Jump to ratings and reviews
Rate this book

গোত্রহীনের ইতিকথা

Rate this book
বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে ছাত্রজীবনেই লেখার পৃথিবীতে আসেন তিনি। যখন তিনি পুতুলনাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝির মতো ধ্রুপদী সব উপন্যাস লিখছেন, রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্যের আকাশের গনগনে সূর্য।

স্বীকৃতির আশায় সময়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ লেখক বই পাঠাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথকে অথচ তিনি এমন বেয়াড়া এবং গোত্রছাড়া—রবীন্দ্রনাথকে পাঠাননি কোনো বই।

একটিমাত্র বই ছাড়া আর কোনো বই কাউকে উৎসর্গ পর্যন্ত করেননি। যেটা করেছেন, সেটাও কোনো ব্যক্তিকে নয়, জনগণের উদ্দেশ্যে।

দেখেছেন দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা। শুনেছেন পরাধীন ভারতবর্ষের আর্তনাদ। স্বজনদের কাছ থেকেও হয়েছেন বঞ্চনার শিকার। স্থাপন করেছেন পিতৃভক্তির বিরল দৃষ্টান্ত।

দু-একটা বিচ্ছিন্ন চাকরি ছাড়া জীবনভর লেখাই ছিল তার পেশা। লিখতে এসে অফিসারের পুত্র তিনি দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছেন। অসুখ-আসক্তি-অভাবের ত্রিমুখী আক্রমণে হয়েছেন বিপর্যস্ত। তবু তার কলম থামেনি এক মুহূর্তের জন্য।

সাহিত্যের পাঠক মাত্রই জানেন, কী ক্লান্ত, বিষণ্ন, বিপন্ন এবং বিপ্লবী জীবন যাপন করে গেছেন মানিক। লেখার জন্য পার্থিব প্রতিষ্ঠার সব হাতছানি নাকচ করেছেন, হয়েছেন নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর, মুখের ওপর বন্ধ হয়েছে স্বজনদের প্রীতির বাতায়ন। তবু ত্যাগ করেননি কলম। এমনই গোত্রছাড়া মানুষ তিনি ছিলেন।

তার জীবন ছিল এমন বেদনাবিধুর, লিখতে গিয়ে বারবার চোখ ভিজেছে লেখকের, অদেখা সেই মানুষটার জন্য বুকের মধ্যে তৈরি হয়েছে হাহাকার। আর তার এমন ইস্পাতকঠিন ব্যক্তিত্ব—সেইসব আখ্যানের বিবরণ দিতে গিয়ে শ্রদ্ধায় নত হয়েছে মাথা।

বাংলাভাষার প্রধান ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জীবনকে যাপন করেননি, করেছেন ইতিহাস যাপন। কথাশিল্পী সাব্বির জাদিদের শক্তিশালী গদ্যে, এই মানুষটির ঝড়ো জীবনের রুদ্ধশ্বাস আখ্যান জানতে আপনাকে স্বাগতম গোত্রহীনের ইতিকথায়।

গোত্রহীনের ইতিকথা মানিকের জীবনী তো নয়ই, নয় ডকুফিকশনও। বরং মানিকের আস্ত জীবন হামানদিস্তায় ফেলে, ভেঙে গুড়ো গুড়ো করে, এক পিওর ফিকশনের রূপ দেয়ার চেষ্টা।

‘গোত্রহীনের ইতিকথা’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস।

360 pages, Hardcover

Published February 1, 2022

3 people are currently reading
57 people want to read

About the author

Ratings & Reviews

What do you think?
Rate this book

Friends & Following

Create a free account to discover what your friends think of this book!

Community Reviews

5 stars
8 (25%)
4 stars
16 (51%)
3 stars
5 (16%)
2 stars
2 (6%)
1 star
0 (0%)
Displaying 1 - 16 of 16 reviews
Profile Image for Titu Acharjee.
258 reviews33 followers
December 31, 2023
“যে জীবন মানিকের,প্রবোধের
আপোষের সাথে তার হয় নাকো দেখা।”

এক যে ছিল মানিক বন্দোপাধ্যায়। তার যে ছিল গল্প....চুপ,চুপ। কোনো কথা নয়। এখন এক দুষ্টু মানিকের গল্প বলবেন সাব্বির জাদিদ। যে মানিক স্কুলের বইপত্র দোকানে জমা রেখে ছুটে বেড়ায় তেপান্তরের মাঠে,বাঁশির সুরের রচনা করে মায়াবী বিভ্রম। গল্পে আসবে গাঁয়ে গাঁয়ে ছুটে বেড়ানোর মানিকের সময়ের দাবীতে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে লেখক হয়ে ওঠার দৃশ্য। একে একে আসবে তার লেখক হওয়ার যাত্রা,শত প্রতিকূলেও মাথা উঁচু রেখে চলা উজ্জ্বল চোখের এক তরুণের গল্প। আসবে তার বাবার গল্প,ভাইদের দেওয়া বঞ্চনা, বিপ্লব,ইতিহাস,স্বপ্ন,স্বপ্নভঙ্গ এবং দারিদ্র্যের দৃশ্য। গল্পের পরতে পরতে জাদুকরের আস্তিনে লুকিয়ে থাকা তাসের মতো লুকিয়ে আছে বিষ্ময়। ঘাসের ভাঁজে লুকোচুরি খেলা খরগোশের মতো লুকোচুরি খেলবে আনন্দ ও বেদনা।

গল্পে শুধু মানিকই নন,একে আসবেন অনেক রথি-মহারথি। আসবেন বিভূতিভূষণ,তারাশঙ্কর, দেবীপ্রসাদ, বুদ্ধদেব বসু ও তার স্ত্রী প্রতিভা বসু প্রমুখ। এমনকি উঁকি দিয়ে যাবেন নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশ ও। কী নেই এই গল্পে, কে নেই এই গল্পে! জীবনের এই গল্পে যেখানে মানিকের পাশাপাশি মূল চরিত্র ছিল মহাকাল। আর গল্পের শেষে? সেটা নাহয় শেষেই জানা যাবে।

গোত্রহীনের ইতিকথা পড়তে পড়তে চমকে চমকে উঠেছিলাম। বহুল ব্যবহৃত Truth is stranger than fiction বাক্যটির জন্ম সম্ভবত এমনসব গল্পের জন্যেই। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবন তার সাহিত্যকর্মগুলোর মতোই অভাবনীয়।

এবার লেখক সাব্বির জাদিদের কথা বলা যাক। মানিককে আঁকতে গিয়ে তিনি সম্ভবত নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন শব্দে,বাক্যে, পাতায় পাতায়। ভাষার কারুকাজ,লেখার মুন্সিয়ানা এমন সাক্ষ্যই দিচ্ছিল। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবন ও কর্ম নিয়ে কেউ যদি একটা বইয়ের পরামর্শ চায়,আমি বিনা দ্বিধায় তাকে ‘গোত্রহীনের ইতিকথা’ পড়তে বলবো। সাব্বির জাদিদ,আপনাকে টুপি খোলা সেলাম।
Profile Image for Shuk Pakhi.
512 reviews307 followers
November 10, 2024
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর জীবনভিত্তিক উপন্যাস।


এ ধরনের বই পড়তে ভালো লাগে তার কারন উল্লেখিত ব্যক্তির জীবন পথের একটা সরলরৈখিক চিত্র পাওয়া যায়। যদিও লেখক সেখানে ঘটনার বর্ণনায় নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে থাকেন।

