‘বন্ধুরা আমার, তোমরা হচ্ছো যোদ্ধা জাতি। যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো কর্মই তোমাদের জানা নেই। মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে মায়ের কন্ঠ শোনার আগেই তোমরা অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনেছো। তোমরা হচ্ছো সেই জাতি, যাদেরকে আজ পর্যন্ত কেউ পদানত করতে পারেনি। যোদ্ধারা আমার, আজকে যুদ্ধের তৃতীয় দিন। গত দুইদিন তোমরা সাহসের সাথে লড়াই করেছো। আমি চাই তোমরা আজকে মরণপণ যুদ্ধ করো। আজকেই যুদ্ধের পরিণতি ঠিক করে দাও। সমুদ্রের ওপাড় থেকে যেমন করে তোমরা তেড়েফুঁড়ে এসেছো, তেমনি আজ তেড়েফুঁড়ে ঢুকে যাও প্রতিপক্ষের সৈন্যদের ভেতর। তোমাদের প্রত্যেকের তরবারি হয়ে উঠুক জুলফিকার। আজকে কোনো কৌশল নয়, শুধুই যুদ্ধ। মনে রেখো, তোমরা বাতিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছো। তোমরাই বিজয়ী হবে। সবাই প্রস্তুত হও।’ গলার রগ টান টান করে দুলকি চালে ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে চিৎকার করে বললো তারিক বিন যিয়াদ। স্পেন বিজয়ী বীর তারিক বিন যিয়াদের দুর্ধর্ষ জীবনে আপনাকে স্বাগতম।
তারিক বিন যিয়াদ মুসলিম বিশ্ব তো বটেই, পুরো পৃথিবীর অন্যতম কৌশলী সমরবিদ হিসেবে বিবেচিত হোন। যার জন্ম আফ্রিকার এক বর্বর জাতিতে কিন্তু ধৈর্য, মানসিক দৃঢ়তা, সাহস, রণকৌশল, ধীশক্তি ইত্যাদির গুণাবলীর সমন্বয়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন কিংবদন্তীতে। ' জিব্রাল্টার' নামটি যে জাবালে তারিক থেকে উৎপন্ন তা জেনে বিস্মিত হয়েছি! ' আফ্রিকার খঞ্জর ' উপন্যাসটি সেই তারিক বিন যিয়াদের বিখ্যাত স্পেন অভিযানের কাহিনীর উপর রচিত।
ঐতিহাসিক উপন্যাস ইতিহাস নয়, তবে সুদূর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে গল্পের ছলে সমসাময়িক পাঠকদের ইতিহাসের প্রতি কৌতূহলী করা তোলা এর অন্যতম উদ্দেশ্য বলে আমার মনে হয়। ' আফ্রিকার খঞ্জর' সেই উদ্দেশ্য সফলে সার্থক। তাছাড়া ' আফ্রিকার খঞ্জর ' শুধুমাত্র এপিক যুদ্ধোপন্যাস হিসেবে বেশ দারুণ, যাতে রয়েছে যুদ্ধ,কূটকৌশল, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, টিকে থাকার কঠিন লড়াই আর নিজ অস্তিত্ব রক্ষার মরণপণ সংগ্রাম ইত্যাদি এলিমেন্টস। লেখক একটা গল্প বলতে পেরেছেন যা পাঠককে ধরে রাখে। গল্পের চরিত্রদের সাথে relate করতে পারে পাঠক। লেখক উপন্যাসটি শুধুমাত্র কোন এক ধর্মের প্রিচিং করতে লিখেন নি বা লিখতে চাইলেও পাশাপাশি তিনি একটা গল্প পাঠকদের দিতে পেরেছেন, যাতে রয়েছে একটি সফল গল্পের সমস্ত উপাদানসমূহ। ' আফ্রিকার খঞ্জর' আমি বেশ উপভোগ করেছি। দ্বিতীয় খন্ডের প্রত্যাশায় রইলাম।
