এ দেশে বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠেছে অনেক রাজনৈতিক দল। এদের মধ্যে আওয়মী লীগ নানা দিক থেকেই ব্যতিক্রম। আওমীলীগ পুরোনো এটি দল। বিশাল এর ক্যানভাস।...... স্মৃতি-বিস্মৃতির ঝাপি খুলে গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ছেকে তুলেছেন এই দলের উত্থানপর্ব ।
জন্ম ১৯৫২, ঢাকায়। পড়াশোনা গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনে মুহসীন হল ছাত্র সংসদের সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বিএলএফের সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দৈনিক গণকণ্ঠ-এ কাজ করেছেন প্রতিবেদক ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে। দক্ষিণ কোরিয়ার সুংকোংহে বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মাস্টার্স ইন এনজিও স্টাডিজ’ কোর্সের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক। তাঁর লেখা ও সম্পাদনায় দেশ ও বিদেশ থেকে বেরিয়েছে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা অনেক বই।
রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে মহিউদ্দিন আহমদের কাজগুলোয় আগ্রহ বেশ অনেকদিন থেকেই। যেহেতু প্রথমার বই, অর্থাভাবে খরিদ করা কষ্টকর। তবু আগ্রহ পূরণ করতেই হয়। জাসদের উন্থান পতন বইটা চমৎকার ছিল। বাংলাদেশের একটা পুরো সময়ের চিত্রই উঠে এসেছে বলা যায়।
এই বইটার শুরু ভারত বিভাগের অব্যবহিত পর থেকে। আওয়ামী লীগের সূচনা থেকে সত্তরের নির্বাচন পর্যন্ত। আছে দলের কথা, নেতাদের কথা, সময়ের কথা।
প্রচুর তথ্যবহুল একটা বই। আইয়ুব খাঁ-র ডায়েরী থেকে শুরু করে আগরতলা মামলার আসামীর জবানবন্দি পর্যন্ত তুলে এনেছেন লেখক।
এই একটা কারনে বইটা চমৎকার এবং বিরক্তিকর। কোন কমিটিতে কে কে ছিল, তাদের নাম পড়তে পড়তে ঘটনাই ভুলায়ে দিছে
নিরপেক্ষ কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর হলো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন অবস্থায় হিসাবে যথেষ্ট নিরপেক্ষ লেখা। এরচেয়ে নিরপেক্ষতা হয়তো লেখকের পক্ষে সম্ভবপর না
বাংলাদেশের ইতিহাসে আওয়ামীলীগের জন্ম এক অভূতপূর্ব ঘটনা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলটি বাঙালির স্বাধিকার আদায়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। রাজনৈতিক দলটির সৃষ্টি অনিবার্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশের বৈষম্য দূর করার জন্য। সুলেখক মহিউদ্দিন আহমদ দেশভাগ ও আওয়ামীলীগের জন্ম থেকে শুরু করে সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে দলটির নিরঙ্কুশ বিজয়ের ইতিহাসকে দুই মলাটে স্থান দিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতের স্বাধীনতা অনেকটা স্পষ্ট হতে শুরু করে। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিম অংশের নেতাদের ষড়যন্ত্রে পূর্ব অংশ অনেকটা পশ্চিমের উপনিবেশ হিসেবে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়। বাংলাকে অখন্ড রাখার দাবিতে একটি পক্ষ কাজ করে গেলেও গণপরিষদে সমর্থন পায়নি। ফলে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অংশ হিসেবে রয়ে যায়। পূর্ববঙ্গের নেতাকর্মীরা পশ্চিমের নেতাদের গুণগ্রাহী হলেও তাঁদের সাথে পার্থক্য ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। একমাত্র ধর্মের মিল ছাড়া সকল দিক থেকেই পাকিস্তানের দুই অংশ আলাদা ছিল। আর পশ্চিমের নেতাদের প্রভুত্ব দাবি এই বিভক্তিকে বৈষম্যে রূপান্তরিত করে। মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ ও নাজিমুদ্দিন গ্রুপের মধ্যে বরাবরই রেষারেষি ছিল। সেই রেষারেষির সূত্র ধরেই মুসলিম লীগে ভাঙন ধরে। টাঙ্গাইলের উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী জমিদার খুররম খান পন্নীকে মুসলিম লীগের বিদ্রোহী অংশের প্রার্থী শামসুল হক হারিয়ে দেন। পরের বছর এই বিদ্রোহী অংশই 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' নামে একটি দল গঠন করে। পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য প্রচারের লক্ষ্যে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
