শিবব্রত বর্মনের গল্পগুলোর চৌহদ্দি চিহ্নিত করা কঠিন। সোনার ডিম পাড়ে না এমন এক বিপন্ন হাঁসের পাশে অদৃশ্য এক দাবার বোর্ডে খেলতে বসে দুই তিক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আর তখনই মধ্যরাতে দোতলা বাসে মৃত্যু সাজিয়ে বসে থাকে এক মানসিক রোগী। এ গল্পসংকলন এক আশ্চর্য ভ্রমণ।
জন্ম ১৯৭৩, ডােমার, নীলফামারী। বিচিত্র বিষয়ে লেখালেখি করলেও প্রধান ঝোঁক গল্প-উপন্যাসে। বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি ও রহস্যকাহিনি লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করেন। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত।
ইশশশ!! এতো ছোট একটা বই!ধরতে না ধরতেই শেষ। শিবব্রত বর্মনের গল্প হচ্ছে সব সম্ভবের রাজত্ব।তার গল্পের সবকিছুই অভিনব, সবকিছুই অপ্রত্যাশিত। কোথায় গল্প শুরু হয়ে কোথায় যেয়ে থামবে সেটা নির্ণয় করা পাঠকের অসাধ্য। তিনি লেখেনও খুব অল্প। যে কারণে আমরা তুমুল আগ্রহ নিয়ে লেখকের প্রতিটা গল্পের জন্য অপেক্ষা করি। তার গল্পে অদৃশ্য দাবার বোর্ডে দাবা খেলে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, নতুন ভাষা শিখতে যেয়ে এক প্রেমিকযুগল আবিষ্কার করে পৃথিবীতে আর একজনই শুধু এই ভাষা জানে, সাধারণ মানের একটি রহস্য উপন্যাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর গড়ে ওঠে গুপ্তসংঘ, একই এলাকায় মনিমুল হক নামের একই চেহারার পাঁচজন লোক বাস করতে শুরু করে। অভিনব প্লট নিয়ে গল্প শুরু করা সহজ কিন্তু শেষ করা কঠিন। শিবব্রত বর্মন তার গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সতেজতা আর অভিনবত্ব বজায় রাখেন। তার সাধারণ মানের গল্পও আমাদের কৌতূহল ধরে রাখে। গল্পের মোচড়গুলোকে মনে হয় কাহিনির অনিবার্য পরিণতি। যারা আমার মতো লেখকের একনিষ্ঠ ভক্ত তারা তো "সুরাইয়া" হামলে পড়ে কিনবেই। যারা তার লেখকের সাথে পরিচিত না,তাদেরও বলবো "সুরাইয়া" পড়তে। তার গল্পের অদ্ভুত, জাদুকরী, বিস্ময়কর জগতে একবার প্রবেশ করলে পাঠক অভিভূত হবে, একথা জোর দিয়ে বলা যায়।
শিবব্রত বর্মনের লেখার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো কিশোর আলো,বিজ্ঞান চিন্তা, প্রথম আলোর শুক্রবারের ট্যাবলয়েডের পাতায়। ২০১৬ বা ১৭ সাল হবে বোধহয়। "জাগার বেলা হলো" গল্পটা পড়েছিলাম প্রথম। তারপর আরো তিনবার পড়েছিলাম। স্কুল পড়ুয়া আমি পুরোটা যে বুঝেছিলাম বলবো না,তবে কেমন যেন একটা অদম্য আকর্ষণ কাজ করেছিলো আমার ভিতরে। তখন আমি নিতান্তই ছোট। সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে যুক্ত ছিলাম না,বা থাকলেও ছিলাম যাকে বলে একদম "ন্যুব"। উনার লেখা ফিচার, সায়েন্স ফিকশন,সায়েন্স ফ্যান্টাসি জনরার গল্পগুলো পড়ে অবাক হতাম। কারণ, তখন প্রচুর থ্রিলার পড়া শুরু করলেও এমন ভিন্ন ধারার ন্যারেটিভ বা অকল্পনীয় প্লট একজন লেখকের মাথায় কোথা থেকে আসে আমার মাথায় আসতো না। মিসির আলীও পড়া হয়ে গেছিলো ততদিনে। কিন্তু সাইকোলজির এমন অলিগলি ঘোরপ্যাঁচানো গোলকধাঁধা কোনো লেখায় পাই না। চিহ্নিত করতে পারি না গল্পগুলোর চৌহদ্দি,ফেলতে পারি না কোনো চেনাপরিচিত বর্গে।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে প্রথম আলোর শুক্রবারের ট্যাবলয়েডে সেবার শ্রদ্ধেয় মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীন আর শিবব্রত বর্মনের লেখা বেরিয়েছিলো পাশাপাশি দু পাতায়। থ্রিলার নিয়েই ছিল সেই ক্রোড়পত্রটা। প্রথমবার শিবব্রত বর্মনের "মরিবার হলো তার স্বাদ" নামের থ্রিলার গল্পটা পড়ি। আবারও ধাক্কা খাই। ততদিনে জেনে গেছি ভদ্রলোকের লেখালিখির মুখর পদচারণা শুধু ম্যাগাজিনের পাতায়। মৌলিক কোনো বই উনার তখনও প্রকাশিত হয় নি। অনুবাদ আছে বেশ কিছু। লাইফ অফ পাই, আপুলুসিয়াসের আশ্চর্য অভিযান এসব পড়া হয়ে গেছে ততদিনে। তারপর মাসের পর মাস মুখিয়ে থাকতাম কোনো জায়গায় উনার লেখা কোনো ফিচার,কোনো গল্প বা নিতান্তই কোনো মতামত প্রকাশিত হলো তার অপেক্ষায়।
২০১৯ সালের বইমেলায় বাতিঘর থেকে উনার ১১ টা কাহিনী নিয়ে "বানিয়ালুলু" বইটা বের হবার পর তুমুল প্রশংসায় ভেসে গেল চারদিক। পাঠকরা তাঁকে চিনতে শুরু করলো। সেখানেও একটা ঘাটতি তো ছিলই। আরো অনেক লেখা ছিল যেগুলো সংকলিত হয় নি বইটাতে। তবে আফসোস থেকেই যায়, গল্পগুলোর মাঝে "মরিবার হলো তার স্বাদ" ছিল না,ছিল না বিস্ময়বোধের অপর নাম "সুরাইয়া"
গতবছর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে শিবব্রত বর্মনের গল্প অবলম্বনে নির্মিত "ঊনলৌকিক" অ্যান্থলজি সিরিজটা প্রিমিয়ার হয়। নিভৃতচারী লেখককে চিনে নেন আরও অনেক পাঠক-দর্শক। আর যেন তাদের প্রতি উপহারস্বরূপ ছাপাখানার ভূতেদের ঠেঙিয়ে মলাটে বন্দী হয়ে আদল নেয় ১২৬ পৃষ্ঠার ছোট্ট বইটা-"সুরাইয়া"
সুরাইয়া এমন একটা সংকলন যেখানে লেখকের সায়েন্স ফ্যান্টাসি জনরার লেখাগুলো বাদ দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে অন্যসব গল্পগুলো। কিছু গল্প মোটাদাগে স্পেকুলেটিভ ফিকশনের অন্তর্ভুক্ত হলেও ওভারঅল সংকলনটা জনরাভিত্তিক সাহিত্যের রাজনীতির সীমানায় থাকে না। আপাত দুর্বলতম গল্পগুলোর মাঝেও রোপিত আছে গভীরতম চিন্তাবীজ, অপ্রচল কনসেপ্ট।
ধরা যাক, "আমার বাম বুদ্ধিজীবী বন্ধুরা কেন আমার চেয়ে স্মার্ট" গল্পটার কথাই। অ্যালিগোরি ধাঁচের গল্পটা আপাতভাবে ঈশপের উপকথার মতো দেখালেও এ কাহিনীতে আছে সুচতুর কারিগরি। "সন্ধ্যারাতে কৃষক তার ছোট্ট শিশুটিকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে যেসব গল্প বলে, একটু দূরে লেজ নাড়তে নাড়তে সেই গল্পগুলো সবই শোনার সুযোগ পায় ভুলু । শুনে শুনে সবকিছু জানা হয়ে গেছে তার। বিশেষ করে মানবজাতির স্বভাবচরিত্র তার নখদর্পণে। এ কারণে হাঁস খুব শ্রদ্ধা করে ভুলুকে । ভুলুর সব কথায় মাথা নাড়ে সে।" এই অনুচ্ছেদেই লুকিয়ে রাখা আছে গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। কৃষক আর তার ছোট্ট শিশু প্রতিনিধিত্ব করছে কমিউনিজম প্রবর্তক আর আর তাদের দ্বারা সরাসরি এফেক্টেড দেশগুলোর, তার কুকুর ভুলো পরবর্তী সময়ে পরোক্ষভাবে তাত্ত্বিক কমিউনিজম চর্চাকারী সমাজ, আর সোনার ডিম না পাড়া হাঁসটি হলো আমজনতা।
অন্য আরেক গল্প "লোকটা" আপাতভাবে শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যায় মনে হলেও যদি আমরা সিনেম্যাটিক সিকোয়েন্সে পুরো গল্পটা দেখি তাহলে একটা অসহ্য গুমোট চাপ সৃষ্টি হয় মস্তিষ্কের অ্যামিগডালায়। প্রথম শট—সংকীর্ণ ঘরের এক কোণায় চৌকির ওপর দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে একজন লোক। তার সামনেই কেরোসিন স্টোভ জ্বালাতে থাকে আরেকজন। অস্ফুটভাবে কথা বলে তারা। শোনা যায় না...
