পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দার্জিলিঙের এক সম্ভাবনাময় কবি, অমিতাভ মিত্র খুন হয়েছিলেন। অভিযোগের তীর ছিল তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রহস্য-ঔপন্যাসিক অরুণ চৌধুরীর দিকে। কিন্তু নানা পরস্পর বিরোধী প্রমাণে সে অভিযোগ দাঁড়ায়নি।
তনয়া একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক। অমীমাংসিত খুনের কাহিনী নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন পত্রিকায়। অমিতাভ মিত্রের হত্যা-রহস্য নিয়ে লেখার জন্য দার্জিলিঙে এলেন তনয়া। তারপর? তনয়া কি খুঁজে পেলেন এই হত্যারহস্যের সমাধান ?
রহস্য কাহিনী কবিতার সৌন্দর্যকে ছুঁয়ে থাকে। রহস্যের যে সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে দ্বিধা,অনিশ্চয়তা আর বিশৃঙ্খলার মাঝে, তার থেকেই পুষ্টি নিয়ে ডালপালা মেলে কবিতা। কঠিন কবিতার মানে খুঁজে বের করবার আনন্দ তো খুনের অপরাধীকে শনাক্ত করবার থেকে কম নয়। তাই বুঝি,‘মানুষ বড় শস্তা , কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো’ শুনলে গা-টা শিরশির করে উঠে।
মেঘ পাহাড়ের দেশ দার্জিলিং। বৃষ্টি অবিরত। গাঢ় সবুজে জলকণা,পাতার সিক্ত মুখ। ময়াল সাপের একসা শরীরের মতোই ভিজে যাচ্ছে ম্যাল,জলাপাহাড়,লেপচাজগৎ,কার্ট রোডের কবরখানা আর ঋষি রোডের সেই বাড়িটা। বৃষ্টি আর কুয়াশার ধোঁয়াশায় হিমেল হাওয়ায় অতীত খুঁড়ে এক দুঃসহ স্মৃতিকে জাগাতেই যেন সেখানে হাজির হলেন সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিক তনয়া ভট্টাচার্য। অমীমাংসিত খুনের কাহিনী নিয়ে তিনি ধারাবাহিক লিখছেন পত্রিকায়। দার্জিলিংয়ে আসার উদ্দেশ্য— সেই ধারাবাহিকের শেষ কাহিনীটার শেকড় সন্ধান। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দার্জিলিংয়ের এক সম্ভাবনাময় কবি,অমিতাভ মিত্র খুন হয়েছিলেন। আর সেই খুনের দায়ের আঙুল উঠেছিলে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, পরবর্তীতে বিখ্যাত রহস্য-ঔপন্যাসিক অরুণ চৌধুরীর দিকে। কিন্তু রহস্যটা অমীমাংসিত থেকে যায়,পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারে নি সেটা। এতো বছরের ব্যবধানে কি সেই পুরোনো পাপের দীর্ঘ ছায়ার উপর আলো ফেলে আসল অপরাধীকে চিনে নিতে পারবেন তনয়া? নাকি এসব ঘটনার ঘনঘটাই কারো নির্মিত মিথ্যের আবরণ?
চার অন্ধের কিসসাটা জানেন? সেই কিসসায় চারজন অন্ধকে দাঁড় করানো হয়েছিলো, একটা হাতির সামনে। তাদের কেউ ধরলো হাতিটার দাঁত,আর কেউ ধরলো তার লেজ। একজন এসে ধরলো হাতিটার কান,আরেকজন ধরলো তার পেট। পরে যখন জিজ্ঞেস করা হলো আসলে তাদেরকে কী জিনিস দেয়া হয়েছে,একেকজনের উত্তর আসলো একেকরকম। কেউ বললো, "এটা একটা দেয়াল।" কেউ বললো,"সাপ।" কারো কাছে মনে হলো, বর্শা বা রঙতুলি। আবার কারো কাছে জাহাজের পাল বা হাতপাখা। কিন্তু আমরা আসলে জানি সেখানে দাঁড়িয়েছিল একটা হাতি। এখানে আসলে কেউই কিন্তু মিথ্যা বলে নি।। হাত দিয়ে স্পর্শ করবার পর তাদের কাছে যা যা কল্পনীয় আর অনুমেয় মনে হয়েছে তারা ঠিক ঠিক সেই উত্তরটাই কিন্তু দেয়। কিন্তু আসলে কী ঘটেছে আর তারা কী সাক্ষ্য দিচ্ছে তার মাঝে কিন্তু আকাশপাতাল তফাৎ। পরস্পরবিরোধী অথচ সমানভাবে যুক্তিসঙ্গত বক্তব্যের কারণে জট পাকিয়ে ঘোলাটে হওয়া এই রহস্যকেই বলা যেতে পারে "রশোমন ইফেক্ট"। এখানে কিন্তু প্রত্যেকের বক্তব্য সমানভাবে "সত্য" হবার ব্যাপারে কিছু বলা হয় নি। এই বক্তব্য মিথ্যা,অনির্ভরযোগ্য বা ধোঁয়াশাপূর্ণ হতে পারে। আর এখানেই এসে পড়ে আনরিলায়েবল ন্যারেটর বা অনির্ভরযোগ্য কথকের বিষয়টা। একটা গল্প যখন বলা হয় তখন যার জবানিতে গল্পটা বলা হচ্ছে আপনি তার কথার উপর কতটুকু নির্ভর করতে পারেন সেটা হয়ে দাঁড়ায় বড়সড় একটা প্রশ্ন। আর লেখক সে সুযোগে আপনাকে শুরু থেকেই এমন কিছু সূত্র দিতে থাকে যার কারণে আপনি আগেভাগেই রহস্যের কিনারা করতে চান,আর শেষটায় গিয়ে আপনার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় "অতিশয় পুষ্ট মর্ত্যমান রম্ভা " বা এক কাঁদি পাকা কলা ঠিক এমনটাই করতে দেখা যায় বর্তমানের বেশিরভাগ জনপ্রিয় থ্রিলারগুলোতে। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের ‘শেষ মৃত পাখি’ পড়তে গিয়ে আলিফ লায়লার গল্পের ভেতর গল্পের প্যাটার্নে পাঠক মুখোমুখি হবেন এমন সব সত্যের,যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে আসলেই ঘটেছিলো। এর আগে অ্যান্টনি হরোউইটযের ‘ম্যাগপাই মার্ডারস’, রাইলি স্যাগারের ‘হোম বিফোর ডার্ক’ বইগুলোতে এই ধরনটার সাথে পরিচিত হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু এতো কাকতালীয় ঘটনার সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিলে তার সার্থকতা কোথায়? এই আখ্যান তাই আপনার আমার কল্পনার অতীতে দাঁড়িয়ে এক বাস্তবের অভিক্ষেপ,যেখানে কে যে সত্য বলছে, আর কে মিথ্যা-সেইটেই ধরাটা মুশকিল। পিঁয়াজের খোসার মতো স্তরে স্তরে লুকিয়ে আছে সেই খুনের সম্ভাব্য নেপথ্য কাহিনীর বিকল্প....
‘শেষ মৃত পাখি’-কে শুধু পিচ পার্ফেক্ট ক্রাইম কাহিনী বলাটা বোধহয় বড়সড় অপরাধ হবে। কারণ,এর বাইরেও এমন কিছু দিক এর সাথে জড়িয়ে আছে যেটা উপন্যাসটিকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মান। এই বিস্তৃত আখ্যানের পেছনের শক্তিশালী প্রেক্ষাপট রহস্য কাহিনী হিসেবে একে সীমাবদ্ধ থাকতে দেয় নি। বইটা প্রতিনিধিত্ব করছে সত্তরের দশকের ঝঞ্ঝাবিক্ষুধ্ব অস্থির সময়ের। শুধু নকশাল আন্দোলন,বাংলাদেশ-পাকিস্তানের যুদ্ধই না, সেসময়টায় বাংলা কবিতার জগতে যে শক্তিশালী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদলটা ঘটেছিলো তার এক জলজ্যান্ত চিত্রকে ধরে রেখেছে ‘শেষ মৃত পাখি’... একটা খুনের রহস্য সমাধান করতে গিয়ে কাহিনীতে ঢুকে পড়েছে প্রসূন বন্দোপাধ্যায়,রণজিৎ দাশ,কৃষ্ণা বসু,পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল,অনুরাধা মহাপাত্র,শম্ভু রক্ষিতসহ সেসময়ের কবিদের কবিতা,কবিতার বিষয়বস্তুর কেন্দ্রীয় প্রবণতা,সাহিত্যচর্চায় লিটল ম্যাগাজিনগুলোর প্রভাব। মাঝে মাঝে পড়তে গিয়ে মনে হয়,বইটার উপরে লেখা রহস্য কাহিনী শব্দবন্ধ কি বইটার ভারকে কমিয়ে দিচ্ছে? লেখক আসলে রহস্য কাহিনীর আদলে যেটা করতে চেয়েছেন সেটা হলো সিরিয়াস সাহিত্য। দুইটা টাইমলাইনে চলতে থাকা গল্পকে সফলভাবে এক বিন্দুতে গিয়ে মেলানোর জন্য এলেম থাকাটা জরুরি। সত্তরের দশকের দার্জিলিংয়ে হয়ে যাওয়া একটা খুনের রহস্যকে সমাধান করতে চেয়েছেন বর্তমানের প্রেক্ষাপটে। স্বভাবতই এই কাহিনীর মূল কঙ্কালকে অক্ষত রাখতে দুই সময়ের শাসনব্যবস্থার সামঞ্জস্য, অস্ত্রের ব্যবহার, সমসাময়িক নানা ঘটনাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ আর সেটাকে কালো অক্ষরে বেঁধে ফেলতে এক পাহাড়সম প্রস্তুতি নিতে হয়েছে লেখককে।
‘শেষ মৃত পাখি’ বইটার ক্যারেকটার বিল্ডআপ দেখার মতো। কাহিনীর মূল রক্তকণিকারা অরুণ চৌধুরী, অমিতাভ মিত্র,ড্যানিয়েল লামা থেকে শুরু করে তনয়া ভট্টাচার্য, সিদ্ধার্থ তো বটেই, এই বইয়ের আড়ালে যে আরেকটা রহস্য কাহিনী লুকানো আছে অমিতাভের অসমাপ্ত উপন্যাস হিসেবে, তার কল্পিত চরিত্রগুলোকেও খুব যত্ন করে, বিস্তৃত করে নির্মাণ করেছেন শাক্যজিৎ। চরিত্রগুলোর বলা ছোট ছোট সংলাপ,ডিটেইলসও যেন পরবর্তীতে কাহিনীর প্রয়োজনে হয়ে উঠেছে খুব অর্থবহ। এজন্যই ৪০০ পাতার বিস্তৃত এই কাহিনীর শেষে এসেও বলতে বাধ্য হতে হয়,লেখকের পরিমিতিবোধ অসাধারণ। প্রতিটা অধ্যায়ে অধ্যায়ে যে কবিতার দিয়ে শুরু হয়,সেগুলোর প্রাসঙ্গিকতা একে একে ধরা পড়ে কাহিনীর একদম শেষে গিয়ে। এজন্যই কাহিনীর ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেয়া এইসব কবিতা আরোপিত মনে হয় না। ❝সে কি রাত্রির শেষ মৃত পাখি, যার স্মৃতি আঁচড়াল মৃত্যুর ঘন ছায়ায় দেবযান ভয়ের মতন মৃদুসঞ্চারী স্বপ্নের পিছু নিতে? স্বপ্নের মত আয়ু চলে যায়, কখনো বা দ্রুত, কখনো বিলম্বিতে।❞
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের লেখার স্বতন্ত্র স্বর, তীব্র কোলাহলের মাঝেও আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। কাহিনীর দৃশ্য হয়ে উঠেছে বাঙময়। অনেক সময় এমন হয় না,গল্পের পারিপার্শ্বিক পরিবেশও একটা গল্প বলে? ‘শেষ মৃত পাখি’ বইয়ে যে রকম বৃষ্টি হচ্ছে,আমার মনে পড়ে যাচ্ছে তুম্বাড় মুভির সেটের কথা। অনর্গল বৃষ্টি,বাইরেও বৃষ্টি,মুভির ভেতরেও বৃষ্টি,বইতেও বৃষ্টি। পাহাড়ি রাস্তার বাঁক,দূরে ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশা, আলো-আঁধারি,ম্যালে রঙবেরঙের ছাতা এক স্বপ্নালু ভাবাবেশ তৈরি করে। লেখার ডিটেইলিংস এতো নিখুঁত যে পড়েই পাঠকের মনে সেই দৃশ্যকল্পের নিজস্ব একটা ছবি তৈরি হতে থাকে,তারপর দৃশ্যায়নের রিল শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটার রেশ থেকে যায়।
অনেকগুলো বছর পরে কর্নেল অরলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যখন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, তার মনে এসেছিলো বাবার সঙ্গে প্রথম বরফ দেখার স্মৃতি। আমিও সম্ভবত কখনো ভুলবো না। কুয়াশাটা ছিঁড়ে-খুঁড়ে যাচ্ছে। কাঁপা ছবির মতো ভেসে উঠছে দূরের পাহাড়,জঙ্গল। বহু বহুক্ষণ নীরবে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। সারা গায়ে শিশির মেখে আবছা নিস্পন্দ একটা কালো ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। ঘাস খাচ্ছে না, শূন্য চোখে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সামনে। শরীরের একটা পেশিও কাঁপছে না। নড়ছে না লেজ। এক বিয়োগান্তক মহাকাব্যের অন্তিম দৃশ্য।
❝শেষ মৃত পাখি❞ পাঠের এই অভিজ্ঞতাকে মনে রাখবো বহু বহুদিন, হয়তো বইটা পড়বো আরও বহু বহু বার। পাঠ অভিজ্ঞতার একটা স্থায়ী ছাপ আমার মনে অনুরণিত হতে থাকবে থেকে থেকে— ❝মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়... সূর্য যদি কেবলই দিনের জন্ম দিয়ে যায়, রাত্রি যদি শুধু নক্ষত্রের, মানুষ কেবলই যদি সমাজের জন্ম দেয়, সমাজ অস্পষ্ট বিপ্লবের, বিপ্লব নির্মম আবেশের, তা হলে শ্রীজ্ঞান কিছু চেয়েছিল?❞
