"প্রকৃতি আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে না কি আমরা প্রকৃতির? বইয়ের পাণ্ডুলিপি গোছানোর সময়ে প্রশ্নটা মাথায় এলো। উত্তর অনির্দিষ্ট। তবে গল্পের ভেতর দিয়ে আমি একটা গ্রহণযোগ্য উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। একজন পুরুষের প্রেগন্যান্ট হয়ে যাওয়া, শহরে আচমকা ডুমুর পাখির দল চলে আসা কিংবা আকাশ থেকে সত্যিকারের পরী নেমে আসার গল্পগুলো দিয়ে একটা ঘোর তৈরি করতে চেয়েছি। সেই ঘোরের ভেতরেই হয়তো উত্তর মিলবে। উত্তর নাও পাওয়া যেতে পারে। তারপর মনে হলো, সবকিছুর উত্তর পাওয়া জরুরি নয়।"
মাহবুব ময়ূখ রিশাদের জন্ম ১৯৮৮ সালের ৩০ জুন। ২০০৫ সাল থেকে লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। লেখকের পছন্দের জায়গা জাদুবাস্তবতা। প্রিয় লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ও শহীদুল জহির। ব্যক্তিজীবনে চিকিৎসক রিশাদ অর্জন করেছেন ইন্টার্নাল মেডিসিনের সর্বোচ্চ ডিগ্রি এফসিপিএস। পড়াশোনা করেছেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুল, নটর ডেম কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে।
গল্পগুলোর আপাত বিচিত্র ও অদ্ভুত পটভূমির আড়ালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের রক্তাক্ত ও বিপন্ন সমকাল ও স্বদেশ। "প্রকৃতির রহস্যময়তা"র প্রতি রিশাদের দুর্নিবার আকর্ষণ বেড়ে চলছে প্রতিনিয়ত। বরাবরের মতোই লেখকের গদ্য বিষণ্ণ সুন্দর। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও রিশাদ স্বপ্ন দ্যাখেন সুন্দর এক পৃথিবীর, সেটাই রাইরিন্তার শেষ উপহার।
'রাইরিন্তার শেষ উপহার' গ্রন্থভুক্ত গল্পসমূহ আপাত স্বতন্ত্র। প্রত্যেকটি গল্প অদ্ভুত বিচিত্রতায় স্বকীয় কিন্তু তারপরেও সবগুলো গল্প একটি রৈখিক সুতোয় গাঁথা। প্রকৃতি কিংবা দৈবের রহস্যময় নিয়ন্ত্রিতকরণ তিনি ম্যাজিক রিয়েলিস্ট পন্থায় দেখিয়েছেন। দিনশেষে আমরা প্রকৃতির কাছে বাঁধা। আমাদের নিয়ে প্রকৃতির পুতুলনাচের ইতিকথার পরের কথা জাদুকরী গদ্যে রিশাদ আমাদের শোনানোর চেষ্টা করেছেন উক্ত গ্রন্থে। পড়ে বিস্মিত বিমূঢ় বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি। রিশাদের হাতে গতানুগতিক গল্প থেকে উদ্ভট, অ্যাবসার্ড টাইপের গল্প বেশি খুলে বলে আমার কাছে মনে হয়।
মাহবুব ময়ূখ রিশাদের গল্প পড়ছি বোধহয় প্রায় এক দশক হয়ে গেলো। ব্লগমণ্ডলের পাতা থেকে কাগুজে বইয়ের পাতায় তার যে যাত্রা, বললে অন্যায় হবে না যে সেই বিবর্তনের আমি একজন সাক্ষী। এবং বছরের পর বছর ধরে তাকে অনুসরণ করে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, রিশাদের লেখা উপভোগ করতে হলে- ঠিক যেমনটা করি হারুকি মুরাকামির ক্ষেত্রে- মনের যুক্তিচালিত অংশটাকে তালাবদ্ধ করে রাখতে হয়। অন্যভাবে বললে, রিশাদের জগতকে আমাদের তখনই ভালো লাগে, যখন আমরা ঘটনার কারণ না খুঁজে ঘটনার স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দেই।
