Asif Siddiquee Deepro's Blog
March 23, 2019
গল্পের পেছনের গল্প
জনপ্রিয় ফেসবুক পেজ "থ্রিলার পাথলদের আসর"-এ একাত্তরের কানাগলি'র পেছনের গল্প নিয়ে আলোচনা এবং একটি ছোট প্রশ্ন-উত্তর পর্ব হয়েছিল। পুরোটাই নিচে তুলে দেওয়া হল। এছাড়া অন্য কোনো প্রশ্ন থাকলে এখানে করতে পারেন, উত্তর দেবার চেষ্টা করব।
বই : একাত্তরের কানাগলি
লেখক : আসিফ সিদ্দিকী দীপ্র
.
.
╚►পেছনের গল্প◄╝
.
আমার বইয়ের ফ্ল্যাপে আমি লিখেছিলাম মৌলিক বই লিখব এমন চিন্তা আমার ছিল না। আসলে প্রস্তুতিও ছিল না। সাধারণত একজন লেখকের প্রথম প্রকাশিত বইয়ের আগে প্রকাশিত-অপ্রকাশিত অথবা আজকালকার হিসেবে বলতে গেলে ফেসবুকে প্রকাশিত অসংখ্য ছোট-বড় গল্প থাকে। আমার সেরকম কিছুই নেই। এর আগে কেবল একটা বই অনুবাদ করেছিলাম সেটাও এমন আহামরি কিছু হয় নি; নিজেও যে খুব উপভোগ করেছি তাও নয়। অর্থাৎ মৌলিক লেখা বলতে আমার একেবারেই কিছু ছিল না এর আগে।
.
‘একাত্তরের কানাগলি’র প্লট একেবারে হুট করেই মাথায় চলে আসে। সেই ব্যাপারটাও বেশ মজার। দিনটা ছিল ২০১৪ সালের ২৫শে মার্চ। দুপুর বারোটার মত বাজে। আমি তখন ড. আব্দুল কাদের খানকে নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম আর অন্যদিকে ফেসবুক অন ছিল। ফেসবুকে একটা পোষ্টে দেখলাম প্রখ্যাত লেখক রবিন জামান খানকে তার এক ফলোয়ার জিজ্ঞেস করলেন ওনার ‘ব্ল্যাক বুদ্ধা’ বইটা কবে আসছে। উত্তরে রবিন ভাই লিখলেন যে আপাতত তিনি ২৫শে মার্চ আর সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে পড়াশোনা করছেন, ওটা আসতে দেরি হবে। পরের বছরের মেলাতেই আমরা উনার অসাধারণ ‘২৫শে মার্চ’ বইটা পেয়ে যাই। যাইহোক, ঐ কমেন্টটা দেখে ২৫শে মার্চের গল্পটা কেমন হতে পারে এটা ভাবতে ভাবতেই আমি চেয়ার থেকে উঠলাম, ঘুমাতে যাবার উদ্দেশ্যে (আমার ঘুমানোর কোনো আগা মাথা নেই)। তো আমি বিছানায় উঠতে যাবো ঠিক ঐ এক মুহূর্তের মধ্যেই পুরো প্লটটা আমার মাথায় একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল।
.
এসময়টা ছিল আমার বিবিএ’এর ফাইনাল সেমিষ্টারের শেষের মাস। ঐ সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু রিসার্চ করে দেখলাম আসলেই প্লটটার কোনো ভিত্তি আছে কিনা। যতই পড়তে লাগলাম ততই মনে হল সম্ভব এবং খুব ভালো করেই সম্ভব। এরপর আস্তে আস্তে গভীরতা আরো বাড়তে থাকল।
.
এখানে একটা জিনিস বলে নিতে চাই। প্রায়ই একটা প্রশ্ন করা হয়, একজন লেখক আসলে কেনো লেখেন? অর্থ বা খ্যাতির জন্য? বাংলাদেশে কোনো লেখক যে টাকার জন্য বই লেখেন না এইটা একেবারে অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেবার মত সত্য। খ্যাতি বা পাঠককে আনন্দ দিতেও আসলে কেউ লেখেন না। লেখেন আসলে একেবারেই নিজের জন্য। অন্তত আমার ক্ষেত্রে সেটাই ছিল। আমি নিজে থ্রিলার পড়ার সময় খুবই বিস্তৃত, অনেক বেশি চরিত্রের আর জটিল গল্প পছন্দ করি। সরল বা যে গল্প পড়তে গেলে কোনো মাথাই থাটাতে হবে না বা যেরকম গল্প লিখতে লেখককে তেমন একটা চিন্তাও করতে হয় না সেরকম গল্প আমাকে ঠিক টানে না। সেজন্যই চেয়েছিলাম আমার নিজের গল্পটাকে জটিল ও বিস্তৃত করতে। না হলে নিজেই উৎসাহ পেতাম না। আর যেহেতু আমি আগে কিছুই লিখিনি আমার জন্য ব্যাপারটা বেশ কঠিন ছিল। এমনকি বইয়ের যখন অর্ধেক শেষ করে ফেলেছি তখনও সন্দেহ ছিল শেষ পর্যন্ত যেতে পারব কিনা।
.
কেবল প্লটের উপর বিশ্বাসের জোরে টেনে গেলাম। আমি এমনিতে নিজের লেখনি নিয়ে খুব বেশি স্যাটিসফায়েড না। এখনকার প্রথম সারির মৌলিক লেখক যারা শরীফুল হাসান, মোহম্মদ নাজিম উদ্দিন, তানজিম রহমান, জাহিদ হোসেন বা রবিন জামান খানের মত লেখকদের লেখার মধ্যে একটা যে আলাদা শক্তিমত্তা অনুভব করা যায় সেরকম কিছু আমি আমার নিজের লেখায় তেমন পাই না। এটা হয়তো আমি আগে কিছু লিখিনি সেকারণেই।
.
বইয়ের কাজ প্রাথমিকভাবে শেষ হয় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি। আর যে ভার্শনটা অবশেষে ছাপানো হয়েছে সেটা করা হয়েছিল ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, ঐ মেলাতেই যাবে এই আশায়। তবে বেশ কিছু জটিলতার কারণে সে মেলায় বই বের করা সম্ভব হয় নি।
.
জটিলতাগুলোর প্রভাব আমার জীবনে বেশ মারাত্মকই ছিল। বই যখন শেষ করেছিলাম তখন বই নিয়ে বেশ কনফিডেন্ট ছিলাম। তবে এই জটিলতাগুলোর কারণে একসময় সেই কনফিডেন্স নামতে নামতে শূন্যতে এসে ঠেকে। শেষের দিকে মোটামুটি বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম যে, এই বই প্রকাশের অযোগ্য এবং এটা প্রকাশ করলে লেখক-প্রকাশক দুজনেরই ক্ষতি।
.
২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল খুব বাজেভাবে কাটে। আমি আসলে ডিপ্রেশন-সিনিসিজম (cynicism)-ওয়ার্কোহোলিজমের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। আমি দিনে প্রায় ১৫-১৬ ঘন্টা একটানা এক নাগাড়ে বসে কাজ করি। এর মধ্যে কোনো ব্রেক-ট্রেক নেই। মাসের পর মাস ঘরের ভিতর বসে থাকি। আমার হাতের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি খেতে বা ঘুমাতে বা অন্যকোনো কাজই করতে পারি না। সবসময় কাজ শেষ করি এরপর খাওয়া বা ঘুম। না হলে সারাক্ষণ মাথার মধ্যে সূঁচের মত বাধতে থাকে। এটা আসলে যে নিজে অনুভব করেনি তাকে বোঝানো সম্ভব না। এজন্য ঐ পুরো বছরটা উঠতে-বসতে-হাঁটতে-চলতে একেবারে কন্সট্যান্টলি একটা যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি কাজ করত। আর আমি নিজের সিদ্ধান্তের উপর সবসময়ই খুব বেশি নির্ভর করি; সহজে নিজের জায়গা থেকে সরি না। ঘাড়ত্যাড়া আর কি। যারা আমাকে ভালো করে চেনেন তারা জানেন। ঐ সময়টা নিজের জাজমেন্টের উপরই বেশ বড়সড় একটা সন্দেহ চলে আসলো। ক্রাইসিস অফ কনফিডেন্সে ভুগতে শুরু করেছিলাম।
.
