১৯৮২ সালের ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য মোস্তফা কামাল হায়দারের চাকরিজীবনের অম্ল-মধুর স্মৃতি ও বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ইতিবৃত্ত-বিষয়ক গ্রন্থ 'স্টিলফ্রেমের বিবর্তন: বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র'।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মোস্তফা কামাল হায়দার। আবার, '৮২ সালে বিসিএস পরীক্ষায় দিয়ে পেয়ে যান প্রশাসন ক্যাডার। কিন্তু তখনও চাকরিতে যোগ দেওয়া নিয়ে শতভাগ দ্বিধাহীন ছিলেন না৷ কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে মাইনে পেতেন সাত-আটশ টাকা। কিন্তু সরকারি চাকরিতে শুরুতে পাবেন সর্বসাকুল্যে তিন-চারশ টাকা। তবু প্রশাসন ক্যাডার বলে কথা! এখনকার শাহবাগের সিভিল সার্ভিস প্রশাসন আ্যকাডেমি 'কোটা' তথা সিভিল অফিসার্স ট্রেনিং আ্যকাডেমি নামে পরিচিত ছিল৷ নবীন কর্মকর্তাদের চারমাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ হতো। কোটা'র পরিচালকদের অন্যতম ছিলেন ড. সা'দত হুসাইন। তিনি প্রবেশনারদের ভয় দেখিয়ে বললেন,
' সরকারি চাকরিতে আবেগ,অনুভূতির জায়গা নেই, কেউ কারো সহায়ক নয়,প্রত্যেকের দায় ও দায়িত্ব ব্যক্তিগত, কর্ম ও জবাবদিহি ব্যক্তিগত। '
আরও একজন প্রশিক্ষক দেবরঞ্জন চক্রবর্তী সরকারি চাকরির অমোঘ নীতি এভাবে শোনালেন,
' আকাশে লক্ষ কোটি তারা খসে পড়লে যেমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছু যায় আসে না। তেমনি আমাদের কারো চাকরি চলে গেলে সরকারের কিছুই যাবে আসবে না। সরকারের মধ্যে কোন প্রাণ নেই, অনুভূতি নেই, সরকার রক্তমাংশ দিয়ে তৈরী নয়...তাই সরকারের কোন দয়ামায়াও নেই। '
কর্মজীবনে গিয়ে এই কথাগুলোর মর্মার্থ আরও গভীরভাবে বুঝতে পেরেছিলেন মোস্তফা কামাল হায়দার। পেয়েছিলেন ব্যতিক্রমও।
প্রথম পদায়ন হলো পাবনাতে। হাতে-কলমে কাজ শিখতে লাগলেন। মোলাকাত হলো আমলাতন্ত্রের সাথে। শিখলেন আমলাতন্ত্রে সবকিছুর মূল চেইন অব কমান্ড। এই কমান্ডের বলেই বয়োবৃদ্ধ উচ্চমান সহকারী পুত্রসম নবীন কর্মকর্তার সামনে হাত কচলে দাঁড়িয়ে থাকেন, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন আদেশের৷
ব্রিটিশগণ এক অদ্ভুত ব্যবস্থার শেকড় গেঁড়ে দিয়েছে এই দেশে। কেউ কোনো কাজ না করলেও আমলাতন্ত্র তার কাঠামোর কারণে ঠিকঠাক চলে যাবে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করেছেন নোয়াখালী জেলার কথা। যেখানে ২০০৬ সালে প্রায় সাড়ে তিন মাস কোনো জেলাশাসক ছিল না। তবু দিব্যি সিস্টেম চলেছে।
নকলের সুবর্ণযুগে মাঠপ্রশাসনে নিযুক্ত ছিলেন লেখক। সেই সময়ে পাবনার বেশকিছু পাবলিক পরীক্ষায় ম্যাজিস্ট্রেসি দায়িত্বপালনকালে সাক্ষী হন নকলকেন্দ্রিক কিছু মজার ঘটনার।
সিএসপি কর্মকর্তাদের দাপট একাধিকবার প্রত্যক্ষ করেছেন লেখক। কর্মজীবনের শুরুতেই সিএসপিদের উত্তাপ বুঝে গিয়েছিলেন। রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার সিএসপি শওকত আলীর পিএস ছিলেন তিনি। পুলিশ ক্যাডার-প্রশাসন ক্যাডারের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব নিত্যকার ঘটনা। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রশাসন ক্যাডারদের কৌলীন্য ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে সেই সুযোগ হ্রাস পেতে থাকে। তৈরি হয় শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অঘোষিত বিরোধ। তখন পাবনাতে শিক্ষার্থী বনাম পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের সংঘর্ষের একটি ঘটনার অব্যবহিত পরে বিভাগীয় কমিশনার শওকত আলী রাজশাহীতে আসেন এবং পূর্বেই ডিসিকে নির্দেশ দেন পুলিশ যেন তাকে প্রটোকল দেয়। কিন্তু পুলিশ সুপার পাত্তা দেননি সিএসপিকে। তৎক্ষণাৎ সিএসপি শওকত আলী ঢাকায় যোগাযোগ করে গোলযোগের তীব্রতার জন্য এসপির অদক্ষতাকে দায়ী করেন। তখনই বদলি করে দেওয়া হয় পুলিশ সুপারকে। শওকত আলী, মোফাজ্জল করিম ও সা'দত হুসাইনসহ আরও কিছু সিএসপি কর্মকর্তার সান্নিধ্য পেয়েছেন লেখক। সিএসপিদের প্রভাব এবং সাফল্যের নিয়ে লেখকের পর্যবেক্ষণ ভালো লেগেছে।
ইউএনও হিসেবে বদলি হন ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলায়। সদ্যপ্রতিষ্ঠিত উপজেলা সদরপুর। অবকাঠামোগত অবস্থা বিশেষ উন্নত না হলেও এরশাদের আমলে এলাকাটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেননা এখানকার আটরশির পিরের মুরিদ ছিলেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ৷ জাকের মঞ্জিলের একটি বিস্তারিত বর্ণনা মোস্তফা হায়দার দিয়েছেন। দেখেছেন একজন রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও এরশাদের পিরভক্তি এবং পিরের ছেলে-শ্যালক কর্তৃক সেই সুবিধার অপব্যবহার। সদরপুরের উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে পিরের শ্যালককে জয়ী করতে খোদ রাষ্ট্রপতিকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল এবং নির্দেশ ছিল যেভাবেই হোক জয়ী করে আনতে হবে। মজার ব্যাপার হলো আটরশিভক্ত এরশাদ তার পতনের পর কোনোদিন আটরশিতে যাননি!