মানিকবাবুর জন্ম, বেড়ে উঠা, তার দূরন্তপনা, বাঁশি বাজানো, গান গাওয়া, পড়াশোনা, রাজনীতি, বিবাহ, সন্তানাদি, দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, সমকালিন সাহিত্য ছোটপরিসরে সাব্বির জাদিদ সবই তুলে এনেছেন বইতে। মানিকবাবুর মনোজগৎ নিয়ে আলাপ থাকলে আরো ভালো হতো।

বইয়ের প্রডাকশন ভালো, লেখার স্টাইলও ভালো একটানে পড়ে ফেলা যায়। তবে কিছু টাইপো রয়েছে যেটা চোখে লাগে।

১৯৩ পৃষ্ঠায় গিয়ে জানলাম মানিকের বসন্তের দাগেভরা মুখ....কিন্তু বসন্ত কবে হয়েছিলো তার কোন ইতিহাস জানা গেল না।
এরকম টুকটাক আরো কিছু দিকে খেয়াল দিলে ভালো হতো।
Profile Image for Shuhan Rizwan.
Author 7 books1,108 followers
January 9, 2024
1.5

ক) লেখকের রচনা প্রক্রিয়া / লেখালেখির দর্শন
খ) লেখকের ঘটনাবহুল জীবন
গ) লেখকের রচনার প্রতি তীব্র মুগ্ধতা
- কিংবদন্তীর কোনো লেখকের জীবন নিয়ে যদি উপন্যাস লিখতে বসেন পরবর্তী প্রজন্মের কেউ, তবে উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের অন্ততঃ একটির প্রতি তীব্র মুগ্ধতা থাকার কথা অনুজ লেখকের। দুঃখের বিষয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন-ভিত্তিক এই উপন্যাসে অনুজ লেখকের মাঝে তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া গেলো না।

'গোত্রহীনের ইতিকথা'য় মানিকের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো আছে, কিন্তু সেগুলো বর্ণনা করা নিতান্ত-শিশুতোষ জীবনী ধাঁচে। মানিকের নিজের জগতে যা বিরাজমান, তেমন কোন বড় প্রশ্ন পাঠকের মাঝে উদয় হয় না সাব্বির জাদিদের মানিককে পড়তে গেলে। এমনকি মানিকের নির্দিষ্ট কোনো রচনার প্রতি প্রেমও জাগে না পাঠকের। ১৯২৬ সালে মানিকের মনে আধুনিক সাহিত্যের যে শর্ত ঘুরপাক খাচ্ছিলো উল্লিখিত আছে উপন্যাসেই, সেই শর্ত যথেষ্ট অফসাইডে থেকেই ভেঙেছেন সাব্বির জাদিদ।

সাব্বির তরুণ লেখক, জনপ্রিয় বলেও জানি। একটা মসৃণ তৈরি ভাষা আছে তার। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে শ্রমলব্ধ লেখা নির্মাণের সাহস করেছেন তিনি, সে সাহস প্রশংসনীয়। কিন্তু মানিক-মানসের প্রতি সুবিচার তিনি করতে পারেননি।
Profile Image for Pranta Dastider.
Author 18 books328 followers
May 11, 2023
শেষ করলাম গোত্রহীনের ইতিকথা। উপন্যাস হিসাবে মোটামুটি ভালই লেগেছে। তবে ব্যক্তি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে একেবারে পছন্দ হয়নি। চূড়ান্ত রকমের হঠকারী, একগুঁয়ে এবং দাম্ভিক লোক বলে মনে হয়েছে। তার আত্মসম্মান আছে, কিন্তু বাস্তবতার চোখে উঁকি দিয়ে বাস্তবকে সমঝে চলার মতো স্থিরতা নেই। আর সেখানেই তিনি ব্যর্থ। এমন হতে পারে যে জীবনে যেন সাহিত্য নির্মাণের উপাদানে ঘাটতি না পড়ে সেই লক্ষ্য থেকেই কাজটি তিনি করেছেন। তবুও ঘন ঘন এত সন্তান নেওয়ার বিষয়টা ঠিক হজম হয় না। আরও হজম হয় না পেটে ঠিকঠাক ভাত না থাকার পরেও বাড়ি বিক্রির টাকা বিলিয়ে দেওয়ার হঠকারিতা।

এছাড়া বলতে হয় লেখক সাব্বির জাদিদ দুই একটি বিষয়ে বিচ্যুত হয়েছেন। যেমন কোথাও "শিকার" হয়ে গেছে "স্বীকার", যৌক্তিক ভাবে যেখানে "জলখাবার" লেখা প্রয়োজন ছিল সেখানে লেখা হয়েছে "নাস্তা"। তাছাড়া এতবার "ভদ্রপল্লির ঈশ্বর" জাতীয় উপমা টেনে আনা নিষ্প্রয়োজন ছিল। এছাড়া মাঝে মধ্যে করা হয়েছে সরাসরি ভবিষ্যৎবানী, "একদিন তিনি বুঝতে পারবেন ... শেষ জীবনে ভুগবেন ... এই সমস্যা ভবিষ্যতে পীড়া দেবে... " প্রভৃতি। এগুলো আরও কম হলে ভাল হতো। কিংবা না হলেও চলত। কারণ, পাঠক বই পড়তে পড়তে নিজে থেকেই এসব অনুসিদ্ধান্তে চলে আসতে পারত।

তবে, বইটি যথেষ্ট খেটেখুটে লেখা হয়েছে। আর লেখকের গদ্য এতে ঠিকঠাক মনে হয়েছে আমার। দুই একটি যায়গা বাদ দিলে তরতর করে অনায়াসে পড়া যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাইরে গিয়েও সাব্বির জাদিদের বই হিসাবে পড়া যায় এই বই, এবং তাতে বইয়ের তাৎপর্য কিছুমাত্র বাধাপ্রাপ্ত হয় না। লেখকের যে লেখার ক্ষমতা আছে, বইটি এর বড় প্রমাণ।

সুতরাং, মোটামুটি ভালর দিকে রাখছি অভিজ্ঞতার পাল্লা। তবে, যারা বইটি পড়তে চাইছেন তাদের বলব মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি অন্ধ ভক্তি থাকলে বইটি পড়ার আগে দুবার ভেবে নিন। কারণ তিনিও রক্ত মাংসের মানুষ, নিছক কোনও কাল্পনিক চরিত্র নন। তার মধ্যে দোষও ভরপুর আছে, আর সেগুলো আপনার সামনে বইটি পড়ার সময় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেটুকু মেনে নিতে না পারলে পাঠক হিসাবে আপনার ক্ষতি হতে পারে, টলে উঠতে পারে আপনার মনে গড়ে তোলার লেখকের শ্রদ্ধার আসনটা। যদিও সব কিছু ছাপিয়ে কেবল তার সৃষ্টিগুলোর জন্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেঁচে থাকা উচিত। তার ব্যক্তিজীবন পাঠকের মাথাব্যাথা হওয়া উচিত নয়।
Profile Image for Mahadi Hassan.
129 reviews11 followers
September 7, 2022
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত লেখকের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস, লেখকের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল নিঃসন্দেহে। আমি বলবো, লেখক বেশ ভালোভাবেই উৎরে গেছেন। লেখকের ভাষা চমৎকার ছিল, দারুণ ��িল উপমার প্রয়োগ। বর্ননা সুন্দর, স্বাদু। পড়তে বেশ আরাম লেগেছে। তবে, হোটেল ওয়ালি কপিলার অংশটুকু আমার কাছে আরোপিত এবং অতি নাটকীয় লেগেছে। তেমনি ভালো লাগে নি প্রতি অধ্যায়ে লেখকের ভবিষ্যতবাণী টাইপ স্বগতোক্তি, ভবিষ্যতে মানিক এই করবে, সেই দেখবে, বাংলার মানুষ এটা করবে, ওটা করবে। এইটুকু না থাকলেই বোধহয় ভালো হত, বাহুল্য বোধ হতো না।