এভাবে ২০১৭ সালের মেলা চলে আসল। তবে বোঝা গেল এবারও হচ্ছে না। আমি যখন প্রথম বই শুরু করেছিলাম নাম দিয়েছিলাম ‘ইষ্টার্ণ লাইটস’, নাম যাদেরকে বলেছি কারোই পছন্দ হয়নি, এমনকি আমার নিজেরও যে পছন্দ ছিল তেমনটা নয়। বই যেভাবে পুরো বছর পড়েছিল নামও তেমন পড়ে ছিলো। পরে মেলার আগে ভালো একটা নামই ঠিক করতে পারছিলাম না, আর অন্য দিকে মেলায় বই প্রকাশিত হচ্ছে এমন কোনো আশাও দেখছিলাম না।
.অবশেষে একেবারেই মেনে নিলাম যে, এই বই আসলে প্রকাশের যোগ্যই নয়। এখন লিখে তো ফেলেছি; তার উপর এত সময় গেছে, মাথার উপর একটা যন্ত্রণার মত ঘুরছে, যেকোনোভাবে প্রকাশ করে দিয়ে শেষ করতে পারলে হয়। যন্ত্রণা থেকে তো বাঁচি। এটা ফেব্রুয়ারির এক তারিখ, মেলা শুরু হয়ে গেছে। বই যে মেলাতেই প্রকাশ করতে হবে এমন কোনো ব্যাপার ছিলো না। তবে মেলার পরেও যে হবে সেরকম আশাও দেখছিলাম না। ২০১৬ সালের মেলার পর তো পড়েই ছিলো এক বছর। তাছাড়া আবার আমাদের দেশে তো বই মেলাতেই ঠিক মত বিক্রি হয় না, তার উপর আমার মত এক অজানা অচেনা লোকের বই! অগত্যা অন্য প্রকাশনীতে চেষ্টা করার কথা ভাবলাম। কিন্তু আমি আর কাউকেই চিনি না। এই সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন নসিব পঞ্চম জিহাদী ভাই। এই লোক আমার বই প্রকাশের জন্য যেই কষ্টটা করলেন সেটা কল্পনার অতীত, চিন্তার বাইরে। আমার নিজের মানসিক অবস্থা তখন একেবারেই খারাপ। আমার তাকে বলতেও হয়নি; উনি একেবারে নিজের দ্বায়িত্বে বেশ কয়েকটি প্রকাশনীর সাথে কথা বলে অবশেষে রোদেলাকে রাজি করালেন বই মেলার এই ব্যস্ততার ভিতর বইটি প্রকাশ করানোর জন্য। রোদেলায় প্রকাশ করাতে পারার পিছনে অসীম পিয়াস ভাইয়েরও ব্যাপক অবদান রয়েছে। এই দুই ব্যক্তি না থাকলে এই বই কোনোদিনও বের হত না।
.
প্রকাশনী ঠিক হল। এদিকে নাম প্রচ্ছদ কোনকিছুর কোন হদিস নেই। একবার নাম ঠিক করলাম ‘ঈশ্বরের ষড়যন্ত্র’। এরপর সেটা পছন্দ না হলে ‘একাত্তরের কানাগলি’ রাখা হল। নসিব ভাই আর অসীম ভাই এব্যাপারেও সাহায্য করেছেন।
এবার প্রচ্ছদ। নসিব ভাই কয়েকজনকে খোঁজার চেষ্টা করলেন আর অন্যদিকে আমি আমার মামাতো ভাই অনীক মোস্তফা আনোয়ারকে বলে রাখলাম, তিনি নিজে পুরষ্কারজয়ী ফটোগ্রাফার, বুয়েট ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং ডিজাইনার। অনীক ভাইয়া হল আমার সেই ভাই যার সাথে রোড-রাশ, এনএফএস, ডুম টু আর গোলাগুলি খেলতে খেলতে বড় হয়েছি। শৈশবের বলতে গেলে প্রত্যেকটি সুন্দর স্মৃতিই তার সাথে। যাই হোক, তার আবার অফিস শিডিউল বেশ টাইট, তো সময়ত পারা যাবে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু এই ব্যক্তি মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে অসাধারণ এই প্রচ্ছদটি বানিয়ে দিলেন।
.
বইয়ের কোনো রকম কোনো মার্কেটিং আগে হয়নি। তো আমাকেই সেটা করতে হল, যেটা আমার খুবই অপছন্দের একটা কাজ। তাছাড়া আমাকে কেউ চেনেও না। তো লাভও তেমন আসলে হয়নি। এমনকি এখনো বইয়ের প্রচারণা বা পরিচিতি তেমন নেই।
.
যাইহোক শত প্রতিকূলতা পার করে অবশেষে বই বের হল। এখন একটু একটু ভয় হতে লাগল কী অবস্থা হয়! গুডরিডসে বই আপলোড করার সময় নসিব ভাইকে বলছিলাম না জানি কত গালাগাল শুনতে হবে। কনফিডেন্স তো আগে থেকেই নেই।
.
বইয়ের প্রথম রিভিউটা দেন জুলিয়ান ভাই। উনি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয় এবং নিজেও সুলেখক। তবে ওনার সাথে আমার আগে কখনও পরিচয় ছিল না। ওই রিভিউটা আমার জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঐ একটা রিভিউ থেকেই আমি আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরে পেতে শুরু করি। ব্যাপারটা বলতে গেলে অনেকটা এরকম, আমি যদি পরবর্তিতে কিছু লিখি সেটার পিছনে ওই রিভিউয়ের বেশ বড় ভূমিকা থাকবে বিশ্বাস করবেন।
.
আরেকটা কথা যেটা না বললেই নয় সেটা হল এদেশে লেখক হবার জন্য সেরকম পিতা-মাতা থাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়া হয় না। আমার আছে। আমি সৌভাগ্যবান। সবার থাকে না।
একজন লেখক যখন প্রথম একটা বই লেখেন তখন আর মনে কিছু কিছু আশা থাকে যে বইটা পড়ে পাঠক যদি এই এই কথাগুলো বলেন তাহলেই জীবন স্বার্থক এমন ধরনের আরকি। আমারও ছিল; তবে গত একবছরে উবে গিয়েছিল সব; এখন তো মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি এমন একটা অবস্থা! তবে বিশ্বাস করুন আমি বই লেখার সময় এক্স্যাক্টলি যা যা পাঠকের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছি এর প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা বাক্য আমি শুনতে পেরেছি। একেবারে হুবহু। এটা আমার চরম সৌভাগ্য। আমি আমার সমস্ত (খুব বেশি নয় কিন্তু) পাঠক, রিভিউয়ার, শুভাকাংখীদের জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। অন্তরের অন্তস্থল থেকে। ভালো থাকবেন সবাই।
.
.╚►এবার পাঠকদের সব প্রশ্নের উত্তর◄╝
.
★এই জনরার বই লেখার কথা মাথায় আসলো কীভাবে?
.
