একজন হুমায়ূন আহমেদ ঘরের মানুষ। তাঁকে অন্তরঙ্গভাবে দেখেছেন পরিবারের সদস্যরা। একজন হুমায়ূন লেখক, আরেকজন নাট্যকার। এই তিন হুমায়ূন মিলে গড়ে তোলেন স্বপ্নের নিবাস নুহাশপল্লী। হুমায়ূন তাঁর প্রতিটি ভুবনে আমন্ত্রণ করেছিলেন সেই সময়কার তরুণ সাংবাদিক আসিফ নজরুলকে। এই বইয়ে ফুটে উঠেছে কয়েকজন হুমায়ূনের এক অতুলনীয় ছবি।
আসিফ নজরুল একজন ঔপন্যাসিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ১৯৯১ সাল থেকে শিক্ষকতা করছেন। আন্তর্জাতিক আইনে পিএইচডি করেন লন্ডন থেকে। এরপর জার্মানি ও ইংল্যান্ডে কিছুদিন কাজ করেছেন পোস্টডক্টরাল ফেলো হিসেবে। সাংবাদিক হিসেবে একসময় খ্যাতি অর্জন করেন। বর্তমানে কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে বহুল পরিচিত। দীর্ঘ বিরতির পর কয়েক বছর ধরে আবার সৃজনশীল লেখালেখি করছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দশের অধিক।
বইয়ের কিছু অংশ আশ্চর্যজনকভাবে ভালো। যেমন - নব্বইয়ের দশকে নেওয়া গুলতেকিন আহমেদের সাক্ষাৎকার। গুলতেকিন হুমায়ূন আহমেদের বেশ কিছু দুর্বলতা তুলে ধরেছেন। যেমন - হুমায়ূনের লেখায় পুনরাবৃত্তি, রাজাকারদের পত্রিকায় লেখা দেওয়া, সংসারের কোনো দায়িত্ব না নেওয়া ইত্যাদি। বিবাহিত থাকাকালীন এরকম সরল স্বীকারোক্তি দেওয়া সহজ কথা নয়। বলার ভঙ্গিও মোলায়েম। শিলা আহমেদের ছোট সাক্ষাৎকারটাও ভালো।শিলা উল্লেখ করেছেন, হুমায়ূনের প্রথম জীবনের বন্ধুরা সৎ ছিলেন।যে কারণে তারা লেখকের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করতেন। এতে বিরক্ত হুমায়ূন পরে এমন বন্ধুমহল বেছে নেন যারা তার প্রতি কথাতেই সায় জানাতো (পড়ুন, তার অধঃপতন শুরু হোলো।)হুমায়ূনের পুরো সংসারই ছিলো তার লেখাকেন্দ্রিক। অর্থাৎ তিনি লিখবেন, এটাই ছিলো সবচেয়ে গুরুত্ববহ ঘটনা।এটা ঠিক রেখে সংসারের অন্যান্য কাজ চলতো। মজা পেলাম, হুমায়ূনের মেয়েরা নব্বই দশকেই জানিয়েছে, "নীল অপরাজিতা " উপন্যাসটা খুব বাজে। এটা সেই উপন্যাস যাতে এক লেখকের সংসারে ভাঙন আর নতুন প্রেমে পড়ার গল্প আছে। মেয়েরা কি তখনই বুঝতে পেরেছিলো কিছু?
হুমায়ূন আহমেদ। দ্য ম্যান, দ্য মিথ, দ্য লিজেন্ড। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত লেখক। অনেকের কাছে তিনি যেমন নন্দিত ঠিক তেমনি বহুজনের নিন্দার ঝুলিতে তাঁর স্থান আছে। কারো কাছে তিনি বাজারি লেখক মাত্র আবার কারো হৃদয়কে গভীরভাবে ছুয়ে গেছে তাঁর লেখনী।
মানুষ বড় অদ্ভুত এক প্রাণী। একজন মানুষের ভিতর বাস করে বেশ কয়েকজন। বাংলা ব্যান্ডের আনুশেহর সেই বিখ্যাত গানটার লিরিকস মনের মধ্যে উদয় হতে পারে সচেতন শ্রোতা এবং পাঠকের মাঝে।
আসিফ নজরুল। ৯০ এর দশকে হুমায়ূন আহমেদের সাথে বিভিন্ন কারণে যার একধরণের অম্লমধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। এই বইয়ের বেশিরভাগ লেখা ৯০ থেকে ২০০০ সনের মধ্যকার টাইমলাইনের। আসিফ অল্প বয়সে তাঁর নিজের ভাষায় যথেষ্ঠ একরোখা ছিলেন। তবে হুমায়ূন আহমেদের সাথে সময়ের পরিক্রমায় আসিফের একধরণের ঘনিষ্ট সম্পর্কের সূচনা হয়। "বিচিত্রা" এ কাজ করার সুবাদে এবং তৎকালিন সময়ে নিজে কয়েকটা ভালো উপন্যাস লিখে ফেলায় স্টার রাইটার হুমায়ূন আহমেদের সাথে বিভিন্ন ঘটনাচক্রে কাজ করার সুযোগ হয়ে ওঠে আসিফের।
বাংলাদেশের খুব সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আসিফ নজরুল। একটি বইয়ের কারণে আদালত অবমাননার রুল জারি হলে সেই সময় হুমায়ূন আহমেদ কিভাবে ডিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সেসবের বর্ণনা ফুটে উঠেছে আসিফ নজরুলের লেখনীতে। তবে গুলতেকিন খানের ( তৎকালিন গুলতেকিন আহমেদ ) এর সাক্ষাৎকারগুলো যথেষ্ট পরিমিত এবং সুচিন্তিত মনে হয়েছে এই বই পড়ে। হুমায়ূন আহমেদ সাক্ষাৎকার দেয়ার বেলায় পরিমিতিবোধের ধার খুব একটা ধারতেন না।
বাকের ভাইয়ের ফাঁসি নিয়ে সেই সময়ের বাংলাদেশে যে বিক্ষোভ এবং আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিলো তার আখ্যান লিখেছেন আসিফ নজরুল। একটি কাল্পনিক চরিত্র কিভাবে মানুষজনের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে লেখকের বিভিন্ন বিশ্লেষণ আছে। একইসাথে আছে সাহিত্য বনাম আইনের বিভিন্ন আলাপচারিতা। আইনের শিক্ষক হওয়ার কারণে বেশ কিছু রেফারেন্সমূলক লেখালেখি এই বিষয়ে আছে। আদালত অবমাননা থেকে চলে এসেছে হুমায়ূন আহমেদের এসব বিষয়ে নিজস্ব ভাবনা।