‘রাইরিন্তার শেষ উপহার’ নামের সংকলনের ক্ষেত্রেও এই যুক্তি খাটে। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে রিশাদের সেরা কাজ ছিলো ‘তর্কশয্যায় মৃত্যু’ নামের গল্প-সংকলনটা, তবে এখন থেকে ‘রাইরিন্তার শেষ উপহার’ও সমানে সমানে টক্কর দেবে সেই বইটির সাথে।
সংকলনে ঘুরে-ফিরে এসেছে কয়েকটা উপাদান। জন্ম-মৃত্যু, অন্তর্ধান, রুপবদল। এই উপাদানগুলো গল্পে আসে বেশ রিশাদ-সুলভ রাস্তায়, সোজা বাংলায় অদ্ভুতুড়ে উপায়ে। তবে এবার রিশাদের লেখায় লক্ষ করি একটা নতুন প্রবণতা। এমনিতে প্রকৃতি যে নানা কিছু ঘটায়, রিশাদের জগতে আমরা তা নিত্য দেখি। তবে, এবার ‘প্রকৃতি’ নামক সত্তাটার প্রতি গল্পকারের অতিমুগ্ধ হয়ে মাথা নোয়ানোর ব্যাপারটা কিছু গল্পে বেশ মাইকিং করে জানানো হয়েছে।
নামগল্পটার কথাই ধরা যাক। প্রকৃতি অর্নিলকে কীভাবে নিজের এক পরীক্ষার অংশ করে তুললো, এই নিয়ে বেশ টানটান একটা গল্প। শুরুর এই গল্প থেকেই বইটার প্রতি পাঠকের মনোযোগ বেড়ে যায়। আরেকটু এগিয়ে গেলে রেবেকা গল্পটায় আবার দেখা যায় প্রকৃতির সেই পরীক্ষার আরেকটা দিক, যখন পূর্বপুরুষের বদলে শোনা যায় উত্তরপুরুষের গল্প।
পড়তে গিয়ে টের পাই, মানুষী সম্পর্কের কয়েকটা দিক দারুণভাবে আক্রান্ত করেছে গল্পকারকে। এই প্রেক্ষিতে ‘রিওনা’ গল্পটা খুবই চমৎকার। আবার, ততটা ভালো না হলেও ‘সম্পর্ক শহর’ গল্পটাও সেই বিষয়ে।
সমকালকে এড়িয়ে যাবার উপায় গল্পকারদের কখনোই থাকে না। সে কারণেই আমরা দেখি এই বইয়ের গল্পে মুছে যাচ্ছে জীবিত ও মৃতের ভেদাভেদ (এই মৃত শহরে); আমরা দেখি, আমাদের নিকটজনকে কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে স্পষ্টবাদিতার অপরাধে (সুনর্ম); আমরা দেখি, আমাদের সমকাল এমনই অসহনীয় যে আত্মুহত্যার অধিকার চাইছে মানুষ (হাতি)। রিশাদের গল্প আমাদের আঘাত দেয়, যখন দেখি সুন্দর সবকিছু হয়ে যাচ্ছে ভোগের সামগ্রী (ডুমুর পাখির মাংস), যখন দেখি এমনকি কাছের মানুষও ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে আমাদের ছলনায় (যেমন খুশি তেমন সাজো)।
মানুষের অবিরাম রুপবদলের এই সব খণ্ডচিত্রই উঠে এসেছে রিশাদের রচনায়। রিশাদের জগত পছন্দ করা পাঠকের জন্য তাই ‘রাইরিন্তার শেষ উপহার’ বেশ উপভোগ করবার কথা।