●►আমি আসলে থ্রিলার ছাড়া অন্য কোনো জনরার বই পড়ি না বললেই চলে। ব্যাপারটাকে আসলে এক ধরণের সংকির্ণতা বলতে পারেন। আর বই লিখব, লেখক হব এমন কোনো চিন্তা ভাবনা তেমন ছিল না। ভালো ভালো থ্রিলার পড়লে, অভিভূত হতাম লেখকের বুদ্ধিমত্তায়, ইচ্ছা হত এমন একটা গল্প বানাতে। অন্য কোনো ধরণের জনরার প্রতি তেমন আগ্রহ জন্মায়নি কখনও, সেগুলো পড়লে মনে হত, আরে এমন গল্প বানানো তো সহজ :p (আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়)। যাই হোক একটা ভালো থ্রিলার প্লট বের করা, সেটল করা, সঠিকভাবে এক্সিকিউট করাটাকে মনে করি পৃথিবীর অন্যতম কঠিন একটি কাজ, তাই লিখলে থ্রিলারই, অন্য কিছু নয়।
.
★প্রথম বই হিসেবে 'একাত্তরের কানাগলি' কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
.
●►ভালো রকমই ছিল। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল অভিজ্ঞতার অভাব, আর উল্টো দিকে বিশাল প্লট। শেষ পর্যন্ত যেতে পারব কিনা সন্দেহ ছিল বেশ দূর পর্যন্ত। গল্পটা আসলে খুবই জটিল আর বিস্তৃত। আর যেকোনো থ্রিলারের ক্ষেত্রে অনেক অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে, এগুলোর একটা সামান্য একটু ওলট পালট হয়ে গেলেই সব শেষ। চেষ্টা করেছি সব কিছু খুব লজিক্যালি করতে, যেই সিচুয়েশনে ন্যাচারালি যেই স্টেপগুলো নেয়ার সমস্ত চরিত্রদের দিয়ে সেগুলোই নিয়েছি, কাউকে সুবিধা করিয়ে দেবার জন্য অন্য কিছু করাই নি বা একেবারে ব্লাইন্ড লাকও ধরিয়ে দেই নি কাউকে। চেষ্টা করেছি কোনো কিছু অতিরঞ্জিত না করতে। আর সবচেয়ে বেশি কঠিন কাজ যেটা ছিল, সেটা হল চরিত্রগুলোর বুদ্ধিমত্তা বজায় রেখে কাজ করা। আমি কক্ষণো চাইনি আমার কোনো চরিত্র কম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হোক। অনেক সময়ই লেখকরা চরিত্রগুলোকে বেশি বাস্তব করতে গিয়ে বলতে গেলে বোকাই করে ফেলেন, বা কখনও ইন্টেলিজেন্সের গ্রাফটা ধরে রাখতে সমস্যা হয়। দেখা যায় এক জায়গায় একজন খুবই বুদ্ধিমানের মত কিছু একটা করছে, অথচ একটু পরেই দেখা গেল সে একেবারে গাধা হয়ে গেছে। আবার কোথাও দেখা গেল উল্টোটা, শুরুতে একদমই বুদ্ধিশুদ্ধি নাই, হঠাৎ করে বুদ্ধিমান হয়ে গেল। আমি চেয়েছি এমন কিছু যেন না হয়। সবাইকে বুদ্ধিমান বানিয়ে একজনকে বা একদলকে জিতিয়ে দেয়া কঠিন। সেটা করতে পারা কঠিন ছিল।
আর যেটা চ্যালেঞ্জিং ছিল সেটা হল আমার লেখনী। থিওরটিক্যালি আমি লেখক হলেও I struggle with words.
.
★এ নিয়ে লিখার আইডিয়া কিভাবে আসল বা কি ধরণের প্রস্তুতি লেগেছে?
.
●►আইডিয়া কিভাবে আসলো তা উপরে বলেছি আর প্রস্তুতি আসলে অনেক লেগেছে। ওই সময়ের অনেক বই পড়তে হয়েছে। এছাড়াও অনেক ডিক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টস, ঐ সময়ের ইউএস ফরেন পলিসি পুরোটা পড়তে হয়েছে। সৌভাগ্য যে অনেক কিছুই আগে পড়া ছিল।
.
★etokisu thakte moktijuddho niye thriller lekhar karon?
.
●►আনটাচড টেরিটরি নিয়ে কাজ করার একটা আলাদা মজা আছে। তবে সেটা ছাড়াও ব্যাপারটা দুঃখজনকই যে অনেক স্কোপ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই জনরায় কিছুই হয় নি। আশা করি সামনে হবে।
.
★মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা পটভূমিতে প্রথম বই লেখার সাহস করা খুব প্রশংসনীয়। এমন কি হয়েছে লেখার সময় কোন কারণে কি প্রজেক্টটা বাদ দিতে চেয়েছিলেন? কি কারণ ছিল পিছনে?
.
●►না। বাদ দেবার কোনো ব্যাপার হয়নি। বই লেখার কাজ বেশ সহজেই শেষ করতে পেরেছি।
.
★মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আরও কিছু লেখার ইচ্ছে আছে?
.
●►ইচ্ছে তো আছে... দেখা যাক।
.
★একাত্তরের পরেও তো আমাদের এই বাংলায় তো কম ট্র্যাএজেডি হয় নি? আমরা কি তবে কানাগলির ডার্ক নাইট কে বইয়ের পাতায় খুজে পাবো?? সিরিজের কোনো প্ল্যান আছে?
.
●►পেতে পারেন....নাও পেতে পারেন, অন্য কাউকেও পেতে পারেন। এখনি ঠিক বলা যাচ্ছে না। আগামী ৫/৬ বছরের মধ্যে নতুন কিছু আসার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ।
.
★লেখার সময় কি তথ্য সংগ্রহ বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
.
●►ইন্টারনেটের যুগে এসব নিয়ে তথ্য পেতে কষ্ট কি? :D
.
★এই প্রেক্ষাপটে লেখার জন্য কি নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে?
.
●►আগে বলেছি।
.
★কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে বইটা লিখতে গিয়ে এবং কতদিন লেগেছিল শেষ করতে?
.
●►বই লিখতে গেলে পরিশ্রম তো একটু করতেই হয়। প্রথমে আবার ইংরেজীতে লিখেছিলাম। বাংলা, ইংরেজি সব মিলিয়ে দেড় বছরের মত।
.
★প্রথম মৌলিক হিসেবে বইটা বেশ প্রশংশনীয়, পাঠকদের কাছ থেকে যখন এমন ফিডব্যাক পান কী ধরণের অনুভূতি হয়?
.
●►যেমনটা উপরে বলেছি। খুব ভালো লাগে। আশা তেমন ছিল না, তবে আমার সৌভাগ্যই বলতে পারেন, এখনো পর্যন্ত যা শুনেছি সবই পজেটিভ।
.
★"মুক্তিযুদ্ধ" একটা চ্যালেঞ্জিং সাবজেক্ট নিঃসন্দেহে... একাত্তরের কানাগলি লিখতে লেখকের কাছে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার কি ছিল??
.
●►উপরে বলেছি।
.
★প্রথম লেখা হিসেবে থ্রিলার বেছে নেয়ার কি কারন? যেহেতু অন্য ঘরানা থেকে থ্রিলার একটু কঠিন, সহজ কিছু দিয়ে শুরু করেননি কেন??
.
●►এটাও বলেছি উপরে। এক ঢিলে বেশ কিছু পাখি মারার দেখতে পাচ্ছি আমার একটা সুপ্ত প্রতিভা ছিল।
.
★প্রথম বই হিসেবে বইটা কতটি চ্যালেঞ্জিং ছিল? জনরা হিসেবে থ্রিলার বেছে নেয়ার কারণ কি?
.
●►বলেছি উপরে। (অনেকগুলো পাখি মারছি নাকি একটাই মারছি বুঝতে পারছি না। :p )
.
★ভবিষ্যতে এই জনরায় লেখার আর ইচ্ছে আছে কি?
.
●►জী আছে। এই জনরার বাইরে কিছু লেখার ইচ্ছে নেই।
.★বইটা লিখতে গিয়ে প্রধান সমস্যা / বাঁধা কোনটা ছিল? বই প্রকাশের পরে সেই ব্যাপারগুলো ভেবে কি মনে হচ্ছে এখন?
.
