প্রসাদ রায়কে আমরা না চিনলেও হেমেন্দ্রকুমার রায়কে আমরা এক ডাকেই চিনি। একসময় বাঙালির ঘরের ছেলে জয়ন্ত-মাণিক-বিমল- কুমার আমাদের মন জয় করে নিয়েছিল, আমাদের শিখিয়েছিল বাঙালিও অ্যাডভেঞ্চার করতে পারে, শুধু দেশ-বিদেশে নয় গ্রহান্তরেও। এছাড়াও শিশুকিশোরদের জন্যে রচনা করেছেন অসংখ্য মণিমুক্তো। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের বুদ্ধিজীবী মহলে হেমেন্দ্রকুমারের প্রতি এক অষূয়াজনিত অবজ্ঞা লক্ষ করা যায়। বাংলায় কিশোরপাঠ্য অ্যাডভেঞ্চার, পাল্প গোয়েন্দা বা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যকে জনপ্রিয় করে তুলতে হেমেন্দ্রকুমারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অন্যদিকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখাতে হেমেন্দ্রকুমার যে কতটা সমৃদ্ধ, জটিল, এবং নিজের সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা মানসিকতার ছিলেন তাঁর খবর কজন বাঙালি রাখেন? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অধ্যাপক প্রদোষ ভট্টাচার্য্য এই বইয়ের মাধ্যমে বাঙালিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবেন হেমেন্দ্রকুমারের সঙ্গে। আশা করা যায় বাংলা সাহিত্য জগতে এযাবৎ হেমেন্দ্রকুমারের প্রতি উদাসীনতার প্রায়শ্চিত্ত হবে এই বইটি।
বাংলা সাহিত্য জগতে হেমেন্দ্রকুমার রায় এক কিংবদন্তি— এ-কথা বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি হয় না। তাঁর কিশোরপাঠ্য লেখাপত্র নিয়ে এখনও যে পরিমাণে ব্যবসা চলে তা দেখে স্পষ্টতই মনে হয়, মানুষটি স্বকীর্তিতে কালজয়ী হয়েছেন। কিন্তু তাঁর কাজগুলো নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা হয় না কেন? এর মূল কারণ দ্বিবিধ। প্রথমত এবং প্রধানত, হেমেন্দ্রকুমারের বিপুল পরিমাণ অলৌকিক, রহস্য, বা অ্যাডভেঞ্চারধর্মী সাহিত্যের প্রায় প্রতিটির উদ্দেশেই কুম্ভীলক-বৃত্তির অভিযোগ তোলেন সমালোচকেরা। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর লেখার প্রতি উন্নতনাসা সমালোচকদের ঔদাসীন্য প্রকট হয়। দ্বিতীয়ত, বিদগ্ধজন উত্তর-ঔপনিবেশিকতার আলোয় বাংলার শিশু-কিশোর সাহিত্যে বিস্তর খারাপ জিনিস খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের দাপটে সেইসব লেখকের পক্ষ অবলম্বন করে কিছু বলতে গেলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনমাসের জেল আর সাতদিনের ফাঁসি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। ফলে হেমেন্দ্রকুমার নানা সরু ও মোটা বইয়ে, জঘন্য বা অনুপস্থিত সম্পাদনার শিকার হয়ে সেলিং লাইক হট কচুরিজ। কিন্তু তাঁর এই কীর্তির নানা দিক সম্বন্ধে বিশ্লেষণ? এতদিন তা ছিল না। কিন্তু এই প্রথম আমরা একটি আস্ত বই পেলাম যা ভালো-মন্দ মিশিয়ে হেমেন্দ্রকুমারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনার নানা দিক আমাদের সামনে তুলে ধরল।
হেমেন্দ্রকুমারের মৃত্যুর মাত্র কয়েকবছরের মধ্যেই তাঁর রচনা কীভাবে প্রকাশকদের ঔদাসীন্যে এবং অপেশাদারিত্বের শিকার হয়ে পাঠকের দৃষ্টির অগোচরে চলে যেতে শুরু করেছিল, তা লেখক নিজের স্মৃতি প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। আন্তরিক 'মুখবন্ধ'-টির পর এই বইয়ে আমরা নিম্নলিখিত কটি অধ্যায় পেয়েছি~ ১. হেমেন্দ্র-ভক্তির ইতিবৃত্ত; ২. উপক্রমনিকা; ৩. হেমেন্দ্রকুমারের কর্মসূচি; ৪. হেমেন্দ্রকুমার ও তাঁর উত্তর-উপনিবেশবাদী সমালোচনা; ৫. হেমেন্দ্রকুমারের অভিযানকারীরা ও তাদের 'পরিবার'; ৬. হেমেন্দ্রকুমার রায় ও কোনান ডয়েলের শার্লক হোমস; ৭. হেমেন্দ্রকুমারের গোয়েন্দা কাহিনিতে অলৌকিকতা; ৮. হেমেন্দ্রকুমার রায় ও বাংলা কল্পবিজ্ঞান; ৯. বাংলায় এইচ.জি ওয়েলসের অনুপ্রেরণা, 'প্যাস্টিশ' ও রূপান্তর; ১০. হেমেন্দ্রকুমারের কল্পকাহিনিতে 'রাতের কলকাতা'-র বাস্তব। এরপর এসেছে বিস্তৃত পাঠ-নির্দেশিকা ও তথ্যসূত্র।
