তেজস্ক্রিয় এক বিস্ফোরণে পালটে গেছে পৃথিবীর ভূ-রাজনীতি। ‘মৃত বিশ্ব’ এর কোনো এক জনপদে আবির্ভাব ঘটেছে সর্বশক্তিমান এক কর্তৃপক্ষের, যারা চায় ইতিহাস মুছে দিতে আর শিল্পের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে। তবু সেই জনপদে গ্রাফিতি আঁকছে কেউ, কেউ আবার লিখতে চাইছে উপন্যাস।
পৃথিবীর সমস্ত উপন্যাসের খলনায়কের মতোই, কর্তৃপক্ষ সর্বদাই নিয়ন্ত্রণবাদী। সে চায় নিজের ইচ্ছামাফিক সকল কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে, সে চায় নিজের মতটাই বাকি সকলের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে। অন্যদিকে শিল্পীরা চিরকালই হাঁটে উল্টোদিকে, নিয়ন্ত্রণ করতে না চেয়ে তারা বরং অন্য মানুষের মনকে বুঝতে চায়। ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’ খুঁজতে চেয়েছে এই দ্বিমুখী শক্তির টানাপোড়েনে তৈরি হওয়া জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর।
Shuhan Rizwan is from Bangladesh. His debut novel, a historical fiction named 'সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ (Knight in the Oblivion)' was published in 2015; since then, he published 3 more full-fledged novels. His novels often centered around the geo-political nuances and predicaments of life in contemporary Dhaka.
Apart that, Shuhan is a screenwriter too, and the recipient of Chorki Best Screenplay Award-2022.
Being a Mechanical Engineering Graduate, Shuhan choose to be a fulltime writer since 2020. Now when he is not writing in his muddled studio, he spends most of his time reading, traveling with his wife and watching sports events.
আমাদের সাম্প্রতিক সাহিত্যে (উপন্যাস হোক বা গল্প) ঢাকার গল্প নেই, এ আক্ষেপ আমাদের অনেক দিনের। এই 'আমাদের' মানে কাদের? সে প্রশ্ন করলে যে নামগুলো আসবে তা আসলে ওই নামের মানুষগুলোই কেবল নয়, তাদের মতো আরও অনেকে। যেমন এই উপন্যাসের সুহান রিয়াসাত আসলে হতে পারেন খোদ লেখক সুহান রিজওয়ান। জেলখানার ওদিকের কোনো মুসলিম হোটেলে যাতায়াত না থাকলেও এই ব্যক্তির মাহমুদুর রহমান হতে দোষ নেই। এমনকি সুহান রিয়াসাত আসলে মাহমুদুর রহমানের লিখিত কোনো চরিত্রও হতে পারে। মোটের উপর, ব্যক্তি যেই হোক না কেন, উপন্যাসে তার উপস্থিতি যে বিষয়কে অ্যাড্রেস করে তা ঢাকার। তবে আজকের ঢাকা নয়, এখন থেকে প্রায় ৫০ বছর পরের ঢাকা।
এখান থেকেই বোঝা যায় সুহান রিজওয়ানের 'গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে' একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস, যেখানে এই ঢাকার অন্য এক রূপ উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু আসলে তেজস্ক্রিয় মহাবিস্ফোরণের পরের যে ঢাকা বা বাংলাদেশের গল্প বলা হয় তা আসলে আজকের এই ঢাকারই গল্প। সুহান রিজওয়ান মূলত এই সময়টাকে, সময়ের ঘটনার সাথে নানা উপসর্গ, অনুসর্গ ও অনুষঙ্গ যোগ করে এক নতুন ঢাকাকে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ডিস্টোপিয়ার সেই পুরনো আবছা, কালো অবয়ব এখানে নেই। সুহান যে ঢাকাকে দেখান তা স্পষ্ট। ইকবাল, আইয়ুবীর কালা কানুন আমাদের মনে করিয়ে দেবে ঊনসত্তর থেকে নব্বই। জনতার মঞ্চ কী মনে করাবে তা পাঠক মাত্রই বুঝতে পারবে। তাহলে সুহান রিজওয়ানের লেখার বিশেষত্ব কী?
এ উপন্যাসের গঠন ও আঙ্গিকের দিকে যাই তাহলে দেখব একটি অধ্যায় এই উপন্যাসের সময়ের গল্প বলে। পরবর্তী অধ্যায়েই আসে নানা বিচার বিশ্লেষন, ব্যাখ্যা। অর্থাৎ ফিকশন এবং নন ফিকশনের মধ্য দিয়ে কাহিনী এবং এর আনুশাঙ্গিক বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেছেন। এই ২০১০/১১ থেকে শুরু হয়ে ২০২১/২২ এর যে সামাজিক, রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা গেছি সে বিষয়গুলোই ভবিষ্যতের আবরণে তুলে আনা হয়েছে। মূল যে বিষয়টি ধরে লেখক এগিয়েছেন তা হলো সিরিজে আকা কিছু গ্রাফিতি। 'ঋজুশির' নামে অজ্ঞাত কোনো শিল্পির আঁকা গ্রাফিতি কেমন করে একটা সময়কে ধারণ করে, কিংবা কোনো গ্রাফিতি নয় বরং একটা সময়ে স্রোতে না ভেসে থেমে থেকে, নিভৃতে কাজ করে যাওয়া চিন্তাশীল, সংবেদনশীল মানুষেরা কী করে দেশ, সময় ও মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, সুহান রিজওয়ান সে গল্প বলতে চেয়েছেন। গল্পটা বলতে গিয়ে তিনি অগুনতি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উত্তর দিয়েছেন, কখনও ছেড়ে দিয়েছেন পাঠকের হাতে।
এই উপন্যাসের বাক্য গঠন কিছুটা অন্য রকম। সেটা লেখকের এক্সপেরিমেন্ট হতে পারে তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পড়তে জিভে স্বাদটা কম লাগে। আর শেষটা কেমন যেন যেখানে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে গেল না (লেখক হিসেবে আমি জানি এ জিনিসটা কেন হয়। আমার নিজের লেখায়ও হয়)। দলকানা বক্তব্য নেই তবে কিছু জায়গায় পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকার চেষ্টা আছে। এই আরকি।
গ্রাফিতি থেকে শুরু করে বেতাল পঞ্চবিংশতিকে বর্তমানের সঙ্গে মিলিয়ে এ বইয়ের লেখক আমাদেরকে লেখার এক নতুন ধরনের হদিস দিয়েছেন। এখানে কোনো উপদেশ নেই, আছে আত্মবিশ্লেষণ। কিংবা সেখান থেকে সময়কে, মানুষকে, ক্ষমতাকে বা প্রবৃত্তিকে বিশ্লেষণ। আদতে এই বই পড়তে গিয়ে সবকিছুকেই অনুভব করা যাবে। অসহায়তা অনুভূত হতে হতেও হবে না তবে বুঝতে পারা যাবে আমাদের আসলে কিছুই করার নেই। সেই না থাকা নিয়ে শেষটায় এসে পাঠকের আক্ষেপ হতে পারে কেন লেখক কোনো পথনির্দেশ করলেন না। কিন্তু এই আক্ষেপ আসলে বৃথা। কেননা গ্রাফিতি প্রশ্ন করে যায়, উত্তর খুঁজতে হয় মানুষকে।
এ বইয়ে সুহান রিজওয়ান বারবার একটা প্রশ্ন করেছেন, কেন লিখতে হবে? পাশাপাশি, এ বইয়ে (এবং দেশ বিদেশের অন্যান্য বহু লেখায়) বারবার বলা হয়েছে প্রতিটি লেখা, প্রতিটি শিল্প এক একটা আবিষ্কার। হতে পারে সেখানে রাজনীতি, অর্থনীতি সচেতনতা থাকবে, হতে পারে থাকবে না। কিন্তু লিখতে হয় (বা শিল্প চর্চা করতে হয়) কোনো কিছু আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে, বিশেষত নিজের মধ্যে। গ্রাফিতির করা প্রশ্নের উত্তর পাঠক খুঁজবেন। নিয়ন বাতি, টিএসসির কনসার্ট বা সরোবরের আড্ডা বা সড়ক আন্দোলন মিলিয়ে ঢাকার যে রঙ, সে ঢাকার ভিন্ন রঙের আবিষ্কার করতে করতে সুহান রিয়াসাত আমাদের সেই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা বা লেখার উদ্দেশ্য দেখিয়ে দেন।
সুহান রিজওয়ানের তৃতীয় উপন্যাস "গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে"। তাঁর লেখালেখির সাইটে নিয়মিত চোখ রাখি,যদিও এই লেখক একটি বইয়ের পর আরেকটি বই লিখতে/প্রকাশ করতে যথেষ্ট সময় নিয়ে থাকেন। তাই "সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ" দিয়ে যার সাথে পরিচয়, "পদতলে চমকায় মাটি"র পরে কয়েকটা বছর অপেক্ষা করতে হল "গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে" হাতে আসা পর্যন্ত। ডিস্টোপিয়া বা আরও স্পেসিফিক করে বললে পলিটিক্যাল ডিস্টোপিয়া, নাকি পোস্টমর্ডান উপন্যাস - কোন ধারার বই এটা- সেসব নিয়ে আলাপে যাওয়ার আগে বরং আমার সুহানের (রিজওয়ান ও রিয়াসাত দুজনেই) করা এই প্রশ্নগুলো নিয়েই কথা বলতে ইচ্ছা করছেঃ
কেন অন্য কোন শিল্প মাধ্যম নয়, নির্দিষ্ট করে উপন্যাসই লিখতে চায় কেউ? কেন লিখতে বসবে কেউ? লিখে ঠিক কী হয়? কেন আমি? কেন আমাকেই উপন্যাস লিখতে হবে?