অন্ধকার অববাহিকায় হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত লাগে, তখন হয়তো শব্দহীন ঘাসের উপর এসে বসি। দূরে লীন হয়ে যাওয়া অরণ্য, হয়তো সেখানে একটি ঘুঘুপাখি ম্লান স্বরে ডাকে। কুয়াশাকে মনে হয় ধোঁয়া, এসব চ্ছেদ করে একটু আগালেই জড়িয়ে ধরে মাকড়শার জাল। মাহবুব ময়ূখ রিশাদের 'রাইরিন্তার শেষ উপহার' পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, গল্প গুলো ঐ ঘুঘুপাখি, যার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে আমি জড়িয়ে পড়েছি মাকড়শার জালের মতো কোন এক রহস্যাবৃত জালে।
সবগুলো গল্পের একটা বেসিক প্যাটার্ন আছে, স্বর্গ আর নরকের মাঝে সেতু তৈরি করার মতো করে গল্পকার গল্পগুলোকে কানেক্ট করেছেন কোন এক দৈবিক বলে। গল্পকার গল্পের আড়ালে ভাগ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে প্রকৃতির, আর সে'ই প্রকৃতির সবকিছুতেই আছে বাধা। তাই হয়তো অর্নিলকে রূপক অর্থে ব্যবহার করে লেখক লিখেছেন এমন গল্প, যা পাঠকের মন চাপ তৈরি করবে নির্ঘাত। বইটার প্রতিটি পাতার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে যেন পাগলাটে বাতাস, এ বাতাসে হারিয়ে যেতে পারে সুনর্ম কিংবা সুনর্মের মতো কোন পাঠক। মনোলগের মধ্যে স্পষ্ট হতে পারে রেবেকার রূপ, যার মা ক্রমশই অনু-পরমানু হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ডায়েরির আড়ালে রিওনা খুলে ফেলছে ডানা কিংবা এই মৃত শহরে, আকাশের রঙ বদলে দিচ্ছে মহামারী। গল্পের টপিকগুলো আউট অব দ্যা বক্স, ভাষাও খুব ড্রিমি। তাই সম্পর্কশহরে'র আয়ুতে জন্মেছে যারা, তাদের চিন্তার সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পাঠক ধাক্কা খেলেও, ক্লান্ত বোধ করবে না বরং গল্পকারের সাথে তাল মিলিয়ে সেও হয়তো খুঁজতে শুরু করবে বাঘের চোখ। তখন হয়তো বধির হয়ে যাওয়া আরিশের ব্যথা রেনিও বুঝতে না পারলেও, বুঝতে পারবে পাঠক। বইটা পড়তে পড়তে আরও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হবে মাহবুব ময়ূখ রিশাদের জগত।
ম্যাজিক রিয়েলিজমের এলিমেন্ট ইউজ করে গল্পকার বারবার আঘাত করেছেন প্রচলিত ভাবজগতে। গল্পগুলোর ভাষা স্মুথ, মনে হয় ঘুমজড়ানো কণ্ঠে, শান্ত নদীর তীরে বসে, কেউ একজন বলে যাচ্ছে গল্প। গল্পগুলোর জগত আমাদের অচেনা, কিন্তু খুবই আপন। গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনের মধ্যে তৈরি হতে পারে ঘোর, পাঠকের মনে পড়ে যেতে পারে নিশি পাওয়া মানুষের কথা।
'রাইরিন্তার শেষ উপহার' পড়তে পড়তে নীরবতার মধ্য দিয়ে পাঠক হয়তো আবিষ্কার করবে নিজস্ব কিছু, যেমন আমি আবিষ্কার করেছি ডুমুর পাখির রাত।
'বাড়ি ফিরে যাও অর্নিল' ছোট্ট এই বাক্য দিয়ে শুরু হয় মাহবুব ময়ূখ রিশাদের গল্পবইয়ের সাথে ভ্রমণ। মনে হয় যেন, অনেক মাইল হেঁটে কোথাও গিয়েছি আর গল্প আমাকে বলছে, 'ফিরে যাও হে। এখানে কিছু নেই। কোন গল্প নেই তোমার জন্য।' তারপরেও একগুঁয়ে পাঠক হয়ে অদৃশ্য এক চেয়ার পেতে বসে থাকি গল্পের পাশে।
