পুরানো সেই দিনের কথা একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের জীবনের উন্মেষ ও বিকাশের কাহিনি। নবীনগরের জলাভূমিতে লালিত সাদাসিধে বালকটি ছিলেন কল্পনাবিলাসী ও অন্তমুর্খী। মুখচোরা বালকটি মাঠপর্যায়ের প্রশাসক হন। দায়িত্ব নেন আইনশৃঙ্খলা, ভূমি প্রশাসন, উন্নয়ন প্রশাসন, নির্বাচন, এমনকি চা-বাগানের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার। এর মধ্যে দেখা দেয় মুক্তিযুদ্ধের টালমাটাল দিনগুলো। এই পরিস্থিতিতে লেখকের অভিজ্ঞতা সাধারণ পাঠকদের ভালো লাগবে এবং বর্তমান প্রশাসকদের কাজে লাগবে।
Akbar Ali Khan (Bengali: আকবর আলি খান) was a Bangladeshi economist and educationist who served as a bureaucrat until 2001. He was the SDO of Habiganj during the Bangladesh Liberation War, when he decided to join the war. Later he served as an official of the Mujibnagar Government. After the independence he joined back the civil serviceand reached to the highest post of Cabinet Secretary and also worked as a university teacher. His book Porarthoporotar Orthoniti (Economics of Other-minding) has been a popular book on economics à la Galbraith.
স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান মারা গেছেন। ভীষণ একাকী মানুষ আকবর আলি খান। আত্মকথা হয়তো তিনি লিখতেন না। তবু কমপক্ষে দুটো দায়বদ্ধতার কারণে তিনি আত্মজীবনী লিখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এক. তার মেয়েকে কথা দিয়েছিলেন নিজের পূর্বপুরুষদের ইতিবৃত্ত তিনি লিখবেন এবং দুই. ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে তিনি পদত্যাগ করলে তিনি সাংবাদিকদের এই পদত্যাগের কারণ বিশদে লিপিবদ্ধ করবেন - এই ওয়াদা করেছিলেন। দুই খণ্ডে আত্মজীবনী লিখবেন আকবর আলি খান। প্রথম খণ্ডে জন্ম থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত স্থান পাবে এবং দ্বিতীয় খণ্ডে তার বাকি কর্মজীবনের কথা লিখবেন। আর, এই দ্বিতীয় খণ্ড হবে স্পর্শকাতর। তাই আকবর আলি খানের মৃত্যুর পূর্বে তা প্রকাশিত হবে না বলে ভূমিকাতেই জানিয়েছেন লেখক।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীনগরের রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়িতে জন্মেছিলেন আকবর আলি খান। সে-ই খাঁ বাড়ির পূর্বজদের কথা বিস্তারিত লিখেছেন। যেখানে একটি বাঙালি মুসলমান পরিবারের উত্থানের কাহিনি পাওয়া যায় এবং মেলে তখনকার মুসলমান পরিবারগুলোর নানা রীতিনীতির বয়ান।
পারিবারিক সূত্রে বিয়ে হয়ছিল আকবর আলি খানের। স্ত্রী ছিলেন পেশায় শিক্ষক। স্ত্রীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কোনোএকটি কুরবানির ঈদের ঘটনা স্মরণ করেছেন লেখক। জোট সরকারের আমলের কথা। তখন তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান। এনবিআর চেয়ারম্যানকে খুশি রাখতে অনেকেই নানা উপঢৌকন নিয়ে আসত। কিন্তু সেসব গ্রহণ করতে নিজের স্ত্রীকে নিষেধ করেছিলেন তিনি এবং তার স্ত্রীও যথেষ্ট সৎ মানুষ ছিলেন। তো ঈদের দিন বিকেলে আকবর আলি খান বাসায় ছিলেন না। হঠাৎ একজন লোক গরুর বিরাট রান নিয়ে হাজির হলো এবং জানালো সে মি. টি রহমানের লোক। উপঢৌকন লেখকের স্ত্রী গ্রহণ না করায় ক্ষুব্ধ হয়ে লোকটি হুমকি দিয়ে চলে গেল। লেখক বাসায় ফিরলে ঘটনাটি জানিয়ে টি. রহমান কে তা তার স্ত্রী জানতে চাইলেন। আকবর আলি খান জানালেন টি রহমান হলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র তারেক রহমান। আকবর আলি খান এ-ও উল্লেখ করেছেন তিনি এনবিআর চেয়ারম্যান থাকাকালে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের কেউ কোনো অনৈতিক আবদার তাকে কখনো করেননি।
মেয়েকে নিয়ে স্মৃতিচারণের অংশটুকু পড়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছিলাম।
বই পড়ার নেশা ছোটোবেলা থেকেই। গ্রামে বই পাওয়া যেত না। তবু যে সংগ্রাম করে বই সংগ্রহ করতেন তা পাঠককে নিশ্চয়ই বই পড়া নিয়ে আরও উৎসাহী করবে।
