রেইনট্রি

জানিনা। কিছুই জানিনা। একটা রেইনট্রি এর সামনে দাঁড়িয়ে এক লোক। লোকটা কে সেটা জানিনা। গায়ে কাঁদা মাখানো নোংরা কাপড়। বৃষ্টির কোনো চিহ্ন নেই, রেইনকোট এর মত কিছু একটা পড়ে আছে। লোকটা দেখতে কেমন খানিকটা পরে বলছি! একটু সংশয় আছে এ ব্যাপারে। আশ্চর্যজনকভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে, ফ্যালফ্যাল করে। না, আমার কাছে তাকে মানসিক ভারসাম্যহীনও মনে হচ্ছে না একদমই। আমাকে কি তার নিজের কোনো জানাশোনা মানুষ মনে হচ্ছে? আদতে এটা কোনো ভ্রম নয় তো!

একটু অদ্ভুত লাগলো, ব্যাটা তো চোর-বাটপার ও হতে পারে। তাকে এড়িয়ে চলতে তাই উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলাম। অসম্ভব বাতাস শুরু হয়েছে। বৃষ্টির আগে আগে মাটিতে যে অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রাণ থাকে সেটা শরীরের সমস্ত জায়গায় প্রবেশ করেছে। দুই পাশের গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে খুশিতে হাত-পা ছুঁড়ে নাচানাচি করছে।

হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। রাস্তা ছেড়ে একটা টং এর কাছে এসে দাঁড়ালাম। দু’ এক ফোঁটা বৃষ্টি আমার খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে এসে আটকে পড়েছে। বাদামী রঙের একটা সুতির শার্ট পড়েছি। বৃষ্টির সামান্য পানিতেই গায়ের চাপা রঙের জন্য শার্টের কিছু কিছু জায়গা খয়েরি দেখাচ্ছে।

কানে এয়ার বাডস গুজতেই স্ক্রিনে দেখলাম পিংক ফ্লয়েডের “উইশ ইউ ওয়ার হেয়ার” পজ করা। প্লে করে বৃষ্টির আঁচ কমেছে কিনা দেখতে বাইরে উঁকি দিলাম। উল্টোটা হয়েছে, আরো বেড়েছে। গানটাও আর ভালোলাগছে না। কেউ এখানে থাকুক এটা আমি এখন একদমই চাচ্ছি না। উল্টা চলে যেতে পারলে বাঁচি!

অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম। কেন যে উল্টা পথে আসতে গেলাম লোকটাকে দেখে কে জানে! তবে সামনেই বটতলা। এ জায়গায় নিয়মিত যাতায়াত করা হয় না। জানাশোনাও কম।অনেকটা পথ ঘুরতে হবে এ পথ দিয়ে গেলে। আর ওখানে গেলে বাস ধরতে পারবো কিন্তু তাও খানিকটা পথ। পুরো ভিজে যেতে হবে।

সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে এবার টং ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। দূর থেকে কিছু একটা আসছে। ভাবলাম সিএনজি, গাড়ি, বাস, ট্রাক যা পাই তাতেই উঠে যাবো! সন্ধ্যা হয়ে আসছে এজন্য হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। লিফট এর উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতে আসলাম, উল্টো সা করে এসে আমার সমস্ত জামাকাপড় এ কাঁদা-পানি দিয়ে একাকার করে দিয়ে গেলো! রাগ হয়ে লাভ নেই এজন্য চুপচাপ রাস্তায় হা করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পাশ দিয়ে টং থেকে বেড়িয়ে এসে কেউ ডাক দিলো,
-ভাইজান আমার একখান ছেড়া রেইনকোড আছে। ম্যালাক্ষণ ধইরা দেখতাসি খাড়ায় আছেন, যদি মনে করেন কাইল ফেরত পাডাইতে পারবেন তয় নিয়া যান।

কথাটা বলেই উনি একটা ছেড়া রেইনকোট আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি আর কোনো উপায় না দেখে রেইনকোটটা পড়ে এবার হাঁটা শুরু করলাম। না, বৃষ্টি কোনোভাবেই থামছে না। বৃষ্টির বেড়ে যাওয়া আর আমার দুর্ভোগ এখন সমানুপাতিক।

রাস্তায় আমি ছাড়া আর কাউকেই দেখছি না। আলো কমে আসছে এজন্য কিছুটা ভয় ও লাগছে। ভূত-প্রেত এর না, মানুষের! মানুষ সুযোগ পেলে সামনে পেছনে সবদিক থেকেই বিপদে ফেলে।
হঠাৎ বৃষ্টির তেজ আরো বেড়ে গেলো! বাতাসের তোড়ে চোখে ময়লা জাতীয় কিছু একটা ঢুকে পড়েছে। তাকাতে পারছি না, চোখ ডলতে ডলতে যা দেখলাম বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার ঠিক এক হাত সামনে সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। অস্বাভাবিক অভিব্যক্তি তার চোখে মুখে। আমার মস্তিষ্ক থেকে পা অব্দি শীতল কিছু একটা বয়ে গেলো!

রেইনকোট গায়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, অবিকল আমার রেইনকোটটার মত। এবং যেটা অলৌকিক কিন্তু সত্য তা হলো তাকে দেখতে হুবহু আমার মত। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একেবারে সব একই। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, সুতির কাঁদাওয়ালা শার্ট আর উপরে হলুদ রেইনকোট। আমার দিকে তাকিয়ে আবার ও হাসছে। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছি। চোখ বন্ধ করলাম। এবার আমি অন্য এক জগতে। এ জগত অন্ধকার, বিষাক্ত সালফার এ ছেয়ে যাওয়া স্যাঁতসেঁতে ল্যাব্রিন্থ। এর মাঝে বসে কেউ একজন ব্যাঙের মত ডাকছে। ঘ্যাঙরঘ্যাঙ, ঘ্যাঙরঘ্যাঙ। আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। আমাকে ডাকছে, আমার অস্তিত্বকে। কাঁদছি, শব্দ বের হচ্ছে না। আমি এখন অন্তঃসারহীন বায়বীয় পদার্থের মত উবে যাওয়ার শঙ্কায়!

এক, দুই, তিন..
চোখের পাতা খুলতেই দেখলাম আমিও হাসছি। কিন্তু লোকটার দিকে চেয়ে না। দূর থেকে দেখলাম একটা রেইনট্রি এর নিচে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে, তার দিকে। পেছনে ফিরে দেখলাম আগের মানুষটা তার জায়গায় নেই। একদম হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার মতন করে সেও মিলিয়ে গেলো! সে কি অভিন্ন কেউ? নাকি সে-ই আমি? কিংবা আমি-ই সে? আমরা একই অস্তিত্বের কেউ? নাকি দুই পেরিয়ে চার কিংবা ছয় ছাড়িয়ে অসীম?

 •  0 comments  •  flag
Share on Twitter
Published on July 29, 2023 09:05
No comments have been added yet.


Shoroli Shilon's Blog

Shoroli Shilon
Shoroli Shilon isn't a Goodreads Author (yet), but they do have a blog, so here are some recent posts imported from their feed.
Follow Shoroli Shilon's blog with rss.