তওবার ৫টি শর্ত

repentance2তওবা করা বলতে আমরা সোজা বাংলায় যা বুঝি তা হলো মাফ চাওয়া। আরবিতে তওবা (التوبة) শব্দটি এসেছে তা-আলিফ-বা অক্ষর সংশ্লিষ্ট ধাতু থেকে যার আভিধানিক অর্থ হলো – ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। ইসলামি পরিভাষায় তওবা বলতে বোঝায় আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা থেকে আল্লাহ্‌র আনুগত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। তওবার গুরুত্ব ইসলামে অপরিসীম। অসংখ্য কুরআনের আয়াত ও হাদীসে  এর গুরুত্ব সম্বন্ধে আমরা আঁচ করতে পারি। উদাহরণস্বরূপঃ

“এবং হে ঈমানদারেরা সকলেই তওবা করো আল্লাহ্‌র নিকট যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” [আন-নূরঃ ৩১]

“তোমাদের রবের নিকট ক্ষমাভিক্ষা করো এবং তার কাছে তওবা করো।” [হূদঃ ৩]

“হে ঈমানদারেরা আল্লাহ্‌র কাছে একটি খাঁটি তওবা করো।” [আত-তাহরীমঃ ৮]

শেষোক্ত আয়াতটিতে আমরা দেখতে পাই আল্লাহ্‌ আমাদের খাঁটি তওবা করতে বলছেন। প্রশ্ন হলো খাঁটি তওবা কীভাবে করা যেতে পারে? ‘আলেমদের মতে তওবা খাঁটি হতে হলে কয়েকটি শর্ত  পূরণ করতে হয়। এই শর্তসমূহের সংখ্যার ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আন-নওওয়ী তার বিখ্যাত রিয়াদুস-সালেহীন গ্রন্থে ৪টি শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে শায়খ সালেহ ইবন আল-‘উসায়মীন বইটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আরও একটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। আসুন তবে দেখে নেয়া যাক শর্তগুলো।

১. ইখলাস

ইখলাস বলতে উদ্দেশ্য বা নিয়তের শুদ্ধতা বোঝায়। ইসলামি পরিভাষায় কোনো সৎ কাজকে কেবল মাত্র আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি কামনার উদ্দেশ্যে করাকে ইখলাস বলা হয়। ইখলাস ব্যতীত কোনো কাজই আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তওবার কাজটি গ্রহণযোগ্য হতে হলে সেটিও করতে হবে পূর্ণ ইখলাস সহকারে। মানুষকে দেখানোর জন্য বা তাদের নৈকট্য লাভের আশায় তওবার কাজটি হয়ে থাকলে সেটিকে খাঁটি তওবা বলা যাবে না। অথবা কোনো বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বা কোনোরূপ কর্তৃপক্ষের হাত থেকে বাঁচার জন্য যে তওবা সেটিও খাঁটি তওবা হিসেবে গৃহীত হবে না। অতএব তওবার উদ্দেশ্য হতে হবে কেবল আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভ ও আখিরাতের সাফল্য অর্জন। যাতে আল্লাহ্‌ তওবাকারীর কৃত অপরাধ ক্ষমা করে দেন।

২. অনুশোচনা বোধ করা

কৃত অপরাধ বা পাপটির জন্য অন্তরে অনুশোচনা বোধ করতে হবে। তার মধ্যে মরমে মরে যাওয়ার একটি বোধ কাজ করতে হবে এবং তাকে অনুভব করতে হবে আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমাভিক্ষা করা ব্যতীত তার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই। অনুশোচনা বোধ করা এই জন্যই শর্ত যে এ থেকেই বোঝা যায় যে ব্যক্তিটি আল্লাহ্‌র কাছে সত্যি সত্যিই খাঁটি তওবা করতে প্রস্তুত।

৩. পাপকাজটি থেকে এখনই বিরত হওয়া

এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। তওবাকে তখনই খাঁটি হিসেবে ধরা হবে যদি তওবাকারী  পাপকাজটি ইতিমধ্যেই বন্ধ করে থাকে। নতুবা এটি একটি তামাশা বই তো কিছু নয়! আর যে ব্যক্তি পাপকাজটি অব্যাহত রেখেই আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করছে সে সত্যিকার অর্থে অনুশোচনা বোধ করছে না, করলে সে কাজটি অন্তত বন্ধ করত। পাপকাজ থেকে বিরত হওয়া দুই অর্থে – প্রথমত, সে একটি অন্যায় বা হারাম কাজ  করছিলো (যেমন মদ খাওয়া)  – সেক্ষেত্রে তাকে সেটি থামিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সে কোনো অবশ্য পালনীয় কাজ বা ওয়াজিব কাজ বন্ধ রেখেছিলো (যেমন নামাজ না পড়া)  – এক্ষেত্রে পাপকাজ বন্ধ করার অর্থ হলো এই ওয়াজিব কাজটি নিয়মিত শুরু করে দেয়া।

পাপকাজটির মাধ্যমে যদি কেবল আল্লাহ্‌র কোনো অধিকার বা হক নষ্ট করা হয়ে থাকে (যেমন নামাজ না পড়া বা রামাদান মাসে রোজা না রাখা) সেক্ষেত্রে কেবল আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করাই যথেষ্ট। এব্যাপারে অন্য কাউকে কিছু বলার নেই, ব্যাপারটি বান্দা এবং আল্লাহ্‌র মাঝে সীমাবদ্ধ। বরঞ্চ এক্ষেত্রে মানুষকে গুনাহ্‌র ব্যাপারে জানানোটা নিষেধ। নবীজী (সাঃ) একটি হাদীসে বলেছেনঃ “আমার উম্মতের প্রত্যেকেই ক্ষমাযোগ্য একমাত্র মুজাহিররা ব্যতীত।” [বুখারী ও মুসলিম] মুজাহিরের ব্যাখায় হাদীসটিতে বলা হয়েছেঃ “একটি গুনাহ করে সেটি মানুষকে বলে বেড়ানো যে আমি এটা এটা করেছি।”