স্কুল পাস করে ঢাকা কলেজ ও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের অনবদ্য বর্ণনা দিয়েছেন আকবর আলি খান। এই বর্ণনাকে চিত্রময়রূপ বললে অত্যুক্তি হবে না।
আমলা হওয়ার ইচ্ছে তার ছিল না। চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। হয়েছিলেন বিভাগে প্রথম। তবে শিক্ষক নিয়োগের নোংরা রাজনীতি ও তোষামোদি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না তিনি। তাই ঢাবিতে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়া হয়নি তার। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে সিএসপি হিসেবে যোগ দিলেন।
কর্মকর্তা হিসেবে নিজের কর্মজীবনের নানান ঘটনা লিখেছেন। পড়তে ভালো লাগবে। বিশেষত, যারা প্রশাসনে যোগ দিতে আগ্রহী, তাদের রোমাঞ্চকর লাগবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হবিগঞ্জ এসডিও ছিলেন আকবর আলি খান। মুক্তিযুদ্ধের সময় কে নেতৃত্ব দিবে তা নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিভক্তি এবং মুজিবনগর সরকারের উপসচিব হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সেই বিভক্তির আরও কদর্য রূপ দেখেছেন আকবর আলি খান। পড়তে ভালো লাগবে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে লেখকের আলাপচারিতাপর্ব এবং ইন্দিরা গান্ধীর বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর।
স্বাধীন বাংলাদেশে কিছুদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা পাঠকের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন লেখক।
এইসময় আমলাগিরি নিয়ে হাপিয়ে ওঠেন আকবর আলি খান। চাকরি ছেড়ে যোগ দিতে চান সদ্যপ্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বঙ্গবন্ধু তাকে চাকরি না ছাড়ার শর্তে জাবিতে যোগ দেওয়ার অনুমতি দেন এবং এখানেই সমাপ্ত আকবর আলি খানের 'পুরানো সেই দিনের কথা'।
আকবর আলি খান বরাবরই ভালো লেখেন। এবারও ব্যত্যয় হয়নি। অত্যন্ত সুখপাঠ্য আত্মকথা। তবে প্রথম পঞ্চাশ পাতা জুড়ে লেখকের পূর্বপুরুষের 'বন্দনা' পাঠক হিসেবে আমাকে বিরক্ত করেছে। অবশ্য সেই বিরক্তির রেশ হারিয়ে গেছে বাকি অংশ পড়ে।আত্মকথা আপনার পছন্দের জনারা হলে কিংবা আকবর আলি খানের লেখার গুণমুগ্ধ যে-কারো বইটি ভালো লাগবে।
কিছু লেখক থাকেন,যাদের কিছু বিশেষ পাঠক থাক। আকবর আলি খান আমার অন্যতম প্রিয় একজন লেখক। বইমেলায় এই বই প্রকাশের খবর পেয়েই সিদ্ধান্ত নেই এবার এই একটা বই অবশ্যই কিনবো। অবশেষে পড়ে শেষ করলাম পুরানো সেই দিনের কথা। বই এর নাম সাহিত্যিক ভাবধারার হলেও আর আত্মজীবনী হওয়া সত্ত্বেও এই বইটিও আমার কাছে লেখকের অন্যান্য বই এর মতোই গবেষণাধর্মী লেখা মনে হয়েছে। ২০০ বছরের পারিবারিক ইতিহাস বর্ণনার মাধ্যমে আত্মজীবনীর প্রথম খন্ডের শুরু।এরপর জন্ম থেকে ২৯ বছর জীবনকালের ঘটনা স্থান পেয়েছে এই খন্ডে। একজন আমলা হিসেবে সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ অবস্থানে থেকে কাজ করেছেন আকবর আলি খান। জীবনের পরবর্তী অংশে স্পর্শকাতর বিষয়ের কারণে মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লেখক।
ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড বই পড়ার নেশা।লাজুক প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু গ্রামে থাকাকালীন পাঠ্যবই এর বাইরে খুব বেশি পড়ার সুযোগ হয়নি।কলেজে উঠে ঢাকা কলেজে ভর্তি হন মানবিক শাখায় পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এরপর আর বই এর অভাব হয় না। পড়াশোনার বাইরেও বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন এখানে এসেই। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ আবার পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের পছন্দে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তখনকার সময় থেকেই মানবিক শাখার ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা হতো সুন্দর মুসলিম স্থাপত্যের ধরণে গড়া এসএম হলে। হলের খাবার,ছাত্রজীবনের সময়সুচী সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। কার্জন হলে বিজ্ঞান বিভাগের ক্লাস এবং ল্যাবরেটরির সমূহকার্যক্রম হওয়ায় তার পাশেই ফজলুল হক হলে থাকে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্ররা। ভার্সিটি তে এনএসএফ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু ছিল।