গৌতম বুদ্ধের জীবৎকাল তথা ভারত-ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়কে অবিকল ও প্রাণবন্ত চেহারায় ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন বিদগ্ধ কথাকার বাণী বসু, দু-পর্বে সুবিন্যস্ত তাঁর এই বিশাল, বেগবান, বর্ণময় উপন্যাসে। এই কাহিনীর পটভূমি একদিকে ছুঁয়ে আছে মধ্যদেশ—অর্থাৎ আজকের বিহার উত্তরপ্রদেশের কিছু-কিছু অঞ্চল, অন্যদিকে চিরকালীন মানুষের চির জটিল মনোলোক। এই দ্বিবিধ পটভূমিতে ভিন্ন ভিন্ন স্তরে ক্রমশ উন্মোচিত হয়েছে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাসের কথাবস্তু। কখনও রাজনৈতিক স্তরে—যেখানে উত্তর-পশ্চিম থেকে পুবে আরও পুবে সরে আসছে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র, গান্ধার-মদ্ৰ-কুরু-পাঞ্চালের জায়গায় কোশল-বৈশালী-মগধ, পুরনো সাম্রাজ্যবাদের নীতির সঙ্গে ঘটছেন তুন মৈত্রী-ভাবনার সংঘাত। এই সংঘাতের কেন্দ্রে যেমন আছেন লোক বিশ্রুত গৌতমবুদ্ধ, আছেন ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট বলে খ্যাত বিম্বিসার, কোশলপতি প্রসেনজিৎ ও নানান ধুরন্ধর রাজপুরুষবর্গ, তেমনই আছেন তক্ষশিলার বিদগ্ধ যুবক চণক, গান্ধারের বিদুষী নটী জিতসোমা, সাকেতের সন্ধিৎ সুরাজন্য কুমারতিষ্য। কখনও-বা অর্থনৈতিকস্তরে, যেখানে ক্ষমতার প্রতিসরণ ঘটছে শ্রেণীবিন্যাসেও। ধনই হয়ে উঠছে প্রকৃত ক্ষমতার উৎস। বাণিজ্যের সম্প্রসারণের সঙ্গে-সঙ্গে শাস্ত্রজীবী এবং শস্ত্রজীবীদের প্রতিযোগিতায় পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে আসছেন বণিক ও ধনজীবীরা। আবার সামাজিক স্তরে এঁদের সবাইকে ঘিরে বৃহত্তর জনজীবনে কৃষিজীবী, বৃত্তিজীবী, ভূম্যধিকারী নাগরিক, ছোটব্যবসায়ী, কবি, নটী, দাস প্রমুখের ক্ষেত্রে চলেছে শাশ্বত জীবনচর্যা। তবু তার উপরেও পড়ছে পরিবর্তনের নানান সূক্ষ্ম আঁচড়। বুদ্ধ কথিত ভাবাদর্শ বহুভাবে প্রবেশ করছে গণচেতনায়, জাগছে কখনও অনুকূল প্রভাব, কখনও-বা প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া। আর এই সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য-বিপর্যয়, সম্পর্কের ভাঙন ও পুনর্বিন্যাসের অন্তঃশীলপ্রবাহ। মনস্তাত্ত্বিক এইস্তর । এই চতুরঙ্গ স্তরের প্রতিচ্ছবির মধ্য দিয়ে মোহনার দিকে এগিয়ে-যাওয়া এই উপন্যাসে কিংবদন্তি হয়ে-ওঠা বহু ঘটনার ও অনুরূপ পরিস্থিতির নতুনতর ভাষ্য। আধুনিক জীবনের চোখে প্রাচীন জীবনের আপাত সরলতার মিথকে ছিন্ন করে এক অতিজটিল আবেগ-অনাবেগ, প্রেম-অপ্রেম, চেতন-অবেচতনের দ্বন্দ্বময় ব্যক্তি ও যৌথ-জীবনের কথা। যথোচিত ভাষায়, এবং যথাযোগ্য আঙ্গিকে|আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত
Bani Basu is a Bengali Indian author, essayist, critic and poet. She was educated at the well-known Scottish Church College and at the University of Calcutta.
She began her career as a novelist with the publication of Janmabhoomi Matribhoomi. A prolific writer, her novels have been regularly published in Desh, the premier literary journal of Bengal. Her major works include Swet Patharer Thaala (The Marble Salver), Ekushe Paa (twenty One Steps), Maitreya Jataka (published as The Birth of the Maitreya by Stree), Gandharvi, Pancham Purush (The Fifth Man, or Fifth Generation?) and Ashtam Garbha (The Eighth Pregnancy). She was awarded the Tarashankar Award for Antarghaat (Treason), and the Ananda Purashkar for Maitreya Jataka. She is also the recipient of the Sushila Devi Birla Award and the Sahitya Setu Puraskar. She translates extensively into Bangla and writes essays, short stories and poetry.
Bani Basu has been conferred upon Sahitya Academy Award 2010, one of India's highest literary awards, for her contribution to Bengali literature.
একটা অস্পষ্ট বেদনার ভার বুকের ভেতর নিয়ে বইটা শেষ হল! চোখের সামনে বিম্বিসারের জগত ধুসর হয়ে এল। একটা বই পড়লাম বটে। ঘোরের মধ্যে ছিলাম খানিকটা। শেষের দিকে এসে মনে হচ্ছিল বইটা শেষ না করি। ওভাবেই রেখে দিই। ঘোরটা থাকুক।
খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ সাল। সেই আড়াই হাজার বছর আগে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। অস্তিত্বের অতীতে। সেই সব বই ই আমার বেশি ভাল লাগে যেগুলো আমাকে ভাবায়। এই বই ভাবিয়েছে, জানিয়েছে, প্রশ্ন জাগিয়েছে। হাজার বছর ধরে যে প্রশ্নের উত্তর মানুষ খুঁজেই চলেছে। বই পড়ে আনন্দ পাবার পাশাপাশি ভাবতে চাইলে এই বইটা ভাল লাগবেই। ইতিহাসের সুতোয় কল্পনার মালা গেঁথে লেখা বই। রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি ঘিরে মানুষের বেঁচে থাকার গল্প বলা বই। বিস্তৃতি মগধ(বর্তমান বিহার), কোশল (উত্তরপ্রদেশ) থেকে পশ্চিমে গান্ধার(পেশোয়ার,পাকিস্তান) ঘিরে জম্বুদ্বীপ( বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশ) জুড়ে। আছে ¬সম্রাট বিম্বিসারের হৃদ্যতার কথা, সেই সময়েও জীবনের সত্য আবিষ্কার করা দূরদর্শী চণকের কথা, সংশয়ী তিষ্য, ব্যক্তিত্বময়ী নারী বিশাখা, আর সবাইকে বৃত্তস্থ করে কেন্দ্রে আছেন লৌকিক মতে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন তথাগত। গৌতম বুদ্ধ।
আমার পড়া বইগুলোর মাঝে একেবারে উপরের দিকে জায়গা করে নিয়েছে বইটা। কি চমৎকার ভাষা, অসাধারণ কাহিনী প্রসঙ্গ। সাধারণ মানুষ জম্বুকের মহামুনি হয়ে ওঠার কাহিনী, ভিক্ষুণী উৎপলার অধিকার-বাসনা রহিত প্রেমের গল্প খুব নাড়া দিয়েছে। তখনো বৈদিক যুগ একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। মূর্তিপুজার চল শুরু হয়নি। বিভিন্ন মতের ধর্ম্পুরুষরা আছেন। মানুষেরা ব্রাহ্মণ বা তাদের মত মেনেই উপাসনা করে, ধর্ম চর্চা করে। এইরকম সময়ে সম্পুর্ণ নতুন জীবনদর্শন নিয়ে এলেন গৌতম। অনেকের মতে তথাগত। সমাজে, মানুষের সংস্কারে আনলেন এক বিরাট পরিবর্তন। বৌদ্ধ দর্শন (মতান্তরে ধর্ম) নিয়ে আমার অনেককাল আগে থেকেই বেশ কৌতুহল ছিল। দুই-একটা বই পড়েছিলাম। এই বই পড়ে আরো খানিকটা জানলাম।অবশ্য একটু অন্য আঙ্গিকে, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে!
একটা সময়কে ধরে রেখেছে বইটা। বনে থাকা অনার্য যক্ষদের থেকে শুরু করে, সাধারণ কৃষক,নর্তকী, ব্রাহ্মণ, ধনী,রাজা কেউ বাদ যায়নি। তখনকার সমাজ আর তার মানুষের গল্প। তাদের চিরকালীন জীবনবোধের গল্প। সেই সময় ও কিছু মানুষ ভাবত, প্রশ্ন করত, জীবনের মানে খুঁজত। গল্প আর ইতিহাসের মাঝ দিয়ে সেই খোঁজের আর একটা প্রচ্ছন্ন দর্শনের সুর বাজিয়ে গেছেন লেখক। কী অর্থ আমাদের এই জীবনের? নির্বাণ কি? আজো আমরা যার উত্তর খুঁজি। খুঁজে যাব হয়তোবা।
উপন্যাস শেষ করবার পরে এক রকমের শূণ্যতা এসে ঘিরে ধরলো আমাকে। কেননা গত কয়দিন ধরেই নেশাগ্রস্তের মতন বই এর পাতা উল্টে চলে গেছি যান্ত্রিক কোলাহল আর ট্রাফিক জ্যামের এই শহর ছেড়ে বহুদূরে। নয়টা-পাঁচটা র গতবাঁধা জীবনকে ফাঁকি দিয়ে পৌছে গেছি আড়াইহাজার বছর আগের সুবিশাল ভারতবর্ষে। হেটে বেরিয়েছি শ্রাবস্তী আর বৈশালীর রাস্তায় কিংবা আচমকা নি:শ্বাস বন্ধ করে ঢুকে পড়েছি মগধের রাজপ্রাসাদে, অবাক হয়ে ভেবেছি এই কী তবে বিম্বিসারের ধূসর জগত! বেনুবনে কিংবা জেতবিহারে বসে তথাগতর মুখে জেনেছি বুদ্ধদর্শন, চণকের তীক্ষ্ণ যুক্তির শরাঘাতে বারবার এলোমেলো করেছি বিশ্বাসের সদর্প অস্তিত্ব।
আর এখন, শেষরাতে; একরাশ শূণ্যতা আর মুগ্ধতা মিলেমিশে জানান দিচ্ছে, কত সহজেই সবকিছু একদিন গল্প হয়ে যায়!!
“গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে রচিত অবিস্মরণীয় এক মহাকাব্য” এটুকু বললে আসলে এর পরিধির ব্যাপারে কিছুই বলা হয়না। আবার পরিধি এতোই বিস্তৃত যে আমার সীমিত শব্দভাণ্ডার সেই সুবিশাল পরিধির কাছে পরাস্ত। এরচেয়ে বরং নিজের অনুভূতির কথা বলা যাক।
আমি তৃপ্ত,মুগ্ধ,বিস্মিত বাণী বসুর এই মাস্টারপিস পড়ে। আলাদাভাবে লেখিকার বর্ণনাশৈলীর কথা বলতেই হবে। প্রতিটা বাক্য,প্রকৃতপক্ষেই প্রতিটি বাক্য চোখের সামনে ভেসে উঠতে বাধ্য। এমন অনবদ্য বর্ণনার জন্য আলাদাকরে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
গৌতমের শুরু থেকে শেষ, তার সাধারণ মানুষ থেকে তথাগত হওয়া,ঐ সময়কার মগধ এবং সমগ্র ভারতবর্ষ, তৎকালীন রাজনীতি,কুটনীতি, হিংসা, ভালোবাসা,মুসলিমদের প্রবেশ ইত্যাদি নিয়ে কেউ যদি কেবলমাত্র একটি বই পড়তে চান সেক্ষেত্রে ‘মৈত্রেয় জাতক’-এর চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারেনা।
গৌতম বুদ্ধরে নিয়া উপন্যাস লেখার ঝামেলা আছে অনেক। কারণ বুদ্ধ যতটা না ঐতিহাসিক চরিত্র, তার চেয়ে বেশি পৌরাণিক চরিত্র। কিন্তু উপন্যাস লিখতে গেলে বুদ্ধের পৌরাণিক চরিত্রের প্রতি সম্মান রাইখাই তারে একটা ঐতিহাসিক রূপ দেয়া লাগবে। এই কারণে বুদ্ধ এই উপন্যাসে যতটা পৌরাণিক, ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ততটাই রাজনৈতিক। এইসব ঐতিহাসিক কাহিনী আবার কতটা ঐতিহাসিক সত্য আর কতটা কল্পনাশ্রয়ী, সেইটাও প্রশ্নসাপেক্ষ।
যারা বৌদ্ধিক দর্শন নিয়া পড়াশোনা করছেন তাদের কাছে এই বই অনেকাংশে বাতুলতা মনে হইতে পারে, কারণ বৌদ্ধ দর্শনের মনস্তাত্ত্বিক দিকের চাইতে তার সামাজিক প্রভাবের উপর বেশি জোর দেয়া হইছে। বুদ্ধ চিত্র এইজন্য হইছে অনেকটা সমাজ সংস্কারকের মতো। তবে সমাজ সংস্কার হয়তো বুদ্ধের শিক্ষার উপজাত বড়জোর, বুদ্ধের মূল লক্ষ্য কখনোই সেই দিকে ছিল না। জগতের প্রতি বুদ্ধের প্রশ্ন ছিল মনস্তাত্ত্বিক দুঃখের সর্বব্যাপিতা নিয়া, কেন সকল সম্ভোগের পরেও তৃষ্ণার লেলিহান শিখা অন্তরকে সর্বদাই অস্থির রাখে সেইটা নিয়া। এবং তিনি যেই উত্তর দিছেন সেইটা সূক্ষ্ম, এবং স্বভাবতই সকলের বোধগম্য না। বুদ্ধের চরিত্র তাই বেশিরভাগ মানুষরে অনুপ্রেরণা যোগাবে না। এইজন্য উপন্যাসের চরিত্র হওয়ার জন্য বুদ্ধ আদর্শ না।
এইরকম একটা চরিত্র নিয়া উপন্যাস লিখতে গেলে যেরকম মনস্তাত্ত্বিক ফোকাসের দরকার ছিল, সেইরকমটা করতে লেখিকা ব্যার্থ হইছেন। এইটা বাদ দিলে একটা সামাজিক-ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে পড়লে বইটা খারাপ না।
কিছু কিছু বই বস্তুত দর্পণের কাজ করে। যে দর্পণের সামনে দাঁড়ালে নিজের চেনা জানার যে জগৎ আছে তারও বাইরে বের হয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কিংবা অন্তঃসারশূন্য মনে হতে থাকে। মৈত্রেয় জাতক শেষ কারার পর নিজের মধ্যেই কেমন শূণ্যতা কাজ করছে। যেন এক মহাকাব্যের অন্ত তার পাঠকদের অনুভূতি শূন্য করে রেখেছেন। যার রেশ পাঠকের মাঝে বহু বহু ক্ষণ পরেও বিরাজ করে।
আদপে মৈত্রেয় হলেন অনাগত সেই মহৎ ব্যক্তি যিনি তথাগত বুদ্ধের দেহান্তের আরো পাঁচ হাজার বছর পরে জন্মাবেন। অপর দিকে জাতক শব্দের একটি অর্থ হলো নবাগত শিশু।
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের নানা জনপদে ঘুরে বেড়ানোর যে অবর্ণনীয় আনন্দ এই বইতে পেয়েছি তার সঙ্গে তুলনা চলে না অন্য কিছুর। যেখানে মহানায়কের আসনে আসীন হয়ে আছে স্বয়ং তথাগত বুদ্ধ। আরো আছেন মগধ রাজ বিম্বিসার। বিখ্যাত নারী চরিত্র বিশাখা। যিনি সেই সময়ের চেয়েও অনেক আগে ধাবমান এক বিদুষী। তার মাতা সুমনা, পিতা ধনঞ্জয়। পাঞ্চাল তিষ্য, গান্ধার রমণী জিতসোমা। এবং এই পুরো কর্ম যজ্ঞের আরেক অগ্রগণ্য নায়ক দেবারত কাত্যায়ন পুত্র চণক। যিনি জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ। জন্মভূমির প্রতি তার ভালোবাসা অপরিমেয়। এনাদের সকলে ঘিরেই মৈত্রেয় জাতক।
"হয়তো মৈত্রেয় কোনো মানুষ নয়, হয়তো তা যুগ যুগান্তরের নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার ফলে উদ্ভূত এক মানসিকতা যা সভ্যতা-সংস্কৃতির মধ্যে যা শ্রেষ্ঠ তার সঙ্গে মানুষের আদিম অপাপবিদ্ধ সরলতার মিলন না হলে জাত হবার নয়। কিংবা হয়তো জাত হবে তখনই, ভেদ-নির্ভর এই সভ্যতা যখন শেষ সর্বনাশকে মুখোমুখি প্রত্যক্ষ করবে। মৈত্রী ছাড়া যখন আর পন্থা থাকবে না।" লেখিকার এই লেখাটুকু অনেক কথা বলে দেয় নীরবে। সারা বইতে যে মৈত্রেয় খুঁজি ফিরি সে মৈত্রেয় বই থেকে উদ্ভাসিত হয়ে আমাদের মাঝেই বিরাজ করছে। লেখিকা অদ্ভুত সুকৌশলে এই উপন্যাসের রজ্জু ধরে রথে আসীন হয়েছেন। কখনো প্রয়োজনে সেই রজ্জু শক্ত হাতে টেনে ধরেছেন কখনো বা দিয়েছেন সুনিপুণ কোমলতা। সৃষ্টি করে গিয়েছেন এমন এক উপন্যাসের যা সময় গর্ভ থেকে আলোকছটা ছড়িয়ে দিচ্ছে পাঠকদের অন্তরে।
এই বই নিয়ে যতই বলি কম হয়ে যায়। আরো অনেক অনেক বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি বলতে পারছি না। এই উপন্যাস হৃদয়ঙ্গম করে আমি এখনো মুগ্ধ। যার রেশ কাটার নয়। তাই বলে প্রকাশ করতে পারছি না। এর তাৎপর্য অনেক গভীর, এত গভীরতা থেকে পাঠকের আত্মাকে উজ্জ্বল এক দীপ শিখায় আলোকিত করে যায়।
পরিশেষে লেখিকার ভাষায় বলবো, "তিনি মিশে যান পারাপারবিহীন জীবনস্রোতে। বইতে থাকেন পাঁচ হাজার বছর পরেকার কোনও সময় বিন্দুর দিকে। বইতে থাকেন। মৈত্রেয় হবেন বলে।"
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'প্রথম আলো' শেষ করে মনে হয়েছিল বইটি কেন শেষ হয়ে গেলো! অনন্তকাল ধরে চলতে পারত কাহিনীটি। আবার একই রকম অনুভূতি হল বাণী বসুর 'মৈত্রেয় জাতক' পড়ে। কাত্যায়ন চণক মুগ্ধ করে রাখবেন দীর্ঘকাল। সেরা বইয়ের তালিকায় অনায়াসে স্থান করে নেয়ার মত এক উপাখ্যান!
