রনিনের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল 'আলোহান' নামক এক আশ্চর্য ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে। ফ্যান্টাসি নামক ধারাটি সম্বন্ধেই এপার বাংলার অধিকাংশ পাঠকের ধারণা ছিল না সেই সময়। তখন একটি আস্ত ফ্যান্টাসি উপন্যাস... লেখকের সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। আর জিনিসটা পড়ার পর মাথা নুইয়ে মেনে নিয়েছিলাম, হ্যাঁ, ইনি লিখতে পারেন। তারপর সেই লেখক আমাদের উপহার দিয়েছেন ইতিহাস-ভিত্তিক রহস্য গল্প। আবার অন্য লেখকদের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি হাই এবং লো ফ্যান্টাসি। ভাবতে শুরু করেছিলাম, রনিন কি তাহলে এখন আর ফ্যান্টাসি লেখেন না? আমার প্রশ্নের উত্তর হয়েই এবারের বইমেলায়, প্রায় নিঃশব্দে প্রকাশিত হল এই উপন্যাসিকাটি। বিষণ্ণ পৃথিবীর বাসিন্দা তুষান আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মধ্যে দূরত্ব মাত্র একষট্টি দিন। "পড়্! পড়্!" বলে মা'র কর্কশ চিৎকার, একদা 'ওয়ান্ডার কিড'-এর তকমা লেগে যাওয়ার ফলে বাকিদের তির্যক দৃষ্টির শিকার হওয়া, বিশুষ্ক তৃণের মতো দিনযাপন— এ-সবের মধ্যেও বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে। তার কারণ একটাই। এক অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ তাকে ইদানীং অনুসরণ করছে! সেই গন্ধ, আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে... কিশোরীর অস্তিত্ব যেন সে সবসময় অনুভব করে। কে সে? কী চায় সে? এ-সবই কি তার উত্তপ্ত, চাপে দুমড়ে যাওয়া মস্তিষ্কের কল্পনা? তারপর একরাতে গভীর ঘুমের মধ্যে সে হারিয়ে গেল এই পৃথিবী থেকে... আর জেগে উঠল অন্য কোথাও, আর কোনোখানে। সেখানে এক সভ্যতা চরম বিপদের সম্মুখীন। তাদের বাঁচার রাস্তা মাত্র একটাই তথা একজনই। সে হল...! না, বাকিটা আর আমি লিখব না। সেটা জানতে হলে বইটা পড়তে হবে। জীবনানন্দের কবিতার স্মৃতিবাহী নামই শুধু নয়, এই লেখার সম্পূর্ণ কাঠামোটিই জীবনানন্দীয়। ভাষার ব্যবহার ও চরিত্রগঠনেও রনিন নিজের দক্ষতা পূর্ণমাত্রায় প্রদর্শন করেছেন। শুধু তুষানের মা বিনীতাবসু মল্লিকের মুখে প্রায় কলতলার ভাষার ব্যবহারটি ভারি বেমানান ও অসুন্দর লেগেছে। ওটুকু বাদে বইটির সর্বত্র ব্যবহৃত হয়েছে সহজ, সুললিত, অথচ ক্ষেত্রবিশেষে ধারালো সংলাপ, বর্ণনা, উপমা। কাহিনি এগিয়েছে ঝড়ের বেগে, ঘাত-প্রতিঘাত, বিস্ময় ও বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে। আশেপাশের চেনা পৃথিবী কীটের মতো মুছে গেছে আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর। তুষাণ... নিয়ন... ফের তুষাণের হাত ধরে চলতে-চলতে আমর দেখেছি, কখন যেন লেখাটাই শেষ হয়ে গেছে! ইয়ং অ্যাডাল্ট পাঠকদের জন্য বাংলায় ফ্যান্টাসি তথা স্পেকুলেটিভ ফিকশনের ধারাটি এখনও অত্যন্ত শীর্ণকায়। তবে সেই ধারাতে এই মূল্যবান সংযোজন। যদি এমন ধারা তথা ঘরানার অনুরাগী হন, তাহলে বইটি আপনাদের আনুকূল্য পাবে— এমনই আশা রাখি।