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্ন তিনটার উত্তরের খোঁজ করে চলে সুহান রিয়াসাত, সাথে হয়ত সুহান রিজওয়ানও। রিয়াসাতের চেয়ে হয়ত রিজওয়ান এগিয়ে আছে বলতেই হবে, কারন উপন্যাসটা সেই লিখছে। আর তাই তাঁর কলমের আশ্রয়ে রিয়াসাত খুঁজে নিচ্ছে উত্তর। একজন সত্যিকারের উপন্যাসিকই সম্ভবত পারেন একের মধ্যে অনেককে ধারন করতে। সুহান রিজওয়ান এ ব্যাপারে তাঁর কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ষোল আনা। উপন্যাসটার কাঠামোটাও অনেক সুন্দর - একেকটা অধ্যায় একেক চরিত্রের বয়ানে লেখে যাওয়াটা হয়ত নতুন কিছু নয় কিন্তু তার মধ্যে যখন আবার সেই ভবিষ্যতেরও ভবিষ্যতে প্রকাশিতব্য বইয়ের অধ্যায়, মৃত বিশ্বের দুজন লেখকের সাক্ষাৎকার, ঋজুশিরের ডায়েরী, নিশাতের মনীষাকে লেখা চিঠি, আধুনিক বেতাল পঞ্চবিংশতি এমনকি ১১৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি টেস্টের প্রশ্নপত্রের মধ্যে দিয়েও আমরা পেয়ে যাই উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যান গুলো। আবার এতো সুন্দর, এতো ইফোর্টলেসলি সুহান রিজওয়ান কাজটি করেছেন যে মনে হয় না "শো-অফ" বা নিছক একটু অভিনবত্ব আনতেই এসবের চেষ্টা। ডিস্টোপিয়ার চেয়েও আমি বলব পোস্টমর্ডান ঘরানার খুব কাছাকাছি এই বই। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করছিঃ
শাস্ত্রমতে, Postmodern হয়ে উঠার কয়েকটা শর্তের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা হল Metafiction (অর্থ জিজ্ঞেস করলে বিপদে পড়ব) আদলে লেখা - "গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে" বইটা আসলে সুহান রিয়াসাতের মধ্য দিয়ে সুহান রিজওয়ানেরই এই বইটা লেখার গল্প। যদি Fragmentation এর কথা বলি, আগের প্যারাতেই উল্লেখ করলাম - পুরা বইটাই ফ্রাগমেন্টেড করে লেখা; কোন টা অন্য আরেকটা বইয়ের অংশ, অথবা কারও সাক্ষাৎকার, কারও নোটবই, কারও চিঠি। Non-linearity'র কথা কাউকে বুঝায় বলার দরকার নাই, বইটা পুরাটাই jumping forward and backward in time. আবার Pastiche - যার মানে হল প্রচলিত কয়েকটা জনরাকে মিলায়ে একটা নতুন ধারা তৈরী করা। এ কথাটাও "গ্রাফিতি"র জন্য খাটে - কারন আমার মনে হয় বইটা ডিস্টোপিয়া আর পলিটিক্যাল থিমের ভালো অ্যামালগামেশন।
আমাদের দেশে Postmodernism নিয়ে আগে কাজ হয়েছে কিন��� জানা নাই, থাকলেও আমার পড়া হয়নি। সুহান রিজওয়ানকে আমার অনেক অনেক সাধুবাদ রইবে শুধুমাত্র এতো কঠিন একটা পথে হাঁটার সাহসও করতে পারার জন্য।
বর্তমান হয়ে যাচ্ছে ব্যথিত অতীত, চূর্ণ ভূখণ্ডের বাতাসে কামানের স্থবির গর্জন, এই গর্জন শুনেছে সুহান, এই গর্জনে পরিচিত মানুষ, অপরিচিত হয়ে যায়। বদলে যায় শহরের মানচিত্র। বাস্তবতা এমন, পাখির চোখে দেখেও এইসব বদলে যাওয়া হজম করা যায় না, নিজেকে আবিষ্কার করতে হয় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মাঝে। কিন্তু, খেলা তবুও শেষ হয় না, ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসে চোখ, মুখ সেলাই করে দিয়ে যায় খাকি পোশাক আর এভাবেই কোন এক পরিত্যক্ত শহরের দেয়ালে প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ঝুলে থাকে অসংখ্য গ্রাফিতি।
ঘড়ির কাটা থেমে আছে এইখানে কিংবা কেউ খুলে নিয়ে গেছে কাটা। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সময়টা ঠিক ঠাওর করা যায় না। লোডশেডিং হয় থেমেথেমে, বাইরে বেরিয়ে তখন নক্ষত্র দেখতে ইচ্ছে করে কিন্তু নক্ষত্র এখানে নেই, নক্ষত্র হয়তো রয়েছে উন্নত কোন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু, আকাশকে মনে হয় খুব কাছাকাছি, এতো কাছে যেন এখনই ভেঙে পড়বে মাথায়। এই ভাবনায় সারারাত আর ঘুম হয় না, অসম্ভব চাপ তৈরি হয় মনে। এমন অস্থিরতা আছে 'গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে' উপন্যাসে।
প্রথম চ্যাপ্টারে তৈরি হয় অমিত সম্ভাবনা, কী ভাষায়, কী বর্ণনায়... ঔপন্যাসিক যেন বলে বলে মারছেন ছক্কা। টানা ফিকশন পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে যখন বসছি পড়ার টেবিলে, ঐ যখন সকাল বেলা, একা শালিক আসে আমার কাছে গান শোনাতে তখন দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে এসে ধাক্কা লাগে। ফিকশনের পরেই দেখি নন-ফিকশন। কখনও এই নন-ফিকশন এসেছে মাহমুদুন নবী নামক এক লেখকের বরাতে কখনও এসেছে স্রেফ পত্রিকার ছেঁড়া পাতা হয়ে, এ যেন এক নেভার এন্ডিং রেস, ফিকশন-নন ফিকশন দৌড়াচ্ছে পাল্লা দিয়ে, কেউই তেমন ক্লান্ত হচ্ছে না। সাম্যাবস্থাটা বুঝে ওঠার আগ পর্যন্ত অবশ্য এই আঙ্গিকের সাথে খাপ খাওয়াতে পাঠক আমাকে, ভালোই দিতে হয়েছে শ্রম। ক্লাইমেক্সে ঢুকতে তাই হয়তো পাঠককে অপেক্ষা করতে হবে প্রেমিকের মতো।
'১৯৮৪' উপন্যাসের কথা মনে আছে আপনাদের? ঐ যে 'বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ', 'গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে' উপন্যাসে সুহান রিজওয়ান তৈরি করতে পেরেছেন তেমন অস্বস্তি। তাই কখনও সুহান, কখনও কামাল কিংবা নিশাত, মনীষার চরিত্রে ঢুঁকে পাঠক আমি শিখতে চেয়েছি ভয়ের ব্যাকরণ। অবশ্য যখন আড়ালে কেউ রাঙাচ্ছিল চোখ তখন কামালের মতো আমারও ইচ্ছে করেছে ঐ চোখ অন্ধ করে দিতে... গল্প এভাবে পাঠককে ফেলে দেয় জোয়ার-ভাঁটার মাঝে। এসবের মাঝে জলদস্যু হয়ে কোথা থেকে যেন উড়ে আসে সাতকুঁড়িয়ার দল। বিরক্ত করে, আবার খেলে শ্যামের মতো পাশা।
অ্যাডভান্স সময়ের গল্প স্পেকুলেটিভ ফিকশনের মতো করে বলেছেন ঔপন্যাসিক। তবে পাঠকের জন্য স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে, শহরটা ঔপন্যাসিক এঁকেছেন পরিচিত আদলে যদিও বদলে দিয়েছেন ম্যাপ। ফিনিশিং টাচে পেয়েছি চিরায়ত ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসের ফিল আর মুহুর্মুহু মিছিলের মাঝে দেখেছি একজন লেখকের চোখে শহর আর শহরের চোখে লেখকের বদলে যাওয়া। এই হাওয়া বদলের মাঝে ফিরে ফিরে আসে ঋজুশির, ঋজুশির আঁকে কারণ অন্তহীন বেদনার পথে রুদ্ধ হয়ে আছে মানবহৃদয়, ঋজুশির আঁকে কারণ পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত মানুষের স্বপ্ন থেকে যায়, ঋজুশির আঁকে কারণ, বোধির ভেতর ভেসে ভেসে ওঠে শাদা কোন প্রিয় মুখ, ঋজুশির আঁকে কারণ, তাঁকে আঘাত করে শোষকের সুখ, ঋজুশির আঁকে কারণ, সবকিছু পুড়ে হয়ে গেছে ছাই, ঋজুশির আঁকে কারণ, সে জানে একদিন সাম্রাজ্য ফুরায়।
বইয়ের নামঃ গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে লেখকঃ সুহান রিজওয়ান প্রকাশনীঃ বাতিঘর প্রচ্ছদঃ সিপাহী রেজা প্রকাশকালঃ ২০২২ পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৩৫১
শেষ করলাম আমার অন্যতম প্রিয় লেখক - সুহান রিজওয়ানের ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে' । উপন্যাসটি নিয়ে শুরু থেকেই অনেক আগ্রহ ছিল। পোস্ট মর্ডান বা ডিস্টোপিয়ান ধাচে লেখা এক মৃত পৃথিবির গল্প, তেজস্ক্রিয়তায় ধংস্ব হয়ে যাওয়া সমাজের গল্প। ২০৩৮ সালে অজ্ঞাত(?) এক মহাবিস্ফোরণে ধংস্ব হয়ে যায় বাংলাদেশসহ পুরো দক্ষিণ এশিয়া। তেজস্ক্রিয়তা থেকে বেচে যাওয়া দেশগুলো অবরোধের প্রাচীর তুলে দেয়, ফলে মোটাদাগে দুই ভাগ হয়ে যায় পৃথিবি - জীবিত বিশ্ব ও মৃত বিশ্ব। এই মৃত বিশ্বেরই এক অংশ, বাংলাদেশকে নিয়ে লেখা উপন্যাসটি।
গল্পের প্লট এগিয়েছে সুহান রিয়াসাতকে নিয়ে, এক অবরুদ্ধতার সময়ে উপন্যাস লিখতে চায়, এমন এক সময়, যখন একনায়ক ইকবাল খান তার সামান্যতম বিরুদ্ধাচারণ করে কিছু লিখলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিষিদ্ধ(তেজস্ক্রিয়) এলাকায়। সুহান তার নিরাপদ জীবন ছেড়ে শুধু একটা উপন্যাস লিখবে বলে চলে আসে মৃত পৃথিবির নিকৃষ্টতম স্থানে, কিন্তু সে জানে না কেন লিখবে?অনেকদিন পর এসে সে চিনতে পারে না তার প্রিয় ঢাকা শহরকে, তার প্রিয় মানুষদের।
এমনসময় ইকবাল খানের , তথা গোটা সমাজের উপর বীতশ্রদ্ধ্য হয়ে এক ক্ষ্যাপাটে শিল্পী ঢাকার দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকতে থাকে, তার ছদ্মনাম ঋজুশির। সে তার শিল্পের মধ্য দিয়ে বিদ্রুপ করতে থাকে শাসন ব্যবস্থার উপর, রাতের অন্ধকারে সে গ্রাফিতি আঁকে, আর চিঠি লিখতে থাকে তার মৃত বাবার কাছে…………………………
একনায়কের বিরুদ্ধে একসময় সাধারণ মানুষ ফুসে উঠে,নিরপরাধ সন্তানের খুনের বিচার চাইতে এসে এক পিতা কেরোসিন দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় নিজের গায়ে! ইকবাল খান কি টিকে থাকতে পারবে,নাকি এক খান চলে গেলে অন্য খান আসবে ক্ষমতায় - জানতে হলে পড়তে হবে ৩৫১ পৃষ্ঠার নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটি।
সুহান রিজওয়ানের “গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” অনেকটা নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস, ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস হলেও আমার মতে স্যাটায়ার। উপন্যাসটি আসলে ভিন্ন ভিন্ন কয়েকটি সময়ের কথা বলে। কখনো আমরা দেখি সুহান রিয়াসাতকে নিয়ে কাহিনি এগিয়ে যাচ্ছে,২০৬৮ সালের উত্তাল সময়ের গল্প, আবার কখনো ভবিষ্যত থেকে অতীতকে ফিরে দেখা , কখনো তা ঋজুশিরকে নিয়ে লেখা বইয়ের কিছু অংশ, কখনোবা তা কোনো পরীক্ষার প্রশ্ন। আবার এতসব কাহিনীর মধ্যে লেখক খুঁজে চলেছেন কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর - আমরা কেন উপন্যাস পড়ি, কেনই বা লেখক উপন্যাস লিখেন বা লিখতে চান, কেনই বা একজন শিল্পী তার শিল্প সৃষ্টি করেন। উত্তরগুলো লেখক নিজেই দিয়েছেন - অনেকসময় সুহান রিয়াসাতের আত্মোউপলদ্ধির মাধ্যমে, কখনো সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে, কখনো ঋজুশিরের চিঠিতে।আবার লেখক নিজের উপন্যাসকে যেন নিজেই ডিফাইন করেছেন অনেকটা এভাবে, "এসব শুনলে কেন যেন বিশ্বাস হতে চায় না রোবায়েত ভাই! মনে হয় বুঝি কোনো উপন্যাসের ভেতর ঢুকে গেছি। কোনো এক নরকরাজ্য নিয়ে উপন্যাস, কোনো এক ডিস্টোপিয়ান শহরের।"
এগুলো গেল উপন্যাসের দৃষ্টিগ্রাহ্য দিক, অনেকটা টিপ অফ এ আইসবার্গের মতো, এবার কিছু অন্তর্নিহিত দিক দেখার চেষ্টা করি। উপন্যাসটিতে বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে লেখক সূক্ষ্য রসবোধের পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমত ২০৬৮ এর ইকবাল খান আর ১৯৬৮ সালের আইয়ুব খানের মধ্যে কি আমরা মিল দেখতে পারি না? ঘটনাপ্রবাহ অনেকটা একই রকম। এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা, এসেছে আমাদের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ইতিহাস মুছে দেবার কথা। এরপর লেখক জীবিত বিশ্বের সাথে যোগাযোগের জন্য সিড়ি তৈরির যে বর্ণ্না দিয়েছেন, তা বুদ্ধিমান পাঠকমাত্রই বুঝে নিবেন। এছাড়া সাতকুড়িয়া( তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ) , ���ান্তিপ্লাটুন, অনন্তকল্যাণ সংস্থা, মুক্তাঞ্চল উপমাগুলো সত্যিই অসাধারণ !!! সবচেয়ে মজা লেগেছে মুক্তাঞ্চল তথা সোস্যাল মিডিয়া নিয়ে একটা প্যারা, “মুক্তাঞ্চল প্রকৃতপক্ষে, আরেফিনের মনে হয়, চিন্তা বিনিময়ের চেয়েও বড় ভূমিকা পালন করে ক্ষোভ প্রকাশের ক্ষেত্র হিসেবে। যুগে যুগে মানুষের ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে উগরে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে ছাড়া হয়েছে নতুন সব টোপ আর লোকে সে ফাঁদে পা-�� দিয়েছে। ইকবাল খান যা করেছে, তার মধ্যেও তাই কোনো নতুনত্ব নেই……………………………………। রাগ ঝাড়ার জায়গা দিলে লোকে থিতিয়ে যায়, ক্রোধ প্রকাশ করা হয়ে গেলে সত্যিকারের বিদ্রোহ করার ক্ষমতা মানুষের আর থাকে না।”
এককথায় বলতে গেলে,” গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে” উপন্যাসটি অসাধারন লেগেছে। প্লট, ন্যারেটিভ, লেখক যেন তার লেখকসত্তার অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরেছেন পুরো উপন্যাস জুড়ে।
প্রথমেই ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি লেখকের কাছে কারণ বইটা একটি সুন্দর বিদ্যুৎ বার্তার মাধ্যমে তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম প্রকাশের পূর্বে রিভিউ করবার জন্য। আমি চাকরি এবং ব্যক্তিগত জীবনের নানা জটিলতায় পরে ঠিক সময়ে তো বইটি পড়ে শেষ করতে পারিইনি বরং রিভিউ দিচ্ছি কয়েক মাস পরে।
গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে- বইটি সবার জন্য না। এক কথায় এটিই আমার মূল অনুধাবন। আরও গভীরে যেতে হবে যদি দেখতে যাই কেন এটা মনে হলো। লেখার ধরণ, কাহিনীর আবর্তন, চরিত্রের সংলাপ সমস্ত কিছু আম পাঠকের জন্য না যারা শুধুমাত্র আনন্দের জন্য বই পড়ছে, সহজ কিছু খুঁজছে। এই বইটি আমার কাছে সহজের আড়ালে জটিল কিছু যা নিয়ে খুব কম পাঠক আত্মস্থ করতে পারবেন। আমি নিজে যমন বাংলায় কখনো এর আগে ডিসটোপিয়ান তেমন পড়িনি। সাই ফাই এর কিছু বইকে এই জন্রায় ফেলা গেলেও গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে কে আমি নির্ভেজাল ডিস্টোপিয়ান হিসেবে উপভোগ করেছি।
বইয়ের প্রধাণ চরিত্রএর নাম লেখকের নামে হলে একটা কৌতূহল চলে আসে এমনিতেই- ‘আরে! একি তবে আত্মকথন?’ আমি জানি এখানেও অনেকের কাছে সুহান রিজওয়ান এবং সুহান রিসাওয়াত মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। লেখক কিছু কিছু জায়গায় মনে হয়েছে যেন পাঠককে নিয়ে খেলেছেন এই বিষয়টা নিয়ে। যেমন পড়তে গিয়ে আমার মনে যে প্রশ্ন এসেছে তা লেখক নিজেই অনেক জায়গায় প্রশ্ন তুলে নিজেই উত্তর দিয়েছেন।
নিজ পরিচিত স্থানকে ভবিষ্যতে কেমন হবে তা ভেবে আমোদ নেবার ব্যপারটা লেখক এখানে দেখিয়েছেন কিন্তু আপনি আমি যেভাবে দেখতে চাই তাঁর বিপরীতে গিয়ে। এই যে ঢাকা সুহান রিজওয়ানের বইয়ে মায়ার নগরী ঢাকায় মায়া কম, ধোঁয়াশা বেশি। তেজস্ক্রিয়তার হানাহানিতে পঞ্চাশ বছর পরের এ শহর থেকে মুছে যাচ্ছে অণু পরমাণু মানুষ ইতিহাস সমস্ত কিছু। আবেগ যাচ্ছে কি? সম্পর্ক? আমার কাছে একটা জিনিস মনে হয়েছে যে বইয়ের পাতা ওলটানোর সাথে সাথে সুহান ছাড়া আমি সেভাবে কাউকে বেড়ে উঠতে দেখিনা। কিন্তু এছাড়া সমস্ত দিক দিয়ে বইটি অনন্য নানা গুণে। নিয়ন্ত্রণের খেলা যেভাবে দেখানো হয়েছে, মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, রাজনীতি, সমাজ সবকিছু নিয়ন্ত্রক মহলে বন্দী - এটি একটি অনবদ্য সংযোজন। সবচেয়ে ভাল লেগেছে এই মনে করে যে ভবিষ্যতের পর্দায় যেন ক্ষণে ক্ষণেই আমি বর্তমানকে দেখেছি। আমার উচিত ছিল আরও সময় নিয়ে উপন্যাস পড়ে তাকে নিয়ে আরও ভালভাবে নিজের মনের কথা গুছিয়ে প্রকাশ করা দায়িত্ব ছিল কিন্তু কোনভাবেই তা পালন করতে পারলাম না।
বই পড়ার সময় একটা প্রশ্নই বারবার ঘুরেফিরে আসে,লেখক ভবিষ্যতের আড়ালে বর্তমানকে গল্পের মতো সাজালেন নাকি? লেখক গল্প বলেছেন সুহান রিসায়াতের বয়ানে। আবার বা ঋজুশিরের খাতা থেকে, বইয়ের উদ্ধৃতি(বইয়ের ভেতরের বইয়ের),সাক্ষাৎকার বা চিঠিপত্র থেকে।ডিস্টোপিয়া শব্দটা জানা থাকলেও এর মূল অর্থ বোধকরি বইয়ের মাধ্যমে বুঝলাম।কিন্তু আশেপাশের সাথে মিল দেখে দমবন্ধ মতোন লাগছে।বইয়ে সময় হিসেবে লেখক বেছে নিয়েছেন ভবিষ্যতের পৃথিবী। কিন্তু আসলেই কি? এটা কি উপন্যাস? নাকি এক গাদা প্রশ্ন?