দ্বিতীয় শট—ঘরের পাশে একটা ছোট জানালা দিয়ে দেখা যায় দুপুরবেলাকার নাজিমুদ্দিন রোডের একটা অংশ। আমরা জানালা পেরিয়ে দেখতে পাই কোভিড মহামারী আক্রান্ত ঢাকার ফাঁকা রাস্তা। দূর দিয়ে হেঁটে যাওয়া মাস্ক পরে থাকা একটা দুটো মানুষ আর দেয়ালে সাঁটা পোস্টার "স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, ঘরের বাইরে মাস্ক পরুন। বজায় রাখুন সামাজিক দূরত্ব" আমাদেরকে সেটা নিশ্চিত করে।
তৃতীয় শট— আমরা আবার ফিরে আসি ঘরের ভেতরে। দুই ব্যক্তির মাঝে অস্ফুট স্বরে চালানো আলাপ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়। কথোপকথন থেকে আমরা জানতে পারি একটা লোককে গোটা দুনিয়ার মানুষজন খুঁজছে। কেন খুঁজছে সেটা ক্রমশ পরিষ্কার হতে থাকে। সামনে কেরোসিনের স্টোভে গরগর আওয়াজ তুলে ফুটতে থাকে ডাল।
ফাইনাল শট—চরিত্রদ্বয় মুখোমুখি বসে ভাত খাচ্ছে। জানতে পারি, তাদের একজনের নাম অরুণ সরকার। অন্য লোকটার দিকে আড়চোখে চেয়ে থাকা অরুণ সরকার তাকে নিচুস্বরে জানায় যে,"সেই লোকটার এ মুহূর্তের অবস্থান আমি বের করে ফেলেছি। লোকটাকে আমি তার গর্ত থেকে বের করে আনতে যাচ্ছি। শিগগিরই।"
অতঃপর এক চাপা উত্তেজনায় ভরা পরিস্থিতি গ্রুভি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক সহযোগে আমাদের চেতনায় ভর করে। একইভাবে, সংকলনের 'দাবা', 'ইন্টারোগেশন','নিষিদ্ধ' গল্পগুলো চিন্তা করে দেখতে পারেন। ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে পারেন অতীতের ঘটনাগুলোকে।
‘বানজি জাম্প দিয়েছেন?’
'না।'
‘বানজি জাম্পের আকর্ষণটা কোথায় জানেন?'
‘জানি না।'
‘আকর্ষণটা মৃত্যুর নৈকট্যে। মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে, মৃত্যু��ে ছুঁয়ে আবার ফিরে আসা। শরীরে প্রচুর অ্যাড্রিনালিন নির্গত হয়। প্রতিটা কোষ মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুতি নিতে থাকে। একটা পারফেক্ট গেম।'
'হুম।'
'তবু পারফেক্ট না।'
'কেন?'
'কারণ আপনাকে গ্যারান্টি দেওয়া হচ্ছে, আপনি মরবেন না। একটা শক্ত ফিতা আপনাকে টেনে ধরে রাখছে। একটা ফেক মৃত্যুভয়। যেন এমন একটা রহস্যগল্প পড়ে শোনানো হচ্ছে, যেটার শেষটা আগেই বলে দেওয়া।'
‘বটে।'
‘আমরা এই ত্রুটি দূর করতে পেরেছি। কিন্তু খেলা নয়, একটা খাবারের আদলে। আ পারফেক্ট ডিশ। স্টিমড পাফার। এখানে এই যে স্লোগানটা দেখুন : দি আলটিমেট টেস্ট। আসলে পুরো বাক্যটা হবে : দি আলটিমেট টেস্ট অব ডেথ। আপনি মৃত্যুর স্বাদ নেবেন। আপনার জিহ্বার প্রতিটা টেস্ট বাড মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।'
গল্পের শরীরে কলমের টানে লেখা এই সংলাপগুলো পড়লে আমাদের একবারের জন্যও মনে হয় না আমরা ভূ-গর্ভস্থ সেই হলঘরের ওভাল ব্যাঙ্কোয়েট টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে কাঁটাচামচ হাতে বসে নেই। বরং সেই লাস্ট সাপারে বসা আর সবার মতো আমরাও অপেক্ষা করতে থাকি, কখন আলাদিনের চেরাগে ঘষা দেয়া চেরাগের মতো একরাশ সাদা স্টিমে ধূমায়িত গ্রিন ভেজিটেবল আর পামকিন মাফিনে মোড়া পাফার ফিশের জন্য....মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণের জন্য।
এরপর 'উত্থান' গল্পে ধারাবাহিকভাবে দেখানো কিছু দৃশ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছবির আদলে যখন বুড়িগঙ্গার উল্টোপাড়ে ইকুরিয়া মহল্লার বাসিন্দা মুহিত ছয়তলার ছাদ থেকে একদিন হুট করে পড়ে যায় ঠিক সে সময় একটা কৌতূহলের বীজ আমাদের মনের উর্বর মাটির কোথাও বপন করা হয়ে গেছে। মুহিত কেন ছয়তলার ছাদ থেকে পড়লো এই প্রশ্নের অনুসন্ধানে গল্পের ভেতর ক্রমশ প্রবেশ করতে গেলে আমরা বিস্ময়ের সাথে দেখি, লেখক মুহিতের পতনদৃশ্য মিলি সেকেন্ড বাই মিলি সেকেন্ড রিভার্স মোডে আমাদের কাছে তুলে ধরেন। যেন এটা পতন নয়,উত্থান। আমরা আরও বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করি, আসলে লেখক আমাদের মুহিতের পতনের কারণ জানাতে গিয়ে সময়ের দুটি উল্টোমুখী তীর ধরে মুহিতের উত্থান দৃশ্য দেখাচ্ছেন। একটা পেভমেন্ট থেকে ক্রমাগত ছয়তলার বাসিন্দা হওয়া উত্থানশীল মুহিতের বর্তমান থেকে অতীতে যাবার সিকোয়েন্স, আরেকটা কংক্রিট ভবনের বাইরে রিভার্স মোডে ছয়তলার ছাদে উঠতে থাকা মুহিত।
গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে লেখকের লেখা নির্মাণের কারিগরি দিকটা বেশ ভাবিয়ে তোলে। মাথার করোটির ভেতরে ঘটতে থাকা একটা চিত্রনাট্যকে রক্তমাংস লাগিয়ে কীভাবে তার সঙ্গে বাস্তবতার দূরত্ব বিনাশ করা যায় সেই কৌতূহলবোধ ভেতরে ভেতরে সঞ্চারিত হতে থাকে। কখনো দৃশ্য,কখনো ছেঁড়া ছেঁড়া সংলাপ, কখনো ধ্বনি গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।
