আসলে তো শৈশব-কৈশোর এমন-এক অমোঘ বিষয়, যা আমাদের মধ্যে মৃত্যুকাল অবধি প্রোথিত থাকে। হারানো সেই জগৎকে স্মৃতি থেকে খুঁড়ে পুনর্নির্মাণ করেছেন ফের আবিদ আজাদ। গদ্য লেখেন তিনি কবিতার ভাষায়-শব্দে-বাক্যে প্রাণসঞ্চারক যে আশ্চর্য ভাষায় ছবির পর ছবি তৈরি করলেন, তা আমাদের প্রত্যেককে নিয়ে যায় নিজের শৈশব-কৈশোরে। এই বই লিখে আবিদ আজাদ দৃঢ় করলেন তাঁর নিজস্ব কবিতার ভিত্তি। কোন অপরূপ জাদুমন্ত্রবলে এই মায়াবী প্রাসাদ তৈরি হয়ে উঠলো, তাতে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকে না। কিন্তু ভাষায় রচিত বলেই এই প্রাসাদের রং চটবে না কখনো, ফাটল ধরবে না, শ্যাওলা জমবে না। ভাষার নির্মোকে এ এক প্রভাস্বর বই ।
"কবিতার স্বপ্ন" এক কিশোরের গল্প যাকে "কবিতার লাল চুলের কাঁচা স্বপ্নে" পেয়েছিলো, যাকে কবিতা তার "চালাক আঙুলের ইশারায়" আলাদা করে ফেলেছিলো,যার স্মৃতিকাচের আলোতে ধরা পড়ে ধারালো বিষণ্ণতা, যাকে সুন্দরের প্রবেশপথে ঘুরে মরতে হয় "একাগ্র, নিঃসঙ্গ ও নির্লিপ্ত। " গত শতকের পঞ্চাশের দশকে জন্ম নেওয়া কবি আবিদ আজাদের মফস্বল শহর কিশোরগঞ্জে বেড়ে ওঠার গল্প "কবিতার স্বপ্ন;" যেখানে মেঘলা আকাশ তাবুর মতো ঝুলে থাকে, থরে বিথরে সাজানো থাকে স্বপ্ন, ফুটে থাকে কাঁঠালিচাঁপা আর অপরাজিতা। আবার যেখানকার সব গল্প বিষণ্ণতার। কবির ডাকনাম ছিলো রেণু। তার স্বপ্নের রাজ্য চুরমার করে দিতে সেখানে হানা দেয় ব্যক্তিমানুষের সংসার, ঝগড়া, দোটানা, মনকষাকষি আর দূরত্ব। ঝগড়া হলেই রেণুর বাড়িটা অভিমানে চুপ হয়ে যেতো। রেণুর ছিলো অবিরাম অসুখ। ছিলো সংসারে থেকেও উদাসীন দাদা, ছিলো কাক, ছিলো পাখির পায়ে সিকি আধুলি বেঁধে দেওয়া, কবিবন্ধু আশু, ছিলো স্কুলে সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর, জীবনানন্দ আর ছিলো শরীর। কবি টের পাচ্ছিলেন তার শরীর সাড়া দিচ্ছে, নারীদেহের দিকে চোরাচোখে তাকাচ্ছে, বাড়ছে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আগ্রহ, বাড়ছে ডানা মেলে ওড়ার দুঃসাহস। তখন "শিরাকাটা রক্তের মতো ফিনকি দিয়ে ছোটে কল্পনা।" একা আর নিঃসঙ্গ হয়ে নিজের শরীরকে চিনতে শেখে রেণু। আর কবি অবলীলায় লেখেন, "কবে আমি প্রথম হাত মারতে শুরু করেছিলাম, মনে করতে পারি না।"
বইয়ের ভাষা অলঙ্ঘ্যভাবে, অনপনেয়ভাবে একজন কবির। একজন কবির পক্ষেই জাদুমন্ত্রের মতো একজন রেণুর দুঃখকে সবার দুঃখে, একজন রেণুর বেড়ে ওঠার গল্পকে সবার গল্পে পরিণত করা সম্ভব।
আবিদ আজাদের কবিতার সাথে আমার পরিচিতি ছিলো না। তাঁর সাথে পরিচিত হলাম 'কবিতার স্বপ্ন' নামক গদ্য রচনা দিয়ে যা কবিতার থেকে কোন অংশে কম নয়। কবির জন্ম আমার পাশের জেলা কিশোরগঞ্জে। যেখানে আমি কৈশোরকালে প্রায়ই স্কুল পালিয়ে যেতাম মেঘনা নদী দেখতে। দুটোই মফস্বল এবং পাশাপাশি হওয়ায় বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একই রকম। তাই আবিদ আজাদের স্মৃতিকথনের ধরণের সাথে একাত্মতাবোধ করেছি যদিও কবি জীবন আমার নয়, তবে কবিতার পাঠকজীবন তো রয়েছে! এমনিতেই কবিদের গদ্যের প্রতি আমার সিগারেটের মতো আপাত নিষিদ্ধ কিন্তু অনতিক্রম টান রয়েছে। এর মধ্যে যদি কবি আবিদ আজাদের গদ্যে থাকে ভোরের শিউলি ঝরে পড়ার মতো অস্ফুট সংগীতময়তা তাহলে সেটা তো আমার ভালো লাগতে এক প্রকার বাধ্য। কবিতার স্বপ্ন' পড়ার ঘোর আমি কভু ভুলতে পারবোনা কারণ তা পড়েছিলাম আমি ব্যক্তিগত আরো এক ঘোরগ্রস্ততায় থাকা অবস্থায়। বইয়ে কিছু কিছু দৃশ্যের বর্ণনা আছে যা প্রায় পরাবাস্তব বলে মনে হবে তবে সেগুলো যে সত্যি তা নিজের সাথে ঘটা ঘটনাবলী থেকে বুঝতে পেরেছি। কৈশোরকালটা নিজেই ম্যাজিক বা ফ্যান্টাসটিক, সেখানে কবিতার স্বপ্নমাখা দৃশ্যাবলী অনাসায়ে ঘটতে পারে এবং ঘটে। বই থেকে আমরা যা জানতে পারি-
