কোনো কোনো লেখা মানুষের চামড়ার ওপর রচিত হয়। এ তেমনই এক রচনা, যা উপন্যাস হতে গিয়ে বদলে যায় অনিঃশেষ সংলাপে; সংলাপ চলে যায় প্রবন্ধের দিকে; আর প্রবন্ধ মিশে যায় কবিতার শরীরে। মণিময়ের স্বপ্নে ও জাগরণে ফুটে ওঠে প্রান্ত-র প্রত্নছবি। আর আসে একটি চরিত্র-বেদনার সন্তান জীবনানন্দ দাশ। তাঁর হাত ধরে মণিময় পেরিয়ে যেতে থাকে জীবন, জীবনের ওপার; কেন্দ্র থেকে প্রান্ত-র পথে। ঝরে যায় এতদিনকার ধরতাই বুলি। বিশ ও একুশ শতকের এক ট্র্যাজেডিই যেন জন্ম নিতে থাকে। দশ বছর আগে রবিশংকর বল-এর এই গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নাশকতার এক সন্দর্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এতদিন পরে প্রতিভাস-এর নতুন সংস্করণেও শিকারোৎসবের দন্দভি শোনা যায়।
রবিশংকর বল পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১৯৬২ সালে। বিজ্ঞানে স্নাতক। ২০১১ সালে দোজখনামা উপন্যাসের জন্য বঙ্কিম স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন।
গল্পগ্রন্থ দারুনিরঞ্জন রবিশঙ্কর বল এর গল্প আর্তোর শেষ অভিনয় জীবন অন্যত্র ওই মণিময় তার কাহিনী সেরা ৫০ টি গল্প
উপন্যাস নীল দরজা লাল ঘর পোখরান ৯৮ স্মৃতি ও স্বপ্নের বন্দর পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন মিস্টার ফ্যান্টম বাসস্টপে একদিন মিলনের শ্বাসরোধী কথা নষ্টভ্রষ্ট এখানে তুষার ঝরে দোজখনামা আয়নাজীবন আঙুরবাগানে খুন জিরো আওয়ার
কবিতা ত্রস্ত নীলিমা ঊনপঞ্চাশ বায়ু
প্রবন্ধ সংলাপের মধ্যবর্তী এই নীরবতা কুষ্ঠরোগীদের গুহায় সংগীত মুখ আর মুখোশ জীবনানন্দ ও অন্যান্য
সম্পাদিত গ্রন্থ সাদাত হোসেইন মন্টো রচনাসংগ্রহ
জাহিদ সোহাগ : মানে আমি বলছি এই কারণে যে, আমাদের বাংলাদেশে রবিশংকর বলকে চেনা হচ্ছে দোজখনামা দিয়ে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখবেন? মানে এখানেও একটা ট্যাগ আছে। রবিশংকর বল : এটা বলা কঠিন, তবু যদি বলো তবে আমি বলব, আমার "মধ্যরাত্রির জীবনী" উপন্যাসটা পড়া উচিত, "বাসস্টপে একদিন" উপন্যাসটা পড়া উচিত, "এখানে তুষার ঝরে" উপন্যাসটা পড়া উচিত। "স্মৃতি ও স্বপ্নের বন্দর", "ছায়াপুতুলের খেলা" অবশ্যই। এই কটা লেখা অন্তত। আর "পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন" এই লেখাটা।
"তুমি আমাকে চক্রের কথা বলেছিলে। আসলে তোমার কাছে আসা মানেই তো চক্রপথে পরিভ্রমণ। সব কথাগুলি ফিরে ফিরে আসে, হয়তো বা একটিই কথা প্রবাহিত হচ্ছে হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপ থেকে সরোবরের পাশে কিওস্কে।
রবিশংকর বলের ❝পান্ডুলিপি করে আয়োজন❞ কে ঠিক কি বলা যায়? বড় গল্প? উপন্যাসিকা?সংলাপ? নাকি জীবনানন্দ দাসের উপর লেখকের টুকরো ভাবনা? কি জানি, হয়ত লেখক নিজেই হারিয়েছেন জীবনানন্দের কাছে!