নুহাশপল্লীর হুমায়ূন আহমেদের মাঝে পাঠক দেখতে পাবেন অবিশ্বাস্য এক মানুষকে যিনি জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুসঙ্গ নিয়ে মুগ্ধতায় ভুগেন। আবার ক্ষ্যাপাটে এবং আপাতদৃষ্টিতে স্বার্থপর এক ব্যক্তির দেখাও মিলে। ব্যক্তিগত জীবনে যিনি বেশ স্বেচ্ছাচারি। আসিফ নজরুল, হুমায়ূন আহমেদের বেশ কিছু সমালোচনাও করেছেন এই বইয়ে। তাঁর জীবদ্দশায় আসিফ সরাসরি কঠিন ক্রিটিক করেছেন হুমায়ূনকে। লেখক হিসেবে আহমেদের জার্নি, লেখালেখির অভ্যাসের কথা, মুড সুইং এবং বিভিন্ন সিনেমাতে অসামঞ্জস্য নিয়ে কথা বলেছেন আসিফ নজরুল। এমনকি হুমায়ূন আহমেদের মেয়েদের সাক্ষাৎকারেও অনেক কথা চলে এসেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি লিজেন্ডারি এই লেখকের তীব্র প্যাশন লক্ষ্য করা যায়। আবার তারই মাঝে হতাশা রূপে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে নিজের করা ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা।
আসিফ নজরুল বাংলাদেশে বেশ পরিচিত এক নাম। তাঁর লিখা প্রথম পড়লাম। বেশ সহজাত এবং সাবলীল লেখনীর অধিকারি এই লেখক। একজন হুমায়ূনের মাঝে যে কয়েকজন বাস করেন তাদের তত্ত্বতালাশ করেছেন আসিফ নিজ দৃষ্টিকোন থেকে। অবশ্য এইসকল তথ্যের বেশিরভাগ হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনীমূলক বা মেমোয়ার টাইপ লেখার সূত্র ধরে আগের থেকেই জানা অনেক পাঠকের। তবে যতটুকু আসিফ নজরুলের কাছ থেকে আশা করেছিলাম ততটা এই বইয়ে পাইনি। হয়তো আসিফের হুমায়ূন আহমেদের সাথে এতটুকুই ইন্ট্যারেকশন ছিল। আসিফ বারবার বলেছেন যে হুমায়ূন আহমেদ গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের অন্ধকার দিকটি আলোয় আনেন নি। ঠিক তেমনি আসিফ নজরুলও সঙ্গত কারণে হয়তো হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রের কোন অন্ধকার দিক সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন বলে মনে হয়। তবে কিংবদন্তি এই লেখকের ভিতরের কয়েকজনকে আরো এক্সপ্লোর করা যেত বলে মনে হয়।
হুমায়ূন আহমেদের ভিতর হিমু, মিসির আলি, ফিহা, শুভ্র, এরকম আরো অনেকে ছিলেন। লেখক আসিফ নজরুল কি অন্তত হিমুর অন্ধকার দিকগুলো ধরতে পারেন নি? নাকি ডার্ক এই ক্যারেক্টার সম্পর্কে তাঁর ধারণা অল্প ছিলো।
হুমায়ূন আহমেদের ভিতর বসত তো করেছিলো বেশ কয়েকজন। তাদের নিয়েই তিনি বাস করতেন এক নন্দিত নরকে।
সাক্ষাৎকার ও আসিফ নজরুলের হুমায়ুন আহমদকে নিয়ে স্মৃতিকথা টাইপের বই। বিচিত্রায় প্রকাশিত একটা বড় প্রবন্ধ ও মতামত ধরনের লেখা আছে হুমায়ুন আহমেদ এর উপর অবমাননা মামলা নিয়ে, ওইটা বোরিং ছিল। গুলতেকিন এর একটা সাক্ষাৎকার আছে, পড়ে জেনুইন লেগেছে। আসিফ নজরুলকে লেখক হিসেবে আহামরি মনে হয়নি। অবশ্য উনার লেখা প্রথম বই এতাই যেটা আমি পড়েছি। হুমায়ুনকে জানতে হলে পড়া আবশ্যক ধরনের বই না।
বইটি মূলত হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। স্মৃতিকথা শুরু করেছেন আসিফ নজরুল নিজের আর হুমায়ূন আহমেদের প্রথম আলাপ পরিচয়ের পর্ব দিয়ে। এরপর গুলতেকিন আহমেদের সাক্ষাৎকার আছে। এই সাক্ষাৎ���ার সেই আমলের, নতুন করে নেয়া নয়। শেষে আছে শীলা আহমেদের সাক্ষাৎকার হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে পড়তে গেলে আসলে মন খারাপ লাগে।
বাতিঘরে বসে দু'মাস আগে একটা বই পড়েছিলাম। বইটার নাম 'কয়েকজন হুমায়ূন আহমেদ'। আগ্রহ নিয��ে বইটা হাতে নিয়েছিলাম কারণ বইটার লেখক আসিফ নজরুল। আমরা বোধহয় সবাই জানি আসিফ নজরুল হুমায়ূন আহমেদের জামাতা (মেয়ে শীলা আহমেদের স্বামী)। তো উনি আসলে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কী লিখেছেন সেটা দেখাই ছিল আগ্রহের বিষয়। তবে অ্যাদ্দিন পরে এ বইটার রিভিউ লিখতে আসার কারণটা আরো ইন্টারেস্টিং। শেষে বলছি।
বইটা পড়া শেষে দেখলাম আমি যেরকম ধারণা করে বইটা হাতে নিয়েছিলাম, আসলে মোটেও সেইরকম না বইটা। ওরকম হলেই বরং বইটা ম্যাড়মেড়ে হতো। বইটা বরং বেশ কিছু প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকারের সংকলন, যেগুলো আসিফ নজরুল সাহেব ৯০ এর দশকে লিখেছিলেন। হুমায়ূন 'ভাই' এর ফ্যামিলির সাথে তখন তার সহজ-সরল একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