এনএসএফ ছিল সামরিক শাসন সমর্থক দল। লেখক ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলেও সরাসরি কোন নির্বাচনে অংশ নেননি। ১৯৬৫ এর নির্বাচনের কার্যক্রমের সঙ্গে অনিচ্ছাসত্ত্বেও জরিত হয়ে পরেছিলেন। নির্বাচনে তার অসদুপায় অবলম্বনের ঘটনা নির্বিকারভাবে বর্ণনা করেছেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বিএ এবং এমএ পাশ করেন। তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ইতিহাস পড়াবেন। কিন্তু যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে পারেননি।
এরপর শুরু হয় সিভিল সার্ভিস অফ পাকিস্তান এ যোগদানের অধ্যায়। তৎকালীন পাকিস্তানে মেধা তা���িকায় ১২তম অবস্থানে থেকে যোগ দেন সিভিল একাডেমির প্রশিক্ষণে। প্রশিক্ষণের বিস্তারিত আলোচনা এবং সিভিল একাডেমি সম্পর্কে আলোচনা কৌতুহলের সাথে পড়েছি। প্রশিক্ষণের পর কাজ করেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এরপর যুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার এবং পরবর্তীতে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ স্থানে। এ ধরণের মানুষের আত্মজীবনী পড়া মানে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে পড়া। বই থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে দুর্নীতির ইতিহাস দেশের জন্মের সাথেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। লেখক তার কর্মজীবনে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের উভয় দেশের সিভিল সার্ভিসে কাজ করেছেন। পাকিস্তান আমলে যেভাবে কাজ করতে পেরেছেন স্বাধীন বাংলাদেশে সেভাবে কাজ করতে সক্ষম হননি। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে জয়েন করার পর দেড় বছর সময়কালের মধ্যে তার কর্মজীবনে বারবার অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টী হয়।
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আকবর আলি খানের পরিচয় টিভিতে আব্বা যখন টকশো দেখতেন সেগুলার মারফতে। লেখক আকবর আলি খানের সাথে পরিচয় "পরার্থপরতার অর্থনীতি" বইটি দিয়ে। সহজবোধ্য ভাষায় অর্থনীতির দুর্বোধ্য বিষয়গুলো তুলে ধরার ব্যাপারে আকবর আলি খানের জুড়ি নেই। সুন্দর গদ্যের অধিকারী আকবর আলি খানের আত্মজীবনী নিয়ে আগ্রহ ছিল তাই বেশি। সচরাচর আত্মজীবনীর সংজ্ঞা একেকজনের কাছে একেকরকম। কেউ হয়ত সহজ স্বীকারোক্তি দিয়ে বসেন কিংবা কেউ হয়ত নিজের প্রেক্ষাপট থেকে স্বীয় ঘটনাগুলো ব্যাখা করেন। আকবর আলি খান বইয়ের শুরুতেই তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোলাসা করে নিয়েছেন, যে তিনি সৎ আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করেছেন। বিচারকের ভূমিকায় সততা নিয়ে অত কঠোরভাবে কাঠগড়ায় দাঁড়া করানো যাবে কিনা তা নিয়ে আমি সন্দিহান তবে স্বাদু গদ্যের জন্য বইখানা উপভোগ করেছি অনেক। লেখক নিজের জীবনের প্রথম ২৯ বছরের বিষদ বিবরণ দিয়েছেন। নবীনগর থেকে ঢাকা কলেজ অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর পাট চুকিয়ে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস এ যোগদান আস্তে আস্তে ফুটে এসেছে ধারাবাহিকভাবে।
কিন্তু প্রথম ৬০-৭০ পৃষ্ঠায় বাঁধল বিপত্তি। তথ্যের ভারে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম। কেননা খাঁ বংশের ২০০ বছরের সমস্ত পূর্বপুরুষের বংশলতিকা তিনি তুলে ধরেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকানোর পর পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে নির্বাচিত হওয়া এবং প্রশিক্ষণ সময়কালীন বিবরণ টা রোমাঞ্চকর ছিল। তবে দূর্বল অংশ লেগেছে যখন নিজের ব্যাচমেট অথবা যত শত ব্যক্তির বর্ণনা এসেছে এবং তাদের শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের অতি বিশদ বিবরণ সংযোজন করায়। এসডিও হিসাবে যেসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন তিনি হয়েছেন সেসব ও নির্দ্বিধায় তুলে ধরেছেন।