" ❝স্বপ্ন অনেক বেশি ক্ষতিকারক । স্বপ্ন কিশোরের পকেট ভরে তুলতে থাকে অসম্ভবের সোনাদানায়, মগজের মধ্যে রুয়ে দিতে থাকে আজগুবি ধরনের লতাপাতা ও ফুল-ফলের চারা, কানের মধ্যে বাজিয়ে চলে পাশের কামরার অন্ধকারের কনুই ও হাঁটুর শব্দ, অজানার গোপন ফিসফাস । স্বপ্ন মেলার মধ্যে নিষিদ্ধ ভিড়ে কানকো ধরে টেনে নিয়ে একদম ফতুর করে ছেড়ে দেয় । ফতুর হয়ে কিশোর ঘুরতে থাকে স্বপ্নের মেলার সুন্দরের আয়োজনের দুয়ারে দুয়ারে । কিন্তু সকল দুয়ারেই সাজানো ঝিলিকমিলিক দৌবারিক । সব দরোজা পাহারাদারদের দখলে । কিশোর দেখে, সুন্দরের সব দরোজায় বসে গেছে টিকিট কাউন্টার । হ্যাজাক জ্বালিয়ে নাভিতে আচমকা লাফিয়ে ওঠে সার্কাসের তাঁবু। কিশোর তার টিকিটবিহীন হৃদয় নিয়ে ঘুরতে থাকে সুন্দরের এক প্রবেশ-পথ থেকে আরেক প্রবেশ পথের দিকে । উঁকি মারে ফতুর কিশোর : একাগ্র, নিঃসঙ্গ ও নির্লিপ্ত ।❞
দয়াহীন, মায়াহীন কোন প্রেক্ষাপট নয়, হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ার একচ্ছত্র দাপটে যখন আপনাআপনি খুলে যায় বহুকাল ধরে বন্ধ থাকা খিড়কি, যখন কাঁঠালিচাঁপা ফুলের গন্ধ নোনতা স্বাদ নিয়ে দখল নেয় হৃদয়ের, যখন প্রবল সঙ্গীহীনতা টেনে নিয়ে যায় নিঃসঙ্গতম কোন রাত্রির কাছে, তখন মনে হয় এইসব কবিতার স্বপ্ন, আমাদের ফেলে আসা শৈশব, নিউটাউনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ওল্ডটাউনের ছায়া গ্রাস করে আমাদের অন্তর্গত বোধ।
শৈশবের গল্প নয় যেন আমৃত্যু একটা মানুষ যেসব রসদ নিয়ে বেঁচে থাকে, এই বইয়ে আবিদ আজাদ মূলত মৃত ডুবুরীর মতো ডুব দিয়ে তুলে এনেছেন সেইসব মণি-মুক্তো। কখনও কুয়াশার মধ্যে মিশে যাওয়া স্টিম-ইঞ্জিনের ধোঁয়া, কখনও রেল ব্রিজ ধরে নেমে আসা সন্ধ্যা, একজন স্কুলবালকের ব্যাগ থেকে সবকিছুই বের করে এনেছেন অপার্থিব কোন শক্তিবলে। শিউলিবনে পড়ে থাকা কাঁটা হাত নাকি, মোরগফুলের মধ্যে ডুবে থাকা পিঁপড়ের হুটোপুটি, কার দিকে মনোযোগ দেয়া যায়, ভাবতে ভাবতে দেখি নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপনের আড়ালে ক্রমেই ভেঙে পড়ছে আমাদের স্বপ্নের একান্নবর্তী পরিবার। রোগা কোন বালকের চোখে তখনও খেলা করছে, সজীব এক জগতের জলছবি। ধরা পড়েও তাই রাজার মতো জলের মধ্যে স্লোগান তুলে এঁকেবেঁকে চলে যেতে পারে আলতা রঙা পুঁটিমাছ।
প্রকৃতি ও প্রকৃতির মধ্যে মিশে যাওয়া কোন জনপদ শুধু নয়, নিজের মতো করে সাজানো এই শৈশবে কখনও কখনও তীব্র আকাঙ্খার মতো এসেছে প্রেম, যৌনতা যৌনতা ভাব। রাজনীতি এসেছে প্রাসঙ্গিক কবিতার মতো যেন রাজনীতি ও কবিতা যমজ ভাই।
গল্পে নয়, আঙ্গিকেও আবিদ আজাদ কী নিঁখুত! কী অপূর্ব ভাষা তাঁর! যেন মোলায়েম হাতে সদ্য ভূমিষ্ঠ কোন শিশুকে করছে আদর। এই মর্মে আরও দুটো বইয়ের কথা মনে পড়ছে.. আল মাহমুদের, ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ আর মণীন্দ্র গুপ্তের ‘অক্ষয় মালবেরী’। কবিদের গদ্য যে কী ম্যাজিক তৈরি করতে পারে, তা এই বইগুলো পড়লে টের পাওয়া যায়। এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় ‘কবিতার স্বপ্ন’ বইটিকেও রাখা যায় অনায়াসে। পুরো বই পড়া শেষে মনে হয়, এক অবছায়াছন্ন দীর্ঘ কবিতাই পড়া হলো যেন। . Thanks to Harun Ahmed for recommending this book.