ধরুন, আপনি একটা দেশের সেনাবাহিনীর সৈনিক। বিশাল জাহাজে করে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা দেশে যুদ্ধ করতে। সেই দেশের সাথে আপনার দেশের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে জলপথ। ঐ দেশের মোট সৈন্যসংখ্যা প্রায় লাখ খানেক, যার বিপরীতে আপনাদের পক্ষের সৈন্যসংখ্যা এই মূহূর্তে মাত্র ৭০০০! তবু আপনি আত্মবিশ্বাসী যে, জয় আপনাদেরই হবে। কারণ আপনাদের রয়েছে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেনাপতি, যার যুদ্ধকৌশল অনন্য এবং খুবই কার্যকরী। কিন্তু যখনি জাহাজ থেকে আপনারা সবাই নামলেন, দেখলেন সেনাপতি ঘোষণা দিচ্ছে, ‘সব জাহাজ পুড়িয়ে দাও। ওগুলো আমাদের লাগবে না কারণ আমরা আর ফেরত যাচ্ছিনা। যুদ্ধে হয় আল্লাহর পথে আমরা শহীদ হবো, নাহয় এদেশেই স্থাপিত হবে আমাদের বিজয়ের পতাকা।’
সত্যি করে বলুন তো, যতই আপনার সেনাপতির ওপর ভরসা থাকুক, সেনাপতির এমন সিদ্ধান্ত আপনাকে কেমন অনুভব করাবে? এ নিয়ে বিস্তারিত বলছি, তার আগে একটু ভূগোল ঘাটি চলুন।
‘জাবাল আত তারিক’ এর নাম শুনেছেন? আরবি জাবাল শব্দটির অর্থ পাহাড় এবং জাবাল আত তারিকের অর্থ তারিকের পাহাড়। জাবাল আত তারিক হোক কিংবা তারিকের পাহাড়ই হোক, নাম শুনেছেন একটারও? যারা আমার মত স্বল্পজ্ঞানী তাদের উত্তর হয়তো হবে, ‘না’। কিন্তু যদি বলি ‘জিব্রাল্টার’, তাহলে? ছোটবেলায় ভূগোল পড়েছি অথচ জিব্রাল্টার প্রণালীর নাম শুনিনি, এমন বোধহয় কেউই নেই।
বিরক্ত হচ্ছেন? ভাবছেন, শুরুতে একটা গল্প বলে এখন আবার এইসব ভূগোল টুগোল নিয়ে আলোচনা কেন হচ্ছে? তাহলে বুঝিয়েই বলি। আজকে যে বইটা নিয়ে কথা বলবো সেটার সাথে জিব্রাল্টার প্রণালী ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরের প্রবেশপথে স্পেনের দক্ষিণে অবস্থিত এই প্রণালীটির নামকরণ করা হয় প্রণালীর পাশে অবস্থিত জিব্রাল্টার পাহাড় নাম অনুসারে। জাবাল আত তারিকই অপভ্রংশ হয়েই বর্তমান জিব্রাল্টার হয়। আর এই জাবাল আত তারিক নামকরণটি করা হয় শুরুতে যে আপাত পাগলাটে সেনাপতির কথা বলছি তার নামানুসারে৷ যারা ইসলাম ইতিহাসের খোঁজ রাখেন তারা হয়তো বুঝে গিয়েছেন আমি কার নাম বলছি। হ্যাঁ, তিনি হচ্ছেন বিখ্যাত সেনাপতি, তারিক ইবনে জিয়াদ (অনেক জায়গায় তারিক বিন জিয়াদও বলে, দুটোই সঠিক)। ‘আফ্রিকার খঞ্জর’ এ বর্ণিত হয়েছে তারিক ইবনে জিয়াদের স্পেন বিজয়ের বীরত্বগাঁথা।
লেখক আল আমিন সরল এর ১ম বই ‘আফ্রিকার খঞ্জর’ এ (হিস্টোরিকাল ফিকশন) ইতিহাসের সাথে মিশেছে ফিকশন। তারিক ইবনে জিয়াদের শৈশবের বর্ণনাসহ স্পেন অভিমুখে তার যাত্রা, স্পেন বিজয়ের খন্ডাংশ উঠে এসেছে বইতে। বার্বার গোত্রের এই তারিক ইবনে জিয়াদ ছিলেন মুসা বিন নুসাইরের একজন দাস, তবে মুসা বিন নুসাইর তাকে মুক্ত করে দেন এবং তার যোগ্যতা বলে তিনি মুসা বিন নুসাইরের একজন গভর্নর পদে নিযুক্ত হন। এরপর স্পেন আক্রমণ করে তিনি হয়ে যান একজন কিংবদন্তী। তবে ইতিহাসের কচকচানি