শান্ত বিকেল। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। পাখিরা উড়ে গিয়ে এক বৃক্ষশাখা থেকে আরেক বৃক্ষশাখায় বসছে। কিন্তু তাদের কূজন নেই। পাখিদের মধ্যে কেমন একটা সম্ভ্রম। পাখিদের সম্ভ্রম আবার বোঝা যায় নাকি? হয়ত যায়। অনেকে হয়ত পারে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে সাধারণেরা তা বোঝে না। বুঝতে পারেন হয়ত মহৎ মানুষেরা। কোন মহৎ মানুষদের কথা বলছি? এই যে শান্ত বিকেলে এক মানবের কথা শুনতে ‘জেতবন বিহারে’ (বিম্বিসার এ জায়গাটি এখানে গৌতম বুদ্ধ ও তার সঙ্ঘের ভিক্ষুদের দান করেন) সমবেত হয়েছে মগধের কত মানুষ। ছদ্মবেশি মহারাজ বিম্বিসার, তিষ্য, চণক, বিশাখা, মহারাজ প্রসেনজিং, জিতসোমা, আম্রপালি এবং আরও নাম না জানা কত মানুষ। মুণ্ডিত মস্তক, রক্ত-কাষায় পরিহিত শ্রমণ গৌতম ‘দেশনা’ (ধর্ম-কথা আলোচনা) করছেন। তার একপাশে আনন্দ। সামনের মানুষগুলো চিত্রার্পিতের ন্যায় বুদ্ধের বানী শুনছেন। কি? দেখতে পারছেন না আপনারা? পাবেন কি করে, এ যে শত বৎসর পূর্বের কথা। আজ তারা নেই। তবু আছেন। এখনও তারা বেঁচে আছেন মানুষের স্মৃতিতে। কখনো ঔপন্যাসিকের লেখায়।
সামান্য এক গোষ্ঠী-নেতার পুত্র থেকে মগধাধীপ হয়েছেন বিম্বিসার। তার আসল নাম সেনিয়। মুখশ্রী সুন্দর বলে সুযোগ পেলেই দর্পণে নিজের মুখ দেখতেন বলে তার আচার্য তাকে বিম্বিসার নাম দিয়েছিলেন। মুখে মুখে সেই নামটিই রয়ে গেল। অঙ্গরাজ্য জয় করে মগধে সুশাসন চালিয়ে যাচ্ছেন বিম্বিসার। বৃষস্কন্ধ-সিংহকটি এই পুরুষটি যেমন বীর, তেমনি কূটনীতিজ্ঞ। চক্রবর্তী রাজা হওয়ার মত সব গুণ রয়েছে তার। আর মগধ হতে পারে সেই চক্রবর্তী ক্ষেত্র। কাত্যায়ন দৈবরাত তার শিষ্য সেনিয়কে আশীর্বাদ করে গিয়েছিলেন। সেই আশির্বাণী সত্য করতে এগিয়ে চলেছেন কাত্যায়ন চণক। আচার্য দৈবরাতের পুত্র।
সাকেতের সেরা ধনী শ্রেষ্ঠী ধনঞ্জয়। পিতা মেন্ডক হলেন ভদ্দিয়ের সেরা ধনী। মহারাজ প্রসেঞ্জিত তাই ধনঞ্জয়কে নিয়ে এসেছেন তার রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্য এবং তা হচ্ছেও। ধনঞ্জয়ের পত্নী দেবী সুমনা, বিদ্যা বুদ্ধি আর শারীরিক বলের দিক দিয়ে যে কোন পুরুষের সমতুল্য তিনি। মহারাজ বিম্বিসারের সতীর্থও বটে। তার বুদ্ধির জন্য মাঝে মাঝেই ডাক পড়ে রাজভবনে। ধনঞ্জয়-সুমনার একমাত্র পুত্রী বিশাখা;পঞ্চকল্যাণী।
রাজা উগ্রসেনের পুত্র তিষ্যর প্রণয় প্রত্যাখ্যান করে, কুমার কুনিয়র সাথে বিবাহ এড়াতে বিশাখা তার বাবা-মার সাথে পরামর্শ করে শ্রাবস্তির মিগার শ্রেষ্ঠীর পুত্রকে বিবাহ করতে সম্মত হয়। কন্যাকে পুত্রের মত করে বড় করেছেন সুমনা-ধনঞ্জয়। রূপ, গুণ, বিদ্যা-বুদ্ধিতে তার সমকক্ষ বা উপযুক্ত পাত্র মেলা ভার। মিগার-পুত্র পুণ্যবর্ধন ভোগী, কামুক নীচ। মনের মিলনের জন্য আকাঙ্ক্ষী বিশাখার জীবনে প্রেম-সুখ আসে না। সে বুদ্ধের শরণ নেয়। আর বিশাখার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাজগৃহ ছেড়ে পথে বেড়িয়ে যায় তিষ্য।
কাত্যায়ন চণকের উপরে ছিল দূতিয়ালির দায়িত্ব। কিন্তু তার মনে মনে আরও কিছু ছিল। তক্ষশীলা-স্নাতক এই গান্ধার যুবকের মনে তার পিতার স্বপ্ন পূরণের সাধ। সাথে সাথে তিনি লিখছেন রাজশাস্ত্র। দৈবরাত স্বপ্ন দেখেছিলেন এক চক্রবর্তী রাজার। যার ছত্রতলে এক হবে ভারতভূমি। সেই আশা নিয়ে বিম্বিসারের কাছে এসেছেন চণক।
অদ্ভুত মানুষ এই বিম্বিসার। সামান্য গোত্রপতির পুত্র থেকে মগধের মহারাজ হয়েছেন। জয় করেছেন অঙ্গ। বৈবাহিক সম্পর্ক করেছেন প্রসেনজিতের সঙ্গে। লিচ্ছবিদের কন্যাকে ঘরে এনেছেন। এই বীর কূটনীতিজ্ঞ মানুষটি নাকি এক নগরশোভিনীর প্রণয় আহ্বানে সাড়া দিয়ে শত্রুরাজ্যে ঢুকেছিলেন একা। গবাক্ষ থেকে গৌতমকে দেখে প্রধান সেনাপতির পদ দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এক নিমেষে। বিম্বিসার যতটা না একজন শৃঙ্খলিত রাজা, তার চেয়ে বেশি তিনি একজন মানুষ।
শাক্যসিংহ গৌতম হতে পারতেন রাজা। গৃহসুখ, রাজ্যলোভ ছেড়ে তিনি হয়ে গেলেন সন্ন্যাসী। নিজেকে তিনি এখন বলেন বুদ্ধ। এক উজ্জ্বল প্রভা ঘিরে রাখে তাকে সব সময়। কাছে যেতেই সাধারণ মানুষেরা সেই প্রভায় স্নান করে। তথাগতর মুখ নিঃসৃত বানী শুনে বহু মানুষ মুহূর্তে বিস্মৃত হয়েছে নিজেকে,নিজের দুঃখকে। গৌতম মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন এক নতুন ধর্ম, এক নতুন জীবন।
আমরা এমন এক সময়ের কথা বলছি যেখানে ইন্টারনেট তো দূরের কথা, রেডিও পর্যন্ত ছিল না। ছিল না ডাক ব্যবস্থা। মানুষ ছিল কূপমণ্ডূক। নিজের আশেপাশে কি ঘটছে তার বাইরে তারা কিছুই জানতেন না। রাজনীতিতে ছিল না সাধারণের কোন অংশগ্রহণ। ‘রাজা একজন আছেন, তিনি থাকেন রাজগৃহে। আর তিনি দেবতা’—এই ভাব ছিল মানুষের মনে। ধর্ম আর ধর্ম-প্রচারক যেখানে সব কিছুর ঊর্ধ্বে। এমন এক সময়ে এক গান্ধার যুবক স্বপ্ন দেখেছিলেন এক রাজসঙ্ঘের। এক রাজার অধীনে একটি সঙ্ঘ গঠিত হবে। প্রত্যেকের থাকবে নিজ সেনাবাহিনী। বহিঃশত্রুর আক্রমণ মানে সবার উপরে আক্রমণ। সবাই মিলে প্রতিহত করা হবে তা।
ইতিহাস আশ্রিত বেশিরভাগ বইই দেখা যায় সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ। হয় একটি প্রেম কাহিনী, কিংবা একটি চরিত্রকে উপজীব্য করে একটা গল্প ফাঁদেন লেখক। সাথে হয়ত থাকে ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি। বাণী বসু ‘মৈত্রেয় জাতক’ বইটিতে নিয়ে এসেছেন কিছু ঐতিহাসিক মানুষকে। তাদের মন উপস্থাপন করেছেন। দেখিয়েছেন তাদের মানুষী চেহারা। দেখিয়েছেন পূর্ববর্তী এক সময়ের সমাজ-বাস্তবতা। পুরুষের কামুকতা,নারীর অসহায়তা। গণিকার ঋদ্ধি, রাজকুমারের দুর্বলতা। কিন্তু ‘মৈত্রেয় জাতক’-এর মূল হল রাজনীতি। এখানে এমকজনকে খোঁজা হয়েছে, যিনি মৈত্রীর মা��্যমে গড়ে তুলবেন এক বিশাল জনপদ। আর্য্য অনার্য্য বিভেদ থাকবে না। দাস থাকবে না। নারী-পুরুষ হবে সমান মর্যাদার অধিকারী। চণক আর জিতসোমার চিন্তার মাঝ দিয়ে উঠে এসেছে অনেক রাজনৈতিক সত্য। অনেক ভবিষ্যদ্বাণী। অজান্তে চণক হয়ত ‘ভারতবর্ষ’ কল্পনা করে গেছেন।
গৌতম বুদ্ধ এই উপন্যাসের একটি মূলচরিত্র। বারবার আমরা তার কাছে ফিরে যাই। এই মানুষটি যেন সবকিছু থেকে বিযুক্ত হয়েও সব কিছুর সাথে যুক্ত। তিনি শ্রমণ, কিন্তু কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে বলেন না। বুদ্ধ কাউকে শরীর নিপাত করে ধর্ম পালন করতে বলেন না। আর মানুষ তার কাছে এসে, কথা শুনে অভিভূত হয়ে পড়ে। গ্রহণ করে প্রবজ্জা। আর তাতেই তার অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তিনি যাগযজ্ঞ করতে নিষেধ করেন। ক্ষেপে ওঠে ব্রাহ্মণরা। কিন্তু তারা তথাগতর সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে নিজেরাই সঙ্ঘে আশ্রয় নেয়। বুদ্ধকে পরাস্ত করতে গিয়ে নিজেরাই পরাস্ত হয়। কি কারন এসবের? কেন গৌতমের সামনে সবাই এমন হয়ে যায়? তিনি নিশ্চয়ই জাদুবিদ্যা জানেন।