এই বইতে থাকা প্রবন্ধগুলোর বেশিরভাগই প্রকাশ পেয়েছিল সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা'তে। আর আমি সবচাইতে বেশি অবাক হয়েছি সাপ্তাহিক 'বিচিত্রা'র ঐ সময়ের কথা জানতে পেরে। এ বইতে থাকা সাপ্তাহিক বিচিত্রার দুইটা প্রবন্ধ আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করেছে। মানে এত মানসম্পন্ন প্রবন্ধ যে ৯০ দশকে প্রকাশ পেত আমার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না।
একটা প্রবন্ধ হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত নাটক 'কোথাও কেউ নেই' নিয়ে। কোথাও কেউ নেই এর শেষ পর্ব প্রচারিত হয়েছিল ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ আর তার আগের পর্ব মনে হয় সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। আগের পর্বেই দেশের জনগণের মধ্যে আলোচনার তুঙ্গে উঠে আসে এ নাটকের সম্ভাব্য শেষ পরিণতি বিষয়ে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে কি হবে না, এসব নিয়ে চায়ের দোকানে, অফিসে, পাড়ায় রীতিমতো গবেষণা হতো। এই শেষ পর্বের পরিণতি কী হতে পারে, দর্শকরা কী মনে করছেন, পরিণতি হলে দেশের মানুষের মাঝে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে; ইত্যাদি বিষয় এত সুন্দর করে সংগ্রহ করে এই প্রবন্ধটা লেখা হয়েছে যে, এটার মান, কন্টেন্ট দেখে আমার খুবই ভালো লেগেছে। এই প্রবন্ধটা প্রকাশ পেয়েছিল ১৭ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ শেষ পর্ব প্রচারিত হবার ৪দিন আগে।
আরেকটা প্রবন্ধ ছিল, হুমায়ূন আহমেদের বিরুদ্ধে হওয়া আদালত অবমাননা বিষয়ক। বইটা হিমু সিরিজের, নাম সম্ভবত 'দরজার ওপাশে'। ঐখানে আদালত অবমাননা হবার রুল কী, পৃথিবীর কোনো দেশে ফিকশন লিখে এরকম ভাবে আদালত অবমাননা মামলার শিকার হয়েছেন কিনা; ইত্যাদ ইত্যাদি বিষয়ে একটা প্রবন্ধ। আসিফ নজরুল নিজে আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ায় এবং প্রচুর রিসার্চ করে লেখা এই প্রবন্ধটা বাংলাদেশের প্রবন্ধ লেখার ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলে মনে হয়েছে আমার।
এই প্রবন্ধগুলো বাদেও বইতে ইন্টারেস্টিং ছিল সাক্ষাৎকার গুলো। বিশেষ করে গুলতেকিন খানের সাক্ষাৎকার। হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে ছিল মানুষকে চমকে দিয়ে আনন্দলাভের একটা অভ্যাস। গুলতেকিন খান একদম আলাদা, তিনি ভান টান করেন না। তবে তিনি বেশ সাহসী। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অকপটে কিছু কথা বলেছিলেন তখনই যেটা ফরমাল ইন্টারভিউতে সাধারণত মানুষ বলে না। ভালো লেগেছে শীলা আহমেদের ইন্টারভিউটাও। কটু অথচ সত্য কথা বলা সমালোচক যে কোনো সাহিত্যিকই পছন্দ করেন না, সেটা জানা গেল শীলা আহমেদের বয়ানেই। আর ভিন্ন ভিন্ন মানুষের বয়ানেই দেখা গেল একজন হুমায়ূনের মাঝেই কয়েকজন হুমায়ূনকে।
তো শুরুতে অ্যাদ্দিন পরে রিভিউ লেখার কথা যেটা বলছিলাম। শীলা আহমেদের ইন্টারভিউতে বাবার লেখা অপছন্দের বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন, আসিফ নজরুল। শীলা আহমেদ বলেছিলেন, 'নীল অপরাজিতা' বইটা একদমই ভালো লাগেনি তার। আমিও শুনে সাধারণ একটা স্টেটমেন্ট হিসেবেই নিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ করে এই বইটার পিডিএফ নামালাম। পড়া শেষ করে চমকে গেলাম। কারণ এই বইটার শেষে এমন একটা ইঙ্গিত আছে যেটা পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদ পরিবারের জীবনে ঘটেছিল। তাহলে কী শীলা আহমেদ আগেই কোনোভাবে ব্যাপারটা টের পেয়েছিলেন? অলৌকিক বিষয়ে আমার বিশ্বাস খুবই সীমিত। তবে মাঝে মাঝে এরকম অলৌকিক কোনো কানেকশান পেলে খারাপ লাগে না।
হুমায়ূন আহমেদের আত্মজীবনীমূলক বেশকিছু বই পড়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই লেখকের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে জানার সুযোগ হয়েছে। বরাবরের মতোই দারুণ স্টোরিটেলিংয়ের মধ্য দিয়ে নিজের কথা লিখেছেন তিনি। কিন্তু এসবের মধ্যে নিজের মাপকাঠিতে নিজেকে বিচার করা কঠিন কাজই বটে। সে হিসেবে ভিন্ন চোখে লেখকের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই "কয়েকজন হুমায়ূন আহমেদ" বইটি পড়া।
প্রথমত বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে না বললেই নয়! সব্যসাচী হাজরার করা দৃষ্টিনন্দন এই প্রচ্ছদ বইটিকে ভীষণভাবে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। সংগ্রহে থাকা সমস্ত বইয়ের প্রচ্ছদের পছন্দ তালিকা করলে এটি নিঃসন্দেহে শীর্ষের দিকে থাকবে।