●►বাঁধা বা সমস্যা ওই অল্প অভিজ্ঞতায় বিশাল প্লট এক্সিকিউট করাই ছিলো। এছাড়া তেমন কোনো সমস্যা বই লিখতে গিয়ে হয়নি। তবে স্বল্প কথায় বেশ কিছু চরিত্রের অনেকগুলো কাজকে যৌক্তিকতা প্রদান করা কঠিন ছিল। ডিটেইলড লেখা পড়তে পাঠকদের বা ছাপাতে প্রকাশকদের মাঝে একটা অস্বস্তি কাজ করে এদেশে। আবার এদিকে সবসময় কম কথায় অনেক কিছুর যুক্তি দেখানো কঠিন।
.
★এমন কোনো ঘটনা বা বিষয় ছিল, যা বইয়ের ছিল কিন্তু ছাপানোর আগে বাদ দিতে হয়েছে? অথবা এমন কোনো বিষয় কি ছিল, যা বইয়ে ছিল না, প্রকাশ পাবার পর আফসোস হলো, না দিতে পারার কারণে?
.
●►বইটা আরো বড় ছিল। ছোট করতে হয়েছে। ছোট করার সাজেশন গুণী একজনের ছিল এবং আমি মনে করি ভালো সাজেশন ছিল। যদিও ডিটেইলস লিখতে বা পড়তে আমার নিজের ভালো লাগে, আর কিছু কিছু জায়গায় ডিটেইলিং আরও ভালো হতে পারত। কিছু কিছু জায়গায় বাদ দিতে হয়েছে। তবে খুব যে আফসোসের কিছু তা বলব না।
.
★ক্যারেকটার ডিভালাপমেন্টের ক্ষেত্রে একজন পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে প্রচুর সময় নেয়া হয়েছে এবং অনেক বেশি ক্যারেকটার আনাতে গল্পের গতি প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত একেবারেই স্লথ ছিল, যদিও বা শেষের দিকে প্রচুর গতি পেয়েছিলো। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এতটা সময় নেয়ার কারন কি? আরেকটু কম সময় নিয়ে কি লেখা যেতো না? কিংবা এত বেশি চরিত্র আনার কারন? তাছাড়া টাইম ফ্রেম গুলো অনেক বেশি ছিল, যেগুলো পড়ার গতি আর মনোযোগ ধরে রাখতে ভীষণ বেগ পাইয়েছে। টাইম ফ্রেম গুলকি আরেকটু কমানো যেতো না?
.
●►খুবই ভালো প্রশ্ন। আমি নিজে মনে করি ক্যারেক্টার ডেভলপমেন্ট যেকোনো বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আর সময় আসলে অনেকগুলো ক্যারেক্টার আনার কারণে লেগেছে। প্লটটা এমনই এখানে অনেক ক্যারেকক্টার থাকতেই হবে। খেয়াল করে দেখবেন কোন চরিত্র কিন্তু ইররেলিভ্যান্ট ছিল না। অনেকে এসেছে আরেকজনের ক্যারেক্টার ডেভলপমেন্টের জন্য। আর 'একেবারেই স্লথ' আমার কাছে মনে হয়নি, কারণ সব সময়ই কিন্তু কিছু না কিছু ঘটেছে। ক্যারেক্টারগুলো ডেভেলপ করেছি বিভিন্ন ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে যাতে ওই স্লো'ভাবটা না আসে। তবে এটা ঠিক যে অনেক ক্যারেক্টার অনেক টাইমলাইনে আনার কারণে অস্বস্তি লাগতে পারে অনেকের। তবে সেই অস্বস্তিভাব সহজেই কেটে যাওয়ার কথা, কারণ যাদের কথা আপনার মনে রাখার দরকার তাদের কথা ঠিকই মনে থাকবে, অন্য 'সাময়িক' ক্যারেক্টারগুলোর কথা মনে থাকবে না (অবশ্য আপনি ঐ পয়েন্টে জানেন না কোনটা সাময়িক, এজন্য বিরক্ত লাগতে পারে)। আর অতগুলো টাইমলাইন ইউজ করা ছাড়া আসলেই এর থেকে ভালো কোনো উপায় ছিল না, চিন্তা করিনি যে তা নয়; আরেকটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, টাইম আমি একটা দিয়েছি তবে সেটা কিন্তু আসলে গুরুত্বপূর্ণও নয়; কেবল কয়েক বছর এ ঘটনাটা ঘটেছিল এটা বোঝাটাই এখানে আসল, এছাড়া অন্য কিছু নয়। আর থ্রিলারের মধ্যে তো এধরণের জটিলতা থাকতেই হবে। এগুলোর সাথে আমাদের আরো ভালোভাবে মানিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
.
গেম অফ থ্রোন্স-এ দেখেন, মনে হয় হাজার খানেক চরিত্র। আর একেবারে মাইনর চরিত্রগুলোও কিন্তু হঠাৎ করে মেজর হয়ে যায়। একবার পড়ে বা দেখে মনে রাখা বলতে গেলে অসম্ভব। তবে এটা কিন্তু বইয়ের কোনো দোষ নয়; খারাপ দিকও নয়, বরং this is something that makes it great. হয়তো আমি লেখনী দিয়ে ভালো করে ধরে রাখতে পারিনি, তবে 'মাস্টারপিস' বলতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেসব বইকে বোঝানো হয় সেগুলো এদেশে হতে গেলে এধরণের জটিল-কঠিন জিনিস নিয়ে বেশি বেশি কাজ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
.
★বইটি লিখতে কত সময় লেগেছিল?
.
●►দেড় বছরের মত।
.
★বইটা লেখার আগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা কোনো বই কি পড়েছিলেন? পড়লে সেগুলো কি কি???
.
●►বই আসলে অনেকই পড়তে হয়েছে। অনেকগুলো আবার অনেক আগে থেকেই পড়া ছিল। কয়েকটার নাম বলছি :
• দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম- গ্যারি জ়ে বাস
• দ্য ক্রুল বার্থ অফ বাংলাদেশ- আর্চার কে ব্লাড
• দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ- অ্যান্থনি মাসকারেনহাস
• দ্য বিট্রেয়াল অফ ইষ্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজী
• সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা- জ়ে এফ আর জ্যাকব
• ডটার অব দ্য ইস্ট- বেনজীর ভুট্টো (এটা আগে পড়েছিলাম, ভুট্টোকে বুঝতে এই বইটা বেশ ভালো কাজে দিয়েছে)
• ইউএস ফরেন পলিসি- একটা ৯০০ পেজের ডকুমেন্ট আছে; ওটার মধ্যে নিক্সন আর হোয়াইট হাউজ স্টাফদের সমস্ত মিটিং আর ফোনের ট্রান্সক্রিপ্ট রয়েছে, সাথে সমস্ত ক্যাবেল, ডকুমেন্টস যেগুলো সেসময় ইস্যু করা হয়, সবকিছু। বইয়ের কভারে যে টুকরো টুকরো ডকুমেন্টের ছবি সেগুলোর কিছু এখান থেকেই নেওয়া। আর বইয়ে নিক্সন-কিসিঞ্জারের বেশিরভাগ কনভার্সেসনই আসল।
• এছাড়াও আরো কিছু বই আছে আপাতত মনে পড়ছে না আর সব মিলিয়ে হাজারখানেক আর্টিকেল পড়তে হয়েছে।
.
★যেহেতু গল্পটায় মুক্তিযুদ্ধ আছে সেহেতু লিখতে গিয়ে কি আবেগ কেমন কাজ করেছে? রাজনীতির বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে গিয়ে কি কোনো হেসিটেশন কাজ করছিল?
.
●►আবেগ তো থাকবেই। তবে আবেগ সরিয়ে র্যাশনাল হয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। আর রাজনীতির বিষয়গুলো আসলেই একটু সাবধানে রাখার চেষ্টা করেছি যাতে বিতর্ক এড়িয়ে চলা যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় নিয়ে বই আলোচিত হোক তা চাইনি
বই : একাত্তরের কানাগলি
লেখক : আসিফ সিদ্দিকী দীপ্র
.