অবাক হবো না হবো না করতে করতে অবাক হতেই হোলো। বেশ ভালোই অবাক হতে হোলো।শাক্যজিৎ কেইগো হিগাশিনো মাপের একটা টুইস্ট দিয়ে ফেলেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না।
"ম্যাগপাই মার্ডার্স" পড়ার পর থেকে "গল্পের ভেতর গল্প" জাতীয় রহস্য উপন্যাস আমার খুব প্রিয়। এই কাহিনিতে খুনের রহস্যের পাশাপাশি আছে বিভিন্ন কবির লেখা কবিতার অজস্র পঙক্তি,ভাষার অভাবিত ব্যবহার, ষাট ও সত্তরের দশকের টালমাটাল ভারত, উত্তাল রাজনীতি, নকশাল আন্দোলন, লিটল ম্যাগসহ আরো বহুকিছু।ভাষার ব্যবহারে বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছি। আর টানটান উত্তেজনাপূর্ণ মূল গল্প তো আছেই।গল্পের দুইটা টুইস্টই দুর্দান্ত। চমকটা কোনদিক থেকে আসছে ধরার কোনো কায়দা নেই।"কে করেছে"র চাইতে "কেন ও কীভাবে করেছে" অংশটা বেশি আকর্ষণীয়। থ্রিলারপ্রেমীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য বই।
ওপার বাংলার এরকম দুর্দান্ত রহস্যোপন্যাস খুব বেশি পড়িনি, প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি। কাহিনীর বর্ণন, অভিনব প্লট, এমনকি বইয়ের ভেতরের মেক-আপ সবকিছু টপনচ। অনেক সময় দেখা যায় যে একটা গড়পড়তা প্লটও প্রেজেন্টেশনের কারণে উৎরে যায়৷ কিন্তু এই ক্ষেত্রে লেখা+প্লট দু'টোই দুর্দান্ত৷ মূল রহস্যটা দু'জন লেখককে নিয়ে হওয়াতে আগ্রহের পারদ ছিল বেশি। কেউ নামধাম পাল্টে আমাকে যদি বলতো এটা হিগাশিনোর লেখা কোন উপন্যাস, আমি বিশ্বাস করে নিতাম নির্ঘাত৷ এই বইটা আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাবার পূর্ণ যোগ্যতা রাখে৷ লেখকের কাছে এরকম আরো উপন্যাসের প্রত্যাশা রাখছি।
স্বপ্নের মত আয়ু চলে যায়, কখনো বা দ্রুত, কখনো বিলম্বিতে।❞
বাংলা থ্রিলারে শেষ মৃত পাখির মত কোনো লেখা পড়তে পারব সেটা মোটামুটি এক্সপেক্টেশনে ছিল না। একদিকে খুবই প্রেডিক্টেবল ভাবে এগিয়ে গিয়েছে কাহিনী , আরেকদিক দিয়ে মনে হয়েছে এর থেকে কমপ্লেক্স করলে গল্প যেন সাবলিলতা হারাতো।
বই এ লেখক শুধু রহস্য নিয়ে কাজ করেন নি, চলে গেছেন অনেক ডেপথ এ। একটি সময়ের চিত্র এবং সেই সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। লেখকের বর্ণনাশৈলী এবং কাহিনী বিন্যাস পাঠককে একটি অনুসন্ধানের যাত্রায় নিয়ে যায়, যেখানে প্রতিটি পাতা উল্টানোর সাথে সাথে নতুন করে শকড হতে হয়। সার্বিকভাবে শেষ মৃত পাখি বাংলার থ্রিলার হিসাবে মাইলফলক বললে খুব বেশি বলা হবে না।
‘পৃথিবীর সবথেকে বুদ্ধিমান এবং নিখুঁত খু*নি হিসেবে তুমি কাউকেই দাগিয়ে দিতে পারবে না। সহজ কারণ। যে খু*নটা নিখুঁত হবে, তার খু*নি হিসেবে তুমি কাউকে শনাক্ত করতে পারবে না। ভাববে আত্মহ*ত্যা, বা অ্যাক্সিডেন্ট। আর শনাক্ত করলে, সেটা নিখুঁত হবে না।’
এ কয়েকটা লাইনই যথেষ্ট একজন থ্রিলারপ্রেমীকে গল্পে আটকে ফেলতে। মানে পারফেক্ট মা*র্ডার নিয়ে এভাবে তো ভেবে দেখিনি। তাই এ লাইনগুলো আপনাকে আটকাতে পেরেছে কিনা জানিনা, আমাকে আটকে ফেলেছিলো। আর এই লাইনগুলো আছে শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের রহসোপন্যাস ‘শেষ মৃত পাখি’র একদম ১ম পৃষ্ঠায়।
বেশ অনেকদিন বাদে বইয়ের রিভিউ লিখছি। বেশ অনেকদিন বাদে হবার জন্য অনেক কারণ আছে আর তাছাড়া ইদানিং রিভিউ লিখতেও আলসেমী লাগে। যাই হোক ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে কাজ নেই, স্রেফ এক লাইনে বলি। এত আলসেমী, ব্যস্ততা সত্ত্বেও ‘শেষ মৃত পাখি’র রিভিউ লিখতে বসার একটাই কারণ, সেটা হচ্ছে একজন পাঠক হিসেবে আরেকজন পাঠকের কাছে ভালো বইয়ের (অনন্ত আমার কাছে ভালো) খবর পৌঁছে দেয়ার দায়।
গল্পটা শুরু হয় ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট তনয়া ভট্টাচার্যের দার্জিলিং যাত্রা দিয়ে। তনয়া সারা ভারত ব্যাপি যত অমীমাংসিত কেস রয়েছে তা নিয়ে একটি ধারাবাহিক লেখেন ম্যাগাজিনে। ধারাবাহিকটা বেশ জনপ্রিয়। আর সে জনপ্রিয় সিরিজের শেষ লেখাটি হবে ৪৪ বছর আগে দার্জিলিং এর বুকে ঘটে যাওয়া ৭০ দশকের উঠতি সম্ভাবনাময় কবি অমিতাভ মিত্রের খু*নের রহস্য উদঘাটন দিয়ে। এ খু*নের সবচাইতে সন্দেহভাজন ব্যক্তি একজন বিখ্যাত লেখক, অমিতাভ মিত্রের বন্ধু অরুণ চৌধুরী। কিন্তু অভিযোগের তীর তার দিকে থাকলেও ৪৪ বছর আগেও সে তীর মুখ থুবড়ে পড়েছিলো। অরুণ চৌধুরীর শক্ত অ্যালিবাই থাকার এবং যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে। তবে কি আসলে অরুণ চৌধুরীই খু*নি নাকি এই প্রায় পারফেক্ট ক্রাইমটির পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোন রহস্য? অরুণ যদি খু*নী না-ই হোন তবে খু*নী কে? ৪৪ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। সময় নদীর স্রোতে গত হয়েছেন ঘটনার অনেক পাত্র পাত্রীই, হারিয়ে গেছে অনেক সূত্রই। তার থেকে বড় কথা হচ্ছে, ৪৪ বছর আগে যে রহস্য কেউ সমাধান করতে পারেনি, আজ এত বছর পর তনয়া কি পারবেন ইতিহাস খুঁড়ে সে রহস্য উদ্ঘাটন করতে?
এই হচ্ছে উপন্যাসের মূল কাহিনী। তবে এত ছোটভাবে বললেও উপন্যাসটা যে মোটেও এত ছোট কিছু না সেটা পাঠকগণ উপন্যাসের সাইজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। এবারে বলি বইটা আমার কেমন লাগলো আর এইটুকু গল্প লিখতে লেখকের কেন ৪০০+ পৃষ্ঠা লাগলো।
বইটাকে স্রেফ মার্ডা*র মিস্ট্রি কিংবা রহস্যপোন্যাস বললে এটার প্রতি অবিচার করা হবে। কারণ একটিই, লিখনশৈলী। তবে লিখনশৈলী নিয়ে বলার আগে অন্য জিনিসগুলো নিয়ে বলি।
প্লট বিচারে এই বইয়ের প্লট অনন্য। আমি প্লট হিসেবে যেটাকে লিখেছি সেটার চাইতে অনেক বেশী বিস্তৃত। তবে সেটা বলে দিয়ে আপনাকে উপন্যাসটার স্বাদ থেকে বঞ্চিত করতে চাইনি। তবে যারা স্রেফ প্লট/কন্টেন্টের বিচারে পড়েন তাদের জন্য এ বই একদম পারফেক্ট একটা উপন্যাস। সেই সাথে মেজর দুটো টুইস্ট আছে, যেগুলোর প্রথমটি অনেকে ধরতে পারলেও শেষটি আপনি ধরতে পারবেন না, আমি মোটামুটি নিশ্চিত, যদিও অসংখ্য ক্লু বইয়ের ভেতরের পরতে পরতে ছড়ানো ছিলো। সুতরাং টুইস্ট লাভাররাও বইটা তুলে নিতে পারেন স্বচ্ছন্দ্যে। চাইলে উপন্যাসের মূল রহস্য উদ্ঘাটনকে আপনি চ্যালেঞ্জ হিসেবেও নিতে পারেন।
এরপর আসে চরিত্রায়ন। আমার দৃষ্টিতে এইখানে লেখক পুরোই ছক্কা হাঁকিয়েছেন। মানে প্রতিটা চরিত্র আমার কাছে আল��দা লেগেছে। লেখক অনেক যত্ন নিয়ে তৈরী করেছেন বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে অমিতাভ চরিত্রটা। তাকে বর্ণনা করার অংশগুলোয় পাগলাটে, ক্ষ্যাপা একটা মানুষের ছবি দেখেছি যে কিনা শুরুতে কবিতার ফুলঝুরিতে সমাজকে পাল্টে দেবার ইচ্ছাপোষণ করতো। তার লেখা চিঠিগুলোতেও তার চরিত্রের দিকগুলো দারুণভাবে উঠে এসেছে। উপন্যাসে আরেকটা এক্সক্লুসিভ ব্যাপার আছে। সেটা হচ্ছে, বইয়ের মাঝে বই। এখানে অমিতাভের একটা অর্ধসমাপ্ত উপন্যাস আনা হয়েছে যেটা অরুণ চৌধুরী তনয়াকে দেন পড়ার জন্য। অরুণ চৌধুরীর মতে এখানে অমিতাভের মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। এই যে উপন্যাসের মধ্যে উপন্যাস, এই কনসেপ্টটা আমার দারুণ লেগেছে। আর তাছাড়া এই উপন্যাসে যে চরিত্রগুলোও এসেছে ওগুলোও অনেক যত্ন নিয়ে তৈরী করেছেন লেখক।
আর পাঁচটা থ্রিলার বইয়ের মত নয় এ বইয়ের লেখা। এ বইতে এসেছে ৭০ দশকের সাহিত্য, রাজনীতি, লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যে তার প্রভাব, লিটল ম্যাগাজিন আর ব্যবসায়িক প্রকাশনী গুলোর দ্বন্দ্ব। আরও এসেছে ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল আন্দোলন। শুধু তাই নয়, গল্পের প্রয়োজনে এসেছেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল (বইটার নামও কিন্তু তার কবিতা থেকেই নেয়া হয়েছে), শম্ভু রক্ষিত, প্রসূন বন্দোপাধ্যায়সহ আরো অনেক কবি। লেখক শাক্যজিৎ শুধু একটি রহস্যপোন্যাস লিখতে চাননি। এমনকি আমি মনে করি এটি আসলে রহস্যপোন্যাস কম, মূলধারার সাহিত্য বেশি। কি দারুণ ভাষার প্রয়োগ, কি দারুণ শব্দের ব্যবহার! আমি তো অন্তত ১০টা নতুন শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছি। সাথে দারুণ কিছু দার্শনিক উক্তি যেন উপরি পাওনা ছিলো। এই মূহূর্তে একটা সেরা উক্তির কথা মনে পড়ছে-
“খুন হল একটা শিল্প। আর গোয়েন্দা হল সেই শিল্পের ক্রিটিক। সমালোচক যেমন শিল্পকর্মের ভেতর থেকে লুকানো নানা চিহ্ন খুঁজে খুঁজে ব্যাখ্যা করেন, গোয়েন্দাও একটা হত্যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন ক্লু খুঁজে খুঁজে হত্যার ব্যাখ্যা দেয়।”
কি দারুণ উক্তি, তাইনা? এছাড়াও গল্পের প্রয়োজনে এসেছে অনেক নামী দামী কবির কবিতা, ৪০-৪৫ টা তো হবেই। আর এই কবিতার জন্যই এখানে একটা পাঠকদের উদ্দেশ্যে একটা সতর্কবার্তা দেয়া প্রয়োজন মনে হলো। আপনি যদি স্রেফ একটা স্ট্রেইট থ্রিলার পড়তে চান, যেখানে শুধু রহস্য ও রহস্য উদ্ঘাটন নিয়ে কথা হবে, তাহলে এই বইটা আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। তবে যদি রহস্যের সাথে সাথে সেই সময়ের পটভূমি নিয়ে জানতে চান, দার্জিলিং এর গ্লুমি আবহাওয়ায় দূর্দান্ত বর্ণনা উপভোগ করেন তবে এই বইটি আপনার জন্যই।
বইয়ের কি সবই ভালো দিক? আসলে সব দিকই ভালো এমন বই খুব একটা হয় না। প্রায় পারফেক্ট এই বইটার একটা দিক আমার খানিকটা দূর্বল লেগেছে। তবে সেটা আসলে আমারই দূর্বল লাগবে, আপনার নাও লাগতে পারে তাই রিভিউতে উল্লেখ করলাম না। আপনি যদি বইটা পড়তে চান কিংবা বইটা ইতোমধ্যে পড়ে থাকেন স্রেফ তাহলেই আপনার সাথে ইনবক্সে এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এখানে নয়, কারণ দূর্বল জায়গাটা হোয়াইট বা ব্ল্যাক না, গ্রে। আর সেটা বলে আপনার বই পড়ার আগ্রহটা নষ্ট করতে চাই না। এমনকি বইটা এ জায়গাটাকে কোট করা সম্ভবত ডিজার্ভও করে না (খানিকটা বায়াসড মনে হচ্ছে, না?)। তারচেয়ে বরং বইতে ব্যবহৃত হওয়া পছন্দের একটা কবিতা দিয়ে রিভিউটা শেষ করি, কেমন?
Yesterday, upon the stair, I met a man who wasn't there! He wasn't there again today, Oh how I wish he'd go away!