প্রথম গল্প 'রাইরিন্তার শেষ উপহ��র' শেষ করেই চমৎকৃত হতে হয়। এরপরের গল্পগুলোও জলের মতো সাবলীল, শুরু আছে শেষ আছে, প্রকৃতির সাথে আছে সূক্ষ্ম সম্পর্ক আর অদ্ভুত রকমের চমক! সব মিলিয়ে ঠিক তেমন একেকটা গল্প, যেমনটা আজকাল মন খুঁজে বেড়ায়। 'সুনর্ম', 'রেবেকা', 'রিওনা'... প্রতিটি গল্পই পাঠকমনে প্রবাহিত হয়ে যায় অকপটে। রিশাদ বরাবরই গল্পের মানুষ। শূন্য থেকে গল্প বানিয়ে ফেলতে ওর দু সেকেন্ডও লাগে না। এবারের গল্পগুলোও তেমনই। মানুষের চোখের মতো প্রজাপতির চোখ, প্রহর থেকে প্রকৃতির সাথে বিচিত্র কিছু বোঝাপড়া, রেবেকার মায়ের আচমকা ছিন্নভিন্ন মাংসে পরিণত হওয়া, ডানা মেলে উড়তে না পারা পরী, মহামারীতে বদলে যাওয়া শহর কিংবা হাতির পায়ের নিচে চাপা পড়তে চাওয়া এক মেয়ের গল্পসহ প্রতিটি গল্পই কোন না কোন ভাবে পরস্পরকে ঘিরে থাকে আবার বিরোধিতা করে যায়। একটা মজার ব্যাপার হলো, রিশাদের গল্পজগতে একটা ভিন্ন স্বাধীনতার আমেজ আছে। গল্পের চরিত্রগুলো আটকে থাকা সময়, সমাজ বা পৃথিবীর হলেও তাদেরকে মনে হয় বিচ্ছিন্ন ও প্রচণ্ড স্বাধীন। খুব চেনা চরিত্র না হবার পরেও সম্ভবত এ কারণেই তাদেরকে জানতে ইচ্ছে করে তীব্র আগ্রহ নিয়ে।
আমার মতে, একজন পাঠক গল্পকারের কাছে মূলত এটাই চায়। সে চায়, একজন গল্পকারের জগতের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেরিয়ে আক্রান্ত হতে। চায়, বিচিত্র জগতে প্রবেশ করতে। অনুভব করতে চায় নাম না জানা সব অনুভূতি, বুঝতে চায় চরিত্রগুলোকে। তারপর একটা সময় তার মনে হয় একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। ক্ষণিকের বিরতি। গল্পগুলো, চরিত্রগুলো আত্মস্থ করার জন্য। যোগসূত্র টানার জন্য। এই বইয়ের বেশকিছু গল্প পড়ে পাঠক হিসেবে আমার অনুভূতিও এমনই ছিল। তবে, ১৩টি গল্পের সংকলন হলেও, একটি বই শেষ করার পর মনে গাঢ় রেশ রেখে যায় অল্পকিছু গল্পই। কিংবা বলা যায়, একটি গল্প, যা ছাপিয়ে যায় সবগুলো গল্পকে। এই বইতে আমার জন্য সেই গল্পটি হলো প্রথম গল্পটি। কারণ সবগুলো গল্প উপভোগ করেও আমাকে ফিরে যেতে হয়েছে আবারও অর্নিল ও রাইরিন্তার উপহারের কাছেই।
বইটা পড়ার সময় বেশ অনেকবার মনে পড়েছে রিশাদের আরেকটি গল্পগ্রন্থ 'তর্কশয্যায় মৃত্যু' এর কথা। ব্যক্তিগতভাবে পছন্দের তালিকায় সেটি সতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছিল প্রকাশের পরপরই। এবারের গল্পবইটা পড়ার কালে মনে হলো 'তর্কশয্যায় মৃত্যু' -এর পাশাপাশি এটিও জায়গা করে নিবে পছন্দের তালিকায়। কিছু গল্পের বাঁক ও সমাপ্তি নিয়ে অল্পকিছু ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ বাদে মার্চের আলোঝরা এক বিকেলে ভিন্ন রকমের ঘোর দিয়ে শেষ হয় বইটির সাথে আমার যাত্রা, এক ক্লান্ত চিবুকের বিষণ্ণতা নিয়ে...