বাদ দিয়ে লেখক এখানে ইতিহাসকে বর্ণনা করেছেন সুন্দর একটা গল্পের মাধ্যমে। এই গল্প শুধু যুদ্ধের গল্প নয়। এই গল্পে এসেছে রাজনীতি, অন্তর্দ্বন্দ, বিশ্বাসঘাতকতা, যুদ্ধ কৌশল, মানবমনের নানা দোষ-ক্রুটি, তৎকালীন সমাজব্যবস্থা সহ আরো অনেক কিছু। এমনকি যারা থ্রিলার বই পড়তে ভালোবাসেন তারা নিঃসন্দেহে বইটা দারুণ উপভোগ করবেন বলে আমার বিশ্বাস। তাই আমি বলবো, বইয়ের গল্প যে ভালো তা নিয়ে কোন সন্দেহ আমার।
এবার আসি লিখনশৈলীতে। লেখার দিক থেকে চিন্তা করলে ইতিহাসের সাথে ফিকশনের মেলবন্ধন করাটা আমার কাছে বেশ কঠিন একটা কাজ মনে হয়। সঠিক ইতিহাস ধরে রেখে পাঠককে গল্পে আটকে রাখতে চাই অসাধারণ গল্প বলার ক্ষমতা। আর অসাধারণ গল্প হবার মূল যে কয়টি উপাদান আছে তার মাঝে অন্যতম হলো ভাষা এবং গল্পে সঠিক ফ্লো ধরে রাখা। এ গল্পে আল আমিন সরল সাবলীল ভাষা ব্যবহার করে গল্পটাকে সকল পাঠকের বোধগম্য এবং উপভোগ্য করে তুলেছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার শব্দচয়ন এতটাই চমৎকার ছিলো যে আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি এটা লেখকের ১ম লেখা বই জানতে পেরে। বইটাকে ১৯২ পেজে মলাটবদ্ধ করলেও যেখানে প্রয়োজন সেখানে বেশ ডিটেইলড বর্ণনা দিয়েছেন লেখক, বিশেষ করে যুদ্ধের দৃশ্যগুলো। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে আমি যেন যুদ্ধক্ষেত্রেই উপস্থিত আছি, চোখের সামনেই ঘটছে মৃত্যুলীলা, কানে ঝনঝন করে বাজছে তলোয়ারের ঝংকার। বিশেষ করে দুদিনের যুদ্ধ শেষে তারিক ইবনে জিয়াদ যখন তার সৈন্যবাহিনীকে বলেন-
‘বন্ধুরা আমার, তোমরা হচ্ছো যোদ্ধা জাতি। যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো কর্মই তোমাদের জানা নেই। মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে মায়ের কন্ঠ শোনার আগেই তোমরা অস্ত্রের ঝনঝনানি শুনেছো। তোমরা হচ্ছো সেই জাতি, যাদেরকে আজ পর্যন্ত কেউ পদানত করতে পারেনি। যোদ্ধারা আমার, আজকে যুদ্ধের তৃতীয় দিন। গত দুইদিন তোমরা সাহসের সাথে লড়াই করেছো। আমি চাই তোমরা আজকে মরণপণ যুদ্ধ করো। আজকেই যুদ্ধের পরিণতি ঠিক করে দাও। সমুদ্রের ওপাড় থেকে যেমন করে তোমরা তেড়েফুঁড়ে এসেছো, তেমনি আজ তেড়েফুঁড়ে ঢুকে যাও প্রতিপক্ষের সৈন্যদের ভেতর। তোমাদের প্রত্যেকের তরবারি হয়ে উঠুক জুলফিকার। আজকে কোনো কৌশল নয়, শুধুই যুদ্ধ। মনে রেখো, তোমরা বাতিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছো। তোমরাই বিজয়ী হবে। সবাই প্রস্তুত হও।’
আমার দারুণ পছন্দের একটি সিনেমা হলো ‘ট্রয়’। একিলিস হিসাবে ব্র্যাড পিট যখন দ্বন্দযুদ্ধে বোয়াগ্রিয়াসকে হত্যা করে, আমি হতবাক হয়ে যাই একিলিসের ক্ষীপ্রতা দেখে। সেই সিনটা আমি সম্ভবত কখনো ভুলতে পারবো না। ঠিক একই ভাবে এই বইটাকে যদি ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় আনা যায় তাহলে আমার ধারণা এই ভাষণটা মনে রাখার মতো একটা দৃশ্য হবে।