পুনশ্চঃ এই কবিতাটার মাঝে কিন্তু বইতে লুকিয়ে থাকা রহস্যের খানিকটা আছে। ক্লু দিলাম। বই পড়ার সময় কাজে লাগাতে পারেন কিনা দেখেন।
উপন্যাসের শুরুতেই খুনি কে সেটা বলে দিলে রহস্য উপন্যাসের মজাটা কোথায় থাকলো? কিন্তু শেষ মৃত পাখির মজাটা আসলে এখানেই। বইয়ের প্রথম সত্তুর পার্সেন্ট খুব স্বাভাবিকভাবেই এগিয়েছে কাহিনী, একেবারে প্রেডিক্টেবল। যা ভাবছিলাম সেটাই হচ্ছিল। যেন কাঁচা হাতে লেখা সস্তা কোনো থ্রিলার। কিন্তু এরপর যেদিকে মোড় নিয়েছে সেটা অভাবনীয়। শেষের টুইস্টটা অনেকটা কেইগো হিগাশিনো বা হারলান কোবেন টাইপ। ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম এমনিতেই আমার ভালো লাগে। এই বইয়ের মূল চরিত্রও সেটাই। এক পুরানো রহস্যের সত্যতার খোঁজে দার্জিলিং যায় সে, সেখানে গিয়ে একটা পাণ্ডুলিপি হাতে পায়। যেটার ভেতরে নাকি লুকিয়ে আছে রহস্যের সমাধান। আসলেই কি তাই? যদি সেটা ভেবে থাকেন তাহলে আরেকবার ভাবুন। শেষে অবাক হতে হবে। যাইহোক, উপন্যাসের ভেতর উপন্যাস কনসেপ্ট পাশ্চাত্য অনেক বইয়ে থাকলেও বাংলাতে এই প্রথম। আর সেটা ইউনিকও হয়েছে দেখে ভালো লাগলো। কাহিনী বেশিরভাগ সময়ই খাপে খাপ মিলে যাচ্ছিল বলে বিরক্ত হয়েছি ঠিকই, তবে শেষে যে চমকটা লুকিয়ে ছিল সেটার জন্য পয়সা উশুল। ভাবতেও পারবেন না মানুষ শুধুমাত্র হিংসা, ক্রোধ বা প্রতিশোধের জন্য কতদূর যেতে পারে। বাংলার রহস্যপ্রেমীদের জন্য মনে রাখার মত একটা বই শেষ মৃত পাখি।
একটা রহস্যোপন্যাস পড়ার পর যদি দেখেন, গল্পের রহস্যময় আবহ শুরুতে আপনাকে একাগ্রতা এনে দিলেও, সব রহস্য উদ্ঘাটনের পর শেষ পর্যন্ত সেই গল্পের সঙ্গে আপনার সংযোগটা পুরোপুরি টিকে থাকে না, তাহলে ধরতে হবে বইটি থেকে আপনার প্রত্যাশার তুলনায় কম কিছুই পেয়েছেন। শেষ মৃত পাখি তেমনই একটি উপন্যাস, যেখানে লেখক ঠিকঠাকভাবে একটি মিস্ট্রি থ্রিলারের আবহ তৈরি করলেও, রহস্য উন্মোচনের পর্যায়ে এসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করবেন।
প্রকাশের পর থেকেই শেষ মৃত পাখি বইটি ক্রমাগত তার অত্যাধিক হাইপ ধরে রেখেছে এবং সাধারণ পাঠকদের প্রশংসায় সয়লাব হয়েছে। দুই বাংলার পাঠকদের মধ্যে সমান জনপ্রিয় এই রহস্যোপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ১৯৭৫ সালে দার্জিলিংয়ে কবি অমিতাভ মিত্রের হত্যাকাণ্ড। সত্তরের দশকের এই প্রতিশ্রুতিশীল কবির খুনের ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন ছিল তার রহস্য সাহিত্যিক বন্ধু অরুণ চৌধুরী, তবে প্রমাণের অভাবে সে মামলার সমাধান অধরাই রয়ে যায়।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় ৪৪ বছর পর, অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে লেখালেখি করা এক সর্বভারতীয় পত্রিকার ক্রাইম জার্নালিস্ট তনয়া ভট্টাচার্য অসময়ে হাজির হয় দার্জিলিংয়ে। তার উদ্দেশ্য এই পুরনো হত্যারহস্য নিয়ে একটি সফল ফিচার লিখে নিজের পেশাগত জীবনের ইতি টানবে। শুরুতেই সে দেখা করে অরুণ চৌধুরীর সঙ্গে, যিনি বর্তমানে একজন সফল রহস্য ঔপন্যাসিক। তনয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে অরুণ চৌধুরী খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অমিতাভকে হত্যার কথা স্বীকার করে। সেইসাথে, তনয়াকে সে অমিতাভের লেখা একটি অসমাপ্ত রহস্য উপন্যাসের পান্ডুলিপি দেয় এবং এই হত্যার পেছনের কারণ বুঝতে সেটির প্রতি মনোযোগী হতে বলে।
গল্প যত এগোয়, রহস্য ততই জটিল হয়ে ওঠে। সত্যিই কি অরুণ খুনটা করেছে, নাকি অন্য কেউ? আর যদি করেই থাকে, তবে কী তার প্রকৃত মোটিভ? কীভাবে সে তৈরি করেছিল নিখুঁত অ্যালিবাই? ৪৪ বছর আগে এই কেসের তদন্তকারী ইনচার্জ ড্যানিয়েল লামা কোন কানাগলিতে আটকা পড়েছিল? কোন সত্য লুকিয়ে রেখেছে পুলিশ অফিসার ধনরাজ গম্বু? সবকিছু জানতে হলে কেসের তথ্যপ্রমাণ বাদেও তনয়াকে অনুধাবন করতে হবে সত্তরের দশকে অরুণ-অমিতাভের সাহিত্যের জগতের পরিস্থিতি।
সত্তরকে বলা হ���় মুক্তির দশক। একদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, আর অন্যদিকে সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ভাঙতে বামপন্থী তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নকশাল আন্দোলন। এই বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য সমাজেও। গুটিকয় বাণিজ্যিক পত্রিকার একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে, নিরীক্ষাধর্মী ও নতুনধারার সাহিত্যচর্চার বিপ্লব গড়ে তুলতে বের হচ্ছিল একের পর এক লিটল ম্যাগাজিন। সেইসব ম্যাগাজিনকে ঘিরেই উঠে আসছিল একঝাঁক নতুন ধারার সাহসী ও তরুণ কবি-সাহিত্যিক। সেই ধারার একজন কবি হিসেবে অমিতাভ মিত্র ছিল বেশ প্রতিশ্রুতিশীল।
কিন্তু অমিতাভের হত্যারহস্যের সঙ্গে এই সবকিছুর সম্পর্কই বা কোথায়? আর অমিতাভের লেখা সেই অসমাপ্ত রহস্যকাহিনীটিই বা কীভাবে যুক্ত এই কেসের সঙ্গে? এক বুদ্ধিমান প্রতিপক্ষ ও দারুণ বিপদের মোকাবিলা করে, তনয়া কি পারবে নানা পরস্পরবিরোধী সাক্ষ্যপ্রমাণের নিচে চাপা পড়া সত্যিটা খুঁজে বের করতে? এই সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে দুই বাংলায় জনপ্রিয় ও সমানভাবে প্রশংসিত শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের রহস্য উপন্যাস শেষ মৃত পাখি-তে।
রহস্যকাহিনী হিসেবে শেষ মৃত পাখি–এর গল্পটা খারাপ নয়। বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং আইডিয়ার টুইস্ট, গল্পের ভেতর গল্প, হত্যা রহস্যের সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিন আর নকশাল আন্দোলনের মেলবন্ধন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা ক্লু দিয়ে গড়ে ওঠা একটি জটিল ধাঁধা, রহস্যকে স্তরে স্তরে ভাগ করে গল্পের মোড় ঘোরানো; সব মিলিয়ে বইটির কাহিনীকে যথেষ্ট ভালোই বলা যায়। বিশেষ করে, গল্পের ভেতর গল্প হিসেবে অমিতাভের লেখা বইটিকে যেভাবে একটি আলাদা ডিটেকটিভ নভেলার মতো লেখা হয়েছে, তা প্রশংসার দাবিদার। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের সুন্দর ও জমাট লেখনী বইটাকে মিস্ট্রি থ্রিলার হিসেবে শক্তিশালী করেছে। তিনি যে একজন সুলেখক এবং ভিন্নধর্মী লেখায় হাত পাকিয়ে তারপর 'শেষ মৃত পাখি' লিখেছেন, সেটা এই বইয়ে তার শব্দের পর শব্দ বসিয়ে সাবলীল ও প্রাঞ্জল বাক্য গঠন দেখে বোঝা যায়।
সেই দারুণ লেখনীর মাধ্যমে দার্জিলিংয়ের বর্ণনা, সেখানকার বর্ষার অস্বস্তিকর আবহ এবং চরিত্রদের কর্মকাণ্ডের চিত্রকল্প ও সংলাপগুলো চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উপমা ও প্রতীকের ব্যবহারও ভালো লেগেছে। একইসাথে, মূল গল্প ও অমিতাভের লেখা বই—এই দুই রহস্যকাহিনীর মধ্যে সামঞ্জস্যতা এবং ভাষাগত পার্থক্য লেখক দক্ষ হাতে সামলে নিয়েছেন। তবে লেখকের লেখার ভঙ্গিটি কিছু কিছু জায়গায় খানিকটা জোরপূর্বক মনে হয়েছে। বিশেষ করে, দার্জিলিংয়ে তনয়ার আগমনের পরপর সেখানকার পরিবেশের ভ্রমণকাহিনীর মতো বর্ণনা কিছুটা বিরক্তিকর ঠেকতে পারে। সেইসাথে লেখক গল্পে প্রাসঙ্গিকভাবে রহস্যের সময়কালের নকশাল আন্দোলন এবং লিটল ম্যাগাজিনের কথা এনেছেন।
নকশাল আন্দোলন এবং সেই সময়ে পুলিশ কর্তৃক তরুণ ছাত্রদের হত্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো গল্পে এসেছে, তবে তা খুব আহামরি কিছু হয় নি। লেখকও ওপার বাংলার সাহিত্য, সিনেমা কিংবা সিরিজের এই চর্বিতচর্বণ নিয়ে অতিরিক্ত টানাহেঁচড়া করেননি, গল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী রেখেছেন। তবে লেখকের ব্যক্তিগত অবসেশন— সেই সময়কার হাংরি কবি, তাদের কবিতা ও আন্দোলন, এই বিষয়গুলো তিনি কিছুটা জোর করেই গল্পের ভেতরে ঠেসে ঢুকিয়েছেন, অমিতাভের লেখা ব্যক্তিগত ডায়েরি ও চিঠিপত্রগুলোর মাধ্যমে। বিষয়গুলো যে গল্পের সাথে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক তা নয়, তবে একটা পর্যায়ে এসে এই নিয়ে লেখকের চিন্তাভাবনার প্রকাশ অতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে।
এতসব ভালো দিক থাকার পরও, বইটি আমার কাছে মিস্ট্রি থ্রিলার হিসেবে আপ টু দ্য মার্ক মনে হয়নি। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো দুর্বল ও অপর্যাপ্ত তদন্তকার্য। একটা মিস্ট্রি থ্রিলার কেবল রহস্য আর টুইস্টের ওপর নির্ভর করেই ভালো হয় না; হয় পুরো কাহিনিজুড়ে চরিত্রদের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের জন্যও। বইয়ের প্রথম ৫০-৬০ পৃষ্ঠার মধ্যে মূল রহস্যকে অনেকটা ধাঁধার মতো উপস্থাপন করার পর পাঠক হিসেবে আমিও নড়েচড়ে বসি, এবার নিশ্চয়ই এক দারুণ তদন্তকার্যের সম্মুখীন হবো। কিন্তু সে প্রত্যাশা পূরণ না হয়ে, মূল কাহিনীটি এরপর থেকেই ঝিমিয়ে পড়তে থাকে।
আসলে ৩০০ পৃষ্ঠার এই বইয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে লেখক মূল গল্পের সমান্তরালে অমিতাভের রহস্যকাহিনী আর অন্যান্য লেখাগুলো তুলে ধরতে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, তনয়ার তদন্তকার্য তাতে তেমনভাবে ফুটে উঠে নি। লেখক নানা উপায়ে গল্পে তথ্য উপস্থাপন করেছেন ঠিকই, কিন্তু সেগুলোর কোনো মজবুত বিশ্লেষণ নেই। রহস্যের জটিলতা সাময়িকভাবে আগ্রহ জাগিয়ে রাখলেও, ধীরে ধীরে পুরো গল্পটি পানসে হয়ে পড়ে। সত্যি বলতে, একটা রহস্যোপন্যাস হিসেবে তনয়ার এই মন্থর গতির কাহিনী আমার কাছে যথেষ্ট দুর্বলই লেগেছে।
অনেকেই হয়তো এই ব্যাপারটাকে বাস্তবধর্মী বলে মনে করতে পারেন, যেখানে তনয়া একজন সাধারণ সাংবাদিক, তাই তার কাছ থেকে কোনো টিপিক্যাল গোয়েন্দার দক্ষতা আশা করাটা ঠিক নয়। সেইক্ষেত্রে বলবো, গল্পে রহস্যের যে সমাধান দেওয়া হয়েছে, সেটি ছিল অতিমাত্রায় অবিশ্বাস্য, আর তার চেয়েও বেশি গাঁজাখুরি ছিল তনয়ার অনুমানের উপর নির্ভর করে সেই সমাধানে পৌঁছানো। সত্যি বলতে, গল্পে উপস্থাপিত তথ্যগুলো থেকে তনয়া যেভাবে হঠাৎ করে সিলি ও ভিত্তিহীন অনুমানের মাধ্যমে দ্রুত সমাধান বের করে ফেলে, তা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। আর এটাই ‘শেষ মৃত পাখি’কে রহস্যোপন্যাস হিসেবে সবচেয়ে বেশি দুর্বল করে তোলে।
আর এমনটা করতে গিয়ে তনয়া চরিত্রটিকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করার ফলে তার চরিত্রায়নও অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। মানে পাঠক হিসেবে আপনি একটা চরিত্রকে, তার চিন্তাভাবনাকে, উত্তম পুরুষ বর্ণনায় পুরো বইজুড়ে দেখেছেন। আপনি বুঝতে পেরেছেন সে কীভাবে ভাবে, সহজেই ভুল করে, এমনকি একটি ভুল সমাধানকে অন্ধভাবে বিশ্বাসও করে। এরপর যখন দেখেন, হঠাৎ করে একটি সাধারণ ক্লু পেয়ে তার চোখ পুরোপুরি খুলে যায়। আর ঠিক পরের অধ্যায়েই কোনো রকম পর্যাপ্ত অনুসন্ধান ছাড়াই সে ৪৪ বছর আগের একদম বিপরীত ও অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো শুধু জানতেই পারে না, বরং গড়গড় করে বিস্তারিতভাবে বর্ণনাও করে ফেলে। বিষয়টা কি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হবে?
