বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর হলে ওঠার আগে কখনো আমার পরিবারের বাইরে গিয়ে বসবাস করা হয়নি। এই কারণে, আগে এই বইটি পড়লে নিজের জীবনের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া হতো না। এখনের হলের জীবনের সাথে যে অনেক মিল পেয়েছি তা নয় কিন্তু বইটির উদ্দেশ্যও তো তা নয়।
গত এক শতকের নারী-পুরুষের, ছাত্র-চাকুরেদের মেস ও হোস্টেল জীবনের অভিজ্ঞতা, এর পাশাপাশি আরও নানা কিছু এই মলাটের মধ্যে পাওয়া যায়। অত্যন্ত সুপাঠ্য।
মেস-হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন সম্পাদনা - সুজন বন্দ্যোপাধ্যায় সুপ্রকাশ মম: ৬২০/-
বাঙালির মেস-হোস্টেল সংক্রান্ত encyclopedia বলা চলে।
মেস-জীবনের দরকার আর উৎস। কখনো লেখাপড়া, কখনো চাকরি বা কাজের সন্ধানে, কখনো নীরব-নিভৃতে থাকার ইচ্ছে, আবার কখনো সংসারহীন মানুষের কাছে মেস-কাবাড়িরাই নিজের সংসার হিসেবে ভেবে তাদের সাথেই আজীবন মেসে থেকে যাওয়া।
মেস বা হোস্টেল কত ধরণের। কোন ক্লাস, কোন সাবজেক্ট, কোন চাকরি, কোথায় চাকরি, ধর্ম, জাত-পাত শুধু নয়, আবার জেলা বা নগরভিত্তিক মেস ও আছে।
মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য প্রথম হোস্টেলের কড়া শাসন, শান্তিনিকেতনের হোস্টেল তথা আচার-নিয়ম। শুধু কলকাতা বা শহরতলীর নয়, বিভিন্ন জেলা আর বাংলাদেশের কিছু মেস-হোস্টেল বাড়িরও বিস্তারে চর্চা রয়েছে।
আবাসিকদের কথা যদি বিচার করলে দেখা যাবে, অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা এই মেসে থেকে তাদের কর্মজীবন শুরু করেছে। তার মধ্যে রয়েছেন বহু নামি লেখক, বৈজ্ঞানিক, খেলোয়াড়, বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ। সবিস্তারে আলোচনা অসম্ভব।
পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪২০, আকার-আয়তনে বেশ বড়ো। বইটি শেষ করতে আমার ১ বছর লেগেছে। এতো তথ্য আর ঘটনাবহুল বই যে ধীরে-সুস্থে পড়তে বাধ্য হয়েছি। এই বইটি পড়ে এতো তথ্য-সমৃদ্ধ হওয়াতে পড়তে পড়তে Gap আসছিলো, মেস-হোস্টেল কাহিনীগুলো পরে নিজের হোস্টেল আর কর্মসূত্রে বাইরে থাকার দিনগুলো মনে পরে যাচ্ছিলো। আবার মাঝে মধ্যে কয়েক দশক আগের মেস বাড়ির ছবি ভেসে আসছিলো, কত খ্যাতনামা ব্যাক্তিরাই মেসের সন্ধেগুলোতে আসর বসিয়েছে, সারারাত কেটেছে তাস বা আড্ডা মেরে, ঘুরে বেরিয়েছে রাতের কলকাতায়। এই মেস বাড়ি কেন্দ্র করে সাড়ে চুয়াত্তর, বসন্ত-বিলাপ মেস-হোস্টেল ভিত্তিক সিনেমা গুলোর গল্প রয়েছে বইতে। বেশির ভাগ মেসের অস্তিত্ব এখন নেই, নেই তার কোনো ভিত্তি। হয়তো সেই জায়গায় গেলেও কেউ সন্ধান দিতে পারবে না। গুটিকয়েক মেস যদিও চলছে, নগরায়নের সাথে পাল্লা দিয়ে।
আমার কাছে বরাবর সেকালের মেস নিয়ে একটা কৌতুহল ছিল, আছে। আমার কাছে এই বইটা একটা কালেক্টর্স আইটেম। আজকাল প্রকাশকরাই তাদের প্রকাশিত বইকে কালেক্টর্স আইটেম বলে বাজারে ছাড়ে, আমি না-হয় পাঠক হিসেবে এই তকমা দিলাম।
এই ধরণের বই পড়তে আমার ভীষণ ভালো লাগে। একই বিষয় নিয়ে অনেক জন লেখেন বলে এক পাতে অনেক রকম অভিজ্ঞতা, নানা রকম দৃষ্টিভঙ্গি চেখে দেখা যায়। বইতে চার ভাগে ৪৫টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। প্রত্যেকটেরই বিষয়বস্তু একটাই, মেস-হোস্টেল। এরপরেও প্রতিটি প্রবন্ধ আলাদা, রিপিটেশন যেমন নেই তেমনি প্রত্যেক প্রবন্ধের আঙ্গিকেই নতুনত্ব আছে। সম্পাদক সাহেব খুবই ভালো কাজ করেছেন, বলতেই হবে।
প্রথম্ ও দ্বিতীয়ভাগের প্রবন্ধগুলোতে লেখকেরা তাদের মেস/হোস্টেল জীবনে কাটানো সময়ের কথা স্মৃতিচারণ করেছেন; তৃতীয়ভাগে, সাহিত্যিকদের মেসে থাকার অভিজ্ঞতা এবং একই সাথে তাদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে সেই অভিজ্ঞতা তারা কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। শেষভাগে সংকলিত হয়েছে গবেষণামূলক লেখাঃ মেস-হোস্টেলের সূত্রপাত, সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় প্রভাব নিয়ে যেমন লেখা আছে তেমনি উঠে এসেছে সিনেমায় মেসবাড়ির চিত্রায়ন, মেসবাড়ির সাথে ফুটবল,বিপ্লবের সখ্যতার মত নানা আকর্ষনীয় বিষয়।
বইটি সাইজ একটু অভিনব- প্রায় বর্গাকার। তবে বাঁধাই এবং পেজের মান খুবই ভালো। আর মেখলা ভট্টাচার্যের করা প্রচ্ছদটি একদম খাপে খাপ হয়েছে।
আঠারো বা উনিশ শতকে মেস-হোস্টেলের স্বরূপ যেমন ছিল এখন তেমন নেই, পালটে গেছে অনেককিছুই। এই ধরণের বইগুলোর ভালোরকমের নৃতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে, আপাতদৃষ্টিতে ছোট ছোট এরকম বিষয়গুলোর ডকুমেন্টশন করে রাখার জন্য।