ক্ষমতা যার হাতে, ইতিহাসে তার কথাই থাকে।হয়তো সে অনেক কিছু নাই করে দেয়,অনেক কিছু বিকৃত করে দেয়।কারণ কর্তৃপক্ষ ইচ্ছামাফিক সকল কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সে চায় নিজের মতটাই বাকি সকলের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে। বইয়েও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ভেবেছিলাম এর একটা সমাধান পাবো। লেখক অল্পস্বল্প উত্তর দেবেন। উল্টো একগাদা প্রশ্ন দিয়ে গেলেন। হয়তো এটাই উদ্দেশ্য ছিলো লেখকের। আমাদের মনে প্রশ্নের উদ্বেগ সৃষ্টি করা। একালের বাংলাদেশ আর তেজস্ক্রিয় এক বিস্ফোরণে পালটে যাওয়া পৃথিবীর ভূ-রাজনীতির ওই বাংলাদেশের আকার ছাড়া আর কোনো পার্থক্য নেই। শুধু সময়টা এগিয়ে দিয়েছেন,আর উপন্যাসের স্বার্থে মানচিত্র বদলে দিয়েছেন।এই বই লেখার সময়কাল ২০১৯-২০২১।কিন্তু বইয়ের ঘটনাপ্রবাহে এক দশক আগের সময়ের দিকের বিভিন্ন কিন্তু উঠে আসে।সে সামাজিক, রাজনৈতিক বা শিক্ষাঙ্গনের হোক।আবার ২০৬৮ সাল বলে ১৯৬৮ সালের আইয়ুব খানের কথা বললেন না কী!? সেটার ইঙ্গিত তো বইয়েই আছে। আবার একালের আবরারের কথা আছে। শান্তিপ্লাটুন, সাতকুড়িদেরও মিল আছে ইতিহাসের আগের অধ্যায়ের সাথে।
বইয়ের নাম থেকে আন্দাজ করা যায় বইয়ে গ্রাফিতির বড় কোনো ভূমিকা আছে।আসলেও তাই। তবে এতে গ্রাফিতি শিল্প,সাহিত্যের প্রতিকৃতি আর বিরাট একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন। কয়েকটি তুলির আঁচড় শক্তি হয়ে অন্যায়কে বিদ্রুপ করে, অন্যদের প্রশ্ন তুলতে উদ্ভুদ্ধ করে। আর হ্যাঁ, বইটি মনে সামান্য হলেও ভয় ধরিয়ে দেবে। ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য। যদিও কাহিনী এসময়ের, এই শব্দগুলো আরও ভয়ানকভাবে সত্য হয়ে ফিরে আসতে পারে,সেই ভয়। "একটু সেয়ানা না হলে এই জমানায় টেকা খুব কঠিন"-ঠিকই বলেছেন লেখক।। । । 🇧🇩
উপন্যাস শেষ করেই লিখতে বসা কঠিন, বিশেষত এমন উপন্যাস শেষ করে, যেসন উপন্যাস বা গল্প বা জীবনকথা বা অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ আমাদের স্তব্ধবাক করে দেয়, ভাবতে বাধ্য করে, সেসব লেখা পড়েই আবার লিখে ওঠাটা মুশকিল, আবার বিপরীতটাও সমান সত্যি। এমন কিছু শেষ করে মানুষকে না জানানো, নিজের অনুভূতিটা নিজেকে না জানানো পাপ মনে হয়। আজকালকার অসাহিত্যের যুগে, খাপছাড়া এক ধাঁচের লেখার যুগে, ভালো লেখা, সত্যিকারের সাহিত্য বলেও কিছু যে বাংলাদেশে হয়ে চলেছে তা আরো কিছু পাঠক জানুক, নিদেনপক্ষে জানুক কিছু মানুষ। সুহান রিজওয়ান এর সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ পড়ে আমি তাঁর সক্ষমতা বুঝেছিলাম। পদতলে চমকায় মাটির বিষয়বস্তু চমৎকার হলেও আমার অতটা ভালো লাগে নি, একরৈখিক বলেই কি? কে জানে! গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে তে লেখক আমাকে চমকে দিয়েছেন পুরোপুরি। থমকেও দিয়েছেন। আর কোন উপন্যাস বা কোন লেখা না লিখলেও এই একটি উপন্যাসের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিতে পারেন তিনি, এমনটাই মনে হয়েছে। হ্যাঁ, গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে আমার এতটাই ভালো লেগেছে। ভালো লেগেছে কারণ বর্তমানকে নিজের কল্পনা আর ভবিষ্যতের আবরণে এমন স্বাপ্নিকভাবে দেখাতে পারাটা যথেষ্ট মুন্সীয়ানার দাবি রাখে। অরৈখিকভাবে গল্প বলে গেছেন লেখক। কখনো সুহান রিয়াসাতের বয়ানে, কখনো কোন বইয়ের উদ্ধৃতি, কখনো প্রশ্নপত্র, কখনো চিঠি, কখনো কথোপকথন এর মাধ্যমে। কিন্তু উপন্যাসের মূল সুর বজায় রেখে। এতে একটা কোন গল্প নেই, উপন্যাসের যে স্বাভাবিক ধারা বয়ে চ��েছে আমাদের সাহিত্যে, তার চাইতে এটা অন্য ধরনের কিছু। উত্তরাধুনিক -ডিস্টোপিয়ান ঘরানার। সুহান রিয়াসাত কেন লেখেন, কেন কেবল লেখার জন্য ফিরে আসেন তিনি, কেন ঋজুশির ঝুঁকি নিয়ে এঁকে যান গ্রাফিতির পর গ্রাফিতি, কেন নিশাত-মনীষা তেজস্ক্রিয়তা আচ্ছন্ন মৃত বিশ্বে ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়, কী পায় কামালেরা দেশ দেশ করে, কেন বাঁচতে চাই আমরা এসবের উত্তর এক কথায় হয় না। আমরা জীবনব্যাপী খুঁজে চলেছি সবাই তা। " শুভবোধের চরম পরিপন্থী কেউও যদি দখল করে নেয় এই জনপদ, যদি সে আমাদের সমস্ত ভুলিয়ে দিয়ে বিশ্বাস করতে বলে একটিমাত্র সত্যকে, যদি তার ভয়ে আমাদের বিপুল দরিয়ায় ভেসে পড়তে হয় সামান্য ডিঙি নৌকা আশ্রয় করে, যদি সে আমাদের মধ্যে একটার পর একটা অবিশ্বাসের দেয়াল তুলে যায়, যদি সে হয়ে ওঠে ঐশী ক্ষমতার অধিকারী এবং পৃথিবীও পরিত্যাগ করে আমাদের- তবুও আমাদের মুক্তির গান গাইতেই হবে, আমাদের আঁকতেই হবে অবাধ্যতার গ্রাফিতি, আমাদের লিখে যেতেই হবে কোনো উপন্যাস। " আমাদের ভালোবাসতেই হবে, ভালোবাসতেই হবে, বাঁচতেই হবে।
সিম্পসনস নামে একটা জনপ্রিয় কার্টুন আছে। চারদিকে মত আছে এই কার্টুন সিরিজটা মূলত ভবিষ্যত বলে দেয়। এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে দুনিয়ায়, যা ঘটার ও আগে সিম্পসনস দেখিয়ে ফেলেছিলো বা ইঙ্গিত দিয়েছিলো বলা যায়।
যদিও আমি বইটা শেষ করলাম আজ কিন্তু বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২২ এর ও আগে। কিন্তু পড়তে বসলে আপনার বার বার মনে হবে বইটি চব্বিশের জুলাই নিয়ে লেখা। সেই চেনা রক্তের গন্ধ, নির্মমতা, বর্বরতা, অত্যাচার, খুন, তেজী স্লোগান। যেন '২২ এ বসেই লেখক চব্বিশ দেখেছিলেন।
সুবোধ নামক যে গ্রাফিতিটা জনপ্রিয় হয়েছিলো, লেখক মূলত সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখতে বসেছিলেন। কিন্তু সুবোধ'রা থেমে গেলেও লেখকমন থামেনা। তাই বাস্তবের সুবোধ হেরে গেলেও গল্পের সুবোধ হারেনি। লেখক তাকে জিতিয়েছেন। এই হলো স্রষ্টার সুবিধা। তিনি তার সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, চাইলেই জিতিয়ে দিতে পারেন। আমরা পারিনা।
সুহান রিজওয়ান সাহেব ধন্যবাদ পাবেন, এমন অনেক দূরে নিয়ে গিয়েও আমাদেরকে নিয়ে যে আপনি আশা দেখিয়েছিলেন যে আমরা পারবো শেকল ভাঙতে। সেই আশা তো চিন্তার আগেই পূরণ হলো। আপনার অন্তবর্তী সরকার ও আমাদের অন্তবর্তীকালীন সরকার, দুজনই দফা পূরণে আগাচ্ছেন। গল্পের সরকার পেরেছে কিনা জানিনা। আমাদের সরকার পারবে কিনা, তাও জানিনা। থাকুক কিছু প্রশ্ন।
নিঃসন্দেহে বইটা বাংলা সাহিত্যে একটা মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে আমার ধারনা।সুহান রিজওয়ান এক পা দুপা করে সাহিত্যে এক শক্ত পোক্ত জায়গা দখল করে নিচ্ছেন। ইনিকিলাবের ভাষা, তেজস্ক্রিয়তা আর ভবিষ্যতকে আশ্রয় করে লেখক যে মনের ভাষা ব্যক্ত করেছেন বই আকারে, আজ অনেকেই বুকে জমা সেই বিষাদগুলো চাইলেই উগরে দিতে পারছে না। 💙
পরপর তিনটি বই তিন রকমভাবে লেখার জন্য লেখক সাধুবাদ পাবার যোগ্য। তবে এটা পড়তে গিয়ে কখনো কখনো মনে হয়েছে লেখক জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ এর কথা মাথায় নিয়ে লিখেছেন। কৃষণ চন্দরের ‘আমি গাধা বলছি’ ব্যঙ্গত্মক উপন্যাসের লেখার ধরণের সাথেও মিল লেগেছে। তবে শেষ পর্যন্ত লেখাটা মনে দাগ কাটেনি তার অন্য দুই উপন্যাসের মতো।
যথেষ্ট লেখার উপাদান থাকলেও, ভাষা খুবই এলোমেলো, প্লট খুবই অগোছালো এবং সবকিছু মিলে জগাখিচুরি লেগেছে। এক টপিক থেকে আরেক টপিকে ধুম করে চলে যাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারিনি। তারচেয়েও বড় কথা এতো এতো বিষয় এসেছে যে রীতিমত ধৈর্য্য পরীক্ষা দিয়ে পুরো বই পড়ে শেষ করতে হয়েছে।
তরুনীর বাহুর মতো এই আলো, সিনেমার সেটের মতো এই শহর আর ম্যানিকুইনের মতো এই মানুষদের সাক্ষী রেখে তবে কি ইতিহাস ফিরে এসে আজ ঠেলা মেরে সরিয়ে দিচ্ছে বর্তমানকে? জনতার উত্থান আর ইতিহাসের পুনরুত্থান, একনায়কের পতন কি চিরকাল এরাই এনে দিয়েছে?