আসলে গোয়েন্দা কাহিনির একটি প্রচলিত ফর্মুলা হলো—মূল রহস্যের সমাধানের আগে লেখক পাঠকের মনোযোগকে নানাভাবে ভুল পথে চালিত করে এবং শেষ অঙ্কে গোয়েন্দার অতুলনীয় বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে সেই ভুল ধারণাগুলো ভেঙে দিয়ে উন্মোচন করে একটি ভিন্ন ও অপ্রত্যাশিত সত্য। এতে করে পাঠক বোকা বনে যায় আর চমকিত হয়। লেখক তার বইয়ে ফর্মুলাটি প্রয়োগ করেছেন। তবে সাধারণত গোয়েন্দা কাহিনী তৃতীয় পুরুষ বা গোয়েন্দার সহকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হয়, ফলে মূল গোয়েন্দার চিন্তাভাবনা পুরোপুরি পাঠকের কাছে প্রকাশ পায় না। এতে করে রহস্য এবং চমকের ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু এই বইয়ের ক্ষেত্রে বিষয়টা ভালো কিছু করতে পারে নি। ফলে যখন প্রি-ক্লাইম্যাক্সে তনয়া অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বোকার হদ্দের মতো ভুল বিশ্বাস করে যায়, আর পরে লেখকের ইচ্ছায় হঠাৎ এক নিমেষে সবকিছু বুঝে ফেলে, বিষয়টি তখন খুবই অস্বাভাবিক মনে হয়। লেখকের এই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ শুধু গল্পের রহস্যকে দুর্বল করে তোলে না, বরং তনয়ার চরিত্রায়নেও বাজে প্রভাব ফেলে।
একই অবস্থা মূল রহস্য এবং তার তথাকথিত মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সমাধানেরও। উপন্যাসের শেষদিকে লেখক প্রকাশ করেন এক বিশাল মাস্টার ক্রাইমের আখ্যান। সমাধানটি অবিশ্বাস্য, সেটা সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হলো, ভালোমতো ডেভেলপমেন্টের অভাব রয়েছে। আগাথা ক্রিস্টি কিংবা কেইগো হিগাশিনোর মতো বিশ্ববিখ্যাত মিস্ট্রি থ্রিলার লেখকদের গল্পেও অনেক সময় বুদ্ধিমান অপরাধীদের এমনসব অস্বাভাবিক অপরাধপ্রক্রিয়ার টুইস্ট দেখা যায়, যা বাস্তব জীবনে প্রায় অসম্ভব বলা চলে। কিন্তু তারা পুরো গল্পজুড়ে রহস্য, তদন্ত, তথ্য ও সূত্রগুলোকে এমন দক্ষভাবে উপস্থাপন করেন যে, সেগুলো অযৌক্তিক মনে হয় না, বরং পড়ে মাথা ঘুরে যায়।
এই বইয়ের টুইস্টগুলোর আইডিয়াগুলো কিন্তু মোটেও খারাপ ছিল না। বিশেষ করে মূল মোটিভ নিয়ে যে টুইস্টটা আসে, সেটা সত্যিই ভালো, কিছুটা হারলান কোবেন স্টাইলের। যদিও অপরাধীদের মূল প্ল্যানের টুইস্টটা আমার অত্যন্ত পছন্দের লেখক কেইগো হিগাশিনোর কিছু বইয়ের সঙ্গে বেশ মিল খায়, যার ফলে হিগাশিনোর সবচেয়ে জনপ্রিয় বইটি পড়া থাকলে এই টুইস্টের অর্ধেকটা আন্দাজ করাটা কঠিন নয়। সম্ভবত এজন্যই অনেকে এই বইয়ের তুলনা হিগাশিনোর বইয়ের সঙ্গে করে। তবে হিগাশিনো যেভাবে পুরো উপন্যাসজুড়ে রহস্য, ক্লু এবং অপরাধীর মনস্তত্ত্বকে যৌক্তিকভাবে নির্মাণ করেন, তার ছিটেফোঁটাও 'শেষ মৃত পাখি'তে নেই। তদন্তকার্যের দুর্বলতার কথা তো আগেই বলেছি, মূল গল্পে লেখক শুধু ভাতের মতো করে তথ্য ছড়াচ্ছিলেন।
লেখক গল্পে অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়েছেন অমিতাভের লেখা ডায়েরি, চিঠিপত্র এবং অসমাপ্ত রহস্য গল্পটির ওপর। এর মধ্যে অমিতাভের ডায়েরি ও চিঠিপত্রের ব্যক্তিগত লেখাগুলো দিয়ে শাক্যজিৎ মূলত সেই সময়কার হাংরি কবিদের সাহিত্য আন্দোলন নিয়ে নিজের দর্শন ফলাতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন, যার সঙ্গে মূল রহস্যের সম্পর্ক একপর্যায়ে খুবই ক্ষীণ হয়ে আসে। তাই এগুলো যে মূল আখ্যানের সঙ্গে পুরোপুরি একীভূত হয়েছে, তা বলা যায় না। আর বাকি থাকে অমিতাভের লেখা রহস্য কাহিনী। সত্যি বলতে, একটা আলাদা ডিটেকটিভ গল্প হিসেবে এটি খারাপ ছিল না। এর আবহ কিছুটা ব্যোমকেশ বক্সীর গল্পগুলোর মতো, আর এই গল্পটি গড়ে তোলা হয়েছে হনকাকু গোত্রের লকড রুম মার্ডার মিস্ট্রির ধাঁচে। এ গল্পের টুইস্টগুলোও বেশ ভালো লেগেছে। বিশেষ করে, বইয়ের মূল রহস্যের সঙ্গে সংযোগ খোঁজা ছাড়া খুব একটা মনোযোগ এতে দিয়নি বলে, এই গল্পটাই আমাকে বেশি চমকে দিয়েছে। তবে যদি ভেতরের এই গল্পটির সঙ্গে মূল গল্পের সংযোগ নিয়ে ভাবি, তাহলে দেখা যাবে, পুরোটা জুড়েই অযৌক্তিকতা বিদ্যমান। সেই অযৌক্তিকতার কয়েকটি উদাহরণ পরের প্যারায় তুলে ধরছি, সেখানে স্পয়লার থাকবে।
স্পয়লার শেষ। সব মিলিয়ে, উপরেরগুলো ছাড়াও মূল উপন্যাসটিতে এমন আরও অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। আর নিখুঁত অপরাধ এবং সেটার খুঁত বানানোতে এত অসংলগ্নতা যে, প্রথম অধ্যায়ে পার্ফেক্ট মার্ডার নিয়ে করা বুদ্ধিদীপ্ত আলাপটিকে জাস্ট খিল্লি মনে হবে। তাই সবকিছু বিবেচনা করে উপন্যাসটিকে শেষ পর্যন্ত একটি দুর্বল রহস্যোপন্যাস ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। ভালো গল্প ও লেখনী থাকা সত্ত্বেও একটা থ্রিলার বই যে এতো দুর্বল হতে পারে, শেষ মৃত পাখি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আর হ্যাঁ, মানুষ যেভাবে এই বইকে থ্রিলার আর মূল ধারার সাহিত্যের মধ্যবর্তী সেতু বলে প্রচার করছে, সেটা নিয়েও আমার কিছু বলার আছে।
আমি জানি না ঠিক কী করলে কোনো লেখা "মূলধারার গভীর সাহিত্য" হয়। সেটা কি একটু প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু সামাজিক বা রাজনৈতিক কথা এনে সেগুলো নিয়ে আলগা আলোচনা করা, নাকি গল্পের পরতে পরতে কোনো বার্তা ঢুকিয়ে দেওয়া, আমি নিশ্চিত না। তবে হ্যাঁ, আমার কাছে ভালো সাহিত্য কিংবা গভীরতার আসল মাপকাঠি হলো চরিত্রায়ন। আমি একটা গল্প থেকে শিক্ষা, দর্শন, সামাজিকতা, মনস্তত্ত্ব বা রাজনৈতিক আলাপ সবই পেতে চাই ভালো চরিত্রায়নের মাধ্যমে। যে গল্পের চরিত্রগুলো আমার মন ছুঁতে পারে, দিনশেষে মনে থেকে যায় সেই গল্পই। সেই হিসেবে, ‘শেষ মৃত পাখি’ উপন্যাসে চরিত্রায়ন কেমন ছিল? আমার মতে, খুব একটা ভালো নয়।
ফার্স্ট পারসন ন্যারেটিভে লেখক প্রোটাগনিস্ট তনয়া ভট্টাচার্যকে টনসিলের সমস্যায় আক্রান্ত এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিজনিত ট্রমায় ভোগা এক চরিত্র হিসেবে তুলে ধরে বিশেষ বানাবার চেষ্টা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত সে তথাকথিত ইনটুইশন নামক প্লট আর্মার পরিহিত একটা একমাত্রিক চরিত্রই রয়ে যায়। সত্যি বলতে, এই কারণে লেখক যদি তনয়াকে নিয়ে কোনো সিক্যুয়েল লেখেন, আমি সেটি পড়তে খুব একটা আগ্রহী হবো না। একই কথা অ্যান্টাগনিস্ট অরুণ চৌধুরীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদিও তাকে অত্যন্ত জটিল একটি চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা শুধু অন্য চরিত্রদের সংলাপ পর্যন্ত-ই। চরিত্রটির মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা কিংবা মানসিক জটিলতা প্রদর্শনের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এই বইটির তুলনা কেইগো হিগাশিনোর লেখার সঙ্গে করা হলেও, হিগাশিনো তার রচনায় অপরাধীর (বলতে গেলে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ) চরিত্রকে যে গভীরতা ও ডেপথের সাথে গড়ে তোলেন, ‘শেষ মৃত পাখি’ সেটার ধারেকাছেও যেতে পারেনি।
বাকি সব চরিত্রগুলোকে সরাসরি বাংলা ওয়েব সিরিজের চরিত্রের আদলে গড়ে তোলা, কিছু একমাত্রিক প্লট ডিভাইসের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় নাই। আর অমিতাভের কথা না-ই বা তুললাম। যদিও তার চিঠিপত্র আর ডায়েরির লেখাগুলোর মাধ্যমে চরিত্রটির একটা মোটামুটি অবয়ব তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু সবশেষে গোঁজামিল দিয়ে ভরা রহস্যভেদের পর, সেসব আর কোনো অর্থ বহন করে না। সত্যি বলতে, তখন কোনো কিছুই আর সেন্স মেক করবে না। পুরো বইজুড়ে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হাংরি কবিদের কবিতা, আন্দোলন আর সামাজিক-রাজনৈতিক আলাপ, সবই তখন অর্থহীন মনে হবে। তাই সবশেষে, এই বইটিকে আমার খুব আহামরি বা গভীর সাহিত্য কিছু বলেও মনে হয় নি। যাক গে, সাহিত্য হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে এসব আমার ব্যক্তিগত অভিমত। সব মিলিয়ে, বইটি পড়ে আমি অনেক হতাশ হয়েছি।
📚 বইয়ের নাম : শেষ মৃত পাখ��
📚 লেখক : শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য
📚 বইয়ের ধরণ : ডিটেকটিভ, মিস্ট্রি থ্রিলার, ক্রাইম থ্রিলার
হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি, পাগল ছাড়া দুনিয়া চলেনা। কিন্তু ৪০৩ পৃষ্ঠার এই রহস্য উপন্যাস পড়ে ধুঁয়ার চোটে কানা যেমনে নারিকেলের ধূপ মাইরা সেট হয়ে থাকে, আমিও ঠিক তেমনি সেট হয়ে চেয়ারে বসে আছি আপাতত।
বেশ আশা জাগিয়ে শুরু হয়েছিল গল্পটা। আমার খুব প্রিয় একজন কবি প্রসূন বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার চমৎকার একটা পঙ্ক্তি দিয়ে গল্পের সূচনা করেছেন লেখক। প্রতিটা অধ্যায়ের শুরুতেই সত্তরের দশকের বিভিন্ন কবিদের কবিতার পঙ্ক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। গোটা উপন্যাসটা পড়লে খুব স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে, লেখক একজন মরমিয়া কবিতাপ্রেমী। রহস্যগল্পের মধ্যে কবিতার অনুষঙ্গ। বাহ, কী দারুণ ব্যাপার!
বিদেশি রহস্য-সাহিত্যে বহুবার দেখেছি কাহিনির ভেতরে আরেকটা কাহিনি, উপন্যাসের ভেতরে আরেকটা কাল্পনিক উপন্যাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ("embedded narrative")। বাংলা সাহিত্যে এমন বস্তু এখনও আমার চোখে পড়েনি। এই উপন্যাসে সেই অভিনব শৈলীটিকে, সম্ভবত প্রথমবার ব্যবহার করা হয়েছে। বাহ, আরো দারুণ ব্যাপার!
গল্প এগোতে থাকে। দেখতে পেলাম, পাঠকের সস্তা মনোরঞ্জনের জন্যে রহস্যকাহিনির চিরাচরিত "escapist" ফর্মুলাগুলোর বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইস্যুকে টেনে আনা হয়েছে। সত্তরের দশককে বলা হয় "মুক্তির দশক"। শুধু তো মুক্তির দশক নয়, তোলপাড় করা ঘটনার দশকও বটে। নকশালবাড়ি আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলন, ভারতীয় গণতন্ত্রে "ইমার্জেন্সি"র অনুপ্রবেশ, আরো কতো কিছু। এইসব সমকালীনতাকে কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দিয়েছেন লেখক। বাহ, আনন্দে আমার প্রাণ আত্মহারা!
কিন্তু শ'খানেক পৃষ্ঠা এগোতেই মনটা খচখচ করতে লাগলো। একটু বেশি বকরবকর করছেন না লেখক? একই কথার, একই ঘটনার, একই জটিলতার বারবার পুনরাবৃত্তি করছেন না? গল্পের গতিও অত্যন্ত মন্থর। ছোটোবেলায় শীতকালের ভোরবেলায় টিউশানিতে যাওয়ার জন্যে যখন জোর করে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া হতো, তখন যেভাবে চোখ অর্ধেক বন্ধ করে ভ্যাবলার মতো দাঁত মাজতাম, সেইরকম মন্থর। ভাবলাম, কী জানি বাবা, এটা তো আর-পাঁচটা বাজারি রহস্য উপন্যাসের মতো ফালতু জিনিস নয়। এর মধ্যে পোস্টমডার্ন কবিতা, নকশাল আন্দোলন, লিটিল ম্যাগাজিন, এই সব বড়ো বড়ো সব ব্যাপার আছে, হুঁ হুঁ বাওয়া।
মাঝের দুশো পৃষ্ঠায় পৃথিবীর সর্বকালের জটিলতম জিলিপির প্যাঁচ তৈরি করেছেন লেখক। খুব ভালো কথা। জিলিপির প্যাঁচেও আমার কোনও আপত্তি নেই (আই ♥️ আগাথা ক্রিস্টি)। আমি তো রেডি হচ্ছি রহস্যের দুর্দান্ত উন্মোচনের জন্যে। ওহ হরিবোল, কোতায় গ্যালো তোমার নকশাল, কোতায় গ্যালো তোমার লিটিল ম্যাগাজিন, আর কোতায়ই বা গ্যালো মুহুর্মুহু কবিতার ব্যবহার। রহস্য উন্মোচনের বাহানায় একটা গোদা সাইজের রামধনু রঙের গরুকে ঠেলে ঠেলে গাছে তুলে দিয়েছেন লেখক। শেষমেশ যদি সেই গাঁজার চাষই করবে, তাহলে অ্যাতো সোশিও-কালচারাল কেরামতির কী দরকার ছিলো মশাই?