তবে সব মিলিয়ে অবশ্যই দারুণ একটা উপন্যাস। মানিকের জীবনে উঁকি দিয়ে দেখতে চাওয়ার আগ্রহ থাকে যদি।
Profile Image for Ahmed Rabbi.
16 reviews
December 21, 2023
• গোত্রহীনের ইতিকথা

•কিছু কথা▪

আজ হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলের জন্মঠিকুজির দিন। ঠাকুর মশাই পাটিতে বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন। দিনক্ষণ ও গ্রহ-নক্ষত্র বিবেচনা করে গণক নাম রাখলেন— অধরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। হরিহরের নাম পছন্দ হয়নি। তিনি বললেন আমি ছেলের জন্মের দিনই তাকে প্রবোধকুমার বলে ডেকেছি। ছেলেকে এই নামেই ডাকবো। এই নামটাই মানানসই।

বাবার দেয়া নামই থেকে গেলো। মায়ের দেয়া কালো মানিক নামটা কী পড়েই থাকবে। ঘরের দাওয়ায়। না পড়ে থাকবে না। মায়ের দেয়া নামেই কালো মানিক থেকে কালো শব্দটি পড়ে গিয়ে জগদ্বিখ্যাত হবে মানিক নামটি। গণকের দেয়া ভবিষ্যৎ বাণী "আপনার অমৃত্স্য পুত্রাঃ" যে এই ছেলে! জগৎজোড়া নাম করবে। কিন্তু হরিহরের গণক ঠাকুরের প্রতি বিশ্বাসের জায়গায় অবিশ্বাসের শিকড় গেঁড়ে বসেছে তারই জীবনের এক ভবিষ্যৎ নিয়ে বলেছিলো এক গণন। কিন্তু ভবিষ্যৎ বাণী হরিহরের জীবনে ফলেনি। এ নিয়েই হরিহরের যেমন কষ্ট অবিশ্বাস তেমনি গণক, ঠাকুর, পুরোহিতদের প্রতি তার অবিশ্বাস।

মানিক বড়ো হলো। দুরন্তপনা, ডানপিটে স্বভাব। একরোখা অভ্যাস। বাবার প্রবোধকুমার। মার কালো মানিক। আদরের সন্তানের চরম দুরন্তপনা ডানপিটে স্বভাব তাদের ভয় পাইয়ে দেয়। আবার এ'ছেলে কী না এতোটুক বয়েসে ছড়া কাটে! নীরদা দেবী দৌড়ে এসে হরিহরকে বলেন ছেলের ছড়াকাটার কথা। তখন হরিহর বলেন আমার ছেলের অনেক দুঃখ হবে।

মানুষের জীবন বড়ো বিচিত্র ও বৈচিত্র্যময়। জীবনের অনুঘটক ঘটনাগুলো ঘটে যায়। যার চিত্রপট স্মৃতি হয়ে ভেসে বেড়ায়। কিছু কিছু কথা ও স্মৃতি অগ্রজের জন্য অতিত ও স্মৃতি। অনুজের বেলায় তা ভবিষ্যৎ। হরিহরের কথাগুলো মানিকের জীবনে সত্য হয়ে ধরা দিলো। আর মানিকের জীবনে দুঃখরা পসরা সাজিয়ে বসে পড়তে শুরু করলে। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানিক দুঃখ দূদর্শা ও অভাব অনটন, রোগবালাই উপেক্ষা করে সৃষ্টি করলেন বাংলা সাহিত্যের নতুন অধ্যায়। যা আজো বাংলা ও বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও ঋদ্ধ করছে।

•শুরুর শেষাংশ ▪

বাবার মতো তিনিও অবিশ্বাসের ধারায় বাড়তে থাকেন। ঈশ্বর কী তবে ওই ভদ্রপল্লির ?
প্রবোধকুমার বাবার দেয়া নাম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণ্ডির ভিতর সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
মায়ের দেয়া কালো মানিক। কালো শব্দটি বাদ দিয় জুড়ে দেন 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়'। পত্রিকায় ছেপে আসা "অতসী মামি" গল্পের লেখক হয়ে 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়' নামে জীবন শুরু হয় লেখক জীবন। এরপর পর্যায়ক্রমে আসতে থাকে "পদ্মা নদীর মাঝি" "পুতুল নাচের ইতিকথা" "জননী" ইত্যাদি। ধ্রুপদি এইসব উপন্যাসগুলির গায়ে মানিক নামটি বহন করে মায়ের দেয়া নামকে জগদ্বিখ্যাত করে তুলেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়!

•বইয়ের নাম ও প্রচ্ছদ ভাবনা ▪

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন লেখক। তখন বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবিত। তিনি বাংলা সাহিত্যের আকাশের গনগনে সূর্য। হাজার লেখক উনার নামে বই পাঠাচ্ছেন স্বীকৃতি পাবার আশায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পাঠালেন না একটি বই বা কোনো গল্পের ক্ষুদ্রাংশ পযর্ন্ত। এজন্যই তিনি গোত্রহীন।

বন্ধু জয়ন্ত যখন সম্পাদক মহল নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। বন্ধুর পক্ষ না নিয়ে সম্পাদকের হয়ে কথা বলতে শুরু করে মানিক। এই বলাবলি রূপ নেয় তর্কাতর্কিতে। সেখানেই বাজিমাত করে বসেন মানিক। যে একটা গল্প পত্রিকায় দিবে। যদি ছেপে আসে জয়ন্ত পাঁচ টাকা দিবে। তর্কাতর্কিতে সম্পাদকের পক্ষে কথা বলেলেন। বন্ধুর পক্ষ হয়ে কোনে কথা বলেননি। এজন্য তিনি গোত্রহীন।

•আমার পড়ার অনুভূতি ▪

আমার পছন্দের তালিকায় গল্প, উপন্যাসের পাশাপাশি আত্মজীবনী জনরার বইগুলো পড়তে খুব ভালো লাগে ও অনেক পছন্দের। উপন্যাস বা গল্প যদি কোনো ঐতিহাসিক ঐতিহ্য বা ব্যক্তি বিশেষ গল্প উপন্যাস হলে তো কথায় নেই…! বইটা হাতে নেয়ার পর। বইটা রেখে অন্যকিছু পড়বো বা লেখবো কিছুই মনে করতেই পারছিলাম না। বইয়ের প্রতিটা পাতা আমার জন্য একএক নতুন অনূভুতি সূচনা করছিলো। একপৃষ্ঠা শেষ করে অপর পৃষ্ঠার জন্য যে অপেক্ষা করতে হতো আমার কাছে সময়টা অনেক লম্বা মনে হতে লাগতো। বিশেষত করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অন্তত দূরন্তপনা ও ডানপিটে স্বভাবের তাই অপর পৃষ্ঠায় থাকা রহস্যময় টুইস্ট জানতে মন উতলা হয়ে থাকতো।

