির পানিতে নিজের করতল বাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলবে, 'একদিন এই পৃথিবীতে কোনো গান থাকবে না।' বুকের ভেতরে পাক খেতে খেতে বিলীন হয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়কে সাথে নিয়ে পৃথিবীর শেষ গান শুনতে যখন আমরা কান পাতবো,তখনই শেষ হবে আঁধার,বিভ্রম, রূপান্তর,বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার এইসব বিচিত্র কাহিনীর আলো-ছায়ার খেলা।
যে কোনো গল্পের গল্প হয়ে উঠতে ক্রাইসিস লাগে। এই সংকলনের গল্পগুলোর বেশিরভাগেই সেটা উপস্থিত। গল্পগুলোর মধ্য সবথেকে কমন হলো ফ্যামিলিয়াল ক্রাইসিস,ব্যক্তির মানসিক টানাপোড়েন,সম্পর্কের নানা মোড়,মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা,একাকীত্ব, বিষণ্ণতা কিংবা সমকালীন সংকট। সেই সূত্রে অনন্য হয়ে উঠেছে মথ, প্যারাকজম, বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়,চেকলিস্ট, ভুলের থাকার গল্প। এক কামরার ঘর আর সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে গল্প দুটো মনে থাকবে তাদের ধোঁয়াশাপূর্ণ সমাপ্তি আর বিপরীতমুখী ভাবনার উদ্রেক ঘটানোর জন্য। তবে ব্যক্তিগতভাবে সবথেকে বেশি বোধহয় মনে থাকবে, মনিদ্র অন্ধকারে গল্পটার কথা। এই গল্পটায় একজন ম্যাজিশিয়ান এঁকে চলেছেন কবিতা। বিশেষত এইসব গল্পই সংকলনটাকে সুখপাঠ্য করে তুলেছে, বারবার এনে দিয়েছে নস্টালজিক হ্যাংওভার।
চক্র,মধ্যরাত হতে কিছুটা সময় বাকি সংকলনের এই গল্প দুটো মনে হয়েছে যে খুবই রিপিটেটিভ সাবজেক্টের উপর ভিত্তি করে লেখা। এই ধরনের গল্প আগেও লেখা হয়েছে অন্য কোনো রূপে,অন্য কোনো নামে। "বিস্কুটের গুঁড়োর মতো বিকেলে" কতটা গল্প হয়ে উঠেছে সেটা আমি ধরতে পারছি না। গল্পের থেকে বরং এক বৈকালিক ভ্রমণের ঘটনাপ্রবাহের দৃশ্যায়ন বেশি মনে হয়েছে। এই গল্প কটা না থাকলেও সংকলনের খুব একটা ক্ষতি হতো না।
মাহরীন ফেরদৌসের বর্ণনাভঙ্গি মনে দাগ কাটবার মতো। দক্ষ বয়নশিল্পীর নানা রঙে রাঙানো সুতোর মিশেলে তৈরি রঙিন জামদানির মতো আকর্ষণীয় অথচ আপাত সহজ ধারাবর্ণনায় এগিয়েছে প্রতিটা গল্প। গল্পের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যতাকেও ছাপিয়ে গেছে এই দারুণ ন্যারেটিভ দক্ষতা।
গল্পগুলো বেশিরভাগই নারীচরিত্র প্রধান আর ক্যারেকটারগুলোর নিজস্ব ভাবনার বারান্দায় পায়চারী করতে করতে শোনা মনোলগের মাধ্যমেই গল্প এগোতে দেখা যায়। চরিত্রগুলোর অনুভূতির আকুতি,বিপন্নতা, অসহায়ত্ব আর টানাপোড়েন খুব নিপুণভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন লেখিকা।
শেষ পর্যন্ত গল্পগুলো পড়তে গিয়ে অরিগামির গোলকধাঁধায় নিজেকে হারিয়ে পাঠকের মনে হতেই পারে, "নৌকা কি কাগজে বন্দি? না কাগজই আটক, নৌকাতে? ভাসিয়ে দেবার পর আজ আর কী আসে যায় তাতে। "
প্রতিটি মানুষের দেখার চোখ আলাদা। এমন ভিন্ন ভিন্ন অনেক চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখতে আমার ভালো লাগে, এই ভালো লাগা আরও বেড়ে যায় যখন সন্ধান পাই একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির, তখন ঐ চোখের সাথে আমি একাত্ম হই, শুরু করি নিরুদ্দেশ যাত্রা। মাহরীন ফেরদৌস'এর 'অরিগামির গোলকধাঁধা' পড়তে পড়তে পেয়েছি এমনই এক সফরের স্বাদ। স্রেফ শব্দ দিয়ে মাহরীন তৈরি করেছেন এমন এক গোলকধাঁধা, যা থেকে বের হওয়ার সহজ কোন পথ নেই।
পিচ্ছিল কোন শরীর নিয়ে তাই জেরিন যখন এগিয়ে আসতে থাকে কাছে, তখন ফোরশ্যাডো হয়ে আসা উলফ পাঠক আমাকে দেয় সাহস, আবিষ্কার করি 'মথ' হয়ে বেঁচে থাকার রহস্য। এই রহস্যকে আরও ঘনীভূত করতে কালো হয়ে আসে আকাশ। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ে, আমি গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে হারিয়ে ফেলি ছাতা, যোগাযোগ বন্ধ করার জন্য ভেঙে ফেলি সিম। আমজাদ মিয়া নামের কোন এক ব্যক্তি আমাকে অনুসরন করতে করতে হারিয়ে ফেলে পথ আর কখনও ফিরেও আসে না, তাঁকে আমার বলতে ইচ্ছে হয়, 'বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়'। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কখন সন্ধ্যা হয়ে আসে টের পাইনা। কিছু নীড় হারা পাখিকে তখন দেখি দিকভ্রান্তের মতো উড়ে চলেছে মাথার উপর, কে জানে ওঁদের এই অস্থিরতাই হয়তো জন্ম দেয় 'চাঁদের গায়ে ছায়া'। এই অদ্ভুত ছায়া দেখতে দেখতে মনের মধ্যে তৈরি হয় এক নানন্দিক এক্সপেক্টেশন। ঐ যে শুরুতে বলেছিলাম, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর কথা, এই গল্প যেন তারই প্রতিফলন। মস্ত বড় নৌকার ছায়া যখন চাঁদের গায়ে পড়ে, তখন আমিও ভুলে যাই নিজের অস্তিত্ব। তাই নিজেকে খুঁজতে থাকি, খুঁজতেই থাকি। নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে দেখা পাই আধো আধো দুঃখের, আমাদের মধ্যবিত্ত যাপন, ফানুশ হয়ে উড়ে যাওয়া স্বপ্নে নিজেকে যখন খুঁজে পাই তখন দেখি 'মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি'। ভোরের অপেক্ষা করি। সারারাত জেগে থাকা দাঁড়কাকও হয়তো আমার মতোই আছে অপেক্ষারত। এই ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে এক কসমোপলিটন বাস্তবতার কথা, যেখানে রুবিকে কেউ চিনতে পারে না। ধরা আর অধরার মতো কোয়ান্টাম থিয়োরি মেনে তখন ফিরে যেতে চাই আমার পরিচিত 'এক কামরার ঘরে', যে ঘরে তৈরি হয় ঘোর। যে ঘর মেনে চলে গোলকধাঁধার সকল সূত্র। এই সূত্রে আছে একটি 'চক্র'। ম্যাজিক রিয়েলিজম নির্ধারণ করে এই চক্রের ভাগ্য... আবার ফিরে আসে ঐ দৃষ্টিভঙ্গি, আলাদা এক চোখ। শূন্যের উপর দাঁড়ানো এই চক্র আমি ভাঙতে পারি না, আর এই ব্যর্থতাই হয়তো সন্ধান দেয় অ্যাবসলিউট বিউটির। বিউটি'র সংজ্ঞা আমি দিতে পারি না। চারপাশে দেখি ফুটে আছে কতো ফুল। হয়তো গোলকধাঁধার মধ্যে কোন বাগান আছে। আমি এখনও ম্যাপটা পারিনি আঁকতে। তাই 'চেকলিস্ট' খুলে বসি আর ফিরে আসে পুরনো ওসিডি। মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত নাকি মনস্তাত্ত্বিক মুক্তি কে জানে, এক অমীমাংসিত ধাঁধাকে পিছনে ফেলে আমি চলে যাই ভুলে থাকা কোন গল্পের কাছে। এই গল্পটা তেমন, যেমন গল্পে আমি স্বস্তি পাই, দেখা পাই বিপন্ন বিস্ময়ের। কারণ, আমি জানি আমাদের সবার গল্পই আসলে ভুলে থাকার গল্প। তবু কী সব ভুলে থাকা যায়? 'মনিন্দ্র অন্ধকারে' ছাই হয়ে যায় সলতে। অ্যামাজন থেকে অন্ধকার এসে মিশে যায় এই গোলকধাঁধায়। পরাবাস্তববাদ কিংবা পেসোয়ার বুক অব ডিসকোয়ায়েটে কেটে যেতে থাকে রাত আর অ্যান্টি ক্লক-ওয়াইজ আমি ছুটতে থাকি গোলকধাঁধার অচেনা পথ ধরে। ক্ষুধাবোধ হয় তখন, যেমন মানুষের হয়। বাতাসে তখন উড়ে যেতে দেখি বিস্কুটের গুঁড়ো, তৈরি হয় এক অদ্ভুত পোয়েটিক বিউটি। এই বিউটি আমাকে টেনে নিয়ে যায় এক অপূর্ব সুরের কাছে, দূরে দাঁড়িয়ে আমি শুনতে পাই 'পৃথিবীর শেষ গান'। তবুও কী পারি এই গোলকধাঁধার রহস্য ভাঙতে, হয়তো পারি কিংবা পারি না। এমনও হতে পারে আমি হয়তো এই রহস্য কখনও ভাঙতেই চাই না, কেনোনা এই গোলকধাঁধায় জীবন আছে, আছে জীবনের চেয়েও বেশি কিছু...
মাহরীনের গল্পের ভাষা, বাক্যে স্বকীয়তা কিংবা সংলাপে স্বতঃস্ফূর্ততা শুধু নয়, প্রশংসা করা যায় তাঁর প্লট সিলেকশন নিয়েও, তবে এসব দিকে না গিয়ে আমি তাঁর জগতের বৈচিত্র্য নিয়েই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে চাই। আমাদের বর্তমান সময়ের গল্পের পরিচিত পথকে উপেক্ষা করে মাহরীন যে গোলকধাঁধা তৈরি করেছেন, সেজন্য পাঠক আমার পক্ষ থেকে তাঁর জন্য রইলো বিশেষ ধন্যবাদ। ...
মাহরীন ফেরদৌসকে টুকটাক পড়ি অনলাইনের এদিক-সেদিক, নানা ওয়েবজিন কিংবা পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে। তার গল্পগ্রন্থ ‘অরিগামির গোলকধাঁধায়’ তাই হাতে নেই আগ্রহ ভরে, দেখতে চাই মলাটবদ্ধ একটা কাঠামোতে তার অক্ষরগুলো কীভাবে স্পর্শ করে পাঠককে। আর অনুভব করি, সংকলনটাকে শেষ করে তা নিয়ে মনে প্রথম যে শব্দটা আসে, সেটা হলো ‘বৈচিত্র্য’।
বৈচিত্র্য কথাটা এজন্যেই মাথায় আসে, কারণ ছোট্টো এই সংকলনের গল্পগুলোর স্বাদ অবিমিশ্র নয়। একটু সময় নিলেই আবিষ্কার করা যায়, তিন ধরনের গল্প আছে এই সংকলনে। একভাগে রয়েছে খাঁটি বাস্তবতার গল্প, একটা ধারায় আছে নিত্যদিনের বাস্তবের সাথে যাদু মেশানো পরাবাস্তব কিছু গল্প; আর একটা ধারা- পাঠকের মনে হয়- রুপকথা ধাঁচের; যেখানে গল্প বলা হয়েছে ‘এক দেশে ছিলো এক অমুক’ ঘরানায়।
এমন তিন-স্রোতা গল্পের সম্মিলনের ফলে যেটা হয়েছে, সংকলনটাকে টানা পড়তে গেলে পাঠককে বেশি কষ্ট করতে হয় না। একটা গল্পকে আত্মস্থ করবার জন্য অল্প বিরতি নিয়েই পরের গল্পে চলে যাওয়া যায়। মধ্যবর্তী ওই বিরতিটা আবার দরকার, কারণ মাহরীন প্রধানত গল্প বলেন মনোলোগ বুনে বুনে, সংলাপের ব্যবহার তার অল্পই। এবং লক্ষ করা যায়, তিনটি ধারায় গল্প বলতে গিয়ে মাহরীনের ভাষাও বদলে গেছে বারবার। কিন্তু বাইরের এসব আবরণকে উপেক্ষা করে যদি অক্ষরগুলোর হৃদয়ের দিকে তাকানো যায়, খেয়াল করা যাবে, গল্প লেখার মূল উদ্দেশ্য মাহরীন বিস্মৃত হয়নি, সে কেবল গল্পই বলতে চেয়েছে।
তবে, অক্ষরের নিজস্ব দুনিয়ার ব্যাকরণ মেনে পাঠককেও যেহেতু পাল্টাতে হয় গল্পের ধরন অনুযায়ী, সংকলনের তিন ধারার গল্পের সাথে পাঠকের বোঝাপড়াও হয় তিন রকমের।
প্রথমেই আসি রুপকথা ধাঁচের গল্গগুলো প্রসঙ্গে। এদের পড়তে গিয়ে মনে পড়েছে সম্প্রতি পড়া উমবার্তো একোর একটা আলোচনার কথা। একো বলেছিলেন, যখনই বড়দের কোনো গল্প শুরু হয় ওই ‘এক দেশে ছিলো এক অমুক’ ধাঁচে, প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের মন তখন নিজেকে বসিয়ে দেয় কোনো শিশুর জায়গায়, যেন সে দাদীর গা ঘেঁষে গল্প শুনছে। স্যাঁৎ-একজ্যুপেরির ‘লিটল প্রিন্স’ ঘরানার এই রচনাগুলো লেখা খুব কঠিন, কারণ বুড়ো পাঠককে দীর্ঘক্ষণ খোকার জায়গায় আটকানোটা সহজ ব্যাপার নয়। মাহরীনের এই ধাঁচের গল্পগুলো (‘চাঁদের গায়ে ছায়া’, ‘পৃথিবীর শেষ গান’) পড়তে গিয়ে, পাঠকও অনুভব করে বারবার, তার ভেতরের বুড়োটা বারবার বেরিয়ে আসতে চাইছে।
কিন��তু গল্প যত বাস্তবতার দিকে যায়, মাহরীন ততই হয়ে ওঠেন নিখুঁত। নিঃসন্দেহে তাই ‘মথ’, ‘এক কামরার ঘর’ বা ‘চক্র’ এর মতো যাদু মেশানো গল্পগুলো বেশি ভালো লাগে রুপকথার চাইতে। এই পরাবাস্তব ধারা আর পুরোদস্তুর বাস্তব ধারার যে গল্পগুলো সংকলনে আছে, তাদের সবগুলোর উপস্থাপন আনকোরা নতুন হয়ে ওঠেনি, কিন্তু যখনই মাহরীন নতুন দিনের ভাষায় উপস্থাপন করেছে তার চরিত্রদের সংকটগুলো, গল্পগুলো সত্যি হয়ে গেছে চমৎকার। সংকলনের সেরা তিনটা গল্পই (‘রুবি তোমাকে চিনি’, ‘চেকলিস্ট’, ‘প্যারাকজম’) এই দাবির পক্ষে জোরগলায় সাক্ষ্য দেবে। বিশেষ করে ‘চেকলিস্ট’ গল্পটা ব��ুদিন মনে রাখার মতো।
অরিগামির গোলকধাঁধায়’ তাই, সব মিলিয়ে সাক্ষর দেয়, লেখালেখির যাত্রায় মাহরীন ফেরদৌসের একের পর এক নতুন স্টেশন পেরিয়ে যাওয়াকে। আমরা তো জানি যে চলমান ট্রেন একসময় ঠিকই লক্ষ্যে পৌঁছে।
আমাদের প্রত্যেকেরই যেন নিজস্ব কিছু গল্প রয়েছে। কিন্তু, সবার গল্পই কি এক? নাহ। কারো গল্পের সুর কাচের চুড়ির রিনিঝিনির মতন, কারো গল্পে থাকে দুঃখ ও বেদনার গিটারের টুংটাং। কারো গল্প লেখা হয় সময়ের নিঃসঙ্গ কালো স্রোতে, কারোটা আবার রাতের আঁধারের রহস্যে ঘেরা হয়। তবে, প্রতিটি গল্পই নিজের থেকে আলাদা এবং এর নিজস্ব তাৎপর্য রয়েছে। জীবনের এই গল্পগুলোর গুরুত্ব আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে প্রভাবিত করে এমন এক বই হলো 'অরিগামির গোলকধাঁধায়'।
মাহরীন ফেরদৌসের 'অরিগামির গোলকধাঁধায়' বইটিতে আমাদের চারপাশের এমন ১৪টি গল্প আছে, যা আপনাকে আসলেই গোলকধাঁধায় ফেলে দিবে। সেই গোলকধাঁধা হলো আমাদের দৃষ্টির গোলকধাঁধা। আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়তই কত ঘটনাই না ঘটে যায়৷ সব কিছুকে আমরা জীবনের অংশ বলেই চালিয়ে দিই। কিন্তু কখনো কি ঘটনাগুলো নিজের অন্তর্গত দৃষ্টি দিয়ে স্পর্শ করে দেখেছেন? গল্পগুলো এমনভাবে লেখা যেটা আপনার রঙিন ভাবনাগুলোর আড়ালের ঘটনা সামনে এনে সব সাদা-কালো করে দিতে পারে।
আঁধার, বিভ্রম, রূপান্তর, বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা- কী নেই এখানে? কিছু কিছু গল্প খুবই ভালো লেগেছে, আবার কয়েকটা পড়ে মনে হয়েছে, "চমক কি একটু কম হয়ে গেল?"
