দীপেন (দেবদর্শী) ভট্টাচার্য (Dipen Bhattacharya) জ্যোতির্বিদ, অধ্যাপক ও লেখক। জন্ম ১৯৫৯ সালে। আদি নিবাস এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা কলেজে পড়াশুনা করেছেন।
মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ম্যারিল্যান্ড-এ নাসার (NASA) গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইনস্টিটিউটের গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিআর) গামা রশ্মি জ্যোতি জ্যোতিঃপদার্থবিদ হিসেবে যোগ দেন। মহাশূন্য থেকে আসা গামা-রশ্মি পর্যবেক্ষণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে বায়ুমণ্ডলের ওপরে বেলুনবাহিত দূরবীন ওঠানোর অভিযানসমূহে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে পদার্থবিদ্যায় গবেষণা করছেন ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড কমিউনিটি কলেজে; এছাড়া পদার্থবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানে অধ্যাপনা করছেন ক্যালিফোর্নিয়ার মোরেনো ভ্যালি কলেজে। ১৯৭৫ সালে তিনি বন্ধুদের সহযোগিতায় ‘অনুসন্ধিৎসু চক্র’ নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬-২০০৭ সালে ফুলব্রাইট ফেলো হয়ে ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। বাংলাদেশে বিজ্ঞান আন্দোলন ও পরিবেশ সচেতনতার প্রসারে যুক্ত।
পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ছাড়াও বাংলা ভাষায় তাঁর বিজ্ঞান-কল্পকাহিনিভিত্তিক ভিন্ন স্বাদের বেশ কয়েকটি ফিকশন বই প্রকাশিত হয়েছে।
কল্পবিজ্ঞান... মানে ঠিক কী, বলতে পারবেন? জানি, প্রশ্নটা ভারি অদ্ভুত শোনাচ্ছে। আমি নিজে একজন কল্পবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা-করা, এমনকি অল্পবিস্তর লেখালেখি-করা মানুষ। সেই আমি এমন ঘেঁটে যাওয়া মানুষের মতো করে প্রশ্নটা কেন তুলছি? তার কারণ একটিই। এইমাত্র এমন একটি বই পড়ে শেষ করলাম, যা আমাকে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে ভেবে রাখা যাবতীয় সংজ্ঞা আর প্যারাডাইমকে নতুন করে দেখতে বাধ্য করছে। তার চেয়েও বড়ো কথা কী, জানেন? বইটির ভাষা বাংলা। গল্পগুলো লিখেছেন এক বাঙালি। তাতে না-বলিয়া বিলাতি দ্রব্য আপন করার কোনো ব্যাপারই নেই। বাংলা ভাষায় নাকি কল্পবিজ্ঞানের চর্চাই হয় না; বিজ্ঞেরা এমনই বক্তব্য রাখেন। বাংলায় নাকি প্রফেসর শঙ্কুই কল্পবিজ্ঞানের পরাকাষ্ঠা; ফেসবুকে এমনই দাবি করে পোস্ট আর কমেন্টের মিছিল দেখি। সেই বাংলা ভাষায় এমন একটা বই লেখা হয়েছে! এরপর সব ঘেঁটে যাওয়াই কি স্বাভাবিক নয়? বইটির লেখক হলেন দীপেন ভট্টাচার্য। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় তিনি পরিচিত নাম। বহু জার্নালে তাঁর মূল্যনান লেখাজোখা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমার সঙ্গে তাঁর লেখার যৎসামান্য পরিচয় ঘটেছিল 'কল্পবিশ্ব' পত্রিকায় প্রকাশিত "মাউন্ট শাস্তা" পড়তে গিয়ে। আলোচ্য বইয়ে সেই গল্পটি এবং আরও একগুচ্ছ ছোটো ও বড়ো লেখা স্থান পেয়েছে। তারা হল~ ১. ক্যামেলট— একটি দূর সময়ের কাহিনি; ২. পৃথিবীর ছায়া; ৩. মনোনকে এক্সপেরিমেন্ট; ৪. মাউন্ট শাস্তা; ৫. বার্ট কোমেনের ডান হাত; ৬. শ্যাতোয়ান্ত; ৭. বেলা ও রেশমি; ৮. রান বয় রান; ৯. নিস্তার মোল্লার মহাভারত; ১০. অসিতোপল কিংবদন্তি; ১১. সিনেস্থেশিয়া; ১২. প্রাসাদ; ১৩. কাপ্রির নীল আকাশ; ১৪. প্রজাপতির স্বপ্ন; ১৫. প্রতিসরিত প্রতিবিম্ব; ১৬. পদ্মগুলঞ্চ; ১৭. বিস্মরণ; ১৮. মা'র সঙ্গে— ট্রেনে; ১৯. শবাধার; ২০. নিওলিথ স্বপ্ন; ২১. ইসাবেল সিমোনের সাক্ষাৎকার। গল্পগুলোর নাম থেকে আপনারা তাদের সম্বন্ধে কিছুই বুঝতে পারবেন না। এদের মধ্যে রয়েছে স্মৃতি, চেতনা, ইচ্ছে, ভয়, বাংলাদেশের ইতিহাস, ট্র্যাজেডি, কল্পনা, আধুনিকতম বিজ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ও কল্পনা, সময়... এমন আরও কত কী। এগুলো এই লেখায় আদৌ আদি-মধ্য-অন্ত-র সুচারু কাঠামো অনুযায়ী বিন্যস্ত হয়নি। কৈশোরের উদ্ভাস, অচেনা নক্ষত্রের আলোয় ভেসে যাওয়া আকাশ, রাজাকারের হিংস্র উল্লাস, এক ডিস্টোপিয়ান দুনিয়ায় প্রেমের দীর্ঘশ্বাস— এ-সব মিশে গেছে এই গল্পগুলোতে। পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, এ যেন জলের গভীর থেকে নানা বর্ণ আর দ্যুতি বিচ্ছুরণ করা এক বিচিত্র নাক্ষত্র-বস্তু। কিন্তু... এই ঐশ্বর্য আর অচেনা পরিসরই এই লেখাগুলোকে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। তার কারণ~ প্রথমত, এদের মধ্যে বহু গল্পই স্রেফ বিবরণ-ভিত্তিক। তাতে সংলাপ নেই, বা থাকলেও নগণ্য। এমন লেখা পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হওয়া কঠিন। দ্বিতীয়ত, বহু গল্পে পটভূমি, চরিত্র, বাচনভঙ্গি— সবই আমাদের কাছে ভীষণরকম অচেনা৷ ব্যাপারটা শুনতে কাঁঠালের আমসত্ত্ব গোছের শোনালেও কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে কিছু চেনামুখ আর পরিপ্রেক্ষিত না পেলে তাকে আপন করে নেওয়া মুশকিল। তৃতীয়ত, আমার ধারণা, এই লেখাগুলো গল্প বলার বদলে কিছু অত্যন্ত আকর্ষক ও কৌতূহলোদ্দীপক আইডিয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতেই বেশি আগ্রহী হয়েছে। এরপর আমার মতো কেউ এই বইটাকে খুঁড়ে সহজপাচ্য প্লটের সন্ধানে রত হতে পারেন। কিন্তু সরাসরি পাঠকের সঙ্গে এই বইয়ের সংযোগ-স্থাপন... কঠিন। বইটির মুদ্রণ চমৎকার। প্রচ্ছদটিও রুচিশীল, তবে গল্পগুলোর সঙ্গে হেডপিস কি নিদেনপক্ষে একটি করে মোটিফ থাকলে ভালো হত। যদি কল্পবিজ্ঞান বিষয়টা নিয়েই নতুন করে ভাবা প্র্যাকটিস করতে চান, তাহলে এই বইটি আপনার অবশ্যপাঠ্য। অলমিতি।
যত বই পড়ি তার মধ্যে বেশ কিছু ভালো লাগে। কিন্তু তারও সবকটা নিয়ে দু চারলাইন লেখা হয়ে ওঠে না। সময়াভাবই মূল কারণ সেটার।
কিন্তু এক-আধটা এমন বইও পড়া হয়ে যায় যা নিয়ে না লিখলে নিজেরই অস্থির লাগে। বিশেষ করে সে বই যদি ততটাও পাঠক-পরিচিত না হয়ে থাকে।
‘অসিতোপল কিংবদন্তি’ এমনই একটা বই।