রবিশংকর বলের লেখনশৈলীর সাথে পরিচয় থাকলেও এই বইটি অনেক খাপছাড়া লেগেছে, ভেবেছিলাম দোজখনামার মতো কোনো মাস্টারপিস হাতে পরল, কিন্তু শেষে আশাভঙ্গ হল।বইটি আরেকটু বড় হলে আরও ভালো লাগত।
"...নিজের জীবনের বেদনাকে মুকুটের মত মনে হয়। বাদলের বাতাসে, আবছায়ায়, জনমানব, ট্রাম-বাস, গাছের পাতাপল্লব, পাখপাখালির কলরবে এক একটা সন্ধ্যা বড় চমৎকার কেটে যায় আমার। মা... —কিন্তু তবুও আমার আত্নহত্যা করতে ইচ্ছা করে। —কার? তোমার? কেন? —চৌকাঠের সঙ্গে দড়ি ঝুলিয়ে কিংবা বিষ খেয়ে যে মরণ, সেরকম মৃত্যু নয়, আউটরাম ঘাটে বেড়াতে গিয়ে সন্ধ্যার সোনালি মেঘের ভিতর অদৃশ্য হয়ে যেতে ইচ্ছে করে; মনে হয় আর যেন এ পৃথিবীতে ফিরে না আসি।"
আধুনিক সময় নরনারীর প্রেম, সমাজ নিয়ে ব্যস্ত। জীবনের একদম কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মানুষকে বরাবরই উৎপাদনশীল হয়ে উঠতে হয়। গ্রহণযোগ্যতা ঠিক তখনই আসে যখন সমাজের চোখে আমি কিংবা আমরা উৎপাদনশীল। গ্রহণযোগ্যতা হারালে ছিটকে পড়তে হয় একদম জীবনের কিনারায়। জীবনের কিনারায় থাকা লোকটি মৃত ঘাস, মৃত মাছি আর মৃত তরমুজের গন্ধের ভেতরে ডুবে যায়। আবডালে দেখে, চলার পথে কিনারায় পড়ে আছে ঠাকুমা-দিদিমার গল্প, লেবুপাতার ঘ্রাণ, ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া তার লাটিমটি।
নির্জনতায় প্লাবিত কার্তিকের বনে হারানো বেদনার মতন ঝাপসা স্মৃতিতে দাঁড়িয়ে আছেন যিনি, তিনি জীবনানন্দ। জীবন এবং আনন্দের মাঝে সেই করুণ বিকেল। যে বিকেলের স্থায়িত্ব ক্ষণকালের। সময়ে অসময়ে লোকটিকে নিঙড়ে পড়তে চাইছে যে জন সে জন হারিয়েছে গভীরে; ফিরেছে কেবল খালি হাতে, আটপৌরে বিষন্নতায়..
রবিশংকর বলের “পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন” — এক নিঃশব্দ অন্বেষণের গদ্য।
রবিশংকর বলের “পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন” বাংলা সাহিত্যে একটি ব্যতিক্রমী গ্রন্থ বললে ভুল হবে না। কারণ এটি কোনও ঐতিহ্যবাহী উপন্যাস, গল্প বা আত্মজীবনী নয়। বরং এটি এক ধরণের অন্তর্মুখী গদ্যকাব্য, যার কেন্দ্রে রয়েছে 'মণিময়' নামক এক চরিত্রের অন্তর্জগত ও তার ভাবনায় বারবার ফিরে আসা কবি জীবনানন্দ দাশ। মণিময় যেন জীবনের প্রতিটি স্তরে খুঁজে ফেরে কবিকে—তাঁর ভাষা, তাঁর নির্জনতা, এমনকি তাঁর অস্তিত্বের ছায়া।