•বইটি কেনো পড়বেন?▪

একজন লেখক, একজন মানুষ ও মানব। তার মাঝে মানবীয় স্বভাব চরিত্রের বাইরে অতি মানবীয় কিছু নেই। প্রত্যকটা মানুষ যেভাবে মায়ের কোলে বেড়ে ওঠে এবং একদিন মৃত্যুবরণ করে। তেমনি করে একজন লেখক মায়ের কোলে বেড়ে ওঠে তারপর তারও মৃত্যু হয়। মানুষের বিয়ে, সংসার, সন্তান-সন্ততি, জীবন-যাপন পরিচালনার জন্য ধন-সম্পদের যেমন প্রয়োজনীয়। লেখকদেরও জীবনের ধনসম্পদ প্রয়োজনীয়। তো, একজন লেখক সাধারণ মানুষের মতোই জীবন-যাপন অতিবাহিত করে। তাদের বিয়ে, সংসার, সন্তান লাপালন করা। যাবতীয় কাজে ধন সম্পদ সহ। বেঁচে থাকার জন্য একজন লেখক আয়রুজি কীভাবে করে? একজন লেখক, একজন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কেমন করে বনে গেলেন। তারই ইতিকথা এ'বইয়ে এক মলাটে পাবেন। রক্তমাংসের গড়া এই মানুষের জীবনাচরণ কেমন ছিলো। তিনি কীভাবে উনার সময়গুলো কাজে লাগাতেন। কীভাবে বাঙলা সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হয়ে গেলেন।
আপনি তো "পদ্মা নদীর মাঝি" বইটি পড়ছেন। পড়ে না থাকলেও বইয়ের নামটা অন্তত শুনেছেন। এটাও যদি না শুনে থাকেন তাহলে এই ভইয়ের উপর নির্মিত চলচ্চিত্র দেখেও থাকবেন হয়তো! ওই বইয়ের কুবের ও কপিলা চরিত্রকে কতসুন্দর ও মার্জিতভাবে তুলে ধরলেন। তা কখনো আপনি ভেবেছেন?
আচ্ছা! মানিক বাবু তাদের কখনো দেখেছেন কী?

•বই ও লেখকের গদ্যের মান ▪

সাব্বির জাদিদ ভাইয়ের চমৎকার শক্তিশালী গদ্য। সাবলীল ও মনোরম এক গদ্যের যে টোন অনুভব করেছি এক কথায় অসাধারণ! উপন্যাসের আখ্যান দিতে গিয়ে ভাষার মার্ধুযতা ও শ্রুতিমধুর ছন্দের তালে তালে উপমার ফুলঝুরির টানে কখন যে "গোত্রহীনের ইতিকথা"পড়ে ফেললাম আমি তো বলতে পারবেন না। আপনি জানবেনই না। একদিকে মানিকবাবুর বৈচিত্র্যময় জীবন। আনন্দ সুখের ব্যাঞ্জনায় হৃদয় যখন হেসে উঠে। পরক্ষণে দুঃখ কষ্টের যাতনায় হৃদয় মুষড়ে উঠে কেঁদে দেয়। মানিকবাবুর বৈচিত্র্যময় জীবন যাপনের ছবি ও দুঃখ কষ্ট অনুভব করে যদি পড়তে চান। অবশ্যই আপনাকে লেখকের "গোত্রহীনের ইতিকথা" পড়তে হবে।

•বইয়ের ছাপা ও বাঁধায় নিয়ে কিছু কথা▪
বইয়ের ছাপা অন্যান্য বইয়ের মতো হলেও। ঐতিহ্য প্রকাশনী এই বইয়ের দু'রকম ছাপা এনেছে। অফসেট পেপার ও নিউজপ্রিন্ট। দুটো বই হার্ডবাঁধায় ভালো মানের বাঁধায় হওয়ায় বই নষ্ট হয়ে যাবার মতো কোনো ভয় নেই।

•বই – গোত্রহীনের ইতিকথা।
•লেখক – সাব্বির জাদিদ।
•জনরা – জীবনভিত্তিক উপন্যাস।
•প্রকাশনায় – ঐতিহ্য।

রিভিউ— আহমদ রাব্বী
মাহাদুস সুন্নাহ, আশকোনা, দক্ষিণ খান, ঢাকা।

২০ আগস্ট ২০২৩ ঈসায়ী।
০৪ সফর ১৪৪৫ হিজরি।
2 reviews2 followers
Read
July 14, 2022
গোত্রহীনের ইতিকথা: আজন্ম দুঃখী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনেতিহাস

"গোত্রহীনের ইতিকথা" বাংলা সাহিত্যে‌ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ��ীবনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস। ইতিপূর্বে মানিককে নিয়ে নানাবিধ কাজ হলেও তার জীবনাশ্রিত কোন উপন্যাস ছিল না। সেই অপূর্ণতা লেখক সাব্বির জাদিদ খুব ভালো ভাবেই পূর্ণ করেছেন এবং এই কাজটি তার সাহিত্য-মুকুটে আরো একটি পালক যুক্ত করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।গোত্রহীনের ইতিকথা পাঠককে গভীর এক মমত্ববোধে খুব কাছ থেকে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানার সুযোগ করে দিবে।

সাহিত্যের রসে এবং উপমার মাধুর্যে লেখক ১৬৫ পৃষ্ঠা নাগাদ ফুটিয়ে তুলেছেন মানিকের জন্ম, শৈশবের দুরন্তপনা, বাবার চাকুরীর সুবাধে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, মানুষের জীবন-উপন্যাসকে খুব কাছে থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া, সমাজের কথিত ভদ্র শ্রেণীর মেকি জীবনাচরণের পরিবর্তে সর্বদা নিম্ন শ্রেণীর অকৃত্রিম ভালোবাসার ডোরে নিজেকে আবদ্ধ করা এইসব কিছু। এককথায় মানিকের লেখক জীবনের বুনিয়াদের সময়কালটিই লেখক এঁকেছেন সুনিপুণ কারিগরের মত করে।

এই সময়েই দুরন্ত স্বপ্নচারী মানিক জেলেদের সাথে নৌকা করে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হবেন। সেখানে যমুনা নদীর তীরে সাক্ষাৎ হবে বাংলা সাহিত্যের অমর চরিত্র কাপিলার সাথে। ঠিক এই সময়েই মানিক নিজেকে আপামর জনতার সাথে একাকার করে মিশে যাবেন, স্কুলে না গিয়ে বিনুদার সাথে ঘোড়ার গাড়িতে করে চলে যাবেন বহু দূরে, বাঁশি বাজানো ও গান গাওয়ার জন্য রাত বিরাতে ছুটে যাবেন পাড়া গাঁয়ে। এই সময়েই মানিকের মনে গেঁথে যাবে জীবনকে শুধু "ভদ্র শ্রেণীর" চশমায় দেখা চলবে না বরং জীবনকে দেখতে হবে মাটির একদম কাছ থেকে। কারণ জীবন হলো আলো-আঁধারের এক মিশেল। এখানে সম্পূর্ণ ভালো কিংবা সম্পূর্ণ খারাপ বলতে কিছু নেই।

যে সাহিত্যিক একদা লিখবেন "ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লিতে" তার জন্য এমন প্রস্তুতি যে বড্ড প্রয়োজন।

লেখালেখি মানিক করবেন তা স্থির করেছিলেন ছোটবেলাতেই। কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল আগে কোথাও থিতু হয়ে তারপর শুরু করবেন এই পথে যাত্রা। কিন্তু যে সাহিত্যিকের নাম কিছুদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্রের সাথে উচ্চারিত হবে, প্রকৃতি তাঁকে সাহিত্য সৃষ্টি থেকে বেশিদিন দূরে রাখেনি, রাখতে পারেনি।