বই নিয়ে রেকমেন্ডেশনে ভরসা করি (এমন লোকের সংখ্যা প্রচণ্ড কম) এমন একজন না বললে, সত্যিই বলছি বইটা আমি নিতুম না। লেখকের নাম শুনিনি এর আগে, বইটা দেখেও খুব একটা আহামরি মনে হয়নি। অথচ পড়তে শুরু করার পর…
নির্দ্বিধায় বলছি, বাংলা ভাষায় বর্তমানে এমন উঁচুমানের বিশুদ্ধ কল্পবিজ্ঞানের গল্প খুব কম পড়েছি।
লেখক পদার্থবিদ, নাসার গবেষক, বিভিন্ন নামী ইউনিভার্সিটিতে জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যা ও গামারশ্মি নিয়ে কাজ করেছেন। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় অধ্যাপনা করেন, এবং তাঁর স্বদেশ বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও পরিবেশ সচেতনতার প্রসারে যুক্ত। এমন একজনের লেখায় বিজ্ঞান তার যথাযথ মহিমাসহ উপস্থিত থাকার কথা, এবং তাই-ই হয়েছে। ভালো লাগার এটা একটা বড়ো কারণ, কিন্তু তাছাড়াও একইসঙ্গে দীপেনবাবু সুলেখকও। তাঁর গল্পগুলি প্রচলিত থ্রিলারধর্মী আবেগের প্রসাধন, অতিনাটকীয়তা বর্জন করে সাদাসিধা যুক্তিনিষ্ঠ চালে এগোয় এ কথা সত্য, কিন্তু সে চলনে সহজ আলাপের স্নিগ্ধতা আর মানবিক অনুভূতির নিবিড় প্রকাশ সুন্দরভাবে ধরা পড়ে।
বিজ্ঞান বিষয়ে বিন্দুমাত্র শুষ্ক আলোচনা বা জ্ঞানপ্রদর্শন না করেও বিজ্ঞানের কিছু আশ্চর্য আবিষ্কার, গভীর সূত্রে ভর করে এত অভাবনীয়ভাবে এবং এত অনায়াস ঢঙে এক একটি প্রেক্ষাপট, এক একটি ঘটনাক্রম গড়ে উঠতে থাকে যা প্রতিবার পাঠককে মুগ্ধ করে, থমকে থেমে ভাবতে বাধ্য করে।
সংকলনে মোট একুশটি গল্প আছে। সেগুলিতে সময়ের ধারণা নিয়ে খেলা আছে, metamaterials এর কথা আছে, ক্লোনিং-এর থেকেও জটিল নিউরোসায়েন্সের এক্সপেরিমেন্টের কথা আছে, টাইম-ট্রাভেল আছে, AI আছে, ক্রায়োজেনিয়ান পৃথিবীর কথাও আছে, দূর মহাকাশের কোনও মৃতপ্রায় গ্রহের সভ্যতার গল্পও আছে। কিন্তু শুধু এটুকুই এ বইয়ের শেষ কথা নয়, এ বইতে আছে আরো কিছু… যেমন ‘পৃথিবীর ছায়া’ গল্পে সাধারণ কিশোরের বয়ানে তার দিনযাপন, আশপাশের মানুষদের প্রতি আকর্ষণ বা বিকর্ষণ খুব চেনা লাগে পাঠকের, ‘শ্যাতোয়ান্ত’ গল্পে কঠোর সমাজনীতি ও সে সমাজ বদলানোর স্বপ্ন ভীষণভাবেই মিলে যেতে থাকে ইতিহাস ও বর্তমানের ওঠাপড়ার সঙ্গে, ‘রান বয় রান’ নির্ভুলভাবে তুলে ধরে বহুদিন পরে এক প্রবাসীর দেশে ফিরে অচেনা বর্তমানের সামনে দাঁড়িয়ে বিপন্ন বিস্ময়, ‘সিনেস্থেশিয়া’ গল্পে নির্লিপ্ত ও নির্মম স্বরে বলা হয় রাজাকারদের চরম অন্যায়-অত্যাচারের কথা।
এই সব মিলিয়ে যা হয়, তা শুধু কল্পবিজ্ঞান নয়, শুধুই গল্পও নয় হয়তো। এ লেখাগুলি পাঠকের মনের ঘরে নতুন এক জানলা খুলে দেয়, হয়তো বা একাধিক।