আমার মনে হয়েছে, এই বইটি হেমেন্দ্রকুমারের তথা বাংলা কল্পকাহিনির অনুরাগীদের দ্বারা অবশ্যপাঠ্য। তার কারণ~ প্রথমত, স্পেকুলেটিভ ফিকশন তথা কল্পকাহিনির ধারায় হেমেন্দ্রকুমারের যাবতীয় লেখার একটি তথ্যনিষ্ঠ সিংহাবলোকন আছে এতে। কিন্তু অবিমিশ্র মুগ্ধতা বা অন্ধ সমালোচনার পরিবর্তে এই লেখাগুলো বিশ্লেষণাত্মক— যাতে স্পষ্টভাবে ধরা দিয়েছে পরের কাহিনি গ্রহণ করেও তাতে এক শক্তিমান লেখকের আপন দক্ষতা ও স্বকীয়তা প্রদর্শনের ভঙ্গিটি। দ্বিতীয়ত, উত্তর-ঔপনিবেশিকতার গঁতে বাঁধা ভঙ্গিতে হেমেন্দ্রকুমারের অ্যাডভেঞ্চারগুলোকে দেখলে যে প্রকাণ্ড ভুলের পাশাপাশি লেখকের দেশপ্রেম ও মনুষ্যত্বকেও অপমান করা হয়, এটি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রমাণিত হয়েছে লেখাগুলোতে। তৃতীয়ত, বাংলায় শিশু-কিশোরসাহিত্যে নারীচরিত্র অনুপস্থিত থাকাটা একরকম নিয়ম হয়ে ছিল দীর্ঘ, অতি দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু সেইসব লেখার মধ্যে কি কোনো হোমো-ইরোটিক সাবটেক্সট ছিল? লেখক উদ্ধৃতি এবং বর্ণনার সাহায্যে হেমেন্দ্রকুমারের নানা রচনার মধ্যে তেমন সম্ভাবনার উল্লেখ করে তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। চতুর্থত, বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ধারায় হেমেন্দ্রকুমারের যাবতীয় রচনাকেই আমরা 'পরস্মৈপদী' বলে দাগিয়ে দিতে অভ্যস্ত। কিন্তু মহাজনেদের নানা কীর্তির উল্লেখ করে লেখক স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, প্রবর্তক না হলেও এই ধারায় পথিকৃতের সম্মান মানুষটির প্রাপ্য। পঞ্চমত, রহস্য কাহিনির ধারায়, এমনকি অনুকরণ ও বঙ্গীকরণের মধ্যেও হেমেন্দ্রকুমার যে বারবার ছক ভেঙে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং পাঠকদের মুক্তমনা হতে বলেছেন— এই কথাটি এত জোর দিয়ে এর আগে কেউ বলেননি। এই প্রসঙ্গে প্রদোষবাবু হেমেন্দ্রকুমারের শ্রেষ্ঠতম রচনা হিসেবে যে উপন্যাসটিকে চিহ্নিত করেছেন সেটি আমারও মতে, ঠিক ওই ছক-ভাঙা সাহসের জন্যই তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। ষষ্ঠত, হেমেন্দ্রকুমার তাঁর রচনায় বাস্তবকে যথাসম্ভব প্রতিফলিত করতে চাইতেন— এ-কথা বারবার দেখানোর চেষ্টা করেছেন লেখক। কিন্তু সেই বাস্তব যে ক্রূর ও কদর্য হয়ে তাঁর মনে কিশোর সাহিত্যের ধারাটিকেই শুষ্ক করে দিয়েছিল, এমনটি এর আগে কেউ দেখাননি।
বইটির কী-কী নিয়ে আক্ষেপ রয়ে গেল? ১) হেমেন্দ্রকুমারের বিপুল অলৌকিক রচনা, বিশেষত তার নানা 'অনুপ্রেরণা' নিয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক লেখার আশা করেছিলাম। তা পেলাম না এই বইয়ে। ২) হোমস-ওয়াটসন বা অন্য জুটিদের মধ্যে হোমো-ইরোটিসিজম খুঁজে বের করার চেষ্টাটি বেশ প্রাচীন। তবে এখনও অবধি ওগুলো একপাক্ষিক ভাবনার স্তরেই রয়ে গেছে। হেমেন্দ্রকুমারের চরিত্ররাও এতটাই নিরামিষ যে তাদের মধ্যে ওই ধরনের আকর্ষণ/বিকর্ষণ খুঁজে একখানা আস্ত অধ্যায় লেখা মশা দেখার আগেই কামান দাগার মতো ব্যাপার বলে মনে হয়েছে আমার। সেই তুলনায় হেমেন্দ্রকুমারের কল্পকাহিনিতে বৈজ্ঞানিক ভাবনার প্রয়োগ তথা এই নিয়ে তাঁর পড়াশোনার দিকটি যদি তুলে ধরা যেত, তাহলে মানুষটির সৃজনশীলতার আরেকটু পরিচয় পাওয়া যেত।
তবু বলব, সব মিলিয়ে এই বই বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্যের এক অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় তথা তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচয়িতার মনোজগতেরই নিবিড় বিশ্লেষণ। এমন কাজ যত হয় ততই ভালো। বইটির মুদ্রণ, বাঁধাই, লে-আউট ইত্যাদি কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনের উৎকৃষ্ট গুণমানের পরিচয়বাহী। আগামী দিনে লেখকের কাছ থেকে হেমেন্দ্রকুমারকে নিয়ে আরও বিশ্লেষণাত্মক কাজ পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।