সংকলনের বিভিন্ন গল্পে বিষয়বস্তু থেকে কখনও সরলরৈখিক, কখনও তীর্যক অবস্থানে পাঠককে রাখলেও নামগল্প 'সুরাইয়া' সরাসরিভাবে বলা গল্প। আর এ কারণেই সম্ভবত সিংহভাগ পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী দাগ কাটতে সক্ষম। গল্পে প্রেমে পড়তে গিয়ে আক্ষরিক অর্থে নতুন এক ভাষা তৈরি করে ফেলে এক তরুণ ও এক। তরুণী,তারা চায় না এ ভাষায় কথা বলুক তৃতীয় কেউ তারপর আমরা হারিয়ে যাই ইন্দিরা রোডের সেই ল্যাঙ্গুয়েজ টিচিং সেন্টারটায় যেখানে ফিনাইলের গন্ধমাখা মরবিড পরিবেশে দুটি মানুষের হৃদয়ে বাড়তে থাকে প্রেম, আর তার উপর তরু থেকে মহীরুহ হয়ে ওঠে এক অজানা অচেনা ভাষা।
লেখকের আগের বই বানিয়ালুলু অনেকটা মেল শভিনিস্টিক প্যারালাল ইউনিভার্সের মতো। ওখানে কোনো ফিমেল ক্যারেকটার নাই, থাকলেও মৃত। ক্রিস্টোফার নোলানের মতো সিগনেচার...নোলান যেমন সবসময় মেইন ক্যারেকটারের স্ত্রীকে মেরে ফেলে। কিন্তু "দুশমন", "মৃতেরাও কথা বলে" আর "সুরাইয়া" এই তিন লেখায় আমরা তা দেখতে পাবো না। কমিউনিকেটিভ ন্যারেটিভে লেখা "সুরাইয়া" গল্পের কোর বিষয়বস্তুগুলোর একটা নারী-পুরুষের প্রেম। "চেইন ক্যাফে" গল্পে আমরা দেখতে পাই সম্পর্কের নানা মোচড় আর পরিণতির এক নির্ধারিত চেইন রিঅ্যাকশন। "উত্থান" গল্পেও আমরা পাই এক জৈবিক চোরাস্রোতের কথা।
এই বেগবান অভিযাত্রায় নিরীহ একটা উপন্যাস নিষিদ্ধ হয়ে যায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের দায়ে আর সে কারণে সবাই সেটার মধ্যে লুকানো ইশারা খুঁজতে শুরু করে; নির্যাতনকেন্দ্রের ভেতরে অদৃশ্য এক দাবার বোর্ডে খেলা শুরু করে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দাবাড়ু, তাদের জীবনের শেষ খেলার আগের খেলা সেটা। শিবব্রত বর্মনের গল্পের ঘোড়া এভাবে ছুটতে থাকে। পাশ দিয়ে ছুটে যায় একের পর এক দৃশ্য : মুক্তিযোদ্ধাদের এক ব্যর্থ অপারেশনের জন্য অদ্ভুত জেরার মুখে পড়েন এক স্কুলশিক্ষক, কফিশপের কাচের জানালা গলে আসা কমলা রোদের মধ্যে বসে থাকে এক তরুণী, ডব্লিউ বি ইয়েটস নোবেল পুরস্কার পান আলফ্রেড নোবেলের জন্মের সতের বছর আগে, একটি মহল্লায় ঘুরে বেড়ায় একই চেহারা ও নামের ছয়টি লোক, একসাথে করে বেড়ায় সব এক্সসাইটিং কাজকারবার।
ব্যক্তিগতভাবে সবথেকে মনে দাগ কেটেছে উত্থান,নিষিদ্ধ,সুরাইয়া, মরিবার হলো তার স্বাদ।
সব গল্পই সরলকোণের হিসাবে এসে মিলিয়ে যায়। ত্রিভুজের দুটি রেখার মিলন বিন্দু থেকে শুরু হওয়া অভিযাত্রা যেমন ধীরে ধীরে গিয়ে ঠেকে সর্বোচ্চবিন্দুতে, তারপর আবার নেমে আসে ভূমিতে -সংকলনের গল্পগুলোও তেমনই। গতিময় লেখার ঘোড়ার চাল বদলায় কিন্তু অক্ষুণ্ন থেকে যায় শিবব্রত বর্মনের ভঙ্গিমা। এই ভঙ্গিতে বাস্তবের গায়ে কল্পনা আর কল্পনার গায়ে বাস্তবের চাপড় মারতে মারতে, পাঠকসত্ত্বাকে ধাক্কা দিতে দিতে এগিয়ে যায় সুরাইয়া'র গতিপথ।
উত্থান, সুরাইয়া, আর মরিবার হলো তার স্বাদ গল্প গুলার জন্য তিন তারা। এরপর ওভারল একতারা বিয়োগ করে দুই তারা দিলাম। একটা তারা কেন কাটলাম ব্যাপারটা বলতেসি।
কয়েক মাস আগে "বানিয়ালুলু" পড়ে চার তারা দেয়া পাবলিক এই আমিই এবার বলব, শিবুদা বাংলাদেশে মোটামুটি বড় একটা কাল্ট তৈরী করে ফেলসেন আই গেস। কাল্ট খারাপ কিছু না, আমিও নিজেও বেশ কিছু লেখকের অন্ধ ভক্ত টাইপ আছি। তবে কাল্টের সমস্যা হচ্ছে এইটার কারনে ১২৪ পৃষ্ঠার একটা পকেট সাইজ বই, বড় বড় ফন্টে একেক পৃষ্ঠায় ২৩ লাইন মতো করে লেখা, সেখানে গল্প গুলা তেমন ভালোও না বা মাঝারি মানের সেটার গায়ের দাম ২৪০ টাকা হাঁকানোর সাহস কতৃপক্ষ করতে পারে। "বানিয়ালুলু" র সাথে তুলনা করার আমার ইচ্ছা নাই, উচিতও না। তবে সত্যি বলতে "সুরাইয়া"র বেশির ভাগ গল্পই খুব হতাশ করে। শিবুদার যেই ব্যাপারটা আমাদের ভালো লাগে সেটা হইল উনার গল্প পড়ে "আরেহ! কী মারাত্নক চিন্তা করল লোকটা" এই ফিলিংটা। এই জাদু "বানিয়ালুলু" পর্যন্ত আমার ক্ষেত্রে খেটে গেসে। এবার আমি গল্পই খুঁজতেসিলাম, যেটা এই বইতে পাইনাই।
আমাদের বাসা দক্ষিণ মুখী। বাসার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন আমার নানু। দারুন একটা কাজ করেছিলেন বাসার ডিজাইনে। একদিকে দক্ষিনের বাতাস আসবে তার সাথে বিভিন্ন গাছ লাগানোর স্পেস। ব্যালকনি তে গিয়ে দাড়ালে সমসাময়িক ভাবে একটা শান্তি পাওয়া যায়, সাথে নানুর ভালো স্মৃতিগুলো যেন আচ্ছন করে দেয়।
এখানে কিছু গল্প যেন প্রচন্ড গরমে দঃক্ষিন দিক থেকে আসা নতুন মুকুল ধরা আম গাছের বাতাসের মত। নতুন মুকুলের গন্ধে যেমন মন জুড়ায়, বাতাসে যেমন শরী�� ঠান্ডা হয়, সব কিছু মনে হয় "যাস্ট রাইট এনাফ" শিবব্রত বর্মন এর লেখা এর বেতিক্রম নয়। সত্যিই আচ্ছন্ন করার মত দারুন৷
তিন বছর আগের এক ভোরে ঘণ্টা দুয়েক টানা পড়ে শেষ করেছিলাম ‘বানিয়ালুলু’, এবং তত্ক্ষণাৎ ফেসবুকের স্ট্যাটাসে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম শিবব্রত বর্মনকে, সেবা প্রকাশনী-ময় শৈশবের রহস্যপত্রিকার সেই অলীক গল্পগুলোর স্বাদ আরেকবার ফিরিয়ে দেওয়ায়। আর এবার, আবারও এক বসাতেই ‘সুরাইয়া’ পাঠ শেষ করে মনে হলো, বিদেশি গল্পের ব্যাকাপ হিসেবে নয়, শিবব্রত একদম নিজ অধিকারমন্ডিত একটি বাংলা গল্প-ধারা তৈরি করে নিয়েছেন।