পাকিস্তান আমলের বছরগুলোতে আওয়ামিলীগ ও দলটির নেতা-কর্মীদের বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। দিনের পর দিন জেলে কাটাতে হয়েছে কোনো মামলা ছাড়াই। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রথম সংগঠিত আন্দোলন বলা হয় ভাষা আন্দোলনকে। এই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের পথ প্রশস্ত হয়। ভাষা আন্দোলনের যে ইতিহাস পাঠ্যবইতে পাওয়া যায়, তাতে মনে হবে এখানে ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের পরবর্তী সময়ের নেতারাই প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। মূলধারার ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। অথচ ইতিহাসগুলো তুলে ধরার দায়িত্ব কেউ নিতে চায় না।
যুক্তফ্রন্ট গঠন, ছয় দফা কর্মসূচি, গণ অভ্যুত্থান ও সত্তরের সাধারণ নির্বাচন - বাঙালি জাতীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাকিস্তান জন্মের পর হতেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুলছে; যা এখনো বর্তমান। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক সরকারের উপর সামরিক হস্তক্ষেপ। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি এবং আইয়ুবকে সরিয়ে আরেক সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান ভিন্ন পথে হাঁটতে চাইলেও পূর্ববর্তীর পথ অনুসরণ করেছেন। সামরিক শাসনের সময়গুলোতে আওয়ামিলীগের মূল চালিকাশক্তি ছিল ছাত্ররা। কারণ অধিকাংশ নেতারাই তখন জেলে কিংবা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। দীর্ঘ এই সময়ের অপশাসনের ফলে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় আনা অনিবার্য হয়ে গিয়েছিল বাঙালির জন্য। তাই সত্তরের নির্বাচনে দলটি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছিল।
মহিউদ্দিন আহমদ একেবারে মাঠ পর্যায়ের তথ্যগুলোকে তুলে এনেছেন তাঁর বইটিতে। এতে করে পাঠকের একটি ধারাবাহিক চিত্র উপলব্ধি সম্ভব হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা কম বেশি সকল বইতেই বলা আছে। যে মামলায় পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র হিসেবে ৩৫ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছিল। মূল আসামিকে প্রাধান্য না দিয়ে জেলে থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে এক নাম্বার আসামি করা হয়েছিল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে। তবে বাংলাদেশের জনগণ সেই উদ্দেশ্য বানচাল করে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল আইয়ুব খান। বঙ্গবন্ধু অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করার চিন্তা করেছিলেন এবং ভারতের সাহায্য প্রত্যাশী হিসেবে ভারতে গোপনে গিয়েছিলেন কয়েকবার। ওপার থেকে সবুজ সংকেতও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত পদক্ষেপ ও সময়ের অভাব কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে দেয়নি।