উপন্যাসে একদিকে গৌতমের দেবত্ব, অন্যদিকে তার মানুষী রূপ দেখানো হয়েছে। এই মানুষটির বুদ্ধি, মনন, মেধা, ধৈর্য, স্থৈর্য, কূটনীতি ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে। প্রবল ধীশক্তি সম্পন্ন মানুষটির সামনে কেউ দাঁড়াতে পারতো না। যে জ্যোতি তার চারদিকে ছড়ানো ছিল, তা কোন অলৌকিক কিছু নয়, বরং তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। গৌতম ছিলেন দার্শনিক। আবার তিনি রাজনীতি বুঝতেন অনেকের চেয়ে ভালো। মানুষের মন পড়তে পারতেন। গৌতমের দৃঢ়তার সামনে একবার রুখে দাঁড়িয়েছিল চণক। তারপর একদিন চণক বুঝতে পারে, যে চক্রবর্তী রাজার খোঁজ করছিলেন, সে আসলে গৌতম।
মহারাজ বিম্বিসার একসময় বন্দী হন পুত্র অজাতশত্রুর হাতে। চণক তখন নির্বাসিত। বন্ধু বিম্বিসারের কাছ থেকে নির্বাসন দণ্ড পেয়ে হারিয়ে যান চণক। ফেলে যান তার অর্ধসমাপ্ত রাজশাস্ত্র। জীবনে সফল কিন্তু নিজের কাছে তখন পরাজিত বিশাখা। জিতসোমা তখনও তার রাজশাস্ত্র লিখে চলেছে। তিষ্য তখন সাড়া জম্বুদ্বীপ ঘুরে মগধের পরিকল্পনা জানিয়ে এসেছে। কিন্তু পারলেন না বিম্বিসার। কেননা তিনি শুধু রাজা নন। অমাত্যদের বিশ্বাসঘাতকতা আর পুত্রের লোভের হাতে রাজ্য সমর্পণ করলেন। পুত্র পিতাকে হত্যা করল অনাহারে। জম্বুদ্বীপ এক ছত্রতলে এলো না। দেহ রাখলেন তথাগত। আনন্দকে বলে গেলেন, তার মৃত্যুর পাঁচ হাজার বছর পর আসবেন একজন। তিনিই হবেন মৈত্রেয়।
চণক মিশে গেছেন বন্যদের সঙ্গে। ভূমি কর্ষণ করে ফসল ফলাচ্ছেন। তাকে সন্তান দিয়েছে এক বন্য নারী। চণকের স্মৃতি হারিয়ে গিয়েছে। তবু হঠাৎ মনে হয়, কিছু করা বাকি। মনে করতে পারেন না। তিনি জানেন না, তার স্বপ্ন পূরণ হওয়া বাকি। তার মৈত্রেয়-জন্ম বাকি।
বাণী বসুর এ বই মূলত ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এক বিশেষ সংযোজন। একটা সময়, সেই সময়ের জনপদ ও মানুষকে তিনি এতো স্পষ্ট করে উপস্থাপন করেছেন যা বাংলা সাহিত্যে মোটামুটি দুর্লভ। পাশাপাশি বইটির ভাষা, বর্ণনা ভঙ্গি, প্রতিটি চরিত্রের বিস্তার এ বইকে পরিপূর্ণ করে তুলেছে।
বাণী বসুর মৈত্রেয় জাতক বুদ্ধের সময়কালীন একটি ইতিহাস ও দার্শনিক উপন্যাস, যেখানে গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা এবং জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলির প্রতি গভীর অনুসন্ধান প্রদর্শিত হয়েছে। বইটির মাধ্যমে লেখক মানবিক সম্পর্ক, নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করেছেন। বুদ্ধ, রাজা বিম্বিসার, চনক এবং বিশাখাসহ নানা চরিত্রের মধ্যে রয়েছে সমাজ, রাজনীতি ও ধর্মের মেলবন্ধন। লেখকের ভাষাশৈলী এবং গভীর চিন্তা পাঠককে বাস্তবতার প্রতি একটি নতুন দৃষ্টিকোণ প্রদান করে।এটি একটি বিশেষ পাঠ, যা ধৈর্য এবং মননশীলতা দাবি করে।
‘মৈত্রেয় জাতক’ উপন্যাস। প্রেক্ষাপট গৌতম বুদ্ধের সময়ের ভারতভূমি। উপন্যাসে উপস্থিত গৌতম বুদ্ধ এবং তাঁর শিষ্যরা। আছেন রাজা-মহারাজা, রাণীরা, আটবিক জাতি; আম্রপালী এবং অন্যান্য নগরশোভিনী বা গণিকারা, নৃত্য-গীতি যাঁদের বিদ্যার অত্যন্ত ক্ষুদ্র অংশমাত্র। অমন জীবিকা তাঁদের গ্রহণ করতে হয় নিরুপায় হয়ে। আছেন চনক, তিষ্য, বিশাখা, সুমনা, জিতসোমা, আরো আছে সমাজের সব স্তরের নরনারী। পড়ার সময়ে বহুবার ঐতিহাসিক উপন্যাসটিকে ইতিহাস বলে ভুল হয়। পড়াশেষে কাহিনির সমস্তটাকেই বাস্তব বলে ভ্রম হচ্ছে। জেনেশুনে কল্পিত গল্পকে সত্য ভাবলে কি তাকে ভ্রম বলা যায়? ঘোর লাগানো মায়ার মতো উপন্যাসটির বিস্তার। রাজনীতি-কূটনীতি-কাহিনি-বর্ণনা সব ছাপিয়ে ভাগ্যের কাছে বিপন্ন চরিত্রদের কথা বারবার মনে পড়ে, পড়বে দীর্ঘদিন। প্রাচীন সময়ের এই নর-নারীর পাওয়া, না-পাওয়া, আকাঙ্ক্ষা, অতৃপ্তি কত মর্মান্তিক! কত আগলে রাখা নিভৃত বাসনা, আর্তি, অপেক্ষা তাঁদের। জন্ম-জন্মান্তরে যার শেষ নেই। আকুতির মতো, হাহাকারের মতো তাঁদের যাপন। তবু কোথাও সামান্য স্থিতি, প্রশান্তি, সুখের দেখা পাওয়ায় আবারো ফিরে আসার ইচ্ছে। কাল-সমাজ-মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তনের পরও কি যুগ-যুগান্তরে মানবহৃদয় একই থাকে? ‘কী প্রবল আত্মপ্রত্যয় নিয়ে একেকটি অমূল্য জীবন আরম্ভ হয়...তারপর একদিন যখন ফেরবার পথ থকে না তখন উপলব্ধি হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি। কিছুই পারিনি।’ স্তব্ধ করে দেওয়া বই।
মাঝে মাঝে আমরা এমন সব বইয়ের মুখোমুখি হই যেগুলো নাড়া দেয় একদম আমাদের অস্তিত্বে , জাগিয়ে তোলে আমাদের ভেতরের শূন্যতাকে , হাহাকারকে । আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় মহাকালের ঠিক মুখোমুখি । প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, কেন এই জীবন ? কি তার উদ্দেশ্য ? কিসে তার সুখ , দুঃখই বা কিসে ? জটিল এই সংসারের আবর্তই কি সব দুঃখের মূল ? শান্তি কি তবে সন্ন্যাসে ? অরণ্যের বৃক্ষরাজিতে ? প্রকৃতির অন্তরঙ্গ সান্নিধ্যে ? বৈদিক দর্শন , বুদ্ধ দর্শন , আরও নানা মত-পথের দর্শন ও তত্ত্বের সাহায্যে আমরা যেন এইসব জিজ্ঞাসার মূল উপড়ে ফেলতে চাই । চলে যাই আড়াই হাজার বছর আগের অন্য এক ভারতবর্ষে । বিস্মৃত সব নগরের পথেঘাটে পদচারণা করি । রাজসভা থেকে চণ্ডালের গৃহ , বণিকের প্রাসাদ থেকে নটীর প্রমোদ ভবন- সর্বত্রই আমরা খুঁজে ফিরি যেন জীবনকেই । লক্ষ্য করি যুগের পরিবর্তন , সাথে পরিবর্তন মানুষের চিন্তা-চেতনায় , দৃষ্টিভঙ্গিতে । আর সকল কিছুর কেন্দ্রে পাই গৌতম বুদ্ধের অলৌকিক উপস্থিতি । শাক্য-কোলিয় বিবাদ, কোশল-মগধ যুদ্ধ আবার এর মাঝে বুদ্ধের নির্বাণ তত্ত্ব ,এইসবের মধ্যেই যেন খুঁজে পাই সংঘাত ও মৈত্রীর সূত্র । ভাষা-ভঙ্গিতে অভিনবতা আর ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে দর্শন-এই সবকিছুর জন্যই বইটি পুরোপুরি অনন্য । সম্পূর্ণই যেন আটকে গিয়েছিলাম জীবনের জটিল ধাঁধায় । সহস্র বছরের সাধনাতেও যে ধাঁধার রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে মনুষ্য জাতির কাছে আজও ।
A supremely well-written and well-researched historical novel set in the times of Gautam Buddha and king Bimbisara. Every character, major and minor, are well etched and with a proper arc. Women and their struggles are vividly portrayed. The religion and politics of the time are well covered and most of the philosophy is timeless. Feeling very enriched to know more about this period of Indian history. Thanks very very much to the writer.
