এই গ্রন্থে মোজাফ্ফর আরও বেশি সংহত, লক্ষ্যভেদী। জাদুবাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভায়োলেন্স— মানুষের মুখোশের আড়ালের চেহারা এমনভাবে প্রকাশিত হয়েছে যে পাঠক শিউরে উঠবেন, প্রশ্নবিদ্ধ করবেন নিজেকেও। ‘নো ওম্যান'স ল্যান্ড’-এ সতেরটি গল্পের সঙ্গে গ্রন্থিত হয়েছে একটি উপন্যাসিকা। সাইকো থ্রিলার জনরার এই উপন্যাসিকায় লেখক ভায়োলেন্স দিয়েই ভায়োলেন্স প্রতিরোধের কণ্ঠস্বর তৈরি করেছেন।
কথাশিল্পী-প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মোজাফ্ফর হোসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সাংবাদিকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে বাংলা একাডেমির অনুবাদ উপবিভাগে কর্মরত। প্রধানত ছোটগল্পকার। পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচক ও অনুবাদক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি আছে। অতীত একটা ভিনদেশ গল্পগ্রন্থের জন্য তিনি এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ কথাসাহিত্য পুরস্কার এবং স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষেরা গল্পগ্রন্থের জন্য আবুল হাসান সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়াও ছোটগল্পের জন্য তিনি অরণি সাহিত্য পুরস্কার ও বৈশাখি টেলিভিশন পুরস্কারে ভূষিত হন।
চার তারাই হয়তো দিতাম কিন্তু শেষের সাইকো থ্রিলারটা পড়ে তিন তারার উপরে দিতে ইচ্ছা করলো না। বইতে মোট গল্প আছে ১৭ টা সঙ্গে একটা সাইকো থ্রিলার। তন্মধ্যে,
"নো ম্যানস ল্যান্ড", "ডেথফরহ্যাভেনডটকম", " আমার মা বেশ্যা ছিলেন", "আত্মহত্যা করার জন্য লোকটা মরেনি", " জলের মাঝে স্বপ্নের বুদবুদ", "মাকে আর মনে পড়েনা", "ব্রেকিং নিউজের পরে"
এই ৭ টা গল্প বেশ লেগেছে। কয়েকটা গল্প একেবারেই জমেনি। কিছু গল্প আবার আগে বিভিন্ন পত্রিকায় ও বইতে ছাপা আছে। সব মিলিয়ে মিশ্র একটা ব্যাপার।
স্যাটায়ার, মেটাফোর কিংবা ম্যাজিক রিয়েলিজমের মাধ্যমে আমাদের চেনা পরিবেশের গল্প-চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলায় লেখকের কোনো তুলনা নেই। চেনা-অচেনা চরিত্রগুলোর মাঝেই বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন তার দর্শন, খুব সাবলীল কোনো বর্ণনা বা সংলাপেই বিশ্লেষণ করতে পারেন জটিল কোনো সামাজিক সমস্যার। একজন ভালো লেখকের সব গুণ তার লেখায় সূক্ষ্মভাবে চোখে পড়ে। এই বইয়ের গল্পগুলোতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিটি গল্পেই ভাবনা উদ্রেক করার মতো অসংখ্য উপাদান ছিল, তবে আপনি যদি ভাবতে না-ও চান সমস্যা নেই, গল্পে আপনি মুগ্ধ হবেনই। পাঠককে গল্পের শুরু থেকে শেষ অবধি আটকে রাখার মতো পর্যাপ্ত 'রস' রয়েছে প্রতিটি গল্পেই। অনেকগুলো গল্প পড়তে গিয়ে কখনো মনে হবে না একটি চরিত্র বুঝি আগের কোনো এক গল্পের চরিত্রের ছায়া। এতটাই মৌলিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিটি গল্প।
তবে, বইয়ের একমাত্র উপন্যাসিকাটিতে অবশ্য বেশ কিছু অসংগতি চোখে পড়েছে৷ সময়োপযোগী ও দুর্দান্ত প্লট হওয়া স্বত্ত্বেও অনেক কিছুর অভাব যেন চোখে লেগেছে। যে সাবলীল ভঙ্গিমায় তিনি ছোটগল্পগুলো লিখেছেন সেটার অনেকটা অভাবই এখানে ছিল। অনেক ক্ষেত্রে গল্পের গতি হয়ে গিয়েছে খুব বেশি, যেখানটাতে লেখক চাইলে আরেকটু ধীরে-সুস্থে বর্ণনা করতে পারতেন। পুরো লেখাটি যদিও তিনি নাম পুরুষে বর্ণনা করেছেন, তবে হুটহাট কোনো কোনো প্যারায় দিনার চরিত্রটির জায়গায় 'আমি' অর্থাৎ প্রথম পুরুষ চলে এসেছে। এসব ভুলগুলো পরবর্তী সংষ্করণে ঠিক করা হবে বলে আশা করছি।
বইটিতে মোট সতেরোটি গল্প ও একটি উপন্যাসিকা রয়েছে। সব মিলিয়ে, আমার কাছে বইটি যথেষ্ট ভালো লেগেছে। যেকোনো পাঠকের জন্যই বইটি সুখপাঠ্য হবে বলে আমার ধারণা।
কয়েকটি গল্প ভালো লেগেছে। লেখক দেশ সময় ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন। বাংলাদেশের সমাজের ধর্মান্ধতা আর নারীবিদ্বেষসহ অনেক বিষয় তার গল্পে উঠে আসে।
শুধু শেষের থ্রিলারখানা মনে হল বেশ কাঁচা হাতের লেখা। ওটা এই সংকলনে না থাকলেই যেন ভালো হত। বেশ তাড়াহুড়া আর অযত্নের ছাপ। থ্রিলার লিখলে সেভাবেই লেখা উচিত বলে মনে হয়।
প্রথম গল্পটা "নো ম্যান'স ল্যান্ড" পড়ে ভালো লেগেছিল। কিন্তু এর পর "মাকে আর পড়ে না মনে" ছাড়া ১৫টা ছোটগল্পের আর কোনটাই মনে ধরেনি। ভীষণ অর্ডিনারি লেগেছে। সবশেষে "নো ওম্যান'স ল্যান্ড" নামের সাইকো থ্রিলার। মোজাফফর তাঁর মানুষের মাংসের রেস্তোরার একটি ছোটগল্পকে টেনে বড় করে এই সাইকো থ্রিলার বানিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে মোজাফফর হোসেন নীরিক্ষাধর্মী লেখক। প্রথম মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু এরপর ওনার যে লেখাই পড়েছি অতটা টানতে পারে নি। ২/৫
মানুষের মাংসের রেস্তোরাঁ যাদের পছন্দ হয়েছে, আমার ধারণা তারা এই বইটি আরো বেশি পছন্দ করবেন। আমি দশটি গল্প পড়েছি, সাইকো থ্রিলারটা সব শেষে পড়ব। ছোটো গল্প, কিন্তু টানা পড়া যায় না এতট অস্বস্তিকর ও চিন্তাশীল গল্পগুলো, এই কারণে সময় লেগে যাচ্ছে।
আমার মা বেশ্যা ছিলেন, ডেথ ফর হেভেন ডট কম, ব্রেকিং নিউজের পরে, নো ম্যানস ল্যান্ড, পরাধীন দেশের স্বাধীন মানুষেরা এই গল্পগুলো পড়ার পর মাথা উড়ে গেছে। সবকিছু শূন্য মনে হচ্ছে।