বইটির ভাষা একদিকে কবিতার মতো, অন্যদিকে দার্শনিক চিন্তার ধারায় প্রবাহিত। রবিশঙ্কর বল তাঁর নিজস্ব গদ্যভাষায় একটি স্বপ্ন ও বাস্তবের মিশ্র আবহ নির্মাণ করেছেন। এখানে দৃশ্যমান কোনো কাহিনি নেই—আছে স্মৃতির ভাঁজে গুটিয়ে রাখা কিছু অনুভূতি, কিছু প্রশ্ন, কিছু অস্তিত্বসংক্রান্ত ভাবনা। মণিময় একা, নিঃসঙ্গ; সে জীবনের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছে এক অদৃশ্য কবিকে খুঁজতে, তার চিন্তার মাঝে খুঁজছে নিজেরই আত্মপ্রতিকৃতি।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা যেভাবে আধুনিক মানুষের নৈঃশব্দ্য, বিষণ্নতা এবং বিমূর্ত অনুভূতিকে ধারণ করে, এই বইটিও ঠিক সেভাবেই পাঠককে ধীরে ধীরে ডুবিয়ে দেয় এক ধূসর অথচ গভীর জগতে। এখানে সময় একটি বৃত্ত, ভাষা একটি দুলে-ওঠা সেতু—যার ওপর দিয়ে হেঁটে যায় স্মৃতি, অভিমান, প্রেমহীন প্রেম, অস্তিত্বের টানাপড়েন।
এই বইয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি তার মনস্তাত্ত্বিক আবহ। লেখক পাঠককে চেনা পথে হাঁটান না, বরং তাকে ঠেলে দেন ভাবনার অচেনা নদীতে। ফলে একবার পড়লে বইটি পুরোপুরি আত্মস্থ করা যায় না—প্রতিবার পাঠে নতুন কোনো অনুভব, নতুন কোনো স্তর উন্মোচিত হয়। পাঠকের ভাবনার গতি যেভাবে পরিবর্তিত হয়, বইটিও ঠিক সেভাবেই নিজেকে মেলে ধরে।
তবে এ কথা সত্য, বইটি সবার জন্য নয়। যারা কাহিনিভিত্তিক লেখায় অভ্যস্ত, তাঁদের কাছে এটি “খাপছাড়া” বা “অস্পষ্ট” মনে হতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের গভীর পাঠক, বিশেষ করে যাঁরা জীবনানন্দ দাশের কবিতা ও মননের ভক্ত, তাঁদের কাছে এটি হয়ে উঠবে এক অনির্বচনীয় পাঠ-অভিজ্ঞতা।
বই : পান্ডুলিপি করে আয়োজন লেখক: রবিশংকর বল প্রকাশক: ঐতিহ্য মূল্য : ১৬০ টাকা
সেই আদি। শক্তি ও পদার্থের খেলা। জন্ম নেয় নতুন ভাষা পৃথিবী। এ এক ভবিষ্যতের কবিতা, যার কথা শ্রী অরবিন্দ লিখেছিলেন, ভবিষ্যতের কবিতা অতীতের কবিতা থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে পৃথক হবে। সেটা হল- যে ভাষায় সেটা লিখিত হোক না কেন, ক্রমশ বেশি করে সমগ্র মানবজাতির অভিন্ন মন ও মানসিকতার দ্বারা সেটা চালিত হবে...
তবে, নিভৃতে চলে যাওয়া কোনো গতিশীল ট্রামের নিচে চলে যাওয়া এক জাদুকর কে নিয়ে ভাবনার কি আছে? বড়ই অদ্ভুত বিষয়। এমন এক কবি যে কথা বলতেন ঘাস নিয়ে, ঘাসের শিশির নিয়ে। যে অন্ধকার কোনো রাতে গলায় ফাস দিতে চায়, যার স্বাক্ষী রবে পেচা আর লাশঘরের প্রতিধ্বনিত শব্দ? এমন কোনো লেখক নিয়ে কেন ভাবা লাগবে যিনি শুধু লিখেছেন বিরহ আর বিচ্ছেদ নিয়ে। বিনুনি গেথেছেন সংসারের কলহের সকল বিষয় নিয়ে। তাকে নিয়ে এত কিসের ভাবনা? যিনি সকালের রৌদ্রের মত নিভৃতচারী, যিনি শীতের সকালের মত নিরব, আর যার লেখায় ফুটে উঠেছে খাটি বিষন্নতা। নামখানাও যেনো ঈশ্বরের কোনো হেয়ালি, জীবনানন্দ এমন এক লেখক ও কবি যার মাঝে আনন্দই যেনো ছিলোনা, ছিলো হৃদয় ভার করে ফেলা একরাশ নিরাশা আর নিরবতা। জীবনানন্দ দাশগুপ্ত কে