এবার আসা যাক, মূল প্রসঙ্গে। বইয়ের নামকরণ ও সূচিপত্র দেখে আঁচ করা যায় প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে লেখক হুমায়ূন থেকে ব্যক্তি হুমায়ূনের আর দশটা দিক নিয়ে আলাপ করা হয়েছে এই বইয়ে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি শিরোনাম বেশ আগ্রহ জাগানিয়া ছিল। বিশেষত বইয়ের লেখক আসিফ নজরুল নিজের বয়ানে তাঁর পরিচিত হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যে অংশগুলো লিখেছেন সেসব বর্ণনা ভীষণ সাবলীল ছিল। লেখকের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকারের অংশগুলো ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে সবচেয়ে উপভোগ্য ছিল। এর বাইরে চলচ্চিত্র নির্মাণে হুমায়ূন আহমেদের অতৃপ্তি, ব্যক্তিগত দ্বিধা, সংকট, নুহাশপল্লীকে ঘিরে তাঁর আয়োজন, মানুষের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ এবং সাধারণের কাতারে থেকেই অসাধারণ হয়ে ওঠার ছোটখাটো দৃষ্টান্তগুলো এই বইয়ের অনন্য সংযোজন।
গোটা বইয়ের অনেকটুকু অংশ পড়তে পড়তে একটা প্রশ্ন বারবার এসে নাড়া দিচ্ছিল; এই বইটা লেখার পেছনে লেখক তাঁর উদ্দেশ্যে কতটা সফল হয়েছেন। ছোটখাটো ভালোলাগাগুলোকে বিবেচনা করলেও মোটাদাগে বলা যায় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লেখক নিজের সেরাটুকু দিয়ে কয়েকজন হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রগুলোকে যথাযথভাবে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন। বইয়ের সূচিপত্র অনুযায়ী বইটি বেশ গোছানো হবে এমনটা আশা করেছিলাম। কিন্তু শুরুর অংশ এবং শেষদিকের কিছু অংশ বাদে বেশ অগোছালো মনে হয়েছে। বিটিভিতে সম্প্রচারিত "কোথাও কেউ নেই" নাটকের ক্লাইম্যাক্স প্রেডিকশন করা নিয়ে যে প্রতিবেদনটি যোগ করা হয়েছে তাতে লেখক, পাঠক এবং নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বড় করার এক প্রকার চেষ্টা স্পষ্ট ছিল। এবং দিনশেষে এ প্রচেষ্টা একঘেয়েমি সৃষ্টি করেছে। "সাহিত্য বনাম আদালত" শিরোনামে সংযোজিত লেখাটির ক্ষেত্রেও একই বিষয় দৃশ্যমান। মূলত "সাপ্তাহিক বিচিত্রা"-য় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনগুলো বইয়ে সংযোজনের গুরুত্বকে অস্বীকার না করলেও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এত বিস্তারিত বিচার বিশ্লেষণ, মামলা মোকদ্দমার হরেক রকম ফর্দের মাঝে মূল বিষয়গুলো আড়ালে চলে গেছে মনে হয়েছে। তখনকার বিবেচনায় পত্রিকায় প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখাগুলোর উপযোগিতা হয়ত ছিল, তবে বইটিতে এসবের আদ্যোপান্ত বর্ণনার তুলনায় মূল প্রসঙ্গ অর্থাৎ ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদের অবস্থান নিয়ে পাঠকের আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ছিল; তা হলো শুরুতেই লেখক উল্লেখ করেছেন, বইটির মধ্য দিয়ে পাঠকের কাছে হুমায়ূন আহমেদের চিন্তা ও মননের জগতে বিচরণের সুযোগ করে দেয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু মূল আলোচনায় এই বিষয়গুলো খুব অল্পই উঠে এসেছে৷ লেখক হুমায়ূন আহমেদ যেমন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর অন্ধকার দিক প্রায় সময়ই এড়িয়ে গিয়েছেন, লেখক আসিফ নজরুলের বর্ণনায় ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েও এমন প্রয়াস ছিল। অনেক জায়গায় তাঁর আলোচনা যতটা গভীর হবে ভেবেছিলাম ততটা ব্যাপকভাবে হয়ে উঠেনি। এক্ষেত্রে এক ধরণের সংকুচিত ভাবও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখায়। এই সংকুচিত ভাবের ঊর্ধ্বে গিয়ে আলো-আঁধারির আয়নায় হুমায়ূন আহমেদকে জানার আগ্রহ নিয়ে বইটি পড়ার যে তৃষ্ণা ছিল, লেখক তা পুরোপুরি তৃপ্ত করতে পারেননি।