সমকালীন সংকট, ব্যক্তির মানসিক টানাপড়েন, প্রেমের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, কোথাও-বা সমান্তরাল মহাবিশ্বে চেনা চরিত্রকে আবিষ্কারের গোপন নির্যাস- চৌদ্দটি গল্পের প্রতিটি লাইনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে চারপাশের চেনা জগৎ। সবকিছু মিলিয়ে এটাকে সুন্দর এক পাঠ্যের কাতারে ফেলাই যায়!
"আমি বিশেষভাবে কিছু বলতে পারি না। এই ভালোলাগা, ঘোরলাগা কিংবা 'আমাদের মাঝে যেন কী মিল আছে' ধরনের অনুভূতির পৃথক কোনো সংজ্ঞা আমার কাছে নেই।"
আটকে গিয়েছিলাম এই দু'টো লাইনে। পুরো বই জুড়েই এরকমের ঘোরলাগা কিংবা মুগ্ধতা ছড়ানো ছিলো। লেখিকা ছন্দপতনহীন ভাবে গল্প বলেন, এক ধরনের আবেশ সৃষ্টি হয় তাতে। ঠিক যেমন আমরা গল্প বানাই লুসিড ড্রিমস এ সজাগে!
বইয়ের বেশিরভাগ গল্পই হয়ে উঠেছে নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে। সমকালীন প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তাদের পেরে না ওঠার গল্প কিংবা সাহসের সঙ্গে সুপ্ত জয়ের মিশেল। 'মথ', 'বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়' 'মধ্যরাত হতে কিছু সময় বাকি' গল্পগুলো অনেকটা এমন ব্যাখ্যার সবিস্তর বর্ণনা দেয়।
'চাঁদের গাছে ছায়া', 'এক কামরার ঘর', 'চক্র' এ গল্পগুলোতে লেখিকা জাদুবস্তবতার সাহায্য নিয়েছেন। যদিও 'এক কামরার ঘর' গল্পটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পেরেছি কিনা তাতে সন্দেহ থেকে যায়!
'বিস্কুটের গুড়ার মত বিকেলে' গল্পের পোয়েটিক স্টোরিটেলিং পড়ে আরাম পেয়েছি। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারে ভুগতে থাকা ব্যাক্তির 'চেকলিস্ট' গল্প কেউ কোনোদিন বলেনি। শেষ পর্যন্ত আমরা সম্ভবত কাউকেই মনে রাখিনা আমাদের সবার গল্পগুলোই আসলে 'ভুলে থাকার গল্প'।
'মনিদ্র অন্ধকারে", 'সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে', পৃথিবীর শেষ গান' ছোটগল্পে নতুন ডাইমেনশন এনে দিয়েছে।
সমকালীন গল্প লিখতে গেলে অনেক কমন প্রেক্ষাপট চলে আসে। গল্পের জন্য গল্পে সংকট এর দরকার হয়। পারিবারিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক সংকট! সেগুলোকে গুরুগম্ভীর, অনেকটা ছন্দময় আর সহজবোধ্য করাটাও চারটে খানি কথা না। একদম মনের মত একটা ছোট গল্পের সংকলন পড়লাম।
অত:পর "অরিগামির গোলকধাঁধায়" ভালোলাগার লিস্টে যুক্ত হলো!
কথা-সাহিত্যিক মাহরীন ফেরদৌস এর ১৪টি গল্প নিয়ে “অরিগামির গোলকধাঁধায়” বইটি ফেব্রুয়ারি ২০২২ এ প্রকাশ পেয়েছে।
বইটির গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট কোন গৎবাঁধা জীবনের প্রেক্ষাপটে রচিত না আবার জীবনের খুব অপিরিচিত অভিজ্ঞতার বাইরেও নয়। তবে লেখিকা খুব সুনিপুণ ভাবে প্রতিটি গল্পের ঘটনা এমন ভাবে বুনেছেন যে, কোন গল্পের ঘটনা পড়ে মন ভারী হয়ে যায়, কোন গল্পের ঘটনার পথ মনের ভেতর হাহাকার তৈরী করে একই সাথে কোন গল্প পড়ে শেষ করার পর গল্পের চরিত্ররা এখন কেমন আছে সেটা জানার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। প্রতিটি গল্পেরই চরিত্র বা ঘটনা মনের মধ্যে কোন না কোন ভাবে প্রভাব ফেলবে পাঠকের মনে, সেটা একেক পাঠকের কাছে হয়তো এক এক ভাবেই পড়বে। তবে পুরো বই পড়াকালীন সময়ে গল্পগুলোর ঘটনা বা চরিত্র আমাকে একাধিকবার নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছে যে, গল্প পড়ে আমি যা অনুভব করছি লেখিকা কি সেই অনুভূতি রেখেই লিখেছেন নাকি আমাদের মত পাঠকদেরকে অনুভূতির কোন গোলকধাঁধায় রেখে দিলেন? হয়তো এই গোলকধাঁধায় রেখে দেয়ার নিমিত্তেই গ্রন্থটির এই যথার্থ নামকরণ।
সব গল্প গুলোই কোন না কোন ভাবে ভালো লেগেছে। তবে সব গুলো গল্পের মধ্যে আলাদা ভাবে মনে দাগ কেটেছে মথ, এক কামরার ঘর, বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয় এবং পৃথিবীর শেষ গান।
প্রথমবার লেখকের কোনো বই পড়লাম। সুন্দর গল্প বলেন। শুরুতে বোঝা যায় না কোথায় গিয়ে থামবে। একটা দুটো গল্প পড়ার পর যতোটা আশ্চর্য হয়েছি, নতুনত্বের আকাঙ্ক্ষা ক্রমাগত বেড়েছে, সেই তুলনায় ভালোই আশাপূরণ হয়েছে। নির্দিষ্ট কোনো ফ্রেমে উনার কাহিনীর চরিত্রদের বাঁধা যাবে না। বইয়ের অনেকটা জুড়েই বারবার ফিরে এসেছে একাকীত্ব। পার্থিব-অপার্থিব কাহিনীর মিশেলে সুন্দর সময় কাটলো।
মাহরীনের অরিগামির গোলকধাঁধায় পড়ে শেষ করলাম। আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা অর্জিত হলো।
আহমাদ মোস্তফা কামাল সবসময় আমাদের একটা কথা বলেন। কথাটা হচ্ছে একজন লেখকের জার্নি দেখতে হয়। কীভাবে শুরু করলেন, কীভাবে এগোচ্ছেন এগুলো মাথায় রেখে একটা মতামত দেওয়া যায়।
মাহরীনের শেষ উপন্যাসটি বাদ দিলে তার প্রায় সব আমার পড়া। সেই ব্লগ জগতে যখন সে একুয়া রেজিয়া নামে বিখ্যাত সেই সময় থেকেই।
সুতরাং লেখক হিসেবে মাহরীনের পরিবর্তন আমি কাছ থেকে দেখেছি। একটা সময় মাহরীন যে গল্পগুলো বলত সেগুলো পড়তে ভালো লাগত কিন্তু সব কেমন যেন উপরিতলের মনে হতো। ভাষা এদিক সেদিক লাইনচ্যুত হতো। এবার মাহরীন সংযত।
কেবল ভাষার ব্যবহারে নয় গল্পেও। মানুষ মথ হয়ে যাচ্ছে কিংবা একজন ম্যাজিশিয়ান কবিতা না লিখে কবিতা আঁকছে এমন সব অভিনব চিন্তার প্রতিফলত ঘটালো গল্পে। অবসসেভিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার নিয়ে লেখা চমৎকার একটি গল্প চেকলিস্ট। এই বইতে আমার সবচেয়ে ভালো লাগার গল্প। এই বইতে কেবল নয় মাহরীনের পড়া আমার কাছে সেরা গল্প চেকলিস্ট।
তারপরও আক্ষেপ থেকে যায়। মাহরীন এতো দুর্দান্ত অভিযোজনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার পর কেন প্যারাকজম কিংবা মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি বইতে রাখল, আমি হয়তো তার কাছে জানতে চাইব। প্যারাকজমে এক ধরনের সাইকোসিস নিয়ে ডিল করতে চেয়েছে, করেছেও কিন্তু গল্পটা আমার কাছে অন্য গল্পের তুলনায় ম্লান মনে হলো। মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি একেবারেই চেনা জীবনের গল্প। আপনার পড়তে ভালো লাগবে। কিন্তু এই গল্প আপনি বা আমরা রাহাত খান/ শওকত আলী/ প্রমুখের লেখায় আগেই পড়ে ফেলেছি।
সবশেষ বলি চাঁদের গায়ে ছায়া নিয়ে। আউট অফ দ্যা বক্স একটা গল্প, এমন একটা সময়ের যখন মানুষের নাম ছিল না, ভাষা ছিল না। সেই সময়ের মহামারীর সাথে এখনকার সাদৃশ্য পেলে ভুল হবে না। লজিক্যাল কিছু গোলমাল থাকলেও গল্পটা ভালো লাগার।
নারী চরিত্রের মনোলগ খুব দৃশ্যমান মাহরীনের গল্পে। এক কাপ চা খেতে খেতে পড়ন্ত বিকেলে বইটি পড়তে মন্দ লাগার কথা নয়। কথাপ্রকাশের প্রোডাকশন নান্দনিক।
"গল্পগুলো বাড়ি গেছে" পড়ার সময় যে মুগ্ধতা, ঘোরলাগা কিংবা বিষন্ন সুন্দর কিছু অনুভূতির সঞ্চালন হয়েছিল দেহ-মনে তার একটুও ছেদ পড়েনি এই বইয়েও। একই রকম ঘোরলাগা, কাব্যিক ছন্দময় লেখনী। কিছু জায়গায় আরও বেশি পরিশীলিত। ছোট ছোট ১৪টি গল্প আছে বইয়ে। প্রায় প্রতিটি গল্পই সুন্দর। কিছু গল্প অদ্ভুত রকমের সুন্দর। গল্পগুলোতে লেখিকা কল্পনা, বাস্তবতা এবং পরাবাস্তবতার এক অদ্ভুত মিশেল ঘটিয়েছে বলা যায়। পড়তে পড়তে কখনো কল্পনায়, কখনো পরাবাস্তবতায় ডুবে যেতে হয়।মুরাকামির বই পড়ার সময় একাকিত্ব যেভাবে জেঁকে বসে পাঠকের উপর, মাহরীন ফেরদৌসের অধিকাংশ গল্পের বেলায়ও ব্যাপারটা একই। একাকিত্ব যেন ছুঁয়ে যায় আমাদের। "গল্পগুলো বাড়ি গেছে"র মতো এই বইটাও শেষ করে একরাশ মুগ্ধতায় ডুবে গেলাম।
বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং গল্প ছিল। যেমন, সান্টা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে গল্পটার কথা বলি। পড়তে গিয়ে মনে হল যেন স্টিফেন কিং এর নাইট শিফটের গল্পগুলোর মত কোন গল্প পড়ছি। চমকে দেয়ার লোভ সামলে যে গল্পের শেষটা লেখা হয়। কিংবা চক্র অথবা মথ গল্পের কথাও বলা যায়।
সিনেমা দেখতে বসলে শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চলার সময় একদিন প্রথম শব্দটা দেখেছিলাম সাবটাইটেলে। Poignant music continues. এরপর এই শব্দের অর্থ আমি অনেকদিন হয়েছে অভিধান থেকে দেখে নিইনি। ভেবেছিলাম থাকুক একটা শব্দ এমন অর্থ দিয়ে না চিনে নেওয়া।
মাহরীন ফেরদৌসের লেখায় ভাষায় বয়ানে আমি Poignant একটা আবেশ তৈরির চেষ্টা দেখতে পাই।
অরিগামি আসল কী? অরিগামি এককথায় কাগজের তৈরি শিল্পকর্ম। একটা কাগজ না কেটে কেবল ভাঁজ করে কখনও ফুল, ফল; আবার কখনও পশুপাখি বা অন্য কিছুর আকৃতি প্রদান করাকেই মূলত অরিগামি বলা হয়। আমাদের জীবন অনেকটা এই অরিগামি মতো। একাধিক ভাঁজে আমাদের জীবন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আকৃতির ধারণ করে। বিভিন্ন পরিস্থিতে ডুবে গিয়ে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কখনও কখনও এর গোলকধাঁধায় আটকে যায় আমাদের জীবন। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় না। গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে খেতে আমরা হারিয়ে ফেলি জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য। এই গোলকধাঁধা-ই হয়ে ওঠে আমাদের লক্ষ্যবস্তু। এখানে জীবনের বাকিটা সময়, এরপর একদিন সবকিছুর শেষ।
“অরিগামির গোলকধাঁধায়” মাহরীন ফেরদৌসের রচিত ছোটোগল্পের সংকলন। যেখানে ১৪টি ছোটোগল্প স্থান পেয়েছে। ছোটোগল্প লেখা আমার কাছে খুব কঠিন মনে হয়। কেননা উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটা প্লট থাকে, তাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে একটা আকৃতি দিয়ে লিখে ফেলা যায়। কিন্তু ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে ছোটো করে অনেককিছু বুঝিয়ে দেওয়ার সাধ্য সবার থাকে না। স্বল্প পরিসরে লেখা কোনো কিছু পাঠক হৃদয় দিয়ে অনুভব করবে, এমন কিছুই ছোটোগল্পকে সার্থক করে তোলে।
আমি সচরাচর ছোটোগল্প উপভোগ করি না। কারণ এই শুরু হলো, গল্পে ডুবতে ডুবতে হঠাত-ই শেষ হয়ে যাওয়া ঠিক পছন্দ হয় না। কিছুটা আক্ষেপ কাজ করে। আরো কিছু পড়তে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছে জাগে। মাহরীন ফেরদৌসের “অরিগামির গোলকধাঁধায়” বইটি পড়ার পর আমার অনুভূতি একই। কিছু গল্প এত তীব্রভাবে আকৃষ্ট করেছে, গল্পটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর কেন শেষ হলো, তার জন্য কিছুটা হতাশা কাজ করেছে। বইটা শেষ করার পর আমার অনুভূতি অদ্ভুত। কেমন এক অস্থিরতায়, বিষন্নতায় ডুবে গিয়েছি। বাস্তব, পরাবাস্তব যেসব গল্প লেখিকা লিখেছেন, এ যেন আমাদেরই চেনা গল্প। আবার মনে হতে পারে খুব অচেনা কিছু। কিছু গল্প শেষে এর রেশ ছিল অনেকক্ষণ।
ছোটোগল্প সংকলনের রিভিউ লেখা আমার কাছে বরাবরই কঠিন মনে হয়। মনে হয়, এই বুঝি স্পয়লার দিয়ে ফেলব। তাই সব গল্পের মূলভাব সম্পর্কে আলোচনা আমি কম করি। তবুও যতটুকু করা যায়!
যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, বইটির সবচেয়ে ভালো লাগা গল্প কোনগুলো, তবে আমি সবার প্রথম “প্যারাকজম” আর “চেকলিস্ট” গল্প দুটোর কথা বলব।
“প্যারাকজম” আসলে এক ধরনের মানসিক রোগ। যে রোগে একজন রোগী নিজের মতো করে কল্পনার জগৎ তৈরি করে। হয়তো বিশেষ কোনো মানুষকে অনুভব করে, যার কোনো অস্তিত্বই এই পৃথিবীতে নেই। কিংবা আছে, হয়তো ছিল। তাকেই কল্পনায় স্থান দিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগে নিজের জীবনের একটা অংশ করে নিতে পারে।
অন্যদিকে “চেকলিস্ট” এমন এক চরিত্রের গল্প, যে হয়তো নিজের জীবন নিয়ে প্রচুর দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে। একে ওসিডি বলে? কে জানে? তবে কিছু মানুষের মধ্যে প্রবল অবিশ্বাস জন্ম নেয়। মনে হয় একটা ভুল জীবনের শেষ দিকে আনতে পারবে। বারবার গ্যাসের চুলা, বাসার জানালা, দরজার লক চেক করা একটা রোগের লক্ষণ। একসময় বাসার বাইরে যেতেও ভয় লাগে। নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখতে রাখতে পরিবার, প্রিয় মানুষের সাথেও দূরত্ব তৈরি হয়। যে দূরত্বের মাঝে কোনো কোনো সময় প্রবল অন্ধকারে হারিয়ে যেতে হয়।
আরও কিছু গল্প ছিল, যেগুলো ভালো লেগেছে। যেমন, “মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি” — যে গল্পে তিন ভাইবোনের অদ্ভুত বন্ধনের দৃঢ়তা ফুটে উঠেছে। কেউ হয়তো নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারে, কেউ আবার অনুভূতি লুকিয়ে রাখে। দিন শেষে প্রত্যেকের জীবনের টানাপোড়েন এখানে প্রকাশ পায়।
কিছু পরাবাস্তব গল্প এখানে দারুণ কিছু অনুভূতি দিয়েছিল। “মথ” যেমন প্রিয় বন্ধুর হারিয়ে যাওয়া গল্পের অবয়বকে প্রকাশ্যে আনে। অন্যদিকে “চক্র” গল্পের মতো জীবনের চক্রও আবির্ভূত হয়। হয়তো আমাদের এ জগতের মতো ভিন্ন কোনো জগতের সংযোগ এ চক্রে প্রবেশ করে। তখন নিজেকেই খেই হারিয়ে ফেলতে হয়।
“ম্যাজিশিয়ান” কিংবা “চাঁদের গায়ে ছায়া” গল্প দুটো রহস্যময় দুই মানুষকে নিয়ে। রহস্য আসলে কী? কী ঘটেছিল তাদের সাথে। কোন অজানা, অচেনা রোগে পুরো এক গ্রাম নিকেষ হওয়ার প্রান্তে? আবার কার ইশারায় ব্যাগ কচ্ছপ হয়ে যায়? কিংবা আকাশ রং বদলায়? হয়তো তখনই চাঁদের গায়ে ছায়া নেমে আসে অজান্তেই।
“ভুলে থাকার গল্প”-টাও আমার ভালো লেগেছে। এই গল্পে মানুষের স্বার্থপরতার দিকটিই লেখক উন্মোচন করেছে। আমরা মানুষকে আপন ভাবি, মনে রাখার চেষ্টা করি — এগুল�� কি আসলেই সত্য? নাহ! আমরা কাউকে মনে রাখি না। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে সত্যিই ভুলে যাই। এই ভুলে যাওয়ার গল্পে প্রতিটি মানুষই শামিল হয়ে।
“বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়” গল্পটা হয়তো মানুষের ব্যর্থতার গল্প। যখন নিজের জীবনে সুখ থাকে না, তখন অন্যের সুখকে অসহ্য মনে হয়। হয়তো সে কারণেই প্রতিবেশীর জীবন বিপন্ন করার ছোট্ট প্রয়াস। কিন্তু তা দেখা দেয় বড়ো করে। তাতে কি অনুশোচনাবোধ আসে?
“রুবি তোমাকে চেনে” আর “এক কামরার ঘর” গল্পদুটো এক ধরনের রহস্যের আবহ তৈরি করেছে। কী সেই রহস্য? তা পাঠককেই খুঁজতে হবে। কিংবা এমনও হতে পারে, কিছু কিছু রহস্যের গভীরে যাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এমন সব রহস্য ঘুরে বেড়ায় প্রকৃতি জুড়ে।
“বিস্কুটের গুড়োর মতো বিকেল”, “মনীন্দ্র অন্ধকারে” কিংবা সান্তা মারিয়া স্টেশন পেরিয়ে” গল্প তিনটি খুব আহামরি লাগেনি। সেই রকম আকর্ষণবোধ করিনি। হয়তো আরেকটু ভালো হলেও হতে পারত।
সংকলনের শেষ গল্প “পৃথিবীর শেষ গান” গল্পটি ইন্টারেস্টিং লেগেছে। মিস্টার ইয়োলো নামের রহস্যময় এক চরিত্র বারবার বলে বেড়াচ্ছে, এই পৃথিবীতে আর কোনো গান থাকবে না। কেন? যদি কোনো সুর, তাল, গান এই পৃথিবীর বুকে না-ই থাকে তাহলে কী হবে? এই সমাজে সবকিছুতে রাজনৈতিক চক্রান্ত খুঁজে বেড়ানো সহজ। এখানেও কি তেমন কোন ষড়যন্ত্র আছে? না-কি রহস্যটা অন্যখানে?
মাহরীন ফেরদৌসের লেখা এর আগে পড়িনি। প্রথমবার পড়ে বেশ মুগ্ধ হলাম। ভাষাশৈলী, বর্ণনাশৈলী, উপমার ব্যবহার, গল্প বলার ধরন বেশ ভালো লেগেছে। আগ্রহ জাগানিয়া। একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, লেখিকা লেখায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলোতে নজর বেশ ভালোভাবে দেন। যেমন, আপনি কোথাও গেলে কীভাবে থাকবেন, তার আশেপাশের পরিস্থিতি কেমন হবে, পরিস্থিতি অনুসারে আপনার অবয়বে কোনো পরিবর্তন আসে কি না; এই বিষয়গুলোর বর্ণনা লেখিকার লেখাকে পরিণত করেছে। তাই বলে অতিরিক্ত বর্ণনার আশ্রয় এখানে ছিল না। বরং বর্ণনায় পরিমিতিবোধ স্পষ্ট ছিল। ফলে পড়তে ভালো লেগেছে।
এছাড়া খেয়াল করে দেখলাম, বেশিরভাগ গল্পের মূল চরিত্র নারী। বিশেষ করে যে গল্পগুলো বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, সেখানে নারী চরিত্রের প্রাধান্য বেশি। এখানে সামাজিক সমস্যা, অবক্ষয়, মানসিক টানাপোড়েন, প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, মানুষের দৈনন্দিন বিষয়ের দিকগুলো ফুটে উঠেছে গল্পের সাথে সাথে। এখানে লেখিকা জোর দেননি, কিন্তু তারপরও গল্পের মধ্য দিয়ে সমাজ, দেশ, মানব চরিত্র যেন প্রকাশ্যে এসেছে। একটি ছোটোগল্প কেবলই ছোটোগল্প নয়; ছোট্ট পরিসরে যিনি রচনা করছেন, তিনি সমাজকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি, মানুষকে ভিন্ন অবয়বে ফুটিয়ে তুলতে না পারলে ছোটোগল্পের মূল লক্ষ্য ব্যাহত হয় বলে আমার মনে হয়। এখানে মাহরীন ফেরদৌসের লেখনশৈলীর তারিফ করতেই হয়।
পরিশেষে, ছোট্ট ছোট্ট গল্পগুলো মানুষকে ভাবায়, চিন্তার উপলক্ষ্য এনে দেয়; এমন সব গল্পের তীব্র আবেগ, বিষন্নতায় মোড়ানো লেখা ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আরও পছন্দ হয়েছে গল্পের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাণীগুলো। পাঠক মাত্রই তা অনুভব করতে পারবে। হয়তো বাস্তবতার সাথেও মিশে যাবে। কিংবা মিশবে না। তাতে কী আসে যায়?
'অরিগামির গোলকধাঁধায়' লেখিকা মাহরীন ফেরদৌস-এর পড়া আমার প্রথম বই। মোট চৌদ্দটি গল্পের সমাহার রয়েছে এই গল্পগ্রন্থে। গল্পগুলো কোন কোনটি বেশ চমৎকার, আনন্দের খোরাক জুগিয়েছে কখনো আবার মাঝে মাঝে একটা অবসাদের ধাক্কাও দিয়েছে। তবে গল্পগ্রন্থের দুয়েকটা গল্প গড়পড়তার মনে হয়েছে। একটা গল্পগ্রন্থের সব গল্প যে ভীষণ ভালো হবে তেমনও তো কথা নেই। আমি দুয়েকটা গল্পের কথা বলি, যেগুলো আমার ভালো লেগেছে। তারমধ্যে প্রথম গল্প 'মথ' বেশ লেগেছে! চেকলিস্ট গল্পটি এই বইয়ের পড়া আমার পছন্দের গল্প, যেখানে মানসিক রোগে ভোগা এক রুগির কিছু ঘটনা গল্পাকারে আলোকিত হয়ে উঠেছে। "পৃথিবীর শেষ গান" এই গল্পটা ইন্টারেস্টিং। ধরুণ পৃথিবী থেকে সব গান মুছে গেলো, তাহলে কেমন হবে? অথবা 'চাঁদের গায়ে ছোঁয়া' গল্পের কথাই ধরি। ভাষা সৃষ্টিরও আগে, মহামারির সময়ের এক কাল্পনিক গল্প! সব মিলিয়ে উপভোগ্য ছিলো।
পরাবাস্তব, বাস্তবতা, আর রূপকথার ১৪টা ছোটগল্পের সংকলন। গল্পগুলোর বৈচিত্র্যময়তার জন্য প্রতিটা গল্প পড়ার সময় ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রতিদিন একটা করে গল্প পড়েছি বলে গল্পগুলোর সাথে ভালোই সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছি।
অনেকদিন পর এমন একটা গল্প সংকলন পড়লাম যার প্রতিটা গল্প ভালো লেগেছে। প্যারাকজম, এক কামরার ঘর, মনিদ্র অন্ধকারে, সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে, পৃথিবীর শেষ গান— এই পাঁচটা গল্প সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। তবে 'মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি' এর মতো বাস্তবতার গল্পগুলো একটু দুর্বল মনে হয়েছে। এজন্য ১ তারা খসল।
ইদানিং এমন অনেক গল্প পড়েছি যেখানে শিল্প-সাহিত্যিক-চিত্রকরদের ছায়া অবলম্বনে অনেক লেখক গল্প লিখেছে। এমন অনেক গল্প পড়ে যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। তবে এই সংকলনে ভ্যান গগের ছায়া অবলম্বনে লেখা 'মনিদ্র অন্ধকারে' গল্পটা এই গল্প সংকলনের সেরা গল্প মনে হয়েছে।
লেখকের আরও বই পড়ার আগ্রহ বোধ করছি। যারা ছোটগল্প পড়তে পছন্দ করেন তাদের জন্য এই বই।
বর্তমান সময়টা এমনই যখন আমাদের চারপাশের নির্মিয়মান বাস্তবতা ভেঙ্গে ফেলছে যাবতীয় বিশ্বাসযোগ্যতার সূত্র। অথচ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আমরা যা কিছু দেখছি, শুনছি, জানছি তাতে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে মনে যে এরকমটা সত্যিই কি ঘটে বাস্তবে?