মৈত্রেয় জাতক । বাণী বসু । আনন্দ । ২০২০র ৮৫তম বই হারিয়ে যাওয়া একরাশ শুন্যতা এসে গ্রাস করেছে আমাকে। নিপুণ মুগ্ধতা আর অপার বিস্ময়ে শেষ করলাম এই বই। শেষ না শুরু? নাকি আজীবন চলমান সত্যের সমাহারে জড়ানো সহস্রাব্দ আগের ভারতবর্ষ পরিক্রমা করে এলাম, বলা মুশকিল। বুদ্ধদেব ও তাঁর সমসাময়িক প্রায় প্রতিটি চরিত্র যাঁদের উল্লেখ পাওয়া যায় ধম্মপদ, অভিনিস্ক্রমনসুত্র, লালিতবিস্তার, মহাবত্তু, বুদ্ধচরিত্র, নিদানকথা, মহাপরিনিস্ক্রমনসুত্র – এসব আকর গ্রন্থগুলিতে, তাঁদের সবাইকেই সুসজ্জিত করেছেন লেখক, তাঁর কল্পনাপ্রসুত চরিত্রদের পাশাপাশি। ইতিহাসের অদৃশ্য প্রবাহ ও সভ্যতার অবিরত ধারা প্রতি পৃষ্ঠায় অপার মায়ার সাথে এসে ধরা দিয়েছে অলীক সাহিত্যভাষ্যে। বেশিরভাগ চরিত্রর নিয়তি-ই বিয়োগান্তক ও চরম কষ্টের মধ্যে চিত্রিত হয়েছে, যেন বিন্দু বিন্দু জলরাশি এসে মিশে যাচ্ছে – করুণাসাগরে। কিন্তু তারমধ্যেও কোথাও যেন এক অদৃশ্য শক্তি ক্ষণে ক্ষণে উজ্জিবিত করে তোলে অধ্যায়ের পর অধ্যায়ের সুবিস্তৃত বাঙময় রচনাকে। বুকজোড়া ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা বাণী বসু ও আনন্দ পাবলিশার-এর প্রতি। ধন্যবাদ রইল বইদেশিক-এর কাছে, বইটি প্রতিকুল পরিস্থিতির মধ্যে সরবরাহ করবার জন্যে।
আমরা ভাবতে ভালোবাসি আমরা স্বাধীন চিন্তা করছি, মুক্ত চিন্তা করছি। কিন্তু আমাদের এই চিন্তা কী আসলেই স্বাধীন, আসলেই মুক্ত? যে আমি আজকে বসে সব মানুষের সমান অধিকারের কথা ভাবছি, সেই আমিই কী দুই হাজার বছর আগে জন্মালে, বর্ণপ্রথার সুবিধাভোগী কোনো পরিবারে কিংবা নিম্নবর্ণের হয়ে বর্ণপ্রথার ঐহিক আর পারলৌকিক জাস্টিফিকেশন শুনতে শুনতে বড় হলে কী এইসব ভাবনা মাথায় আনতাম? আমাদের মধ্যে তেমন কেউ কি আনতেন? খুব সম্ভব না। আমি আজকে বসে হয়ত মধ্যযুগের মানুষদের গালাগালি করতে পারবো অসভ্য, অমানবিক বলে। কিংবা তাদের গালাগালি না করলেও একটা অবজ্ঞা করব, হয়ত অজ্ঞ বলে করুণা অনুভব করব। আবার আমার সময় যখন মধ্যযুগ হয়ে যাবে, যদি মানুষের পারমাণবিক কিংবা কে জানে, আরো ভয়াবহ কোনো অস্ত্রের হাত থেকে যদি তখনও মানুষ আর পৃথিবী বেঁচে থাকে, সেই সময়ের মানুষেরা হয়ত আমার চিন্তাভাবনাকে মধ্যযুগীয় বলে গালাগাল করবে। আমাদের চিন্তাভাবনার জগতটা সময় দিয়ে কিংবা পরিবেশ দিয়ে যতটা প্রভাবিত আর কিছু দিয়ে কী অতটা হয়? মানুষ তার সময়ের, পরিবেশের সন্তান। স্থান-কাল নির্ধারণ করে দেয় একটা লোক কী ভাববে, কীভাবে ভাববে। দুই একজন মহাপুরুষ হয়ত একদম বৈপ্লবিক কিছু ভাবতে শুরু করতে পারেন, কিন্তু তারাও কী স্থান-কালকে অতিক্রম করে যেতে পারেন? এইরকম কিছু অগ্রগামী লোকের গল্প বাণী বসুর "মৈত্রেয় জাতক"। দুদিন আগে শেষ করলাম বইটা। বেশ সময় নিয়ে পড়েছি। গল্পটা না বলেও গল্পটা বলার চেষ্টা করছি সামনে, ঠিকঠাক বলতে না পারলে স্পয়লার চলে আসলেও আসতে পারে :/
গল্পের শুরু আচার্য চণকের রাজদূত হয়ে গান্ধার (বর্তমান কান্দাহার) থেকে মগধে (বর্তমান বিহার ও বাংলার কিছু অংশ নিয়ে ছিল) রাজা বিম্বিসারের কাছে আসায়। আসতে আসতে তিনি জনপদে জনপদে ঘুরেছেন, বনবাসী অনার্য মানুষের সাথে থেকেছেন, যাদের আর্য সভ্যতা রাক্ষস বলেছে, যাদের পরিচয় দিয়েছে কালো গায়ের রং, মাথায় শিংধারী হিসেবে। তাদের সাথে থেকে, জনপদ থেকে জনপদে ঘুরে তিনি বুঝতে পেরেছেন, আসলে এইসব মানুষ আলাদা নয়। তার ভয় জম্বুদ্বীপ (ভারতের প্রাচীন নাম) শীঘ্রই আক্রমণ করবে বাইরের শক্তি। এই আক্রমণ থেকে জম্বুদ্বীপকে বাঁচাতে হলে জম্বুদ্বীপের ঐক্য চাই। কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে বিভক্ত জম্বুদ্বীপ একত্রিত হবে কীভাবে? এইজন্য চাই একজন চক্রবর্তী রাজা, যিনি পুরো জম্বুদ্বীপকে এক সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসবেন, রক্ষা করবেন বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে, গড়ে তুলবেন পুরো জম্বুদ্বীপকে। পিতা আচার্য দেবরাতের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সেই রাজার খোঁজ তিনি করেন মগধের রাজা বিম্বিসারের মধ্যে, দেখতে পান মগধ সত্যি সত্যিই চক্রবর্তী রাজার রাজধানী হওয়ার মত ভৌগোলিক অবস্থানে আছেন। কিন্তু তার চেষ্টা কী সফল হবে? তাতে যে বিম্বিসারের সমর্থন দরকার, বিম্বিসার কী দেবে সেই সমর্থন?
বিম্বিসার তখন বুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আর বুদ্ধ প্রচার করে যাচ্ছেন অহিংসার বাণী। যুদ্ধ করে কী লাভ? তার চেয়ে শান্তিই তো অনেক ভালো। তিনি প্রচার করছেন এমন পথ, যাকে তিনি বলছেন মধ্যপন্থা, আর অহিংসার বাণী। তুমি আমাকে মেরেছ, আচ্ছা, কিন্তু আমি তোমাকে মারলেই কি সমস্যার সমাধান হবে? তার চেয়ে মৈত্রীর পথে আসো চলি দুজনে, এমন বাণী প্রচার করেছেন। অহিংসার প্রচারক এই লোকটার প্রতি অনেক আগে থেকেই কী যেন একটা আকর্ষণ কাজ করে আমার মাঝে। ট্রেডিশনাল ধর্মগুলোর মূল হচ্ছে অতিপ্রাকৃত সত্ত্বায় বিশ্বাস, কিন্তু এই লোক কি না আড়াই হাজার বছর আগে ধর্ম প্রচার করে গেছেন, কিন্তু স্রষ্টা নিয়ে প্রশ্ন পেলেই বলেছেন, আমার এই পৃথিবীতে ভালো থাকা না থাকার উপর কি স্রষ্টা আছে নাকি নাই এর কোনো প্রভাব থাকবে? যদি না থাকে, তাহলে দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে স্রষ্টার কথা জিজ্ঞেস করা কী অপ্রাসঙ্গিক না? বরং তিনি বলেছেন, আমার কথা ভুল হলে তা বাদ দেবে, যদি নিজের চিন্তায় যা ঠিক মনে হয় তাই করবে। এইসব বলে যাওয়া মানুষটার জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি কী জানেন? এই লোকটাই মৃত্যুর পরে আরেকজন দেবতা হয়ে গেলেন, লোকেরা তাঁকে পুজো দিতে শুরু করল। অনেকের কী করা উচিত আর কী অনুচিত, তার মাপকাঠি হয়ে গেলেন বুদ্ধ, যদিও তিনি নিজে বলেছিলেন অন্যরকম করতে।
কিন্তু ট্রাজেডি কি এখানেই শেষ? বুদ্ধ যখন সন্তান, প্রেমিক কিংবা পিতাকে তার সংঘে নিচ্ছেন, তখন তার মা কিংবা প্রণয়ীর মধ্যে কী হচ্ছিল তা কী তিনি ভেবেছেন? নন্দকে বিয়ের কিছুক্ষণ আগে সংঘে নেয়ার তার বাল্যপ্রণয়ী যে শোকে জীবন দিলেন, একে কি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন? নাকি তিনি ভেবেছেন এইভাবেই নারীরা পুরুষদের অহর্ত্ত্ব থেকে দূরে রেখেছে চিরদিন, এই চক্র ভাঙা দরকার? পায়ের নিচের পিঁপড়া তাঁর কাছে যে সম্মান পেয়েছে, সেই সম্মান কি নারী পেয়েছে? যে লোক চন্ডাল আর ব্রাহ্মণকে এক করতে পেরেছেন, সেই লোক যখন নারীদের সংঘে জায়গা দিতে ইতস্তত করেন, কিংবা পরে অনেকের অনুরোধে জায়গা দেয়ার পরে বলেন এতে সংঘের আয়ু পাঁচশ বছর কমে গেল, তখন এটাকেও কি একটা ট্রাজেডি বলবো না? এত কিছু করার পরেও লোকটা সময়কে পেছনে ফেলতে পারল না, এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি কী হতে পারে?