‘সুরাইয়া’ পড়ে আশাহত হবার কারণও আছে, ‘বানিয়ালুলু’র গল্পগুলোর যা গড়মান, তার থেকে ‘সুরাইয়া’-এর কিছু গল্প বেশ পিছিয়ে। ‘দাবা’, ‘চেইন ক্যাফে’ বা ‘হামশাকল’; এই গল্পগুলোর রাস্তা বেশ অনুমানযোগ্য।
চিন্তাবীজ বাদে বাকি সবকিছু শিবব্রতের কাছে, মোটা দাগে, বাহুল্য। গল্প না বলে তিনি খেলতে চান আইডিয়া বা চিন্তাবীজ নিয়েই। ‘লোকটা’ গল্পটা এই ঘরানার সেরা উদাহরণ। পরিসর তৈরি হতে না হতেই গল্পটা ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু সেই চিন্তাবীজ ঠিকই আলোড়িত করে গেছে পাঠককে।
সংকলনের সেরা তিনটা গল্প কী হতে পারে?
তিন নাম্বারে থাকবে ‘নিষিদ্ধ’। যেই ঘরানার গল্প বলতে চান শিবব্রত, তার একটা ভালো উদাহরণ এই গল্পটা। কী হলে কী হতে পারে, তার একটা প্রকল্পিত অনুমান বা হাইপোথিসিস নির্ভর গল্পটা এই গল্পটা এগিয়েছে গতিময় কথোপকথনের মাধ্যমে, উনলৌকিক ওয়েব-সিরিজে খ্যাতি পেয়ে যাওয়া ‘দ্বিখন্ডিত’ বা ‘মিস প্রহেলিকার’ মতো।
দুই নাম্বারে থাকবে, ‘উত্থান’ গল্পটা। একটা সিনেমা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই গল্পে, আঙ্গিকের নিরীক্ষা আর নানা রকম ইন্টারটেক্সটুয়ালিটি ব্যবহার করে। যেই চিন্তাবীজের কথা বললাম একটু আগে, শিবব্রত এই গল্পের শেষ লাইনে তারই একটা প্রমাণ রেখেছেন।
আর সংকলনের সেরা কাজ, নিঃসন্দেহে নামগল্পটা, সুরাইয়া। চমৎকার কোনো আইডিয়া যখন পায় গল্প হয়ে ওঠার পরিবেশ আর ভাষা, তখন যে কী বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটে, এই গল্পটা তার সার্থক উদাহরণ। এই একটি গল্প এমনই দুর্দান্ত, বাংলা ভাষায় ফ্যান্টাসি ঘরানার কোনো ছোট্ট তালিকা করলেও ‘সুরাইয়া’ সেখানে জায়গা করে নেবে।
শিবব্রত বর্মনের পরবর্তী সংকলনের জন্য মুখিয়ে রইলাম।
গল্পগুলো কেমন লেগেছে কিংবা শিবব্রত বর্মনের লেখা নিয়ে কিছু না হয় না বলি। রেটিং দেখেই আশা করি আন্দাজ করা যাচ্ছে।
'এ বছর যদি একটিমাত্র বইও কিনি, সেটি হবে এই বই'- এরকম ক্যাপশন দিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে না জানা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচিত হওয়া এক ভদ্রলোক (বলা ভালো অগ্রজ) সেই পোস্ট দেখে বই প্রকাশের পরপরই পাঠিয়ে দিয়েছেন! গল্পগুলো পড়ে যতটা আনন্দ পেয়েছি তারচেয়েও বেশি অভিভূত হয়েছি বইটি হাতে পাওয়ার পর। অনেক অনেক ভালোবাসা সেই মানুষটির প্রতি।
আবার কবে লেখকের নতুন বই পাব, ঠিক নেই। ততদিন পর্যন্ত বানিয়ালুলু কিংবা সুরাইয়া'র গল্পগুলোই যে আরও অনেকবার পড়া হবে সেটুকু নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে।
অবশেষে 😃 সুরাইয়াও পড়া হলো। কয়েকটা গল্প অনেক ভাল্লাগসে। শিবব্রত বর্মণের একটা জিনিস মজা লাগে, প্লটগুলা এমন ইউনিক হয়! ছোট ছোট গল্প তাই আর আলাদা রিভিউতে গেলাম না।
ছোটোগল্প একটি বহুল-প্রচলিত অথচ লুপ্তপ্রায় শিল্প। পত্রপত্রিকায় তার উপস্থিতি প্রবল। কিন্তু গল্প-সংকলন বিক্রি করতে গেলেই শোনা (ও দেখা) যায় যে বাজারের বদলে পোকায় কাটাই তার ভবিতব্য। ফলে যথার্থভাবে "অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে, শেষ হয়ে হইল না শেষ" অনুভূতি-জাগানিয়া লেখালেখির বদলে লেখকের নামসর্বস্ব ফিলার-টাইপের জিনিসই আমরা পাই। এই অবস্থায় আলোচ্য বইটি ভ্যাপসা গরমে একমুঠো ভিজে হাওয়া আর চাঁপার গন্ধ হয়ে এল। মোট এগারোটি ছোট্ট লেখা আছে এই বইয়ে। তারা কতটা গল্প, কতটা ভিনিয়ে (vignette), কতটা রূপক, আর কতটা স্বগতকথন— সে-সব তাত্ত্বিক প্রশ্ন এক্ষেত্রে অবান্তর। কেন জানেন? কারণ শেষ লাইনটায় পৌঁছোনোর পর, শেষ শব্দটার ওপর চোখ রাখার সঙ্গে-সঙ্গে মনের চোখের সামনে একরাশ দৃশ্যের জন্ম হয়। সেইসব দৃশ্যের মধ্য দিয়ে আমরা কল্পনা করে নিই অজস্র সম্ভাব্য পরিণতি— যারা ততক্ষণ অবধি আমাদের মোহিত করে রাখা শব্দ ও বাক্যদের নানাদিকে নিয়ে যেতে থাকে— ছোটোগল্পের ঠিক যেমনটি করা উচিত। এদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখা "সুরাইয়া"। বাকিরাও স্মরণীয়, তবে শুধু এই গল্পটার জন্যই বইটা কেনা যায়। যদি গল্প ভালোবাসেন, তাহলে এই বইটা কোনোমতেই উপেক্ষা করবেন না।
প্রতিটা গল্প পড়ার পর আনন্দে চোখ বুজে আসে, আহা। শেষ করে ফেলার পর আবারও হয়তো তিন বছরের অপেক্ষা, পরের গল্পসংকলনের জন্য। যাই, টিয়ার-অফ ক্যালেন্ডারের পাতা ছিঁড়তে বসে পড়ি।
সেদিন শের-ই-বাংলা নগর নিউরোসায়েন্সের সামনে দাঁড়ায়ে পোড়া মরিচ আর কাসুন্দি মাখানো পেয়ারার নির্যাস জিহ্বের ডগায় ঠোকর মেরে উঠলে "সুইরায়া"র গল্প-জগতের স্বাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। লেখকের পূর্বপঠিত বই 'বানিয়ালুলু'র সাথে একটা অনাকাঙ্ক্ষিত তুলনা পরিহার করে সুরাইয়াকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসাবে বিবেচনা করলেই বরং ন্যায়ের কাঠগড়া মজবুত থাকে। বিমোহিত সব ভাবনার রসদের সাথে বিশাল সম্ভবনাময় প্লটের ব্যাপ্তি এক বিন্দুতে ব্ল্যাকহোলের সিঙ্গুলারিটির মতই ঠাসা!