.
╚►পেছনের গল্প◄╝
.
আমার বইয়ের ফ্ল্যাপে আমি লিখেছিলাম মৌলিক বই লিখব এমন চিন্তা আমার ছিল না। আসলে প্রস্তুতিও ছিল না। সাধারণত একজন লেখকের প্রথম প্রকাশিত বইয়ের আগে প্রকাশিত-অপ্রকাশিত অথবা আজকালকার হিসেবে বলতে গেলে ফেসবুকে প্রকাশিত অসংখ্য ছোট-বড় গল্প থাকে। আমার সেরকম কিছুই নেই। এর আগে কেবল একটা বই অনুবাদ করেছিলাম সেটাও এমন আহামরি কিছু হয় নি; নিজেও যে খুব উপভোগ করেছি তাও নয়। অর্থাৎ মৌলিক লেখা বলতে আমার একেবারেই কিছু ছিল না এর আগে।
.
‘একাত্তরের কানাগলি’র প্লট একেবারে হুট করেই মাথায় চলে আসে। সেই ব্যাপারটাও বেশ মজার। দিনটা ছিল ২০১৪ সালের ২৫শে মার্চ। দুপুর বারোটার মত বাজে। আমি তখন ড. আব্দুল কাদের খানকে নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়ছিলাম আর অন্যদিকে ফেসবুক অন ছিল। ফেসবুকে একটা পোষ্টে দেখলাম প্রখ্যাত লেখক রবিন জামান খানকে তার এক ফলোয়ার জিজ্ঞেস করলেন ওনার ‘ব্ল্যাক বুদ্ধা’ বইটা কবে আসছে। উত্তরে রবিন ভাই লিখলেন যে আপাতত তিনি ২৫শে মার্চ আর সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে পড়াশোনা করছেন, ওটা আসতে দেরি হবে। পরের বছরের মেলাতেই আমরা উনার অসাধারণ ‘২৫শে মার্চ’ বইটা পেয়ে যাই। যাইহোক, ঐ কমেন্টটা দেখে ২৫শে মার্চের গল্পটা কেমন হতে পারে এটা ভাবতে ভাবতেই আমি চেয়ার থেকে উঠলাম, ঘুমাতে যাবার উদ্দেশ্যে (আমার ঘুমানোর কোনো আগা মাথা নেই)। তো আমি বিছানায় উঠতে যাবো ঠিক ঐ এক মুহূর্তের মধ্যেই পুরো প্লটটা আমার মাথায় একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল।
.
এসময়টা ছিল আমার বিবিএ’এর ফাইনাল সেমিষ্টারের শেষের মাস। ঐ সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু রিসার্চ করে দেখলাম আসলেই প্লটটার কোনো ভিত্তি আছে কিনা। যতই পড়তে লাগলাম ততই মনে হল সম্ভব এবং খুব ভালো করেই সম্ভব। এরপর আস্তে আস্তে গভীরতা আরো বাড়তে থাকল।
.
এখানে একটা জিনিস বলে নিতে চাই। প্রায়ই একটা প্রশ্ন করা হয়, একজন লেখক আসলে কেনো লেখেন? অর্থ বা খ্যাতির জন্য? বাংলাদেশে কোনো লেখক যে টাকার জন্য বই লেখেন না এইটা একেবারে অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেবার মত সত্য। খ্যাতি বা পাঠককে আনন্দ দিতেও আসলে কেউ লেখেন না। লেখেন আসলে একেবারেই নিজের জন্য। অন্তত আমার ক্ষেত্রে সেটাই ছিল। আমি নিজে থ্রিলার পড়ার সময় খুবই বিস্তৃত, অনেক বেশি চরিত্রের আর জটিল গল্প পছন্দ করি। সরল বা যে গল্প পড়তে গেলে কোনো মাথাই থাটাতে হবে না বা যেরকম গল্প লিখতে লেখককে তেমন একটা চিন্তাও করতে হয় না সেরকম গল্প আমাকে ঠিক টানে না। সেজন্যই চেয়েছিলাম আমার নিজের গল্পটাকে জটিল ও বিস্তৃত করতে। না হলে নিজেই উৎসাহ পেতাম না। আর যেহেতু আমি আগে কিছুই লিখিনি আমার জন্য ব্যাপারটা বেশ কঠিন ছিল। এমনকি বইয়ের যখন অর্ধেক শেষ করে ফেলেছি তখনও সন্দেহ ছিল শেষ পর্যন্ত যেতে পারব কিনা।
.
কেবল প্লটের উপর বিশ্বাসের জোরে টেনে গেলাম। আমি এমনিতে নিজের লেখনি নিয়ে খুব বেশি স্যাটিসফায়েড না। এখনকার প্রথম সারির মৌলিক লেখক যারা শরীফুল হাসান, মোহম্মদ নাজিম উদ্দিন, তানজিম রহমান, জাহিদ হোসেন বা রবিন জামান খানের মত লেখকদের লেখার মধ্যে একটা যে আলাদা শক্তিমত্তা অনুভব করা যায় সেরকম কিছু আমি আমার নিজের লেখায় তেমন পাই না। এটা হয়তো আমি আগে কিছু লিখিনি সেকারণেই।
.
বইয়ের কাজ প্রাথমিকভাবে শেষ হয় ২০১৫ সালের মাঝামাঝি। আর যে ভার্শনটা অবশেষে ছাপানো হয়েছে সেটা করা হয়েছিল ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, ঐ মেলাতেই যাবে এই আশায়। তবে বেশ কিছু জটিলতার কারণে সে মেলায় বই বের করা সম্ভব হয় নি।
.
জটিলতাগুলোর প্রভাব আমার জীবনে বেশ মারাত্মকই ছিল। বই যখন শেষ করেছিলাম তখন বই নিয়ে বেশ কনফিডেন্ট ছিলাম। তবে এই জটিলতাগুলোর কারণে একসময় সেই কনফিডেন্স নামতে নামতে শূন্যতে এসে ঠেকে। শেষের দিকে মোটামুটি বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম যে, এই বই প্রকাশের অযোগ্য এবং এটা প্রকাশ করলে লেখক-প্রকাশক দুজনেরই ক্ষতি।
.
২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সাল খুব বাজেভাবে কাটে। আমি আসলে ডিপ্রেশন-সিনিসিজম (cynicism)-ওয়ার্কোহোলিজমের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। আমি দিনে প্রায় ১৫-১৬ ঘন্টা একটানা এক নাগাড়ে বসে কাজ করি। এর মধ্যে কোনো ব্রেক-ট্রেক নেই। মাসের পর মাস ঘরের ভিতর বসে থাকি। আমার হাতের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি খেতে বা ঘুমাতে বা অন্যকোনো কাজই করতে পারি না। সবসময় কাজ শেষ করি এরপর খাওয়া বা ঘুম। না হলে সারাক্ষণ মাথার মধ্যে সূঁচের মত বাধতে থাকে। এটা আসলে যে নিজে অনুভব করেনি তাকে বোঝানো সম্ভব না। এজন্য ঐ পুরো বছরটা উঠতে-বসতে-হাঁটতে-চলতে একেবারে কন্সট্যান্টলি একটা যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি কাজ করত। আর আমি নিজের সিদ্ধান্তের উপর সবসময়ই খুব বেশি নির্ভর করি; সহজে নিজের জায়গা থেকে সরি না। ঘাড়ত্যাড়া আর কি। যারা আমাকে ভালো করে চেনেন তারা জানেন। ঐ সময়টা নিজের জাজমেন্টের উপরই বেশ বড়সড় একটা সন্দেহ চলে আসলো। ক্রাইসিস অফ কনফিডেন্সে ভুগতে শুরু করেছিলাম।
.