মাহবুব ময়ূখ রিশাদের লেখা পড়তে গিয়ে আমার মাথায় বারবার ইরাজ আহমেদের কিছু লাইন চলে আসে, 'মাঝে মাঝে মনে হয় এই শহরটার নিচে আরেকটা শহর আছে । তার নিচে আরেকটা, তারপর আরো আরো শহর । শহরগুলো পরিত্যক্ত নয়। সেখানে সাজানো আছে বহু গল্প, কত দিবারাত্রির সুঘ্রাণ । আমি হয়তো একটা ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাবার সময় এই শহরগুলোকে ফেলে যাচ্ছি । কিন্তু সব গল্প মনের মধ্যে থেকে যাচ্ছে রূপকথা হয়ে।'
রিশাদ সাহেবের গল্পগুলো যেন সেইসব প্রতিচ্ছবি ধরনের শহরগুলোর কোনোটা থেকে উঠে আসা। এখানে প্রতিনিয়তই যা কিছু ঘটে, যা কিছু ঘটে চলে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যার প্রয়োজনও নেই।
এখানে গাছের নিঃশ্বাসের শব্দে মানুষের ঘুম ভেঙে যায়, বাতাসেরা গুলি করে মানুষ খুন করে, প্রকৃতির হেয়ালিতে মানুষের ভাগ্য পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে, দুপুর এসে মানুষের কানে মন্ত্রণা দেয়, পরীরা আসে মানুষের রূপ নিয়ে.... এবং পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, আমি আসলে এরকম কিছুই পড়তে চাই কিংবা আমি বোধহয় এরকম কিছু পড়ার অপেক্ষাতেই ছিলাম।
একটা ঘোর সৃষ্টি করতে চেয়েছেন লেখক। যেই ঘোরের মাঝে যুক্তি, বিচার, বুদ্ধি ব্যবহারের চাইতে গল্পের তোরণে ভেসে যাওয়াটাই উত্তম মনে হয়। কিছু গল্পে মনে হচ্ছিলো একটা আবহ দরকার চারপাশে। একটু গুমট, নীরব, স্বল্প আলো...কবিতাপাড়ায় যেমন থাকে। তবে এখানে ছন্দের উপস্থিতি থাকবেনা। থাকবে মোহমায়ায় জড়ানো মানবিক অমানবিকতার দন্দ। এখানে গল্পগুলোর মাঠে খেলা চলেছে প্রকৃতির সাথে। অদল বদল ঘটেছে প্রাকৃতিক নিয়মের, প্রতিকৃতি বদলেছে বাস্তবতার মানচিত্রের। অন্ধকারের সাথে সাথে আলোর নয়, উলটো যোগসাজশ ঘটেছে মহাশূন্যতার। প্রকৃতির নিয়ম ছিন্ন করে গর্ভবতী হয়ে পড়ছে পুরুষ, মানুষের মন পড়ে ফেলার অলৌকিক গুণ পেয়ে এই কলুষিত শহরে টিকে থাকছে এক নারী, মানুষ হয়ে মানুষের মতো মানুষকে ভালোবাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে যায় এক পরী, হাজার হাজার ডুমুর পাখি উড়ে আসে বসবাসঅযোগ্য শহরে। লেখক স্বাধীনভাবে উড়তে দিয়েছেন তার চিন্তাভাবনা গুলোকে। ম্যাজিক রিয়েলিজম, কিংবা পরাবাস্তবতার ব্যবহারই মূল উপজিব্য ছিলনা যে এই বইতে সেটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে লেখকের প্রকৃতির সাথে মিলিত হবার প্রয়াসটাকে। নতুবা শুধুই এলেবেলে কিছু কল্পনাই ঠেকবে একসময়।