[ কষেপিষে পেয়ারা শেষ করে চায়ের দোকানে ঢুকলাম।]
এই যে, দোকানের কোণায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে হাঁ করে ঘুমানো লোকটা৷ খেয়াল জাগে আমার জায়গায় বর্তমানে শিবব্রত বর্মণ/দীপেন ভট্টাচার্য থাকলে ধূসর কোষে একটা গল্পের বীজ রোপন হত৷ যেমন ধরুন, লোকটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাজার আলোকবর্ষ দূরে অনাবিস্কৃত কোনো গ্রহের একাকী বটগাছের সাথে কথা বলে৷ দুপুরের খাওয়া শিং মাছের ঝোলকে তাদের মধ্যকার আলোচনার বিষয়বস্তু ভাবা যায়। দেখা গেলো, কথাবার্তার এক পর্যায়ে বটগাছ শিং মাছের ঝোল খেতে চাওয়ার বায়না ধরায় লোকটা তাঁর আঙুলের মাথায় লেগে থাকা শিং মাছের ঝোলের বাষ্পীয় ঘ্রাণটা বটগাছের পাতায় ঘষা দিলেই হাজার আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্রহের নি:সঙ্গ বটগাছ পৃথিবীর স্বাদটা পেয়ে যায়। এরপর, শিবব্রত বর্মণ/দীপেন ভট্টাচার্য ইচ্ছামত গল্প-নাটাইয়ের সুতো ছাড়তেন আর বিস্তৃত ভাবনার মহাকাশে পাঠককে বুঁদ করে রাখতেন। যাক৷ আমার মতে, সাইফাই রচনা অত্যন্ত জটিল এবং ক্রিয়েটিভ ঘরানা। বাস্তবতার পরিধি ডিঙিয়ে অসীম কল্পনালোকে ফিউচারিস্টিক সম্ভবনার দুয়ারে অদৃশ্য টোকা মেরে একটা নতুন ভাবনা উন্মুক্ত করা হেনতেন কাজ নয়। আর অভিহিত দুইজন লেখক বর্তমান সাই-ফাই ঘরানায় অন্যদের চেয়ে ঘোড়ার দেড় চালে এগিয়ে আছেন।
শিবব্রত বর্মণ/দীপেন ভট্টাচার্যের অন্যতম বিশেষত্ব হলো, মানবসভ্যতা রক্ষার্থে ইন্টারগ্যালাক্টিক ব্যাটলের তুলনায় চেনা-পরিচিত বাস্তবতার মোড়কে গল্পের ভিত নির্মাণ। যেখানে সাইফাই এলিমেন্টের বিপন্ন মানবজাতি রক্ষা, দশম/দ্বাদশ মাত্রার রোবটের কারসাজি, এলিয়েন ইনভ্যাশন, ইন্টারগ্যালাক্টিক এক্সপ্লোশন, বিশাল স্পেসশিপের চাকচিক্য — এইসব ক্লাসিক জিনিসপত্র এড়িয়ে (তুলনামূলকভাবে!) থিওরিটিক্যাল সায়েন্সের সাথে প্রকৃতির রহস্য মিলিয়ে যেভাবে গল্প বলেন সেটা বেশি রিয়েলিস্টিক লাগে। ভাবনাটা তখন অকল্পনীয় ঠেকে না, বরং নির্জলা বাস্তব মনে হয়। এটা গল্পের আঙ্গিকে বিরাট পরিবর্তন এনে দেয়৷ সময়ের প্রবাহমান বাস্তবতার রেখায় বিজ্ঞানের এমন চমৎকার সন্ধিকাল দাঁতের তলায় কড়মড় করে পিষে নির্যাস আহরণে চিত্তের পরিতোষ। ঘটনার স্থান কালে আমাদের চেনা নিত্যদিনের জাগতিক রূপঢঙ ধরা দেয় নতুন রঙে।
'সুরাইয়া' — বইয়ের গল্পগুলো নিয়ে বিশেষ আলোচনা করব না। শুধু মৃদু টোকা মেরে যাই। উত্থান, সুরাইয়া, চেইন ক্যাফে, মরিবার হলো তার স্বাদ — চারটা গল্প অত্যন্ত ভালো। এই চারটা গল্পের ইম্প্যাক্ট পুরো বইয়ের শক্তপোক্ত ভাবমূর্তি গড়ে দেয়। গল্পের চরিত্ররা এখানে বিপন্ন এক অবসাদ বৃত্তের কিনারায় অবলীলায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ নাহলে মধ্যরাতে দোতলা বাসের ভেতর জগতের সবচেয়ে সুস্বাদু মৃত্যুর আসর সাজায় কে? কৌতুহলের বীজ খুঁজতে গিয়ে মৃত্যুর গ্রেভিটেশনাল ফোর্স আঁকড়ে ধরে কাকে? কীভাবে দুজন মানুষের প্রেমের গল্প বীভৎস অপরাধের গল্প হয়ে যায়? ইউনিক সব লোভনীয় প্লট। শুরু থেকে গল্পের আবহে আবিষ্ট হয়ে থাকি, আর শেষে, কাসুন্দির ঝাঁঝালো ঘ্রাণে মত্ত। বাকিসব মোটামুটি কমবেশি ভালো৷ একদম মনে ধরে নাই এমন গল্প নেই। তব, ওই যে, অন্যান্য গল্পগুলো বিশেষ ভালো না লাগলেও পূর্বোক্ত চারটা গল্পের স্ট্রং ইম্প্রেশনে বইটা সহজেই রেকমেন্ড করা যায়।
হুমায়ূন আহমেদ ও মুরাকামির মধ্যে একটা ব্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিবব্রত বর্মণের গল্প। স্টোরি টেলিং, ক্রাফট কিংবা ল্যাংগুয়েজে নয় বরং এই সম্পর্কটা অনেকটা বোধ নির্ভর আর এই 'বোধ' নিয়ে ভাবতে গেলেই মনে পড়ে যায় জীবনানন্দের কথা, আমি তারে পারিনা এড়াতে। শিবব্রত গল্প বলেন দুলকি চালে। গল্পে আছে শূন্য থেকে শুরু হয়ে শূন্যতে মিলিয়ে যাবার প্রবণতা। এই প্রবণতাই সম্ভবত গল্পগুলোর ইনার বিউটিকে তুলে আনে পাঠকের সামনে, তাই অদৃশ্য দাবার চাল পাঠকের সামনে হয়ে ওঠে দৃশ্যমান কিংবা নিষিদ্ধ বইয়ের লেখকের সন্ধানে গিয়ে আমরা শিখে ফেলি নতুন কোন ভাষা, যে ভাষা মাত্র তিনজনই পৃথিবীতে জানে। এই ভাষার ব্যকরন বুঝতে না পারলেও পাঠকের মনে লাগে ধাক্কা, মনে হয় এইসব ধাক্কাও ভালো। আশা বাড়ে, কিন্তু লোকটা চেইন ক্যাফেতে বসে বসে সিঙ্গুলারিটি নিয়ে দীর্ঘ আলাপ করেও পুরোপুরি মেটাতে পারে না সে'ই সাধ। কোথাও অতৃপ্তি রয়ে যায়। তখন ইচ্ছে করে শুরু করি ইন্টারোগেশন আর ইন্টারোগেশনের ভাষা রপ্ত করতে করতেই নিজের মধ্যে টের পাই উত্থান, পাই থ্রিলারের স্বাদ। নতুন ডায়মেনশন আসে। রসদ তো কম না, প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ার মতো একটার পর একটা ভাবনা তাই মনের মধ্যে দখল করে নেয় নিজের জায়গা আর মনে হয় পাঠক আমি ও লেখক একে অন্যের হামসকল। জগতের লীলা গোপনই থাকে, তবুও দেখা হয় অ্যাবসলিউট ট্রুথের সাথে আর কারও কারও হয়তো মরিবার হয় বড় সাধ। ভাষায় আভিজাত্য নেই তবে স্বতঃস্ফূর্তভাব আছে, গল্পে জড়তা নেই, তবে ম্যাজিকাল এসেন্স আছে। সবমিলিয়ে আছে নতুন কোন খাবার টেস্ট করার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ... এমন অভিজ্ঞতা অবশ্য আনন্দেরও বটে।
শিবব্রত বর্মনকে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তার আইডিয়ার জন্য। প্রচন্ড ইউনিক আইডিয়া ভদ্রলোকের। সাথে নিয়ন্ত্রিত ভাষা। ইঙ্গিতবহ ও পরিমিত। খুব হিসাব কষে শব্দগুলো একটার পর একটা সাজানো থাকে। শিবব্রত বর্মনের গল্প বলার ভঙ্গিটাও বেশ আকর্ষণীয়। একবার শুনলে শুনতে ইচ্ছা করে। গল্প শেষও হয় একটা চমক দিয়ে। অনুধাবন করার জন্য প্রায়ই আবার চোখ বুলানো লাগে।