দুটি মাত্র মৃদু অভিযোগ রইল – এক, মলাটের ছবিটি বিন্দুমাত্র আকর্ষণীয় নয়, বিশেষ করে কল্পবিশ্ব যে মানের প্রচ্ছদ করছে আজকাল সে তুলনায়… আর বইয়ের নামটি, এরকম বইয়ের একেবারেই উপযুক্ত মনে হয়নি। না, কঠিন শব্দ বা নামে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা নেই। আমার প্রিয় লেখক বঙ্কিমচন্দ্র, অসিতোপল মানেও(অসিত+উপল, সাদা নয় এমন পাথর, বিশেষার্থে নীলকান্তমণি) আমি জানতুম – তবু একটা কল্পবিজ্ঞান গল্পসংকলন হিসাবে এ নামটা মেনে নিতে আমার অসুবিধে হয়েছিল এবং এখনও হ���্ছে কেন যেন! তা বাদে বইটি কল্পবিশ্বের এখনকার সমস্ত বইয়ের মতোই সুমুদ্রিত; প্রুফের ভুল চোখে পড়েনি; পাতার কোয়ালিটি, বাঁধাই, ফন্ট সাইজ প্রত��টি অত্যন্ত ভালো।
তবে হ্যাঁ, এ বই একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার নয়; এটি বার বার থেমে, নিজের ভিতরে ডুব দিয়ে, নিজে ভেবে, কল্পনার পাখা মেলে ধরে, সময়ে নিয়ে পড়ার মতো বই। ফিরে ফিরে পড়ার মতো বই।
সকলেই এ বইয়ের গভীরতা ছুঁতে পারবেন কিনা জানি না, কিন্তু মগ্নপাঠে অভ্যস্ত যেকোনো পাঠকের কাছে এ বই এক নীলকান্তমণির মতোই সুন্দর ও দুর্লভ।
বিজ্ঞান নিয়ে সামান্যও আগ্রহ থাকলে, অবশ্যই পড়ুন।
---
বই – অসিতোপল কিংবদন্তি লেখক – দীপেন ভট্টাচার্য প্রকাশক – কল্পবিশ্ব মুদ্রিত মূল্য – ৪০০/-
লেখক দীপেন ভট্টাচার্য বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানের অধ্যাপক। তাঁর জন্মস্থল বাংলাদেশ, তাঁর শৈশব মুক্তিযুদ্ধের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত, তাঁর কর্মস্থল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নানা দেশ। তাঁর গবেষণা মহাকাশ, বিচরণ রবীন্দ্র-মাণিক, সিলেবাস পদার্থবিদ্যা এবং ফিরে আসা শৈশবের সাথে যুক্ত একটি ওয়ার্ম-হোল৷ অসিতোপল কিংবদন্তি ২১টি ছোটগল্পের একটি ভারতীয় সংকলন, যা ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকা বা গল্প-সংকলনে প্রকাশিত। বইটি আমি পড়া শেষ করি গতবছর পূজাবকাশে। বলতে বাধা নেই, খুবই ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়ে গল্পগুলোকে রেটিং দিতে শুরু করি। কিন্তু সেই কাজ অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়, যখন আমি আবিষ্কার করি আমার ১ থেকে ১০ লেখা ফিতে গল্পগুলির গভীরতা মাপতে অপারগ। বইটি হাতে পাওয়ার আগে আমার পড়া ছিল উপন্যাস 'অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো', আর গল্পের মধ্যে 'নিস্তার মোল্লার মহাভারত', 'মাউন্ট শাস্তা', 'শবাধার', আর 'শ্যাতোয়ান্ত'। তাই লেখার নিয়ে একটা ধারণা আগে থেকেই ছিল। বিজ্ঞানী লেখক হলে ( বা কোন লেখক বিজ্ঞান পড়ে এলে) প্রায়ই দেখা যায় গল্পে ব্যবহৃত বিজ্ঞানের বিষয়টি পাঠকদের পড়ানোর দায়িত্ব তিনিই নেন, এবং সেটাকেই একটু বিস্তার করে কল্প ও গল্প - দুটি বস্তু মেলে ধরেন। এখানে সেই ভয় নেই। চেনা ট্রোপও খুব একটা মিলবে না। যেটা মিলবে তা হল এক ধারণার সাথে আরেক ধারণার অন্তর্দ্বন্দ্ব। চিরায়ত কথাসাহিত্য যেমন কোন মানুষের গল্প বলে, অন্য চরিত্রের সাথে তৈরী হওয়া দ্বন্দ্ব ও নিজের ভেতর চলতে থাকা অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলে – এই গল্পগুলোও তার চেয়ে আলাদা নয়। কিন্তু বদলটা দেখতে পাওয়া যায় সত্তায়, সময়ে, পরিবর্তিত