প্রথম গল্প রাইরিন্তার শেষ উপহার পড়ে শেষ করবার পরই জোরেশোরে একটা ধাক্কা খেয়েছি। বইটাকে শুধুই এবস্ট্রাকট শিল্পের বই ধরে বসে থাকবো সেই সুযোগ নেই বুঝে গেলাম। সময় দিলাম অন্যান্য গল্পগুলোতে। বোঝার চেষ্টা করলাম প্রচ্ছন্ন মূল বার্তাটা। এরপর রেবেকা, রিওনা, সুনর্ম, ডুমুর পাখির মাংস এই গল্পগুলো আস্তে আস্তে ভালো লেগে গেছে। সব গল্প যে একেবারেই বুঝে ফেলেছি কিংবা বুঝতে পারবো সেই আশা করেও বসে থাকিনি। কোনো কোনো গল্প আমার তাবৎ জ্ঞান পরিমিন্ডলের কয়েক ফুট উচ্চতা দিয়ে উড়ে চলে গেছে সেটা বলতে দ্বিধা নাই। তবে প্রথম গল্পটিই সবচাইতে বেশি উপভোগ করেছি বলাই বাহুল্য।
১৩টি গল্পের সব কটাই ভিন্ন আঙ্গিকে সুন্দর। সবচাইতে বড় কথা যেটা আমি সবসময় বলি, একটা বই যখন ভাবনার খোড়াক যোগাতে পারবে আপনার মস্তিষ্কে, ভিন্নতার জানান দিতে পারবে, গন্ডির বাইরে বেরুতে পারবে চিন্তার বাক্সটার, তখন বইটি স্বার্থক। মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এই বইটিকে সেই দিকে স্বার্থক করে তুলেছেন। একটু ধৈর্য্য নিয়ে ধীরস্থির ভাবে যদি অন্যরকম কিছু ছোটগল্প পড়ায় আগ্রহ আপনার থাকে, তবে আমি বইটি পড়তে আমন্ত্রণ জানাবো।
সময়, প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে বইয়ের অনুভূতি জড়িত এটি পড়তে গিয়ে প্রবল ভাবে অনুভব করেছি। প্রচন্ড মেলানকলিক বৃষ্টির বিকালে পড়েছি দেখেই বোধহয় অনুভূতিটা ছিলো প্রচন্ড। তারকার ক্ষেত্রে কিপ্টেমি করা গেলো না মোটেও তাই।
রিশাদের তৈরি শহরে হাওয়ারা আততায়ী, মানুষগুলো হুটহাট মিলিয়ে যায় শূন্যে, শহরের আকাশ ছেয়ে যায় দূর গোলার্ধ থেকে আসা অসংখ্য ডুমুর পাখির ডানায়, মানুষগুলো তাদের চেহারা ইচ্ছেমতোন বদলে নিতে পারে অন্য কারো চেহারায়। কিংবা প্���কৃতির নির্ধারিত ছক উল্টে পাল্টে দিয়ে পুরুষ শরীরে বেড়ে ওঠে শিশু ভ্রূণ। মানুষগুলো হারিয়ে ফেলা বাড়ির ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে ভুলে যায় প্রিয় মুখ এমনকি নিজের নাম অথবা সম্পর্কের ক্লেদ থেকে পালিয়ে সম্পর্কহীন কোন এক কাল্পনিক জগতে ঢুকে একই ভাবে আটকে পড়ে পৌনঃপুনিকতার অন্তহীন চক্রে। এই শহরটা নিজ থেকেই বিশ্লিষ্ট হয়ে অনেকগুলো শহরে ঢুকে পড়ার কারণে তৈরি হওয়া সিমেট্রিতে যে কারো মনে হতে পারে রিশাদ তার লেখায় বোধহয় একই শহরের গল্প বলে গেছেন।
এইসব শহরে ঘটতে থাকা অদ্ভূতুড়ে সব ঘটনা ও মানুষগুলোর আপাত অপ্রাকৃতিক স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যের কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় যাপিত জীবনের সীমাহীন বৈচিত্রহীনতাকে। কেননা এটা শক্তিশালী করে তোলে মানুষের কল্পনার জগতকে যার ভিত ও অবয়ব তৈরি হয় বাস্তব জীবনের প্রাপ্তিশূন্যতা জারিত বিবিধ অনুষঙ্গ থেকে।