একটু সহজ করে বলা যাক, ধরুণ বহুদিন পর আপনার পুরানো কোন বন্ধুর সান্নিধ্য যখন একই সাথে আপনাকে দিতে শুরু করেছে স্মৃতিতাড়িত হবার অনুভূতি কিংবা পোষাকি সামাজিকতা ছেড়ে-ছুড়ে একান্তই নিজের কাছে ফেরার আনন্দ ঠিক তখনই দেখতে পেলেন আপনার প্রিয় বন্ধুটি হঠাৎই মানুষের অবয়ব ছেড়ে রুপ নিচ্ছে বিকট আকৃতির এক মথের। তখন মোটাদাগে আপনার মনে হতেই পারে যে এসব বড়জোর ঘটতে পারে স্বপ্নে, অথচ ঐ একই ঘটনার অন্যান্য উপকরণগুলোর সাথে কড়া যোগসূত্র রয়েছে প্রত্যক্ষ বাস্তবের ।
এটাকে স্রেফ যাদুবাস্তবতা হিসেবে ধরে নিয়ে যদিওবা নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষণিক প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় কিন্তু তাতে করে কতটুকুই বা সান্ত্বনা পায় মন? কিংবা এমনোও তো হতে পারে যে বিশেষ বিশেষ ঘটনা ও দৃশ্যের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আমাদের অন্তকরণই মূলত ডিজাইন করছে বিশেষ কল্পনা, যা বিশ্বাসযোগ্যতার বিচারে ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেও।
একারণেই আপাত নিষ্পাপ চেহারার কারো আড়ালে খল চরিত্রের ভূমিকায় বদলে যাওয়া কিংবা তুমুল মানসিক পীড়নে উস্কে ওঠা আকস্মিক মেটামরফসিসে পুরুষ থেকে নারীতে রুপান্তরিত হওয়ার ঘটনাকে আমরা অবান্তর বলে উড়িয়ে দিতে পারি না। কিংবা ভীষণ এক বৃষ্টিদিনে ছেড়া রেইনকোট গায়ে নর্থস্ট্রিটে আসা সেই লোকটা যখন আকাশের দিকে মাথা তুলে দৈব বানীর মতো উচ্চারণ করেন যে "একদিন এই পৃথিবীতে কোন গান থাকবে না", তখন আমাদেরকে কয়েক মুহূর্ত থমকে যেতে হয়। ভেতরে ভেতরে বাড়তে থাকে স্নায়ুচাপ।
মৃত্যু অপার রহস্যময়। বেঁচে থেকেও মরে যাওয়া কিংবা মরে বেঁচে যাওয়ার ডিসকোর্সটা আজ অবধি ধরতে পারেনি বলেই জীবনের বিবিধ প্রতিকুলতার বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াতে মানুষমাত্রই টালমাটাল হয়ে পড়ে। একবার ভেবে দেখুন তো যদি এমন হয় যে একদিন আপনি আবিষ্কার করলেন নিজেকে মৃত হিসেবে অথচ আপনি তখন প্রচন্ড রকমের জীবিত অথবা আপনি ভাবছেন আপনি বেঁচে আছেন অথচ আপনি মৃত!
আর এভাবেই গল্পের সাথে জীবন এবং জীবনের সাথে গল্�� মিলেমিশে যায় বলেই আমরা প্রায়শই নিজেকে জটিল কোনো প্যারাডক্সের ভেতর আবিষ্কার করে ভীত হয়ে উঠি। মনে মনে প্রার্থনা করি আদি যুগের অবতারের মতো হয়তো কেউ একদিন আমাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে নিরাপদ আশ্রয়ে।
অরিগামির গোলকধাঁধা’র বিশেষ কয়েকটি গল্প পাঠককে নিশ্চিতভাবে ফেলে দেবে এরকম সব মানসিক টানাপোড়নের ভেতর। এক্ষেত্রে 'মথ' 'এক কামরার ঘর, 'সান্তা মনিকা স্টেশান পেরিয়ে, পৃথিবীর শেষ গান' গল্পগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
একেবারেই সাদামাটা থেকে শুরু করে বেশ ভালো এবং দারুণ, তিন স্তরের গল্পই রয়েছে মাহরীন ফেরদৌসের এই গল্পগ্রন্থে। গদ্য ঋজু এবং সুস্বাদু, এমন ধারণা জন্ম নিল প্রথমবারের মতো তার লেখা পড়ার পর। 'রুবি তোমাকে চিনি', 'প্যারাকজম' গল্প দুটো পুরো সংকলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুই গল্প। নিজের প্রাত্যাহিক জীবনের অদ্ভুত কর্মকান্ডের সাথে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া 'চেকলিস্ট' শিরোনামের গল্পটিও চমৎকার।
এই লেখকের দুটো বই পড়েছি আগে। Mehnaz আপু যখন ওনার নতুন বইটা পাঠাবেন বলেছিলেন,মনে মনে দু তিনটে চিৎকার দিয়ে ফেলেছি।লেখকের লেখা মন ছুঁয়ে যায়,আগে যতবার ওনার গল্প পড়েছি,ততবার কিছু না কিছু নিয়ে ঘোরে ছিলাম।এবারও তাই-ই হয়েছে। মোট ১৪টা গল্প আছে এতে।দ্বিতীয় গল্প তজেকে আমি শব্দের নেশাতে উন্মত্ত। ঠিক hooked বলেনা?তেমনই।
আমি যখনই ছোট গল্পের বই নিয়ে বসি,একগাদা চাহিদা এসে ভর করে। গল্পের সাথে রিলেট করতে পারা,বা চারপাশে এর ছায়া দেখা,অন্যের গল্প বা কিছু শব্দ যেনো নিজের করে নিতে পারি, এসব মাথায় ঘুরে।পড়তে গিয়ে টের পেলাম দু-তিনটে গল্প চেনা,অবশ্য সব যে আনকোরা নয় শুরুতেই বলেছেন লেখক। আমার খুবই প্রিয় দুটো শব্দ আছে, "বিষণ্ণ সুন্দর ", এই বোধটাই বারবার মনে আসছিলো। মথের মুনিবার কথাতে হয়তো মনে পড়ছিলো আমাদের সমাজের বয়স বা পারফেকশনের মিটার উতরে যেতে না পারা কারো কথা। বা চোখে ভাসে বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয় গল্পের আমজাদ সাহেবের মতো লোকগুলোর নিষ্ঠুরতার চিত্র,যারা বউ মেরে নিজের পুরুষত্বের পরিচয় দেয়। এমন আরো অনেক গল্প,অনেক পথচলাতে একই পথের সন্ধান পাওয়া যায় গল্পগুলোতে।
বইটা খুব সহজেই বাতিঘর থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।আর একটা কথা বলি,কিছু বই দেখলে মনে হয় দাম বেশি, কিন্তু এই বইয়ের বেলাতে সে উলটো মনে হয়।
মাহরীন ফেরদৌসের লেখা ‘অরিগামির গোলকধাঁধায়’ গল্পের বইটি পড়ে শেষ করেছি বেশ আগে। এতে রয়েছে চৌদ্দটি ছোট গল্প। মাহরীন ফেরদৌসের লেখায় একটি মৌন বিষাদময়তার ঘোর রয়েছে, আর সে ঘোরে আছে আসক্তি। তার লেখার আমি বিশেষ ভক্ত। তার ছোটগল্পের তো তুলনাই হয় না। গল্প বলার ভাষা এতোটাই প্রাঞ্জল যে অনায়াসে আবৃত্তি করা যায়। গল্প বলার টেকনিকের কথা যদি বলি এখানে রয়েছে পরাবাস্তবতা, যাদুবাস্তবতা, প্যারাকজম ইত্যাদি টেকনিক তিনি ব্যবহার করেছেন। গল্পগুলো সেরকম কাহিনী নির্ভর নয় বরং লেখক এখানে মনজগতের অদৃশ্য বিন্দুগুলোকে কালারফুল শেড দিয়ে অচেনা এবং অদেখা জগতকে সুনিপুণ বর্ণনা শৈলীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন । এখানে গভীর দর্শন তো রয়েছেই, সাথে আছে কিছু কারুকার্য খচিত বর্ণনা, যেটাকে আমার কাছে কবিতার মত সুরেলা লেগেছে।
শব্দচয়ন এবং বাক্যগঠন যথেষ্ট আধুনিক পন্থায় ঝরঝরে করে লেখা যেটা পাঠক পড়ে যাবে মসৃণ ও সহজ ভাবে। তবে পাঠক যদি গল্পগুলোর সাধারণ অর্থ করে তবেই ভুল করবে। কারণ জীবন অতি জটিল অরিগামির গোলক ধাঁধার মতোই। এর একেক ভাঁজে রয়েছে একেক গল্প। আর সেই গল্পগুলোকে বুঝতে গেলে literal rule ব্যবহার করলে হবে না। করতে হবে moral, allegorical, অথবা anagogical ইন্টারপ্রিটেশন রুল। তবেই এই গল্পগুলোর প্রকৃত স্বাদ পেয়ে পাঠক মুগ্ধ হবে।
এবার কয়েকটি গল্প নিয়ে একটু আলোচনা করবো- ‘বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়’ এই গল্পটিতে দেখানো হয়েছে মানুষের মনজগত যে কত ডার্ক হতে পারে। ক্রাইম করার ক্যাপাসিটি যে একজন মানুষের কতটা গহিন হতে পারে সেটা সত্যিই পরিমাপযোগ্য নয়। যদিও এই গল্পে অপরাধ করার পেছেনে যথেষ্ট যুক্তি পাবে পাঠক। তবে লেখক এখানে কোন কিছুই জাস্টিফাই করেনি। সাধারণ লেখক গল্প বলেন, কিন্তু মাহরীন ফেরদৌস গল্প দেখিয়েছেন। এটাই তার গল্পকার হিসেবে সার্থকতা।
‘প্যারাকজম’- হচ্ছে অতিমাত্রায় কল্পনা প্রবণতায় ডুবে থাকা এক গল্প। গভীর কল্পনায় বসবাসকারি মানুষেরা নিজের অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। যেটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ ভাবে ক্ষতিকর।
‘চাঁদের গায়ে ছায়া’ সিম্বোলিক গল্প। মনে হতে পারে রূপকথা, তবে রূপকথা থেকেও আরও গভীরে কিছু।
‘মধ্য রাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি’- এই গল্পে নানা হতাশা, দুর্দশার মাঝেও এক পেয়ালা চায়ের মাঝে তিন ভাই বোন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। কিন্তু সেই সময়টি যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। তখন এক মৌনতা গ্রাস করে নেবে পাঠককে। আর সেই মৌনমুখর অনুভূতি একেক পাঠক একেক ভাবে নেবে। কারণ মৌন বিষাদেরও একটি ঘোর লাগা স্বাদ রয়েছে। সে স্বাদ আস্বাদন ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
‘রুবি তোমাকে চিনি’ গল্পটিতে দ্রুতগামী জীবনের ছটফটানি রয়েছে, তবে শেষে এসে কি এক আদিম শূন্যতায় ডুবে যায় মন। একেবারেই অচেনা হয়ে যাওয়া রুবির সেই আদি চাহনিতে কোথায় যেন এখনো রয়েছে সেই চেনা মেয়েটি।
‘বিস্কুটের গুঁড়ার মত বিকেল’ এই গল্পে রয়েছে চমৎকার বর্ণনা, যেন ক্যানভাসে আঁকা একটি অতি উজ্জ্বল পৃথিবীর চিত্রকলা। কিছু অনুভুতি এবং সময়ের ঘোর।
‘এক কামরার ঘর’ এবং ‘চক্র’ এই দুটি গল্পই অসাধারণ লেগেছে।বিশেষ করে চক্র পড়ে আমি ভীষণ মুগ্ধ।মনের মত একটি গল্প।
‘চেকলিস্ট’ আরও একটি চমৎকার গল্প। সেখানে দেখানো হয়েছে মেন্টাল হেলথ প্রব্লেম যে কতটা জটিল হতে পারে এবং এই সমস্যাটি কতটা অবহেলিত আমাদের সমাজে। এর সুদূর প্রসারী প্রভাব যে কি, সেটা ভুক্তভুগি ছাড়া আর কেউ অনুধাবন করতে পারে না। এরকম অনেক মানসিক সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে যায়। গল্পের ছলে obsessive compulsive disorder (OCD) এ ভোগা একটি মেয়ের জীবন সঠিক ট্রিটমেন্ট না নেয়ার ফলে কতটা দুর্বিষহ হতে পারে সেই চিত্রই আঁকা হয়েছে।
‘মনিদ্র অন্ধকারে’ গল্পটিতে লেখক ভিন্সেন্ট ভেন গগের জীবনীতে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছেন। আরভিং স্টোনের Lust for life উপন্যাস পড়ে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলাম ঠিক তেমনি ভিন্সেন্ট ভেন গগের জীবন নিয়ে এই গল্পটিও ছোট পরিসরে চমৎকার সাজিয়েছেন লেখক।
এরকম সবগুলো গল্পই একটার থেকে আরেকটি ভিন্ন। তবে সবগুলোতেই মনস্তাত্ত্বিক উপাদান রয়েছে যেখানে মনজগতের মৌন ক্রিয়াগুলো শব্দ পেয়েছে। মাহরীন ফেরদৌস গল্পকে শুধু বলেননি, সে এর স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ, উত্তাপ এবং মৌনতাকে দক্ষ হাতে চিত্রায়ন করেছেন। বইটি পছন্দের তালিকায় রেখে দিলাম।
অ��িগামির গোলকধাঁধায় " বইটি চোদ্দটা গল্পের সংকলন।২০১৮ থেকে ২০২১ মধ্যবর্তী সময়ে লেখা।অরিগামি তে যেমন সাধারন দেখতে চারকোনা কাগজকে ভাজ করে অসম্ভব সুন্দর সব আকৃতি দেয়া হয়,এই বইয়ের গল্পগুলোও তেমনি আধার,বিভ্রম,বাস্তবতা, পরাবাস্তবতার ভাজে ভাজে অন্য এক দৃষ্টিভঙ্গিতে চারপাশের পৃথিবীকে দেখতে বাধ্য করে।কিছু কিছু গল্প খুব পরিচিত কিন্ত তবুও চেনা পরিবেশের সবকিছুকে লেখিকা তার ঝরঝরে লেখনীতে অসাধারন করে তুলেছেন।গল্পের চরিত্রগুলোর মাঝে কোথাও যেনো এক গভীর বিষাদের সুর আছে,আছে না পাওয়া আর অতৃপ্তি যেটা পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে যায়।হঠাত হঠাত ’মথ'গল্পের ওই মেয়েটার হতে মতো ইচ্ছে করে যে ভার্জিনিয়া উলফের মতো নিজের ঘরটাকে নদী ভেবে ঘুমের দেশে ডুব দিয়েছিলো।কিংবা "বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়" এর মেয়েটার যখন সকালকে পাহাড়ের মতো ভারী লাগে বা আহত চাঁদের মতো একা লাগে।"মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি" গল্পটায় কোথায় যেনো আমি হুমায়ুন আহমেদ "শঙ্খনীল কারাগার" এর মিল পাই।চেকলিস্ট গল্পটা একধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করে।এক কামরার ঘরে আসলে কি হচ্ছিলো,আ নামের ছেলেটা যে পানির মতো স্বচ্ছ চোখ নিয়ে জন্মেছিলো,কেন সে বুকের মধ্যে হিমধরা শূন্যতা নিয়ে দিন কাটায় আর "বিস্কুটের গুড়োর মতো বিকেলে" কোন "চক্রের" ভেতরে একজন আটকে যায়- এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে বইতে।
সমকালীন সংকট,ব্যক্তির মানসিক টানাপোড়ন, প্রেমের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি,সমান্তরাল মহাবিশ্বে চেনা চরিত্রকে আবিষ্কারের গোপন নির্যাসে ভরপুর একেকটা গল্প।শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমান আগ্রহে শেষ করেছি।কয়েকটা গল্প বাকিগুলোর সামনে কিছুটা ফিকে লাগলেও কল্পনা আর বাস্তবতার এক দারুন মিশেলে লেখিকা আপনাকে রহস্যময় স্মৃতিভ্রমনের দারপ্রান্তে অবশ্যই নিয়ে যাবেন।
গল্প সংকলনের সংক্ষিপ্ত রিভিউ লেখার এই ডিপেডেন্সি তথা বাতিকটা ছাড়তে পারব কিনা জানি না৷ একটা গল্প সংকলনের ৯/১০/১৫ টা গল্পের আলাদা আলাদা পরিচয় দিতে আমার ধৈর্য কুলোয় না।
মাহরীন ফেরদৌসের লেখার গতিময়তা, শব্দ বুননের মাধুর্যতা, বৈচিত্র্যময় প্লট একটা ঘোর তৈরি করে। সংলাপ গুলো বেশ ভালো লেগেছে। সবমিলিয়ে ওর্থ রিডিং.....