বানিয়ালুলু লিখে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। এবারেও গল্পগ্রন্থ লিখেছেন তিনি। এবারেরটা শীর্ণকায়। নাম সুরাইয়া। গতবারেরটা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এবারে মুগ্ধতার পরিমাণ কম। গল্পে আইডিয়ার চমক আছে, নতুনত্ব আছে। কিন্তু গল্পগুলো পূর্ণতা পায়নি মনে হলো। মনে হলো ফিল্ম দেখানোর বদলে সিনেমা হলের লোকেরা ট্রেলার দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
এর মধ্যে নাম গল্প 'সুরাইয়া' উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। একটা আপাত সরল প্রেম কাহিনির আড়ালে এরকম কিছু পড়বো তা ধারণাও করিনি।
সবগুলো গল্পই বাহুল্যবর্জিত। বাহুল্যের ধারই ধারেননি লেখক৷ তার মূল হাতিয়ার - আইডিয়া, কনসেপ্ট৷ আইডিয়াও বটে। বানিয়ালুলুর তুলনায় কিছুটা দূর্বল৷ তবে 'নিষিদ্ধ' কিংবা 'সুরাইয়া'র মতন গল্পগুলো মনে থাকবে অনেকদিন।
বাতিঘরে এক বসায় দেড় ঘন্টায় পড়ে ফেললাম বইটা। মূলত একটা ছোটগল্পের বই। মোট এগারোটা গল্প আছে এখানে। প্রতিক্রিয়া? অভিভূত! বেশ কিছুদিন আগে মোজাফফর হোসেনের মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁর পর আরেকটা গল্পগ্রন্থে মুগ্ধ হলাম। বইটার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো বিষয়বস্তুর বিচিত্রতা। নীতিগল্পের সোনার ডিম পাড়া হাঁস থেকে বিজ্ঞানের সিঙ্গুলারিটি, মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রেম, খুন থেকে রহস্য, রূপক থেকে থ্রিলার সব আছে বইটাতে। আর কি বর্ণনাভঙ্গি! আলাদা একটা ভাষা ব্যবহার করেছেন যেন! নাম গল্প সুরাইয়া, উত্থান, চেইন ক্যাফে আর মরিবার হলো তার স্বাদ - ভীষণ ভালো লেগেছে। লেখকের বানিয়ালুলু পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে গেল বইটা।
একটানা অনেকগুলা ছোটগল্প কখনোই ���ড়তে পারি না। কিন্তু সুরাইয়ার গল্পগুলো একটানাই পড়লাম। সম্ভবত লেখনশৈলীর জাদুতেই। সেইসাথে গল্পগুলোর ভিন্নধর্মী কনসেপ্টও হয়ত প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। বইয়ের গল্পগুলো বিভিন্ন জনরার। রহস্য, পরাবাস্তব, কল্পবিজ্ঞান, কিছুটা স্যাটায়ারও হয়ত। নির্দিষ্ট গন্ডিতে বাঁধা যায় না। সব গল্পই বৈচিত্র্যময়। কিন্তু সবথেকে ভালো লেগেছে নিষিদ্ধ, সুরাইয়া, ইন্টারোগেশন আর মরিবার হল তার স্বাদ। সিঙ্গুলারিটি ও উত্থান সবথেকে ভিন্নধর্মী গল্প। অনারারি মেনশন- চেইন ক্যাফে।
নাম গল্পটা ঘোর লাগা। বাকি গল্পগুলোতে শিবব্রত বর্মনীয় উইট আর প্লটের চমক। শিবব্রত বর্মন হঠাৎ করে হয়ে উঠেছেন পত্রিকায় যার লেখা থাকলে সবার আগে পড়তে হবে এমন লেখকদের একজন। এ মুহূর্তে তিনি বাংলাদেশে আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্পকার।
একজন গল্পকার, যার গল্প বলার সুন্দর কৌশলে আমাদের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি হলেন শিবব্রত বর্মন। বানিয়ালুলু পড়ার পর থেকে চাতকের মত এই লেখকের লেখার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। অবশেষে মেলায় আসলো নতুন বই সুরাইয়া। এই গল্পগুলো তৃপ্ত করতে পেরেছে খুব অসাধারণ ভাবে। এই গ্রন্থের নাম গল্প 'সুরাইয়া' গল্পটার কথা ধরা যাক। যেখানে শুধু দুইজন মানুষ জানে পৃথিবীর একটা ভাষা। কিন্তু তার শিখলো কার থেকে? 'সুরাইয়া' গল্পের কারিকুরি আমার মতো সাধারণ পাঠককে সহজেই একটা মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে দিয়েছে। 'উত্থান' গল্পটি দু'টো টাইমলাইনে ঘটতে থাকা ঘটনার অদ্ভুত বিবরণ। পাঠককে চৌম্বকের মতো আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করে এই গল্পের পরিণতি জানার জন্য। সুরাইয়া আর উত্থান ছাড়ও হামশাকল, দাবা, নিষিদ্ধ, ইন্টারোগেশন আমার প্রিয় গল্প এই বইয়ে। তাছাড়াও 'আমার আমার বাম বুদ্ধিজীবী বন্ধুরা কেন আমার চেয়ে স্মার্ট' গল্পটি যেন দ্ব্যর্থক অর্থে রচিত হওয়া একটি গল্প বলে মনে হয়েছে। যার দুটো মানে বের করা যায়। প্রথমটি হলো, লেখক যা আমাদের বলে গিয়েছেন সেই কথাগুলো। আর দ্বিতীয়টি হলো তার আড়ালে বলা ভিন্ন আরেকটা গল্প, যেটার সাথে হয়তো চেনা জগতেরও মিল খুঁজে পেতে পারে পাঠক। সবশেষে বলি, সুরাইয়া আমাকে পরিতৃপ্ত করেছে। কখনো আনন্দের খোরাক দিয়েছে আবার কখনো ভাবার খোরাক, নয়তোবা থ্রিল দিয়েছে কখনো কখনো। আমার শিবব্রত সাহেবের লেখা পড়লে মনে হয়, এতো তারাতাড়ি কেন লেখা শেষ হয়ে গেলো! আরেকটু থাকতে পারতো না? কিংবা আরেকটা গল্প! তাই আবার কোনো নতুন লেখার জন্য লেখকের পানে চাতক হয়ে বসে রইলাম।
গল্প বলার যে মেদহীন ও স্বতঃস্ফূর্ত কায়দা শিবব্রত বর্মণ রপ্ত করেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তাঁর রচিত 'বানিয়ালুলু' পড়ার পর থেকেই তাই অপেক্ষা ছিল নতুন বইয়ের। 'সুরাইয়া' নিয়ে প্রত্যাশাও তাই আকাশচুম্বী। তবে এ কথা বলতেই হয়, সার্বিক বিচারে আজও 'সুরাইয়া'এর চেয়ে এগিয়ে থাকবে 'বানিয়ালুলু'। কারণ, এবারের বইতে তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। একইসাথে কিছু গল্পে কোথাও যেন সুর কেটেছে। তবে শিরোনামের গল্পটি এতই ঘোরলাগা যে বারদুয়েক পড়তে হলো। এই একটি গল্পের জন্যই বইটি স্মরনীয় হয়ে থাকবে বহুদিন। এছাড়া ভালো লেগেছে, নিষিদ্ধ, মরিবার হলো তার সাধ ও উত্থান।
শিবব্রত বর্মণের পরবর্তী গল্পজগতে প্রবেশের অপেক্ষায় রইলাম...