সেই জায়গায় চণক প্রশ্ন করেছেন এই বুদ্ধের মতবাদকে। ব্যক্তিগত এইসব শান্তি পাওয়ার চেষ্টা যে আসলে জন্মভূমির প্রতি দায়িত্বকে হেলা করা, নিজের অপারগতার প্রকাশ সেইসব মত দিয়েছেন। যুক্তি দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করেছেন বুদ্ধকে, নিয়ে আসার চেষ্টা করেছেন নতুন যুক্তি, নতুন তত্ত্ব। ভারতবাসীরা, এই সভ্যতার বাসিন্দারা এক জাতি, তাদের এক করতে চেয়েছেন তিনি। বালুতে চোখ গুঁজে দুঃখকে অস্বীকার করতে শিখে নিজে নিজে অর্হত্ত্ব নেয়ার চেয়ে দুঃখ থাকবে আবার সুঃখও থাকবে, সেই সুখের জন্য দুঃখকে বরণ করে রাজি থেকে এমন এক পৃথিবী তৈরি করতে চেয়েছেন, যেখানে রাষ্ট্র চলবে কিছু নিয়মে, রাষ্ট্র হবে কল্যাণকা���ী, যে রাষ্ট্রের জন্য লড়াই এখনও আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। বৈদিক সব মিথকে প্রশ্ন করেছেন, প্রশ্ন করেছেন বৈদিক যাগযজ্ঞের দরকার নিয়ে। ধর্মীয় দিক থেকে এদের দরকার নেই বলে একমত হলেও শেষমেষ বলেছেন, চণক যদিও বুদ্ধের বিপরীতে কথা বলেছেন, চণকের চেয়ে ভালোভাবে বুদ্ধের অনুসরণ করতে পারা আর কে ছিল তখন? সেই হিসাবে তিনিই বুদ্ধের প্রকৃত অনুসারী, কিংবা কে জানে, তিনিই হয়তো পরবর্তী অনুসারী!
আমার কাছে প্রতিকূল সময়ে দুইজনের অগ্রগামী দুইটা চিন্তার গল্প মৈত্রেয় জাতক। এই দুই চিন্তা কখনো নিজেদের মাঝে লড়াই করে, কখনো তারা একসাথে কারো মাঝে আসে, আবার নতুন পথ খোঁজে। দুই চিন্তার জন্ম আর বেড়ে উঠা যাদের সাথে, তাদের গল্প মৈত্রেয় জাতক। তাই গল্পে অনেক বড় সময় নিয়ে অনেকে আসলেও তাদের গল্প আলাদা হয়নি আমার কাছে, তারা আলাদা হয়নি আমার কাছে। এই দুই চিন্তাই আলাদাভাবে ভালো চেয়েছে সমাজের, কিন্তু লড়াই করে গেছে যুগের সেরা কিছু মানুষের শক্তি সাথে নিয়ে। কিন্তু শেষমেষ হয়ত সময়ের কাছেই, কিন্তু নিজেরা নিজেদের কাছে হেরে গেছে তারা। চাণক্য চিন্তার মানুষজন তাই শেষমেষ হয়ত সব স্বপ্ন ছেড়েছুড়ে নিজেরা সুখী হতে চেয়েছেন ব্যক্তিগত জীবনে। কিন্তু সেই সুখের সন্ধানই কি বুদ্ধ দিতে চেয়েছিলেন না? কিংবা সংঘ যখন রাজনীতিতে পড়ে ধ্বংস হয়, তখন কি শাক্যপুত্রীয় সংঘের একজন চণকের দরকার ছিল না? কী জানি, কে জানে।
একদম শেষ প্যারায় কিছু একটা আছে। সেটা আর না লিখি, সব লিখে দিলে নিজে পড়বেন কী?
এই বইয়ের রিভিউ লেখা আমার মত পাঠকের জন্য বেশ কঠিন। মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু একাধারে কষ্ট ও লেগেছে, যে সবকিছুই এত কঠিন কেন এই জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত, আর এত অসহায় কেন আমরা। বুদ্ধ নিজেও স্ট্রাগল করেছেন নিজের সত্য প্রচারের জন্য। একমাত্র এবং অন্যতম সত্য হচ্ছে সাফারিং আর নিত্য পরিবর্তন। বুদ্ধের জীবনের চেয়ে সেই সময়ের সমাজ মানুষের চিন্তা ভাবনা বেশি ফুটে ওঠেছে, বেসিক জিনিসপত্র সব আগের মতই আছে এখনো।
বইটা পড়েছি অনেকদিন সময় নিয়ে। ভেঙে ভেঙে একটু একটু করে। মাঝারি পরিসরের বই, ইতিহাস আশ্রিত গল্পগুলোর প্রতি টানের কারণে অনেক দ্রুতই পড়ে ওঠা যেতো। তবে গেলো যে না, তার পেছনে বইয়ের তুলনামূলকভাবে অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহারের চেয়ে বেশি দায়ী ব্যক্তিগত ব্যস্ততা। আমার বরং এই অপ্রচলিত শব্দগুলো ভালোই লাগে, চমৎকার একটা গেসিং গেম। বই শেষ করে দেখি শেষে টীকা করে অর্থগুলো দেয়া আছে!
গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে আমি ছোটোবেলা থেকেই ফ্যাসিনেটেড, তবে খুব এক্সটেনসিভ পড়াশোনা করা হয়নি। কাজেই, তাঁর দর্শনের কতটা এই বইয়ে প্রতিফলিত হয়েছে সে ব্যাপারে মন্তব্য করা যাচ্ছে না। কিন্তু সামাজিক একটা উপন্যাস হিসেবে যদি বলতে হয়, বেশ ভালোভাবেই তুলে আনা হয়েছে এখানে। শুরুতে তো সাবপ্লটগুলোকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে মূল চরিত্র বুঝে উঠতেই বেশ সময় লেগে যায়। যতক্ষণে বুঝে ওঠা যায় ততক্ষণে দেখা যায় গল্পের বেশ ভেতরে ঢুকে যাওয়া গেছে।
প্রত্যেক পাতায় পাতায় চমৎকৃত হয়েছি। কেননা পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর সমন্বয়ে তৈরি হওয়া এই গল্পে ইতিহাস ও পুরাণের সাথে কল্পনা মেলাতে হয়েছে বেশ সাবধানে। একটু এদিক ওদিক হলে গল্প বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে সত্য থেকে। অবশ্য পরম সত্য বলেই বা কী আছে? মুগ্ধ হয়েছি তিষ্য চরিত্রে- লেখিকা তাকে বিশাখা বা চাণক্য বা বিম্বিসারের মতো অতো যত্ন নিয়ে আঁকেননি, তবু কোথায় যেন এই যুবক মন ছুঁয়ে যায়। সময়ে সময়ে তথাগত বুদ্ধকেও যেভাবে সংকটজনক দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়ে পাঠকের মনে দ্বিধার সৃষ্টি করেছেন, সে জন্যেও প্রশংসা প্রাপ্য তাঁর।
তবু শেষটায় কেমন যেন অপূর্ণতা অনুভব করলাম। মনে হলো যেন কিছুটা তাড়াহুড়ো। যেভাবে বিস্তার হয়েছিলো গল্পের জাল, তাতে আরেকটু সময় নিয়ে শেষ করলে হয়তো আরো ভালো লাগতো। এক তারা কেটে রাখলাম তাই।
প্রত্যেকটা মানুষ এর চিন্তাধারা ভিন্ন হতে পারে,উদ্দেশ্য ভিন্ন হতে পারে,ভিন্ন হতে পারে সব কিছুই--কিন্তু শুধু মাত্র একটা স্ট্রিং এ সবাই এক। সেটা হচ্ছে--দিন শেষে লাইফ হচ্ছে উদ্দেশ্য পূর্ণ না করতে পারার হাহাকার।
উপন্যাসের কোন কাহিনীই অজানা না--এক্স কঠিন ধার্মিক হিসেবে সব কাহিনীই জানা---নতুন কিছু নেই। কিন্তু অই যে --হাহাকারের সূত্রে সবাইকে বেঁধে ফেলা--এটাই লেখিকার নতুনত্ব।
চণক, জিতসোমা,বিশাখা,বিম্বিসার,বুদ্ধ শেষ পর্যন্ত জীবনের এই ট্র্যাজেডিতেই এক স্ট্রিংয়ের অধিবাসী হয়ে যান। নির্বানের মানে তাই বোধহয় অনন্ত কুহেলিকা।
সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই পঙতিটি দিয়েই শুরু হয় বাণী বসুর ‘মৈত্রেয় জাতক’। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন সময়-ঘড়ি পিছিয়ে যায় সহস্রাধিক বছর—যখন কোনও বিদেশী জাতি সাম্রাজ্যবিস্তারের আশায় এই দেশের মাটিতে পা রাখেনি, যখন পাহাড়-জঙ্গল চিরে সড়কপথ চলে যায়নি, যখন মানুষ প্রযুক্তি-সর্বস্ব হয়ে বেঁচে থাকার কথা কল্পনাও করতে শেখেনি। উপন্যাস মানে আসলে তো এক নির্মাণ। চরিত্রদেরকে পরপর সাজিয়ে, ঘটনার গাঁথুনি দিয়ে গড়ে তোলা কাহিনীমালা। জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যেমন ভেসে যায় বিবিধ জলজ জীব—বিশাল সময়ের সঙ্গে তেমন ভেসে যায় বিচিত্র চরিত্ররা। বুদ্ধকালীন ভারতের পটভূমিতে রচিত এই উপন্যাসে উপস্থিত তক্ষশীলার মেধাবী ছাত্র চণক, শ্রেষ্ঠীকন্যা পঞ্চকল্যাণী বিশাখা, বিদুষী নটি জিতসোমা, নগরবধূ আম্রপালি, ধুরন্ধর রাজপুরুষ পরিবেষ্টিত সম্রাট বিম্বিসার, তথাগতর বুদ্ধত্ব নিয়ে দোলাচলে ভোগা মহারাজ প্রসেনজিত, কৌতূহল আর প্রশ্নে পরিপূর্ণ রাজকুমার তিষ্য, শিশুহন্তা বলে পরিচিত যক্ষিণী... এবং আরও বহুজন। আর আছেন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ—যার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে যেন চতুর্দিক আলোয় ভরে ওঠে, যার সত্যদর্শন আর উপদেশ মনের মধ্যে জলতরঙ্গের মতো বেজে ওঠে, জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসগুলোর প্রতিও যার তাচ্ছিল্য অনুভব করে নিজেদের লোভী প্রবৃত্তিগুলো লজ্জায় ভরে ওঠে। কিন্তু এই বিশাল উপন্যাসের নায়ক কিন্তু বুদ্ধ নন। বহু রত্নে সজ্জিত অলংকার ‘মহালতাপসাদন’-এর আসল আকর্ষণ যেমন সে নিজে, এই উপন্যাসের আসল নায়কও তেমন এর ব্যপ্ত কাহিনী। বুদ্ধ হলেন সেই অলংকারের এমন এক রত্ন—নিজগুণে এবং লেখিকার চরিত্রচিত্রণের দক্ষতায় যিনি উজ্জ্বলতম হয়ে উঠেছেন। কী নিপুণ দক্ষতায় সজীব করে তোলা হয়েছে প্রতিটা চরিত্রকে! কী প্রগাঢ় কুশলতায় একবারও দিগভ্রষ্ট না হয়ে উপন্য���সকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার অন্তিম পরিণতির দিকে! যেন বহতা নদী এগিয়ে গেছে নিজের পথ কেটে... যান্ত্রিকসভ্যতার জটিলতা না থাকলেও, মানবমনের চিরাচরিত জটিলতা; ভিন্ন ভিন্ন রাজনীতি, আধ্যাত্মিক এবং ব্যক্তিগত মূল্যবোধের সংঘাত; ক্ষমতার লোভ, প্রতিষ্ঠার মোহ আর বিচিত্র মানসিক দ্বন্দ্ব—ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে কাহিনীতে। তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসাপদ্ধতি, কুসংস্কার... কী নেই! হয়ত নেই শুধু ঔপন্যাসিকের দীনতা—দু’হাত ভরে তিনি গোটা কাহিনীতে ছড়িয়ে গেছেন সাহিত্যসুধা। যেমন ঢিমে আঁচে দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীর বানানো হয়, যেমন সূক্ষ্ম আঁচড়ে অপূর্ব সব চিত্রকলা ফুটিয়ে তোলা হয়—তেমন অতিসন্তর্পণে তিনি বুনেছেন এই নিটোল কাহিনী। অনুপম ভাষায়, যথাযোগ্য আঙ্গিকে, মেধার বৈদুর্য্যে, প্রজ্ঞার গভীরতায় এই উপন্যাস হয়ে উঠেছে অতুলনীয়। একটানে দ্রুত পড়ে তুলে রেখে দেওয়ার মতো বই এটি নয়। এই বই ধীরলয়ে আত্মস্থ করার, বারংবার হাতে তুলে নেওয়ার। এই উপন্যাস আসলে আত্মানুসন্ধানের এক দলিল। এক দীর্ঘ ভ্রমণ—হয়ত যার শেষ হবে মৈত্রেয়র আবির্ভাবের পর। বা হয়ত শেষ নেই। চলতেই থাকবে—যেমন চলছে চলিষ্ণু বসুধা, যেমন চলছে সৃষ্টি-লয়ের চক্র, যেমন চলছে বুদ্ধের অনন্ত দর্শনের ধারা—চিরায়ত, শাশ্বত।
Evocative imagining of E India at the time of the Buddha, where elites had to deal with very 'modern' problems: regional difference, the role of women, the rights of 'tribals,' a desire for peace and friendship. An opportunity to think about a very different India and very different Indians, perhaps drawn as an overly romanticized realm of freedom, but one that dares to be imagined. Social realism meets Buddhist mythology/historiography -- I'm amazed that such a book exists.