গল্প-সংকলনের আলোচনায় নিজের কিবোর্ড চালানো আমার জন্যে বরাবরই ক্লান্তিকর। প্রথমত আমি ধান ভানতে শীবের গীত গাই বেশি এবং তার ফলে সংকলনে একাধিক গল্প থাকায় আমার মগজে গেঁথে থাকা ভাবনারা অর্নবের "হারিয়ে গিয়েছি এইতো জরুরী খবর" এর ট্যাগ ঝুলিয়ে কংকালের হাসি হয়ে ঝুলতে থাকে বিলবোর্ডে। তাই কিছু গল্প নিয়ে হয়তো অধিক বলবো, কিছু গল্পে নিতান্তই ভালো লাগা ও মন্দ লাগার অভিব্যক্তিতেই দায় সারবো। আর কিছু গল্পে ধান ও ভানবো, শীবের গীতও গাইবো।
পাঠকের নির্দিষ্ট কিছু চাওয়া-পাওয়া তো থাকেই তার পাঠ-প্রসেসে। গল্পটা কি তার থেকেও আমার কাছে মূথ্য হয়ে দাঁড়ায় গল্পটা কিভাবে বলা হয়েছে। গল্পের সমাপ্তি নিয়ে দ্বিমত থাকতেই পরে। মানুষের ভিন্ন ভিন্ন বয়স ও ভাবনার কারনে ভিন্ন ভিন্ন পার্সপেক্টিভ তৈরী হয়। গল্পের ইন্টারপ্রিটেশনটাও হয়ে ওঠে আলাদা। গল্পে আমি খুঁজি শব্দের পর শব্দের কুয়াশা ঠেলে সামনে আসা গল্পের ঘরটা কতটা সংবেশিত হয়ে উঠলো।
বইয়ের প্রথম গল্প "মথ"। পরাবাস্তব আর বাস্তবের মিশেলে গল্পটা শুরুতেই লেখকের ভাষাগত সৌন্দর্যের আভাসটুকু দিয়ে রেখেছেন। মানে আপনি প্রথমবার একজন লেখকের বই ধরে সেটাকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিতে পারবেন না, বরং বেশ সাবলীলভাবেই এগিয়ে যাবেন। "মথ" পড়তে পড়তে লীলা মজুমদারের "পাকদন্ডী" থেকে মথ আর প্রজাপতির একটা পার্থক্যের কথা মনে পড়লো। ঠিকঠাক মনে নেই, তবে পার্থক্যটা এরূপ ছিল যে কোনটা ডানার নিচে নকশা আর কোনটার ডানার উপরে। গল্পে জেরিন আর গল্পের কথকের জীবনের নকশাগুলোও কি কারওটা লাইমলাইটের নীচে হাইলাইট হওয়া, আর অন্য জনেরটা পারিপার্শ্বিকতার জ্যাকেটে আলোর আড়ালে ঢেকেঢুকে দেয়া?
মথের নিশাচর স্বভাবের জন্যেই কি জেরিন আলো থেকে সেই অন্ধকারে পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ে গেল নাকি জীবনানন্দের "আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে" সূত্র অনুসরণ করে এগিয়ে যায় সেই অন্ধকারের দিকে? যে সেভাবেই যাক, পাঠকের সামনে (অথবা আমার) আয়না ধরিয়ে দিয়েছে গল্পের শেষটা। পাঠক হিসেবে আমি কি আশা করেছিলাম জেরিন লাফ দিবে? গল্পের কথকের জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা কি করুন পরিনতির দিকেই হিপনোটাইজড হয়ে পড়ি? মনে মনে তাই চাই? খুব ঘটনাবহুল কিছু ঘটুক আমাদের চারপাশে? কমলকুমার মজুমদারের "গৃহস্থিত চিনিপাতা জীবনের" মাঝে সেই ঘটনাবহূল বা অমোঘ পরিণতি কড়া লিকারের স্বাদ দিয়ে যায়? এই পার্সপেক্টিভগুলোর দিকে তাকিয়েই "মথ" হয়ে ওঠে দারুন একটা গল্প।
"বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়" গল্পটা মোটের উপর ভালো। আহমরি কিছু না। সিম-কার্ডের অবছা টুইস্ট বরং গল্পটার সমসাময়িক জীবনের চিরচেনা কাহিনির মসৃন সারফেসটুকুতে ক্ষত রেখে গেছে। সাদামাটা স্টাইলের গল্পেও একধরনের ঘোর থাকে - এখানে সেই স্টাইলটুকু আছে; ঘোরটুকু নেই।
তবে একই ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন মানুষের যে ভিন্ন দৃষ্টি এবং প্রতিক্রিয়ার চিরায়ত স্বভাব, তা দুই বোনের স্বভাবে বেশ ভালোভাবেই তুলে ধরেছেন মাহরীন ফেরদৌস।
তিন.
"প্যারাকজম" নিঃসন্দেহে এই সংকলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং দারুন গল্প। যদিও মৌনতার ঘরে যাওয়া সেই কথকের ভিভিড ফ্যান্টাসির শৈশব সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। তাই এই ফ্যান্টসির স্বরূপ নির্ণয়ের চেয়ে ফ্যান্টাসির সাইক্যাডেলিক ঘোরে আটকে থাকাটাই পাঠকের জন্যে দারুন এক তৃপ্তি।
আলোচনার শুরুতেই আমি লিখেছিলাম যে, গল্পে আমি খুঁজি শব্দের পর শব্দের কুয়াশা ঠেলে সামনে আসা গল্পের ঘরটা কতটা সংবেশিত হয়ে উঠলো। "প্যারাকজম" গল্পটায় বরং আমার কাছে উল্টো লেগেছে। শব্দের পর শব্দের কুয়াশায় থাকতেই আমার ভাল্লাগছিল। ক্লান্তিহীনভাবে এমন পোয়েটিক মেটাফোরের কাছে পাঠক আত্মসমর্পণ করতে পারেন। অন্তত আমি পারি।
তাই গল্প কথকের মানসিক অবস্থা জানার জন্য অদম্য কৌতূহলটুকু কাজ করে না, বরং তার সেই ইমাজিনারি ওয়ার্ল্ডের সাথে সাথে নিজের চিন্তার ও অনুভবের ট্রানজিশন ঘটতে থাকে। সেখান থেকে আবার কথকের সেল্ফ এলিয়েনেশনও দেখা দেয়। পাঠক হিসেবে আমি হয়তো সেই সেল্ফ এলিয়েনেশন-এর পথ ধরে চেনা রিয়েলিটিতে ফিরে আসি। কিন্তু আমার কিন্তু সেই অবসেশনেই থাকতে ভালো লাগে। যার সমূহ কারন মাহরীন ফেরদৌসের এই গল্পের পোয়েটিক মেটাফোর।
পাঠক হয়তো একটু মনযোগী হলেই খেয়াল করবেন, কথকের সেই সেল্ফ এলিয়েনেশনের ব্যপ্তিটুকুও সামান্য। ক্ষনিকের। মৌনতার বাড়ির সামনের পরিত্যক্ত বাসায় যে আসলে কেউ নেই, সেই ভয়ঙ্কর রিয়েলিটির মুখোমুখি না হতে চাওয়া বা পালিয়ে বেড়ানোও হতে পারে।
প্যারাকজমের বীজ মূলত শৈশবেই প্রোথিত হয়। আলোচনার শু���ুতেই বলেই যে, শৈশবের ব্যাপারে তেমন কোন ইঙ্গিত নেই। নাকি আছে? এই যে ভিভিড ফ্যান্টাসির আছে-ও-নাই এর মাঝে দাঁড়িয়ে গল্প কথক (অথবা গল্পের প্রোটাগনিস্ট) - কোনটা বাস্তব আর অবাস্তব? আমাদের এই বেঁচে থাকা, এইযে গল্পটা নিয়ে শীবের গীত গাইছি এটাও হয়তো স্বপ্ন - বাস্তব না। সবটাই ঘোর।
চার.
"চাঁদের গায়ে ছায়া" নামক গল্পটি শুরু থেকেই আমাদের রূপকথার আঁচে ওম দিতে থাকে। এবং সেই ওমেই আমরা মাঝে মাঝে টের পাই বাস্তবতার অন্য দিক। "আ" এর কথা ভাবতে যেয়ে আমার মনে পড়ে "ইনসাইড আউট" এনিমেটেড মুভির কথা। রাইলির পারসনিফাইড ইমোশোনের কথা। "আ" যেন সেই ৫টি পারসনিফাইড ইমোশোনের একটি হয়ে ধরা দেয়। কনসাস অফ আস? হয়তো। তবু গল্পের শেষটা নিছকই যেন একটা "শুরু থাকলে শেষ থাকবে" এই টানাপোড়েনের ফল। ঠিক ওখানেই গল্পটা ভালো লাগার আবেশ থেকে ছিটকে পড়ে।
"মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি" চেনা সময়ের এবং পরিচিত গল্প। লেখক মাহরীন ফেরদৌসে লিরিক্যাল গদ্যভাষার খুব একটা ছাপ নেই যদিও এই গল্পে, এবং গল্পের থেকে বরং আমার কাছে কারও ডায়েরির এন্ট্রি হিসাবেই বেশ মানায়। সংকলনের অন্য গল্পের তুলনায় অনেক দুর্বল। তবুও গল্পটা থেকে উঠে আসে অমোঘ এক প্রশ্ন - "এমন জীবন কি আমাদের কারও হবার কথা ছিল?" এই চিরায়ত প্রশ্নের জবাব হয়তো কোনদিনই কেউ দিতে পারবে না কখনও।
তবু এই গল্প প্রসঙ্গে লেখকের লেখা নিয়ে সামান্য কিছু বলা যাক। লেখকের প্লট বা সমসাময়িক ব্যাপারগুলোর যে উপস্থাপনা তাতে একটা কমন জিনিস থাকে যেটাকে বলে ক্রাইসিস। সংকট। সেটা হোক ব্যক্তিকেন্দ্রি, পরিবারকেন্দ্রিক অথবা সমাজকেন্দ্রিক - সেই ক্রাইসিসের ওমটুকু পাঠক টের পান ঠিকই, কিন্তু মাহরীন ফেরদৌস সেটাকে ডিফেন্ড করার চেষ্টা করে না। সেই যন্ত্রনাটুকু উপশমে লেখকের কলম গল্পে শক্তভাবে চেপে বসে না। মানে মেইড আপ কোন সিদ্ধান্ত বা উপশম নিয়ে তিনি গল্পের চরিত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রক করেন না। তারা নিজের নিয়মেই বহমান। গল্পের চরিত্রগুলো তাদের সিচুয়েশনের কাছে হার মেনে বা জিতে যায় - লেখক শুধু তার লিরিক্যাল গদ্যভাষার ভারসম্য বজায় রেখে আবেগ ও আস্থার ভরসায় এগিয়ে যান।
"রুবি তোমাকে চিনি" গল্পে এডভ্যারটাইজ ফার্মের একজন কর্ত্রীর কোন এক ব্যস্ত দিনের মুহূর্তের ঝাপি মেলে দিয়ে শেষে স্মৃতির পুরোনো মায়াপথে দাঁড়িয়ে দেখেন অমসৃণ পথ। স্মৃতির ঝঞ্ঝা হাতড়িয়ে টের পান চোখের সামনে নিঘাধ অন্ধকার! এই শেষটায় এসে আমরা যদি আবার একটু গল্পের শুরুতে চোখে দেই - সেই কর্ত্রীর দিনযাপনে এবং স্বপ্নে - অনেক ভীড়ের মাঝেও আমরা দেখি আইসোলেটেড হয়েই আছে। স্বপ্নেও একা - স্মৃতিতেও একা। রুবির চোখের শূন্যতার মাঝেই ঝুলে আছে যেন তার পতন অথবা পরিনতি।
পাঁচ.