❛এমন একজন মানুষ নেই আর এই পৃথিবীতে। অথচ তিনি আছেন আমাদের বুকের মাঝে অসীম বেদনা হয়ে। তাঁকে কখনো ভুলব না আমরা। তা সম্ভব নয়।❜ হুমায়ূন আহমেদ। বাংলা সাহিত্যজগতে গল্পের জাদুকর, কথা জাদুকর হিসেবে যার পরিচিতি। সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক হিসেবে যিনি খ্যাতি কুড়িয়েছেন। হিমু, মিসির আলি, রূপা, বাকের ভাই, শুভ্র চরিত্রগুলোকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে নয়, পাঠক আপন অস্তিত্বে খুঁজে পেতে চেয়েছে এই চরিত্রগুলোকে। লেখকের লেখার গুণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাকে উপমা, বিশ্লেষণ দিয়ে বর্ণনা করা যাবে না। ৭০, ৮০ এর দশকের সেই ল্যান্ডফোনের দিনগুলোতে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল বই। সেই সময় হুমায়ূন আহমেদ তার গল্পের জাদুতে মাতিয়ে রেখেছিলেন। রসায়নের এই অধ্যাপক বাংলা সাহিত্যে এনে দিয়েছিলেন অনন্য এক মাত্রা। যার ধারাবাহিকতা এখনও বজায় আছে। হলুদ পাঞ্জাবীতে নিজেকে হিমু ভাবতে তরুণেরা আজও পছন্দ করে। নীল শাড়িতে রূপা ভাবতে পিছিয়ে নেই রমণীরাও। সেলিব্রেটি হুমায়ূন আহমেদ তো একরকম। কেমন ছিলেন ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ? লেখকের বিভিন্ন জীবনী পড়ে আমরা কিছুটা জানতেও পারি। বিভিন্ন সময় হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখা অন্য লেখকদের বই, সাক্ষাৎকার থেকেও জানা যায় তার জীবনের গল্প। তবে হুমায়ূন আহমেদের কাছের মানুষদের চোখে তিনি কেমন ছিলেন? একান্ত আপনজনদের সাথে লেখকের সম্পর্ক, পারিবারিক বন্ধন কেমন ছিল? বাবা, স্বামী হুমায়ূন না লেখক হুমায়ূন কোনটার প্রভাব ব্যক্তিজীবনে বেশি ছিল? এমনই কিছু বিষয় নিয়ে লেখক আসিফ নজরুল লিখেছেন ❛কয়েকজন হুমায়ূন আহমেদ❜ বইটি। প্রথমদিকে বিচিত্রার সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত আসিফ নজরুলের সাথে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল বিচিত্রার অফিসে। সে সময় হুমায়ূন আহমেদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মাম লা ঠুকে দিয়েছিল আদালত কর্তৃপক্ষ। অপ রাধ লেখকের বইতে আদালত সম্পর্কে কটুক্তি করা। এই নিয়েই এক প্রতিবেদন করতে পরিচয় তাদের। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে ওঠে। তবে লেখকের জবানীতে আছে এই সখ্যতা বেশিদিন ছিল না। তবে দা-কুমড়া সম্পর্কও হয়নি। হুমায়ূন আহমেদের জন্য গভীরে যে ভালোবাসা তিনি অনুভব করতেন তা আজীবন থাকবে। গুলকেতিনের দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি হুমায়ুন সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দিয়েছেন। স্ত্রী (তৎকালীন) হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের একজন নিয়মিত পাঠক, সমালোচক। লেখকের লেখা পড়তেন এবং মতামত দিতেন। স্বামী, পিতা হিসেবেও হুমায়ুন আহমেদ কেমন ছিলেন সেসব তথ্যও সাক্ষাৎকারে এসেছে। গুলকেতিনের সংসারে হুমায়ুন আহমেদ কেমন ভূমিকা পালন করতেন, খ্যাতির শিখরে থাকা এই লেখকের পারিবারিক জীবনের খন্ডচিত্র উঠে এসেছে স্ত্রী এবং তিন কন্যার জবানীতে। ❛কোথাও কেউ নেই❜ ধারাবাহিকে বাকের ভাইয়ের ফাঁ সিকে কেন্দ্রে করে সেই সময়ে হওয়া অস্থির পরিবেশের কথা তুলে ধরেছেন। একজন লেখকের লেখনী, উপস্থাপন কতটা শক্তিশালী হলে তা আমজনতাকে রাজপথে নামিয়ে আনতে পারে, শুধুমাত্র কাল্পনিক এক চরিত্রের ফাঁ সি রুখতে। ধারাবাহিকের শেষ পর্ব প্রচারের আগে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এবং তা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের চিন্তাধারা তুলে ধরেছেন। ❛দরজার ওপাশে❜ নামক বইতে আদালত নিয়ে ক টুক্তির দায়ে তিনি অভিযুক্তও হয়েছিলেন। আত্মপক্ষ সমর্থন করে লেখক সে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিয়েছিলেন তার কিছু কথাও এখানে আছে। নুহাশপল্লী তৈরি, সে জায়গাকে কেন্দ্র করে লেখকের স্বপ্ন, আশা এবং তার প্রতিফলনের দৃশ্যও ভেসে উঠেছে। কন্যা শীলা আহমেদ লেখকের অন্যতম প্রিয় সন্তান। শীলার কাছে বাবা হুমায়ূন, লেখক হুমায়ূন কেমন ছিলেন এ বিষয়ে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারও বইতে সংযোজিত হয়েছে। সংযোজন হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব এক লেখাও। যার শিরোনাম ❛কচ্ছপের গল্প❜। পাঠ প্রতিক্রিয়া: ২২ এর মেলার অন্যতম কাঙ্খিত বই ছিল ❛কয়েকজন হুমায়ূন আহমেদ❜। হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়তে যেমন কখনও অত্যুক্তি হয় না, তেমন লেখককে নিয়ে লেখা অন্যদের লেখা পড়তেও আমার খুব ভালো লাগে। আর আসিফ নজরুলের এর আগে দুটো বই পড়ার সুবাদে এই বইটিও আমার পড়ার আগ্রহ ছিল। ছোটো আকারের বইতে লেখক বিভিন্ন