আর গল্পের ফ্লো এর কথা বললে বলতে হয় আপনি শুরু থেকেই একদম সেঁটে যাবেন বইয়ের সাথে। যুদ্ধ বা ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহ থাকলে আমার ধারণা আপনি এক মূহূর্তের জন্য বিরক্ত হবেন না। আর এরকম একটা বই ২৫০-৩০০ টাকা দিয়ে কিনলে লাভ বৈ লস হবেনা মনে হয় (মুদ্রিত মূল্য – ৪০০ টাকা)।
যাই হোক, এক বই নিয়ে অনেক প্যাঁচাল পেরে ফেলছি। এর কারণ হচ্ছে এটা ব্লাইন্ড ভাবে সিলেক্ট করা বই। এবং বইটা আমার ভালো লেগেছে। ব্লাইন্ড ভাবে সিলেক্ট করা বই ভালো লাগলে সেটা জানাতে আমার ভালো লাগে। তাই আমি সাধারণত এত বড় রিভিউ না লিখলেও এখন থেকে ঠিক করেছি যে বইগুলো বেশি ভালো লাগবে সেগুলো নিয়ে একটু বড় করে লিখবো।
রেকমেন্ডেশন : যারা থ্রিলার ভালোবাসেন, যারা হিস্টোরিক্যাল ফিকশন ভালোবাসেন এবং সর্বোপরি যারা একটা গল্প ভালোবাসেন।
খবরদার! খবরদার! আপনাদের হাত যেন এমন কোনো যোদ্ধার ওপর না উঠে, যে অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে। আপনাদের তলোয়ার যেনো এমন এমন কারো মাথা ছিন্ন না করে যে পরাজয় মেনে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেছে। মনে রাখবেন, আপনার সৈনিকেরা সবুজ শস্যের ক্ষেত যেন পদদলিত না করে, ফসল না কাটে, বৃক্ষের মূলোৎপাটন না করে। যারা যুদ্ধ করছে না তদের বিরুদ্ধে যেনো অস্ত্র ধারণ না করে। নারী, বৃদ্ধ, শিশু, দুস্থ, প্রতিবন্ধী লোকদের যেন বিনা কারনে কষ্ট না দেয়। যে অমুসলিম জিযিয়া কর দিতে রাজী থাকবে সে মুক্ত থাকবে। একজন মুসলিম যে অধিকার পায় সেও একই অধিকার পাবে। সাবধান, কোনো অমুসলিম প্রজার প্রতি এমন কোনো আচরণ করবেন না, যা আপনি আপনার ভাইয়ের সাথে করেন না।
উপরের কথাগুলো চমৎকার না? এরকম পুরো বই জুড়েই সেনাপতি কিংবা খলিফাদের বিভিন্ন চমৎকার ভাষন রয়েছে। ওহ, বইয়ের কাহিনীটাই তো বলা হয়নি। কাহিনী কিচ্ছু না, মুসলিম সম্রাজ্যের স্পেন বিজয়ের গল্প। যে গল্পের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে অকুতোভয় মুসলিম সেনা আর তাদের সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ। আর বাকী অংশে রয়েছে তৎকালীন স্পেনের পরিস্থিতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, লোভ, লালসা, হিংসা, বিশ্বাসঘাতকতা আর যুদ্ধ।
এক বাক্যে বলতে গেলে চমৎকার একটা বই পড়ে শেষ করলাম। ইতিহাসের সাথে কল্পনার মিশ্রণে দূর্দান্ত একটা হিস্টোরিক্যাল ফিকশন দাঁড় করিয়েছেন লেখক। গল্পের শুরুটা হয় তৎকালীন সিউটা দূর্গের অধিপতি কাউন্ট জুলিয়নের ঘরে। যে মাত্রই তার রাজত্ব হারিয়েছে স্পেনের সম্রাট রডারিকের হাতে। শুধুই কি রাজত্ব? নিজের একমাত্র মেয়ের সম্ভ্রমটাও যে কেড়ে নিয়েছে নৃশংস এবং চরিত্রহীন রডারিক। রাগে ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গিয়ে কাউন্ট জুলিয়ন আর তার বন্ধু এবং সেনাপতি ক্লডিয়াস গিয়ে সহায়তা চাইলো সমুদ্রের ওপারে মিশরের আমির মুসা বিন নুসাইরের কাছে। তারা শুনেছে মুসলিমরা নাকী সবসময় মজলুমদের পাশে দাঁড়ায়। আর এভাবেই শুরু হয় মুসলিমদের স্পেন অভিযান।