আকবর আলি খানের ভাষ্যে, সিএসপি ছিল পাকিস্তানের স্টিল অফ ফ্রেম। সিএসপি অফিসার রাই এক হাজার মাইল দূরত্বে দুটি ভিন্ন দেশের প্রশাসন অব্যহত রেখেছেন। সে ইস্পাত-দৃঢ় আনুগত্য ছেড়ে যুদ্ধে যোগদান করে লার্নেড ম্যান আকবর আলি খান যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আকবর আলি খান ভাবেন নি লেখক হবেন কিন্তু জীবনের ৫০ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। বিষয়টা আমাদের মতন পাঠকের জন্য সুখকর কেননা আকবর আলি খানের মতন প্রাজ্ঞ ব্যক্তির জ্ঞানের ছোঁয়া পাওয়ার সুযোগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাফিলতি অনেক আগেই নষ্ট করে দিয়েছিল। তবুও এই বিচিত্রময়ের জীবনের অনেক চিন্তাধারা সাধারণ পাঠকের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন সে এক পাওনা বটে। আত্মজীবনীর পরবর্তী ও মূল আকর্ষণ দ্বিতীয় খণ্ডের অপেক্ষায়।
শান্তি পাইলাম না। প্রথম আলোতে অংশবিশেষ পড়ে ঠিক করছিলাম পড়ব না বই। তারপরও নিলাম। শুরুটা ভালোই ছিল। অংশ পরিচির বিশাল আলাপেও আপত্তি ছিল না। কিন্তু কর্মজীবনে ব্যাচমেটদের সম্পর্কেও আলাদা করে লেখার আসলে কোনো দরকার ছিল বলে মনে হয় না। শুরু ২৫শতাংশ পার করে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সাধারণ পাঠকের কোনো দরকার নাই। লেখকের কর্মজীবনের কিছু অংশ, আদালতের মোক্তারদের কাজকর্ম, প্রান্তিক বিভিন্ন ছোট ছোট রাজনীতির বিষয়গুলো আরও বিস্তারে, স্পষ্ট হয়ে আসলে ভালো হতো। মুক্তিযুদ্ধের অংশে ট্রেজারি লুণ্ঠন, নোট বাতিল ও বিনিময় এই বিষয়গুলো ইন্টারেস্টিং এবং প্রয়োজনীয়।
সব মিলিয়ে আকবর আলি খানের বর্ণাঢ্য জীবনের খানিকটা এসেছে। আশা করা যায় পরের অংশে আরও অনেক কিছু পাওয়া যাবে। বিশেষত স্বাধীন দেশের নানা ভাঙাগড়ার কথা।
আত্মজীবনী আমার পছন্দের জনরার একটি। আমি বই কিনতে গেলে আত্মজীবনী এবং ভ্রমণকাহিনীর দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখি৷ আত্মজীবনী কেন ভালো লাগে এর উত্তর আমি নিজে নিজেই খোঁজার চেষ্টা করেছি। কী লাভ অন্য একজনের ব্যক্তিগত জীবন এবং তাঁর আদর্শ সম্পর্কিত কথাবার্তা পড়ে? কারো জীবনের সাথে তো কারোরটা মিলবে না। জীবনী পড়ার একটা বড় কারণ বিখ্যাতদের জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজে সফল হওয়ার চেষ্টা করা বা অনুপ্রেরণা নেওয়া৷ তবে আমার ক্ষেত্রে বড় কারণ, যাঁদের আত্মজীবনী আমরা পড়ি, তাঁরা অধিকাংশই মারা গেছেন বা অতি বৃদ্ধ বা আরো কয়েক প্রজন্ম আগের। এর ফলে গ্রামীণ দৃশ্য এবং জীবনের যে মনোরম ছবিটা তাঁদের ছেলেবেলা থেকে পাওয়া যায়, আমাকে প্রচণ্ড টানে সেই সময়টা। ওই মধুর অতীতটা আমাকে নিজের অতীতেও ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এক ধরনের আয়না হিসেবে কাজ করে। একই সাথে ইতিহাসের নানা গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল সম্পর্কে এবং একজন রাষ্ট্রীয় বা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কেও জানা যায় আত্মকাহিনী থেকে৷ এই কারণগুলো গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে কেবল চেনা নয়, এর অন্যান্য কারণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আকবর আলি খানের অন্যান্য অর্থনীতি, সাহিত্য বিষয়ক বই পড়েই তাঁর লেখার মধ্যে একটা অন্য ধরনের সাবলীলতা খুঁজে পাই। তাঁর আত্মজীবনী বের হয়েছে, অথচ পড়ব না, এটা হতেই পারে না। তবে বইটি সম্পূর্ণ নয়। নানা কারণে অনেক কথাই সবসময় জীবিত অবস্থায় প্রকাশ করা যায় না, বিশেষত একজন রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য সেটা আরো কঠিন৷ তাই তাঁর বাকি জীবনকাহিনী প্রকাশিত হবে তাঁর মৃত্যুর পর। এই বইটিতে তাঁর শৈশবের নবীনগরে বেড়ে ওঠা, তাঁর পরিবার এবং বংশপরিচয় রয়েছে প্রথম ভাগে৷ ছাত্রজীবনের সব ক্ষেত্রেই মেধার স্বাক্ষর রেখে পরবর্তীতে প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখযোগ্য সময় পার করেন তিনি৷ সেই সময়ের অভিজ্ঞতাই এই বইটার প্রাণ৷ একই সাথে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানান অভিজ্ঞতার কথা। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সাথে তিনটি স্মৃতিচারণের ঘটনা। লেখকের মতে, পৃথিবীর কোন মানুষই ১০০% সৎ না। ১০০% সৎ হয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা সম্ভব না। সকলের মাঝেই কমবেশি মুনাফেকি রয়েছে। এছাড়াও আত্মজীবনীতে সম্পূর্ণ সত্যকথন সম্ভব না, এইটাও শুরুতেই কবুল করে নিয়েছেন তিনি৷ বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী বর্ষীয়ান এই মনিষীর জীবনের গল্প নানান কারণে একজন পাঠকের কাছে আকর্ষণীয়৷ একই সাথে সাহিত্যক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করার মতো। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম- কথাটা এই ক্ষেত্রে বলাটা সাজে না। তিনি আরো বেঁচে থেকে আমাদের আরো নানান মণিমুক্তা উপহার দিন, এই কামনাই বরং করি।
জানিনা আত্মজীবনীমূলক বই কেন আমাকে এত বেশি টানে। যেখানে মানুষ আজ থেকে ১০০ বছর পর কি হবে সেটা নিয়ে ভাবছে ; সেখানে কিনা নানান মনীষীদের অতীতের কথা গুলো পড়তেই বেশি ভালো লাগে। যে মানুষটার কলাম পড়তে ভালো লাগে ; তিনি কিভাবে দিন পার করছেন? তার বন্ধুবান্ধবই বা কারা? কেমন কেটেছে উনার শৈশব? গ্রাম বাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতির অতীত ইতিহাস টুকু আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে। গল্প উপন্যাস কবিতাতে হয়তো এই দৃশ্যগুলো ফুটে ওঠে কিন্তু সেখানে কেন জানি বাস্তবের চেয়ে কল্পনা প্রাধান্য পায়। কেমন জানি একটা মেকি মেকি ভাব । কিন্তু আত্মজীবনী পড়লেই মনে হয় মানুষটাকে সামনাসামনি দেখতে পাচ্ছি । ওতে একবিন্দুও খাঁদ নেই।
তবে এটাও ঠিক যে, প্রিয়জনের কাছ থেকে গল্প শুনতে যতটা ভালো লাগে ; অন্যদেরটা অতটা টানে না। প্রত্যেক পাঠকদের কিছু দুর্বল জায়গা থাকে। শরৎবাবু যেমনটা বলেছেন, "এই পৃথিবীতে এক সম্প্রদায়ের লোক আছে,তাহারা যেন খড়ের আগুন। দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেও পারে,আবার খপ্ করিয়া নিবিয়া যাইতেও পারে। তাহাদের পিছনে সদা সর্বদা একজন লোক থাকা প্রয়োজন- যেন আবশ্যক অনুসারে খড় যোগাইয়া দেয়"। ডঃ আকবর আলি খান আমার কাছে তেমনই একজন। উনার প্রত্যেকটা বই গোগ্রাসে গিলেছি এবং বিভিন্ন প্লাটফর্মে সেগুলো নিয়ে আলোচনাও করেছি। পড়ে ফেললাম উনার আত্মজীবনীমূলক বই 'পুরানো সেই দিনের কথা' ।
১। তিন টি দায়বদ্ধতার কারণে তিনি আত্মজীবনীটি লিখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। এক. উনার মেয়েকে কথা দিয়েছিলেন নিজের পূর্বপুরুষদের ইতিবৃত্ত তিনি লিখবেন এবং দুই. ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে তিনি পদত্যাগ করলে তিনি সাংবাদিকদের এই পদত্যাগের কারণ বিশদে লিপিবদ্ধ করবেন - এই ওয়াদা করেছিলেন। তিন. আমলাতন্ত্রে যারা ভবিষ্যতে যোগ দেবেন তারা যেন একজন আমলার সফলতা বা ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। জন্ম থেকে ২৯ বছর জীবনকালের ঘটনা স্থান পেয়েছে এই খন্ডে। তবে উনার বর্ণাঢ্য জীবনের বাকি অংশের কথা প্রকাশিত হবে উনার মৃত্যুর পর, দ্বিতীয় খন্ডে । কারণ এই অংশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর বিষয়ে আলাপ থাকবে।
২। বইয়ের প্রথম অংশে তাঁর শৈশবের নবীনগরে বেড়ে ওঠা, তাঁর পরিবার এবং বংশপরিচয় রয়েছে৷ কিভাবে উনার পূর্বপুরুষরা সনাতন ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন ;সেটার বিশাল ঐতিহাসিক বর্ণনা । উনার বংশের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে আলাদা আলাদা বিস্তারিত আলাপ করেছেন। ঘটনাচক্রে কিভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন এবং উনার পিএইচডি চলাকালীন সময়ে গাণিতিক সমস্যার সমাধানে উনার স্ত্রীর কাছ থেকে কীভাবে সাপোর্ট পেয়েছেন সেটা আন্তরিকভাবে বর্ণনা করেছেন। স্ত্রীর একান্ত ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন ,সেটাও কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করেছেন । ঈদের দিনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ছেলে তারেক রহমানের উপহার উনার স্ত্রী ফিরিয়ে দিয়েছেন এরকম নানান বর্ণনায় স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন। বিশেষ করে, কন্যা নেহেরিন খান সম্পর্কিত বর্ণনা পড়ে পাঠক হিসেবে আমি নিজেও আবেগাপ্লুত হয়েছি। এই অংশে প্রায় ৭০ পৃষ্ঠা অযাচিত খরচ করেছেন বলেই মনে হয়। তবে ইতিহাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া আকবর আলি খান এর ইতিহাস সংক্রান্ত বর্ণনায় মুন্সিয়ানা দেখতে পাওয়া যায়।