আমার ছোটবেলার একদিনের কথা বিশেষ করে মনে আছে, সেইবার প্রচন্ড বৃষ্টির ফলে আমাদের বাড়ির উঠোন পর্যন্ত প্লাবিত হয়ে গিয়েছে। তখন একান্নবর্তী পরিবার আমাদের। বাড়ির পিছনে পুকুর, পুকুরের পাড়ের সাথে লাগোয়া লম্বা দোচালা ঘর। সেগুলো কাকা, আমার বাবা এবং এক দাদুর ছিলো। সেই দোচালা ঘরের সামনে আবার লম্বায় সমান কিছু ঘর। সেখানে রান্নাঘর, গোলাঘর ইত্যাদি ঘর। দুই পাশের ঘরের মাঝখানে সরু একফালি বারান্দা সেই বারান্দার যার উভয় মুখ খোলা, এই বারান্দাই ছিলো খাওয়া দাওয়ার স্থান। চাষের মৌসুমে যখন কাজ করার জন্য ভাড়া করা লোক আসতো তাদের সাথে খেতে বসে যেতাম আমিও। আমাদের ঘরের পাশের ঘরে বাবার আরো আরো কিছু কাকা এবং জেঠা থাকেন। এই নিয়ে আমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছের বাড়িতে যেতে হলে তিন চার মিনিট তো লাগেই। সেই বর্ষার মৌসুমে মাঠ, ঘাঠ, চাষের জমি প্লাবিত। বড়দের কোমড় সমান পানি। আর আমি সেই সময় চার পাঁচ বছরের এক বাচ্চা। সেই পানি আমার উচ্চতার সামন্য এদিক-সেদিক হবে। মোদ্দা কথা আমরা গৃহবন্দী বিশেষ করে আমি। স্কুলে যাওয়ার উপায় নেই। বড়রা দুয়েকজন বাইরে গেলেও জলদি ফিরে আসে। তারপর কেউ কেউ জাল বিছিয়ে দিয়েছে এদিক সেদিক। আর আমার নিজেকে মনে হতো দ্বীপে আটকে পড়া এক বন্দী। অবশ্য ভালোও লাগতো। সারাদিন ঘরে ঘুরঘুর করি, খাইদাই বৃষ্টি দেখি। গোড়ালি সমান জলে নেমে জলকেলি করি। কাগজের নৌকা ভাসিয়ে দিই। বিশেষ করে রাত্রেবেলা ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর এবং পোকামাকড়ে কিচিরমিচির ডাকে অন্য পরিবেশ তৈরি হতো। বিদ্যুৎ না থাকায় কেরোসিনের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হতো, ছিলো কাঁচের ল্যাম্প। সেই কেরোসিন প্রদীপের আলোর টানে উড়ে চলে আসতো সব পোকামাকড়। কেউ কেউ মরে, পুড়ে কেরোসিনের বাতির গায়ে লেগে থাকতো। বাতির গা থেকে ভেসে আসতো কেরাসিনের একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ। কিন্তু তখন জোনাকিপোকা দেখতাম না। কারণ বৃষ্টি হলে জোনাকিরা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সন্ধ্যায় বই উল্টেপাল্টে ভাত খেয়ে শুতে যেতাম। মাঝে মাঝে আকাশের বুক চিড়ে বাজ পড়তো। সেই বারান্দায় থেকে দেখতাম দূরে আকাশের বুক চিড়ে প্রচন্ড রকম আলোর রেখা একদিক থেকে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। সাথে সাথে কানে হাত চাপা দিতাম ভয়ে,চোখ গুলো বন্ধ করে ফেলতাম খুব জোড়ে। কিন্তু আওয়াজ আসতো তার-ও একটু পরে। তখন জানতাম না যে শব্দের চেয়ে আলো গতি বেশি। এরপর খেয়েদেয়ে ঘুমাতে গেলে মনে হতো প্রচন্ড বৃষ্টির ধারা টিন ভেদ করে এখনই ভিতরে প্রবেশ করে আমাকেসহ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এসব আজগুবি চিন্তা মাথায় নিয়ে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে যেতাম।