লেখক গল্পের লেয়ার সাজিয়েছেন সুনিপুণ দক্ষতার সাথে। গল্পের এক অংশ এগিয়ে নিয়েছেন সম্রাট রডারিক, সম্রাটের খাস দূত হোরাস, সেনাপতি বেনেশিয়ো আর পাদ্রী বিনাই ব্রিথের বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে। তৎকালীন সময়ের সামাজিক পরিস্থিতির কিছু চিত্রও উঠে এসেছে এই অংশে। আবার আরেক অংশে মিশর থেকে স্পেন পর্যন্ত মুসলিম অভিযানের খুঁটিনাটি অংশগুলো বর্ণনা করেছেন। এখানের চরিত্ররা ছিল আমির মুসা বিন নুসাইর, তার ছেলে আব্দুল আজিজ, বুড়ো ভাল্লুক মুগীস-আর-রুমি, শাবাব বিন কাস, আবু আব্দুল্লাহ, আর তারিক বিন জিয়াদ। পাশাপাশি আচার ব্যবসায়ী মাউলি বেকো, ইহুদি উজায়েল এবং তার মেয়ে এরিনাকে সাথে নিয়ে একটা সাইড স্টোরিও এনেছেন৷ আর এই সব কিছুকে লেখক কোনো গৎবাঁধা বর্ণনার মাধ্যমে নয়, চরিত্রগুলোর কর্মকান্ড দিয়ে ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে সাজিয়েছেন। সেই গল্প এতোটাই চিত্তাকর্ষক যে বইটা পড়তে বসলে টানা পড়ে যেতে ইচ্ছে করবে।
বইটিতে তৎকালীন স্পেনের রাজ পরিবারের উপর চার্চের কর্তৃত্ব, সাধারণ জনগনের উপর তাদের ক্ষমতার নমুনা, ইহুদিদের প্রতি নিদারুণ অত্যাচার, অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়েদের কঠিন জীবন; এমন অনেক কিছুই উঠে এসেছে। পাশাপাশি বইয়ে উঠে এসেছে আফ্রিকার দুর্ধর্ষ বার্বার জাতির যুদ্ধের উপাখ্যান, মুসা বিন নুসাইরের হৃদয় জয় করা কথামালা, তারিক বিন জিয়াদের একজন দাস থেকে স্পেন অভিযানের সেনাপতি হয়ে উঠার গল্প। এই সব গল্পই এগিয়েছে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে, একবারের জন্যও গল্পের ফ্লো নষ্ট হতে দেননি লেখক। প্রতিটা চ্যাপ্টারেই এমন কোনো না কোনো ঘটনা ঘটছিলো যে অটোমেটিক পরের চ্যাপ্টার পড়ার আগ্রহ তৈরী হয়ে যাচ্ছিলো। মূল অভিযানের ফাঁকে ফাঁকে যেভাবে লেখক তারিকের অতীত তুলে ধরেছেন তা প্রশংসার দাবীদার।
তারিক ইবনে জিয়াদ, এই বইটার হাইলাইটস। তারিকের মুখে বলা প্রতিটা কথা, তার মনের গভীরে থাকা ভালোবাসা, তার শান্ত ধীর স্থির অবিচল চরিত্র, যুদ্ধের সময়ে ধারণ করা অগ্নিমূর্তি, নিজের সেনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষদের প্রতি মায়া, জেতার অদম্য বাসনা, সবকিছু মিলিয়ে দীর্ঘদিন মনে গেঁথে থাকার মতো একজন চরিত্র। যুদ্ধের সময়ে নিজ সেনাদের উদ্দেশ্যে দেয়া তার বিভিন্ন ভাষন পড়ার সময়ে মনে হচ্ছিলো আমি নিজেই বুঝি এখন যুদ্ধে নেমে যাবো!!