৩। শৈশব, কৈশোর এবং শিক্ষাজীবন নিয়ে আলোচনা করেছেন । বইপড়ুয়া আকবর আলি খান কীভাবে নানা প্রচেষ্টায় বই সংগ্রহ করতেন ; সেই বর্ণনাটুকু আপনাদের ভালো লাগবে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সংক্রান্ত বর্ণনায় তৎকালীন সময়ের ছাত্র রাজনীতি , শিক্ষার মান ইত্যাদি আলোকপাত করেছেন । উনার সময়কার শিক্ষকদেরকে নিয়েও ছোট ছোট বর্ণনা রয়েছে। কিভাবে ছাত্র ছাত্র ইউনিয়ন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন সেটিও স্বীকার করেছেন । অনার্স-মাস্টার্স দু'জায়গাতেই রেকর্ড সংখ্যক মার্কস নিয়ে, প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে হয়েও শিক্ষক হতে না পারার আক্ষেপ করেছেন । তৎকালীন সময়ে শিক্ষক নিয়োগের এই ফাঁকফোকরগুলো আলোচনায় এসেছে।
৪। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সারা পাকিস্তানে ১৬ তম এবং বাঙ্গালীদের মধ্যে ৫ম স্থান অধিকার করার মাধ্যমে সিএসপি হিসেবে যোগ দিলেন।। উনার সাথে যারা সিভিল সার্ভিসে যোগ দিয়েছেন তাদের আলোচনা এসেছে। বইয়ের বাকি অংশ খুবই রোমাঞ্চকর এবং যারা আমলাতন্ত্রে যোগ দিতে চান জন্য অনুপ্রেরণার। কর্মকর্তা হিসেবে কিভাবে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেছে ; ক্ষেত্রবিশেষে অনেককে শাস্তি দিয়েছেন ,অপরাধ না করেও বিপদে পড়েছেন , আমলাতন্ত্রের ফাঁকফোকর গুলো কোন জায়গায় ; সেগুলো অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণনা করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় । আকবর আলি খান হবিগঞ্জের এসডিও ছিলেন । এ সময় তাঁর ভূমিকা কেমন হবে ? অখন্ড পাকিস্তান কায়েম করার যে শপথ নিয়ে পাবলিক সার্ভিস এ যোগ দিয়েছেন সেটি অক্ষুন্ন রাখবেন নাকি স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন? স্বাধীন দেশে উনার ভূমিকা টা কি হবে? কেমন ছিল তখনকার প্রশাসন? জানতে হলে পড়তে হবে বইটি।
শেষ কথা- সব বইয়ের কিছু দুর্বলতা থাকে এটিও ব্যাতিক্রম নয়। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীনগরের রসুল্লাবাদ খাঁ বাড়ির দীর্ঘ ইতিহাস আপনাকে বিরক্ত করতে পারে । আবার উনার সাথে যোগ দেওয়া সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের বিস্তারিত বিবরণ কিংবা মুক্তিযুদ্ধে কোন সেক্টরে কে যুদ্ধ করেছে ; এরকম সাধারণ বর্ণনাগুলো পাঠকদের ভালো লাগবে না । কিছু কিছু জায়গায় উনার অন্য বইগুলোর রিপিটেশন রয়েছে , যেটা হয়তো ওনার মনের অজান্তেই হয়েছে । উনার পূর্বপুরুষ কিভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে , এরকম বর্ণনা উনার 'বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য' বইটি থেকেই পড়েছিলাম। কিংবা জন্মদিন সংক্রান্তঃ চুটকিগুলো 'আজব জবর অর্থনীতি ' বইটি পেয়েছিলাম। এরকম একজন ব্যক্তির আত্মজীবনীর প্রচ্ছদ এতটা বাজে হতে পারে! দুঃখজনক। যেহেতু উনি শারীরিকভাবে লিখতে অক্ষম ,অন্য একজন নির্দেশনা অনুযায়ী টাইপরাইটিং করছে ; তাই কিছুটা আকবর আলী খানের লেখার রম্য ঘরানা অনুপস্থিত।
সর্বোপরি বইটি আমার দারুন লেগেছে এবং আগ্রহী পাঠকদের তৃষ্ণা মেটাবে বলেই বিশ্বাস করি।
I have read 2 of his previous books, so wanted to read this one eagerly. But disappointed to some extent. If I divide it into 2 equal halves, i didn't like the 1st, but the 2nd part was good. So many obsolete information (to me) was given by the author. But as it's his autobiography, he has every right to write whatever he likes. Still I am eagerly waiting for sequel to this one as he has wished to reveal the insights of Caretaker Govt of 2007.