এই হলো ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ, কারণ আবিদ আজাদের আত্মজীবনী "কবিতার স্বপ্ন" আমাকে ঘিরে ফেলেছে পড়ার সময় থেকে। লেখকের ছোটবেলার কথা পড়তে পড়তে স্মৃতির একটা স্রোত আমার অগোচরে বয়ে চলেছিলো আমার ভিতর দিয়ে। সেই স্রোতে ভাসতে ভাসতে অনেক কথা মনে আসছিলে। কিন্তু তারচেয়েও অভিনব লেখকের বই। তাই সেসব স্মৃতিকাতরতায় আর বেশি ডুব দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। কবিরা যখন গদ্য রচনা করেন তখন সেই গদ্যও হয়ে ওঠে কবিতার মতো প্রাঞ্জল, এইরকম একটা মতবাদ প্রচলিত আছে। যদিও এর সত্যতা যাচাইয়ের ইচ্ছে বা আকাঙ্খা এই মুহূর্তে নেই। তবে কবি শঙ্খ ঘোষের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ "কিশোরকথা", মণীদ্র গুপ্তের আত্মজীবনী "অক্ষয় মালবেরি" এবং আবিদ আজাদের ছোটবেলা থেকে কিশোরকাল পর্যন্ত স্মৃতিচারণ এবং আত্মজীবনী মূলক বই "কবিতার স্বপ্ন" পড়ে উক্ত মতবাদে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে। সে যাই হোক, কবিতার স্বপ্ন শুধু আত্মজীবনী নয় এই বই একজন কবির কবি হয়ে ওঠার গল্পও বটে। এরও পিছনে আছে আছে পরিবারের সাথে কাটানো সময়ের গল্প। যে গল্প নিয়ে চলে গত শতাব্দীর ষাট এবং সত্তরের দশকের বাংলার গ্রাম চিকনির চর এবং মফস্বল কিশোরগঞ্জে। ভেদ করে দেয় ছোট্ট এক শিশুর চোখে দেখা একান্নবর্তী পরিবারের বিবাদ, সুখ, স্নেহ, বন্ধনসহ সব। এরই মাঝে বেড়ে ওঠা, রোজ সকাল বেলা বকুল ফুল কুড়ানোর জন্য সবার আগে জোড়া বকুল তলায় চলে যাওয়া। সেই জোড়া বকুল গাছের একটিতে আছে ডাকবাক্স। মাঝে মাঝে তার উপরেও পড়ে থাকে দুয়েকটা বকুল। "কবিতার স্বপ্ন" আসলে এক মায়াজাল সৃষ্টি করা বই। মনে হবে সেই ভোরে আমি কিংবা আপনিও বকুল কুড়চ্ছি জোড়া বকুল ফুল গাছের তলায়।
খুবই বিচিত্র এবং সঙ্গত এক কারণে বিষন্নতা আমাকে খুব টানে- হোক সে পারিপার্শ্বিক অবস্থায়, চিন্তাভাবনায় বা লেখায়! আবিদ আজাদের কবিতার সাথে একটুআধটু পরিচয় থাকলেও তার গদ্য নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না আমার। সেই অজানা গদ্যকার আমাকে কী দারুণ এক বিষন্নতায় ডুবিয়ে মারলেন!
ফিলিস্তিনি কবি মুরিদ বারঘুতির স্মৃতিচারণা "I Saw Ramallah" পড়েছিলাম কয়েকবছর আগে। নিজের বাল্যকালের স্মৃতি রোমন্থনে কবি বারবার আমাকে রামাল্লার জলপাই গাছতলায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আবিদ আজাদের 'কবিতার স্বপ্ন' আমাকে তেমন একটা অনুভূতি দিল অনেকদিন পর, কিশোরগঞ্জের অখ্যাত গ্রামে চড়ুই পাখির পায়ে কানাকড়ি সুতা দিয়ে বেধে দিতে আমিও কবির সঙ্গী হলাম, তাকিয়ে রইলাম আকাশের দিকে অনেকক্ষণ!
ছোট ছোট কালো কালির অক্ষরে আজাদ সাহেব তার ছোটবেলার দীর্ঘ লাল, নীল বিষন্নতার যে গল্প লিখে গেছেন তা আমার মনে ঠিক কোন রঙের ছাপ ফেলেছে এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে ছাপটা যে দীর্ঘস্থায়ী হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কবিতার স্বপ্নে আবারো হারাতে হবে সময় পেলে।
আবিদ আজাদ কে? আমি তাকে চিনি না। আমি কবিতা পড়ি না। আবিদ আজাদের কোনো কবিতা আমি কখনো পড়ি নাই। তাহলে কেন আমি তার কবিতার স্বপ্ন পড়লাম?