আর এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব অবশ্যই লেখকের। তিনিই তারিক সহ গল্পের প্রতিটা চরিত্রকে অত্যন্ত যত্নের সাথে লিখেছেন। পাঠক হিসাবে তাই চরিত্রগুলোর সাথে রিলেট করতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হবে না কারো। লেখকের লিখনশৈলী চমৎকার লেগেছে আমার কাছে। সম-সাময়িক অনেক নামকরা লেখকের তুলনায় খুবই ভালো উনার লেখার হাত। মনেই হয়নি এটা উনার প্রথম উপন্যাস। একটা ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার সাথে নিজের কল্পনাকে মিশিয়ে এভাবে টুকরো টুকরো গল্পের মাধ্যমে পুরো ঘটনাবলী তুলে ধরাটা লেখকের মুন্সিয়ানার পরিচয় তুলে ধরে। গল্পের পাশাপাশি সংলাপও সাজিয়েছেন চমৎকার। সংলাপগুলো পড়ার সময় প্রচন্ড রকমের বাস্তব মনে হচ্ছিলো। এর সাথে আছে যুদ্ধের বর্ণনা। যুদ্ধের রণকৌশল আর খন্ড খন্ড যুদ্ধের বর্ণনাও ছিলো চিত্তাকর্ষক। বিশেষ করে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ গুলোর দৃশ্যায়ন খুবই চমৎকার এবং বাস্তব মনে হয়েছে। এছাড়া দূর্গ দখলের সময়ে যেসব বুদ্ধির আশ্রয় নিয়েছে তারিক সেগুলোর জন্যও লেখক প্রশংসা প্রাপ্য। সোজা কথায় বলতে গেলে, লেখকের দক্ষতার কারনেই একটা সত্য ঘটনা গল্প হিসাবে পড়ার সময় এতোটা ভালো লেগেছে।
সমালোচনার জায়গা বলতে গেলে, কিছু পরিস্থিতিতে কিছু চরিত্রের কর্মকান্ড ঠিক বাস্তব বলে মনে হয়নি। যদিও তা সামান্যই। আর বইটা কেমন যেনো হুট করেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি যখন শেষ পাতায় "প্রথম পর্ব সমাপ্ত" লেখাটা দেখি তখন মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছে। কতো প্রশ্নের উত্তরই তো জানা হলো না! দ্বিতীয় পর্বের জন্য আরো কতোদিন অপেক্ষা করা লাগবে কে জানে!!
ব্যক্তিগত রেটিংঃ ৮.৫/১০ (হিস্টোরিক্যাল ফিকশন আমার অত্যন্ত পছন্দের। তবে যাদের এই জনরাটা খুব একটা পছন্দ নয়, তারাও অনায়াসে বইটা পড়ে যেতে পারবেন এর ঘটনার পরিক্রমার গতিশীলতা আর চমৎকার লিখনশৈলীর দরুণ )
প্রোডাকশনঃ স্বরে অ, এই প্রকাশনীর সাথেও পরিচয় ঘটলো এই বইটার মাধ্���মে। তাদের প্রোডাকশন বেশ ভালো লেগেছে আমার। বিশেষ করে বইয়ের মিনিমালিস্ট প্রচ্ছদটা অনেক অনেক পছন্দ হয়েছে আমার। এছাড়া পেজ কোয়ালিটি, বাঁধাইও ভালোই ছিলো। খুব সামান্য কিছু বানান ভুল ছিলো। ব্যক্তিগত একটা সাজেশন তাদের প্রতিও রয়েছে৷ কিছু কিছু অধ্যায়ে ঘটনা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সুইচ করেছে, সেই জায়গা গুলোতে একটু গ্যাপ রেখে মাঝে *** বা এই জাতীয় চিহ্ন দিলে ভালো হতো।
পুনশ্চঃ দুইজন মানুষ ধন্যবাদ প্রাপ্য। প্রথমে ধন্যবাদ জানাই তানজীম ভাইকে নিতান্তই আলোচনাহীন এই বইটাকে নিয়ে দুরন্ত রিভিউ দিয়ে বইটাকে আমার নজরে আনার জন্য। এই বই মিস করাটা কোনোমতেই আমার উচিত হতো না। দ্বিতীয়ত ধন্যবাদ প্রাপ্য সাদিয়া, যে আমার অধীর আগ্রহের কারনে নিজ থেকেই বইটা আমাকে ধার দিয়েছিলো পড়ার জন্য। তবে পড়ার পর এই বইটা এখন আমি নিজেই কিনে রাখবো। এমন বই সংগ্রহে থাকা উচিত।