বিষয় দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেন। তবে এই বইটি ফিকশন নয়। বিভিন্ন সময় লেখা পত্রিকার লেখা এবং কিছু নতুন সংযোজনের সমাবেশ করেছেন। ৭টি ভিন্ন শিরোনামে লেখক ব্যক্তি হুমায়ূনকে চিত্রায়ন করেছেন। হুমায়ূন আহমদের ভক্তের সংখ্যা যেমন কম ছিল না, তেমনই নিন্দুকও ছিল সমানুপাতিক হারে। এইসব ব্যাপারগুলো তিনি কীভাবে নিতেন, খ্যাতির চূড়ায় থাকা লেখকের মাঝে অহংবোধ কতটা ছিল, সমালোচনা কেমন নিতে পারতেন এই বিষয়গুলো ছোটো আকারে তুলে ধরেছেন। হুমায়ূন আহমেদ তার লেখায় কেন মানব চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো আনতেন না, কেনই বা তার লেখাকে অনেকে বাজারী লেখা বলতেন, অথবা এতো লিখতে গিয়ে লেখায় রিপিটেশন থাকা নিয়ে লেখকের মনোভাব কেমন ছিল এগুলো গুলকেতিন ও তার তিন কন্যার জবানীতে তুলে এনেছেন। তবে সূক্ষভাবে লেখক হুমায়ূন আহমেদের জীবনের অনেক অধ্যায়ই এড়িয়ে গেছেন। খুব অল্প পরিসরে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার মেলবন্ধন করেছেন। আমি একটু বেশিই আশা নিয়ে বইটা পড়তে বসেছিলাম। সেই আশা পুরোটা পূরণ হয়নি। কিছুক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় তথ্যের আধিক্য লেগেছে। যেমন, সাহিত্য বনাম আদালত প্রসঙ্গে দেয়া বর্ণনা আমার অযথা লেগেছে বরং সেখানে এর ইতি কীভাবে ঘটলো তা দিতে পারতেন। শীলা আহমেদের দেওয়া সাক্ষাৎকারের অংশটুকু খুব ভালো লেগেছে। মোটের উপর বইটা পড়ে খুব একটা খারাপ লাগেনি আবার আহামরি ভালোও লাগেনি। চাইলেই আরো সুন্দর করে তথ্য দিয়ে সাজানো যেত বইটা। বইয়ের প্রচ্ছদটা আমার খুব পছন্দের। আর বাতিঘর এর বইয়ের মান নিয়ে কখনই প্রশ্ন থাকে না। এই বইটিও বাতিঘরের উন্নতমানের প্রোডাকশনের ফলাফল। হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন। তবে রেখে গেছেন তার অসাধারণ সব কর্ম। ভারিক্কি বই পড়ে যখন ক্লান্ত লাগে বা একঘেয়ে হয়ে যাই তখন ৮০-৯০ পেইজের হুমায়ূন আহমেদ পাঠ যেন সকল জড়তা দূর করে দেয়। অনেককেই বলতে শুনি, সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু পড়ার পরে হুমায়ূন আহমেদকে পানশে লাগে। আমি এদের লেখা পড়ার পরেও হুমায়ূন আহমেদে অন্যরকম তৃপ্তি পাই। এ তৃপ্তি আজীবনের। জোছনা, টিনের চালের বৃষ্টিকে যিনি গভীরভাবে ভালোবেসেছেন তিনি চলে গেছেন অন্যভুবনে। সেখানে থেকে কি আমাদের এই হাহাকার পৌঁছে তার কাছে!
হুমায়ূন আহমেদ কে আমরা চিনি লেখক হিসেবে। কিন্তু এর বাইরে ও তাঁর চরিত্র রয়েছে,একজন স্বামী হিসেবে,বাবা হিসেবে,সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে।
লেখক আসিফ নজরুল,ব্যক্তি হুমায়ূনকে এই বইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাই তো তিনি তার সাথে হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের কথা এই বইতে তুলে ধরেছেন।
তাছাড়া হুমায়ূন আ���মেদের বহুল আলোচিত নাটক "কোথাও কেউ নেই" নিয়ে বিচিত্রার বেশ কয়েকটা প্রতিবেদন। গুলতেকিন খান এবং শীলা আহমেদ এর একটা সাক্ষাৎকার আছে,তাও অনেক আগের।
সব মিলিয়ে মোটামুটি টাইপের একটা বই। সহজ ভাষায় এভারেজ। বইটা আশা নিয়ে কিনেছিলাম,তার এক পার্সেন্ট ও পূরণ হয়নি।
লেখক হুমায়ূন আহমেদকে ছাপিয়ে ব্যাক্তি হুমায়ূন আহমেদকে চেনানোর এক দারুণ চেষ্টা করেছেন লেখক আসিফ নজরুল। আসিফ নজরুলের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, হুমায়ূনের পূর্বের স্ত্রী গুলতেকিন, মেয়ে শীলা আহমেদের সাক্ষাৎকারসহ ব্যক্তি হুমায়ূন সংকলন বলা যায়। তবে পড়া শেষে কেন জানি বারবার মনে হচ্ছিল যেই আশা নিয়ে বইটি কিনেছিলাম তা পূর্ন হয় নি। ব্যক্তিগতভাবে অতটা ভালো লাগে নি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে জাদুকরকে নিয়ে লেখা পড়তেই হয়।
শীলার সাথে বিয়ের পূর্বে তার সাথে আমার বেশ ভালো সম্পর্কই ছিল, কিন্তু এরপর আমৃত্যু আর কখনো যোগাযোগ হয়নি - আসিফ নজরুল
আসিফ নজরুল এর লেখা কয়েকজন হুমায়ুন আহমেদ। বইটি পড়ার ইচ্ছা ছিল অনেকদিন ধরেই। মূলত হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যুর পর থেকে তাকে নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা অভাব তৈরী হয়। আর সেটা উপজীব্য করে কাছের অনেক মানুষ বই লিখেছেন,লিখছেন। তবে আসিফ নজরুলের এই বইটি বিশেষ করে পড়ার কারণ গুলতেকিনের আর শীলা আহমেদের হুমায়ুন এর উপর দেয়া সাক্ষাতকার!