কবিতার স্বপ্ন আবিদ আজাদের শৈশব কৈশোরের স্মৃতিকথা। কিন্তু শৈশব কৈশোর কি কখনো একজনের থেকে আরেকজনের আলাদা হয়? কোনো ধনী পরিবারের এক শিশুকিশোর তার শৈশব কৈশোর যেমন করে হাসিকান্নায় কাটিয়ে দেয় তেমনিই রাস্তায় বড় হওয়া কোনো বঞ্চিত শিশু তার অভাব সম্পর্কে সচতেন না হয়েই কাটায়।
এজন্য এই স্মৃতিকথা কখনো কারো ব্যক্তিগত থাকে না। আমরা অন্যের স্মৃতিকথা পড়ে নিজেদের শৈশবকেই পুনর্যাপন করি।
একজন কবির শৈশব আর গদ্য; দু’টোই হওয়া দরকার কবিতার মতো। পড়লে যেন বোঝা যায় মানুষের কবি হয়ে ওঠার যাত্রা সহজ নয়, তবে ঐশ্বরিক কিছু।
আবিদ আজাদের কবিতা পড়েছিলাম টুকটাক। বহু আগে। কবিতার স্বপ্নই পড়া হয় নাই নানা অজুহাতে। খানিক দেরি করে হলেও পড়লাম এইবার। মনে হইলো কবি তাঁর হৃদয়ের সমস্ত সত্য আর ভালোবাসা নিয়া শৈশবের স্মৃতিচারণ করতেছেন। আমারই পাশে বসে আছেন আর গল্প বলতেছেন যাবতীয় বিষণ্ণতাকে একপাশে ফেলে রেখে।
আবিদ আজাদের গদ্যে বিশেষণের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো কাব্যিক। পড়তে গেলে ঘোর লাগে। তাঁর ভাবনাগুলোও ভীষণ সরল, সুন্দর। লিখেছিলেন–'শৈশব হচ্ছে একটি জানলা; পৃথিবীর দিকে যে জানলা একবারই খোলা হয়'–জানলা দিয়ে কবি যা কিছু দেখেছিলেন; ডাকপিয়নের সাইকেল বা স্টেশনের বাতিল টিকেট- এইসব নিয়েই তো স্মৃতিকথা। বাড়াবাড়ি আবেগ নাই, চাকচিক্য নাই। মেঘের আড়ালে সূর্যকে দেখবার আশাবাদ ছিল বলেই দিব্যি বেঁচে যাচ্ছিলেন একটা ভাঙাচোরা শৈশবে, জটিল জীবনে। এইতো!
আবিদ আজাদের শৈশব ও কৈশোর কেটেছে জন্মস্থান কিশোরগঞ্জে। সেই বেড়ে উঠার ঘটনাবলী লিখেছেন এই গ্রন্থে। শৈশবের বেশিরভাগ ঘটনাতেই পরিবার, স্কুল, বন্ধু, শিক্ষক এবং পরিবেশের কথা স্থান পেয়েছে। পরিবারের মধ্যে আবার বাবা-মায়ের বদলে অল্পবয়সে মারা যাওয়া এক ছোটভাই, দাদা, বোন, ফুফুর কথাই এসেছে বেশি।
কবিতার কথা এসেছে কিশোর বয়সে। না, তখনো কবিতা লেখালেখি শুরু হয়নি সে অর্থে। আশু নামে তার বন্ধু অবশ্য কবিতা লিখত��। আশুর সাথে তার দারুণ সম্পর্ক ছিলো, হয়তো কবিতার কারণেই। কবিতা না লিখলেও পড়া হতো বেশ। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবি-সাহিত্যিকরা আসলে দেখা করতে যেতেন। সবমিলিয়ে কবিতা নিয়ে আগ্রহ ছিলো ব্যাপক। এই আগ্রহই হয়তো একসময় তাকে কবি হিসেবে নিয়তির দিকে নিয়ে যায়। কিশোর বয়সে রাজনীতির সাথেও কিছুটা যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেসবের কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। এছাড়া সে বয়সের উত্তাল আবেগ, প্রেম, যৌনতার প্রতি নিষিদ্ধ আকর্ষণের কথাগুলো বলে গেছেন অকপটে।
তার স্মৃতিচারণের শব্দচয়ন বেশ আকর্ষণীয়। আমার এক বড় ভাইয়ের মুখে শুনেছিলাম কবিদের শব্দ��াণ্ডার সমৃদ্ধ থাকে বলে তাদের লেখা গদ্য পড়ে এক অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। এই কথাটার প্রমাণ অবশ্য বহু জায়গাতেই পেয়েছি, এই বইটা পড়ার সময়ও মনে হলো।
“মনে হতো আমি যেন ক্লান্ত হয়েই জন্মেছি। আমার গা-ভরা জগতের সব ক্লান্তি। কেউ যদি কোলে করে আমাকে উঠোনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় তাহলে আমি যেন সেই উঠোনের ধুলোতেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়বো। কেউ যদি খোলা খিড়কির পাশে বসিয়ে দেয় তাহলে আমি সেই কব্জাখোলা খিড়কিতেই ঝুলে থাকবো। পা ঝুলিয়ে বসিয়ে দিলে মনে হতো একটা তেলাপোকার মতো চিৎ হয়ে যাবো। একবার চিৎ হয়ে পড়লে আর রক্ষা নেই। আমি পা কিলবিল করতে থাকবো। হাত কিলবিল করতে থাকবো। পা কিলবিল করতে করতে হাত কিলবিল করতে করতে আমি মরে যাবো।