আওয়ামিলীগ পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত আমাদের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত রয়েছে। বহু চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে দলটিকে। যুদ্ধের পর বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কিতও হয়েছে। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে আওয়ামীলীগের অবদান অস্বীকার করার কোনো কায়দা নেই। বিতর্কিত অনেক বিষয় নিয়েই লেখক আলোকপাত করেন নি; ব্যাপারগুলো খোলাসা করা উচিৎ ছিল। আওয়ামীলীগের পাকিস্তান আমলের ইতিহাস জানার জন্য অবশ্যপাঠ্য বই। হ্যাপি রিডিং।
অনেক বই থেকে তথ্য নিয়ে একটা বই লিখলে পাঠকের সুবিধা হল অনেকগুলা বই পড়ার ঝক্কিতে যেতে হয় না- কম আয়াসে অধিক তথ্য-যে তথ্যগুলো জরুরী, সেটা জানা যায়। আওয়ামী লীফঃ উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০ সেরকই একটা বই। মহিউদ্দিন আহমদ ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকটা বই লিখেছেন। জাসদ আর বিএনপি নিয়ে লিখেছেন আগে। এবার আওয়ামী লীগ। ইন্টারেস্টিং অনেকগুলো তথ্য জানতে পারলাম বইটা পড়ে। সোহরাওয়ার্দী আর ফজলুল হককে নিয়ে। ক্ষমতার জন্য কী পরিমাণ আকুল ছিলেন এরা তা বোঝা গেছে। অবশ্য, এটা অস্বাভাবিক না।
তবে এত বেশি তথ্যের ভার বহন করা কঠিন। মাঝে শ্বাস নেয়ার মত জায়গা না পেলে খুব কষ্ট হয়। আর আমার মত পাঠকের জন্য তা অসহনীয় হয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর একটা আওয়ামী লীগ। ৭০ বছরের পুরাতন এ দলের জন্ম, বিকাশ, এ সময়কালে দলটির উত্থান পতনের ইতিহাস বাংলাদেশের গড়পরতার চেয়ে বেশি ইতিহাস ও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তির কাছেও অস্পষ্ট আর ধোঁয়াশায় ভরা। আওয়ামী লীগের ইতিহাস সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত বয়ান আছে, অসংখ্য ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ আছে, কিন্তু সে কথ্য আর লিখিত ইতিহাস এক করে, সব বয়ান কষ্টি পাথরে যাচাই করে একটা ডকুমেন্টেড নিরপেক্ষ প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ ৭০ বছরে একটাও লিখিত হয় নাই। . ইতিহাস অনুসন্ধানী গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের আওয়ামীলীগ উত্থানপর্ব বইটি সে শূন্যতা পূরণে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মহিউদ্দিন আহমদ ইতিহাস অনুসন্ধান, বিভিন্ন এলোমেলো তথ্যকে প্রাসঙ্গিকভাবে ঘটনাক্রম অনুযায়ী সাজিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে পরিবেশন করতে কেমন দক্ষ, তা তাঁর লেখা বাংলাদেশের অপর দুই রাজনৈতিক দল - বিএনপি আর জাসদের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইগুলোতে দেখা গিয়েছে। আওয়ামীলীগ - উত্থানপর্বেও গবেষক মহিউদ্দিনের মুনশিয়ানার ছাপ দেখা যায়, যদিও যতোটা তথ্য আর বিশ্লেষণ ভরপুর হলে বইটি পরিপুর্ণ হয়ে উঠতে পারতো, তা হয় নাই। . এখানেও মহিউদ্দিন আহমদ সমকালীন প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে ঘটনাক্রম অনুযায়ী প্রাসঙ্গিকভাবে সাজিয়ে ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মূলতঃ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা তিন সদস্য আবুল মনসুর আহমেদ, আতাউর রহমান খান আর অলি আহাদের আত্মজৈবনিক বই তিনটাই তাঁর প্রধান সোর্স, কিন্তু তিনি এই তিন বইয়ের পাশাপাশি আরো অসংখ্য বই, তার সাথে সমকালীন পত্রপত্রিকায় উঠে আসা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলী, তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের লিখিত বয়ানগুলোর সাহায্যেও ইতিহাসের কংকালে রক্তমাংস দিয়েছেন। বইটাতে যেটা চোখে পড়ে, বিভিন্ন সোর্স থেকে নেওয়া অসংখ্য তথ্যের সন্নিবেশ, যার ফাঁকে লেখকের সিদ্ধান্ত বা বিশ্লেষণ প্রায় নাই বললেই চলে। . এ বই পড়ার সময় মনে হয়েছে লেখক খুব সাবধানী আর আড়ষ্ট ছিলেন, যার কারণে অনেক কথাই হয়তো অব্যক্ত আর অনুচ্চারিত রেখেছেন। লেখকের