প্রথম খন্ড পড়ে তৃপ্ত হলাম না।অজানা অনেক বিষয়ের ইংগিত দিয়েছেন যা দ্বিতীয় খন্ডে থাকার কথা। দ্বিতীয় খন্ড বের হবে নাকি জানি না। অনেক সাহসের সাথে প্রশাসনের কাজ করেছেন। আল্লাহ উনাকে বেহেশত নসীব করুক।
আকবর আলি খান কর্মজীবনে হতে চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নিজ বিষয়ে প্রথম শ্র���ণীতে প্রথম হবার পরেও তৎকালীন বিভিন্ন রাজনৈতিক জটিলতায় তার মনোকামনা তখন পূরণ হয়নি। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হবিগঞ্জ জেলার এস. ডি. ও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই তরুণ বয়সেই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার মাধ্যমে তিনি তার দেশপ্রেম ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন সংস্থাপন মন্ত্রনালয়, অর্থ মন্ত্রানালয়ে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন, অধ্যাপনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে, অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্ব ব্যাংক ও ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসে।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে বাস্তবায়িত অনেক কর্মসূচিতে কাজ করেছেন আকবর আলি খান। তিনি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত আরডি-১ প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে। অর্থ সচিব থাকাকালে তিনি গরিবদের জন্য ঘর নির্মাণে ‘গৃহায়ণ তহবিল’ এবং ‘কর্মসংস্থান ব্যাংক’ গড়তে অনন্য ভূমিকা রাখেন। তিনি দুই বছর সামাজিক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে সাধ্যমত অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন।
এই বইতে তিনি তার একদম শৈশব থেকে বেড়ে ওঠা, শিক্ষাজীবন, পরিবার, বংশ পরিক্রমা, চাকরিজীবনের প্রথম ভাগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনা করেছেন তার দর্শন ও জীবন চিন্তা নিয়েও। বইয়ের প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনা, তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ রেফারেন্স দিয়ে তার গবেষক সত্তার পরিচয় দিয়েছেন।
প্রথমার যেকোন বইয়ের মত এই বইয়ের ও প্রোডাকশন অনেক ভালো। বইয়ের পরবর্তী অংশ প্রকাশিত হবার কথা কিছু সময়ের মাঝেই।
সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণের পর পূর্ণকালীন লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। তার লেখা ১৭ টি বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। পরার্থপরতার অর্থনীতি, আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি, দারিদ্র্যের অর্থনীতি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের বাজেট অর্থনীতি ও রাজনীত; এগুলো তার অর্থনীতি নিয়ে লেখা বই। এই বইগুলোতে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে তার চিন্তা, সার্বিক উন্নয়নের জন্য করণীয় ও উন্নয়নের পথে বাঁধা সহ দেশের অর্থনীতির নানাবিধ দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিয়ে যারা ভাবে তাদের জন্য আকবর আলি খানের বইগুলো অবশ্যপাঠ্য।
বর্নাঢ্য কর্মজীবনে অর্জন করেছেন অনেক কিছুই তবে তার সবচেয়ে বড় অর্জন সম্ভবত নিজেকে আপাদমস্তক সৎ এবং অকপট মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। জীবনে কখনোই নীতির সঙ্গে আপোষ করেননি। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য তার অবস্থান ছিল অনড় ও অকপট।
আকবর আলী খানের জীবনের প্রথম ২৯ বছরের গল্প আছে এখানে। বইটির আরেকটি খন্ড প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তিনি চলে যাওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি।
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলী খান ১৯৪৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার রসুল্লাবাদ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় ধানমন্ডি গভ: বয়েজ হাই স্কুলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি। কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য মনোনীত হয়ে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
তার পেশাগত জীবন ছিলো বিচিত্র। তিনি পেশগত জীবন শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে। এরপর তিনি লাহোরের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭০ সালে হবিগঞ্জ মহুকুমার এসডিও হিসেবে পদস্থ হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি হবিগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসক (এসডিও) ছিলেন এবং যুদ্ধকালীন সময়ে সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সাথে কাজ করেছেন। পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে হবিগঞ্জ পুলিশের অস্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে তিনি মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীপরিষদ বিভাগে উপসচিব হিসাবে পদস্থ হন। আগস্ট মাসে তাকে উপসচিব হিসাবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকার তার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। যুদ্ধ শেষে তিনি সচিবালয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। পরে তাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।
১৯৭৩ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় যোগদানের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার পদত্যাগপত্র জমা দিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তাকে অবসর না দিয়ে শিক্ষকতা করার জন্য ছুটি দেয়া হয়।
এরপর কিছুদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য মনোনীত হয়ে তিনি কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং সেখানে অর্থনীতি বিভাগে মাস্টার্স এবং পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৯ সালে দেশে ফেরত আসার পরে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
❝জীবনযাপন করাই যথেষ্ট নয়, জীবন থেকে শেখার প্রয়োজন রয়েছে। জীবন নিয়ে বীক্ষণ করতে হবে। চিন্তা করলে দেখতে পাব আমরা কেউই সম্পূর্ণ সৎ নই। প্রত্যেকের মধ্যেই কমবেশি মুনাফেকি রয়েছে। পরিবেশবিষয়ক সংগ্রামী নেতা Paul Watson লিখেছেন, 'Everybody is a hypocrite. You cannot live on this planet without being a hypocrite.' পৃথিবীতে শতভাগ লোক মুনাফেক নয়, আবার শতভাগ লোক সৎ-ও নয়। সততা ও মুনাফেকির আলপনায় চলছে মানুষের জীবন।❞
আকবর আলী খানের বই প্রথম নেড়েচেড়ে দেখি বছর তিনেক আগে, বুঝেছিলাম অল্পই, কিন্তু তাঁর লেখার ধরনটা ভালো লেগে যায়। এরপর তাঁর অনেকগুলো বই-ই কমবেশি পড়েছি। বইগুলো পড়ে বুঝতে পারলাম যে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক সমৃদ্ধ। সেখান থেকে জানার এবং শেখার অনেক কিছু রয়েছে, যদিও রাজনৈতিকভাবে তিনি অনেক বিতর্কের মধ্য দিয়ে গিয়েছেন।
যাহোক, নিজের না বলা কথাগুলো প্রকাশ করতে এবং মরহুম কন্যাকে দেওয়া কথা রাখতেই তিনি এই আত্মজীবনীখানি লিখেছেন। শুরুতেই তাঁদের বংশপরিচয়ের বিস্তারিত আলোচনা, এবং সেই সময়ে তাঁদের এলাকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বর্ণনা! বর্ণনা পড়ে মনে হচ্ছিল এ যে আসলেই একজন ইতিহাসবিৎ!! (এবং অর্থনীতিবিদও!!)