সমান্তরালে আরেকটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করান যায় যে রিশাদের বর্ণিত এই শহরগুলো তৈরির নেপথ্যে যারা ছিলো, তারা প্রত্যেকেই সময়ের বিবর্তনে ক্রমেই হয়ে উঠেছিলো বেপরোয়া। মানুষ কেন বেপরোয়া ওঠে তার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে জানা যাবে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। প্রকৃতি আগাগোড়ায় খেলোয়ার স্বভাবের। মূলত সেই মানুষকে প্রলুব্ধ করে তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে যেখানে বরাবরই হার হয় মানুষের। সুতরাং প্রকৃতির শর্ত পুরণ করে যাওয়াটাই মানুষের নিয়তি।
"রাইরিন্তার শেষ উপহার" গল্পগ্রন্থে গল্পকার রিশাদের মুন্সিয়ানার ছাপটা যেমন স্পষ্ট একইভাবে তার সৃষ্ট জগতের মাধ্যমে পাঠক কিছুটা হলেও ইঙ্গিত পেতে পারেন লেখকের মনস্তত্বের। লেখক-পাঠকের এই অদৃশ্য যোগাযোগ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। রিশাদের গল্পের আরেকটা দিক হলো বেশীরভাগ গল্পের বিষয়বস্তু পূর্বপরিকল্পিত নয়। লেখক যেন অনেকটা হাওয়া থেকে গল্প বানিয়ে ফেলতে পারেন যেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবীদার। এক্ষেত্রে যেমন সম্ভাবনা তৈরি হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সৌন্দর্য্য সৃষ্টির হবার, একইসাথে ঝুঁকি থেকে যায় ভাবনার পুনরাবৃত্তির।
ছোট গল্প বলতে জানতাম শেষটুকু পড়েও আরো জানার ইচ্ছা থেকে যাবে| কিন্তু এই বইয়ের গল্পগুলো বুঝে উঠার আগেই সমাপ্তি ঘটে| আরো জানার ইচ্ছা তো দূরে থাক, প্লট টাই বুঝে উঠা দায় হয়ে যায়| কেমন যেন হ য ব র ল সব কটি গল্প|
যে দুটি গল্প আমার তাও ভালো লেগেছে: 'বধির' ও 'যেমন খুশি তেমন সাজো'|
আমি এমন ছোট গল্পের বই আরো একটি পড়েছি যেটা পড়ে একই রকম লেগেছে| বোধগম্য হওয়ার আগেই গল্প শেষ| তাহলে কি contemporary ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য এমন যা আমার জানা নেই?
নাগরিক জীবনের গোপন গল্পগুলো সব ধরা আছে রিশাদের এই বইয়ে। আরোপিত নেই কিছু, শুধু বলে যাওয়া। এমন এক ভাষায় যেটা আমাদের টানে আবার বিষণ্ণও করে দেয়। শুধু গল্পের জন্যও গল্প হতে পারে যেগুলো নিয়ে বসলে একে একে আবিষ্কার করা যায় এক অদ্ভুতুড়ে কিন্তু চেনা জগত। কিন্তু এর গভীরে কি আর কোনো কথা থাকে না? থাকে মনে হয়।
সুনর্ম, বাতাসপ্রুফ জ্যাকেট, বাঘের চোখ, ডুমুর পাখির মাংস এমনই সব গল্প যা আমাদের সময়ের সবচেয়ে অন্ধকার বিষয়গুলো খুব সাবলাইম কৌশলে ডিল করেছে, শেষ করে চমকে ওঠা ছাড়া উপায় থাকে না।