আসলে আমি নিঃসঙ্গ ছিলাম না। ছিলাম রুগ্ন ও একরোখা।”
কুয়াশা মাখা ছায়া ছায়া বৃষ্টি মুখর দিনে একটানা পড়ে ফেললাম। এ আর কিছু নয় দীর্ঘ কবিতা ছাড়া। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই বই পড়ার সময় আমার পুনরায় হুমায়ুন আজাদের “ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না” পড়ার পিপাসা জেগেছিল খুব।। তাছাড়া শহীদ কাদরীর কবিতা’র কাছে ফিরতে হবে আবার। এই স্মৃতিকথাটার মতো এতো অদ্ভুত সুন্দর কিছু আমি খুব কম পড়েছি। সবাইকে পড়ার আমন্ত্রণ রইলো।
'কবিতার স্বপ্ন' পড়তে পড়তে সত্যি আমার চারিপাশের বৃষ্টি নেমেছিলো রিমঝিম রিমঝিম শব্দে। নিসর্গের এক কলতান উঠেছিলো করোটিতে।এমনি এক অবহ তৈরি করছিলো বইটা৷
'কবিতার স্বপ্ন' কবি আবিদ আজাদের আত্মকথন। তার জীবনের শৈশব থেকে শুরু অনেক ঘটনা এখানে বর্ণিত। খুব হালকা চালে নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ, বেদনা,সংসারে নানান টানা-পোড়েন, প্রেম, নিঃসঙ্গতা, শিল্পীসত্ত্বার ভাঙাগড়া ইত্যাদিকে কবি নিজের শিল্প সুষমায় করেছে তুলেছেন ঝিরিপথের রঙিন নুড়ি পাথরে। নারীর প্রতি প্রেম আর নারী দেহের শৈল্পিকতার প্রতি আদিম আকর্ষণ বারবার কবিকে ঘিরে ধরেছিলো রঙিন প্রজাপতির মতো। শরীর জেগে উঠছে বারবার প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে। আর তাতে সাড়া দিতে কবি মরিয়া হয়ে উঠতে চাইছেন। সাজোয়া নিসর্গের প্রতি একরাশ মুগ্ধতা কাঁদা মাটির লেপ্টে যাচ্ছে কবির শিল্পসত্ত্বার কোষে কোষে। এমনি অজস্র বিষয়ের ঘনঘটায় জমে উঠে কবি 'কবিতার স্বপ্ন'
মণীন্দ্র গুপ্তের আত্মকথা 'অক্ষয় মালবেরি' পড়ার পর আর তেমন জুত মতো আত্মকথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। 'কবিতার স্বপ্ন' পড়ার পর মনে হচ্ছে সেই তৃষ্ণার খানিকটা মিটেছে। বেশ ভালো লাগলো বইটা। বইটার মধ্যে দিয়ে কয়েকটি যুগকে যেন ভ্রমণ করে এলাম।
২৪ এর বিপ্লবের সেই উত্তাল এবং দূর্বিষহ সময়টাতে যখন এক কঠিন মনস্তাত্ত্বিক ভাঙাগড়া চলছে। শঙ্কায়, বেদনায়, অশ্রু এবং উল্লাসের অপেক্ষায় যখন যন্ত্রণায় ছটফট করতাম, তখন এই বইটার পাতায় দু'দণ্ড মুখ ঘুজে বসতাম একটু শীতলতার খোঁজে। বিপ্লবের পুরোটা সময় যখনই সময় পেয়েছি, এটা নিয়ে বসেছিলাম শান্তির আশায়। ২৪ এর বিপ্লবের স্মৃতি অংশে এইটেও দগদগে হয়ে থাকবে অনেক অনেক কাল।
চমৎকার বই।আরো বেশি চমৎকার লেগেছে এ বইটাতে যে শহরের কথা আছে সেখানে আমিও বেড়ে উঠেছি,তবে ভিন্ন একটা সময়ে।সে সূত্রে পিছনের দিকে একটা যাত্রা হলো এই বইটার মাধ্যমে।গদ্যের ভাষাটা খুব লোভনীয় লেগেছে।একজন কবির কবি হিসেবে বেড়ে উঠার যাত্রাও আমরা দেখতে পাই,এক ছোট্ট মফস্বলে।
ওয়েলশ ভাষার খুব মিষ্টি একটা শব্দ আছে, ‘হিরাইথ’ । ইংরেজীতে এটাকে অনেকে আদর করে ‘হোমসিকনেস’ডাকনাম দিয়েছে। কিন্তু এর আসল অর্থ হোমসিকনেস না। দূরে কোনো ঠিকানায় ফেলে আসা কাছের মানুষ,চেনা ভূগোলের জন্য মন কেমন করা থেকেও গভীরতর এর অর্থ। একটু কঠিন করে বলা যেতে পারে, এমন কোনো স্মৃতির জন্য মন কেমন করা যার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব এখন আর নেই। আরও সহজ করে বাংলায় কীভাবে লেখা যায়? স্মৃতিকাতরতা তো ঠিক যায় না এর সাথে। স্মৃতিমেদুর অনুভূতি? হয়তো... হিরাইথ হলো এমন কোনো ঘরের জন্য মন কেমন করা যে ঘর আমাদের কোনোকালে ছিল না আদৌ। কখনো কখনো গভীর রাতে কুকুরের কান্না শুনতে শুনতে দূরগামী কোনো স্মৃতির জন্য বুক ভার হয়ে আসে। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক গলে আমাদের নির্নিমেষ চেয়ে থাকা প্রতিদিনের চেনা রাস্তাটা প্রবল বর্ষণে ময়াল সাপের মতো ভিজতে থাকে। তখন আমরা চিন্তা করতে থাকি জীবনের সমস্ত কুড বি,কুড নট বি...এমন কিছুর কথা,এমন কারো কথা যা আদতে একান্ত আমাদের ছিল না কখনো । এই স্মৃতির মুহুর্মুহু আক্রমণেই,অন্যদের নস্টালজিয়া হয়ে ওঠে আমাদের নস্টালজিয়া। অন্যদের প্রেমিকারা হয়ে ওঠে আমাদের প্রেমিকা। অন্যদের অতীত হয়ে ওঠে আমাদের অতীত। আর এই অতীত এক অদ্ভুত জায়গা। আমরা মাঝেমাঝেই টুক করে সেখানে চলে যাই, কিছুক্ষণ কাটাই, ফিরে আসি। আর তাকে বলি নস্টালজিয়া। কিংবা কখ্খনো যেতে চাই না, তখন এর নাম দিই ট্রমা। সময়ের, অতীতের কোনো গ্যাস মাস্ক বা বম্ব শেল্টার বানায়নি কেউ আজ পর্যন্ত। যারা বর্তমান হারিয়ে কাছে-দূরের অতীতে বাঁচছেন, তাদের নেই কোনো আশ্রয়। আবিদ আজাদের ‘কবিতার স্বপ্ন’ কোথাও গিয়ে মনের এমন এক বিন্দুকে স্পর্শ করে ফেলে,যাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলা ভাষা পেরিয়ে ওয়েলশদের সেই স্মৃতিমেদুর হিরাইথের আশ্রয় নিতে হয়। কোনো প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রতিশব্দ খোঁজাটা নিরর্থক হয়ে পড়ে। কবিতার একটা নিজস্ব আবরণ আছে। তার ভেতরে প্রচ্ছন্ন রেখে অনেক কথা বলে নেয়া যায়,অনেক আত্মপ্রসঙ্গ। কিন্তু একজন কবি যখন শোনাতে শুরু করেন নিজের কথা,তখন আর লুকাছাপার প্রয়োজন পড়ে না। দীর্ঘ কবিতার মতো এই স্মৃতি ও সময়ের অনন্ত আশ্রয়ে পঞ্চাশের দশকের কবি আবিদ আজাদ শোনাচ্ছেন ফেলে আসা কৈশোরের কথা,শৈশবের কথা।যারা কবিতা জগতের নিয়মিত পথচারী নন তাদের কাছে নামটা বেশ অপরিচিতই ঠেকবে ,কিন্তু তাতে পড়ার আনন্দ কমে না। ‘কবিতা যারে খায়,প্লেট-সুদ্ধা খায়...’ কিশোরগঞ্জের মফস্বলী কিশোরকে পেয়েছিলো কবিতার লাল চুলের স্বপ্ন। কবিতা কিশোরটির মনে লেপ্টে গিয়েছিলো প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের বাইরে গিয়ে এক গভীর প্রকট চাহিদা হয়ে। তার টিকিটবিহীন হৃদয় নিয়ে সে ঘুরেছিলো সুন্দরের এক প্রবেশপথ থেকে অন্য প্রবেশপথের দিকে। কবিতা কেড়ে নিয়েছিলো তার হৃদয়ের নিষ্পাপবোধটুকু। ফতুর করে ছেড়ে দিয়েছিলো নিষিদ্ধ ভিড়ের মধ্যে... চাঁদনী রাতে একাকী নেকড়ের মতো নিঃসঙ্গ। ���র নিশিপাওয়া কিশোরটির চোখের সামনে আর দশটা মফস্বল শহরের মতো হয়েও কিশোরগঞ্জ তার সমস্ত স্পেয়ারপার্ট নিয়ে যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে। মোরগটুপী ফুলে ঘেরা কিশোরগঞ্জ স্টেশন, খড়মপট্টি,নিউটাউনের ছায়াময় এক অপরিচিত ভূগোল লুকিয়ে আছে আমাদের চেনা জায়গার ছদ্মবেশে।প্রত্যেক মানুষের কাছে তার বাল্যের শহরের সব দুঃখ, অভাব, আনন্দ এবং সকল দৈন্যদশার স্মৃতির চেয়ে বোধহয় রহস্যের কাতরতাই প্রবল হয়।