যিনি গোয়েন্দা, তিনি রহস্যের সমাধান কীভাবে করেছেন? উপন্যাসের একদম শেষের দিকে, যিনি অপরাধী, তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গোয়েন্দাকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন :
"আপনার এই সমস্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি কোথায়?"
গোয়েন্দাকে তো আর পাচ্ছি না, তাই লেখকের প্রতি আমারও একই প্রশ্ন। এই জটিল রহস্যের যেরকম হাস্যকর (এবং অবিশ্বাস্য) সমাধানটা আপনি পেশ করলেন, তার ভিত্তি কোথায়? নেই! কোনও ভিত্তি নেই! যেন স্বপ্নের ভিতরে রাতারাতি সমাধান খুঁজে পেয়েছেন গোয়েন্দা। শুধু খুঁজে পাননি, সিনেমার মতো চোখের সামনে পুরো ঘটনাটা পষ্ট দেখতে পেয়েছেন।
স্রেফ আন্দাজে! স্রেফ "ইনটুইশন" নামক ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে! বেশি কিছু বলতে পারছি না স্পয়লার দিয়ে দেওয়ার আশঙ্কায়, কিন্তু একটা যৎসামান্য ক্লুয়ের দড়ির উপর দাঁড়িয়ে যে অসামান্য মাদারির খেলা দেখিয়েছেন, স্বয়ং শার্লক হোমস থাকলে গোয়েন্দাকে বলতেন, "মা গো, মা জননী, আপনার এট্টুসখানি পায়ের ধুলো আমার মাথায় মাখিয়ে দিন, প্লিজ? ব্রো ওয়াটসন, ওরকম ফ্যালফ্যাল কোরে তাকিয়ে কী দেকচো? তুমিও মা জননীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করো! হ্যাঁ, শুয়ে পড়ো। একদম টানটান হয়ে মাটিতে শুয়ে প্রণাম করো!" 🙏🏼
তারপর বেহালা বাজিয়ে দুজনেই গলা ছেড়ে গান ধরতেন :
পাগলের দল জটলাতে আস্তানায় মজমাতে পট থিকা টোপলাতে ঝোলা থেইকা পোটলাতে জয় গুরু থেইকা জয় বাবা লোকনাথে বৈরাগী আন্ডারগ্রাউন্ড কলিকাতার ভূতনাথে...
ওপার বাংলার কেউ যে এরকম ভালো রহস্য উপন্যাস লিখতে পারবে ভাবতেও পারিনি। ম্যাগপাই মার্ডারসে গল্পের ভিতরে আরেকটা গল্প পড়েছিলাম, কিন্তু এটাতেও এরকম দেখে ভালো লাগলো, চ্যাপ্টারের শুরুতে বিভিন্ন কবিতা দিয়ে শুরু করাটাও বেশ সুন্দর লাগলো। লেখক যে কবিতাপ্রেমী বইটা পড়লেই বুঝা যায়।
তবে মাঝখানের অংশটাতে অনেকটা ত্যানা পেঁচিয়ে ফেলেছিল, যেটা না করলেও চলতো কিন্তু লাস্টের টুইস্টটা মারাত্মক ছিল। অনেকদিন কোন বই না পড়েও ৪০৩ পৃষ্ঠার এই বইটা একদিনে পড়ে শেষ করে ফেললাম।
জাপানিজ থ্রিলার এর মতো কে খুন করেছে সেটাতে ফোকাস না করে মূলত কেন এবং কিভাবে খুন করেছে সেটার স্টোরিটাই লেখক বলে গেলেন। অনেকদিন পরে কোন বই পড়ে বেশ ভালো লাগলো।
যদিও এটাকে আমি ৩.৫ স্টারের বেশি দিবোনা কিন্তু আমি পড়ে বেশ এনজয় করেছি তাই ৪ স্টার-ই দিলাম।
অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বইটা পড়লাম। ২০২৪ এ কেনা হলেও বিভিন্ন কারণে এই বই পড়া হয় নি। শেষে এবার শুরু করলাম এবং সিদ্ধান্ত নিলাম একটু একটু করে বইটা পড়ব আর নিজের মতো করে লজিক দাঁড় করিয়ে সিদ্ধান্ত নিবো। প্রথমে কিছু অংশ পরে যে সিদ্ধান্ত এসেছিলাম তাতে গল্পের ভিতরের গল্পের সমাধানের কিছুটা মিল ছিলো। এরপর বিভিন্ন ধাপে ধাপে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে এসেছি। যদিও আসল কাহিনী ধরতে পারি নি। যতই পড়ছি ততই এক লেয়ার থেকে আরেক লেয়ার এ যাচ্ছে আর পরতে পরতে নতুন নতুন রহস্য উন্মোচন হচ্ছে। ৩৪৮ পৃষ্ঠায় এসে যে সিদ্ধান্ত পাচ্ছিলাম তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল এটাই যদি আসল গল্প হয় তাহলে বইটা পড়াই বৃথা। কিন্তু না তারপর শুরু হলো আসল রহস্য উন্মোচন। গল্পের ভিতরের গল্প এবং আসল গল্প দুটোরই রহস্যের সকল ছেড়া সূতা একদম মিলে গেলো। পারফেক্ট ক্রাইম বা পারফেক্ট রহস্য যাকে বলে।শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য এতো সুন্দর ক্লাইমেক্স দিলেন যা পড়ে আমি রীতিমতো মুগ্ধ। নিঃসন্দেহে পাঁচ তারকা এবং থ্রিলার প্রেমীদের জন্য highly recommended।
এই বইটা সম্পর্কে একবাক্যে কিছু বলতে চাইলে একটা শব্দ প্রথমেই মাথায় আসে-অভিনব। রহস্যের মাঝে ডাবল লেয়ার.. গল্পের মাঝে গল্প... ৭০ এর দশকের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়.. অতীত-বর্তমান সবকিছু খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমার কবিতা পড়ার অতো একটা অভ্যাস নেই.. বইয়ে উল্লেখিত অনেক কবিকে নামে চিনলেও তাদের কবিতা পড়া হয়েছে কমই। হত্যা রহস্য উন্মোচনের পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক বর্ণনা.. ঘটনার পিছনের মূল কাহিনি সবই হৃদয় ছুঁয়ে যাবার মতো.. যদিও দিন শেষে খুন খুন-ই। খুন অবশ্যই ঘৃণ্য অপরাধ.. একে কোনভাবেই কোন যুক্তিতর্ক দিয়ে জাস্টিফাই করা যায় না, এমনকী উচিতও নয়।
এটাকে শুধুমাত্র একটা রহস্য উপন্যাস বলব না আমি, এটা বাংলা সাহিত্যের অনন্য এক সংযোজন। লেখকের স্টোরিটেলিংটা জাস্ট পাগল করে দিয়েছে। তয় পুরো উপন্যাসটা পড়ার সময় মনের মধ্যে একরকম খচখচ করছিলো। যারা কেইগো হিগাশিনোর 'ম্যালিস' পড়েছেন তাদের এরকম অনুভূতি আসতে পারে। কি সেই অনুভূতি সেটা বলে স্পয়লার নাই বা দিলাম। লেখক যা দিয়েছেন তাতে তাকে কুর্নিশ করতে বাধ্য। এমন কাজ আরো কিছু চাই, এই আশা লেখকের উপর রাখতেই পারি।
গত শতাব্দীর সাতের দশকের মাঝামাঝি দার্জিলিঙে প্রতিভাবান কবি অমিতাভ নিহত হন। তার কিনারা হয়নি। পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেলেও সমকাল এবং ভবিষ্যৎ সেই খুনের দায় তাঁর বন্ধু অরুণের ওপরেই চাপায়। চুয়াল্লিশ বছর কেটে গেছে। ইতোমধ্যে রহস্য ঔপন্যাসিক হিসেবে সুবিখ্যাত হয়েছেন অরুণ। দিল্লিবাসী সাংবাদিক তনয়া অমীমাংসিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সিরিজ শেষ করার লক্ষ্যে দার্জিলিং এসে অরুণ এবং সেই ঘটনার অন্য চরিত্রদের সঙ্গে কথা বলতে চান। প্রাথমিকভাবে আপত্তি জানালেও অরুণ পরে রাজি হন। আর তারপর...
সাম্প্রতিককালেই শুধু নয়, বেশ কয়েক দশকের মধ্যে বাংলায় সবচেয়ে সাড়া-জাগানো এই রহস্য উপন্যাসটির গড়ন খাঁটি ক্রিস্টীয়। নিছক অংক মেলানো নয়, বরং চরিত্রগুলোর মাধ্যমে একটা সময়কে মন্থন করা হয়েছে এতে। একেবারে উপরে ভেসে উঠেছে আপাত-সত্যের অমৃত, আর তার নীচে থেকে গেছে ঐরাবত থেকে চন্দ্র, অলক্ষ্মী থেকে হলাহল। প্রতিটি চরিত্র ধূসরের নানা শেডেও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে স্বমহিমায়। পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক, বৃষ্টি আর বিচিত্র পোকায় ভরা শৈলশহর— এই স...অ...বকিছু ভীষণভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে এতে। তবে এর প্রকৃত শক্তি এবং দুর্বলতা লুকিয়ে আছে রহস্যে।
শক্তির জায়গাটা কী? প্রথমত, ইম্পসিবল ক্রাইম বা লকড-রুম মিস্ট্রি আসলে কীভাবে ঘটে বা ঘটানো হয়, সে-বিষয়ে "দ্য থ্রি কফিনস্" বইয়ে গিডিঅন ফেলের মুখে জন ডিকসন কার একটা ছোটোখাটো প্রবন্ধই বসিয়ে দিয়েছেন। তাতে মূলত আটটা পদ্ধতি বা প্রকরণের উল্লেখ আছে, যা দিয়ে খুনির ভূমিকায় অবতীর্ণ জাদুকর দর্শককে অন্যদিকে চোখ-কান দিতে বাধ্য করে তার হাতসাফাইটি সারে। হ্যাঁ, এই ধরনের রহস্যকাহিনি তায় প্রায়শই জীবনের আসল আখ্যান ছেড়ে একটা বিভ্রম বা ইলিউশনকেই সযত্নে নির্মাণ, তারপর বিনির্মাণ করে। আলোচ্য উপন্যাসে লেখক সেই বিভ্রমের নির্মাণ ও বিনির্মাণের প্রক্রিয়াটি— সে-ও আবার তিনবার— করে দেখিয়েছেন। এর আগে কোনো বাংলা উপন্যাস এমন কিছু করেছে বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, এই উপন্যাসের হত্যাকাণ্ড আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও ক্রমে উন্মোচিত হয় এর প্রবলভাবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি। সেই প্রেক্ষাপট নির্মাণের জন্য এতে যেভাবে সাতের দশকের কবিতা— তা-ও আবার লিটল ম্যাগাজিনের মতো ঘোরতর অবাণিজ্যিক মাধ্যমে প্রকাশিত এবং অধুনা বিস্মৃত বা লুপ্ত— ব্যবহৃত হয়েছে, তা নজিরবিহীন। হত্যার মতো একটি ক্রূর প্রক্রিয়াও যে রাজনীতি ও ক্ষমতার লোভের ফলে আগুনের মতোই সহজে সবকিছু পুড়িয়ে ফেলতে পারে, অঅত্যন্ত অনুচ্চ কণ্ঠেও তা বোঝানোর জন্য এই কবিতাগুলো প্রায় স্নাইপারের বুলেটের মতোই কার্যকরী হয়েছে। তৃতীয়ত, উইটগেনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী রহস্যভেদীর বর্গীকরণ করলে আমরা মূলত দুটি মডেল পাই। তার একটিতে থাকেন শার্লক হোমস বা এরকুল পোয়ারোর মতো গোয়েন্দা— যাঁরা নিরাসক্ত, নির্মোহ এবং একমাত্র রহস্য সমাধানের প্রতিই দায়বদ্ধ। অন্য মডেলে আসেন কন্টিনেন্টাল অপ, মার্লো, বা লিউ আর্চারের মতো গোয়েন্দারা— যাঁদের কাছে সত্যসন্ধান একটা ব্যক্তিগত এবং প্রায়শ আত্মানুসন্ধান হয়ে দাঁড়ায়। এই উপন্যাসে তনয়া বারবার দাবি করেছেন যে তিনি একটা "স্টোরি" করতে এসেছেন। কিন্তু কাহিনি যত এগিয়েছে, আমরা ততই অনুভব করেছি যে এ শুধুই এক স্যাঁতসেঁতে ঠান্ডা শহরে চুয়াল্লিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া খুনের গপ্পো নয়। তনয়া তাঁর ফেলে আসা, অথচ দুঃস্বপ্ন বা হাতের পোড়া দাগে টিকে থাকা দিনগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকা কল্পনা ও বাস্তবকে আলাদা করার জন্যও অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন— সে যে-ই হুমকি দিক, বা যত বাধাই আসুক। এই যে দু ধরনের রহস্যভেদীকে অদ্ভুতভাবে মিশিয়ে দেওয়া, এমনটিও কি আমরা এর আগে বাংলায় দেখেছি? চতুর্থত, অত্যন্ত সহজ ও নির্মেদ ভাষায় লেখা এই উপন্যাস গোল্ডেন-এজ মিস্ট্রির প্রতি সার্থক শ্রদ্ধার্ঘ্যও বটে। ভাষার টানে, দার্জিলিঙের প্রতি চিরন্তন অনুরাগে আচ্ছন্ন হয়ে, চরিত্রদের সূক্ষ্ম ঘাত-প্রতিঘাতে গড়ে ওঠা নকশায় মজে আমরা হয়তো ব্যাপারটা খেয়াল করি না। কিন্তু এই উপন্যাসের একেবারে শুরু থেকেই যাবতীয় ক্লু আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। হ্যাঁ, তাদের প্রায় প্রতিটির সঙ্গে থেকেছে রেড-হেরিঙের বর্ণাঢ্য উপস্থিতিও। কিন্তু রহস্য কাহিনির নিজস্ব জ্যামিতিক গঠন যাঁরা অধ্যয়ন করেন (সত্যিকারের রহস্যলেখক ও পাঠক), তাঁরা একেবারে সোল্লাসে বুনো হাঁসের ভিড় থেকে আসল পাখিদের চিনতে পারবেন। তাঁদের কাছে বইটা ফুল-কোর্স ডিনারের চেয়ে কম কিছু হবে না।
এবার উপন্যাসের দুর্বলতার কথায় আসি? প্রথমত, শ্যান্ডলার ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে হওয়া হত্যাকাণ্ডের ক্রিস্টীয় সমাধানটির উপর খড়্গহস্ত ছিলেন। কেন জানেন? তাঁর বক্তব্য ছিল, এ-জিনিস জাস্ট হয় না। হত্যা কোনো সূক্ষ্ম শিল্প নয়, হত্যাকারীও দুর্মূল্য গালিচায় নকশা ফুটিয়ে তোলার মতো করে সেই লক্ষ্যে আদৌ এগোয় না। হ্যামেটের ভূয়সী প্রশংসা করে শ্যান্ডলার বলেছিলেন, খুনকে ওইরকম সূক্ষ্মতা ও জটিলতায় ভরা অবাস্তবতার সাজঘর থেকে বের করে পথের ধারে আর নর্দমার বাস্তবতায় নিয়ে এসেছেন হ্যামেট। এই উপন্যাসের আসল জিনিস, অর্থাৎ খুনটা এতই অসম্ভাব্য যে শ্যান্ডলার-কথিত অবাস্তব সাজঘরের কথাই মনে পড়ে। দ্বিতীয়ত, হিগাশিনো আমাদের দেখিয়েছেন, রহস্য উপন্যাসে হত্যাকাণ্ডের সমাধান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভর করে ছোটো-ছোটো অসংগতির সমাধানের ওপর। এই উপন্যাসে বক্তাদের ন্যারেটিভের বিশাল বড়ো-বড়ো বেশ কিছু অসংগতি দূর করায় তৎপর হয়েছেন লেখক। সেই অসংগতির জায়গাগুলো বানাতে গিয়ে কাহিনিটি যে আরও বেশি অসম্ভাব্য বর্ডারিং অন গাঁজাখুরি হয়ে পড়েছে, তা-ও তিনি মেনে ও মানিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু আসল জিনিস— অরুণের হাতের আঁচড়ের গুরুত্ব— তিনি আদৌ ব্যাখ্যা করেননি। নাকি এ-ও ছিল শ্যান্ডলারের উদ্দেশেই তাঁর এক তির্যক শ্���দ্ধার্ঘ্য, যেহেতু মার্লোর স্রষ্টাও 'দ্য বিগ স্লিপ'-এ একটি হত্যার কোনো ব্যাখ্যাও দেননি, হত্যাকারীকে চিহ্নিতও করেননি? তৃতীয়ত, কোল্ড কেসে শেষ অবধি সবই স্পেকুলেশন— এ-তো চৈতন্য থেকে নেতাজি, সবাইকে নিয়ে গবেষণা-করা মানুষেরাই জানেন। তার বেশিরভাগ তথ্যপ্রমাণই সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স বা হিয়ার-সে গোত্রীয়— যাদের আদালত খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। এই উপন্যাসেও শেষ অবধি সব যুক্তি আর তক্কোর পর আমরা যা পেয়েছি তা স্রেফ গল্প। তার কোনোটার ভিত্তি একটি অসমাপ্ত উপন্যাস, কোনোটি অর্ধসত্য, কোনোটি মিথ্যা, আর কোনোটি যুক্তিনির্ভর কল্পনা। হার্ড এভিডেন্স? কিচ্ছু নেই। আছে শুধু একরাশ সন্দেহ। আর ঠিক এই জায়গাতে এসেই আমি সন্দিহান হয়ে পড়েছি।
লেখক কি আদৌ রহস্য উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন? নাকি কিছু ধূসর চরিত্র আর একটা বৃষ্টি ও কুয়াশায় মোড়া শহরের অতীত-বর্তমান নিয়ে জীবনের রহস্যময় রূপটা আমাদের কাছে তুলে ধরাই ছিল তাঁর লক্ষ্য? সেজন্যই কি সাতের দশকের সেইসব কবিতার ব্যবহার করেছেন তিনি— যেখানে পুরাণের বীজ আর চিরন্তন কিছু চিত্রকল্পের কাঠামো দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছিল লাল-কালো সমকালকে? সেভাবেই কি এই উপন্যাস গত শতাব্দীর মৃতবৎসা সাতের দশক এবং ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ের হিসেবে চলা বর্তমান নিয়ে লেখকের যাবতীয় ভাবনার মূর্ত প্রতিমা গড়ে দিয়েছে? হয়তো। হয়তো নয়। হয়তো লেখক সচেতনভাবেই বাংলা রহস্য উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক স্থাপন করেছেন। হয়তো তিনি ব্যক্তিগত ভাবনার প্রকাশ-অপ্রকাশ ঘটিয়ে তাই নিয়ে আমাদের মুগ্ধতা ও বিশ্লেষণ দেখে মুচকি হাসছেন। কে জানে!