সাক্ষাতকার দু'টো পাঠের পর এমন কিছু অজানা দিক জানলাম যা সত্যিই অনেক হুমায়ুন ভক্ত জানেন না।
যেমন- হুমায়ুন আহমেদ নিজ লেখার সমালোচনা সহজভাবে নিতেন না। গুলতেকিনের এবং শীলা উভয়েই এটা স্বীকার করলো যে হুমায়ুন আহমেদের প্রথম দিকের লেখা এবং উল্লেখযোগ্য কিছু লেখা নিজের আনন্দে লিখেছেন, আর কিছু ছিল প্রকাশকদের চাপে লেখা। সেগুলোতে এসেছে অনেক রিপিটেশান, একিরকম চরিত্র।
গুলতেকিন এই বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন "ওর লেখায় বাবারা খুব ভালো মানুষ হয়, মায়েরা তেমন হন না তারপর মেজরিটি তার চরিত্র হিমু না হলেও হিমুর মত বাউন্ডুলে স্বভাবের৷"
হুমায়ুন পাঠক হিসেবে তার উপন্যাসগুলোর থেকেও সায়েন্স ফিকশন গুলো আমার দারুন লাগে। এগুলা অনুবাদ হয় না কেন জানি না! ভালো লাগলো যে শীলা আহমেদ ও একি মত পোষণ করেছেন।
এছাড়া বইটিতে আসিফ নজরুল তার সাথে হুমায়ুন এর পরিচয় হলো কি করে তা নিয়ে আলাপ করেছেন। "কোথাও কেউ নেই" নাটকের উপর লেখা ফিচারটি পড়লে নব্বইয়ের সে সময়ে নাটকটি নিয়ে সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনা সম্পর্কে ভাল ধারণা পাবেন।
সবশেষে আমিও আসিফ নজরুলের মতো বলব- সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র মেগাস্টার। যার জনপ্রিয়তায় কোনদিন ভাটা পড়ে নি।
শত শতাব্দী অতীত। মানুষের সমাজ, সামাজিকতা, সংস্কৃতি, মেধা, মনন, মানসিকতায় সাধিত হয়েছে আমূল পরিবর্তন। অগণিত বিদুষী-বিদ্বান, রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, দানবীর, বিপ্লবী-বিদ্রোহী, খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক ও জনপ্রিয় লেখক সহ নানান পদের জ্ঞানী-গুণীদের জ্ঞানজোয়ার ও গুণজোয়ারে সোনার বাংলাদেশ প্লাবিত। ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে নিশ্চুপ অথচ কম্পনসৃষ্টিকারী প্রতিভা নিয়ে আবির্ভূত হলেন দুই বাংলার পাঠকপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
হুমায়ূন আহমেদকে মন দিয়ে পড়েছে অথচ তার সৃষ্টিকৃত চরিত্রের প্রভাব পাঠকের নিজ সত্তায় আঁচড় ফেলেনি— তা নিদারুণ অবাস্তব ও অন্য দৃষ্টিতে অতি হাস্যকর। তার প্রযোজিত চলচ্চিত্র ও ধারাবাহিক নাটকগুলোও দর্শকমহলে সমানুপাতিক হারে সমাদৃত। 'আগুনের পরশমণি', 'শ্রাবণ মেঘের দিন' দর্শকের হৃদয়ে অত্যাশ্চার্যের রেখাপাত এঁকে দিতে সক্ষম। 'কোথাও কেউ নেই' এর বাকের ভাইকে নিয়ে যা হয়েছিল তা তো এখন বিশ্বাস করাও অবিশ্বাস্য বোধ হয়। দু'বছর আগে কমলাপুর জংশনের পশ্চিমমুখী বইয়ের দোকানে যেদিন উক্ত বইটি ক্রয় করি সেদিন ছলছল চোখে আমার মুখাবয়ব পানে বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন বয়োবৃদ্ধ দোকানি। সব মরে যায় কিন্তু স্মৃতি মরে না।
হুমায়ূন আহমেদ এর জামাতা আসিফ নজরুল রচিত 'কয়েকজন হুমায়ূন আহমেদ' নানাদিক বিবেচনায় অনন্য সাধারণ একটি গ্রন্থ। প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক নানান আলোচনার মাঝে আপনি খুঁজে পাবেন অন্য একজন হুমায়ূন আহমেদকে। সহধর্মিনী ও সন্তানদের প্রতি তিনি আদতে কেমন ছিলেন, অপরপক্ষে তারাও তার প্রতি কী ভাবাপন্ন ছিল তাও সুচারূরুপে ফুটে উঠেছে এই বইটিতে। বিশেষত বাকের ভাইয়ের ফাঁসি নিয়ে তৎকালীন জনমানুষের পক্ষে-বিপক্ষের মতামতসমূহ স্থান পেয়েছে 'ডেটলাইন ২১সেপ্টেম্বর ১৯৯৩ : বাকেরের কি ফাঁসি হচ্ছে' শীর্ষক পরিচ্ছেদে। হুমায়ূন আহমেদ এর লিখিত বইসমূহর প্রথম পাঠক তার কন্যা শীলা আহমেদ এর হৃদয়স্পর্শী একটি সাক্ষাৎকারও বইটিতে খুঁজে পাবেন।
মোটকথা, চিরচেনা হুমায়ূন আহমেদ এর অচেনা দিকগুলো সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়ার জন্য 'কয়েকজন হুমায়ূন আহমেদ' বইটি পড়ার বিকল্প নেই। তার তীক্ষ্ম মেধা, মনন ও পারিপার্শ্বিক অভিরুচির এক জ্বলন্ত প্রমাণপত্র 'কয়েকজন হুমায়ূন আহমেদ'। শেষের শেষে বইটি পড়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলছি— পূর্বোক্ত উক্তিগুলো পাঠকের অভিমত মাত্র, বইটির সার্বিক পর্যবেক্ষণের বহিঃপ্রকাশ নয়।
একজন হুমায়ূন আহমেদ ঘরের মানুষ। তাকে অন্তরঙ্গভাবে দেখেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। একজন হুমায়ুন লেখক আরেকজন নাট্যকার। এই তিন হুমায়ুন মিলে গড়ে তোলেন স্বপ্নের নিবাস নুহাশ পল্লী। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর প্রতিটি ভুবনে আমন্ত্রণ করেছিলেন সেই সময়কার তরুণ সাংবাদিক আসিফ নজরুলকে। লেখক আসিফ নজরুলের লেখনীতে এই বইয়ে ফুটে উঠেছে কয়েকজন হুমায়ূনের এক অতুলনীয় ছবি।