জীবনের এই অপরিপূরিত দুঃখ বোধগুলো আছে বলেই চানক্যরা বারবার আসেন। হয়তো ফিরে যান দ্বিগুন দুঃখে, তবুও প্রচেষ্টার মৃত্যু হয়না। যত অন্ধকারই আসুক, কোন এক কোনায় খনিতে লুকায়িত হীরকের মত মতবাদেরা বেঁচে থাকে এমনকি চানক্যদের আপাত পরাজয়ের পরও।
মানবের জীবনপ্রবাহকে বহমান রাখে আগণিত মানুষ। রাজা কিংবা আটবিক ( আরণ্যবাসী), বিদগ্ধ কিংবা জ্ঞানহীন, পুণ্যবান কিংবা পাপী- সবারই জীবন এই অনন্ত প্রবাহে বিন্দুর মতো মিলিয়ে যায় । মিলায় নাম, রৃপ, খ্যাতি, প্রেম, বেদনা, কলহ, দ্বন্দ্ব, দক্ষতা, শৌর্য, বীর্য, প্রচেষ্টা সমস্তকিছুই। দিনশেষে সবকিছুই ধুলি অধিকৃত। ইতিহাস ব্যক্তিবিশেষ, ঘটনাবিশেষকে কতকটা বিধৃত রাখে। কিন্তু কতটাই বা প্রাণ তার! যতিচিহ্ন দিয়ে লেখা একসারি ঐতিহাসিক নাম এক নিঃশ্বাসে পাঠ করে যেতে পারি , অথচ সেই যতিচিহ্ন ধারণ করে শত বছর, শত যুগ, শত শতাব্দীর ব্যবধান! একটা নাম ধারণ করে একটা বর্ণিল জীবন, অগণিত গল্পগাথা। শূন্যবোধের ভেতর এইসব ভাবনা মাথাচাড়া দেয় 'মৈত্রেয় জাতক' পাঠান্তে। জীবন ক্ষয়িষ্ণু, পার্থিব সমস্তকিছুই ক্ষয়িষ্ণু। গ্রন্থে চিত্রিত বুদ্ধের উক্তিতে, 'হে আনন্দ, পৃথিবীর একটি ক্ষুদ্রতম অংশেরও নাম করো যা মৃত্যুস্পৃষ্ট নয়।' এ গেল পাঠানুভূতি এবার মুগ্ধতার কথা বলি - এই ঝলকানো পৃথিবীর আলোয় বাস করা পাঠককে আড়াই হাজার বছর আগের জনপদে পরিভ্রমণ করানোর পারঙ্গমতা মুগ্ধ করেছে। ইতিহাস-ধর্ম-দর্শন-কল্পনা এবং সহস্রবছরের নারীজীবনের অবরুদ্ধ বেদনার প্রতিফলন নিপুন ভারসাম্য ধরে রেখে মিশ্রিত হয়েছে। পুরো উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে বুদ্ধের সক্রিয়তার চেয়ে তাঁর প্রভাবটাই সক্রিয়। যেন বুদ্ধ এখানে স্বয়ং সময়, বুদ্ধ একটা পরিভ্রমণ, বুদ্ধ এক জীবনবোধ। উপন্যাস জুড়ে তিনি প্রবলভাবে উপস্থিত নন, অথচ প্রত্যেকটি চরিত্রের জীবন কখনো না কখনো তাঁকে কেন্দ্রে রেখে আবর্তিত হয়েছে। এ-ও এক মায়াজাল বোধকরি। বিস্তৃত কলেবরের উপন্যাসটি একটি ঘোর তৈরি করে। আর এই ঘোরের অন্যতম প্রধান বাহন ভাষা। সময়-প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভাষার ব্যবহার বিস্মিত এবং মুগ্ধ করেছে।
গত সপ্তাহে শেষ করেছি এই উপন্যাসটি, কিন্তু তার রেশ যেন এখনও রয়ে গেছে।
কি অপূর্ব লেখনী! আজ থেকে ২৫০০ বছর আগের গৌতম বুদ্ধের সময়ের ভারতবর্ষ। ঘটনা গুলো সব যেন চোখের সামনেই ঘটে গেলো। সেই সময়কার রাজনীতি, সামাজিক অবস্থান, অর্থনীতি, ধর্মনীতি সব মিলিয়ে এক অনির্বচনীয় অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে।
এ বই শেষ করতে মন চাইছিলো না।
শেষ হওয়ার পর এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে।
"সিংহ শয়নে শুয়ে গৌতম (বুদ্ধ) বললেন - আমার যা সাধ্য তা করেছি হে আনন্দ। পাঁচ সহস্র বছর পরে সদ্ধম্মের (সধর্মের) প্রভাব যখন লুপ্ত হয়ে যাবে তখন আসবেন আরেক বুদ্ধ - মেত্তেয্য (মৈত্রেয়)। ....................... তিনি মিশে যান পারাপারহীন জীবনস্রোতে। বইতে থাকেন পাঁচ হাজার বছর পরেকার কোনও সময়বিন্দুর দিকে। বইতে থাকেন। মৈত্রেয় হবেন বলে।"
আমার খুব প্রিয় বই এর মধ্যে অন্যতম। অসাধারণ মানবিক একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। গৌতম বুদ্ধ, বিম্বিসার সহ সবাই যেন রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। বহু আগে পড়া.. আবার পড়ে হৃদয় ভারাক্রান্ত ও একই সাথে অনাবিল আনন্দও উপভোগ করলাম। এতো টাই হৃদয়স্পর্শী.. আমার শুধু একটা প্রশ্ন আছে, আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র চানক কি ঐতিহাসিক নাকি মহান চানক্যর আদলে সৃষ্টি একটা কল্প চরিত্র? বানী বসুকে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন অনবদ্য উপন্যাসের জন্য 🙏
এ কয়টা দিন যাপন করেছি আড়াই হাজার বছর আগেকার জীবন। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ বছরে ঘুরে ফিরছিলাম। ইতিহাসের সুতো জড়িয়ে বুনা এক নিপুণ নকশিকাঁথা এই বই। তৎকালীন সময়ের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সব অতি নিপুণতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মৈত্রেয় জাতকে। সহস্রাব্দ প্রাচীন শ্রাবস্তী, বৈশালী, মগধের রাজপথ আর রাজ কুটিরের অন্তঃপুরে নিয়ে গিয়েছিলেন লেখক। বাদ যায় নি বন্য যক্ষ কিংবা সাধারণ জনজীবনও। আছে মহৎ হৃদয় সম্রাট বিম্বিসার, দূরদর্শী চনক, রূপবতী আর ব্যক্তিত্বময়ী বিশাখা, রাজপুরুষ তিষ্যকুমারের কথা, আছে নৃত্যগীত পটীয়সী, চতুঃষষ্টি কলায় শিক্ষিতা জিতসোমার কথা। এই মানুষ গুলো সেই আড়াই হাজার বছর আগে সমাজে, রাজনীতিতে আর জীবনাচরণে চেয়েছিলেন প্রচলিত ধ্যান ধারনার বাইরে গিয়ে নতুনের অনুসন্ধান করতে। নব চিন্তা, নব পথ সৃষ্টি করতে। কতটুকু সফল হয়েছিলেন সেটা অন্য বিষয়, কিন্তু তারা চেষ্টাটি করেছিলেন, খুঁজেছিলেন মুক্তির পথ। আর এদের সবাইকে বৃত্তস্থ করে কেন্দ্রে রয়েছেন স্বয়ং তথাগত। গৌতম বুদ্ধ। যিনি নতুন এক ধর্মের মাধ্যমে নির্বানের পথ দেখিয়েছিলেন।
মৈত্রেয় জাতক পড়তে গিয়ে জেনেছি, ভেবেছি, প্রশ্নও সৃষ্ট ক���েছে মনে অনেক। আবার অনেক প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে পেয়েছি। বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে আলাদা একটা মুগ্ধতা ছিল, সেটা কেটে গেলেও জানার আগ্রহ আরো প্রবল হয়েছে।
এই প্রথম কোন বাংলা বই পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল আমার শব্দভাণ্ডার একেবারেই অপ্রতুল। এত বেশি অপরিচিত শব্দ! অথচ এত মাধুর্যময়! প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়তে একটু সমস্যা হলেও পরে কেমন ঘোর লেগে যায়।
বিম্বিসার, চনক, বিশাখা, তিষ্য, জিতসোমা... আর কোন একক বইয়ে এতগুলো প্রিয় চরিত্র ছিল বলে মনে করতে পারছি না!