অপরদিকে পাপকাজটি যদি হয়ে থাকে এমন যাতে অপর কোনো বান্দার হক নষ্ট হয়েছে। সেক্ষেত্রে কেবল তওবা করাই যথেষ্ট নয় বরঞ্চ  ওই বান্দার যে হকটি নষ্ট করা হয়েছে সেটি ফিরিয়ে দিতে হবে। এরকম কাজের মধ্যে রয়েছে  – টাকা আত্মসাৎ করা, গীবত করা অথবা মারধোর করা বা গালি দেয়া প্রভৃতি। নষ্ট হকটি কী প্রকারে ফিরিয়ে দিতে হবে সে ব্যাপারে কথা বেশ লম্বা। আমরা পরবর্তী ব্লগ পোস্টে সেই আলোচনাতে যাব।

৪. পরবর্তীতে সেই কাজে ফিরে না যাবার সংকল্প

তওবা খাঁটি হতে হলে পাপী ব্যক্তির মাঝে দৃঢ় সংকল্প থাকতে হবে যে সে এই কাজ আর করবে না বা এই অপরাধে আর প্রত্যাবর্তন করবে না। ধরুন কোনো ব্যক্তি একসময় ধনী ছিলো। সেই তার ধন দৌলত দিয়ে মদ খেত, জুয়া খেলত বা এমনকী ব্যাভিচার করত (আল্লাহ্‌র কাছে পরিত্রাণ চাইছি এসব থেকে।) অতঃপর সহসা সে নিঃস হয়ে গেলো। সে তার পূর্বেকার পাপাচারে ফিরে যেতে পারছে না পয়সার অভাবে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে সে আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করলো কিন্তু সম্পদ না হারালে সে ঠিকই সেসব পাপাচার অব্যাহত রাখতো। এই তওবা তার কখনই কবুল করা হবে না। তওবা গ্রহণযোগ্য তখনই হবে যখন সে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করবে সেই কাজটি ভবিষ্যতে না করার, কাজটি করার সুযোগ তার থাকুক আর নাই থাকুক।

৫. সময়মতো তওবা করা

তওবা করার নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। এই সময় পার হয়ে গেলে তওবা আর কবুল হবে না। এই নির্দিষ্ট সময়কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ক) ব্যক্তিগত সময় ও খ) সার্বজনীন সময়।

ক) ব্যক্তিগত সময়ঃ ব্যক্তিগত সময় প্রতিটি ব্যক্তির জন্য আলাদা করে প্রযোজ্য। আর এসময়টি হলো যখন মৃত্যু অবধারিত ভাবে উপস্থিত হয়। আল্লাহ বলেনঃ “তওবা তাদের জন্য নয় যারা মন্দ কাজ অব্যাহত রাখে সেই পর্যন্ত যখন মৃত্যু এসে হাজির হয় আর তারা তখন বলে আমি এখন তওবা করলাম।” [আন-নিসাঃ ১৮] অতএব মৃত্যু যখন নিশ্চিতরূপে উপস্থিত তখনকার তওবা উপায়ান্তর না দেখে করা তওবা, এটি আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

খ) সার্বজনীন সময়ঃ এই সময় যখন এসে উপনীত হবে তখন আর কারও তওবাই আর গ্রহণীয় নয়। সময়টি আমরা পাই নবীজী (সাঃ) এর একটি হাদীসেঃ “হিজরত ততদিন পর্যন্ত বন্ধ হবে না যতদিন তওবা বন্ধ না হয়, আর তওবা ততদিন পর্যন্ত বন্ধ হবে না যতদিন না সূর্য পশ্চিম দিক থেকে ঊদীত হচ্ছে।” [আবু দাঊদ, আন-নাসাঈ ও আহ্‌মাদ]  শেষ সময়ের যে বড় চিহ্নগুলো উল্লেখ করা হয়েছে কুরআন বা হাদীসে তার একটি সূর্য পশ্চিম দিক থেকে ওঠা। ওপরের হাদীসটি থেকে আমরা জানতে পারি যে এই ঘটনা যখন ঘটে যাবে তখন ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ কারও তওবাই আর গৃহীত হবার নয়।  কুরআনেও এই ঘটনার ইশারা পাওয়া যায়ঃ “যেদিন তোমার রবের কিছু চিহ্ন এসে উপনীত হবে (তখন) কোনো সত্ত্বাই তার ঈমান দিয়ে আর উপকৃত হবে না যদি সে আগেই ঈমান না এনে থাকে …” [আল-আন’আমঃ ১৫৮]

আল্লাহ্‌ আমাদের সঠিক সময়ে খাঁটি তওবা অব্যাহত রাখার তাওফীক দিন।

[শায়খ সালেহ্‌ আল-‘উসায়মীনের “শারহ্‌ রিয়াদিস-সালেহীন” অবলম্বনে]

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on April 30, 2013 10:19
No comments have been added yet.


Asif Shibgat Bhuiyan's Blog

Asif Shibgat Bhuiyan
Asif Shibgat Bhuiyan isn't a Goodreads Author (yet), but they do have a blog, so here are some recent posts imported from their feed.
Follow Asif Shibgat Bhuiyan's blog with rss.