ছোট্ট একটা বই যেন মাখনের মতো গলে যায় কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পড়া শেষ হয়ে গেল। বানিয়ালুলু পড়ে প্রতিক্রিয়া ছিল দারুণ। এই বইয়েও লেখকের সেই লেখার ধরণটি উপস্থিত। যদিও বানিয়ালুলুতে বেশিরভাগই ছিল সায়েন্স ফ্যান্টাসী, এবারের গল্পগুলোর মধ্যে বিভিন্ন বিষয় মেলানো মেশানো। বইয়ের নাম যে গল্প দিয়ে শিরোনাম দেয়া হয়েছে সেই সুরাইয়া কিংবা নিষিদ্ধ, মরিবার হলো তার সাধ কোনটাই পুরোপুরি ফ্যান্টাসী গল্প নয়, অন্তত আমাদের স্বাভাবিক জীবনে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাব্যতা উড়িয়ে দেয়া যায় না হোক তা কল্পনা। তবু লেখকের অদ্ভুত গল্প বলার ক্ষমতা, ভাষার বুনোট, শব্দচয়ন মনকে নিয়ে যায় কোন এক কল্পলোকে, কোন এক জাদু বাস্তবতায়।
সিঙ্গুলারিটি বিশুদ্ধ সায়েন্স ফ্যান্টাসি, ইন্টারোগেশন, উত্থানকেও ফ্যান্টাসি গল্পের মধ্যেই ফেলতে হবে এবং সব কয়টিই এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো। কিছুটা দূর্বল মনে হয়েছে লোকটা, চেইন ক্যাফে কিংবা আমার বাম বুদ্ধিজীবি বন্ধুরা কেন আমার চেয়ে স্মার্ট,হামশকল এই কয়টি গল্প। লোকটা গল্পটি যেন হঠাৎ শেষ নির্দিষ্ট কোন পরিণতি না নিয়েই, চেইন ক্যাফেও গতানুগতিক এবং অনুমেয় আর আমার বাম বুদ্ধিজীবি বন্ধুরা কেন আমার চেয়ে স্মার্ট এই গল্পটিও ঠিক যেন মন ভরালো না। হামশকল গল্পে কোন বিষ্ময়কর পরিণতির জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষটা যেন একটু সাদামাটাই হয়ে গেল। তবু সব মিলিয়ে শুরুতে যা বলেছিলাম মাখনের মতো গলে গেল বইটা, শুরু করতে বসে শেষ করতেই হলো। লেখকের গল্প বলার ধরণ, গল্পের বিষয়বস্তু সবই মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। অনেকসময় এমনও মনে হয়েছে বিষয়বস্তু মূখ্য নয়, কিন্তু পড়ছি মন্ত্রমুগ্ধ হয়েই। একালে এমন সাবলীল অথচ বর্ণনা নির্ভর গল্প বলার ভঙ্গী খুব বেশি লেখকের লেখায় বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভাষা শৈলী এমন যে একটা স্রোতের আবর্তে ফেলে দিকে বাধ্য পাঠককে যে গল্পের শেষ পর্যন্ত যাওয়া না পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতে হয়। ২০১৯ এর বানিয়ালুলুর পর এই বইমেলার সুরাইয়া সময়ের ফাঁকটুকু বেশি হয়ে গেল মনে হয়। লেখকের কাছ থেকে আরও বেশি এবং আর নিয়মিত এমন লেখার প্রত্যাশায় রইলাম।
অভারঅল ৩.৫ সংকলনটিতে ১১ টি নানা বিষয়ের গল্প আছে,যা পাঠককে যথেষ্ট ট্রান্স এর মধ্যে ফেলে দেয়।গল্পগুলো হলোঃ ১.দাবা - ৩/৫ ২.নিষিদ্ধ-৪/৫ ৩.সুরাইয়া-৫/৫ হিন্দি একটি গান আছে-সুরাইয়া জান লেগি ক্যায়া? এক্ষেত্রে সুরাইয়া জান নিজে নেয়নাই,প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। ৪.লোকটা-২/৫ গল্পটিতে একটি আইডিয়া ছিলো শুধু মাত্র,গল্প ছিলো না। ৫.সিংগুলারিটি-২/৫ পড়তে যেয়ে মাথায় জট লেগে গেছে। ৬.চেইন ক্যাফে-৩/৫ খুব অনুমেয় হলেও,বেশ লেগেছে। ৭.ইন্টারোগেশন-৫/৫ ৮.উত্থান-৩.৫/৫ সিনেমা এবং সিনেমা নির্মানশৈলী বিষয়ে ধারণা থাকলে বোধকরি আরো বেশি ভালো লাগতো। ৯.হামশাকল-৩/৫ ১০.আমার বাম বুদ্ধিজীবী বন্ধুরা কেন আমার চেয়ে স্মার্ট-৩/৫ ১১.মরিবার হলো তার স্বাদ- ৫/৫ (সুরাইয়া আর এই গল্পটি আমার মতে প্রথম স্থানে টাই করেছে)
সবশেষে বলবো,লেখকের লেখার অভিনবত্ব,আইডিয়াতে বেশ চমক খেয়েছি।এই যে কেমন কেমন ঘোর লেগে যাওয়া টাইপের বিষয়বস্তু,এটিই বোধহয় লেখকের বিশেষত্ব।ছোটগল্পে আমার কখনো মন ভরেনা,আমি বিশেষ একটা পড়িও না ছোটগল্প,লেখক যদি তাঁর এমন অদ্ভুত বিষয়-আইডিয়া নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখেন,বেশ হয়।
ছেলেবেলায় পড়া সেবা প্রকাশনী থেকে বেরনো কিছু গল্প সংকলনের কথা আজও মনে পড়ে। পঞ্চ রোমাঞ্চ, ছায়া অরণ্য কিংবা জামশেদ মুস্তফির হাড়। গল্পগুলোতে থাকত চমক আর বিস্ময়। প্রায় সব গল্পই ছিল বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা।
মিঃ বর্মনের 'বানিয়ালুলু' গল্প সংকলনে সেইসব গল্পের অলৌকিক স্বাদ কিছুটা ফিরে পেয়েছিলাম। 'সুরাইয়া'র জন্য তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলাম। এতটাই বেশি ছিল সেই আগ্রহ যে বইটা হাতে পেয়েই পড়িনি। রেখে দিয়েছিলাম। এরপর প্রায়ই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতাম। ছোট একটা বই। বড় বড় ফন্টে লেখা। পড়া শুরু করলেই শেষ হয়ে যাবে। তাই পড়ি না।