---------
সুহান রিজওয়ান আমার পছন্দের লেখক। ওনার থেকে ডিস্টোপিয়ান জনরার বই আসছে শুনে খুব আগ্রহ করে বসে ছিলাম। আগ্রহ মিটল, বইটাও ভালো লাগল।
গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে ভবিষ্যৎের এক অরাজক সময়ের গল্প। যেই অরাজক সময়ে স্বৈরশাসক দ্বারা ক্ষুন্ন হয়েছে মানুষের ব্যাক্তিস্বাধীনতা, মানবাধিকার, শিল্পীর শিল্পচর্চায় টানা হয়েছে সীমাবদ্ধতার গন্ডি। সাহিত্যিকরা হারিয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহিত্য চর্চা করার অধিকার। সেই অরাজক সময়ে একজন উপন্যাসিক আরেকজন শিল্পী তাদের মনোজগতের এবং তাদের মনোজগতে প্রভাব ফেলা ডিস্টোপিয়ান শহরের আখ্যান তুলে ধরেছেন সুহান রিজওয়ান।
তমসাময় ভবিষ্যতের যে চিত্র সুহান রিজওয়ান এঁকেছেন সেই চিত্র বর্তমানে আমাদের দেশের পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উপন্যাসে তেজস্ক্রিয়তায় যেমন মানুষের স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। তেমনি বর্তমানেও আমরা আমাদের সঠিক ইতিহাস বিস্মৃত হচ্ছি। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবের মতো মানুষ উবে যায়। কতিপয় সাতকুড়িয়ারাই আমাদের সমাজের মৌলবাদীদের প্রতিনিধি। অনন্তকল্যানসংঘই বোধহয় শেষমেষ আবির্ভাব হবে সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রে। দমনমূলক আইনের প্রতিচ্ছবি হয়ে আমাদের দেশেও রয়েছে তেমন একটি আইন।
আমার মতে সৃজনশীল মানুষ মাত্রই সংবেদনশীল। একজন শিল্পী একজন সাহিত্যিক এই পৃথিবীকে দেখেন নিজ নিজ স্বতন্ত্র নজরে ভিন্ন মাত্রায় ভিন্ন আঙ্গিকে। তাদের কাছে একই পৃথিবী তার রুপ, রস, রঙ, গন্ধ বাস্তবিক মাত্রার সীমা অতিক্রম করে একেকটা সময় ভিন্ন ভিন্ন রুপ নিয়ে ধরা দেয়। সমাজের অসঙ্গতিগুলো তাদের সংবেদনশীল মনে আঘাত করে।
তমসাময় সময়কে ঘিরে একজন সাহিত্যিক ও একজন শিল্পীর মানসিক টানাপোড়েন। তাদের সৃষ্টিশীল স্বত্বার যে দ্বিধা দ্বন্দ্ব এই দ্বিধা দ্বন্দ্বের যাত্রা পেরিয়ে তারা কীভাবে তাদের একেকটি উপলব্ধি অর্জন করেন। নিজের অর্ন্তগত সত্ত্বার সাথে এই দ্বন্দ্ব অনন্য এক মাত্রা নিয়ে ধরা দিয়েছে এই উপন্যাসে। শিল্পী কেনো ছবি আঁকে? একজন উপন্যাসিক কেনো উপন্যাস লেখেন? শিল্পী ও উপন্যাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই উত্তর খোঁজা থেকে শুরু করে একটা সিদ্ধান্তে পৌছানো বা পৌছানোর চেষ্টা অব্দি বিষয়গুলো খুব ভালো লেগেছে আমার। শিল্পী ও সাহিত্যিকের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তাদের সীমাবদ্ধতার অকপট স্বীকারোক্তিগুলো ছিলো আমার জন্য অভিনব এক অভিজ্ঞতা।
কোনো কোনো বই পড়ার অভিজ্ঞতা দারুন। সেই অভিজ্ঞতা পাঠক সত্তাকে আলোড়িত করে পরিতৃপ্ত করে।কিন্তু গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে শুধু পরিতৃপ্তি আর মুগ্ধতার আবেশ জাগায় ���ি। এখানে আমার উপলব্ধি হলো লেখক নিজের সম্পূর্ণটা ঢেলে এই বই লিখেছেন। যে অনুভূতির মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ ক্বচিৎ মেলে।
উপন্যাস টা আমার ভেতরে সারাজীবনের জন্য দাগ কেটে গেলো। সুহান রিয়াসাতের ২০৬৮ সালের ঢাকা কথা বলছে এই বর্তমানের অস্থির ঢাকার। বিগত পাচ দশক কে লেখক বড্ড সুন্দর করে একটি ফ্রেমে ধরেছেন... ফ্রেমের ব্যাকগ্রাউন্ড ২০৬৮...
মনে হলো, চা কফি খেতে খেতে এক জন মানুষের সাথে আড্ডা দিলাম। কোনো চ্যাপ্টার ইতিহাস, কোনো চ্যাপ্টার কারো নোটবুক থেকে, কোনো চ্যাপ্টার অন্য বই থেকে বর্ণিত অধ্যায়, কোনো অধ্যায়ে তৎকালীন সময়ের কিছু তরুণের যাপিত জীবন- পুরোপুরি ফ্র্যাগমেন্টেড করে লেখা।
আমার যাপিত জীবনের বিধ্বস্থ শহর আর অস্থির সময়কালকে এভাবে কালো অক্ষরে এত সুন্দর করে কেউ বাধতে পারবেন, কখনো কল্পনাই করিনি।
লেখকের উপন্যাস টি লিখতে সময় লেগেছে গুনে গুনে দুই বছর প্রায়। উপন্যাসের শেষে নোট দেওয়া দেখলাম।
একটা উপন্যাস কালজয়ী হতে পারে নানা কারনেই। এই বইটি পড়তে পড়তে বর্তমান কে নিয়ে দীর্ঘ ভাবনার জন্ম হয়, অনেক প্রশ্নের জন্ম হয়। তাতে মনে হয় এই উপন্যাস কালজয়ী হতে দেখলে আমি ভীষণ সুখী হবো।
সবশেষে ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসটার শেষ দিকের অক্ষরগুলো ভীষণ বাস্তব হয়ে গেছিলো। ভিন্ন কোনো বাস্তবতার মাঝে ঢুকে গিয়ে চারপাশটা দেখা লাগেনি। কারন এই বাস্তবতাটা আমার নিজের। সুহান রিয়াসাতের আইডেন্টি ক্রাইসিস সমাধানের দীর্ঘ জার্নিটা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প। এই ধুকতে থাকা বিষাক্ত শহরের প্রতিদিনকার গল্প।
লেখককে দাঁড়িয়ে গিয়ে টুপি খুলে সম্মান জানাচ্ছি... হ্যাটস অফ।
একবিংশ শতাব্দীর বিধ্বস্থ এই সময়কালকে এইভাবে অক্ষরবন্দি করাটা কাজে দিয়েছে। নইলে এই একগাদা প্রশ্ন নিজেকে করার প্রয়োজনীয়তাই হয়তো কখনো অনুভব করতাম না।
হোক একটা যত প্রকট ধ্বংসস্তুপ, যতক্ষণ মানুষ সেখানে বেঁচে আছে, যেভাবেই বেঁচে থাকুক, মানব সমাজ ততোক্ষণ শ্বাস ধরে রাখে, মরে না। মানুষের স্বভাবে আছে প্রশ্ন করা, নিজের পরিস্থিতি নিজের পরিবেশ নিয়ে মানুষ কৌতুহলি। নিজেকে সে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে পারে না বলেই অন্যদের দিকে তীর্যক আঙুল তোলে।
যতই সে অসুখে দারিদ্র্যে রাজনৈতিক নিষ্পেষণে কোনঠাসা হোক না কেন, মানুষ এমনকি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও শেষ একটা সুযোগ খোঁজে, যদি বেঁচে থাকা যায়। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকা মানুষ তাই যে কোন সময় ঘুরে দাঁড়াতে পারে, ফুঁসে উঠতে পারে। একটা অকল্পনীয় লড়াইয়ের বীজ তার রক্তে প্রোথিত আছে। সেই লড়াইয়ে ফলাফলের প্রত্যাশা সকলেই করে, কিন্তু আগেভাগে তা নিয়ে অধিকাংশেই ভেবে উঠতে পারে না, হয়ত চায়ও না। তাই ফলাফল সব সময় টিকে থাকার দৌড়ে যারা ধূর্ত ও শক্তিমান, যায় তাদের হাতেই। এ এক নাফুরন্ত চক্র।
আর, এসব তো আমরা জানিও। মানব সমাজ আর নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে যে লোকেই চিন্তা করেছে, সে জানে যে এ নিয়তি মানুষ প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি বয়ে চলেছে।
তাহলে সুহান রিজওয়ান 'গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে' নামের বইটিতে যে রাষ্ট্র ও সমাজ দেখাতে চাইলেন এর চরিত্রগুলোর চোখ দিয়ে, যে সময় ও পটভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছুঁড়ে দিতে চাইলেন অজস্র প্রশ্ন পাঠকের দিকে, এমনকি নিজের দিকেও, সেই প্রশ্নগুলো কি উত্তর খুঁজে পেলো?