নির্বাচনে সরকারের হস্তক্ষেপের সাক্ষী আরও একবার হয়েছেন লেখক। তিনি তখন রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার মোফাজ্জল করিমের পিএস। '৮৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটের কাস্টিং প্রথম বেশি দেখাতে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা ডিসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়। সন্ধ্যার পর এ নিয়ে গণমাধ্যমে সমালোচনা শুরু হলে ডিসিদের তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী ও সাবেক সংস্থাপন সচিব মহবুবুজ্জামান আদেশ দেন ভোটার কাস্টিং সংশোধন করে আরও কম দেখাতে। রাজশাহী ও পাবনার দুই একগুঁয়ে ডিসি এই কাজ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং নিজেদের অফিস ও বাসার টেলিফোন লাইন খুলে রাখেন। তখন মন্ত্রী বিভাগীয় কমিশনার মোফাজ্জল করিমকে বলেন এই দুই ডিসিকে কথা শোনাতে। মোফাজ্জল করিম এসিআরের ( বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) ভয় দেখিয়ে কার্যসিদ্ধি করেন।
নোয়াখালী সদরের ইউএনও ও নোয়খালীর ডিসি ছিলেন মোস্তফা কামাল হায়দার। নোয়াখালী নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন লেখক। বেশকিছু আগ্রহউদ্দীপক ঘটনা থাকলেও অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা একঘেয়ে লাগছিল।
যুগ্ম-সচিব হিসেবে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাজ করেছেন লেখক। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাজে কতটা সতর্ক থাকতে হয় তা পড়তে পাঠককের ভালো লাগবে।
সরকার যেসব কর্মকর্তাদের পছন্দ করে না তাদেরকে তিনভাবে 'দেখে নেয়'। এক. পঁচিশবছরপূর্তি হলে অবসর। দুই. ওএসডি করে রাখা এবং তিন. অগুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং আর প্রমোশনবঞ্চিত রেখে চাকরিজীবন সমাপ্তের সুযোগ দেওয়া। শেষের অপশনটি পেয়েছিলেন মোস্তফা কামাল হায়দার। তাঁত বোর্ড ও স্থানীয় সরকার ইন্সটিটিউটের মতো ডাম্পিং পোস্টিংয়ের মাধ্যমে শেষ হয় তার কর্মজীবন।
পদোন্নতিবঞ্চনার ক্ষোভ পুরো বই জুড়ে ছিল। লেখক স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদে কাজ করেছেন। দেখেছেন অনেককিছু। কিন্তু লেখেননি। আবার, যা লিখেছেন তা সবটুকু সুখপাঠ্য নয়। বানান ভুলের মহড়া যথেষ্ট বিরক্ত করেছে।
যারা প্রশাসন নিয়ে আগ্রহী এবং আগামীতে প্রশাসন ক্যাডারে যেতে চান তাদের কাছে বইটি ভালো লাগবে।
পড়তে মন্দ লাগেনি। আমলাতন্ত্রের ব্রিটিশ পাকিস্তান কাল অতিক্রম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
লেখক অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত, চাকুরী জীবনের শেষ দশক খুব একটা ভালো অবস্থানে ছিলেন না। পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ে এ সময় তার যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল। সচিব হতে পারলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমলাতন্ত্র বিষয়ক সরকারি নীতির সমালোচনা করতেন কিনা সন্দেহ আছে।
এরশাদের শাসনামলে আটরশির পীরের প্রভাব, জেলা প্রশাসক হিসেবে নোয়াখালীতে কাজ ও নোয়াখালীর বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য, প্রশাসনের আনুষ্ঠানিক অনানুষ্ঠানিক রীতিনীতি মোটামুটি গ্রহণযোগ্যভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন। কর্মক্ষেত্রে আত্মস্মৃতিতে নিজের প্রশংসায় একটু বেশি এসেছে, দলগত সাফল্যের পর্যাপ্ত উদাহরণ টানতে পারেননি।
যারা আমলাতন্ত্রে ক্যারিয়ার এর স্বপ্ন দেখছেন অথবা প্রশাসন যন্ত্র কিভাবে চলে জানার আগ্রহ আছে, তাদের ভালো লাগবে। কিছু বিষয় বারবার একাধিক অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে যেটা বিরক্তির কারণ।