জাসদকে নিয়ে লেখা বইটা আমার পড়া হয় নাই, কিন্তু বিএনপিকে নিয়ে লেখা বই পড়েছিলাম। প্রায় একই ধরণের এ দুই বই পড়া থেকে মনে হয়েছে, লেখক বিএনপির ইতিহাস বলার সময় অনেক স্বাধীনভাবে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে বলতে পেরেছিলেন, যা লীগের ইতিহাস বলার সময় পারেন নাই, বা বলতে চান নাই। তিনি শুধু যন্ত্রের মতো তথ্য সন্নিবেশ করে গিয়েছেন, ঘটনার ফল দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া, ঘটনাকে প্রশ্ন করা, আর উত্তর খোঁজার দায় সম্পুর্ণভাবে পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। . হয়তো এ ধরণের ইতিহাসগ্রন্থ লেখার সময় এখনো আসে নাই, তার মধ্যেও মহিউদ্দিন আহমদ যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন পাঠক যেন বইটা পড়ে অব্যক্ত আর অনুচ্চারিত প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবে আর সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সচেষ্ট হয়। বইটি পড়ে অনেকগুলো প্রশ্নই মনে এসেছে, যার মধ্য থেকে সামান্য কয়েকটা উল্লেখ করতেছি। . ১) মানিক মিয়া পরিবার কিভাবে ইত্তেফাকের মালিকানা পেলেন? . ২) ষাটের দশকে বিপর্যয়ের সময় আওয়ামী লীগ কার্যালয় আগলে রাখা ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম কেন বহিস্কৃত হয়েছিলেন? . ৩) ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগের টিকেটে জয়ী ১৬০ জনের মধ্যে (পূর্ব পাকিস্তানের মোট আসন ১৬২) কেন মুসলিম বাদে একজনও অন্য ধর্মাবলম্বী অথবা পাহাড়ি প্রার্থী ছিলেন না? (৭০ এর নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায় ছিলেন সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত একমাত্র অমুসলিম সদস্য। তিনি আওয়ামীলীগের টিকেটে নির্বাচন করেন নাই। আর সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে অমুসলিম নাগরিক ছিলেন ২০ শতাংশ।) . এরকম অসংখ্য অব্যক্ত প্রশ্ন উঠে এসেছে, যেগুলো মনে মনেই প্রশ্ন করা সম্ভব, বলা সম্ভব না। . আওয়ামীলীগের জন্ম আর মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগে পর্যন্ত বিকাশ আর উত্থান নিয়ে লেখা “আওয়ামীলীগ উত্থানপর্ব” বইটিতে মহিউদ্দিন আহমদ পাঠকের প্রত্যাশা ৮০ ভাগ মিটাতে সক্ষম হয়েছেন। তারপরেও এ বিষয় নিয়ে আর কোন বই না থাকায়, এ বই ইতিহাস অনিসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য অন্যতম রেফারেন্স বই হিসাবে কাজ করবে। আমি আশা করবো পাঠক এ বইকে পড়ে অব্যক্ত আর অনুচ্চারিত প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে সচেষ্ট হবে।
লেখক মহিউদ্দিন আহমদ কে চিনি তাঁর লেখা 'জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি' বইটির মাধ্যমে। বইটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয় সেসময় থেকেই বইটির পক্ষে বিপক্ষে প্রায়ই প্রথম আলো পত্রিকায় লেখক গবেষকগণ কলাম লিখতেন। জাসদের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে আমারও জানার আগ্রহ ছিল খুব, যে কারণে পরবর্তীতে বইটি সংগ্রহ করেছিলাম। বইটাতে লেখকের সহজবোধ্য ও নির্মোহ বিশ্লেষণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেই মুগ্ধতা থেকে পরবর্তী সময়ে এদেশের অন্যতম প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কে নিয়ে লেখা ওনার আরো তিনটি বই কেনা হয়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস বেশিরভাগ সময়ই দলের নেতা, কর্মী কিংবা দল সমর্থক কেউ লিখেছেন। নির্মোহ ও নিরপেক্ষ ভাবে রাজনৈতিক দলের ইতিহাস খুব একটা লেখা হয়নি। যে কারণে দেখা যায়, লেখকরা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ঘটনা প্রবাহ সাজিয়েছেন, আলোচনা করেছেন এবং সবশেষে নিজেই বিচারক হয়ে একটা রায় দিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ নিজের ধারণাপ্রসূত মন্তব্য পাঠককে গেলানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু নিরপেক্ষতার চাদর হারানো ইতিহাস খুব বেশিদিন টেকে না। চোখরাঙানি কিংবা আইন করেও সেই ইতিহাস টেকানো যায় না।