গ্রীষ্মের এক মধ্যরাতে যখন আমি শেষ পৃষ্ঠাটা পড়ে ফেললাম, আমার মনে তখন খেলা করছে এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ। উপরের কথাগুলো যেন আমার আঙুল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ওগুলো কীভাবে বলা যেতে পারে, কেনই বা আমাকে এসব বলতে হবে, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
ঠিক এ বইয়ের এক প্রধান চরিত্র সুহান রিয়াসাতের মতই। যে একটা উপন্যাস লিখতে চায়। কেন তাকেই উপন্যাস লিখতে হবে সে জানে না, কিন্তু জানার আগ্রহ তার অপরিসীম। কিংবা সে জানে, আর নিজের এই জ্ঞানের বিষয়ে তার অজ্ঞতা আমাদের চোখে চরিত্রটিকে আরও জীবন্ত ও কাছের করে তোলে।
একটা ডিস্টোপিয়ান জগতে ঘোরাফেরা করে গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে'র চরিত্রগুলো। পারমাণবিক বিস্ফোরনে বদলে গেছে পৃথিবী। তারপর পেরিয়ে গেছে কয়েকটা প্রজন্ম। এর চরিত্রগুলো প্রায় সকলেই সেই বিস্ফোরণ পরবর্তি দ্বিতীয় প্রজন্মের সন্তান। তেজস্ক্রিয়তার আওতামুক্ত জীবিত বিশ্বের সাথে সুহান রিয়াসাতরা বলতে গেলে প্রায় বিচ্ছিন্ন। দেশে স্বৈরশাসন চলে। চারদিক ভরে থাকে ক্ষমতাবান শাসক ও তার চাটুকারে। দৃশ্যমান উন্নয়নের সিঁড়ি উঠতে থাকে বছরের পর বছর, যে সিঁড়ি মৃত বিশ্বের জনগণকে জীবিত বিশ্বে নিয়ে যাবে। আর দেশের ভিতরে থাকে দেয়াল। কালো সেই দেয়ালের ওপাশে কী আছে কেউ জানে না। হয়ত তেজস্ক্রিয়তায় সেখানে টিকে থাকা দায়, নইলে তা সহ্য করে তেজস্ক্রিয়তায় মিউটেটেড অতিমানবের দল সাধারণ মানুষকে মেরে কেটেই খেয়ে নেয়, ঠিক জানা যায় না। কিন্তু সরকার কাউকে তার বিরুদ্ধে উচ্চকন্ঠ কাউকে বা সমালোচকের ভূমিকায় আবিষ্কার করলেই তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেয়ালের ওপাশে। আর এই জগতে বসেই কেউ শ্রমীকদের নিয়ে আন্দোলন করতে চায়, কেউ সব রসাতলে গেল বলে আড্ডায় টেবিল চাপড়ায়, দেয়াল থেকে তেজোস্ক্রিয়তার তেজে বালুর মত ঝরে পড়ে ঘড়ি বা কোসন-বাসন, রাস্তা থেকে সকলের সামনে ঐ ঘড়ির মত উবে যাওয়ার ভয়ে লোকে ব্যবহার করে বিশেষ ধরণের স্প্রে, ওতেও অনেকের শেষরক্ষা হয় না। কেউ লেখালেখি থেকে অবসর নিয়ে নেয় কেন না সরকারের অনুমোদন ছাড়া বই প্রকাশ নিষিদ্ধ। আর এসবের মাঝখানে থেকেই আমাদের মূল চরিত্র লিখতে চায় একটা উপন্যাস। কাকে নিয়ে? এক গ্রাফিতি শিল্পীকে নিয়ে। বদ্ধ গুমোট শহরের দেয়ালে দেয়ালে যার গোপনে আঁকা গ্রাফিতিগুলো বলতে চায় যে সে দেশে মানুষ ভালো নেই, তারা মুক্তি চায়।
গঠনের দিক দিয়ে এই বইকে প্রথমে মনে হতে পারে ফিকশন আর নন-ফিকশনের মিশ্র এক কোলাজ। কাহিনী অংশে সেই ২০৬৮/৬৯ সালের ঢাকা থেকে গল্পগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে কয়েক দশক আগে ও কয়েক দশক পরের ভবিষ্যতে। নন-ফিকশন অংশের সময়কালও একই প্যাটার্ন ফলো করে, এর ফলে যে সময়ের গল্প করা হচ্ছে বইটিতে, তা কীভাবে নির্মিত হয়েছে সে বিষয়টির গ্রাভিটি নির্মাণ হতে থাকে। অতঃপর ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারি লেখক মুছে দেয়ার চেষ্টা করছেন এই দুই ধারার মধ্যিখানে থাকা সীমানাটিকে।
কিছু সমালোচনার যায়গা আছে আমার। এর চরিত্রগুলোর বহুস্বর হয়ে ওঠার চেষ্টায় একটু ভাঁটা ছিল মনে হয়েছে। গল্পাংশের অনেক থ্রেড আছে, যা আরও বিকাশের দাবি রাখে। সে দাবি পূরণ হলে নিশ্চয় চরিত্রগুলোও আরও বহুত্বের দিকে এগিয়ে যেতে পারতো। এটা বোঝা যায় যে মূল চরিত্রের দৃষ্টিসীমার বাইরে লেখক যেতে চান নাই, কিন্তু যাওয়ার সুযোগ ছিল কিনা এ প্রশ্ন আমি করে রাখলাম।
শেষ পর্যন্ত কতটা পারলেন সুহান রিজওয়ান? তার এই বইটি এক যথার্থ উপন্যাস হয়ে উঠল কী না, তা বলার আগে আমার মনে পড়ে যাবে ভি এস নাইপলের আ ওয়ে ইন দা ওয়ার্ল্ডের কথা। যেখানে লেখকের জীবনের এক পালট মুদ্রার সঙ্গে মিলেমিশে যেতে চায় ক্যারিবীয় অঞ্চলে বৃটিশ আর এস্পানিওল সাম্রাজ্যের স্বর্ণনগর খুঁজে ফেরার অভিযান আর শেষে গিয়ে বইটা আমাদের বলতে চায় যে কখনও কখনও পরাজিত মানুষকে অমরত্ব দি��ে পারে শুধুমাত্র তার ঐ হেরে যাওয়ার গল্পটিই।
সব মিলিয়ে তাই মনে হয়, একে এক বিশেষ ধরণের উপন্যাসই বলবো, যেখানে কাহিনীর মাকড়শা জালে জড়িয়েও সুহান সতর্কভাবে সেই জাল থেকে বের হতে চেয়েছেন, উপায় হিসেবে সরাসরি নিজের লেখকীয় জিজ্ঞাসাগুলিকেই ছুঁড়ে দিয়েছেন পাঠকের সামনে। অমোঘ সব প্রশ্ন। যার উত্তর এই কিম্ভূত সমকালে বসে না খুঁজলে আমাদের আর চলে না।
কিন্তু, উত্তর কি লেখক নিজে কিছু আবিষ্কার করতে পারলেন? তা বইটির সম্ভাব্য পাঠকদের জন্য তোলা রইলো।
তমসাময় এক ভবিষ্যৎকে নিয়ে এই কাহিনি। অশুভ এক কর্তৃপক্ষ সেখানে মুছে দিতে চাইছে ইতিহাস। দেয়াল উঠছে বিচ্ছিন্নতার, স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের, তেজস্ক্রিয়তায় উবে যাচ্ছে সমস্ত কিছু। দুনিয়া-বিচ্ছিন্ন ওই জনপদে তবু কেন আইন অমান্য করে দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকে যাচ্ছে কেউ? সুহান রিজওয়ানের নতুন উপন্যাস ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’-র এই হচ্ছে কাহিনিসংক্ষেপ। এতটুকু পড়ে কেউ কেউ ভাবতে পারেন এটা সম্ভবত ভবিষ্যত পৃথিবীকে নিয়ে কল্পবিজ্ঞান গোছের কিছু। লেখকের আগের দুইটি উপন্যাসে মূলত অতীত ও বর্তমানকে ধারণ করা হয়েছে, এবারের উপন্যাস কি তাহলে কল্��বিজ্ঞান বিষয়ে? কিছুদূর পড়ার পর সেই সংশয় ধীরে ধীরে উবে যেতে থাকে। শুরুতেই যে ধাক্কাটি খেতে হয়, এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সুহান রিয়াসাতের নামটা দেখে। লেখকের নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার প্রবণতা যে ইচ্ছাকৃত, সেটা বোঝা যায়। পামুকের উপন্যাসে এই ধরনের ব্যাপার দেখা যায়, সম্ভবত লেখক তা থেকেই প্রেরণা নিয়েছেন। কিন্তু লেখকের নিজের নামটা বারবার চলে আসায় একটু কি অস্বস্তির উদ্রেক হয় না? অবশ্য বইটার সাথে সময় নিয়ে এগুলে বোঝা যায় ইচ্ছাকৃত এই ব্যাপারে সম্ভবত আরেকটা অপ্রকাশিত কারণ আছে। বইটার গড়ন বা নির্মাণকৌশল একটু অন্যরকম। উপন্যাস নিয়ে নানান রকম নিরীক্ষা করেন অনেকেই। খুব সাম্প্রতিক সময়ে শাহাদুজ্জামানের একজন কমলালেবু পড়ার সময় প্রশ্ন করেছিলাম, বইটাকে কি আদৌ উপন্যাস বলা চলে ? তবে চেনা চশমার কাচটা মুছে ফেলে তাকালে আসলে বোঝা উচিত, ঠিক সংলাপ-ডিটেল-চরিত্রচিত্রণের গতানুগতিক ধাঁচের বাইরেও উপন্যাসের অন্য কোনো ধরন থাকতে পারে, অন্য কোনো গড়নে হতে পারে। এই উপন্যাসে যেমন লেখক দিনলিপি ও প্রবন্ধের মধ্যে বলার চেষ্টা করেছেন গল্পটা। সেজন্য উপন্যাসটা ঠিক তরতরিয়ে পড়ার মতো হয়নি। গল্প শোনার সঙ্গে প্রবন্ধের যুক্তির ঝলকটাও তাই চোখ এড়াবে না। উপন্যাসের ধরনের জন্যও বোধকরি এই নিরীক্ষাটা করতে চেয়েছেন লেখক। এমন একটা ভবিষ্যত পৃথিবীর কথা বলতে চেয়েছেন, যেখানে নেই কথা বলার স্বাধীনতা। যেখানে তন্ত্রসাধকেরা আড়ি পাতে গোপন তথ্যের জন্য, যেখানে শান্তিপ্লাটুনের দাপটে সাধারণ মানুষ থাকে তটস্থ। যেখানে স্বৈরশাসক মুছে দিতে চায় বিগত দিনের ইতিহাস। তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণের পর বদলে যাওয়া পৃথিবীর গতিপ্রকৃতি বোঝানোর জন্য তাই দরকার হয় প্রবন্ধের। তাতে স্পষ্ট হয় নতুন পৃথিবীর সংকট, বোঝা যায় ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসে লেখক ঠিক কী বলতে চেয়েছেন। তবে প্রবন্ধে যে সত্য স্পষ্ট হয়, সেটা জোর ধাক্কার মতো নেমে আসে কারও না কারও সুহানের নিজের দিনলিপিতে। বোঝা যায়, লেখক বাস্তব জীবনে তার না বলতে পারা কথাগুলোকে বলাতে চেয়েছেন ভবিষ্যত পৃথিবীতে অন্য এক জাতিস্মরের হাত ধরে। কেন তিনি লেখেন, সেই সত্যের সাথে যুঝতে হয়েছে প্রায় পুরো উপন্যাসেই। প্রেম বা বিরহের মতো অনিবার্যতাও সেই সত্যির সামনে ফিকে হয়ে গেছে। আর এই সত্যিটাকে বলার জন্য মূল নায়ক হয়ে এসেছে গ্রাফিতিশিল্পী ঋজুশির। উপন্যাসের ব্যপ্তি এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তার দিকেই চলে আসে, পরিণতিতেও সমস্ত আলো থাকে তার ওপর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই উপন্যাসটা লেখকের সমস্ত দ্বিধা, প্রশ্ন বা অব্যক্ত কথা প্রকাশ করে অকুন্ঠে। আর সেজন্যই এই প্রশ্নগুলো লেখক নয়, করে গ্রাফিতিও।
পৃথিবীকে আমরা সকলেই নিজেদের চোখ দিয়ে অবলোকন করি প্রতিনিয়ত। সেই পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সকলের ভিন্ন, হয়তো বহুজনের সাথে আমাদের দেখার মিল পাই, তবে তবুও তা কোথাও না কোথাও সেই মিল হোঁচট খেয়ে মতের অমিলটাকেও প্রত্যক্ষ করে তুলে। লেখক সুহান রিজওয়ান তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে রচনা করেছেন একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস। যে উপন্যাসের রচনাকাল ভবিষ্যৎ পৃথিবী, সেই পৃথিবীর মানচিত্র বদলে গিয়েছে তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণের কারণে। আর যে অংশে তা সংঘটিত হয়েছে তা হলো দক্ষিণ এশিয়া, সাতটি দেশের মানচিত্র নাম সব পাল্টে গিয়েছে। পৃথিবী দুইভাগ বিভক্ত একটি হলো জীবিতবিশ্ব অর্থাৎ যে অংশগুলোই তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়নি আর অন্য দিকে যে অংশতে বিস্ফোরণ হয়েছে তাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে মৃতবিশ্ব বলে। এইসবের মধ্যে অরাজকতা ছড়িয়ে আছে সমস্ত মৃতবিশ্ব জুড়ে। বাংলাদেশের মধ্যেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। একনায়কতন্ত্রের আগ্রাসনে মানুষ যেমন নাজেহাল তার মাঝেই কিছু তরুণ ছুটে চলে দেশকে থাবা থেকে রক্ষা করতে, বিপরীতে আছে আগ্রাসী থাবা! আমাদের গল্পের নায়ক দেশে এসেছে দেশকে নিয়ে লিখবে বলে, সমস্ত অরাজকতার বিরুদ্ধে কলম সোচ্চার করবে বলে। কারণ তার দেশে আজ শিল্পের পাশে শেকল বেঁধে দিয়েছে কেউ একজন! যেখানে শিল্পী নিজের মত প্রকাশ করলে তাকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে অজ্ঞাত অঞ্চলে। লেখকের কলম থেমে গিয়েছে ভয়ে। আর তার মাঝেই উত্থান ঘটে আমাদের আমাদের আরেকজন শিল্পীর যে তার শিল্পকলাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এসেছে, বলতে এসেছে শিল্পীর না বলা কথাগুলো নিয়ে বলতে, প্রশ্ন করতে, জনতাকে পথ দেখাতে। লোকে তাকে চিনে ঋজুশির নামে। তার ভাষা হলো গ্রাফিতি, সে গ্রাফিতি দিয়েই তার সত্তার প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে। আর তাকে নিয়েই গল্প ফাঁদতে চান আমাদের প্রথম নায়ক সুহান রিয়াসাত। কোথায় এর শেষ? নরকের মাঝে ফুল যারা ফোটাতে আজ উদ্ধত তাদের কী ভুলে যাবে সময়? কিংবা ফিরোজ কামালের মতো জনকল্যাণমুখী মানুষের স্থানই বা কোন নরকে! বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস মুছে সরকার সূচনা করেছে নূতন ইতিহাসের। অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণের পর ক্ষমতার হাল ধরে ইকবাল খান তার রাজ্যকে নিজের ইতিহাস দ্বারা গড়তে তৎপর।
"গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে" বইটি মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে আমার নিজের ব্যক্তিসত্তাকে বারবার প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে। সাদা পৃষ্ঠা থেকে কালিতে ছাপা অক্ষরগুলো উঠে এসে আমার মনকে বারবার জর্জরিত করেছে বহু প্রশ্নে। সব প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছি কী পাইনি তার হিসেবে যাবো না, তবে এমন বইগুলো নিজের ভিতর প্রচন্ড উত্তাল স্রোতের সৃষ্টি করে। লেখক, সুহান রিয়াসাতের হয়ে কিংবা ঋজুশিরের মতো শিল্পী হয়ে তাদের জবানিতে তাদের ভাষায় যে চিন্তাধারা ব্যাপ্ত করেছেন সেসব প্রশ্ন নিশ্চই নিজের ভিতরের লেখক কিংবা শিল��পী সত্তার ভাষা। একজন লেখক লিখতে গিয়ে যে পরিস্থিতির মধ্যে যায় তার ধারণা পাঠকদের হয়তো থাকে না। সেসব ধারণা, দোদুল্যমান চিন্তা যে লেখককে প্রতিনিয়ত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। একটা লাইন কিংবা একটা শব্দও যে কতটা শক্তি ধারণ করে তা লেখক নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়ে পাঠককে বোঝান। সেইরকম চিন্তাভাবনা শিল্পীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যখন একটি রাষ্ট্রে লেখক কিংবা শিল্পীর পায়ে বেড়ি দেওয়া হয় তখন সেই রাষ্ট্র এক তমসাচ্ছন্ন সময়ের ভিতর দিয়ে গমন করে। শিল্পীরা তখন হয়ে ভিন্নমতের অধিকারী। সবচেয়ে বড় কথা লেখক ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ে লিখলেও কোথাও যেন মিল খুঁজে পাওয়া যায় বর্তমানের। আর লেখকের কল্পনায় রচিত সেই ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসের পৃথিবীকে কল্পনা করে শিউরে উঠতে হয়। তখন দরকার হয় বারুদের সলতেতে আগুন দেওয়ার জন্য ঋজুশিরের মত কেউ একজনকে। যার মস্তক চির উন্নত, অবক্র। আবারও বলি ঋজুশির আর সুহান রিয়াসাতের দ্বৈরথ যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে তার শেষ কোথায় তা আমি জানি না! হয়তো খেয়ালের ফাঁক গলে কখনো কখনো সেই প্রশ্নগুলো উঁকি দিয়ে উত্তর খুঁজবে, নয়তো বা বিষন্ন বিকালে অন্য কোনো বই পড়তে পড়তে উত্তর খুঁজে পাবো লেখক আমার সত্তাকে যেসব প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন তার।
একদিকে জীবিত বিশ্ব আর অন্যদিকে মৃত, চারদিকে মুমূর্ষু সময়, অন্তরীণ স্বাধীনতা আর যন্ত্রণাকর অস্তিত্ব। একজন লেখকের যাত্রাপথ তাই ক্রমশ কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠছে। এর ভেতরেও লেখককে সামনে যাবার চেষ্টা করতে হয়, নিজের জন্যই, কেননা ওই তাঁর কাজ, নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া। গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস। আমাদের সাহিত্যে ডিস্টোপিয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো সময় হয়তো ছিলনা। কিন্তু কেবল ডিস্টোপিয়ান কি? নাকি এই উপন্যাস মূলত লেখকের সংগ্রামের একটা গল্প? কিংবা কী করে একজন শিল্পী একটা অথরেটেরিয়ান রেজিম এর চেয়ে বেশি শক্তি রাখেন, গল্পটা সেই ঘটনার? নাকি এই গল্প মূলত আমাদের দুর্ভাগ্যের, যে দুর্ভাগ্য আমরা বহন করে চলেছি এই মৃত বিশ্বের কানা গলিতে গলিতে? এই উপাখ্যান বলবার জন্য ন্যারেটিভ টেকনিকে যে রঙীন কালাইডোস্কোপ লেখক তৈরি করেছেন, সেটা দুর্দান্ত এবং সম্ভবত যে কোন পাঠকের জন্যই আকর্ষণীয়। লেখক সুহান রিজওয়ানকে অভিবাদন এবং ভবিষ্যতের জন্য নিরন্তর শুভকামনা।
‘গ্রাপ্রক’ এমনই এক উপন্যাস যা চাইলেই আপনাকে আমি পড়তে বলতে পারি না। মনঃক্ষুণ্ণ হবেন না। এমন উপন্যাস সব ক্যাটাগরির পাঠকদের উদ্দেশ্য করে লেখাও হয় না। তবে আপনি যদি অনুসন্ধিৎসু পাঠক হয়ে থাকেন—প্লিজ বাই অ্যান্ড রিড ইট। কেন পড়তে দিতে পারি না—সেই কারণ হিসেবে আমি দুটো বিষয় উল্লেখ করছি। ১। এটি ডিস্টোপিয়ান ঘরনার হলেও ঘরনার দিক থেকে মিশ্র। অর্থাৎ এখানে লেখক শুধু ফিকশন আকারে গল্প লিখেননি, লিখেছেন, বলা ভালো দেখানোর চেষ্টা করেছেন নন-ফিকশনের দিকটাও। গল্পের সাথে সাথে এখানে রয়েছে বিভিন্ন মন্তব্য—যা কাহিনির আবহে নতুন রূপরেখা সৃষ্টি করবে। পড়তে হয়তো বিরক্তি আসবে। একটুখানি সময় নিবে আপনার চিন্তাকে নিয়ে খেলা করতে অথবা বলা চলে ‘মগজ ধোলাই’ করতে। মাঝে মাঝে মনে হবে, এই বই পড়ে বা এতকিছু জেনে আদতে লাভ কী? ২। গল্পটিতে লেখক এমন কিছু প্রশ্নের অবতারণা করেছেন, যার কিছু উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন, আর কিছু পাঠকদের জন্য ছেড়ে গিয়েছেন। এমনকি সেটা ফিকশন ও নন-ফিকশন; দুইভাবেই। লেখক এই উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে যা আপনাকে বলতে আর দেখাতে চেয়েছেন, তা যদি আপনি উপলব্ধি করতে না পারেন, তবে পুরো সময়টা বৃথা মনে হবে। তাই বি কেয়ারফুল।
—‘গ্রাপ্রক’ উপন্যাসের সবকিছুই নিয়ে একটু আলোচনা করতে চেষ্টা করব। বিরক্ত হলে এড়িয়ে যেতে পারেন।
শুরুতে আমি কাহিনির চরিত্রায়ন নিয়ে কথা বলব। গল্পে বেশকিছু চরিত্রের সাথে লেখক আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—সুহান রিয়াসাত, আরেফিনুল হক, ফিরোজ কামাল, মনজুর, মনীষা, নিশাত প্রমুখ। বেশ কয়েক পুরুষ চরিত্রের ভিড়ে দুটি নারী চরিত্র এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অনেকের পাঠকের কাছে এই দুই নারী চরিত্রের অবস্থান বা সংযুক্তি বাহুল্য মনে হতেই পারে। তবে উপন্যাসের বাস্তবতা অনুভব করতে চাইলে এই দুই চরিত্রের প্রয়োজনীয়তা শতভাগ সত্য। যেহেতু গল্পটি ভবিষ্যৎ সময়ের তার ওপর ডিস্টোপিয়া ঘরনার; সেদিক থেকে চিন্তা করলে উপন্যাসটি বর্তমান সময়কে কেন্দ্র করেই লেখা বা ভবিষ্যতে কী হতে পারে—তারই একটি চিত্র লেখক আমাদের মানসপটে প্রদর্শন করেছেন। এর পিছনে কারণ হিসেবে বলব, আমাদের (পুরুষ) সকলের জীবনে এক বা একাধিক নারী কোনো না কোনোভাবে জড়িত থাকে। সম্পর্কে তারা ভিন্ন হতে পারে। তাই বলে কারও অবদান কম বা ছুড়ে ফেলে দেওয়ার মতো না। একটু চিন্তা করুন, আপনার জীবনে এই পর্যন্ত যত জন নারী এসেছে, তারা কি আপনার স্বাভাবিক কিংবা অগোছালো জীবনে কোনো প্রভাব ফেলেনি? কেউ হয়তো আপনাকে দুঃখে জর্জরিত করেছে, কেউ ভালোবেসেছে, কেউ বা বিশ্বাসঘাতকতার সহিত বিদায় নিয়েছে। প্রত্যেক নারী আপনার জীবনকে অল্পবিস্তর উপকার-ক্ষতি করার প্রয়াস নিশ্চয়ই করেছে। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে ‘গ্রাপ্রক’ উপন্যাসেও এই নারী চরিত্রদের দ্বারা লেখক আসল বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। যার কেন্দ্রে রয়েছে কেবলই—ভালোবাসা। অবশ্যই, পৃথিবীতে যত যা-ই কিছু ঘটে তার কেন্দ্রবিন্দুতে এই ভালোবাসার অনুভূতি খুঁজে পাওয়া যায়। হোক সেটা মানুষ বা বস্তুর। কেউ মানুষকে ভালোবাসে, কেউ বা যন্ত্রকে, কেউ বা তার কাজকে, কেউ বা নিজেকে। যাহোক, লেখক মনীষা আর নিশাত চরিত্র দিয়ে পুরো সংগ্রামের এমন এক অংশকে প্রস্ফুটিত করেছেন, যা নিত্যনৈমিত্তিক রূপে ঘটে থাকে হরহামেশাই। পূর্বেও এর প্রচলন ছিল, বর্তমানেও রয়েছে। যারা সংগ্রামী মনোভাব বা পরিবর্তনের সংজ্ঞার সাথে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে নিয়েছেন বা নিচ্ছেন; তাদের এমন এক বাধা ও ভালোবাসার সম্মুখীন হতে হয় যা—আপনার সংগ্রামী চেতনাকে হয়তো বৃহৎ করবে নাহয় চিরকালের মতো বিনাশ।
বাকি চরিত্রদের নিয়ে আলোচনা করার বিস্তর দিক থাকলেও এ মুহূর্তে করার প্রয়োজন বোধ করছি না। কখনও যদি বইটি পড়েন, তবে নিজ থেকে বুঝে নিতে পারবেন কোন চরিত্র কেন এসেছে। তবে সুহান রিয়াসাত, অর্থাৎ লেখক নিজেই হয়তো নিজেকে—নিজ উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে কল্পনা করেছেন। এবং সেটাকে যে খুব নায়কোচিতভাবে উপস্থাপন করেছেন এমনও না। বরং বাস্তবতা ঘেঁষে কীভাবে চলতে হয় তা-ই দেখানোর চেষ্টা করেছেন অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে। এমনকি আপনার নিজেই পড়াকালীন সময় মনে হবে, ‘আরেহ, এই চরিত্র আদতে করতে চাইছে কী? এমন লাইফলেস ক্যান? কাপুরুষের তো একটা সীমা থাকে ভাই।’ এই একটি চরিত্রকে নিজের মধ্যে ধারণ করে অদৃশ্য বাক্য বিনিময় করা—এটাও ‘গ্রাপ্রক’ উপন্যাসের সার্থকতা। পুরো উপন্যাস জুড়ে এই সুহান চরিত্রটি যে কয়েকটি প্রশ্নের খাদের কাছাকাছি নিজেকে দাঁড়া করিয়েছে, তা থেকে শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরতে পেরেছে কি না; তা না-ই বা বলি। তবে যেসব প্রশ্নের উত্থাপন তার মাধ্যমে করা হয়েছে, তা খুবই যথোচিত। এর মধ্যে একটা প্রশ্ন হচ্ছে, অবশ্য সব লেখকদের হয়তো তিনি এই উপন্যাসের দরুন প্রশ্নটা করেছেন যে—আপনি উপন্যাস কেন লিখতে চান?
শুরুর দিকে আমি যা বলেছি, সেটার পুনরাবৃত্তি আবারও করছি। এই উপন্যাস চাইলে যেমন পড়তে পারেন না, কারণ, রুচির দিক থেকে এই উপন্যাস আপনার মস্তিষ্কে সংগ্রামী বীজ আর বাস্তবতার কালো থাবা ব্যতীত কিছুই দিবে না। যে অবস্থায় আমরা প্রতিনিয়ত ভুগে যাচ্ছি। পাঠক বই পড়ে শান্তি আর আনন্দের জন্য, সেখানে অত চিন্তা-ভাবনা করে মাথাব্যথা করত কে চাইবে বলুন? আপনি নিশ্চয় না? তেমনই সব লেখক এমন ধরনের উপন্যাস লিখতে ঠিক অভ্যস্ত যেমন না, আবার ইচ্ছা হয়তো তাদের তেমন একটা করে না। সংগ্রামী উপন্যাস বা দেশের শ্রাদ্ধ করতে হয়তো অনেক থ্রিলার উপন্যাস লেখা হয় ঠিক; কিন্তু সেগুলো অবস্থাগত কোনো পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে হয় না। ‘গ্রাপ্রক’ ধরনের উপন্যাস এক্ষেত্রে কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে। তবে শুধুমাত্র পাঠকদের উদ্দেশ্য করে এই বই লেখা হয়ে থাকলে বিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। যাদের উদ্দেশ্য করে উপন্যাসের বাক্যগুলো ব্যয় করা, তারা কতটুকু এমন উপন্যাস পড়ছে—সেটাই মূল প্রশ্ন। পাঠক হিসেবে যদি ভাবেন আপনি এখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক আগ্রাসী সংগ্রাম দেখবেন, ভালোবাসার বিপক্ষে বিচ্ছেদের গল্প জানবেন কিংবা মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলবেন; তেমনটা এখানে লেখা হয়নি। প্রতিটি বিষয়কে লেখক নিজ বুদ্ধি আর বিবেক দিয়ে বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে সেগুলো অতি জ্ঞানগর্ভ বা অযাচিত মনে হলেও সত্যতা এতটুকু ক্ষয়ে যায়নি। তেমনই সবার মনন ও মগজে এমন কিছু প্রকট ধাক্কা দিয়ে চিন্তা-ভাবনা পালটে দেওয়ার মতো দুর্দান্ত কোনো কার্য সিদ্ধি করবে তা-ও না।
‘গ্রাপ্রক’—যা উপেক্ষা করা যায় না তেমন একটি উপন্যাস। এখানে তমসাময় এক ভবিষ্যতের চিত্র দেখানো হয়েছে। যেখানে অশুভ এক কর্তৃপক্ষ মুছে দিতে চাইছে পূর্বের সব ইতিহাস। পুরো পৃথিবী হয়েছে দ্বিখণ্ডিত। সেই খণ্ডেরও খণ্ড করতে চলেছে সেই শক্তি। দেওয়াল তুলে দিচ্ছে বিচ্ছিন্নতার। মহাবিস্ফোরণের তেজস্ত্রিয়তার কারণে স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের। উবে যাচ্ছে সমস্ত কিছু। দুনিয়া-বিচ্ছিন্ন জনপদে তবু কেন আইন অমান্য করে দেওয়ালে গ্রাফিতি এঁকে যাচ্ছে কেউ?