এভাবে ২০১৭ সালের মেলা চলে আসল। তবে বোঝা গেল এবারও হচ্ছে না। আমি যখন প্রথম বই শুরু করেছিলাম নাম দিয়েছিলাম ‘ইষ্টার্ণ লাইটস’, নাম যাদেরকে বলেছি কারোই পছন্দ হয়নি, এমনকি আমার নিজেরও যে পছন্দ ছিল তেমনটা নয়। বই যেভাবে পুরো বছর পড়েছিল নামও তেমন পড়ে ছিলো। পরে মেলার আগে ভালো একটা নামই ঠিক করতে পারছিলাম না, আর অন্য দিকে মেলায় বই প্রকাশিত হচ্ছে এমন কোনো আশাও দেখছিলাম না।
.অবশেষে একেবারেই মেনে নিলাম যে, এই বই আসলে প্রকাশের যোগ্যই নয়। এখন লিখে তো ফেলেছি; তার উপর এত সময় গেছে, মাথার উপর একটা যন্ত্রণার মত ঘুরছে, যেকোনোভাবে প্রকাশ করে দিয়ে শেষ করতে পারলে হয়। যন্ত্রণা থেকে তো বাঁচি। এটা ফেব্রুয়ারির এক তারিখ, মেলা শুরু হয়ে গেছে। বই যে মেলাতেই প্রকাশ করতে হবে এমন কোনো ব্যাপার ছিলো না। তবে মেলার পরেও যে হবে সেরকম আশাও দেখছিলাম না। ২০১৬ সালের মেলার পর তো পড়েই ছিলো এক বছর। তাছাড়া আবার আমাদের দেশে তো বই মেলাতেই ঠিক মত বিক্রি হয় না, তার উপর আমার মত এক অজানা অচেনা লোকের বই! অগত্যা অন্য প্রকাশনীতে চেষ্টা করার কথা ভাবলাম। কিন্তু আমি আর কাউকেই চিনি না। এই সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন নসিব পঞ্চম জিহাদী ভাই। এই লোক আমার বই প্রকাশের জন্য যেই কষ্টটা করলেন সেটা কল্পনার অতীত, চিন্তার বাইরে। আমার নিজের মানসিক অবস্থা তখন একেবারেই খারাপ। আমার তাকে বলতেও হয়নি; উনি একেবারে নিজের দ্বায়িত্বে বেশ কয়েকটি প্রকাশনীর সাথে কথা বলে অবশেষে রোদেলাকে রাজি করালেন বই মেলার এই ব্যস্ততার ভিতর বইটি প্রকাশ করানোর জন্য। রোদেলায় প্রকাশ করাতে পারার পিছনে অসীম পিয়াস ভাইয়েরও ব্যাপক অবদান রয়েছে। এই দুই ব্যক্তি না থাকলে এই বই কোনোদিনও বের হত না।
.
প্রকাশনী ঠিক হল। এদিকে নাম প্রচ্ছদ কোনকিছুর কোন হদিস নেই। একবার নাম ঠিক করলাম ‘ঈশ্বরের ষড়যন্ত্র’। এরপর সেটা পছন্দ না হলে ‘একাত্তরের কানাগলি’ রাখা হল। নসিব ভাই আর অসীম ভাই এব্যাপারেও সাহায্য করেছেন।
এবার প্রচ্ছদ। নসিব ভাই কয়েকজনকে খোঁজার চেষ্টা করলেন আর অন্যদিকে আমি আমার মামাতো ভাই অনীক মোস্তফা আনোয়ারকে বলে রাখলাম, তিনি নিজে পুরষ্কারজয়ী ফটোগ্রাফার, বুয়েট ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং ডিজাইনার। অনীক ভাইয়া হল আমার সেই ভাই যার সাথে রোড-রাশ, এনএফএস, ডুম টু আর গোলাগুলি খেলতে খেলতে বড় হয়েছি। শৈশবের বলতে গেলে প্রত্যেকটি সুন্দর স্মৃতিই তার সাথে। যাই হোক, তার আবার অফিস শিডিউল বেশ টাইট, তো সময়ত পারা যাবে কিনা এটা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু এই ব্যক্তি মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে অসাধারণ এই প্রচ্ছদটি বানিয়ে দিলেন।
.
বইয়ের কোনো রকম কোনো মার্কেটিং আগে হয়নি। তো আমাকেই সেটা করতে হল, যেটা আমার খুবই অপছন্দের একটা কাজ। তাছাড়া আমাকে কেউ চেনেও না। তো লাভও তেমন আসলে হয়নি। এমনকি এখনো বইয়ের প্রচারণা বা পরিচিতি তেমন নেই।
.
যাইহোক শত প্রতিকূলতা পার করে অবশেষে বই বের হল। এখন একটু একটু ভয় হতে লাগল কী অবস্থা হয়! গুডরিডসে বই আপলোড করার সময় নসিব ভাইকে বলছিলাম না জানি কত গালাগাল শুনতে হবে। কনফিডেন্স তো আগে থেকেই নেই।
.
বইয়ের প্রথম রিভিউটা দেন জুলিয়ান ভাই। উনি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ জনপ্রিয় এবং নিজেও সুলেখক। তবে ওনার সাথে আমার আগে কখনও পরিচয় ছিল না। ওই রিভিউটা আমার জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঐ একটা রিভিউ থেকেই আমি আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাস কিছুটা ফিরে পেতে শুরু করি। ব্যাপারটা বলতে গেলে অনেকটা এরকম, আমি যদি পরবর্তিতে কিছু লিখি সেটার পিছনে ওই রিভিউয়ের বেশ বড় ভূমিকা থাকবে বিশ্বাস করবেন।
.
আরেকটা কথা যেটা না বললেই নয় সেটা হল এদেশে লেখক হবার জন্য সেরকম পিতা-মাতা থাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়া হয় না। আমার আছে। আমি সৌভাগ্যবান। সবার থাকে না।
একজন লেখক যখন প্রথম একটা বই লেখেন তখন আর মনে কিছু কিছু আশা থাকে যে বইটা পড়ে পাঠক যদি এই এই কথাগুলো বলেন তাহলেই জীবন স্বার্থক এমন ধরনের আরকি। আমারও ছিল; তবে গত একবছরে উবে গিয়েছিল সব; এখন তো মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি এমন একটা অবস্থা! তবে বিশ্বাস করুন আমি বই লেখার সময় এক্স্যাক্টলি যা যা পাঠকের কাছ থেকে শুনতে চেয়েছি এর প্রত্যেকটা শব্দ, প্রত্যেকটা বাক্য আমি শুনতে পেরেছি। একেবারে হুবহু। এটা আমার চরম সৌভাগ্য। আমি আমার সমস্ত (খুব বেশি নয় কিন্তু) পাঠক, রিভিউয়ার, শুভাকাংখীদের জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। অন্তরের অন্তস্থল থেকে। ভালো থাকবেন সবাই।
.
.╚►এবার পাঠকদের সব প্রশ্নের উত্তর◄╝
.
★এই জনরার বই লেখার কথা মাথায় আসলো কীভাবে?
.
●►আমি আসলে থ্রিলার ছাড়া অন্য কোনো জনরার বই পড়ি না বললেই চলে। ব্যাপারটাকে আসলে এক ধরণের সংকির্ণতা বলতে পারেন। আর বই লিখব, লেখক হব এমন কোনো চিন্তা ভাবনা তেমন ছিল না। ভালো ভালো থ্রিলার পড়লে, অভিভূত হতাম লেখকের বুদ্ধিমত্তায়, ইচ্ছা হত এমন একটা গল্প বানাতে। অন্য কোনো ধরণের জনরার প্রতি তেমন আগ্রহ জন্মায়নি কখনও, সেগুলো পড়লে মনে হত, আরে এমন গল্প বানানো তো সহজ :p (আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়)। যাই হোক একটা ভালো থ্রিলার প্লট বের করা, সেটল করা, সঠিকভাবে এক্সিকিউট করাটাকে মনে করি পৃথিবীর অন্যতম কঠিন একটি কাজ, তাই লিখলে থ্রিলারই, অন্য কিছু নয়।
.