১৯ সালে মাত্র বছর বয়সে বন্ধুর সাথে বাজি ধরে লিখে ফেললেন তাঁর বিখ্যাত গল্প "অতসীমামী"।এরপর আর পিছনে ফেরা নয়। একে একে লিখে ফেলেন প্রাগৈতিহাসিক, জননী, দিবারাত্রির গল্প, পদ্মানদীর মাঝি,পুতুল নাচের ইতিকথা সহ বিখ্যাত সব ছোট গল্প ও উপন্যাস।

কিন্তু সাহিত্য সাধনায় উৎসর্গ মানিক জীবন-সংসার চালাতে হিমশিম খেয়েছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী হ‌ওয়া সত্ত্বেও অনাহারে-অর্ধাহারে, রোগে-শোকে যাপিত জীবন পার করেছেন শুধু সাহিত্যকে ভালোবাসার কারণেই। বড় ভাই বিজ্ঞানী। অনেক টাকা মাইনে। অন্যজন নামকরা ডাক্তার, বাকিরা ব্যবসায়ী। সবার জীবনে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও আমাদের গল্পের নায়ক স্বেচ্ছায় জড়িয়ে নিয়েছেন দারিদ্র্যের কন্টক-মাল্য।

বাংলা সাহিত্যের এই মুকুটহীন সম্রাট মৃগী রোগের কারণে প্রায়শই অবচেতন হয়ে যান কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারেন না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অস্থির সময়ে মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে কমিউনিস্ট দলের সাথে যুক্ত করেন, পঞ্চাশের মন্বন্তরে ধারা-পরিবার নিয়ে কোনরকম টিকে থাকেন কলকাতায়।

কিন্তু একসময় বাংলা সাহিত্যের তৎকালীন জীবন্ত কিংবদন্তী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থাভাবে কলকাতা ছেড়ে দূরে দুই রুমের বাসা ভাড়া নেন। শহরের ক্রমবর্ধমান জীবন ব্যয় এবং বড়লোক ভাই ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে দূরে থাকতেই যে এই সিদ্ধান্ত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জীবনের শেষ দিনগুলোতে বাজার করার, ঔষধ কেনার, ছেলেমেয়েদের স্কুলের বেতন দেয়ার‌ও সামর্থ্য ছিল না মানিকের। এত কিছুর পরও নিঃশ্বাস বন্ধ হ‌ওয়ার আগ পর্যন্ত মানিকের লেখা থামেনি। মৃত্যুর আগে লিখে গেছেন ৪০টি উপন্যাস, ৪০০ টি ছোটগল্প, ২০ টি প্রবন্ধ, অপ্রকাশিত অনেক কবিতা এবং শেষ ১২ বছরের ডায়েরি।

শেষবার যখন মানিক মৃগী রোগের কারণে অজ্ঞান হলেন তখন তাকে হাসপাতালে নেওয়ার মতো কোনো অর্থকড়ি ঘরে ছিল না। দুইদিন পর্যন্ত মানিক আধো জ্ঞানে পড়েছিলেন নিজ বাড়িতে। বৃদ্ধ পিতা ছাড়া অন্য কোন পুরুষ মানুষ না থাকায় স্ত্রী কমলা দেবীও সাহস করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি। দুইদিন পর এক ভাঙা এম্বুলেন্সে করে মানিককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু ততক্ষণে মানিক অনন্তকালের পথে অনেক দূর চলে গিয়েছিলেন।

নিরাপদ ভবিষ্যত রেখেও সাহিত্যের জন্য স্বেচ্ছায় দারিদ্র্য বরণ, প্রথা বিরোধী "ভদ্রলোকের" সাহিত্য রচনার পরিবর্তে গণমানুষের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি, মানবতার মুক্তির জন্য সক্রিয় বাম রাজনীতিতে যোগদান এসবকিছুই একরোখা ও প্রচন্ড জেদি মানিককে করেছিল গোত্রহীন। সেই গোত্রহীনের ইতিকথাই আমাদের বলেছেন লেখক সাব্বির জাদিদ।

এবার ব‌ই নিয়ে খুব অল্প কথায় কিছু বলা যাক। ব‌ইটি পড়লেই যে কোন সচেতন পাঠকের সামনে কতগুলো জিনিস উদ্ভাসিত হবে। যেমন;

১. উপমার ব্যবহার।
লেখকের উপমার ব্যবহার আপনার মন-প্রাণ ছুঁয়ে যাবে। কথোপকথনের মধ্যে এমন সব নিত্য দিনের উপমা চলে আসবে, মনে হবে এই উপমাটি এই কথার জন্য‌ই সবচেয়ে উপযুক্ত।

২. লেখার ধরণ।
মেদহীন ছোট ছোট বাক্যে সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলবে উপন্যাসের গতিধারা। পাঠক কখন যে উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রকে চোখের সামনে দেখতে পাবেন নিজেই জানবেন না।

৩. তথ্যের সমাহার।
উপন্যাসের খাতিরে নাটকীয় ভঙ্গিমায় নানা ঘটনা উপস্থাপন করতে হয়েছে লেখককে কিন্তু তথ্যের সাথে আপোষ করে নয়। লেখক দেখিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে বিপুল তথ্যকেও সাহিত্যের রসে সিক্ত করা যায়।

৪. সময়কে ধারণ।
লেখক ১৯০৮-৫৬ এই বিস্তৃর্ণ সময়কে ধারণ করেছেন, এর গভীরে ডুব দিয়েছেন। সেজন্যই লেখক তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতি সবকিছুর সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছেন।

৫. সর্বোপরি কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ঠিক রেখে পার্শ্বচরিত্র গুলোকেও দিয়েছেন যথাযথ স্থান।

সবশেষে বলব, যারা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানতে চান তারা তো ব‌ইটি পড়বেনই কিন্তু যারা নিখাদ উপন্যাস ভালোবাসেন তারাও ব‌ইটি পড়ে নিরাশ হবেন না। কেননা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনালেখ্য কোনভাবেই কোন উপন্যাস থেকে কম রোমাঞ্চকর ছিল না, গোত্রহীনের ইতিকথার প্রতিটি পৃষ্ঠা যার সাক্ষী।

ব‌ইয়ের নাম: গোত্রহীনের ইতিকথা
লেখক: সাব্বির জাদিদ
প্রকাশক: ঐতিহ্য
মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০৳ (নিউজ প্রিন্ট সংস্করণ)
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২২
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩৬৬
Profile Image for Tanbeer Ahmed.
35 reviews26 followers
June 19, 2024
চিরদু:খী মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবনকে চোখের সামনে দেখছিলাম আর মর্মাহত হচ্ছিলাম। অর্থাভাবে, রোগে ভুগে একটি জ্বলন্ত তারা যেন অতি দ্রুত নিভে গেলো।
Profile Image for Sazzad Hossain.
22 reviews
December 16, 2023
নীলরতন হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে নীরব বারান্দায় হঠাৎ সাতসকালে এক যুবক কার মৃত্যসনদ নিয়ে যেন দৌড়াদৌড়ি করছেন। জোরালো কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন, মৃত্যুর কারণ অধিক মদ্যপান নয়; মৃত্যুর কারণ মৃগীরোগ। এই চিৎকার চেঁচামেচিতে জবুথবু এক বৃদ্ধার ঘুম ভেঙে গেল। যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বৃদ্ধা তার নাতনীকে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে রে খুকি? কারা চিৎকার করে? এটা কি চিৎকার করার জায়গা? বিরক্ত কিশোরী ঘুমের জড়তা কাটিয়ে জবাব দেয়, সম্ভবত কোনো কবি মারা গেছে। সেই দুঃখে আরেক কবি চিৎকার করছে। হাসপাতাল তো মরারই জায়গা। অচিরেই সেই কিশোরী সাহিত্যের মনোযোগী পাঠক হবে। সাহিত্যের ডানা মেলতেই জানতে পারবে ১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করা মানুষটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর হাসপাতাল তোলপাড় করা ব্যক্তিটি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। সেদিনের বিরক্ত হওয়া নিয়ে কিশোরী জীবনভর পুড়বে।

পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একপাল সন্তানাদি নিয়ে বসবাস ছিলো গোটা ভারতবর্ষে। মানিকের বেড়ে উঠা দুমকা শহরে। এই শহরের আলো হাওয়ায় ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে কৈশোর পেরুতেই কত যে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরে উঠেছে তাঁর জীবন। বটির ওপর পড়ে পেট কেটে যাওয়া, আগুনগরম রসগোল্লায় মুখ পুড়ে যাওয়া, কাঁকড়া ধরতে গিয়ে কাদায় ডুবে যাওয়া, আলমারির নিচে পিষ্ট হওয়া, সুবোধকে কুয়ায় ফেলে দেওয়া; এসব ঘটবে জেনেই হয়তো গণক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলো আপনার এই ছেলে বিশেষ নাম করা কেউ হবে।

তুখোড় মেধাবী মানিকের ছিলো স্কুলের প্রতি অনীহা। অ্যাকাডেমিক পাঠের চেয়ে বাস্তব জীবনের পাঠ বেশি আকর্ষণ করতো। তাইতো মানিক মাকে না বলে গায়েব হয়ে যায়, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিধুদার সাথে নৌকাভ্রমণে যায়। গাঙের পাড়ে কপিলার হোটেলে খেতে গিয়ে রাত কাটায়। পুরো জীবনটাই মানিকের বিচিত্র অভিজ্ঞতার রেলগাড়ি। বাবার বদলি জীবনও সেখানে তুলেছে জোয়ার। ভাইবোনেরা জীবনের বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়, মানিক পড়ে রয় সাহিত্যের একলা জগতে। 'একদিন সাহিত্য দিয়ে বিশ্ব পাল্টে দিবে' এরম চিন্তায় মানিক যখন কলম ধরে তখন জীবনের দুই তৃতীয়াংশ কেটে যায়। শরীর ভেতর ধরে পচন।

'অতসী মামী' গল্প যখন প্রকাশের পর সাহিত্যমহল বলতে থাকে, শরতের পর আরেকজন লেখক এলো যার হাতে সাহিত্যের পালাবদল ঘটবে। এদিকে দারিদ্র্য উঠেছে তুঙ্গে। বাবার বয়স হয়েছে, ভাইবোনদের ব্যস্ত জীবনে মানিকের ঠায় নাই। এরিমধ্যে মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে 'জননী'(প্রথম উপন্যাস) উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি বেচে দেয়। বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লেখে গেলেও মানিক বড্ড হিমশিম খাচ্ছে জীবনধারণে। সাহিত্যের জন্য তিনি যে আসলেই দারিদ্র‍্যকে বরণ করেছেন সে সত্য উপলব্ধ হয়, যখন যুবক বয়সে মৃগীরোগ ধরা পড়ে। এর পরবর্তী করুণ জীবিনের বর্ণনায় বইয়ের বাকি অংশ ভরে উঠেছে। খাওয়া না খাওয়ায় দিন কাটানো, দারিদ্র‍্যের জন্য চিকিৎসার অভাব, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেপরোয়া জীবন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঘাত, যুদ্ধপরবর্তী দুর্ভিক্ষ। মানিকের জন্য এই পৃথিবী কোনো করুণা করেনি, তাঁর সৃষ্টি সে কথা বলে।

সাহিত্যের জন্য স্বেচ্চাদারিদ্র‍্যবরণকারী মানিক চাইলেই অন্য এক প্রতিষ্ঠিত জীবন পেতো, যেমন পেয়েছিলো তার সহোদরেরা। কিন্তু আমরা পেতাম না পদ্মা নদীর মাঝি, দিবারাত্রির কাব্য কিংবা পুতুলনাচের ইতিকথার মতো কালজয়ী উপন্যাস। তিনি শরৎ-বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ থেকে বেড়িয়ে মানুষের বাস্তব জীবন আঁকতে চেয়েছিলেন। নিপীড়িতদের আর্তনাদ শোনাতে চেয়েছেন। তাঁর সৃষ্টির বেশিরভাগই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি নিয়েছেন। প্রকাশকরা লেখা ফিরিয়ে দিলেও মানিক তাঁর লেখা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তাঁর লেখা প্রকাশিত হবেই। একটা কথা মানিক বলতেন, ত্রিশের আগে যেন কেউ লেখালেখি না করে আর একমুঠো অন্নের সংস্থান না করে কেউ যেন লেখতে না আসে। দুইটারই উত্তর মানিকের জীবন।
Profile Image for Shariful Hasan.
5 reviews1 follower
February 9, 2024
বুক রিভিউ : গোত্রহীনের ইতিকথা
লেখক : সাব্বির জাদিদ
প্রকাশক : ঐতিহ্য
জনরা : জীবনভিত্তিক উপন্যাস

"জীবনে মেনে নিতে হয় বা মানিয়ে নিতে হয় কিংবা নিয়ম ভাঙতে হয়" - নিয়ম ভেঙে নিজের নিয়মে ইতিহাস গড়া গোত্রের লোক মানিক বন্দোপাধ্যায়। গোত্রের বাইরে গিয়ে সমস্যাবলি চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের পথ খুঁজলে ইতিকথা লেখার মতো ইতিহাসের সৃষ্টি তো হবেই। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবন তেমনই এক ইতিহাস, এক বিপন্ন বিস্ময়ের ইতিকথা।
সার্থক নামকরণের সাথে তাঁর কঠিন জীবনকে দরদ দিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ সাব্বির জাদিদ ভাইকে।
১৯০৮ থেকে ১৯৫৬ ; ৪৮ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবন অথচ বিচিত্র সব অভিজ্ঞতায় সুদীর্ঘ এক আখ্যান লিপি।

বিপুল বিস্ময়ে পাঠক সমাজ উপলব্ধি করবেন যে মানিক বন্দোপাধ্যায় হওয়ার জন্য যে জীবন, তাতে প্রমোদভ্রমণ না থাকলেও রয়েছে দারিদ্যের দৈন্য দশার ভরপুর প্রমাদ৷ দারিদ্যের কষাঘাতে সে জীবন এতই জর্জরিত ছিলো যে একবার উনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, "পর্যাপ্ত ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা না করে কেউ যেন সাহিত্যচর্চা করতে না আসে"৷ অথচ সাহিত্যের প্রথম ধাপে পা দিলেই উনার অবদান চোখে পড়ে৷