বইটাতে বিস্তর টাইপো আছে। এতদিনে নিশ্চয় এটির আরও অনেক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে এই ত্রুটিগুলো সংশোধন হয়েছে— এমন আশা রাখি। শেষ কথা: বইটি নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে একটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ও উপভোগ্য সংযোজন। আপনি এটিকে রহস্যকাহিনি হিসেবে পড়লে হয়তো গোগ্রাসে গিলবেন, তারপর যত ভাববেন, তত নানা বিষয় নিয়ে খচে বোম হবেন। তাই বিনীত পরামর্শ দিই, এটিকে স্রেফ একটি গল্প হিসেবে পড়ুন। অদ্বিতীয় কিছু চরিত্র পাবেন। গতিময় অথচ কাব্যিক এক অনন্য গদ্যে বহু বর্ণনা ও স্মরণীয় সংলাপ পাবেন। দুর্দান্ত কিছু কবিতার সন্ধান পাবেন। মাথা খাটানোর সুযোগ পাবেন বিস্তর। আর শেষ করার পর হয়তো ভাববেন, "মানুষের ব্যবহারে আজও রঙ্গ আছে, চৈতন্যে রহস্য আছে— পাশাপাশি এইসব থেকে গেছে, বড়ো দীর্ঘযাত্রার পর ক্কচিৎ রুপোলি রেখা দৈন্য আরও ঘনীভূত করে।" (পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের 'বন্দনা বিলাপ ধ্বনি' থেকে) এমন একটি বহুমাত্রিক, বিচিত্র ভাবনা-জাগানিয়া উপন্যাস লেখার জন্য লেখককে আভূমি সেলাম জানাই।
মার্ডার মিস্ট্রি নিয়ে বাংলা ভাষার এত সুন্দর থ্রিলার ঠিক কবে পড়েছি বলে মনে পড়ে না। একফোটাও বাহূল্যহীন, রূদ্ধশ্বাস বইটি সব পাঠকের কাছেই ভালো লাগবে বলে মনে করি। পরে হয়ত বিস্তারিত রিভিউ লিখব। এখনো থ্রিলারটির রেশ কাটে নি।
দার্জিলিং! এমনিতেই আমার পছন্দের সাহিত্যপটভূমি। সাহিত্যপটভূমি এই কারণে বলছি যে এখনো পা দিতে পারিনি। তাই প্রিয় জায়গা বললাম না। যাই হোক, দার্জিলিং এর পটভূমিতে একটা রহস্যোপন্যাস, কুয়াশাঘেরা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহ, প্রচণ্ড শীত এর যেকোন একটা বিষয়ই তো একটা বইকে উপভোগ করার জন্য যথেষ্ট। এদিকে বাস্তবেও শীত। ফলে খুব আরাম করে পড়া গেছে৷ বইটির প্রচ্ছদ, ছাপা, ফন্ট সবকিছুই এত্ত ভালো! এবার আসি উপন্যাসটি কেমন সে প্রসঙ্গে। তনয়া ভট্টাচার্য নামে একজন সাংবাদিকই এখানে সত্যান্বেষীর ভূমিকায়। অমিতাভ মিত্র আর অরুণ চৌধুরী দুই লেখক বন্ধু। প্রথমজন পাগলাটে, কবি। দ্বিতীয়জন উচ্চবংশীয়, রহস্য লেখক৷ বন্ধুত্ব তাঁদের প্রবাদপ্রতিম। কিন্তু অমিতাভ মিত্র খুন হয়ে যান আর সন্দেহ এসে পড়ে অরুণ চৌধুরী এর উপরই। যদিও অ্যালিবাই শক্ত থাকায় তিনিও ছাড়া পেয়ে যান৷ কিন্তু ৪৪ বছর ধরে পাঠকসমাজে এ প্রশ্নের মুখোমুখি তাঁকে অনেকবারই হতে হয়েছে। কিন্তু এত বছরেও উদঘাটিত হয়নি সত্যি। সেই সত্যিকেই সিরিজ আকারে ছাপার জন্য আসল গল্পটা খুঁজতে দার্জিলিং এ পা রাখেন তনয়া। গল্পের শেষ ৫০ পৃষ্ঠাই আসলে টুইস্টে ভরপুর, সম্পূর্ণ একটা রহস্য বাকি ৩৫০ পৃষ্ঠা জুড়ে ধীরে ধীরে যে রূপ নিচ্ছিল, শেষ দিকে তা দুমড়ে মুচড়ে যায়৷ রহস্যোপন্যাস হিসেবে এখানেই এই বইটির সার্থকতা। কিন্তু একটা সত্যিকারের উপন্যাস হিসেবে, সাহিত্যিক গুণাগুণ ও সম্পূর্ণভাবে বজায় ছিল এতে। সস্তা চটুল থ্রিলার উপন্যাসের চাইতে এটি অনেক আলাদা। দার্জিলিং এর অসাধারণ প্রকৃতির পাশাপাশি, কবিতা, চিঠি, উপন্যাসের মধ্যে আরেক উপন্যাস, লেখকের সচেতন শব্দচয়ন, কাব্যের মাধ্যমে ক্লু ইত্যাদি উপন্যাসটিকে আলাদা করে ফেলেছে অন্য উপন্যাসগুলোর থেকে৷ খুব বেশি ইতিহাস বা তথ্যের কচকচানি নেই। গল্পের প্রয়োজনেই দার্জিলিং ব্যবহৃত হয়েছে সুন্দরভাবে। নেই অযথা সেক্সুয়াল বা এমনি কোন ভায়োলেন্স, নেই মাখো মাখো কোন প্রেম৷ আপাদমস্তক একটা রহস্যোপন্যাস কিন্তু লেখকের লেখনশৈলী, ভাবনা আর দর্শনে বইটি অন্য আলোয় জ্বলজ্বল করে৷
কলকাতার কিছু থ্রিলার পড়ে,দীর্ঘদিন আর ওমুখো হওয়ার সাহস পাইনি। টাকা, সময় দুটোর এমন নিখাদ অপচয় কমই হয়েছে আমার। ফলে, শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের এই বইটাও হয়তো এড়িয়েই যেতাম। কেন জানি কিছু বিশ্বস্ত রিভিউ দেখে মনে হচ্ছিল, সাহস করে একবার পড়ে ফেলা যায়। হয়তো...হয়তো ভালো কিছু হলেও হতে পারে। তারপর এক বর্ষামুখর রাতে শুরু করলাম ‘শেষ মৃত পাখি’। শুরুতেই লেখক একটানে নিয়ে ফেললেন দার্জিলিঙে। তারপর কেবল মুগ্ধতা। অবাক হয়ে দেখলাম, কবিতা নিয়ে শাক্যজিৎ কি অসাধারণ এক কাজ করেছেন বইয়ে। রহস্য আর কবিতা এখানে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে গোটা সময়। অদ্ভুত সুন্দর সব দৃশ্যকল্প চমকে দিচ্ছিল বারবার। তনয়ার সাথে আমিই যেন হাঁটছিল বর্ষণমুখর দার্জিলিঙে। পাইনের গা বেয়ে নেমে আসা কুয়াশায় হারিয়েছিলাম পথ। আবার আমিই যেন সমাধান করেছি এক অভূতপূর্ব রহস্যের।
রহস্য গল্প কম পড়া হয়নি। সুতরাং বারবার ধরতে চেষ্টা করছিলাম এটার ক্লাইম্যাক্স কী হতে পারে। কয়েকবার মনে হয়েছে চূড়ান্ত পরিণতি বুঝি ধরেই ফেললাম। কিন্তু... এখানে ওখানে অসংখ্য সূত্র ছড়িয়ে রাখলেও,আসল খেলাটা খেলেছেন শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য। আর যেভাবে গল্পের যবনিকা টানলেন,ভদ্রলোককে টুপি খোলা সেলাম জানাতে হবে। দার্জিলিঙয়ের প্রেক্ষাপটে অভূতপূর্ব এক থ্রিলার পড়তে চাইলে,অনায়াসে ‘শেষ মৃত পাখি’ পড়ার পরামর্শ দিব।
পশ্চিমবঙ্গের গত বছর দশেকের থ্রিলার-মিস্ট্রি-হরর ধারার লেখকদের সাথে যদি পূর্ববঙ্গের একই ধারার লেখকদের তুলনা করি, তাহলে গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে দেখতে পাই, পশ্চিমের লেখকদের লেখনশৈলী অনেকটাই ভাল। ভাল বলতে পরিণত বোঝাচ্ছি না, বোঝাচ্ছি যে, পড়তে ভাল লাগে। শব্দের পর শব্দের পর বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে তাদের বেশিরভাগই আবহ এবং পরিবেশটা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন (এনাদের অন্য সমস্যা আছে, সেটায় পরে আসছি)। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, একই সময়কালে পূর্ববঙ্গের বেশিরভাগ এই ধারার লেখকেরই বাক্যশৈলী দেখলে মনে হয়, এনারা প্রাইমারি স্কুলের বাংলা লিখছেন। এদের কাহিনীতে নতুনত্ব বেশি, ট্যুইস্ট বেশি, এক্সপেরিমেন্ট করার সাহস বেশি, কিন্তু লেখার ধরণ এতটাই শিশুতোষ যে, প্রচুর হোঁচট খাওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত পৌঁছানো একটা যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। ওদিকে পশ্চিমের লেখকদের অনেকের কাহিনীতে গোঁজামিল, বা অতি সাধারণ প্লট থাকলেও, লেখার গুণে পড়ে ফেলা যায়। দুই বাংলার মিল একটাই, গড় রেটিং দিতে হলে পাঁচের ভেতর আড়াই বা তিনের মাঝেই থাকতে হয়। পড়ার পরেও দীর্ঘদিন মনে থাকবে, এমন লেখার সংখ্যা হাতেগোণা। শাক্যজিতের 'শেষ মৃত পাখি'-কে এই হাতেগোণার মাঝে ফেলা গেল না, সম্ভাবনা থাকার পরেও। কাহিনি যদিও পুরানো একটা খুনকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে, কিন্তু মোটিভ আর প্রেক্ষাপটে নতুনত্ব ছিল। চমৎকার ছিল আবহ আর প্রেক্ষাপট নির্মাণ। এমনকি শেষের দিকে কোন গোঁজামিলও দেয়া হয়নি, পুরোটাই বিশ্বাসযোগ্য। তারপরেও ৩-এর বেশি যেতে পারলাম না, তার কারণ পশ্চিমবঙ্গের এই ধারার নতুন লেখকদের অত্যন্ত বিরক্তিকর একটা স্বভাব--লেকচার, লেকচার, লেকচার। এনারা নিজেদের যদি গুরুমশাই মনে করেই থাকেন, সেক্ষেত্রে প্রবন্ধের লিটল ম্যাগে লিখলেই পারেন, গল্প-উপন্যাস লিখতে আসার কি দরকার? মানছি যে, এই গল্পের কাহিনীর সাথে কবিতার একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগ আছে, কিন্তু সেজন্য খুন হওয়া কবি অমিতাভ-এর চিঠিপত্রের নামে কবিতা আর সাহিত্যের উপর যে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেকচার পাঠককে খাওয়ানো হল, সেটা ক্ষমার অযোগ্য। ফিকশন আর নন-ফিকশনের মাঝে খুব পরিস্কার একটা সীমারেখা আছে, গল্প লিখতে চাইলে গল্পই লেখা উচিত, নিজের জ্ঞান বা মতামত ফলানো নয়, এটা এনাদের কে বোঝাবে? আরেকটা ব্যাপার হলো, প্রটাগনিস্টের চরিত্রটা ঠিক সেভাবে ডেভেলপ করেনি, কাজেই একে নিয়ে আরেকটা উপন্যাস পড়ার আগ্রহ জন্মায় না। রহস্যের সমাধানটা খুবই যুক্তিযুক্ত, কিন্তু সেখানটায় এসে লেখার সব কারুকার্য উবে গিয়ে অংশটুকু হয়ে গেছে সরকারি রিপোর্টের মত। কাজেই, যা বলছিলাম, গড়পড়তা ৩। তবে, এটাও বলবো, কাহিনীর জন্যই রহস্য কাহিনীর পাঠকদের জন্য এটা অবশ্যপাঠ্য।
বৃষ্টিভেজা দার্জিলিঙের এক রক্তরাঙা রহস্য উপন্যাস। তনয়া, এক তরুণী সাংবাদিক, যার কাজ অমীমাংসিত খুনের গল্প খুঁজে বের করা। কিন্তু এবারের কেসটা শুধু কোনো সাধারণ খুন নয়—এটি দার্জিলিংয়ের এক প্রহেলিকাময় হত্যাকাণ্ড, যা ৪৫ বছর ধরে রহস্যে ঘেরা। ১৯৭৫ সালে দার্জিলিঙের বুকে ঘটে যাওয়া কবি অমিতাভ মিত্রের রহস্যজনক মৃত্যু আর ২০১৯ সালে সাংবাদিক তনয়ার অনুসন্ধান একসাথে বুনে দেয় এক মায়াবী জাল।
যদি আপনি গোয়েন্দা গল্পের পাশাপাশি সাহিত্যিক গভীরতা চান, অথবা দার্জিলিঙের মায়া অনুভব করতে চান, এই বই আপনার জন্য।
ওপার বাংলার দারুণ একটা থ্রিলার বই পড়লাম। বেশ সময় নিয়ে পড়লাম। মাঝে একটু অসুস্থ হওয়ার কারনে পড়াশোনাতেও রেস্ট ছিলো কিন্তু বইয়ের সাথে দীর্ঘ এক সপ্তাহ বেশ ভালো সময় কেটেছে। মাঝেমধ্যে কিছু জায়গায় মনে হয়েছে বইটা আরেকটু ছোট হতে পারতো বা কিছু যায়গায় বাড়তি লেখা মনে হয়েছে কিন্তু আবার আরেকটু পড়ার পরেই মনে হয়েছে যা লেখা হয়েছে কাহিনীর প্রয়োজনেই এবং সবকিছুই যথোপযোগী। প্লটটা যেমন ইন্টারেস্টিং, গল্প বলার ধরনটাও ভালো লেগেছে। সবমিলিয়ে দুর্দান্ত একটা থ্রিলার বই। রহস্য গল্প যাদের পছন্দ আশা করি কেউ আশাহত হবেন না। গল্পের ভেতরে গল্প কিংবা বর্তমান সময়ের রহস্যভেদ সবকিছুর বিবেচনায় বইটা আসলেই মনে রাখার মতো। সালমান ভাইয়ের রিভিউ এর সাথে মিল রেখে আমিও বলতে চাই বইটা আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