আওয়ামী লীগ নিয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমদ দুটো বই লিখেছেন, তার একটি হল- 'আওয়ামী লীগ : উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০'। ভূমিকা, উপসংহার ও পরিশিষ্টবাদে মোট ১৪ টি অধ্যায়ে লেখক আওয়ামী লীগের নানা ঘটনা প্রবাহ পাঠকের সামনের তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তুলে ধরেছেন পর্দার পেছনের বিষয় ও এমন সব খুঁটিনাটি বিষয় ও তথ্য যা অনেকটা সাগর সেঁচে মুক্তা আহরণের মতই কঠিন। কারণ আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের অন্যতম পুরনো একটি দল, এই দলের তথ্যের ঝাঁপিটিও অনেক বড়। এই তথ্যগুলো আবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা জায়গায়।
আলোচ্য বইয়ে নানা ঘটনা, চরিত্র ও পটভূমিকে তিনি একসূত্রে গেঁথে আওয়ামী লীগের চরিত্র রূপায়ণের চেষ্টা করেছেন। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এটি কি আওয়ামী লীগের ইতিহাস, না ইতিহাসের গল্প? দলের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, না পরম্পরা? দুটোই হতে পারে। মহিউদ্দিন আহমদ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘আমার কাজ অনেকটা রাঁধুনির মতো। বিভিন্ন সূত্র থেকে চাল ডাল তেল মসলা জোগাড় করে তবেই তো রান্না। এ জন্য আমাকে খোঁজখবর করতে হয়েছে।’
আলোচ্য বইয়ের শুরু হয়েছে '৪৭ এর দেশভাগ এবং শেষ হয়েছে '৭০ এর নির্বাচনের মাধ্যমে। দেশভাগের সময়ে বাঙ্গালীদেরকে কংগ্রেস এবং মুসলিমলীগ নেতারা কিভাবে যৌথভাবে বঞ্চিত ও প্রতারিত করেছেন তা চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। দেশভাগের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ, তেল-জলের সম্পর্ক, সর্বোপরি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃত্বের পারস্পরিক সন্দেহ-বিশ্বাসকে সামনে নিয়ে এসেছেন। লাহোর প্রস্তাবে একটি রাষ্ট্র বা একাধিক রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল, সেই বিতর্ক তখন বড় ছিল না; তখন ভারতের অধিকাংশ মুসলমান পৃথক আবাসভূমির স্বপ্নে বিভোর ছিল। সে স্বপ্নভঙ্গ হতেও বেশি স��য় লাগেনি। যে কারণে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত হওয়া পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ নামে উপমহাদেশে তৃতীয় রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল।
আলোচনা হয়েছে ছাত্রলীগের জন্ম ইতিহাস নিয়ে। ছাত্রলীগের নানা গৌরবময় কর্মকান্ড নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইউব খানের সামরিক শাসন, ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তের গনঅভ্যু্ত্থান, সত্তরের নির্বাচনের ইতিহাস নিয়ে সাবলীল আলোচনা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নিয়ে কথা বলতে গেলেই যার নামটি অবধারিতভাবে উঠে আসে তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহিউদ্দিন স্বীকার করেছেন, ‘আ���য়ামী লীগের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে চলে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। একজন ব্যক্তি একটা রাজনৈতিক দল ও একটা দেশ যখন এক হয়ে মিশে যায় তখন তাদের আলাদা করে দেখা বা বোঝা কঠিন একটা কাজ।’ পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব ছিলেন তরুণ নেতা। তারুণ্যের সঙ্গে তিনি সাহস ও জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে মেলাতে পেরেছিলেন বলেই রাজনীতির গতিধারা ঘুরিয়ে দিতে পেরেছিলেন। বয়সে যাঁরা তাঁর চেয়ে তরুণ, তাঁদের ভরসাস্থল হয়েছিলেন শেখ মুজিব। ষাটের দশকের শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে তাঁর বৈঠকটিও ছিল কৌতূহলোদ্দীপক। তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা যাবে না বলে অভিমত দিলে কমিউনিস্ট নেতারা বললেন, ‘এখনো সময় আসেনি, জনগণকে প্রস্তুত করেই চূড়ান্ত সংগ্রামে নামতে হবে।’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনাদের কথা মেনে নিলাম, কিন্তু স্বাধীনতাই আমার শেষ কথা।’
এখনও অনেকে মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করেন সশস্ত্র লড়াই এর মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করার জন্য আওয়ামীলীগ কিংবা শেখ মুজিবের কোন প্রস্তুতি ছিলনা। পাকিস্তানীদের আক্রমণের কারণে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়। আলোচ্য গ্রন্থটি পাঠে এই শ্রেণির লোকদের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণিত হয়। ১৯৬২ সনে শেখ মুজিবের ত্রিপুরা মিশনটি লেখক এখানে সুস্পষ্টভাবে তুলে এনেছেন। এর মধ্যে দিয়ে দেখা যায় শেখ মুজিব নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতির পাশাপাশি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীকার আদায়ের পথটিও খোলা রেখেছিলেন। ত্রিপুরা মিশনে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রেজা আলীকে ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে দলের বাইরেও সবসময় শেখ মুজিবের যে একটি নিজস্ব নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ছিলো তা আলোচ্য গ্রন্থে প্রমাণিত হয়েছে। একই সাথে ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকের গড়া 'নিউক্লিয়াস' এর প্রসঙ্গটি আনলে আরো ভালো হতো। নিউক্লিয়াস নিয়ে তিনি অবশ্য বিশদ আলোচনা করেছেন তাঁর লেখা 'জাসদের উত্থান পতন' বইয়ে।
জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামীলীগে অভ্যন্তরে পরস্পরবিরোধী ধারার অবস্থান এবং তাদের মধ্যে মত বিরোধের কারণে বারবার দলের অভ্যন্তরে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম থেকেই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরোধ, পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে ৫৭ সালে দলের ভাঙ্গন, প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে ভাসানী কর্তৃক হেনস্তা করা, সোহরাওয়ার্দী মৃত্যুর পর শেখ মুজিব আওয়ামীলীগ পুনুরুজ্জীবন করার সময় দলের সিনিয়র নেতাদের ভূমিকা, এনডিএফ থেকে বেরিয়ে আওয়ামীলীগকে রাজনীতিতে সক্রিয় করার সময় আতাউর রহমান খান আবুল মনসুর আহমেদের মত নেতাদের তীব্র বিরোধিতা, ছয় দফার বিরুদ্ধে দলের নেতাদের একাংশের অবস্থান এবং মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সালাম খানদের নেতৃত্বে পাল্টা আওয়ামীলীগ গঠনের মত বিষয়গুলো লেখক পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন সুনিপুণভাবে।
'আওয়ামী' শব্দটি যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দেওয়া, তা আগে জানা ছিল না। একই সাথে '৭০ পর্যন্ত ভাষানীর নানা ভূমিকা সংক্ষেপে উঠে এসেছে এখানে।