বইটিকে হুমায়ূন আহমেদের জীবনের বিভিন্ন অংশের অজানা গল্প নিয়ে লেখা গল্পগ্রন্থ বলা চলে। লেখক হুমায়ূন আহমেদকে পাবেন অন্তরঙ্গ পরিচয়ে,আবার জানতে পারবেন গুলতেকিন এর সংসারে হুমায়ূন আহমেদ কেমন ছিলেন! ডেটলাইন ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৩, বাকেরের কি ফাঁসি হচ্ছে পিছনের রহস্য! হুমায়ূন আহমেদ সবকিছু মায়ার আদলে করতে ভালোবাসতেন। ঠিক তেমনভাবেই মায়ার আদলে সন্নিবেশিত পুত্র নুহাশের নামে নির্মাণ করেছিলেন নুহাশ পল্লী। এই নুহাশপল্লীকে ঘিরে রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের মাঝে লুকিয়ে থাকা অনেক গুলো নাম না জানা হুমায়ুন আহমেদ এর পরিচয় মেলে। লেখক হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে মায়ার আদলে গল্প লিখতেন প্রতিটি চরিত্র সাধারণ হলেও প্রত্যেকটি পাঠক, চরিত্র গুলোকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারতো। সেই লেখকই কেন অভিযুক্ত হয়েছিলেন আদালতে। সাহিত্য বনাম আদালত হুমায়ূন আহমেদকে যে অভিজ্ঞতার সাথে পরিচয় করিয়ে ছিল তা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
আমার পছন্দের অংশটি হলো,শীলা আহমেদের জবানীতে বলা এবং এই বইয়ে লিপিবদ্ধ হওয়া 'বাবার বইয়ের মধ্যে একটা মায়া আছে ' অংশটি। হুমায়ূন আহমেদ যেকোনো সাহিত্য রচনায় পরেই তাঁর সাহিত্যকর্ম কিংবা বই সবার আগে তার কন্যা শীলা আহমেদকে পড়তে দিতেন। তাছাড়াও তার সকল সাহিত্যকর্ম তার পরিবারের সদস্যদের আগে পড়ত দিতেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রচেষ্টা ছিল, সাধারণ মানুষ তার বইয়ে লেখা গল্পের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারবে কিনা সেটি যাচাই করা। কখনো শীলা আহমেদ বইয়ের মাঝে কোনো ভুল ধরিয়ে দিলে,তিনি রেগে যেতেন! প্রয়োজন হলে সংশোধনও করে নিতেন।
পাঠকের এত ভালোবাসা পাওয়া হুমায়ূন আহমেদ বাবা, স্বামী হিসেবে কেমন ছিলেন সেই গল্পের পসরাও এই বইটিতে সাজানো হয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, বইটি পাঠকের মন ভরিয়ে দিতে পারে। সুন্দর গঠনশৈলী ও প্রাঞ্জল লেখনী পাঠকের কাছে হুমায়ূন আহমেদকে নতুন রুপে পরিচয় করিয়ে দিবে।
বইটি আমি কিনেছি দুইটি কারণে - ১) বইটি হুমায়ুন আহমেদ স্যার কে নিয়ে লেখা। ২) বইটি আসিফ নজরুলের লেখা।
একজন হুমায়ুন আহমেদ ঘরের মানুষ, তাকে অন্তরঙ্গভাবে দেখেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। একজন হুমায়ুন আহমেদ লেখক, আরেকজন নাট্যকার।
লেখক ও নাট্যকার হুমায়ুন আহমেদকে কমবেশি আমরা জানি কিন্তু ব্যাক্তি হুমায়ুন আহমেদ বা ঘরের মানুষের কাছে উনি কেমন তা হয়তো পাঠক বা দর্শক হিসেবে তেমনটা জানিনা।
ঐ আগ্রহ নিয়েই বইটা পড়া শুরু।
বইটিতে মুলত হুমায়ুন আহমেদ স্যারকে নিয়ে বহু আগে আসিফ নজরুলের কিছু প্রতিবেদন ছিল যা তখনকার সময়ে সাম্প্রতিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়। সেসব প্রতিবেদন ও কয়েকটি নতুন লেখা নিয়ে এই বই।
এই প্রতিবেদন পড়ে হুমায়ুন আহমেদ স্যারকে কতটুকু জানা যাবে তা আমার জানা নেই। তবে তার পারিবারিক জীবন নিয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে বলে আমার মনে হয়।
বইটির শেষের অংশে দুটি সংযোজন ছিল।
একটি উনার কন্যা শীলা আহমেদের সাক্ষাৎকার যা হুমায়ুন আহমেদ স্যারের নবম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথম আলো প্রত্রিকায় ১৯শে জুলাই ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়।
দ্বিতীয়টি হুমায়ুন আহমেদ স্যারের।
এই বইয়ে কোন অংশেই হুমায়ুন আহমেদ স্যারের দ্বিতীয় পরিবার নিয়ে একটি লাইনও ছিলনা।
ব্যক্তি হুমায়ূন একজন ভিন্ন মানুষ আর লেখক,নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ আরেক ভিন্ন এক মানুষ! লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ একজন জনপ্রিয় মানুষ। তার পাঠকদের সবসময় আগ্রহ ছিলো তাদের প্রিয় লেখক ব্যক্তি হুমায়ূনকে জানা। সেই হিসেবে লেখক আসিফ নজরুল 'কয়েকজন হুমায়ূন আহমেদ' লিখেছেন। বইটিতে ১৯৯৩ সালে বিচিত্রায় প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন রয়েছে। রয়েছে স্ত্রী গুলতেকিন,কন্যা শীলা আহমেদ তারা হুমায়ূন আহমেদ'কে নিয়ে কি ভাবেন/ভেবেছেন সেসব! রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় নাটক 'কোথাও কেউ নেই' নিয়ে প্রতিবেদন। বইটি মোটামুটি লেগেছে আমার কাছে। খুব বেশি ভালোও না আবার খারাপও না।
একজন হুমায়ুন ভক্ত হিসেবে বইটি আমার মোটামুটি ধরণের ভালো লেগেছে। তবে একটা পর্যায়ে গিয়ে পড়তে বেশ বিরক্তবোধ করেছিলাম। বইটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক যেটি সেটি হলো বইটির প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদটি একটু অদ্ভুত রকমের সুন্দর!
হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখি, চলচ্চিত্র ও নাটক, সাক্ষাৎকার, নুহাশ পল্লী, পরিবার, ব্যক্তিগত জীবন এবং আসিফ নজরুলের সাথে দ্বন্দ্বমধুর সম্পর্ক নিয়ে লেখা হুমায়ূন ভক্তদের জন্য সুপাঠ্য একটা বই।।