দেশের এক উত্তাল পরিস্থিতিতে এমন একটা উপন্যাস শেষ করলাম যা আরেক উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে। উপন্যাসের শুরুতেই আমরা এমন এক সাংবাদিককে দেখতে পাই যিনি ৭০ দশকের এক উদীয়মান জনপ্রিয় কবি অমিতাভের হত্যা নিয়ে রিপোর্ট করতে আসেন দার্জিলিং। এই ব্যাপারে তার শরণাপন্ন হতে হয় অমিতাভেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু অরুণ চৌধুরীর কাছে। তার অনুমতিক্রমে নিজের রিপোর্ট নিয়ে কাজ শুরু করে সাংবাদিক তনয়া। অরুনের কাছে তনয়া আবার অমিতাভের লেখা একটা অসমাপ্ত ক্রাইম উপন্যাস পায় যেখানে কিনা অমিতাভ নিজের আগত হত্যা নিয়ে ধারণা দিয়ে যান। এরকম উপন্যাসের মাঝে গল্প এর আগে ম্যাগপাই মার্ডাসে পেয়েছিলাম। বইটা পড়তে পড়তে উঠে আসে নকশাল অন্দোলনের সেই উত্তাল সময় আর তৎকালীন পুলিস বাহিনীর নজিরবিহীন অত্যাচার। পুলিসের এই অত্যাচার বর্তমান বংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের উপর হামলার সাথে বেশ মিল রয়েছে।
সে সময়ের কবিদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে খুব সুন্দর এনালাইসিস পড়লাম বইটাতে। বইটা অত্যন্ত সুলিখিত। ক্রাইম উপন্যাস অনেকদিন ধরেই পড়ছি। কিন্তু ক্রাইম উপন্যাস যে সাহিত্য হয়না সে তকমা লেখক ঝেড়ে ফেলতে পেরেছেন বলেই আমার মতামত। বেশ সময় নিয়ে লেখা বইটা বোঝা যায়। আর লেখকের ব্যাপক কবিতাপ্রীতি বইটা পড়লে বোঝা যায়।
অর্কের দুর্দান্ত রিভিউ পড়ার পর থেকে বইটি পড়বার তর সইছিলোনা। এক বন্ধুকে ফুসলিয়ে বইটি কেনালাম এবং এর জন্য এখন মোটেও অনুতাপ হচ্ছেনা। বরং মহৎ একখান কর্ম করলাম বলে আত্মতুষ্টি বোধ করছি।
' শেষ মৃত পাখি' রহস্য কাহিনী হলেও আদতে এটি সিরিয়াস সাহিত্য। বাংলা কবিতা আর হত্যা-রহস্যের আদলে মানব মনের গভীর রহস্যময় দিক যা তমসাময় তার উন্মোচন শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য উক্ত বইতে করেছেন। শাক্যজিৎ এর গদ্যভাষা অত্যন্ত সাহিত্যমান সম্পন্ন। উপন্যাসের ন্যারাটিভ, কাহিনীর পরত খোলাসা দুর্দান্ত। সাধারণত রহস্যকাহিনী একবারের বেশি পড়ার মতো না কিন্তু এই উপন্যাস পুনর্পাঠের যোগ্যতা রাখে। রহস্য তো প্রকৃতপক্ষে কবিতা কিংবা কবিতা ই রহস্যের চূড়ান্ত রূপ।
৪.৫ সমকালীন সময়ে পড়া মার্ডার মিস্ট্রিগুলোর মাঝে 'শেষ মৃত পাখি' কে আলাদাভাবে উল্লেখ করবো। শুধু রহস্য ও রোমাঞ্চকর প্লটের জন্য নয়; এগুলোর পাশাপাশি শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের ভাষা ও গল্প বয়ান বেশ চমৎকার হবার কারণে এই দীর্ঘ উপন্যাস আরও উপভোগ করা গেলো।
“খুন হল একটা শিল্প। আর গোয়েন্দা হল সেই শিল্পের ক্রিটিক। সমালোচক যেমন শিল্পকর্মের ভেতর থেকে লুকানো নানা চিহ্ন খুঁজে খুঁজে ব্যাখ্যা করেন, গোয়েন্দাও একটা হত্যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন ক্লু খুঁজে খুঁজে হত্যার ব্যাখ্যা দেয়। শুদ্ধতম শিল্প কী? ব্যাখ্যার অতীত। কবির কথায়, অবাঙ্মনসগোচর। ব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন যে নাদ, অথবা ভ্যান গঘের ছবিতে একপাশ থেকে এসে ঠিকরে পড়া এক অপার্থিব আলো। শুদ্ধতম খুন কী? একইরকম। ব্যাখ্যার অতীত।”
কবিতা কি বোঝার জিনিস? নাকি উপলব্ধি করার? বোঝা আর উপলব্ধির মধ্যে পার্থক্য কী? এসব নিয়ে তর্ক হতে পারে৷ কিন্তু কবিতা বুঝি আর না বুঝি, উপলব্ধি করি বা না করি, কবিতার প্রতি অবসেসড, সুন্দর সুন্দর শব্দের প্রতি প্রবল ফেসিনেশন, সেই ছোটবেলা থেকেই ছিল। কোনো সিনেমা বা নাটকে কবিতার ব্যাবহার আমাকে মুগ্ধ করে। অন্যদের কাছে যেটা নেহাতই ফালতু লাগে, সেই জিনিসও আমার পছন্দের শীর্ষে উঠে আসে যদি সেখানে কবিতা আসে বার বার। একই কথা খাঁটে বইয়ের ক্ষেত্রেও। সাহিত্যে প্রবন্ধ আমার পছন্দের একটা ঘরানা৷ কবিতা এবং কবিদের নিয়ে লেখা ডকু-ফিকশন ভালো লাগে আরও বেশি। কারণ সেখানে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকে কবিরা এবং তাদের কবিতার ব্যাখা। কবিতা ছাড়া আরেকটা জিনিসের উপর আমি চরম অবসেসড। বৃষ্টি। হুমায়ূন আজাদ লিখেছিলেন, "সৌন্দর্য যেভাবে থাকে সেভাবেই সুন্দর"। বৃষ্টির ক্ষেত্রেও তাই। আমার কাছে বৃষ্টি সিনেমায় সুন্দর, গানে সুন্দর, বইয়ে সুন্দর। বৃষ্টি যেখানে যেভাবে থাকে সেভাবেই সুন্দর। অর্ক ভাই তার রিভিউতে " থুম্বাড়" সিনেমার সেটের কথা উল্লেখ করেছেন। ভিতরে বৃষ্টি, বাইরে বৃষ্টি, সিনেমায় বৃষ্টি, বইয়ে বৃষ্টি। সবখানেই বৃষ্টি। এই বৃষ্টির জন্যই সিনেমাটা অনেকদিন মনে থাকবে। বৃষ্টি নিয়ে আমার অবসেসন প্রবল। যখন পড়ি 'জল পড়ে পাতা নড়ে' বা 'এসো করো স্নান নবধারা জলে' তখন আমার ভালোলাগে। সিনেমায় যখন বৃষ্টির দৃশ্য দেখি তখন আমার ভালোলাগে। আবার বইয়ের পাতায় যখন পাহাড়ি বৃষ্টির বর্ণনা পাই মনে হয় আমিও যেনো হেঁটে চলেছি পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তার ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে। আমার মনে পড়ে ইন্টার লাইফে বান্দরবানে কাটানো সময় গুলোর কথা। পাহাড়ি বৃষ্টির যে কত রুপ আর বৃষ্টির যে এত সৌন্দর্য সে তখনই বুঝেছিলাম। আমার পছন্দের সবকিছুই যেনো শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য এই বইয়ে তুলে এনেছেন। সত্তরের দশকের কবি এবং কবিতা। বৃষ্টিস্নাত দার্জিলিং। অদ্ভুত সুন্দর পোয়েটিক স্টোরিটেলিং আর চমৎকার টুইস্ট এই বইটাকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে। এমন অদ্ভুত সুন্দর কিছু উপহার দেওয়ার জন্য লেখককে একটা টুপি খোলা কুর্ণিশ।
"মানুষের মৃত্যু হ’লে তবুও মানব থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে" -জীবনানন্দ দাশ
মহাভারতের যুদ্ধের কথা সকলে কমবেশি জানি। আর কৌরব এবং পান্ডবদের গুরু দ্রোণাচার্যকে চেনার কথা। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে গুরু দ্রোণাচার্য যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন তখন তাকে বধ করা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। আমাদের উপন্যাসের খাতিরে বধ করা জরুরি নয়, বধ করার প্রক্রিয়াটা জরুরি। শ্রীকৃষ্ণের সাথে আলোচনা করে এগিয়ে গেলেন যুধিষ্ঠির। আমরা যাকে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির বলে জানি। যে কখনো মিথ্যা বলে না। গুরু দ্রোণের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, "অশ্বত্থামা হত, (ইতি গজঃ)"। অশ্বত্থামা হত জোড়ে বলার পর, ইতি গজ বলেছিলেন খুব ধীরে। যার ফলে গুরু দ্রোণ শুধু "অশ্বত্থামা হত" শুনতে পেয়েছিলেন। অন্যদিকে ভীম সত্যিই অশ্বত্থামা নামের এক হাতিকে বধ করে ফেলেছিলেন। গুরু দ্রোণ জানতেন যুধিষ্ঠির কখনো মিথ্যা বলেন না। নিজ পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ শুনে অস্ত্র ত্যাগ করলে তখন তাকে দ্রুপদ রাজার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণের শিরশ্ছেদ করেন। এইখানে যুধিষ্ঠির অর্ধসত্য বলেছিলেন।
উপরের ঘটনার উপমা টেনে আনার কারণ হয়তো বইটি যারা শেষ করেছেন তারা ভালোভাবে ধরতে পারবেন। অন্যদের জন্য ধাঁধা। উপন্যাসের ভিতরে আবার উপন্যাস! এমন জটিল এবং অদ্ভুত সুন্দর লেখার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল কয়েকবছর আগে ব্রিটিশ লেখক অ্যান্টনি হরোউইটয্ এর 'ম্যাগপাই মার্ডার্স' এর মধ্য দিয়ে। এবং সত্যি বলতে পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম, কারণ এভাবেও যে উপন্যাস লেখা যায় সেই ধারণটা ততদিনে মগজে আসেনি। তারপর শুনেছি বাংলা ভাষাতে এইরকম বই বের হয়েছে। কিন্তু কেন যেন কিনি নাই। তারপর এইবছরের শুরুর দিকে চোখ আটকায় শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের লেখা 'শেষ মৃত পাখি' বইটির উপর। পরিচিত মহলে অনেকের পর্যালোচনা দেখে কিছুদিন আগে কলেজস্ট্রিট থেকে তুলে নিয়েছিলাম বইটি। এইতো গেলো বইটির সাথে আমার পরিচয়ের ঘটনা।
এবার আসি পর্যালোচনায়। জনরার ভিত্তিতে ক্রাইম থ্রিলার, মার্ডার মিস্ট্রি। কিন্তু জনরাতে আটকে না থেকে লেখক তৈরি করেছেন আলাদা একটি সুবিশাল জগৎ। সেই জগতের অংশ হয়ে উঠেছে বাকি সবকিছু। সত্তরের দশকের একজন কবি খুন হয়ে গেলেন। এই খুন হওয়া কবিকে জানতে হলে কিংবা বুঝতে হলে আপনাকে বুঝতে হবে সেই দশকের কবিদের, কবিতাদের। চারিদিকে নকশাল আন্দোলনের তোরজোর এর মাঝে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। তবে পশ্চিমবঙ্গের কবিদের কলম ততদিনে চলতে শুরু করেছে একটি স্রোতের গতিতে। লেখাতে উঠে এসেছে বিপ্লবের ডাক, নীরব হুংকার। যে কবি নীরব এবং অরাজনৈতিক তিনিও সেই স্রোতে নীরবে গা ভাসালেন। উপন্যাসের সেই কবি অমিতাভ মিত্র ব্যাতিক্রম নয়। কুয়াশা মোড়ানো শহর দার্জিলিংয়ে বসে সেও গা ভাসালো। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে একদিন খুন হয়ে গেলো অমিতাভ মিত্র আর দায় চাপলো তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু অরুণ চৌধুরীর উপর। আর এইখান থেকেই আমাদের গল্পের ছোটছোট পায়ে পথচলা।
"ময়দান ভারি হয়ে নামে কুয়াশায় দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় রুটমার্চ তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া? নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই তোমার ছিন্ন শির,তিমির" -শঙ্খ ঘোষ