A deep research for the rise, success and short falling of Buddha at that social and political atmosphere was needed...and this book reveals the untold secrets of that spiritual revolution which swept the whole world up its feet.
পাঁচ সহস্র বছরে পরে সদ্ধমের প্রভাব যখন লুপ্ত হয়ে যাবে তখন আসবেন আরেক বু্দ্ধ - মেত্তেয্য (মৈত্রেয়)।
"মৈত্রেয় জাতক" গৌতমবুদ্ধের সমসাময়িক সময়ের এক সুবিশাল উপন্যাস। খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ সাল। কলেবরে বহৎ উপন্যাস অনেকই আছে। কেউ নির্মাণ করেন; কেউ বিনির্মাণ। বাণী বসু তার "মৈত্রেয় জাতক" বিনির্মাণ করেছেন তার সুনিপুণ এবং অসাধারন ভাষার দক্ষতায়।
এই সুবশিাল উপন্যাসের পাঠ-অনুভুতি শব্দে ধরা বাতুলতা মাত্র। এর অজস্র পরত, জীবনের নানা অলি-গলিতে দাঁড় করিয়ে দেয়া মিরর-মেজ। সময় বা ভূখণ্ড বা ব্যক্তি উপজীব্য এই উপন্যাস, তথাপি শুধু সময় বা ভূখণ্ড দিয়ে বোঝা বা অনুভব করা মুশকিল "মৈত্রেয় জাতক"কে। যে সময়কার গল্প তার সময়উপযোগী নকশা থেকে লেখিকা যেমন সরে আসেননি, তেমনি চরিত্রের পরিণতমনস্কতাকে ঠিক রেখেই সবচেয়ে বেশি যেটায় কলম চালিয়েছেন তা হচ্ছে - শিল্পের গভীরতা।
বাণী বসুর "মৈত্রেয় জাতক" তার কাহিনিগুণে অথবা চরিত্রগুলোর বিস্তৃততায় যেমন যেকোন পাঠকে আকৃষ্ট করে রাখবেন, তেমনি যে কোন পাঠকই আরও একটি জায়গায় আটকে যাবেন - যার নাম - "ভাষার ফাঁদ"। তবে সব ফাঁদ বন্দিত্ব দেয় না, অদম্য আকর্ষণের লক্ষ্যও হয়ে ওঠে। পাঠক হিসেবে একটু বলার প্রয়োজন বোধ করছি (অথবা পাঠকালে পাঠক নিজেই সেই কোর্স অফ একশ্যান ঠিক করে নিবেন) যে, বাড়তি মনোযোগ দাবি করে এই উপন্যাস তার ভাষার এব শব্দের কারনে। তৎসম, তদ্ভব এবং সংস্কৃত শব্দের কারনে বাড়তি মনোযোগের ঘাটতি হয়তো দুর্জ্ঞেয়কে ধরা দিবে অদম্য আকর্ষণের বিপরীতে।
উপন্যাসের শেষটা ধূসর! ভরাক্রান্ত। বলতে গেলে তিষ্য, বিশাখা, রাজা বিম্বিসার, সুমনা, জিতসোমা, কাত্যায়ন চণক, এবং তথাগত নিজে - সব চরিত্রই যেন শেষটায় এসে ধূসরতায় আবৃত, কিন্তু বিষয়ান্তরে চলে যাননি কেউ। বরং পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়ে উঠবে নিজ নিজ পরিসমাপ্তির হাত ধরে। তবু সব চরিত্রের মাঝ থেকে আমার কাছে অবশ্যই "কাত্যায়ন চণক" মুগ্ধতার সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম হয়ে থাকবেন।
বাণী বসুর "মৈত্রেয় জাতক" শুধু তার কাহিনি বিন্যাস বা ভাষার শৈল্পিক রূপের জন্যেই অনবদ্য না, বরং দৃষ্টিভঙ্গির নাটকীয়তায়, গল্প বলার ভঙ্গি এবং যে কাহিনি লেখিকা বলেছেন তা পাঠকের সামনে শব্দ ও বাক্যের আরকে প্রদর্শনের জায়গাটুকুতেও হয়ে উঠেছে অনবদ্য ও স্বতন্ত্র। অক্ষরগুলো হয়ে উঠেছে পাঠকের চোখের জায়নামাযে স্পষ্ট ছবি।
বাণী বসুর "মৈত্রেয় জাতক" তাই নিঃসন্দেহে পড়া বইয়ের খুব উপরের দিকেই থাকবে। এবং পাঠকের জন্যে আবশ্যপাঠ বলতে অত্যুক্তি হবে না।
বুদ্ধ পূর্ণিমার শুভেচ্ছা। কিছু দিন ধরে একটা বেশ বড় উপন্যাস পড়ছি - " মৈত্রেয় জাতক - বাণী বসু"। গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক ভারতভূমির প্রেক্ষাপটে রচিত। কাহিনী ভৌগলিক পটভূমি মধ্যদেশ, আর এক পটভূমি চিরকালীন মানুষের চিরজটিল মনোলগ। এই সময় সাম্রাজ্যবাদী নীতির সাথে ঘটেছে মৈত্রী ভাবনার সংঘাত। কীভাবে বুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রবেশ করেছে মানুষের মধ্যে, চেতনার বিকাশ হয়েছে। নীচের লেখাটা, অর্নিবান মাইতির - সেখানে দেখি চনক আর দর্ভসেন বিম্বিসারের দরবারে গোবৎসের তুলতুলে মাংস, মধু, ক্ষীর দুগ্ধ ইত্যাদি দিয়ে জমিয়ে আহার করছেন। ওনারা কি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পেরেছিলেন ২০১৯ এ দাঁড়িয়ে উন্নততর মানুষেরা গরু, শুয়োর, হালাল এইসব নিয়ে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বিতর্কে অবতীর্ণ হবে? টাইম মেশিন পেলে ঐ সময়েই ফিরে যেতাম। বিশাখা, সুমনা, জিতসোমা, আম্রপালীদের জগতে। প্রায় চলেই গেছিলাম, হঠাৎ দেখি সেখানে পুত্রের হাতে বন্দী রাজা বিম্বিসার প্রিয়তম বন্ধু গৌতমের দিকে চেয়ে অসহায়ের মত চোখের জল ফেলে চলেছেন। আর অপর দিকে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে গৌতম বুদ্ধ বন্ধুর কারাগারের দিকে তাকিয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছেন, তিনিও আজ ততটাই অসহায় আর অপারগ। ঠিক যেমন আজকেও বিম্বিসার আর গৌতমেরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে কেঁদেই চলেছে। আমাদের কারো কিছু করার নেই। নীতি নৈতিকতাহীন অজাতশত্রুরাই এদেশের রাজনীতির নিয়ন্তা।
গতবছর জুলাইতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে এই বইটা সংগ্রহ করেছিলাম। তারপর বারবার শুরু করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম। প্রতিবারই ব্যর্থ হচ্ছিলাম। দুই তিন পাতা পড়ে আর আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে এই বইয়ের লেখার ভাষা টা একটু কঠিন লেগেছে আমার কাছে। তো শেষ পর্যন্ত নভেম্বরের শেষের দিকে আবার নতুন করে পড়া শুরু করেছিলাম। এবার ঠিক করেছিলাম যে এক দুই পাতা করে হলেও পড়াটা চালিয়ে যাবো। অবশেষে আজকে শেষ করে মনে হলো, "ইশ! আর কোনোদিন যদি শেষ না হতো! "
বইয়ের ব্যাপারে আসি এখন। পুরো বই জুড়ে বুদ্ধ আছেন আবার নেই! এরকম ধূম্রজাল সৃষ্টির জন্যে কি স্বয়ং বুদ্ধ দায়ী নাকি লেখক! একেকটা পর্ব পড়ার মাঝে মনে হয়েছে আমি যেন ঐতিহাসিক সময়ে আবদ্ধ হয়ে গেছি। প্রতিটা চরিত্রের নির্দিষ্টতা আমাকে সম্মোহনের মতো আবদ্ধ করে রেখেছে। যেন আমি চোখের সামনে পুরো ইতিহাসের সাক্ষী হচ্ছি! কখনো বিসাখার সখী রূপে, কখনো শ্রমণ রূপে, কখনো চণকের আড্ডার অংশীদার হয়ে, আবার কখনো তিষ্যর পথের সাথী হয়ে, কখনো বিসিম্বারের অমার্ত্য হয়ে ...... বিভিন্ন রূপে তাদের পদচারণা প্রত্যক্ষ করেছি।
বাণী বসুর লেখার মুন্সিয়ানার প্রশংসা করতে হয়। প্রতিটা পর্বে হুট করে দৃশ্যপট বদলে যায়! কিন্তু ট���ন টান উত্তেজনাটা ধরে রাখতে পারেন। বাণী বসুকে এই প্রথম পড়া। আশা করি, উনার বাকি বইগুলো পড়া হবে।