অথচ পড়ার পরে হতাশ হলাম। জমল না মোটেই। মনে হয় আরও সময় নিয়ে আরো বেশ কতগুলো গল্প জমলে সেখান থেকে বাছাই টাছাই করে সংকলনটি প্রকাশ করলে ভালো হত।
দাবা : ৩/৫ নিষিদ্ধ : ২/৫ সুরাইয়া : ৫/৫ লোকটা : ১/৫ সিঙ্গুলারিটি : ২/৫ চেইন ক্যাফে : ২/৫ ইন্টারোগেশন : ৫/৫ উত্থান : ৫/৫ হামশাকল : ৪/৫ আমার বাম বুদ্ধিজীবী বন্ধুরা কেন আমার চেয়ে স্মার্ট : ৩/৫ মরিবার হলো তার স্বাদ : ৫/৫
নন-লিনিয়ার স্টোরিটেলিং, পরাবাস্তবতা এবং দুর্দান্ত সাহিত্য ভাষা - এই তিন হলো তাঁর গল্পের আবরণ। আর গল্পের স্কেলেটন বা কাঠামো, মানে তাঁর আইডিয়া; গল্পের কেন্দ্রে যে বসে চরকি কাটছে আপন মনে - এগুলোর জন্ম আসলেই পৃথিবীর বাইরে, অন্য কোথাও।
আমার এরকম রেটিংয়ের কারণ, বানিয়ালুলুর সমান এক্সপেকটেশন আর আগে থেকে কিছু গল্প পড়া থাকা। সবার ভালো-মন্দ লাগা আমার সাথে নাও মিলতে পারে। তবে স্বীকার করবেন নিশ্চয়ই, প্রতিটা গল্পই আপনাকে স্তব্দ করে দেবে পড়ে শেষ করার পর।
শিবব্রত বর্মনের মাথার ভেতরের পৃথিবীটা কেমন, সেটা এই বই পড়তে গিয়ে আবারও দেখতে ইচ্ছে হয়েছে বারেবারে। গল্প নিয়ে একটা অক্ষরও না লেখার কারণ, সেটা হবে অযথা চেষ্টা। ধরা যাবে না ও জিনিস আমার ভাষায়।
শিবব্রত বর্মনের গল্পপাঠে একটা অন্যরকম উত্তেজনা অনুভব করা যায়। নিরুদ্দেশ যাত্রার মতো, গন্তব্য জানা নেই; কুয়াশায় ঢাকা চোরাগলি, কাঁটার মতো ছড়িয়ে থাকা ধাধাঁ। ঝোপঝাড় ঠেলে এগোতে গিয়ে প্রায়সই চমকে উঠতে হয়।
তবে বানিয়ালুলু যেমন আগাগোড়া মুগ্ধ করেছিল, গল্প সংকলন হিসেবে 'সুরাইয়া' তেমনভাবে আমার মনে দাগ কাটতে পারেনি।
চেইন ক্যাফে, হামশাকল, নিষিদ্ধ - এই গল্পগুলো ভালো লেগেছে। সেরা হিসেবে বেছে নিতে বললে নির্দ্বিধায় নাম গল্প 'সুরাইয়া।'
শিবব্রত বর্মনের লেখার সাথে আমার পরিচয় "বানিয়ালুলু" গল্পগ্রন্থ পড়ার মাধ্যমে। প্রথম আলো'র কোনো এক ঈদসংখ্যায় "দুশমন" নামের উপন্যাসিকাও পড়া হয়েছে। উনার লেখনশৈলী মুগ্ধ করার মতো, "সুরাইয়া" গল্পগ্রন্থও এর ব্যতিক্রম নয়। একটানা এগারোটা গল্প পড়ে শেষ করেছি। লেখকের লেখার ধাঁচ ই এরকম যে পাঠককে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে। নামগল্প "সুরাইয়া" সংকলনের সেরা গল্প।
অসীম আগ্রহ নিয়ে লেখকের পরবর্তী বইয়ের অপেক্ষায় থাকবো।
শিবব্রত বর্মন সহজাত মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন গল্প বলার ক্ষেত্রে। তবে কয়েকটা গল্প একটু অসংলগ্ন লেগেছে, সম্ভবত এক্সপেরিমেন্টাল ছিলো। তবে যে কয়টা ভালো, সেগুলোর জন্যে হলেও পড়ার রেকমেন্ডেশন থাকবে।
গল্পগুলোর চৌহদ্দি বোঝা আসলেই কঠিন! আলাদা আলাদা স্বাদ প্রতিটা গল্পের, আর সেই স্বাদগুলোও আবার বহুল চর্চিত না। একেবারেই ভিন্ন রকম৷ শিবব্রত বর্মণের আর্টিকেল পড়ার পর পূর্ণাঙ্গ বই পড়ি বানিয়ালুলু। সেটা ভালো লেগেছিল। সুরাইয়া পড়ি পড়ি করেও পড়া হয়ে উঠছিল না। এই বছরের প্রথম কেনাকাটার লিস্টে সুরাইয়া তুলে নিলাম আর বছরের প্রথম ৪ তারাও এই বইটিকেই দিতে বাধ্য হলাম। একেবারেই ভিন্ন ধাঁচের বর্ণনাশৈলী, লেখক নিজস্ব ভাষা নির্মাণ করতে চাইছেন আর অনেকাংশে সফল ও। নামগল্প সুরাইয়ার মতোই শিবব্রত এবং তাঁর পাঠকদের বোঝাপড়ার আলাদা একটি ভাষা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, বিষয়টা রোমাঞ্চকর। সুরাইয়া, চেইন ক্যাফে, উত্থান আর মরিবার হলো তার স্বাদ আমার বেশি ভালোলাগার হয়ে থাকবে৷ হামশাকলটা কি কখনো কোন পত্রিকা বা ঈদ সংখ্যায় এসেছিল? গল্পটা আগেও পড়েছি মনে হল। সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে দিকটা, খুব স্বাদু ভাষায় লেখক গল্পগুলো লিখেছেন, রূপকাকারে নাগরিক জীবনের জটিলতা এনেছেন কিন্তু পড়তে পড়তে আগ্রহ হারায় না বা খুব ভারী ভাষা ব্যবহার না করার কারণে কোন প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি হয় না৷ উপরন্তু বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যের পাশাপাশি মানবমনের জটিল দ্বন্দ্ব এবং জাগতিক কিন্তু অপার্থিব রহস্যময়তার আবহ থাকায় বইটার প্রতিটা গল্পই একটানে শেষ করতে হয়। এছাড়াও গল্পগুলোর একটা স্ট্রেঞ্জ এন্ডিং থাকায় এবং নানা ভাবনার বীজ থাকায় পাঠককে ভাবিতও করে। শিবব্রত বর্মণের কাছে প্রত্যাশা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। একজন পাঠক হিসেবে এটা আনন্দের।