বইটি গ্রাফিতি নিয়ে হলেও রূপকধর্মী নানান দিক উঠে এসেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। গল্পে যে তেজস্ত্রিয়তার কথা উল্লেখ রয়েছে সেটা মনে করিয়ে দেয় চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয়ের কথা। যে সময়টা পুঁজি করে লেখক উপন্যাসের প্রেক্ষাপট সাজিয়েছেন তা যেন আমাদের অতি পরিচিত উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে ফুটে উঠেছে আমাদের চেনা-পরিচিত সেইসব মানুষরা, যারা সংগ্রামী, চিন্তাশীল আর ভাবুক। পুরো প্রেক্ষাপট হিসেবে লেখক নির্বাচন করেছেন ভবিষ্যৎ ঢাকাকে। যা বিপর্যয়ের পরবর্তী রূপে তুলে ধরেছেন। ২০৬৮ সালের ঢাকার এক মানচিত্র লেখক বইযের শুরুর দিকে দিয়েছেন দুটি অঞ্চলের পরিচয় দেওয়ার জন্য। মুক্তাঞ্চল ও অজ্ঞাত অঞ্চল। এই দুই অঞ্চলের বিশেষত্ব নিয়ে আপনার কৌতূহল কিঞ্চিৎ জাগতেই পারে। পুরো ঢাকাকে লেখকের দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার যদি লোভ জাগে, তাহলে পড়ুন বইটি। কেমন হতে পারে ভবিষ্যৎ রাজধানী। অথবা কল্পনার পটে আঁকতে পারেন উনসত্তরের গ্রাফিতি।
ডিস্টোপিয়া, অনেকটা কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসি ঘরনার প্রতিনিধিত্ব করে। সেখানে যেমন কল্পবিজ্ঞানের একটি ধারাকে উপস্থিত করানো হয়, তেমনই ফ্যান্টাসির মতো নিজস্বতা তৈরি করা প্রয়োজন। খুব কঠিন কাজ। সূক্ষ্ম আর বাস্তবিকতার মিশেলে এই জগতে উন্মোচিত করা হয় সত্যকে। পাঠক এমন সব কাহিনিতে বিস্তর এস্টার এগ অনায়াসে খুঁজে পাবে। লেখক উক্ত উপন্যাসে জনগণের ওপর নজর রাখতে যে কালো জাদুর প্রক্রিয়াটা দেখিয়েছেন তা খুবই বুদ্ধিদীপ্ত। ওই জাদু বা প্রেতাত্মা ধারা কী বুঝিয়েছেন তা বুঝলে যতটুকু ভালো লাগবে, ততটুকু চিন্তা ঘিরে ধরবে। বর্তমানেও আমাদের ওপর তেমনই এক জাদুর জাল বিছিয়ে রেখেছে। যা আমরা জানি, কিন্তু জেনেও সেই সীমাবদ্ধতার জালে জড়িয়ে পড়ি। দেহকে হয়তো আটকে রাখা যায় কিন্তু চিন্তা-চেতনা, আবেগ, অনুভূতিকে কখনোই না। উক্ত উপন্যাসে তেমনই এক বার্তা লেখক দিতে চেয়েছেন আমাদের। উন্নতির কলা ঝুলিয়ে যে অপেক্ষার কারসাজি কর্তৃপক্ষ বছরের পর করিয়ে যাচ্ছে; তা-ও মিলিয়ে দিয়েছেন সিঁড়ি নামক প্রকল্পের সাথে। প্রতিটা বিষয়কে বেশ গভীর পর্যবেক্ষণ করেছেন লেখক। এবং সেটার যথাযথ প্রয়োগই ‘গ্রাপ্রক’। বইটি অনেক পাঠক নিকট স্যাটায়ার ধরনের মনে হতে পারে, তবে তেমন কিছু আমি অনুভব করিনি। বরং তিক্ত সত্যকে, ছদ্মবেশে পরিচয় করিয়েছেন আমাদের সাথে। যা শুধুমাত্র শক্তিশালী আর সাহসী লেখক দ্বারা সম্ভব। সাহিত্য এখানে বিদ্রোহী আর সাদা-কালো ক্যানভাসে রাঙানো। যার প্রতিটি পদক্ষেপ আপনার চিন্তাকে তাড়িত করতে সক্ষম।
কাহিনির গভীরতা বোঝাতে লেখক ‘মহাভারত’-এর শকুন্তলা ও হিড়িম্বা রাক্ষসী নিয়ে যে গল্প বলেছেন, তা ওই মনীষা আর নিশাতের অবস্থানের সাথে অনেকাংশ মিলে যায়। এছাড়া উঠে এসেছে বিক্রমাদিত্য ও বেতালের প্রশ্ন-উত্তরের মতা লেখকের নিজস্ব ফাঁদানো গল্প। যেখানে তিনি এমন একটি গল্প পাঠকদের জন্য লিখেন, যার উত্তর শুধু পাঠকই দিবে। এছাড়া ভবিষ্যৎ বিসিএস বা পরীক্ষার প্রশ্ন ধরনের অধ্যায় লিখেছেন বর্তমান অবস্থা নিয়ে। একটি উপন্যাসে কত ধরনের লিখনপদ্ধতি আপনি আশা করেন? উত্তমপুরুষ, মধ্যম পুরুষ, বাক্যের সৌন্দর্য, মনশ্চক্ষুতে উপভোগ করার মতো বর্ণনা, সংলাপের বাস্তব প্রয়োগ, পত্রিকার কলাম লেখা, ব্যক্তিগত চিঠি, প্রশ্নের ধরন, দার্শনিক আলাপন, ভালোবাসার সংজ্ঞা—অর্থাৎ কী নেই এই উপন্যাসের ভেতরে। তার ওপর এতকিছু সামাল দেওয়ার একটা প্রশ্ন তো থেকেই যায়। বর্ণনার কিছু আধিক্য কিছুটা ভ্রুকুঞ্চন ঘটাতে পারে, মাঝে মাঝে পড়ার অনিচ্ছাও জাগাতে পারে। তবে ধৈর্য ধরে পুরোটা শেষ করতে পারলে একটা গ্রহণযোগ্য সমাপ্তিতে হয়তো পৌঁছানো সম্ভব। কারণ উপন্যাস তা-ই বলে। এই লেখা যেন শেষ হয়েও হয়নি। এটিকে আপনি অসম্পূর্ণ একটি কাহিনি হিসেবে ধরতে পারেন। গ্রাফিতি আঁকা ঋজুশিরকে নিয়ে যে আলোড়ন আর সুহানের ভাবনার যে প্রসারণ—তা কোথাও গিয়ে যেন থমকে যায়। আদতে যে প্রশ্নের উত্তরের প্রয়োজনীতা বেশি ছিল; সেটারই উত্তর আর পাঠকদের পাওয়া হলো না। মোদ্দা কথা, পাঠক একটা সমাপ্তিতে পৌঁছাতে পছন্দ করে। কিন্তু পুরো উপন্যাস যেখানে প্রশ্নের ডালপালা দিয়ে জর্জরিত সেখানে এমন অসমাপ্ত বাতুলতা কিছুটা অসহনীয়।
লেখকের ‘গ্রাপ্রক’ উপন্যাসটি ঠিক কোথায় গিয়ে যেন এরিক আর্থার ব্লেয়ার ওরফে জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যা বিংশ শতাব্দির শ্রেষ্ট বই হিসেবে আজও বিবেচিত। ডিস্টোপিয়ান বইগুলো যে কতটা বাস্তবতা ঘেঁষা তা শুধুমাত্র পড়ার পরেই উপলব্ধি করা যায়। তার ওপর এমন লেখা যখন কোনো শক্তিশালী লেখক লিখেন; তখন সেটা নিয়ে আলোচনা করা কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। ‘গ্রাপ্রক’ সেই সব ধরনের তালিকায় উত্তীর্ণ অবশ্যই হয়েছে। কিছু লেখা হয়তো হারিয়ে যাবে কালের স্রোতে আর কিছু টিকে থাকবে ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ হয়ে। যদি আপনি কিছুটা সংগ্রামী ভাবনার, দেশের পরিস্থিতি আর ভবিষ্যৎ পৃথিবীর সংকটপূর্ণ অবস্থান সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তবে এই উপন্যাস পড়ে দেখার অনুরোধ রইল। সাহিত্য কী, আর কীভাবে সেটাকে ব্যক্ত করতে হয় তার বড়ো প্রমাণ ‘গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে’।
বাতিঘরের বই সিলেকশন দুর্দান্ত। তাদের কনটেন্ট নিয়ে আপস করতে দেখিনি। সাধারণত এই ধরনের উপন্যাস খুব কম লেখকই ছাপাতে আগ্রহী হবেন। তার ওপর আলাদা ���কটা ঝুঁকি তো অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করা এমন লেখার প্রচার আরও বেশি হওয়া দরকার বলে মনে করি। প্রেমে ব্যর্থ, পারিবারিক অশান্তি, খু নে র রহস্য উদ্ধার, দুনিয়া বাঁচানো উদ্যোগ, রহস্য সমাধান, ভূত-প্রেতের বাইরে বাস্তবতা বলতে যে একটা বিষয় আছে তা আমাদের পাঠকরা ভুলে যেতে বসেছে প্রায়। এমন ধরনের উপন্যাসের দিকে আগ্রহ প্রকাশ করা উচিত। তার জন্য প্রয়োজনে সহজ লেখা পড়ে আশ্বস্ত হওয়া। ডিস্টোপিয়া ঘরনাকে আমি বাস্তবতার ছায়া অথবা সত্য দেখানো আয়না মনে করি। সেখানে এমন নৈরাজ্যর চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়; যেখানে আমরা বসবাস করছি।
৩৫১ পৃষ্ঠা বইটির মুদ্রিত মূল্য ৬০০ টাকা। প্রোডাকশন নিয়ে আলাদা কিছু বলার নয়। আমি কনটেন্টে বিশ্বাসী। কনটেন্ট ভালো হলে অর্থ দিয়ে সেটা কিনে পড়তে খারাপ কখনোই লাগে না। আর এমন বইয়ের কনটেন্ট অনুযায়ী মুদ্রিত মূল্য একেবারে সাধ্যের মধ্যে।
এ বইটা আমাকে বেশ ভালোই ধাক্কা দিয়েছে। তার মূল কারণ হচ্ছে চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক দিক গুলো। গ্রাফিতির ঋজুশি, নিশাতের আক্ষেপ, মনীষার অপেক্ষা কিংবা সুহানের উপন্যাস লেখা আবার স্বৈরশাসক ইকবাল খান ক্ষমতার দাপটে মৃত বিশ্বকে লুকিয়ে রাখছে দেয়াল নির্মানের আড়ালে। তেজস্ক্রিয় বিস্ফোরণের পরে সবকিছু যেখানে থমকে গেছে সেখান থেকেই বইটার শুরু। লেখকের লেখনশৈলী অন্যরকমের লেগেছিলো। বলা যায় প্রথমদিকে মোটামুটি ভালোই বেগ পেতে হয়েছে আর এর কারণ হয়তো আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা!
আজকের আমাদের এই ঢাকা নয়, ঠিক এই সময় থেকে প্রায় ৫০ বছর পরের ঢাকা। সময়ের সাথে সাথে সেই ৫০ বছর পরের ঢাকাতে রয়েছে নানা পরিবর্তন, এই ঢাকারই অন্য এক রূপ উপস্থাপিত হয়েছে। তেজস্ক্রিয় মহাবিস্ফোরণের পরের কোন এক ঢাকার গল্প লেখক এখানে বলেছেন কিন্তু তা আসলে আমাদের আজকেরই এই ঢাকারই কাহিনি ।
লেখক মূলত এই সময়ের সাথে নানা অনুষঙ্গ ও উপকরণ মিশিয়ে এক নতুন ঢাকাকে তুলে ধরেছেন। যাতে রয়েছে একটা সময়ের গল্প, ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ও চরিত্রকে নিয়ে কাহিনির ক্রমবিকাশ। সময়ের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তকে লেখক ভবিষ্যতের ভাবনাতে তুলেধরেছেন। আর সেই গল্পটা শুরু হয়েছে সিরিজে আঁকা কিছু গ্রাফিতি নিয়ে। 'ঋজুশির' নামে অজ্ঞাত কোনো এক শিল্পির আঁকা গ্রাফিতি, যা কোন নিদিষ্ট একটা সময়ের পরিচয় দেয়। আইন অমান্য করে আঁকা এই গ্রাফিতি যা লেখক নতুন ভাবে কাহিনি সাজিয়ে তুলেছেন বর্তমানের আলোকে। ঘটনার দ্বান্দ্বিকতা বা জটিল তাত্ত্বিক আলোচনা নাই এই উপন্যাসে তবে আত্মোপলব্ধির প্রকাশ করেছেন চরিত্রের মাধ্যমে।
বইটা পড়তে গিয়ে কখনই ভুলে গেলে চলবে না যে ভবিষ্যতের ঢাকার কাহিনি এটা। লেখক সুহান রিজওয়ানের 'গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে' উপন্যাসে সুহান রিয়াসাত এর হাত ধরে ভবিষ্যতের এক ঢাকাকে চিনবে পাঠক।
খুব কম লেখা আছে, যা পড়ে এতটা অভিভূত হওয়া যায়, বা হয়েছি।
একই বই যখন একই সাথে ডিস্টোপিয়ান, ফিকশন, নন-ফিকশন, পোস্ট মর্ডান, স্যাটায়ার, প্রতীকী বা রূপকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন তাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, আমার ঠিক জানা নেই। নিঃসন্দেহে গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে বাংলা সাহিত্যে একটা মাইলফলক টাইপের লেখা। এবং অবশ্যই, সাহসী লেখা। হয়তো আগামী ৫০ বছর পরে এই বই শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসির মত ক্লাসিক হয়ে দাঁড়াবে। আজকের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে সরকারকে নিয়ে, বাকস্বাধীনতার অধিকার নিয়ে কেউ এভাবে লিখতে পারছে বা পারবে বলে মনে হয় না। একটু চালাকির আশ্রয় নিয়ে ভবিষ্যতে টাইমলাইন সেট করলেও সব ঘটনাই যে আজকের বাংলাদেশের, তা সচেতন পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন। কিংবা, এটা শুধু আজকের বাংলাদেশ নয়, অতীতের, বর্তমানের, আর ভবিষ্যতের বাংলাদেশ এখানে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
"কিন্তু সত্যিই কি একজন নৃপতিকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলা যায়? বরং যতই চিন্তা করা যাক গভীরভাবে, আমাদের কাছে তো পৃথিবীর নৃপতিদের সাথে সাদৃশ্য স্পষ্ট হয় আরেকজনের। এমন একজন, যার চাতুরীতে সৃষ্টির আদিতেই মানুষের জন্মগত অধিকার হারিয়ে স্বর্গচ্যুত হয়েছে; এমন একজন, যার উসকানিতে প্রথমবারের মতো মানুষ হত্যা সংঘটিত হয়েছে কাবিলের হাতে; এমন একজন, যা পবিত্র বাণীকেও অবিরাম বিকৃত করে ব্যবহার করেছে নিজের স্বার্থে আর মানুষ বিস্ফোরিত হয়েছে রেস্তোরাঁয় কি প্রার্থনাস্থলে; এমন একজন, যে নিজেকে সম্রাটদের মতোই প্রতীকায়িত করেছে মুদ্রায় আর মানুষকে উন্মাদ করে তুলেছে সেই মুদ্রার মোহে; এমন একজন, যে যিশুকে বাঁচিয়ে জন্ম দিতে পারে অলৌকিকের; এমন একজন, রক্তবাহী শিরা উপশিরায় চলাফেরা করে যে আড়ি পেতে জেনে নেয় মানুষের সমস্ত গোপনীয়তা; এমন একজন, পাপকর্মে লিপ্ত করতে মানুষকে যে ঘিরে থাকে চারপাশ থেকে সর্ববিস্তারী হয়ে। সেক্ষেত্রে কি এটাই উচ্চারণ করা যৌক্তিক নয় যে নৃপতি প্রকৃতপক্ষে অন্য কারও প্রতিনিধি?"