অতসীফুলের গাঢ়তর রঙ,কালো পিঁপড়ের হুটোপুটি,পাখির পায়ে বেঁধে দেয়া আধুলি,স্টিম ইঞ্জিনের ধোঁয়া,আখের রসের মৌতাতে মশগুল কিশোরগঞ্জের ওল্ডটাউনকে পার্থিবতা ছাপিয়ে এক অপরূপ কাব্যভাষায় ক্রমশ শ্যামলের ঈশ্বরীতলা,মার্কেজের মাকোন্দোর মতো চাঁদের দেশের জনপদ হয়ে উঠতে দেখি। আবিদ আজাদের কাছে কবিতা মানে শুধু শ্যামলিমা প্রকৃতির কথা বলে বিষাদের প্রতিমা গড়ার ছুতামিতি খেলা না ৷ জীবনের এই কবিতা কবির কাছে এক নিজস্ব দুনিয়াদারি। চেনা সব ছকের বাইরে গিয়ে একটা অপরূপ,আদিম না-ছক। কোনো সেলফ-সেন্সরশিপ নেই,রাখঢাক নেই। ঠোঁটকাটা আপসহীন ভাষায় আবিদ আজাদ স্বমেহনের কথা বলে দেন। অকপটে জানান,বয়ঃসন্ধির পোশাকের নিচে প্রকৃতির নিয়মে বেড়েছে শরীর। আর নারী শরীরের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণে সাড়া দিতে শুরু করেছে সে। এভাবে যৌনতা আর রাজনীতি এসে মিশে যায় কবিতার দুই ফান্ডামেন্টাল এলিমেন্টের মতো। স্টিম ইঞ্জিনের কয়লা ক্ষুধা,পেটের ক্ষুধার বাইরে গিয়েও যে আরো এক ভৌতিক ক্ষুধা শরীরের থাকতে পারে,তার স্পর্শে গায়ে লেগে থাকে বিচিত্র জ্বরের কাঁপুনি তার কথাও অবলীলায় বলেন তিনি। জীবন আমার বোন উপন্যাসে মাহমুদুল হক লিখেছিলেন,‘আসলে জীবন মানেই শৈশব; জীবনভর মানুষ এই একটা ঐশ্বর্যই ভাঙ্গিয়ে খায়, আর কোনো পুঁজিপাট্টা নেই তার।’ আবিদ আজাদের কবিতার স্বপ্ন পড়েও বারবার একই অনুভূতি হয়। মনে হয় একই শিবিরের দুই বন্ধু গল্প করেছে শৈশব নিয়ে। দুঃখ আর বেদনা গায়ে মেখে থাকা এক বিষাদবর্ণ দেওয়ালে যেন ধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে আবিদের কণ্ঠস্বর— ❝শৈশব হচ্ছে একটি জানালা: পৃথিবীর দিকে যে জানালাটি শুধু একবারই খোলা হয়। সেই খোলা জানালায় যা কিছু চোখে পড়ে-রাস্তার তুচ্ছ ধূলিবালি থেকে শুরু করে আকাশের তারা, ঘাসের পাতা থেকে শুরু করে নৌকার অশ্রুরুদ্ধ গলুই, মানুষের হাতের আঙুল থেকে শুরু করে মৃত্যুর থুতনির পাশে ছিটকে লাগা রক্তের কালচে দাগ-সব, সবকিছুকে কোটি কোটি টাকা এবং অতুল রত্নরাজির চেয়েও দামি লাগে।❞ আর তখন আমাদেরও আবিদের ফেলে আসা কৈশোরকে নিজের কৈশোর মনে হতে থাকে। আর তার জন্য মন কেমন করতে থাকে...
এখন আমরা পড়তেছি আবিদ আজাদের ‘কবিতার স্বপ্ন’। ১৯৯৩ য়ের লেখা একটা বাল্যস্মৃতিকথা। উমদা গদ্য; নিজস্ব চাল ও নিজস্ব ঢং। জীবনরে কেমনে কবিতা না কবিতারে কেমনে জীবন জড়ায়ে নিল তাই লেখক রেলস্টেশনের টইটই, যাত্রীদের ফেলায় যাওয়া সিগারেটের চকচকে খলি প্যাকেট আর খাকি ক্লারের বাতি টিকিট, বর্শা নিয়া রাত-বিরাতে মাছ ধরার পোঁক, আর শীতের ভোরে দাদার লগে চাষবাসের সবুজ-সতেজ ফিলিং—এইসব দিয়া মিলায়ে মিলায়ে স্তরে স্তরে কিছুই বাদ রাখতে চান নাই; বাল্যকালের খুটিনাটি বিষয় অাঁকছেন রঙ ভরায়ে ভরায়ে। তো এখন আমরা ভাবতেছি যে, তিন দশকের এই ব্যবধানে আমাদের গদ্যের মধ্যে কী পরিবর্তন আর কী উন্নতি আসল। পাঠক যদি তিরানিব্বইয়ের এই উমদা গদ্য পইড়া খুব নিজে কসরত করতে লাগল এমন গদ্য কেন হয় না—তাহলে এইটা পেরেনাশি। কারণ আজ তিন দশক পর গদ্যের চাল-চলনে একটা উন্নতি আর অগ্রগতি আইসা থাকবে, যা এইত পাঠকের লেখায় প্রকাশ পাবে। এত এত গদ্য পইড়া রিফাইনিং হওয়া বৈকি।
কবিদের গদ্য আমার কাছে অনন্য এক আকর্ষণ নিয়ে ধরা দেয় সবসময়ই। কবিরা মেলোডিয়াস স্নিগ্ধ গদ্য লেখে নাকি যারা এত চমৎকার গদ্য লেখে তারাই কবি হয় কে জানে! মণীন্দ্র গুপ্ত থেকে শঙ্খ ঘোষ কিংবা সৈয়দ হক, কবিদের গদ্য মানেই শব্দের শেকলে মূহুর্তদের বেঁধে রাখা যেন।
কবিতার স্বপ্ন আসলেই কবিতার স্বপ্ন! কিশোরগঞ্জের গ্রাম থেকে শহরে আসে যে বালক, নিতান্ত কাঁচা বয়স থেকেই সে যাপন করছিল কবিতা; কখনো হাঁপানির টানে কখনো জ্বরের ঘোরে। বইতে কবি আবিদ আজাদ মূলত, তার বাল্যকাল ও কৈশোরেরই স্মৃতিচারণ করেছেন। কবিতা, ছিটেফোটা বাম রাজনীতি আর নিজের বড় হয়ে ওঠা এসবের কথাই কবি বর্ণনা করেছেন একদম অসংকোচে, নিজেকে মেলে ধরেছেন শব্দের সিম্ফনি বাঁধতে বাঁধতে অসামান্য সব উপমার সাথে।