★প্রথম বই হিসেবে 'একাত্তরের কানাগলি' কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল?
.
●►ভালো রকমই ছিল। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল অভিজ্ঞতার অভাব, আর উল্টো দিকে বিশাল প্লট। শেষ পর্যন্ত যেতে পারব কিনা সন্দেহ ছিল বেশ দূর পর্যন্ত। গল্পটা আসলে খুবই জটিল আর বিস্তৃত। আর যেকোনো থ্রিলারের ক্ষেত্রে অনেক অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে, এগুলোর একটা সামান্য একটু ওলট পালট হয়ে গেলেই সব শেষ। চেষ্টা করেছি সব কিছু খুব লজিক্যালি করতে, যেই সিচুয়েশনে ন্যাচারালি যেই স্টেপগুলো নেয়ার সমস্ত চরিত্রদের দিয়ে সেগুলোই নিয়েছি, কাউকে সুবিধা করিয়ে দেবার জন্য অন্য কিছু করাই নি বা একেবারে ব্লাইন্ড লাকও ধরিয়ে দেই নি কাউকে। চেষ্টা করেছি কোনো কিছু অতিরঞ্জিত না করতে। আর সবচেয়ে বেশি কঠিন কাজ যেটা ছিল, সেটা হল চরিত্রগুলোর বুদ্ধিমত্তা বজায় রেখে কাজ করা। আমি কক্ষণো চাইনি আমার কোনো চরিত্র কম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হোক। অনেক সময়ই লেখকরা চরিত্রগুলোকে বেশি বাস্তব করতে গিয়ে বলতে গেলে বোকাই করে ফেলেন, বা কখনও ইন্টেলিজেন্সের গ্রাফটা ধরে রাখতে সমস্যা হয়। দেখা যায় এক জায়গায় একজন খুবই বুদ্ধিমানের মত কিছু একটা করছে, অথচ একটু পরেই দেখা গেল সে একেবারে গাধা হয়ে গেছে। আবার কোথাও দেখা গেল উল্টোটা, শুরুতে একদমই বুদ্ধিশুদ্ধি নাই, হঠাৎ করে বুদ্ধিমান হয়ে গেল। আমি চেয়েছি এমন কিছু যেন না হয়। সবাইকে বুদ্ধিমান বানিয়ে একজনকে বা একদলকে জিতিয়ে দেয়া কঠিন। সেটা করতে পারা কঠিন ছিল।
আর যেটা চ্যালেঞ্জিং ছিল সেটা হল আমার লেখনী। থিওরটিক্যালি আমি লেখক হলেও I struggle with words.
.
★এ নিয়ে লিখার আইডিয়া কিভাবে আসল বা কি ধরণের প্রস্তুতি লেগেছে?
.
●►আইডিয়া কিভাবে আসলো তা উপরে বলেছি আর প্রস্তুতি আসলে অনেক লেগেছে। ওই সময়ের অনেক বই পড়তে হয়েছে। এছাড়াও অনেক ডিক্লাসিফায়েড ডকুমেন্টস, ঐ সময়ের ইউএস ফরেন পলিসি পুরোটা পড়তে হয়েছে। সৌভাগ্য যে অনেক কিছুই আগে পড়া ছিল।
.
★etokisu thakte moktijuddho niye thriller lekhar karon?
.
●►আনটাচড টেরিটরি নিয়ে কাজ করার একটা আলাদা মজা আছে। তবে সেটা ছাড়াও ব্যাপারটা দুঃখজনকই যে অনেক স্কোপ থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই জনরায় কিছুই হয় নি। আশা করি সামনে হবে।
.
★মুক্তিযুদ্ধের মতো একটা পটভূমিতে প্রথম বই লেখার সাহস করা খুব প্রশংসনীয়। এমন কি হয়েছে লেখার সময় কোন কারণে কি প্রজেক্টটা বাদ দিতে চেয়েছিলেন? কি কারণ ছিল পিছনে?
.
●►না। বাদ দেবার কোনো ব্যাপার হয়নি। বই লেখার কাজ বেশ সহজেই শেষ করতে পেরেছি।
.
★মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আরও কিছু লেখার ইচ্ছে আছে?
.
●►ইচ্ছে তো আছে... দেখা যাক।
.
★একাত্তরের পরেও তো আমাদের এই বাংলায় তো কম ট্র্যাএজেডি হয় নি? আমরা কি তবে কানাগলির ডার্ক নাইট কে বইয়ের পাতায় খুজে পাবো?? সিরিজের কোনো প্ল্যান আছে?
.
●►পেতে পারেন....নাও পেতে পারেন, অন্য কাউকেও পেতে পারেন। এখনি ঠিক বলা যাচ্ছে না। আগামী ৫/৬ বছরের মধ্যে নতুন কিছু আসার সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ।
.
★লেখার সময় কি তথ্য সংগ্রহ বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
.
●►ইন্টারনেটের যুগে এসব নিয়ে তথ্য পেতে কষ্ট কি? :D
.
★এই প্রেক্ষাপটে লেখার জন্য কি নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে?
.
●►আগে বলেছি।
.
★কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে বইটা লিখতে গিয়ে এবং কতদিন লেগেছিল শেষ করতে?
.
●►বই লিখতে গেলে পরিশ্রম তো একটু করতেই হয়। প্রথমে আবার ইংরেজীতে লিখেছিলাম। বাংলা, ইংরেজি সব মিলিয়ে দেড় বছরের মত।
.
★প্রথম মৌলিক হিসেবে বইটা বেশ প্রশংশনীয়, পাঠকদের কাছ থেকে যখন এমন ফিডব্যাক পান কী ধরণের অনুভূতি হয়?
.
●►যেমনটা উপরে বলেছি। খুব ভালো লাগে। আশা তেমন ছিল না, তবে আমার সৌভাগ্যই বলতে পারেন, এখনো পর্যন্ত যা শুনেছি সবই পজেটিভ।
.
★"মুক্তিযুদ্ধ" একটা চ্যালেঞ্জিং সাবজেক্ট নিঃসন্দেহে... একাত্তরের কানাগলি লিখতে লেখকের কাছে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার কি ছিল??
.
●►উপরে বলেছি।
.
★প্রথম লেখা হিসেবে থ্রিলার বেছে নেয়ার কি কারন? যেহেতু অন্য ঘরানা থেকে থ্রিলার একটু কঠিন, সহজ কিছু দিয়ে শুরু করেননি কেন??
.
●►এটাও বলেছি উপরে। এক ঢিলে বেশ কিছু পাখি মারার দেখতে পাচ্ছি আমার একটা সুপ্ত প্রতিভা ছিল।
.
★প্রথম বই হিসেবে বইটা কতটি চ্যালেঞ্জিং ছিল? জনরা হিসেবে থ্রিলার বেছে নেয়ার কারণ কি?
.
●►বলেছি উপরে। (অনেকগুলো পাখি মারছি নাকি একটাই মারছি বুঝতে পারছি না। :p )
.
★ভবিষ্যতে এই জনরায় লেখার আর ইচ্ছে আছে কি?
.
●►জী আছে। এই জনরার বাইরে কিছু লেখার ইচ্ছে নেই।
.★বইটা লিখতে গিয়ে প্রধান সমস্যা / বাঁধা কোনটা ছিল? বই প্রকাশের পরে সেই ব্যাপারগুলো ভেবে কি মনে হচ্ছে এখন?
.