এরপরে তাঁর ছেলেবেলা, ছাত্রজীবন, বিশ্ববিদ্যালয়জীবন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা রয়েছে; রয়েছে সরকারি চাকরিতে যোগদান এবং ট্রেইনিংচলাকালীন অভিজ্ঞতা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থার আলোচনা। এই আলোচনাগুলো যারা প্রশাসনিক লাইনে রয়েছে কিংবা সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কাজের, পাশাপাশি আগ্রহী পাঠকদেরও সন্তুষ্ট করবে।
বইটা এখানেই শেষ নয়! দ্বিতীয় খন্ডও প্রকাশিত হবে। লেখকের ভাষ্যমতে সেখানে অনেক সংবেদনশীল তথ্য থাকবে যেহেতু তিনি সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ পর্যায়ে কাজ করেছেন। তিনি দ্বিতীয় খন্ড লিখে রেখে যাবেন, এবং প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়ে যাবেন। প্রায় নিঃসঙ্গ এই মানুষটির জন্য রইলো ভালোবাসা!
এই বইয়ে একজন কিশোরের কথা বলা হয়েছে। জেনে ভালো লাগে যে ছেলেটিও আমার মতোই কিশোর বয়সে প্রচুর মুজতবা আলীর লেখা গিলেছে। ছোটবেলা থেকেই তার জ্ঞানার্জনের ইচ্ছা ছিলো প্রবল। ছেলেটি বড় হয়, এবং ঘটনাচক্রে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে না। সিএসপি অফিসার হওয়ার গৌরব অর্জন করে সে। ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও কর্মজীবনের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে করতে বইটি এগিয়ে চলে। স্বাভাবিকভাবেই মুক্তিযুদ্ধের আলোচনাও আসে। আমার মনে হয় লেখক তার নিজের সম্পর্কে ‘তিনি সৎ’ ধারণা পোষণ করেন যা একটু হলেও ভ্রান্ত। এ প্রসঙ্গে তার বইয়ে উল্লেখ করা উদ্ধৃতি তুলেই দেয়া যায়: “Everybody is a hypocrite. You cannot live on this planet without being a hypocrite.” - Paul Watson, Environmentalist leader
ইদানিং নতুন একটা জিনিস শিখেছি- ননফিকশন পড়ার সময় শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় অংশ পড়া। এতে সময় বাঁচে। এই বইয়ের শুরুর অংশ, প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা ভর্তি রসুল্লাবাদ গ্রামের ইতিহাস, আর আকবর আলি খানের পূর্বপুরুষের ইতিহাস নিয়ে। এই অংশটা বাদ দিয়ে পড়েছি। বাকি অংশটুকু ভাল লেগেছে।
আমার পড়া ভদ্রলোকের দ্বিতীয় বই । ছোটবেলা থেকে একদম তার কর্মজীবনের শেষ পর্যন্ত সব বিষয় নিয়ে লেখা । উঠে এসেছে সমসাময়িক কিছু ঘটনাবলিও । বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো আর আমলাতন্ত্র কেন শক্তিশালী বা স্বাধীন হলো না সে বিষয়ে বিস্তর বর্ণনা আছে বইটিতে । প্রথম পড়া বইটি ছিল ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’, সেটা মূলত অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ের সরল বিবরণ । তবু সেখানে মানুষ বলতে গেলে উপস্থিত ছিল না । সেক্ষেত্রে এই বই বলা যেতে পারে বিপরীত ।
মানুষ আছে, আছে কী করে কিছু ভাল কাজ আসলে খারাপ ফল নিয়ে আসে । সেগুলোকে ভদ্রলোক বলেছেন Friendly Fires । সে বিষয়ে একটা বইও আছে তার । নামটাও Friendly Fires, সেটা পড়তেও বেশ ইচ্ছে হচ্ছে এখন । সময় আর সুযোগ হলে ঐটাই পরবর্তী বই ।
যারা বই পড়েন, আর প্রামাণ্য খুঁজে বেড়ান বিভিন্ন বিবরণের দলিলে তারা পড়ে দেখতে পারেন । ভাল লাগার কথা । ৪.৫/৫ ।