ডিস্টোপিয়ান জনরার বই বাংলা সাহিত্যে বিরল। তাই প্রিয় লেখক সুহান রিজওয়ানের এই বইটি অবশ্যই পড়বো বলে ঠিক করেছিলাম। বইটি মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়ে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমার এক্সপেকটেশন ফুলফিল হয়েছে। প্রচুর পলিটিকাল আর কনটেম্পোরারি মেটাফোর সাথে মেলানকোলিক উপস্থাপনা। এখানে George Orwell এর 1984 ও Ray Bradbury'র Fahrenheit 451 এর স্ট্রং ইনফ্লুয়েন্স রয়েছে। যাদের উপরের বই দু'টো পড়া থাকবে, তারা সুহান ভাইয়ের এই বইটি আরো বেশি এঞ্জয় করবেন বলে আমি মনে করি।
বইটি নিয়ে কথা বলার আগে, বইয়ের একটা বাক্য তুলেই শুরু করতে চাই।
‘ যতদিন পৃথিবীতে রাজনীতি থাকবে, তত দিনই পৃথিবীতে তৈরি হবে নতুন সব দেয়াল। কিন্তু যত দিন পৃথিবীতে দেয়াল উঠবে, তত দিন কেউ না কেউ ঠিকই তুলি ধরবে দেয়াল ভাঙার ছবি আঁকতে’
উপন্যাসের মাঝপথে লেখক সুহান রিজওয়ান যখন ঋজুশিরের মাধ্যমে এই বক্তব্যটি তুলে ধরে তখনই কিংবা তারও অনেক আগে অথবা পড়ে গিয়ে সুহান রিজওয়ান কেন এই উপন্যাসটি লিখলেন তার কিছুটা হয়তো আমি ধর���ে পারি।
একজন লেখক কেন লিখবে? একজন শিল্পী কেন আঁকবে? একজন সুরকার কেন সুর তৈরি করবে? শিল্পের এত সব মাধ্যমের আসলে কী প্রয়োজন? মূলত সুহান এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে চেয়েছেন বলে মনে হয়েছে আমার কাছে আলোচ্য উপন্যাসটিতে।
যেই ভবিষ্যত সময়ের গল্প সুহান বলতে চেয়েছেন সেই সময়টাকে তিনি দেখিয়েছেন তেজস্ক্রিয়তার কারণে মহাবিস্ফোরণ হওয়া এক শহর কিংবা দেশের গল্প, যে দেশটা বাংলাদেশ, যে শহরটার নাম ঢাকা, যে শহরে বসে আছেন একজন শাসক, যে শহরে কথা বলা মানা, যে শহরে মুহূর্তেই হারিয়ে যায় মানুষ, যে শহর খুব নিষ্ঠুর ও নির্মম, যে শহরে বন্ধুরা আড্ডা দেয় লুকিয়ে কিংবা ভয়ে, যে শহরে শব্দকে পাহারা দেয় রাষ্ট্রীয় সৈনিক, যে শহরে চলে উন্নয়নের নানা কাজ কিন্তু যে শহরে মানুষের আত্মা লুকিয়ে থাকে আতংক ও ভয়ে, যে শহরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলা হয়, মুছে ফেলা হয় শেখ মুজিবের নাম, যে শহরে তৈরি হয় শাসকের মন মতো ইতিহাস এবং ঐ শহরে একজন ক্ষ্যাপাটে শিল্পী গ্রাফিতি এঁকে জানায় প্রতিবাদ, আর তাকে খুঁজতে মরিয়ে হয়ে ওঠে শাসকের দল, এমনকি সুহান নিজেও। কেননা সুহান রিয়াসাত যে কিনা উপন্যাসের চরিত্র সেও ঠিক করে একটি উপন্যাস লিখবে এবং সেই গ্রাফিতি আর্টিস্টকে নিয়েই লিখবে।
সুহানের তৈরি করা খেলার মাঠ কি চেনা মনে হয়? ডিসটোপিয়ান উপন্যাস এই শব্দের আড়ালে সুহান কি আসলে অন্য কথাই বলতে চায়?
কখনো নন ফিকশনের আদলে, কখনো ডায়েরি লেখার আদলে, কখনো ন্যারেশন পরিবর্তন করে, কখনো কথক পরিবর্তন করে সুহান উপন্যাসে একটার পর একটা লাফ দিয়ে চললে, সুহানের প্রেমিকা নিশাতের জন্য আমার মায়াই হয়। এত সব ডামাডোলের ভেতরে মেয়েটার গল্প হারিয়ে গেল কোথায়? লেখকরা তবে স্বার্থপর? লেখার জন্য তারা এতটাই মশগুল থাকে যে নিজের প্রেমের সন্ধানও সে করতে পারে না, যত্ন নিতে পারে না?
এতসব ডামাডোলের ভেতরে আমার গ্রাফিতি আর্টিস্টের জন্য খারাপ লাগবে। গ্রাফিতি আর্টিস্ট যার নাম ঋজুশির সে কিনা এত সহজেই সুহানের কলমে উত্তর দিয়ে গেল?
একেক উপন্যাসে একেক ধরনের কাজ। সুহান রিজওয়ানকে তাই অভিনন্দন জানাই। ঈর্ষাও জানাই। আর জানাই যে খুব সুন্দর কোনো স্ট্রাকচারের ভেতরেও মাঝে মাঝে রক্ত-মাংসের কান্না ঢুকিয়ে দিতে হয়, কেবল প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই জীবন নয়।
গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে সুহান রিজওয়ান বাতিঘর ৬০০/- ( বইনগর - Boinagar থেকে ৪২০/- এ নেয়া)
ডিস্টোপিয়ান বাংলাদেশ, ২০৬৮ঃ
সুহান রিয়াসাত উপন্যাস লিখতে চায়। স্বৈরাচারী ইকবাল খানের কালাকানুনের খড়গের নিচে বসেও কেন সে উপন্যাস ই লিখতে চায়? তেজষ্ক্রিয় মহাবিস্ফোরণের পরের মৃত বিশ্বে কাদের জন্য উপন্যাস লিখবে সে?
কেন্দ্রীয় চরিত্রকে খুঁজে পেতে দেরি হয়না। ঋজুশির নামের সেই রহস্যময় গ্রাফিতি আর্টিস্টকে নিয়েই লিখবে সুহান, অন্ধকারে আঁকা যার দেয়ালচিত্র প্রশ্ন করে মাথা নিচু করে চলা জনপদকে।
ডিস্টোপিয়ার আড়ালে সমকালকে ধরার চেষ্টায় বেশ সফল সুহান রিজওয়ান। ২০৬৮ সাল কেবলই ধোঁকা, গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে কোন ডিস্টোপিয়ান হরর না বরং ১৯৬৯-২০২১ কেই ভিন্ন চেহারায় ফুটিয়ে তোলা মাত্র। তবে লেখক যে আড়াল করার খুব চেষ্টা করেছেন তাও না। ঋজুশির আর সুবোধ যে সমার্থক বুঝতে এক সেকেন্ড ও লাগে না। সবকিছু এত অবভিয়াস যে চরিত্র, সাল আর স্থানের বদলগুলো মকারির মত লাগে৷
(৩৩০ পেজের জিনিসটা দেখে যে কারো শত দুঃখেও হাসি চলে আসবে শিওর)
নিছক উপন্যাস ? নাকি গল্পটা আমাদের? লেখক যদি প্রশ্ন করেন কেন তিনি লিখবেন, তাহলে পাঠককেও প্রশ্নের মুখোমুখি করতে হয় নিজেকে, কেন তাকেই পড়তে হতো ? কেন এত শত সহস্র বই থাকতে তাকে কোন নির্দিষ্ট উপন্যাসটাই পড়তে হতো ? না পড়লে কি হত ? কোন উপন্যাস পড়া মানে কি শুধুই গল্প পড়ে যাওয়া ? চরিত্রের সাথে জীবনের মিল খুঁজে বেড়িয়ে আক্ষেপ কিংবা দুই চারটা লাইন এর মাঝে নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলা? নাকি এর চেয়েও বড় কিছু? যদি লেখক প্রশ্ন করে যান কেন তাকেই লিখতে হত, কেন এই উপন্যাসটাই তাকে লিখতে হত, পাঠক হিসেবে আমাদেরও একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় । ''যে জিজ্ঞাসার জবাব থাকেনা, সেটার উত্তর আমাদের দিতে হয় জীবনের সমস্ত কিছু দিয়ে''
বাংলা ভাষায় ডিস্টোপিয়া বলতে আনিসুল হকের 'অন্ধকারের একশ বছর'এর ব্যাপারে আমার জানা এবং ঐ একটা বই-ই এই জনরায় আমার পড়া। এটা আর 'গ্রাফিতিও প্রশ্ন করে' বাদে আর কোন বাংলা বই এ জনরার আছে কিনা তা আমার জানা নাই। 1984 কেনা হইসে পড়া হয় নাই। সুতরাং এই জনরা নিয়ে আমার আসলেই ধারণা কম।
লেখক বর্তমানে চলমান পরিস্থিতিকে বা সেই পরিস্থিতির চরম রূপকে রূপকার্থে ভবিষ্যতের ছাঁচে ফেলে বর্তমানকে মেপেছেন। লেখক হিসেবে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, উত্তর খুঁজেছেন আর সর্বোপরি নিজে চিন্তা করার পাশাপাশি পাঠকদের মনেও চিন্তার উদ্রেক ঘটাবার চেষ্টা করেছেন। লেখক নিজে লেখার টেবিলে লড়াই করেছেন, পাঠককেও পড়ার বেলায় লড়াই করিয়েছেন শব্দের মাধ্যমে।
লেখকের কল্পিত বন্ধুমহল আমার বাস্তবজগতে বিরাজমান বলেই হয়ত এক প্রকার সাদৃশ্য অনুভব করেছি আলোচনার বিষয়বস্তুর মধ্যে। গল্পের মত আমাদের আলোচনার অঙ্কের উত্তরেও ক্ষমতা 'অনন্তকল্যাণী'দের হাতেই যায়। হতাশ হয়েছি। বাস্তবেও এই দেয়াল নিয়ে হতাশ।
উপন্যাসে আবরার ফাহাদও এসেছে, আরব বসন্তের সূচনাকারী মোহাম্মদ বৌয়াজিজিও এসেছে। এছাড়াও বিশ্বে ঘটে একাধিক বিপ্লবের নানা মালমসল্লাও বইয়ে উঠে এসেছে ভবিষ্যত বাংলাদেশের বিপ্লবী পটভূমিতে।
বই শেষ করে আমার চিন্তাভাবনা বিক্ষিপ্ত তাই বোধহয় পড়া শেষ করেই এটা লিখতে বসায় আমার লেখাও বিক্ষিপ্ত।
এক কথায় অনবদ্য। আমি লেখকের পদতলে চমকায় মাটির পাঠ প্রতিক্রিয়া তে বলেছিলাম আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা এমন একটা সময় এ বাস করছি যখন সুহান রিজওয়ান লিখেছেন। এই বইটি এর কোন ব্যাতিক্রম নয়। ডিস্টপিয়ান রিয়ালিটি নিয়ে কাজ খুব বেশি বাংলাতে নাই, তার একটা বড় অভাব এই বইটি মেটাবে। একই সাথে আশ্চর্যজনক এবং দূর্ভাগ্যজনক বিষয় হল বর্তমান বাংলাদেশের সাথে বইয়ের বাংলাদেশের যেই অসম্ভব মিল। ৩৫০+ পৃষ্ঠার বইটির প্রতিটি লাইনে যেই যত্নের সাথে লেখা হয়েছে তা ঈর্ষনীয়। অধির আগ্রহে অপেক্ষায় থাকলাম লেখকের পরবর্তী বইয়ের।