●►বাঁধা বা সমস্যা ওই অল্প অভিজ্ঞতায় বিশাল প্লট এক্সিকিউট করাই ছিলো। এছাড়া তেমন কোনো সমস্যা বই লিখতে গিয়ে হয়নি। তবে স্বল্প কথায় বেশ কিছু চরিত্রের অনেকগুলো কাজকে যৌক্তিকতা প্রদান করা কঠিন ছিল। ডিটেইলড লেখা পড়তে পাঠকদের বা ছাপাতে প্রকাশকদের মাঝে একটা অস্বস্তি কাজ করে এদেশে। আবার এদিকে সবসময় কম কথায় অনেক কিছুর যুক্তি দেখানো কঠিন।
.
★এমন কোনো ঘটনা বা বিষয় ছিল, যা বইয়ের ছিল কিন্তু ছাপানোর আগে বাদ দিতে হয়েছে? অথবা এমন কোনো বিষয় কি ছিল, যা বইয়ে ছিল না, প্রকাশ পাবার পর আফসোস হলো, না দিতে পারার কারণে?
.
●►বইটা আরো বড় ছিল। ছোট করতে হয়েছে। ছোট করার সাজেশন গুণী একজনের ছিল এবং আমি মনে করি ভালো সাজেশন ছিল। যদিও ডিটেইলস লিখতে বা পড়তে আমার নিজের ভালো লাগে, আর কিছু কিছু জায়গায় ডিটেইলিং আরও ভালো হতে পারত। কিছু কিছু জায়গায় বাদ দিতে হয়েছে। তবে খুব যে আফসোসের কিছু তা বলব না।
.
★ক্যারেকটার ডিভালাপমেন্টের ক্ষেত্রে একজন পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে প্রচুর সময় নেয়া হয়েছে এবং অনেক বেশি ক্যারেকটার আনাতে গল্পের গতি প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত একেবারেই স্লথ ছিল, যদিও বা শেষের দিকে প্রচুর গতি পেয়েছিলো। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এতটা সময় নেয়ার কারন কি? আরেকটু কম সময় নিয়ে কি লেখা যেতো না? কিংবা এত বেশি চরিত্র আনার কারন? তাছাড়া টাইম ফ্রেম গুলো অনেক বেশি ছিল, যেগুলো পড়ার গতি আর মনোযোগ ধরে রাখতে ভীষণ বেগ পাইয়েছে। টাইম ফ্রেম গুলকি আরেকটু কমানো যেতো না?
.
●►খুবই ভালো প্রশ্ন। আমি নিজে মনে করি ক্যারেক্টার ডেভলপমেন্ট যেকোনো বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আর সময় আসলে অনেকগুলো ক্যারেক্টার আনার কারণে লেগেছে। প্লটটা এমনই এখানে অনেক ক্যারেকক্টার থাকতেই হবে। খেয়াল করে দেখবেন কোন চরিত্র কিন্তু ইররেলিভ্যান্ট ছিল না। অনেকে এসেছে আরেকজনের ক্যারেক্টার ডেভলপমেন্টের জন্য। আর 'একেবারেই স্লথ' আমার কাছে মনে হয়নি, কারণ সব সময়ই কিন্তু কিছু না কিছু ঘটেছে। ক্যারেক্টারগুলো ডেভেলপ করেছি বিভিন্ন ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে যাতে ওই স্লো'ভাবটা না আসে। তবে এটা ঠিক যে অনেক ক্যারেক্টার অনেক টাইমলাইনে আনার কারণে অস্বস্তি লাগতে পারে অনেকের। তবে সেই অস্বস্তিভাব সহজেই কেটে যাওয়ার কথা, কারণ যাদের কথা আপনার মনে রাখার দরকার তাদের কথা ঠিকই মনে থাকবে, অন্য 'সাময়িক' ক্যারেক্টারগুলোর কথা মনে থাকবে না (অবশ্য আপনি ঐ পয়েন্টে জানেন না কোনটা সাময়িক, এজন্য বিরক্ত লাগতে পারে)। আর অতগুলো টাইমলাইন ইউজ করা ছাড়া আসলেই এর থেকে ভালো কোনো উপায় ছিল না, চিন্তা করিনি যে তা নয়; আরেকটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, টাইম আমি একটা দিয়েছি তবে সেটা কিন্তু আসলে গুরুত্বপূর্ণও নয়; কেবল কয়েক বছর এ ঘটনাটা ঘটেছিল এটা বোঝাটাই এখানে আসল, এছাড়া অন্য কিছু নয়। আর থ্রিলারের মধ্যে তো এধরণের জটিলতা থাকতেই হবে। এগুলোর সাথে আমাদের আরো ভালোভাবে মানিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
.
গেম অফ থ্রোন্স-এ দেখেন, মনে হয় হাজার খানেক চরিত্র। আর একেবারে মাইনর চরিত্রগুলোও কিন্তু হঠাৎ করে মেজর হয়ে যায়। একবার পড়ে বা দেখে মনে রাখা বলতে গেলে অসম্ভব। তবে এটা কিন্তু বইয়ের কোনো দোষ নয়; খারাপ দিকও নয়, বরং this is something that makes it great. হয়তো আমি লেখনী দিয়ে ভালো করে ধরে রাখতে পারিনি, তবে 'মাস্টারপিস' বলতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেসব বইকে বোঝানো হয় সেগুলো এদেশে হতে গেলে এধরণের জটিল-কঠিন জিনিস নিয়ে বেশি বেশি কাজ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
.
★বইটি লিখতে কত সময় লেগেছিল?
.
●►দেড় বছরের মত।
.
★বইটা লেখার আগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা কোনো বই কি পড়েছিলেন? পড়লে সেগুলো কি কি???
.
●►বই আসলে অনেকই পড়তে হয়েছে। অনেকগুলো আবার অনেক আগে থেকেই পড়া ছিল। কয়েকটার নাম বলছি :
• দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম- গ্যারি জ়ে বাস
• দ্য ক্রুল বার্থ অফ বাংলাদেশ- আর্চার কে ব্লাড
• দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ- অ্যান্থনি মাসকারেনহাস
• দ্য বিট্রেয়াল অফ ইষ্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজী
• সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা- জ়ে এফ আর জ্যাকব
• ডটার অব দ্য ইস্ট- বেনজীর ভুট্টো (এটা আগে পড়েছিলাম, ভুট্টোকে বুঝতে এই বইটা বেশ ভালো কাজে দিয়েছে)
• ইউএস ফরেন পলিসি- একটা ৯০০ পেজের ডকুমেন্ট আছে; ওটার মধ্যে নিক্সন আর হোয়াইট হাউজ স্টাফদের সমস্ত মিটিং আর ফোনের ট্রান্সক্রিপ্ট রয়েছে, সাথে সমস্ত ক্যাবেল, ডকুমেন্টস যেগুলো সেসময় ইস্যু করা হয়, সবকিছু। বইয়ের কভারে যে টুকরো টুকরো ডকুমেন্টের ছবি সেগুলোর কিছু এখান থেকেই নেওয়া। আর বইয়ে নিক্সন-কিসিঞ্জারের বেশিরভাগ কনভার্সেসনই আসল।
• এছাড়াও আরো কিছু বই আছে আপাতত মনে পড়ছে না আর সব মিলিয়ে হাজারখানেক আর্টিকেল পড়তে হয়েছে।
.
★যেহেতু গল্পটায় মুক্তিযুদ্ধ আছে সেহেতু লিখতে গিয়ে কি আবেগ কেমন কাজ করেছে? রাজনীতির বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে গিয়ে কি কোনো হেসিটেশন কাজ করছিল?
.
●►আবেগ তো থাকবেই। তবে আবেগ সরিয়ে র্যাশনাল হয়ে লেখার চেষ্টা করেছি। আর রাজনীতির বিষয়গুলো আসলেই একটু সাবধানে রাখার চেষ্টা করেছি যাতে বিতর্ক এড়িয়ে চলা যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় নিয়ে বই আলোচিত হোক তা চাইনি
Published on March 23, 2019 10:48