এই উপন্যাস একসাথে দুটো সময়কে উপস্থাপন করে। প্রথমটা সত্তরের দশক, যেসময় খুন হয়েছেন অমিতাভ আর দ্বিতীয়টা বর্তমানকে।(২০১৯)। তবে স্টোরি বলছেন লেখক সবসময় বর্তমান টাইমলাইনে থেকে। একটা উপন্যাসে যখন নির্দিষ্ট একটা সময় কালকে এবং একটা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতেকে উপস্থাপন করতে হয় তখন সেই সময় কাল এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা তৈরি করতে পারাটা ভীষণ জরুরি, কারণ এই দুইটি জিনিস পাঠকের মনে প্রভাব বিস্তার করে পুরো উপন্যাস জুড়ে। আর এইখানেই চমৎকার স্বার্থকতা দেখিয়েছেন লেখক শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য। সত্তরের দশককে উপস্থাপন চমৎকার ভাবে, ধীরে ধীরে সময় নিয়ে। যার প্রভাব উপন্যাসের আনাচে-কানাচে বিরাজমান। কারণ সেই সময়ের কবি অমিতাভ মিত্রকে বুঝতে হলে সেই দশকটাকেও বোঝা জরুরি পাঠকদের জন্য এবং আমাদের গল্পের ক্রাইম জার্নালিস্ট তনয়ার জন্যে। এটা ছাড়াও শাক্যজিৎ সাহেব অমিতাভ মিত্রের চরিত্র তৈরিতে যে নিপুনতা দেখিয়েছেন তার কথাও বলা প্রয়োজন। প্রায় প্রতিটা বিবরণ নিখুঁত এবং নিখাদ। এসব জিনিসগুলো বইটাকে করে তুলেছে চমৎকার।
মানুষের চরিত্র বোঝা দায়! সে কখন কী করে, কে বলতে পারে? যখন সমাজের তৈরি করা নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয় সেখানে বাকিসব বর্ণহীন হয়ে যায়। এর মাঝে অপরাধ ঘটে চলে। ছোট্ট একটা ঘটনা বা সামান্য একটা ভুল বিরাট ঢেউ নিয়ে আসে সবদিক থেকে, একে বাটারফ্লাই ইফেক্ট ছাড়া আর কী বলা যায়? শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের 'শেষ মৃত পাখি' উপন্যাসেও সেই ঢেউ মৃদু দক্ষিণা হাওয়ার মতো। ওলটপালট করে দিয়ে যায় সবকিছুকে, দাবার বোর্ডে পড়ে থাকে খালি একটা বোড়ে, দান যে আরো একটা বাকি…
গল্পের ভিতরে গল্প! ম্যাগপাই মার্ডারস এর মতোই উপভোগ করছিলাম। অমিতাভের উপন্যাস একটা আলাদা থ্রিলার বই পড়ার অভিজ্ঞতা দিয়েছে যা সুখকর। এক স্টার কম দেয়ার কারন - শেষে তনয়ার শুধুমাত্র আন্দাজে অনুমানের উপর রহস্য বের করা টা কাকতালীয় যা পুরাটাই অবাস্তব।
রহস্যোপন্যাস পড়বার সময় যখনি মনে হবে, "এইতো ধরে ফেলেছি কাহিনী", থামুন। যদি একটু পরে আপনার ধারণা ঠিক দেখতে পান, তবে ওইটা কোন রহস্যোপন্যাসের জাতে পড়ে না। কিন্তু যদি দেখেন, আপনে একটা বুদ্ধু, কাহিনী আরেকটা, লেখক আপনাকে আলতো করে নাকানি-চুবানি খাইয়েছেন, তখনি বুঝবেন, এটা একটা সেরা বই।
এক ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট বিস্মৃত কিছু হত্যা রহস্য নিয়ে নতুন এক সিরিজ বের করেন (পুরো উপন্যাস তার ফার্স্ট পার্সন ন্যারেটিভে বলে যাওয়া)। এক পর্যায়ে দার্জিলিংএ চুয়াল্লিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া এক উদীয়মান কবির হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য সেখানে যান। এরপর শুরু হয় এই বইয়ের কাহিনী। কাহিনীর ভেতর কাহিনী বা গল্পের ভেতর গল্প ব্যাপারটা খুব সুন্দর। আরব্য রজনী বা মহাভারত তথা সব গ্রেট ক্রিয়েশন এর কমন ট্রেন্ড। এখানেও একটা সুন্দর ছোট্ট উপন্যাস পাবেন ভেতরে, কাহিনীর প্রয়োজনে। আর একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে সেরা একটা টুইস্ট।
আপনি কবিতা প্রেমী হলে এই বইটা আপনার জন্যে Pandora's Box। নকশাল আন্দোলন , বাংলাদেশের স্বাধীনতা, পশ্চিমবঙ্গ ও সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল সত্তুরের দশকে, সেই প্রেক্ষিতে ক্ষুরধার কলম ধরা প্রচুর কবিদের রেফারেন্স পাবেন এখানে। সাথে পাবেন সমসাময়িক লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্কে ভালো আইডিয়া। লিটল ম্যাগাজিন আর এইসব কবিদের নিয়ে মোটামুটি ভালো গবেষণা করে লেখক এই বইতে সুন্দর কিছু ঘটনা আনছেন। "ছায়া ঘনাইছে বনে বনে" শীর্ষক লেখাটা খুব ভালো লাগছে আমার। আন্দোলনের ঝড় পাহাড়ি ছোট্ট শহরে কিভাবে আচ্ছন্ন করছে জনজীবনে, সেসব নিয়েও সুন্দর একটা ধারণা পাবেন।
শেষ মৃত পাখি আমার চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বদলি হবার প্রাক্কালে বন্ধুদের থেকে পাওয়া শেষ উপহার। ১০ ডিসেম্বর ২০২৩। সাড়ে ছয়মাস কেনো হাতের কাছে থাকলেও পড়লাম না, সেই নিয়ে অনেক অনেক আফসোস থাকছেই। ছুটি না পাওয়া এই ঈদে অফিসের কাজের ফাঁকে সম্ভবত একমাত্র আনন্দদায়ক পাওনা এই বইটা।
জীবনদাশের “মানুষের মৃত্যু হলে” কবিতার কয়েকটা লাইনে যখন একটা রহস্য উপন্যাসের মূলসূত্র গাঁথা থাকে তখন ব্যাপারটা কেমন হবে? জীবনদাশের কয়েকটা কবিতা আমাকে বারবার ভাবাতো। মনে হতো- এ হয়তো পাপ থেকে সৃষ্ট কোনকিছু। পাপের পর হঠাৎ প্রেম কিংবা সভ্যতা নয়তো প্রকৃতি এসে হানা দিতো। হঠাৎ বলাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। সে আলোচনা বরং থাক। তবে উপন্যাসে একটা চরিত্রের নাম বাবলা। জীবনদাশের “কুড়ি বছর পরে” কবিতায় মাঝের কয়েকটা লাইন এমন- “বাবলার গলির অন্ধকারে/ অশথের জানলার ফাঁকে/ কোথায় লুকায় আপনাকে”। এখান থেকে উপন্যাসের নামও আসতে পারে। কারণ প্রচুর পাখির কথাও আছে এই কবিতায়।আবার কাকতালীয়ও হতেই পারে।
“Old sins have long shadows”
পয়তাল্লিশ বছর আগে একটা খুন হয় একজন প্রতিশ্রুতিবান কবির এবং সন্দেহ করা হয়েছিলো তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু অরুণ চৌধুরীকে। যে নিজেও একজন লেখক। রহস্য উপন্যাস লিখতেন। সেই পর্যন্ত যদি হতো তাহলে নিছকই সাধারণ কোন রহস্য উপন্যাস বলে না পড়ার তালিকায় রেখে দিলেই চলতো। তবে এই উপন্যাসটা এতোও সহজ কিছু না। উপন্যাসের ভিতর আরেকটা উপন্যাস এবং সেই উপন্যাসটা অমিতাভ'র খুনের রহস্যের সমাধান যখনই দিচ্ছিলো তখনও আমার পাঠক সত্তা সন্তুষ্ট হতে পারছিলো না কারণ তার এখনও কিছু খটকা দূর হচ্ছিলো না। এবং শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মনে হচ্ছিলো জীবনদাশের সেই কবিতাতেই আঁটকে আছি-
“সকল রৌদ্রের মতো ব্যপ্ত আশা যদি গোলকধাঁধায় ঘুরে আবার প্রথম স্থানে ফিরে আসে, শ্রীজ্ঞান কী তবে চেয়েছিল?”
তনয়ার সাথে সাথে আমি মাথা খাটাচ্ছিলাম পুরোটা সময়। প্রথম কোন নারীকে দিয়ে রহস্যের সমাধান হচ্ছিলো। যদিও তিনি সাংবাদিক ছিলেন এবং প্রথম থেকেই তিনি চাইছিলেন তার সিরিজের জন্য একটা গল্প। তবে মিথ্যে বা অনুমানের উপরেই কিছু লিখে দিতে চাইছিলেন না। বা মানুশ যা বলছে তাই লিখে দিতেও চাইছিলেন না। একটা শুদ্ধ এবং সত্য গল্প চাইছিলেন সে অমীমাংসিতই হোক না কেন। এই ব্যাপারটা নতুন।
এই পুরো উপন্যাসে একটা ব্যাপার চোখে আঙুল দিয়ে বারবার দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক- কবিতা আর রহস্য দুটো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত৷ আমি মনে হয় অনেকদিন এমন কিছু পড়িনি। বারবার তুচ্ছ কিছু বা সহজে ভুলে যাওয়া যায় এমন ক্লু মনে করিয়ে দিয়েছেন লেখক। ব্যোমক্যাশ বা ফেলুদা পড়ার সময় যেমনটা হতো কিছু তথ্য মিস হয়ে গেলে সেটা একেবারে শেষে এসে ধরতে পারতাম ব্যাপারটা এমন না। তাতেই আরো ভালো লেগেছে। তনয়া আর সিদ্ধার্থের সাথে সাথে পাঠকরাও একসাথে সব তথ্য পাচ্ছে এই ব্যাপারটাই আমার কাছে নতুন। আরো একটা ব্যাপার বেশ মজার।সেটা হচ্ছে প্রতি অধ্যায়ে শুরুতেই কবিতা। আমি বিশেষ কবিতা বুঝি না। তবে চেষ্টা করেছি বুঝবার। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য বেশ পড়েন এটা উনার লেখায় বোঝা গিয়েছে। হৃদয় নিংড়ে দেওয়া কবিতাগুলোকেও কি সুন্দর কাজে লাগিয়েছেন। বারবার ভুল পথে নিয়ে গিয়ে কিছু ফাঁক আর খটকা রেখে নতুন পথে পরিচালিত করেছেন পুরো গল্পটাকে। সব সম্ভাবনায় চোখের সামনে একবার করে দাঁড় করিয়েছেন। এই রহস্যের সমাধান কি কি হতে পারে সব একবার একবার বাজিয়ে দেখিয়েছেন। এমন বই অনেকদিন পড়িনি।
আমার কাছে সবসময় মনে হতো ম্যাথ আর রহস্য দুইটা সেইম টাইপ সাবজেক্ট। সমাধান জানা থাকলে নিচ থেকে উপরে যেকোন উপায়ে আসা যায়। এই ব্যাপারটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিলো ফেলুদা পড়ার সময়। আমি হয়তো ফেলুদাকে একটু বেশি ভালোবাসতাম এই ব্যাপারগুলোর জন্য৷ তবে এখানে একটু ভুল ভাঙলো। সেটা হচ্ছে অনেক সূত্র এবং উপায় আছে সবচেয়ে উপরের লাইনে যাওয়ার। এখন একটা সম্ভবনা থেকেই যায় ভুল হওয়ার। এই বইটাতে এসে দেখলাম দুজন গণিতপ্রেমি দুইরকম। অন্যনা এবং সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থকে আমার বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে। এই বইটা পড়ার পর মনে হয়েছে কবিতা, ম্যাথ আর রহস্য যদি কোনভাবে এক সুতোয় বাঁধা যায় তাহলে ব্যাপারটা বেশ দারুণ কিছু হয়ে যায়।
শেষ আরেকটা ক্লু ছিল গাঁথা ছিল এই কবিতাটায়-
“Yesterday upon the stair
I met a man who wasn’t there
He wasn’t there again today
I wish, I wish he'd go away.”
জীবনদাশের “মানুষের মৃত্যু হলে” কবিতার সাথে কোথাও একটা যোগ আছে মনে হচ্ছে না?
বইটা পড়তে ভালো লাগার আরো অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে মজার যেটা সেটা হচ্ছে ৯০ দশকের কবিতা, লেখক, কবিদের নিয়ে বিস্তর আলাপ আছে৷ পড়তে পড়তে সেই সময়টাকে অনুভবও করা যাবে। সেই সময়কার নকশাল আন্দোলন এবং তরুণদের প্রতিবাদের পন্থা সবকিছুই।
This entire review has been hidden because of spoilers.