"এক কামরার ঘর" যেন এক কামরার ঘোর। কিছুটা যেন চেনা বাস্তব আবার কিছুটা পরাবাস্তবতা, এবং এই দুয়ের মাঝামাঝি দাঁড়িতে দেখা (পড়া) এবং অনুভবের মধ্যবর্তী দূরত্বটুকু আঙ্গুল দিয়ে মেপে দেখেছি - সেখানে কোন সংখ্যা ভাসে না। যা পাই তার নাম - শূন্যতাবোধ। এখানে গল্পের একটা লাইনের কিছু অংশ তুলে ধরা প্রয়োজন:- "আমাদের চারপাশটা হঠাৎ একই সাথে হয়ে ওঠে নীরব ও সরব।"
মাহরীন ফেরদৌসের গল্প পড়তে পড়তে এই ব্যাপারটা বেশ টের পাওয়া যায়। আপনা কাছে মনে হবে আপনার চারপাশটা কখনও নীরব, কখনও সরব আবার কখনও একই সাথে এই দুয়ের সমষ্টি। গল্প পড়া শেষে অনুভূতি ছাপিয়ে নতুন আবহের উপস্থিতি যেন সেই মুহূর্তের উজ্জ্বল স্বাক্ষর। কখনও সেটা বিমর্ষতার, কখনও বিষাদের আবার মাঝে মাঝে শূন্যতাবোধ। হাহাকার নেই সেখানে।
লেখকের অধিকাংশ গল্পই নারীকেন্দ্রিক। মনোলগ ফর উইমেন? বোধহয়। মনোলগের ডানায় ভেসে ভেসে এগিয়ে চলে তার গল্প, তাই সংলাপকেন্দ্রিক না। গার গল্পের উপমা, উপমান ও উপমেয় তাই হয়ে ওঠে আরও দুর্দান্ত। আমি ঠিক জানি না সংলাপ-নির্ভর গল্পে এই ব্যাপারগুলো খুব স্ট্রং ভাবে তুলে ধরা যায় কিনা। পাঠক হিসাবে আমার এমন উপস্থাপন মনোলগ নির্ভর লেখাতেই বরং বেশি ভালো লাগে। উপমায় আচ্ছাদিত বাক্য আর মনোলগের ডানায় ভেসে যাওয়া গল্পগুলো যেন বিমূর্ত ঘোরের খোরাক নিয়ে হাজির হয়।
"বিস্কুটের গুঁড়ার মতো বিকেলে" এই বইয়ের সবচেয়ে ছোট এন্ট্রি। দেড় পেজ বড় জোর। অনেকের কাছেই হয়তো এটা ঠিক গল্প হয়ে উঠলো কিনা সেই আত্মজিজ্ঞাসা হানা দিয়ে যাবে মনে। আমিও ঠিক জানি নি, তবে না হোক, গল্প আর কবিতার মাঝামাঝি বিচরণ করতেও তো দারুন লাগে। বিশেষ এই গল্পটার জন্যে আমি দুটো শব্দই বলবো - অ্যাস্ট্রাল প্রজেকশন। এমন অ্যাস্ট্রাল প্রজেকশন আমি নিজের মধ্যে টের পাই। "-'আমি-যা-দেখি-....-তুমি- তা - দেখো?' - এর মাঝে যেন অসম্ভব একটা নস্টালজিক হ্যংওভার ভর করে। নোনা-নোনা সামুদ্রিক বিকেল, বৃষ্টি শেষে ফুলার রোড, অলস দুপুরের বিষণ্ণ মফস্বল শহর, অথবা নিজরে অস্তিত্বের শূন্যতা অনেক কিছুই উড়ে আসে সেই বিকেলের পথ ধরে। নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই, তবে আমার অনুমানে সংকলনের সবচেয়ে ছোট এন্টি হলেও হয়তো এটা লিখতে লেখকের পরিশ্রমের পাল্লাটা ভারী ছিল। অবশ্য নাও হতে পারে। এরূপ লিরিক্যাল গদ্যভাষাই তো মেহরীন ফেরদৌসের ট্রেডমার্ক। হয়তো খুব সহজ এবং সবলীলভাবেই তৈরী হয়েছে। আমার কাছে অন্তত অন্যতম প্রিয় হয়ে থাকবে এটা। পোয়েটিক ফিলটুকু হৃদয়ে ছাপ ফেলে দিয়ে যায়।
"চক্র" দারুন এক গল্প। চক্র আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় আবার সেই ঘোরে। কোনটা বাস্তব আর কোনটা স্বপ্ন? অয়নের মা (?) উদ্বেগ আর ঘোরের মাঝে বিচরণ করে বারবার ফিরে আসে এক ভয়ংকর বাস্তবতার সামনে যে, অয়নের মা মানে গল্পের সেই কথক বলে কেউ নেই। সেভেন-এ থেকে যখন বের হয় দুঃসংংবাদ পেয়ে সেই মুহূর্তটা বাস্তব নাকি গল্পের শেষে চাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অচেনা অয়ন বাস্তব? এই যে "অরিগামির গোলকধাঁধায়" পড়ছি, ঘুম ভেঙে দেখবো হয়তো সেটাই স্বপ্ন। আমরা হয়তো স্বপ্নের মধ্যেই বাস্তবতার গভীরে অতল স্পর্শ করি।
"চেকলিস্ট" সংকলনের অন্যতম দুর্দান্ত গল্প। গল্প বলার ঢং, গল্পের শেষ সব মিলিয়েই বিশেষ একটা গল্প হয়ে থাকবে। OCD তে ভোগা গল্পের কথকের সেল্ফ-এলিয়েশনের নিমিত্তে বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে ওঠে চেকলিস্ট। লেখক একধরনের মেলানকোলিক আবহের সৃষ্টি করেছেন যাতে আমরা সেই OCD তে ভোগা গল্পের চরিত্রটিকে লোনার বলতে পারি। হয়তো ক্ষেত্র-বিশেষে আমাদের "আমির"-টুকরো কে মিলিয়ে অনুভব করতে পারি, চ্যালেঞ্জিং বিষয় হচ্ছে বেঁচে থাকা।
ছয়.
"ভুলে যাওয়ার গল্প" ভালো লেগেছে গল্পের শেষটার জন্যে। আমাদের এই যাপিত জীবনে হাসিমুখ-ঘোমটা আড়াল থেকে উঁকি মারে বিষণ্ণতার আনুগত্য আর নানা টানাপেড়নের মাঝে ভুলে থাকার, অভিমানের মহড়া।
"মনিন্দ্র অন্ধকারে" আমাদের আগ্রহোউদ্দীপক করে তোলে ছবি আর কবিতার (ছবিতা-ই বলি) আবেশ মিলিয়ে বিষণ্ণ শহরের হলুদ রঙা দেয়ালের বাড়ির ঘর অথবা সেই আর্ট-গ্যালারির প্রতি। ভ্যানগগের আত্মজীবনী এখনও পড়িনি। পড়বো সামনেই।
"সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে" গল্পের সমাপ্তি আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তোলে কৌতূহল। সেই কৌতূহলের লাঠি ভর করে জোসেফের পিছু পিছু পাঠকও রওয়না দেয় একই ঘরের দিকে। জানতে ইচ্ছে করে, সেই রহস্যময় হালকা মিষ্টি ঘ্রাণ কি কিছুটা তীব্রতা নিয়ে ফিরে আসবে? ঘরের এপাশে নিবিড় ঘোর, ঘ্রাণের তারতম্য যাচাই হোক না হোক, পাঠক হিসেবে আমার দরকার পোয়েটিক ফিল। সেই ঘ্রাণটুকু বাড়িতে তোলে গল্পের সমাপ্তি।
"পৃথিবীর শেষ গান" গল্পের উপমা, উপমান ও উপমেয় আবারও আমাদে আচ্ছন্ন করে রাখে। কিছুটা দুর্বোধ্য ও লাগে। তবে এই দুর্বোধ্যতা আমারই অক্ষমতা। শুধু শব্দের পর শব্দ সাজিতে যে কাব্যিক যে ঢঙে এই গল্প হ��জির হয়েছে - তা ভালোলাগার অন্যতম কাঁচামাল হয়ে মর্মে লাগে।
সাত.
মাহরীন ফেরদৌসের "অরিগামির গোলকধাঁধায়" ১৪ টি ছোটগল্পের সংকলন। উপরে অনেক স্থানেই বলেছি, লেখকের লিরিক্যাল গদ্যভাষা আমার মতে তার সবচেয়ে স্টং দিক। সমসাময়িক লেখক বা ছোটগল্পে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট অনেকের লেখায়। সেটা হচ্ছে গল্পের ভিন্ন ভিন্ন ইন্টারপ্রিটেশন পূর্বে পাঠককে গল্পের চরিত্রগুলোর দিকে তাকাতে হয় সবিস্ময়ে। এই বিস্ময় চরিত্রের অতিমানবীয় গুণ বিবর্জিত এবং অতি-দানবীয় বৈশিষ্ঠ্য বিবর্জিত বলে। মানে লেখক আলাদা কোন বাড়তি সিমপ্যাথি বা এমপ্যাথি আরোপ করে সেটাকে পাঠকের সামনে উন্মোচন করেন না।
মাহরীন ফেরদৌসের গল্পের চরিত্রগুলোও তাই পাঠকের চেনা। প্রতিদিন এই সকল চরিত্রের সাথে পাঠকদের দেখা হয়, কথা হয়। হয়তো খুব খেয়াল করে মনে রাখা হয় না। অচরিতার্থ জীবনের হাহাকার যেমন মিশে থাকে পোষাকের মতো চরিত্রগুলো গায়ে, তেমনি মৌলিক কল্পনা ও লেখকের চিন্তাসূত্রও পোষাকের বুকপকেটে সেফটিপিন-বিদ্ধ শোকের কালো ব্যাজের মতো দৃশ্যমান।
তাই লেখকের দেখানো গোলকধাঁধায় হাঁটতে হাঁটতে গল্পগুলো বুঝতে হয়তো কিছুটা সময় লাগে, কিছু গল্প দুর্বোধ্যতার মোড়কে অধরা থেকে যায় - তবে নিঃশ্চিতভাবেই লেখকের গল্পের পয়েটিক মেটাফোর, তার মনোলগ সাথে সাথে আক্রমন করে পাঠককে। আচ্ছন্ন করে রাখে। শব্দের সঠিক নির্বাচন আর উপযুক্ত তুলির আঁচড়েই ক্যানভাসটা ভালোলাগার অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত মাহরীন ফেরদৌসের "অরিগামির গোলকধাঁধায়" দারুন এক গল্প সংকলন, যার অনেকগুলো গল্পই পাঠককে ভালোলাগার হ্যংওভারে আচ্ছন্ন রাখবে। ২০২২ এর প্রথমদিকে প্রকাশিত বইটির প্রথম মুদ্রণ এখন চলমান - যেটা দেখে অবাকই লাগলো।
প্রথম মুদ্রণের কথা আসায় এটুকু যোগ করি, "প্যারাকজম" গল্পের শেষদিকে (৩৩ নং পৃষ্ঠার একদম শেষ প্যারা) গল্পের কথক আর তার বন্ধুর ফোন কনভারশেসনের অংশে একটা লাইন-ব্রেক দেয়া উচিৎ। একই লাইনে এসে গেছে। যার ফলে পরবর্তী প্যারায় বক্তব্যটুকু কার সেটা নির্নয়ে পাঠককে ক্ষুদ্র একটা সময়ের হেরফেরে হোঁচট খেতে হয়।
❛আমাদের জীবন এক অদ্ভুত চক্রে আবর্তিত হয়। এই জগতে আমরা চলি একটা নির্দিষ্ট নিয়মে। এর হেরফের নেই। কিন্তু এমন কোনো জগৎ আছে কি যেখানে সব কেমন ওলট পালট? যে জগতের গোলকধাঁধা সমাধান করা যায় না। টুপ করে ডুবে যাওয়া কোনো অরিগামির মতো কোনো এক জগতের বাসিন্দা হলে কেমন হয়?❜
জীবনের কঠিন বাস্তবতা সওয়া যায় না। বিদেশ থেকে বান্ধবী এসেছে আরেক বান্ধবীর সাথে দেখা করতে। হয়তো অন্য কাজও ছিল। নিজের সুন্দর জীবনের বিপরীতে বান্ধবীর রঙহীন, ফ্যাকাশে জীবন দেখে কেমন লাগে? সাদা ওড়না জড়ানো সখিটি হুট করে কেমন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। যেন ঠিক একটা ❛মথ❜!
মায়ের মৃ ত্যুর তেত্রিশ দিনের মাথায় বাবা বিয়ে করে আনে এক তরুণী মেয়েকে। যে ঘরে তেত্রিশ দিন আগেও মা থাকতো, যে খাটে মা শুয়ে থাকতো সেখানে জায়গা করে নিলো নতুন কেউ? বড়ো বোন শোকে অস্থির। ছোটো বোন সব দেখেও কিছু বলতে পারে না। হৃদয়ের গহীনে বৃষ্টি ঝরে যায় আর সে ❛বৃষ্টিতে একাই ভিজতে হয়❜। পাশের বাড়ির ঐ বয়স্ক লোকটার বাড়িতে হুট করেই ঝগড়ার শব্দ। কী হলো? একটা বেনামী সিমকার্ড দিয়ে এত শক্ত কিছু করা যায় কে ভেবেছিল!
বান্ধবীর বাড়ির সামনের ছাদে বাস করা ওই লোকটিকে এত কেন ভালো লাগে? কী আছে তার মধ্যে যে কোনোদিন কথা না বলেও এত টান? কেউ বোঝালেও কেন সে বুঝতে চায় না। এই অদ্ভুত ❛প্যারাকজম❜ এ সে বেশ আছে। সবকিছু ছেড়ে ঐ টানের দিকে জলের মতো ঘুরতে থাকাই যেন শান্তি।
বহু বছর আগের এক গ্রাম। যেখানে নেই কোনো টেকনোলজিয়া। তবুও তারা বেশ সুখে ছিল। এরপর একদিন জন্ম নিলো ফুটফুটে এক শিশু। শিশুটি বেড়ে উঠতে লাগলো। কিন্তু এতে পরিবর্তন কোথায় হলো? গায়ের শিশু এবং বৃদ্ধরা আচমকাই অজানা রোগে ভুগতে ভুগতে ধরিত্রীর মায়া ত্যাগ করতে লাগলো। সুন্দর সুখের গ্রামটা যেন সুখ বিমুখ হয়ে যাচ্ছিল। বেড়ে ওঠে সেই ছেলেটি এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে যাত্রা শুরু করলো অনেককে নিয়ে। কখনো কখনো তার সেই গমনপথকেই হয়তো দূর আকাশ থেকে মনে হয় ❛চাঁদের গায়ে ছায়া❜ পড়েছে।
স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, উটকো গরম আর পরিবারের অভাব সব কেমন গুমোট করে রাখে তাদের জীবন। অসুস্থ মা আর তার সারাবেলা অহেতুক চিল্লাপাল্লা যেন এই জীবনে আরও বেশি বিতৃষ্ণা ধরিয়ে দেয়। গুমোট ধরা কোনো এক রাতে তিন ভাইবোন একত্রে বসে গল্প করতে। হাতে চা, জানালার বাইরে এক ফালি আলো আর না পাওয়া জীবনের গল্পগুলো যেন দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে। গল্প শেষ হয়ে যায়, সময় ফুরিয়ে যায় দেখার কিন্তু তখনও ❛মধ্যরাত শেষ হতে কিছু সময় বাকি❜।
কোনোভাবেই সে মনে করতে পারে না সেই সহপাঠীর নাম। যাকে মনেই করতে পারছে না তার অসুস্থতার খবর শুনে অফিস ফেরত ক্লান্ত শরীরে কেন দেখতে যেতে হবে? তাও গেলে কিছু অর্থ সাহায্য করতে হতে পারে। কিন্তু কে সে? মনে পড়েনা কেন? বারবার কেন মনে হয় ❛রুবি তোমাকে চিনি❜?
❛এক কামরার ঘর❜ এ আবদ্ধ চারটি মানুষ। কেউ ঝাপসা হয়ে আসছে, জার আশপাশে সাদা ধোঁয়ার মতো রয়েছে। সে জানেনা এই কামরায় সে কীভাবে এলো। কেনই বা বাইরে যেতে পারবে না? তবুও যেটুক সময় আছে মিলিয়ে যাওয়ার আগে তুলি ক্যানভাস নিয়ে শেষ সেই মুখটা আঁকতে হবে।
❛বিস্কুটের গুঁড়োর মতো বিকেল❜ কখনো হয়? যে বিকেলের আকাশ অনেকগুলো ছবি তৈরি করে। সেই ছবি কি একা তার চোখেই পড়ে? নাকি পাশে থাকা সঙ্গীও দেখতে পায়?