বাংলা সাহিত্যে অদ্ভূত একটা ব্যাপার আছে ; গল্প বা উপন্যাসের নায়ক মাত্রই মানবিক বা চারিত্রিক দোষত্রুটিমুক্ত থাকবে, থাকলেও তা উপন্যাসের প্লটে উপেক্ষিত, যেন ইউটোপিয়ার জগৎ থেকে নেমে আসা কেউ। এই তালাবদ্ধ ঘরের জানালা খুলে বাইরের উন্মুক্ত আলোয় উঁকি দিয়েছেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। তার রচনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দোষমুক্তির ঊর্ধ্বে না গিয়েই মানুষ তার স্ব স্ব জীবনের নায়ক৷ সেখানে দিনের যেমন কাব্য থাকে, রাতেরও থাকে আখ্যান ; নায়ক কখনও মানুষ হয়ে ভাবে দেশ ও দশের কথা, সমাজ ও সংহতির কথা, কখনও পুতুল হয়ে নাচে সামাজিক অনাচারের আয়োজিত রঙ্গমঞ্চে। মা যে এমন নির্লিপ্ত নির্বিকার হয়েও সুন্দর, 'জননী' না পড়লে হয়তো জানা হতো না কখনও।

মধ্যবিত্ত মানেই দ্বৈতনীতির অপূর্বায়নে কেমন যেন অন্যের জন্য বাঁচা জীবন, মন্দ এখানে ভালো হয়ে নিজেকে চালায়, দরিদ্র এখানে দীনতা দেখাতে ইসস্তত বোধ করে ; ভেতরে যাই হোক, উপরে সস্তা রঙের পলেস্তারা আবরণ, অল্প একটু রোদ উঠলেই ফ্যাকাশে হয়ে যাবে যে রঙ৷ মধ্যবিত্ত সমাজের মুখোশের আড়ালে ভালো সাজার বা নিজেকে ঢেকে রাখার যে কুকুমার বৃত্তি, মানিক বন্দোপাধ্যায় তা খুলে দিয়েছেন কলমের কড়াঘাতে৷ এজন্যেই তার গল্প-উপিন্যাসের চরিত্রগুলো নদীর পাড়ের, চরের, শহরতলীর বস্তির বা এরকমই সমাজের নিম্নজীবী মানুষেরা৷

বিষণ্ণ মন আর ক্লান্ত চোখে তিনি দেখেছেন দু'দুটো মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা ; অনুভব করেছেন পরাধীনতার ভার, স্বাধীনতার গ্লানি৷ সংক্ষিপ্ত এক জীবনেই তিনি অতি গুরুত্বপূর্ণ অথচ ব্যথিত সব ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছেন৷
বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে সাহিত্যের জগতে পদার্পণ করে বাজিতে জিতে গেলেও জীবন জুয়ায় হেরে গেলেন মাতাল লেখক খ্যাত মানিক বন্দোপাধ্যায়, তবে নিজে হেরেও জিতিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে, সমৃদ্ধির সুবর্ণ শিখরে পৌঁছেছেন বাংলা সাহিত্যকে, এখানেই তার জয়, চাহিত সফলতার একাংশ, সুকুমার বৃত্তির দীপ্ত পদরেখা৷

এবার আসি লেখকের লেখার বিষয়ে৷ সাব্বির জাদিদ ভাইয়ের ভাষাশৈলী চমৎকার, তবে পড়ার সময় বারবার পরের ঘটনা আগেই ইঙ্গিত দেওয়ার বিষয়টা একটু পাঠ্যকটু লেগেছে৷ তাছাড়া মানিক বন্দোপাধ্যায়ের জীবনদর্শনকে পাঠকের চোখের তারায় দর্শনীয় করার ব্যাপারটা উপেক্ষিত মনে হয়েছে৷ আজীবন আপোষহীন লেখকের জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে কোথাও না কোথাও আপোষ করা হয়ে গেছে। কোনো বই পড়ার সময় যদি পাঠকের ভাবনার দুয়ার খুলতে না পারে, বারবার পড়া বন্ধ করে ভাবতে বাধ্য না করে, তবে কোথাও না কোথাও সেই বইয়ের সাহিত্যিক মান নিয়ে ��্রশ্ন থেকেই যায়৷

ব্যক্তিগত রেটিং : ৩.৫/৫
Profile Image for Sumaiya Jesmin.
5 reviews
April 2, 2025
১৯০৮ সালের ১৯ মে সাঁওতাল পরগনা দুমকায় জন্ম নেওয়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের একটা কালজয়ী নাম।
জন্মঠিকুজি করার সময় গণকের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য করে মানিক বন্দোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন "অমৃতস্য পুত্রাঃ", তিনি দুনিয়ায় জোড়া নাম করে জগদ্বিখ্যাত হয়েই আছেন।

ছোটবেলা থেকেই মানিক ছিলেন বাকি সব ভাই-বোনের চেয়ে চঞ্চল। মাছের বটিতে পেট কেটে ফেলা, কয়লায় পা পুড়িয়ে ফেলা, চোরাবালিতে আটকে যাওয়ার মতো দুর্ঘটনা তার চঞ্চলতা অন্যতম সাক্ষী হয়ে আছে। ছোটবেলা থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় ভালো ফলাফল করলেও তিনি ছিলেন বিদ্যালয় বিমুখী। বিদ্যালয়ের একঘেয���ে রুটিনের থেকে আর কাছে প্রিয় ছিলো বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো, বিভিন্ন পেশার মানুষের সাথে মেশা। জেলেদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে টাঙ্গাইলে যমুনা তীরে তার পরিচয় ঘটে কপিলার সাথে, যে পরবর্তীতে "পদ্মা নদীর মাঝি"-তে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পায়।

লেখক হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই হয়তো মানিক ছিলেন অনুভূতি প্রবল। প্রকৃতি,মানুষের মনের ভাষা তাই তাকে অনেক স্পর্শ করতে পারতো। জীবদ্দশায় দেখেছেন দু-দুটো মহাযুদ্ধ, দেখেছেন দুর্ভিক্ষ। শ্রেণিবৈষম্যের জাতাঁকলে পিষ্ট গরীব দুঃখীদের জন্য তিনি বিপ্লবী হয়েও উঠেছিলেন। নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়েও পার্টির জন্য নিজের উপার্জনের একটা অংশ দিয়ে দিতেন, দিয়েছিলেন বাবার সম্পত্তি থেকে পাওয়া পুরো টাকাটাও। স্বভাবে ছিলেন প্রচন্ড জেদি, সাথে আত্মবিশ্বাসী। তাইতো বন্ধুর সাথে বাজি ধরে লিখে ফেলেন ছোটগল্প "অতসীমামী"। যা তাকে লেখক হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। নিজের সম্ভাব্য গোছানো ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে বড়দাদার কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে তিনি পেশাগত লেখক হয়ে ওঠেন।

লেখক হিসেবে চল্লিশটি উপন্যাস, চারশটি ছোটগল্প, তেইশটি প্রবন্ধ, একটি নাটক, বেশকিছু কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধি করেও, সারাজীবন তিনি দারিদ্র্যের মধ্যে ছিলেন। মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবদ্দশায় যতজন শুভাকাঙ্ক্ষী পেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি শুভাকাঙ্ক্ষী এসেছিল তার মৃত্যুর পরে। তিনি বিশ্বাস করতেন "বাংলাদেশের মানুষেরা সাহিত্যিকদের ভালোবাসে", তবে হয়তো সেটা মৃত্যুর পরে বেশি। না হলে নির্দিষ্ট কোনো পেশায় না থেকে শুধু লেখালেখি করার জন্য নিজের ভাইদের কাছে তাকে লাঞ্ছিত হতে হতো না।
মৃত্যুর আগের দিনে তাকে উঠতে হয়েছিলো ভাঙা অ্যাম্বুলেন্সে সেই মৃত্যুর পরে শোকযাত্রায় তাকে শয়ন করা হয় পুষ্পশোভিত ট্রাকে। তা দেখে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বিদ্রুপের হাসি হেসে আওড়েছিলেন :

"ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
মালা
জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল
জমতে জমতে পাথর।
পাথরটা সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।"

এজন্যই হয়তো, বিপ্লব আর অভাবের মিশেলে জন্ম নেয়া এক বারুদ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। (ref.দি ডেইলি স্টার)

"গোত্রহীনের ইতিকথা" মানিক অনুরাগীদের জন্য একটা ভালো বই। সাব্বির জাদিদ ভাইয়ের লেখা অনেক গোছানো। "পিতামহ" পড়ার পরে যে মুগ্ধতা ছিলো, গোত্রহীনের ইতিকথা পড়েও একই মুগ্ধতা থেকে যাবে।
ইবিয়ানদের জন্য সাব্বির জাদিদ ভাই একজন গর্ব করার মতো লেখক-ই।
মানিক বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে হয়তো নতুন আরও অনেকে লিখবেন, আশা করি তাদের জন্য বইটা একটা ভালো পথিকৃৎ হবে।

Profile Image for Parvez Alam.
306 reviews12 followers
March 29, 2022
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একজন জ্বলন্ত মশাল। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে সেই ছাত্রজীবনে লেখার দুনিয়াতে আসেন আমাদের প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্তু ব্যবহার করেন 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়' নাম। 'মানিক' নামটা উনার মায়ের দেয়া। প্রথম লেখাতেই সেই সময় পাঠক, প্রকাশক সবার মাথা খারাপ হবার যোগাড়। 'গোত্রহীনের ইতিকথা'-তে তার জীবনের শুরু থেকে শুরু করে শেষ সময়ের গাড়িতে করে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া ও এর পরে শ্মশানের চিত্র -সবকিছুই সুন্দর ভাবে তুলে এনেছেন লেখক। আমি পড়ে খুব অবাক হয়েছি যে, 'পুতুল নাচের ইতিকথা' এর দ্বিতীয় পর্ব নাকি লেখার ইচ্ছা ছিলো মানিকের, কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে নি। স্বীকৃতির আশায় সময়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ লেখক যখন বই পাঠাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথকে, তখন ভীষণ বেয়াড়া ও 'গোত্রছাড়া' এই মানিক রবীন্দ্রনাথকে কোনো বই পাঠান নি। একটিমাত্র বই ছাড়া আর কোন বই কাউকে উৎসর্গ করেন নি তিনি, আর যেটা করেছিলেন সেটাও জনগণের উদ্দেশ্যে করেছিলেন। "দেখো, দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না আসে" এই কথা শুধু আগে শুনেছি, কিন্তু বুঝতে পারি নি কেনো মানিক এই কথা বলেছেন। আহ, কি কষ্টই না এই ৪৮ বছরের জীবনে করেছেন আমাদের প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়! বইটা পড়ার সময় বেশ কিছু জায়গায় আমার মনে হয়েছে, আর নিতে পারবো না এই কষ্ট। 'গোত্রহীনের ইতিকথা' বইটা পড়ে এইটুকু বুঝতে পেরেছি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বুঝতে হলে যে লেভেলে যেতে হবে সেটা এখনো আমাদের পাঠক কিংবা লেখক সমাজের হয় নি। লেখক সাব্বির জাদিদ এমন অসাধারণ লিখেন -এই সম্পর্কে আমার আগে ধারণা ছিলো না। কেউ যদি কখনো কোনো বই না পড়ে থাকেন, তাদেরকেও আমি বলবো একবার হলেও এই বইটা পড়ে দেখবেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যে শুধু একজন লেখকই ছিলেন না, সেই সাথে যে একজন বিপ্লবীও ছিলেন, শুধুমাত্র সেই গল্প জানবার জন্য হলেও এই বইটা পড়ে দেখবেন।
Profile Image for Imdadul  Swadin .
49 reviews2 followers
August 23, 2024
স্বীকৃতির আশায় সময়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ লেখক বই পাঠাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথকে অথচ তিনি এমন বেয়াড়া এবং গোত্রছাড়া—রবীন্দ্রনাথকে পাঠাননি কোনো বই।

একটিমাত্র বই ছাড়া আর কোনো বই কাউকে উৎসর্গ পর্যন্ত করেননি। যেটা করেছেন, সেটাও কোনো ব্যক্তিকে নয়, জনগণের উদ্দেশে।
দেখেছেন দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা। শুনেছেন পরাধীন ভারতবর্ষের আর্তনাদ। স্বজনদের কাছ থেকেও হয়েছেন বঞ্চনার শিকার। স্থাপন করেছেন পিতৃভক্তির বিরল দৃষ্টান্ত।

দু-একটা বিচ্ছিন্ন চাকরি ছাড়া জীবনভর লেখাই ছিল তার পেশা। লিখতে এসে অফিসারের পুত্র তিনি দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছেন। অসুখ-আসক্তি-অভাবের ত্রিমুখী আক্রমণে হয়েছেন বিপর্যস্ত। তবু তার কলম থামেনি এক মুহূর্তের জন্য।

বাংলাভাষার প্রধান ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি জীবনকে যাপন করেননি, করেছেন ইতিহাস যাপন। কথাশিল্পী সাব্বির জাদিদের শক্তিশালী গদ্যে, এই মানুষটির ঝড়ো জীবনের রুদ্ধশ্বাস আখ্যান জানতে আপনাকে স্বাগতম গোত্রহীনের ইতিকথায়।

যোগসুত্র
Profile Image for Rezwan Khan.
36 reviews
December 29, 2025
এ বছরের পড়া ১৫৭ তম বই ছিল এটা।
“মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়” এর জীবনীভিত্তিক উপন্যাস।

উনার লেখা উপন্যাস “পদ্মানদীর মাঝি” পড়েন নি এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম!

জীবনীভিত্তিক উপন্যাস পড়তে সহজ হলেও,লেখাটা খুবই পরিশ্রম এবং কষ্টসাধ্য কাজ।
বরাবরেই মতোই সুলেখক-“সাব্বির জাদিদ” দূর্দান্ত কাজ করেছেন।
গোত্রহীনের ইতিকথা আস্তেধীরেই পড়েছি।
উনার “পিতামহ” এবং “গোত্রহীনের ইতিকথা” দুটা বইই এই বছরে পড়া সেরা বইগুলোর তালিকায় থাকবে।
রেটিংঃ ৫/৫
Profile Image for Rokib Hossen.
16 reviews2 followers
December 1, 2024
মানিক বন্দোপধ্যায়ের জীবন ভিত্তিক উপন্যাস।

সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার বইটিতে লেখক মানিক বন্দোপধ্যায়ের জীবনকে এঁকেছেন। মানিকের শৈশব-কৈশর, দুরন্তপনা, তার শিক্ষা জীবন, রাজনৈতিক জীবন, দারিদ্র্যতা, লেখক হয়ে উঠা— সবই উঠে এসেছে বইটিতে।

যারা মানিক বন্দোপধ্যায়কে ব্যক্তিগতভাবে জানতে চান তাদের জন্য এ বইটি রেকোমেন্ডেড থাকবে।
Profile Image for Sanjida Yeasmin.
28 reviews
January 7, 2025
সাধু,সাধু... চমৎকার লেখনী... শুরু থেকে শেষ তক যেন মানিকের সাথেই পথ চলা।
Displaying 1 - 16 of 16 reviews

Can't find what you're looking for?

Get help and learn more about the design.