নিয়ে ভাবনার একটুকরো চিন্তাশীলতার ফসল এই বইটি। এই বইটি আমাকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে হাজারো উত্তরহীন প্রশ্নের কানাগলিতে হেটে গিয়ে হারিয়ে যেতে। দিনশেষে আমার হৃদয���ে জীবনানন্দ একটি বিরাট স্থান জুড়ে রয়ে গেছে। কেননা বিষন্নতা আমার বেশ নিকটে, যেনো জীবনানন্দের বিষন্নতাকে আমি নিজের মাঝেই খুজে পাই। একমাত্র বিষন্নতাকেই যেনো তিনি প্রকৃতভাবে চিনেছেন, জেনেছেন আর হৃদয়ে ধারন করেছেন। নিরবে নিভৃতে তিনি পূজেছেন একেই, আর সাহিত্যের কালির আচড়ে একে গিয়েছেন এমন সব কবিতা যা তার প্রয়াণের এতগুলো বৎসর অতিক্রমের পরেও তিনি ই রয়েছেন, তাকেই প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। আর এই জীবনানন্দের মত করেই চিনতে চাই, দেখতে চাই তাকে আর তার সাহিত্যকে।
রবিশংকর বল এর পান্ডুলিপি করে আয়োজন মূলত এটি একটি প্রবন্ধ আর আলোচোনামূলক ছোট একটি গ্রন্থ। দুভাগে ভাগ করা, একটি স্বপ্নে ও একটি জাগরণে। মূলত মনিময়ের স্বপন ও জাগরনে বিচরন করা কল্পনার জগতে জীবনান্দের স্থান কেমন সেটিকেই স্তরে স্তরে সাজিয়েছেন লেখক।
লেখক তার বর্ননায় ব্যবচ্ছেদ করেছেন, অথবা করতে চেয়েছেন জীবনানন্দের চিন্তাধারাকে অতি ঠাস বুনট শব্দের বেড়াজালে, হেয়ালী আর উপমার সাথে। রবিশংকর বল সাহেবের লেখার সাথে আমি পরিচিত নই ব্যক্তিগতভাবে, এটি ই প্রথম আমার পড়া তার কোনো লেখা। তবে লেখনির মাঝে এক অপরূপ সৌন্দর্য্যের অস্তিত্ব দেখা যায়। যেনো লেখাই নিজের মত করে চিন্তা করছে, ভাবছে। নিজের শব্দগুলোকে নিজেই গুছিয়েছে, আর রবিশংকর যেনো শুধু তাদের সাথে খেলা করছেন। মণিময় জীবনানন্দকে খুজছেন, তাকে ধারন করছেন, তার লেখনিকে প্রশ্ন করছেন। কেননা তার কবিতার ছন্দের আলোড়নে লুকিয়ে আছে আরো গভীর কোনো নিরবতা, যা ঢেকে আছে আড়ালে আবডালে, হারিয়ে গিয়েছে সময়ের স্রোতের মহিমায়। তবে মণিময় বলেছেন সেগুলোকে প্রশ্ন করতে, বলেছেন তাকে আরো গভীর ভাবে পর্যবেক্ষন করতে। এছাড়া মণিময় খুজেছেন আত্মহত্যার কারন, অকারনেই মৃত্যুকে পূজার কারণ। তিনি নিজেও আতিপাতি করে খুজেছেন কিছু, এমনকি আমাদের ও বলেছেন। এভাবে মণিময়ের স্বপনে আর জাগরণে শুধু জীবনানন্দের চিন্তাই নয়, খুজেছেন সমাজকেও। সমাজ যেভাবে ধারণ করতে চেয়েছেন জীবনানন্দকে, আর যেভাবে হেও করেছেন তার বিষন্নতাকে, মণিময় সেটাকেও খুজতে চেয়েছেন। আর জাগরণে? সেটা না হয় পাঠক নিজেই খুজে বের করে নিলেন।
মণিময়ের দ্বারা খুজেছেন জীবনানন্দকে, এক নাশকতার সন্দর্ভ হিসেবে। তবে এর গভীরতা অনেক, যাকে আমার মত ছোট পাঠকেরা হয়ত সেভাবে যেতে পারবেন না, তবে দিনশেষে হয়ত আমরা জীবনানন্দ কে আরো বেশি খুজতে চাইবো সবসময় এভাবেই।