মা কে ছেলেটি বাবা ডাকছে। এটা কেন করছে মা জানেনা। আততায়ীর আ ক্রমণের ঘটনা শুনে মা প্রাণপণে ছুটে গিয়ে দেখে সন্তান নেই। তাকে তার মা আগেই নিয়ে গেছে। তবে সে কে? কেউ তাকে চিনতে পারছে না? কোন ❛চক্র❜ তাকে বন্দী করে ফেললো?
ওসিডি নাকি অতিমাত্রায় সচেতন? কোনটা সে জানেনা। বাড়ি থেকে বের হয়ে বারবার লক চেক, চুলোটা ঠিকমতো বন্ধ করেছে নাকি সেটা নিয়ে বারবার সংশয়ে থাকা কিংবা এই বুঝি কোনো বিপদ হয়ে গেল এসব নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা করাটা কি মানসিক পুষ্টিহীনতার কারণ? সে জানেনা। জানে শুধু প্রতিটা কাজ ❛চেকলিস্ট❜ অনুযায়ী করতে হবে। গ্যাস বিস্ফোর ণের ভয়ে রান্না বন্ধ করে দেয়া, অসুস্থ ভাইকে হাসপাতালে দেখতে না যাওয়া কারণ হাসপাতালে ঢুকলেই অজানা ভয়, আশঙ্কা গ্রাস করে ফেলে। এগুলো সে কাকে বোঝাবে? কেউ তো ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব নিয়ে দেখেই না। তবে কি আপন দুনিয়ায় একাই থাকতে হবে?
আমরা সবাই ভুলে যাই। পরিস্থিতি, পরিবেশ আমাদের অনেক কিছুই ভুলতে সাহায্য করে। পুরোনো ক্ষত সেরে যায় সময় নামক মলমের গুণে। তাইতো প্রথম প্রেমের দুঃখ ভুলে নতুন করে ঘর বাঁধা যায়। আবার দুঃখ ভুলে সুখকে কাছে নেয়া যায়। আমাদের সকলেরই আছে কিছু ❛ভুলে থাকার গল্প❜।
ম্যাজিশিয়ান কবিতা আঁকছে। হয় এমন? সে তো তাই আঁকাতো। কাগজে হিজিবিজি কিছু, আবার কখনো ঝাপসা নারী অবয়ব এক সে বলতো কবিতা। কেমন হয়েছে? চিত্র দিয়ে কবিতা প্রকাশ করা যায়? যদি নাই যাবে তো তার আঁকা সেই খবর টেবিলে পাঁচটি মানুষের ছবি কিংবা কবিতায় এত রহস্য কেন? কোথায় গেল সে হারিয়ে? কোন ❛মনিন্দ্র অন্ধকারে❜ সে বিলীন হয়ে গেল জানা নেই।
শারীরিক ত্রুটি নিয়ে বয়স হয়ে যাওয়ার পরেও একলা বোনটি জীবন কাটাচ্ছিল তার ভাইকে নিয়ে। ট্রেনের নিচে পিতা-মাতা উভয়েই প্রাণ হারালেন (নাকি প্রাণ দিলেন?), সেই থেকে দুটি ভাইবোনে একা। ��িসাব করে বাজার, বোনের ছোট্ট চাকরি আর নিজের বিদ্যালয়ের পাঠ করে সময় যাচ্ছিল। একটু। পরিবর্তন হলো বেকারির লোকটির একদিন পরপর দেয়া নানা স্বাদের কেক আর বোনের সাথে লোকটির অজানা সম্পর্ক দিয়ে। নিয়মিত রুটিনেও ছেদ পড়ে। তারও হয়তো পড়ল। নয়তো এক সকালে কেন তার অবস্থাও তার বোনের মতোই হবে এই সম্ভাবনা দেখা দিল? ❛সান্তা মারিয়া স্টেশন পেরিয়ে❜ তাদের দুঃখের সীমা ছাড়িয়ে যায় দূর থেকে বহুদূরে।
মিস্টার ইয়োলো কোথায় থেকে এসেছিল কেউ জানে না। শুধু সে বলেছিল ❛একদিন পৃথিবী থেকে সব গান হারিয়ে যাবে❜। কীভাবে? কাউকে বলেনি সে। শুধু অনেকগুলো বছর বাদে এক বৃষ্টির পরিবেশে সে প্রস্তুত হয়েছিল ❛পৃথিবীর শেষ গান❜ টি শোনার।
পাঠ প্রতিক্রিয়া:
❝অরিগামির গোলকধাঁধায়❞ লেখিকা মাহরীন ফেরদৌসের গল্পগ্রন্থ। গল্পগ্রন্থ পড়তে আমার একটু কম ভালো লাগে। সেই সাথে পাহাড় সমান কঠিন মনে হয় বইটি নিয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করতে। কারণ যে গল্পের শুরু হওয়ার আগেই ইতি টানতে হয় সে নিয়ে ব্যক্ত করতে গেলে শুরু শেষ তো একাকার হয়ে যাবে।
তবে এই বইটা পড়ে আমি খানিকক্ষণ অনুভূতিশূন্য হয়ে গেছিলাম। ছোট্ট ছোট্ট গল্পগুলো কেন এত অস্থিরতার সৃষ্টি করবে? কী হলো আর কেনই বা হলো এই দ্বিধায় মনে হবে আমিও আটকে গেছি সমাধানের অতীত কোনো গোলকধাঁধায়। লেখিকার লেখা এই প্রথম পড়লাম। এবং বলাই বাহুল্য উনার লেখার মুগ্ধতায় আমি বুদ হয়ে গেছি।
গল্পগুলো অদ্ভুত এক জীবনের। হয়তো পরিচিত জগতের বাইরের কোনো জীবনের গল্প। যেখানে ম্যাজিশিয়ান কবিতা আঁকে, কেউ মথ হয়ে যায় আবার কোনো এক নারী যাকে কেউ চিনতে পারে না, আবার কারো জন্মদিনের উৎসবে কেউ ছোটো হয়ে যাচ্ছে।
স্বাভাবিকত্ত্বের বাইরে ঘটছে ঘটনা। যার শুরু বা শেষ আঁচ করা যায় না। ১৪ টি গল্প রয়েছে বইটিতে। কোনো গল্প একেবারেই ছোটো তো কিছু আছে একটু দীর্ঘ। তবে সবগুলোই কেমন ঘোরলাগা তৈরি করবে। সত্যি না কল্পনা নাকি কোনো মাদকতার জগতের কথা বলা হয়েছে তাই নিয়ে ভাবতে হবে।
সবগুলো গল্পই দারুণ এমনটা বলা যাবে না। কিছু গল্প অযথাই মনে হয়েছে বা কোনো মানে ছিল মনে হয়নি। আবার কিছু গল্প নিবিড় ভালোলাগা তৈরি করেছে। তবে লেখার ভাষা, বাক্যের মাধুর্যতা আর শব্দের প্রয়োগ এই দিকে কোনো কমতি তিনি রাখেননি। এত সুন্দর করেও বর্ণনা দেয়া যায়, গল্পের ভাষা এমন আদুরে বা মায়াময় হয়! গল্পগুলো যতটুক না আমার মনে ধরেছে তার থেকেও বেশি মুগ্ধ করেছে ভাষার ব্যবহার। কিছু গল্প আবেগের আতিশয্য প্রকাশ পেয়েছে আবার কোনোটা মনে হয়েছে জমলো না। তবুও অদৃশ্য এক টান লাগছিল বাকি গুলো কেমন পড়ে দেখতে। এর কারণ নিঃসন্দেহে গল্পের বর্ণনার ধরন।
ফেসবুক লেখিকা কিংবা দেহ নাচানো প্রেমের বর্ণনা দেয়া লেখিকার ভিড়ে মাহরীন ফেরদৌসের লেখার ধরন অন্যদের জন্য শিক্ষণীয়।
প্রচ্ছদ:
প্রচ্ছদ সাধারণ কিন্তু সুন্দর।
❛এই দুনিয়ায় বিচরণে নেই কোনো বাঁধা, তবুও আমরা আটকে পড়ি অজানা কোনো গোলকধাঁধায়!❜
মাহরীন ফেরদৌস যখন থেকে ছদ্মনাম 'একুয়া রেজিয়া' নামে লিখতেন, আমি তখন থেকেই তার বই পড়ি। কাজেই তার লেখার ধরণ, উপমার ব্যবহার, সমাজের কঠিন সত্যগুলো সাবলীলভাবে বলার ভঙ্গিমা সবটুকুই আমার পরিচিত। আর তাই ধাক্কা লাগে যখন বেটা রিডার হিসেবে হাতে পাই অরিগামির গোলকধাঁধায় — এর পাণ্ডুলিপি! শুরুতেই আগের সব লেখার ধাঁচ ছাপিয়ে ঘ্রাণ পাওয়া যায় নতুন কিছুর! তাই, নড়েচড়ে বসি আরও কিছুটা মনোযোগী হয়ে। তাক লেগে যায় প্রথম গল্পেই! মানুষ রুপান্তরিত হয়ে যেখানে হয়ে যায় মথ! এরপরেই, ১৪ টা ছোট গল্পের বিন্যাসে অরিগামির গোলকধাঁধা পড়া হয়ে যায় এক রাতেই। তবে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে হলে গল্প পড়তে হয় একজন চিন্তাশীল ও মনযোগী পাঠক হয়ে। মাহরীন ফেরদৌসের নতুন বই আসবে আর আমি পড়ে মন্তব্য করবো না, এমনটা হয় না টানা ৫ বছর! তাই একটু দেরিতে হলেও বইটি আবার পড়ে প্রতিক্রিয়া লিখতে বসলাম। এই বইটিকে আমি ভাগ করবো দুইভাগে। প্রথম ভাগ সেসব গল্পের যেগুলো সহজেই জানান দেয় গল্পকারের নিজস্বতা। আর দ্বিতীয় ভাগে দেখা মেলে এক ভিন্ন মাহরীন ফেরদৌসের। নিজস্ব ধারার বাইরের যেই লেখাগুলো নিজের কম্ফোর্ট জোন সরিয়ে ফেলার। দ্বিতীয় ভাগের গল্পগুলো তাই ভালো লেগেছেও বেশি। যেমন, 'মথ' গল্পটা তেমনই একটা গল্প যার রেশ রয়ে যাবে পাঠকমনে দীর্ঘদিন। ভিন্ন ধাঁচে লেখা অন্য গল্পগুলোর মাঝে আরও আছে 'চাঁদের গায়ে ছায়া', 'এক কামরার ঘর', 'মনিদ্র অন্ধকারে', 'সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে' আর, 'পৃথিবীর শেষ গান'। ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দ "আ" চরিত্রটি। 'চাঁদের গায়ে ছায়া' গল্প পড়তে তাই নিজেকে তাই বারবার প্রশ্ন করেছি 'আ' কি তবে হারুকি মুরাকামির রচিত 'নাকাতা' চরিত্রের মতো আলোড়ন তুলবে পাঠক মনে? হলুদ ঘরের দেয়াল-চেয়ার, চারিদিকে ছড়ানো ক্যানভাস আর তুলি, নৈশভোজে আলু খাওয়া এক পরিবার, কিংবা বন্ধুর কাছে লেখা চিঠি- কত সহজেই বেদনার রংতুলিতে আঁকা একজন অনবদ্য শিল্পী ভ্যানগগকে নিয়ে ভিন্নভাবে গল্প বলে চললেন গল্পকার মাহরীন তাঁর 'মনিদ্র অন্ধকারে' গল্পটিতে। অথচ কোথাও উল্লেখও করেননি প্রকৃত শিল্পীর নামটি! আমি গল্প পড়ে ভেবেছি, এই গল্প পড়ে কি তবে পাঠকেরা আমার মতো ছুটে যাবে ভ্যানগগের আত্মজীবনী নতুন করে পড়তে? ভ্যানগগকে আরও একটু কাছ থেকে চিনতে? ছোট বড় বেমানান পা, মোটা কোমর ও বেঢপ আকৃতির দুই বোনের গল্প পড়তে যেয়ে ঠিক কোন গন্তব্য ছাপিয়ে 'সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে' গল্পটা মনে দাগ কাটবে? পাঠক ধাক্কা খাবে আমার মতোই গল্পের শেষ পরিনতি জেনে? নাকি সবশেষে মন ভারাক্রান্ত করে, অস্থির হয়ে বারবার খুঁজবে উত্তর, 'পৃথিবীর শেষ গান হিসেবে আসলে কোন গানটা থেকে যাচ্ছে আর কোনটা যাচ্ছে মুছে?' *** এমন অসংখ্য ভাবনা ও উপলব্ধি আনে এই বইয়ের সবগুলো গল্প। তাই প্রতিবার নতুন বই হাতে নিয়ে, কথাসাহিত্যিক মাহরীন ফেরদৌসের গল্প বলে চলা, একের পর এক কম্ফোর্ট জোনের বাইরে লিখে যেয়ে পাঠককে ভালো কিছু উপহার দেওয়ার এই সম্পূর্ণ যাত্রাটুকু আমি ভীষণভাবে উপভোগ করি, একজন নিয়মিত পাঠক হিসেবে। একজন প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবেও! রোজকার সম্পর্কের টানা-পড়েন, প্রেম ভালোবাসা কিংবা পাওয়া না পাওয়ার মতো অহরহ ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ছাপিয়ে তাই ভালো লাগে যখন গল্পে খুঁজে পাই প্যারারাল ওয়ার্ল্ড, কোয়ান্টাম ফিজিক্সের নানান রসদ, ম্যাজিক রিয়েলিজম অথবা একেবারেই না জানা কোন ঘটনা কিংবা গল্পের পটভূমি। যেমন 'মথ' গল্পটা পড়েছি বলেই জানতে পেরেছি ফ্রানৎস কাফকার ‘দ্য মেটামরফোসিস' সম্পর্কে! *** শেষ কিছু কথা লেখকের জন্যঃ আমি এই বইটার পাণ্ডুলিপি পড়েই অনুভব করেছিলাম, ও বলেছিলাম "This book will create a buzz, it may take longer time than your usual book, but it will surely reach the zenith of success." আমি এখনও মন থেকে সেই কথাই বিশ্বাস করি। আর, যারা বইটি এখনও পড়েননি, তাদের জন্য বলার ছিল, Don't miss the quotation that Mahrin Ferdous wrote on the second page- 'It is only with the heart that one can see rightly; what is essential is invisible to the eye.' I genuinely feel this book needs to be read through the heart. If you read through eyes only, you will end up being unsatisfied as a reader. Because here she has described a lot that's unseen to our normal eyes considering our usual surroundings!