অবাক হয়েছি শেরে বাংলা ফজলুল হক সম্পর্কে পড়তে গিয়েছে। এ.কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক জীবনের সুবিধাবাদী অবস্থান, ঘনঘন রাজনৈতিক মত ও পথ পরিবর্তনের বিষয়টি আলোচ্য গ্রন্থে পাঠকের সামনে পরিষ্কার ভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। ১৯৪৯ সনের ২৩ জুন রোজগার্ডেনে অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগের উদ্বোধনী অধিবেশনে শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক কিছু সময়ের জন্য যোগদেন এবং বক্তব্য প্রদান করেন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন “ফজলুল হক কিছুক্ষণের জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি একটা বক্তব্য দেন। কয়েক মিনিট পরেই তিনি সম্মেলনস্থল ছেড়ে চলে যান। হয়তো তাহার ভয় ছিল পাছেনা সরকারের এডভোকেট জেনারেলের পদ হারাইতে হয়”। শুধু তাই নয় আওয়ামীলীগে সাংগঠনিক কমিটির প্রথম সভা হয় ১৫০ মোগলটুলীতে। ফজলুল হক এই সভাতেও যোগদান করেছিলেন। ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এতে অন্যান্যের মাঝে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং একে ফজলুল হকের নাম ও ছিল। কিন্তু পরদিন ফজলুল হক তার বিবৃতি অস্বীকার করেন। তবে পাকিস্তান কায়েমের পরপর ঢাকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে এ.কে ফজলুল হকের যে কথোপকথন লেখক পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন তাতে ফজলুল হকের সাহসের প্রশংসা করতেই হয় এবং বলতেই হবে তিনি সত্যিকার ভাবেই শেরে বাংলা।
নানা প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার কথা। মানিক মিয়ার ঢাকা আগমন এবং ইত্তেফাক প্রকাশের পটভূমিটি এখানে লেখক চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রতিষ্ঠাকালীন কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খানের স্ত্রীর কিছু আক্ষেপের কথাও তুলে ধরেছেন লেখক।
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭০। প্রায় পুরো সময়টি আওয়ামী লীগকে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে, মাঝখানে ১৩ মাসের কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার হওয়া ছাড়া। শাসকদল হিসেবে আওয়ামী লীগ সফল বা ব্যর্থ সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু মাঠের আন্দোলনে এখনো পর্যন্ত দলটি অদ্বিতীয়। অন্যান্য দল ও নেতারা যখন বারবার মত ও পথ পরিবর্তন করেছেন, শেখ মুজিব লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থেকেছেন। মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, 'পাকিস্তানের ২৪ বছরের রাজনীতিতে বাঙালির চাওয়া-পাওয়া আবর্তিত হয়েছে প্রধানত গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে কেন্দ্র করে। একই দাবি অন্য দলগুলোরও ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ যত স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছে, অন্যরা তা পারেনি।' একারণেই হয়তো ন্যাপে বাঘা বাঘা সব নেতার উপস্থিতিও জনগণের মন জয় করতে পারেনি।
রাজনীতি সচেতন পাঠক অথবা স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বুঝতে ও জানতে আগ্রহী হলে পড়তে পারেন মহিউদ্দিন আহমদ এর এই বইটি।
'৪৮ থেকে '৭০ এর নির্বাচন পর্যন্ত ঘটনাবলী নিয়ে লেখা এবং যেটা মূলত আওয়ামীলীগের একটি জীবনী। প্রচুর তথ্য, অনেক জায়গায় ভাসা ভাসা লেগেছে। তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পড়া যায়।
মহিউদ্দিন আহমেদের বই এর ভালো লাগার ব্যাপার হচ্ছে প্রচুর রেফারেন্স থাকে কিন্তু সেটা পড়ার ফ্লো এর মধ্যে কোনো সমস্যাই করে না। ইতিহাসের বই এর আরেকটা ব্যাপার আমার পছন্দের তা হলো দুই বা ততোধিক ব্যক্তির কথোপকথন। কারণ এই কনভারসেশনগুলো ওই সময়ের ওই ঘটনাগুলো বুঝতে অনেক বেশি সাহায্য করে। বই টির মধ্যে এমন বেশ কিছু কনভারসেশন আছে যা ইতিহাসের সেই ঘটনাগুলো উপলব্ধি করতে অনেক সাহায্য করে।