বাস্তবতায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পালটে যাওয়া পরিস্থিতি নিজে গৌণ ভূমিকা নিয়ে গল্পের মূল সচেতন সত্তার অভিব্যক্তিকে প্ররোচিত করে তাকে মুখ্য ভূমিকা দিয়েছে। এই সত্তা সবসময়ে মানুষ নন। যেমন ক্যামেলট গল্পে একটি সচেতন সত্তা জানাচ্ছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর ইতিহাস। বেলা ও রেশমীতে সত্তা নিজের স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করে যখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে হাজার হাজার বছর পার করে অন্য এক সভ্যতায়। প্রাসাদ গল্পে আবার একটা প্রাচীন প্রাসাদই যেন একটা আলাদা গ্রহ, সেখানে সভ্যতার বিকাশের ইতিহাস পুনরাভিনীত হচ্ছে মনুষ্য ও বৃক্ষচেতনার অভিযোজনে। বার্ট কোমেনের ডান হাত বৈজ্ঞানিক কারিকুরিতে আলাদা মস্তিষ্ক পেয়েছিল গল্পে। কল্পিত প্রেক্ষাপট ছাড়াও প্রচুর গল্প আছে যেগুলো একদম চেনা পৃথিবীতে, পরিচিত জনবৃত্তে ফাঁদা। আছে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব। কেশব ব্যানার্জি স্ট্রিটের নিস্তার মোল্লার সাথে তার অদ্ভুত উপন্যাসের খোঁজ পেতে পারেন, ময়মনসিংহের আমলাপাড়ায় থাকা ভাড়াটে সালমা আপা আর রোকেয়া খালার কিছু রহস্য আপনি তদন্ত করে দেখতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রাজাকারদের ঘৃণ্য অপরাধ জানবেন খুলনার সাহানার জবানবন্দীতে। ইসলামপুরের রাস্তায় কখনও দেখা হয়ে যেতে পারে নিজেরই শৈশবের সাথে। বইয়ের তিনটি উল্লেখযোগ্য গল্প হল মাউন্ট শাস্তা – দুটি বিপরীতমুখী সময়প্রবাহের মাঝামাঝি এসে পড়া কিছু মানুষের গল্প, শ্যাতোয়ান্ত – নিয়ন্ত্রক ও প্রতিবাদীর মধ্যে চলা একটি কথোপকথন আর প্রজাপতির স্বপ্ন – পুরনো স্মৃতি ভেঙে নতুন স্মৃতি গড়ার গল্প বা স্মৃতি ভুলিয়ে এক প্রবঞ্চনার গল্প। সাহিত্যকর্মের বিচারে প্রতিটা গল্পই উচ্চমানের, কল্পবিজ্ঞানের মাত্রায় তাদের মাপা হোক বা না হোক। বিনোদনের বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা নেই, চেনা ছকে ফেলে উৎরে দেওয়ার প্রবণতা নেই। লেখার মধ্যে লেখকের বিজ্ঞান, দর্শন ও মনুষ্যত্বের উপর প্রজ্ঞা প্রতিফলিত হয়। বাংলা SF এ বইটি সেরাদের সারিতেই থাকবে।
এই গল্প সংকলনে 21টি গল্প আছে।সব গল্পই প্লট বৈচিত্র্যে অসাধারণ। গল্পে মুক্তিযুদ্ধ আছে, গল্পে কল্পবিজ্ঞান আছে আর আছে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক।সব গল্পই শুধু কল্প কাহিনী বা কল্প বিজ্ঞান না হয়ে আরো অন্য কিছু হয়ে উঠেছে।প্রতিটি গল্প পড়লে বোঝা যায় লেখক অনেক কিছু জানেন।physiology থেকে phisics এ অনায়াসে চলে এসেছেন।সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগলো। আমার রেটিং 5/5
এটি একটি একুশটি গল্পের সংকলন, যার মধ্যে কল্পবিজ্ঞান, ফ্যান্টাসি, জাদুবাস্তবতা মিলিয়ে মিশিয়ে আছে। গল্প গুলি আপনাকে ভাবাবে , তাই দ্রুত পড়ার জন্য এই বই নয়। আমিও ধীরে ধীরে পড়ে শেষ করলাম। বেশ ভালই লাগলো।