'অরিগামির গোলকধাঁধায়' বইটি পড়তে ভালো লাগবে না। মানুষের জীবনের চরম পরাজয়, কঠিন পরীক্ষা আর মন ভাঙনের গল্প সব। এখানে ভ্রম-বিভ্রম, বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতা একত্র করে শব্দ বুনেছেন লেখিকা। বিপরীতমুখী ভাবনা নিয়ে বলে যাওয়া গল্পগুলির কোথাও আছে সমাজের কালো অধ্যায়, ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়ন, মানসিক অশান্তি কিম্বা গভীরতম বিষাদ।
চৌদ্দটি গল্প দিয়ে মার্জিন টানা হয়েছে—মানুষের বহমান জীবনের ওপর। যে দাগে উঠে এসেছে চারদিকের চেনা-অচেনা জগৎ। চরিত্রগুলি কখনও সখনও জীবনকে নতুন করে উদ্যাপন করেছে কখনওবা থেমে গেছে। লেখিকা তার আপন দক্ষতায় কাগজের ভাঁজে নিখুঁত শব্দ গেঁথেছেন। তুলে ধরেছেন প্রেমের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, চলমান পৃথিবীর কোনো চরিত্র আবিষ্কারের গোপন পদ্ধতি।
গল্পকার মাহরীন ফেরদৌস তার 'রুবি তোমাকে চিনি' গল্পে লিখেছেন, আমার জিমের লকার কোড ৩১৪০, আমার পার্লারের সিরিয়াল নং ২৫, আমার জুতার সাইজ ৬, আমি ৩৬ বি সাইজের ব্রা পরি, আমার নেটফ্লিক্সের বিল মাসে বারশ টাকা আর আগস্টের তিন তারিখে আমার মেয়ের জন্ম। আমাকে প্রথম প্রেমপত্র দিয়েছিল শোভন নামে এক হিন্দু ছেলে যখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমার হাতের বালাগুলি দুবাই থেকে কেনা, আমার চুলে বারগেণ্ডি রঙ। আমি সব মনে করতে পারি। সব; কিন্তু আমি আমি এই মানুষটার চেহারা বা পরিচয় মনে করতে পারিনা।—চিনতে না পারা এক মানুষের কথা বলতে গিয়ে কত সুন্দর বিবরণ দিয়েছেন লেখিকা। কেমন যেন দক্ষ তাঁতিনীর মতন কাপড় বুনেছেন তিনি।
অরিগামি হলো কাগজের শিল্প। একটা কাগজ না কেটে এবং কোনোরকম আঠা ব্যবহার না করে কেবল ভাঁজ করে জীব-জন্তু, পাখি ইত্যাদির রূপ দেয়া হয় তা হলো অরিগামি। অল্প কয়েকটি সরল ভাঁজের মাধ্যমে অরিগামির একেকটি অংশ তৈরি হয়। লেখিকা তার বইয়ের একেকটি গল্পকে অরিগামির অংশ করেছেন। কোনোরকম কাটাচেরা ছাড়া। এরপর ভাঁজগুলি এক করে একটি গোলকধাঁধা বানিয়েছেন। যেখানে একজন পাঠক তরতর করে পড়ে যেতে পারবেন। আটকে পড়লে সহজে বের হতে পারবেন না কিম্বা বেরোতে চাইবেনও না।
লেখিকার প্যারাকজম গল্পে একটি মেয়ের চলমান চিত্র পাই। যেখানে সে কিনা কারো জন্য অপেক্ষা করছে। মনে মনে, গোপনে। এবং মেয়েটি ভাবে, তার কথা না ভাবলে মনে হয় এবেলায় আকাশের দিকে তাকানো পাপ। তাদের যোগাযোগের জন্য কোনোরকম সোশ্যালের ব্যবস্থা নেই। এরপরও তাদের হুটহাট কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যায়। মেয়েটি একসময় স্থির হয়ে যায়। তার সময় যায়না কিম্বা সে নিজেই সময়ের বিপরীত হয়ে চলতে থাকে। লেখিকা তার এই গল্পে গদ্যশৈলীর নতুনত্ব দেখিয়েছেন। অভিনব বাক্যগুলি যেন টান সৃষ্টি করে। এরপর বারবার পড়তে ইচ্ছে হয়। এক এক করে তার লেখা গল্প—মথ, চক্র, চেকলিস্ট পাঠককে অন্যরকম ভাবনার মঞ্চে দাঁড় করাবে। যেখানে সে স্বস্তি-অস্বস্তির মুখোমুখি হবে। জীবনকে ভিন্ন ভঙ্গিতে দেখবে।
আমাদের চারপাশে প্রতিটি মানুষের জীবনে বলার মতো একটি গল্প থাকে। হোক সেই গল্প নিজের কিম্বা অন্য কারো। গল্পগুলি জানানোর জন্য কেউ মুখে বলছে, চিত্রকর্ম করছে কেউবা লেখছে। এইসব গল্প আমাদের বহমান জীবনে হালকা দুলুনি দিয়ে যায়। আমরা হয়ত তখন কেঁপে উঠি নতুবা সজাগ হই। আমরা জানতে পারি, জীবন এমনও হয়। আলো-আঁধার মিলিয়ে চলতে হই। পর্দার আড়ালে কত সত্য-মিথ্যে লুকানো জানা যায়। 'অরিগামির গোলকধাঁধায়' এমনই একটি বই। যা আপনাকে জীবনের গভীরতম গল্প শোনাবে। কঠিনতর বাস্তবতা শেখাবে। গল্পগুলি পড়তে পড়তে ঘোরলাগা কাজ করবে। এবং শেষ করার পর আরো জেঁকে বসবে। বসুক না—জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি হবে গল্পে গল্পে।
কোন একটি বিশেষ সময় বা মুহূর্তের রেশ যেমন আমাদের মনে বেশি দোলা দেয় যখন সেটি স্মৃতি হয়ে আসে তেমনি ‘অরিগামির গোলকধাঁধায়’ পড়ার মুহূর্তগুলো পড়া শেষে মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। কথাসাহিত্যিক মাহরীন ফেরদৌস এর ১৪টি ছোটগল্প নিয়ে গল্পবই ‘অরিগামির গোলকধাঁধায়’। পুরো বই এর সবথেকে চমকপ্রদ বিষয় ১৪টি গল্পের প্লট একেবারেই আলাদা এবং চরিত্র গুলোর অনুভূতি, আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাওয়া যায় সহজেই। যেমন, মথ গল্পের জেরিনের বিষন্নতা কিংবা মায়া দুপুরে বসে পুরনো বাসার স্মৃতিতে নস্টালজিক হয়ে ওঠা আচমকা মা হারানো মেয়েটির নিঃসঙ্গতার বৃষ্টিতে পাঠক হয়েও ভিজে যাই আমি। এই পৃথিবীর রুঢ় বাস্তবতায় ছিন্নভিন্ন হবার থেকে ‘প্যারাকজম’ আক্রান্ত হয়ে ভাল থাকাটা মন ছুঁয়ে যায়। একজন রেবেকার ‘এমন জীবন কি হবার কথা ছিল আমাদের কারও?’ এই দীর্ঘশ্বাস এর মধ্যেও আত্মসম্মান নিয়ে একটা অচিন শাড়ির আচল ফেলে আসাটা একটা সাধারণ চরিত্রকে করে দেয় জীবন্ত এবং সম্মানিত। তারপর রুবিকে চেনা চেনা লেগেও মনে করতে না পারা রুবির সহপাঠী, এক কামরার ঘরে হারিয়ে যাবার সময় মা’কে মনে রাখতে তাঁর ছবি আঁকতে চেষ্টা করা, চেকলিস্ট করতে করতে জীবনের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলা মেয়েটি, কিংবা প্রিয় মানুষকে ভুলতে না পারা ঝাকড়া চুলের ছেলেটি সবগুলো চরিত্রের অনুভূতি ভাবনার জগতে তৈরি করে আলাদা কিছু ট্রাঞ্জিশন। কিছু গল্পের কিছু ঘটনা রহস্যময় হয়ে থাকলেও ‘মনিদ্র অন্ধকারে’ গল্পের ভিক্টর হাতে আঁকা ছবিকে কবিতা হিসেবে কল্পনা করার যে বিষয়টি লেখিকা বলেছেন সেটি আমাকে মুগ্ধ করে। আমি মুগ্ধ হই ভেবে কত ছবিতো আশেপাশে দেখি, অথচ কোনদিন মনে হয়নি শিল্পীর আঙুলের ছন্দ মিললেই সেটা হয়ে ওঠে কোন চিত্রকর্ম, সেই আঙুলের ছন্দ আর অলংকার তাই চিত্রশিল্পীর নিজের আঁকা ছবিকে এক একটা ছন্দ মিলানো কবিতার মতই মনে হতে পারে। এভাবেই প্রতিটি গল্পের টুকরো বিষণ্ণতা, ভাল লাগা আর মুগ্ধতার ভেতর দিয়ে লেখিকা নিয়ে যান, আর পাঠক আমি হারিয়ে যাই অজানা এক ভাবনা আর উপলব্ধির গোলকধাঁধায়। যেই গোলকধাঁধার অর্থ বুঝতে হলে জগত দেখতে হয় হৃদয়ের চোখ দিয়ে। কারন সাধারণ দৃষ্টিতে আমরা যে জগত দেখে চলি, সেখানে সত্যিকারের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই আমাদের চোখে অধরা থেকে যায়। আর এই উপলব্ধি তৈরি করতে পারাটাই লেখিকার স্বার্থকতা। ( বইটি একুশে বইমেলায় সরাসরি পাওয়া যাচ্ছে কথাপ্রকাশ এর ১২নং প্যাভিলিয়ন এ এবং অনলাইন বুকশপগুলোতে)
অরিগামির গোলকধাঁধায় – মাহরীন ফেরদৌস অরিগামির গোলকধাঁধায় বইটি ১৪টি ছোট গল্পের একটি সংকলন, যা আমাকে মিক্সড ফিলিং দিয়েছে। বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তু। লেখিকা মানুষের ডার্ক সাইকোলজি, ইলিউশন, বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা এই সবগুলো এলিমেন্টকে নিপুণভাবে একত্রিত করেছেন। গল্পগুলোতে সমকালীন ক্রাইসিস, মানুষের মানসিক টানাপোড়েন, ভালোবাসার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি প্যারালাল ইউনিভার্সে নিজের মতো আরেকজনকে খুঁজে পাওয়ার মতো ইন্টারেস্টিং বিষয় উঠে এসেছে। এই বহুমাত্রিকতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। লেখিকার গল্প বলার ধরন সহজ এবং সাবলীল। ফলে সহজেই পড়া যায়। তবে, কিছু ক্ষেত্রে আমার কাছে বইটির দুর্বলতা চোখে পড়েছে। যদিও প্রতিটি গল্পই সুন্দরভাবে শুরু হয়, কিছু গল্পের শেষে আমি আমার আগ্রহ ধরে রাখতে পারিনি। তবে মনে হয়েছে গল্পগুলো দারুণভাবে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তার শেষ হয়নি। কিন্তু "প্যারাকাজম" এবং "চক্র" এর মতো কয়েকটি গল্প ব্যতিক্রম, যা পড়ে মনে হয়েছে লেখিকা সামনের দিকে আরও ভালো করবেন (উনার বাকি বইগুলো পড়ার ইচ্ছা আছে)। কারণ উল্লিখিত গল্পগুলো আমাকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছে। যদিও কিছু গল্প হয়তো সব পাঠকের রুচির সঙ্গে নাও মিলতে পারে, তবুও চারপাশের চেনা জগতের গভীরে লুকিয়ে থাকা বিষাদ, আনন্দ এবং জীবনকে নতুন করে উদযাপনের আয়োজনগুলো লেখিকা অত্যন্ত সহজভাবে তুলে ধরেছেন। সব মিলিয়ে, ‘অরিগামির গোলকধাঁধায়’ বইটা এক বসায় পড়ার মতো।
প্রতিটি ছোটগল্পের আলাদা শিরোনাম রয়েছে। তবুও সেই সব গল্প বইটির শিরোনামকে চমৎকারভাবে justify করে । গল্পগুলো অসম্পূর্ণ সমাপ্তি বৈশিষ্টের সাধারণ ছোটগল্প নয়। কিছুটা বিশৃঙ্খল প্লট নিয়ে গঠিত কাহিনী যা আপনাকে জীবনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাগুলি নিয়ে ভাবায়। এই ঘটনাগুলো দৈনন্দিন জীবনের আশেপাশে ঘটলেও সেগুলো সাধারণ নয়। এসব ঘটনার প্রভাব সাধারণ মানুষের চিন্তার বাইরে।
প্রতিটি প্লট এবং গল্পের শেষ, পাঠকের ব্যাখ্যার জন্য উন্মুক্ত। তাই বইটি buddy-read এবং আলোচনার জন্য শ্রেয়। আমার জানা আছে, ছোটগল্পের সৌন্দর্য তার অসম্পূর্ণ সমাপ্তিতে। কিন্তু এই বইয়ের গল্পের কিছু প্লট আমার বোধগম্যতার বাইরে ছিল। সেজন্য, বইটি খুব একটা উপভোগ করতে পারিনি। যদিও আমি এই গল্পগুলোর কিছুটা ভিন্ন জীবন দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত আছি।
কেও বইটা পরে থাকলে প্লিজ ইনবক্স করবেন, আমার এখনো অনেক কিছু বুঝার এবং বলার আছে গল্প গুলো নিয়ে।
মাহরিন আপুর লেখা আমার ভালো লাগে।অনেকে বলে না লেখক হতে হলে জটিল জটিল শব্দের ভেতর দিয়ে লেখকদের যেতে হয় মাহরিন আপু সেই স্টেরিওটাইপ ধারণাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। আপু আমাদের যাপিত জীবনের সরল শব্দগুলো দিয়েই গল্প বলেন, যেই গল্পগুলোতে থাকে প্রবল দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্তর্নিহিত ছন্দ। যেই গল্পগুলো পড়তে আমরা ভুলে থাকি আমাদের নিজেদের নিজস্ব গল্পগুলি।প্যারকাজমে ভুগতে ভুগতে আমাদের মনে পড়ে মধ্যরাত হতে এখনো কিছু সময় বাকি ।মনিদ্র অন্ধকারে সান্তা মনিকা স্টেশন পেরিয়ে ভিক্টর আর দু বোনের পৃথিবীর শেষ গান শুনতে শুনতে বিষণ্নতার পলেস্তারা খসে পড়তে থাকে অবিরাম।বিস্কুটের গুঁড়োর মতো বিকেলে জাদুবাস্তবতার চক্র হুট করেই বন্ধ হয়ে যায়।
গল্পগ্রন্থের তিনটে গল্পকে কোনো ছন্দের মধ্যে ফেলতে পারলাম না। এক কামরার ঘর, চেকলিস্ট আর মথ। এর মধ্যে চেকলিস্ট পড়ার সময় কিছুটা অস্বস্তি বোধ করেছি আর মথ গল্পটা বহুদিন স্মৃতিতে থাকার মতো।
I traveled through emotions by reading this book. At times, I felt sad, puzzled, hopeful, scared (a bit) and mostly, I felt amazed. I realized the powerful thoughts of ''আ'' while being tensed for another character. A proverb goes by, "Do not judge a book by it's cover". But here my friend, you can. Because the title of the book fulfills it’s purpose. You are bound to be lost and found throughout the reading. Okay, no more spoilers. Here are a few picks,
1. Brishty Te Ekai Bhijte Hoy 2. Ek Kamrar Ghor 3. Chokro 4. Monidro Ondhokare 5. Prithibir Shesh Gaan
So these are my personal favourites from the book. Hope you’ll like these too :)