মোটের উপর কেউ যদি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে আরও ভেতরে জানতে চায়, পটভূমি গুলো বুঝতে চায় তাহলে বই টি রেকমেন্ড করব।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন। দেশ স্বাধীনের পিছনে দলের নেতা কর্মীদের রয়েছে দীর্ঘ ত্যাগের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের প্রথম অংশটুকুর বিস্তারিত উঠে এসেছে পরিচিত লেখক মহিউদ্দিন আহমদের কলমে। লেখকের র���়েছে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, বিপুল পড়াশুনা সাথে অনুসন্ধানী ইচ্ছা। যার ফলে বইটি হয়ে উঠেছে তথ্য বহুল, পেয়েছে বিপুল জনপ্রিয়তা। তবে বইটিতে অনেক পেজ কমানো যেত। শেষ দিকে রেফারেন্স পেজটা আরো সুন্দর গোছানো যেত।
"কে কার দাদু, কে কার কাকা, কে কার ভাই, এগুলো আমার একটু গুলিয়ে যাচ্ছিল । এবার সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল।" বই শেষ করে আমার প্রথমে টিনটোরেটোর যীশুর এই লাইনটাই মনে পড়ছিল। ৪৭ থেকে ৭০ পর্যন্ত এত দ্রুত রাজনীতির পরিবর্তন হচ্ছিল, এত চরিত্র আর ঘটনা ঘটছিল, সেই সময়কার ইতিহাস পড়তে গেলে সেইগুলির তাল ঠিক রাখাই দায়। ৪৭ এর পর থেকেই আওয়ামী লীগের জন্ম, এবং তার পরের প্রতিটা রাজনৈতিক ঘটনার সাথে কোন কোন ভাবে জড়িত, তাই আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সাথে সেই সময়কার ঘটনাও অনেকাংশে চলে আসে।
মহিউদ্দিন আহমদ তার অন্যান্য বইয়ের মতই নিজের কোন মতামত না দিয়েই বিভিন্নজনের মতামত নিয়ে এসেছেন, ২৩ বছরের ইতিহাস আনতে তাকে বেশ খাটতে হয়েছে, বিপুল পরিমাণের তথ্য জোগাড় করেছেন। কিন্তু সমস্য হচ্ছে অনেক জায়গায়ই সেই তথ্য কাট ছাট করতে পারেন নি। বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের কমিটি হয়েছে, সেই ১৫-২০ জনের তালিকা তুলে দিয়েছেন, আগরতলা মামলা চলাকালীন বন্দীর নিহত হওয়ার 'গুজব' কয়েক পাতা জুড়ে বর্ণনা দিয়েছেন, ধারাবাহিক বর্ণনার সাথে যার আপাত কোন সম্পর্ক নেই। কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের তেমন উত্তর নেই - প্রায় একই ধরনের উদ্দেশ্য থাকলেও কেন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য দলগুলি আওয়ামী লীগের মতো সফল হল না। ছাত্র লীগ যদি আওয়ামী লীগকে বিপদের দিনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, ছাত্র ইউনিয়নের কাঁধে চড়ে কেন বামপন্থি দলগুলি তেমন কিছু করতে পারলো না। সাংগঠনিক ভাবে সারাদেশ জুড়ে আওয়ামী লীগ এত সফলই বা কিভাবে হল। এই না থাকার তালিকা দীর্ঘ হলেও এ দেশের ইতিহাস চর্চার জন্য এই বই অতুলনীয়। আওয়ামী লীগের কথা বললেই যার কথা চলে আসে, সেই শেখ মুজিবর রহমানও আরও বিস্তৃত ভাবে ধরা দিবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। বইটিতে উঠে এসেছে ৪০ এর দশকে আওয়ামী লীগের জন্ম, ৫০ এর দশকে উত্থান এবং ৬০ এর দশকে পূনর্জন্ম। উঠে এসেছে বিভিন্ন সময়ে দলটির নেতাদের ভূমিকা, যা তাদের নিয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করে। এসবের সমান্তরলে ৫০-৬০ এর দশকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বর্ননা রয়েছে বইটিতে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ ইতিপূর্বে জাসদ নিয়ে "জাসদের উত্থান পতন" বইটি লিখেছিলেন। এই বইটি ঠিক জাসদ নিয়ে লেখা বইটির মত সাবলীল নয়। তবে দলটি সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে বইটি একটি সুখপাঠ্য হতে পারে।
১৯৪৯ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত লম্বা একটা সময়কে একটা বইয়ে আবদ্ধ করা খুবই কঠিন। তাও আবার দেশের সবচেয়ে উত্তাল সময়ে দেশের প্রবীণ দল কে নিয়ে লেখা।লেখক তবুও চেষ্টা করেছেন।নতুন অনেক কিছু জানা গেছে অবশ্যই।তবে জানার আগ্রহ ছিল আরো বেশি। পরের পার্ট এর জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।